নীল সায়রের অচিনপুরে – ১০

দশম পরিচ্ছেদ – হারা মহাদেশ

এবারে তাদের দৃষ্টির সামনে উন্মুক্ত ও বিশাল দৃশ্যপটের মতন পরিপূর্ণ মহিমায় যা জেগে উঠল, আগেকার বিস্ময়ের চেয়েও তা কল্পনাতীত। সে দৃশ্য সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করতে গেলে পৃথিবীর কোনও ভাষাতেই কুলোবে না।

উপর থেকে সমস্ত দৃশ্যটাকে মনে হচ্ছে ঠিক একখানা ‘রিলিফ ম্যাপে’র মতো। শিখরের সেই বিরাট ফাঁকের ভিতর দিয়ে তখন দুপুরের পরিপূর্ণ সূর্যকে দেখা যাচ্ছিল। ফাঁকের মধ্যাগত উজ্জ্বল রৌদ্র নীচের দৃশ্যের উপরে গিয়ে যেখানে বায়োস্কোপের মেশিনের মতো একটা প্রকাণ্ড আলোকমণ্ডল সৃষ্টি করেছে সেখানে সর্বপ্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশাল এক সরোবর! তাকে সাগরের একটা ছোটোখাটো সংস্করণও বলা চলে—কারণ সেই চতুষ্কোণ সরোবরের এপার থেকে ওপারের মাপ হয়তো মাইল দেড়েকের কম হবে না!

সরোবরটিকে দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, এমন অদ্ভুত স্থানে কী করে এই অসম্ভব জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে? এর মধ্যে শিল্পী মানুষের দক্ষ হাত যে আছে, সে—বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওখানে জল সরবরাহ হয় কোন উপায়ে? তার তলদেশে কি কোনও গুপ্ত উৎস আছে? না উন্মুক্ত শিখরপথ দিয়ে বৃষ্টির যে ধারা ঝরে, তাকেই ধরে রাখবার জন্যে এইখানে সরোবর খনন করা হয়েছে? এই সরোবরই বোধহয় এখানকার সমস্ত জলাভাব নিবারণ করে। কারণ তার চারিদিক থেকে চারটি বেশ চওড়া খাল আলোকমণ্ডল পার হয়ে আলো—আঁধারির ভিতর দিয়ে দূর—দূরান্তের অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক খালটি যে কত মাইল লম্বা, তা ধারণা করবার উপায় নেই!

খালের মাঝে মাঝে রয়েছে স্বর্ণবর্ণ সেতু! সোনার সাঁকো! শুনতে আজগুবি বলে মনে হয় বটে, কিন্তু এ অতি সত্য কথা। তবে রং দেখে মনে হয়, এ যেন খাদ—মেশানো সোনার মতো! হয়তো এদেশে লোহা মেলে না, কিংবা সোনার চেয়ে লোহাই এখানে বেশি দুর্লভ। হয়তো এখানে এত অতিরিক্ত পরিমাণে সোনা পাওয়া যায় যে, আমাদের দেশের লোহার দরে বিক্রি হয়। আগে আমেরিকাতেও অনেক দামি ধাতুরও কোনও দাম ছিল না। ইউরোপের লোকেরা সেই লোভে আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার আদিম বাসিন্দাদের উপরে অমানুষিক অত্যাচার করেছিল। এখনও অনেক অসভ্য জাতি হিরার চেয়ে কাচকে বেশি দামি মনে করে।

সরোবরের চারিধারে প্রথমে রয়েছে শস্যখেতের পর শস্যখেত। কিছু কিছু বনজঙ্গলও আছে, তবে বেশি নয়। সূর্যের আলো না পেলে ফসল ফলে না, উন্মুক্ত শিখরের তলায় যেখানে রোদ আনাগোনা করে সেইখানেই খেতে ফসল উৎপাদন করা হয়। দূরের যেসব জায়গায় রোদ পৌঁছায় না, সেখানে রোদের আভায় দেখা গেল গাছপালা বা শ্যামলতার চিহ্ন নেই বললেই হয়।

আলোকমণ্ডলের বাইরে, শস্যখেতের পর খুব স্পষ্টভাবে চোখে কিছু পড়ে না বটে, কিন্তু এটুকু দেখা যায় যে, বাড়ির পর বাড়ির সারি কোথায় কত দূরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গিয়েছে। কোনও বাড়ি দোতলা, কোনও বাড়ি তেতলা বা চারতলা! তাদের গড়নও অদ্ভুত—পৃথিবীর কোনও দেশেরই স্থাপত্যের সঙ্গে একটুও মেলে না।

অনেক সুদীর্ঘ ও প্রশস্ত রাজপথ দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাজপথ—প্রত্যেকটিই দূর থেকে সরলভাবে সরোবরের ধারে এসে পড়েছে। প্রত্যেক রাজপথে বিষম জনতা। দলে দলে লোক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে চিৎকার ও ছুটাছুটি করছে! স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বালিকা! প্রত্যেক পুরুষের হাতে বর্শা ও ঢাল এবং পৃষ্ঠে সংলগ্ন ধনুক! বর্শা ও ধনুকের দণ্ড চকচক করছে, সোনায় তৈরি বা স্বর্ণমণ্ডিত বলে! মেয়েদের পরনে ঘাঘরা ও জামা, কিন্তু পুরুষদের পরনে কেবল জাঙ্গিয়া, গা আদুড়! স্ত্রী ও পুরুষ—সকলেরই দেহ আশ্চর্যরূপে বলিষ্ঠ, বৃহৎ ও মাংসপেশিবহুল। তাদের সকলেরই দীর্ঘতা প্রায় ছয় ফুট! সংখ্যায় তারা হয়তো আট—দশ হাজারের কম হবে না, বরং বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা। কারণ সূর্যকরে সমুজ্জ্বল সরোবরের তীরবর্তী স্থান, তারপর আলো—আঁধারির লীলাক্ষেত্র —এসব জায়গায় আর তিলধারণের ঠাঁই নেই, তারপর রয়েছে যে অন্ধকারময় সুদূর প্রদেশ, সেখানেও ছুটোছুটি করছে অসংখ্য মশাল।

সরোবরের পূর্বে ও পশ্চিমে কেবলমাত্র দুইখানি প্রকাণ্ড অট্টালিকা রয়েছে। দুইখানি অট্টালিকার উপরেই রয়েছে দুটি বিশাল ও অপূর্ব গম্বুজ। দেখলেই বোঝা যায় একটি তার সোনার ও আর একটি রুপোর। প্রত্যেক অট্টালিকার উচ্চতা একশো ফুটের কম হবে না। খুব সম্ভব এর একটি রাজপ্রাসাদ এবং আর একটি দেবমন্দির। কারণ প্রথমোক্ত অট্টালিকার সুমুখের প্রাঙ্গণে দলবদ্ধ ও শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা এবং শেষোক্ত অট্টালিকার চারিদিকে ভিড় করে রয়েছে শত শত মুণ্ডিত—মস্তক ব্যক্তি—হয়তো তারা পুরোহিত। এবং তাদের আশেপাশে স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে দলে দলে হৃষ্টপুষ্ট গোরু। এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই রাজবাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত, সেই প্রায় দেড়মাইলব্যাপী সরোবরের উপরে স্থাপন করা হয়েছে অতি অদ্ভুত ও বিচিত্র এক সেতু। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনও মহাকাব্যেও এমন সেতুর কাহিনি বর্ণনা করা হয়নি! স্বর্ণময় সেতু এবং তার রৌপ্যময় রেলিং। সমস্ত সেতুর উপর দিয়ে রবির কিরণ যেন ঝকমকিয়ে পিছলে পড়ছে—তাকালেও চোখ ঝলসে যায়। এই একটিমাত্র সাঁকো তৈরি করতে যত সোনা ও যত রুপো লেগেছে, তার বিনিময়ে অনায়াসে মস্ত এক রাজ্য কেনা যায়।

অবাক হয়ে এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতে বিমলের মনে হল, সে যেন মাটির পৃথিবী ছেড়ে কোনও অলৌকিক স্বপ্নলোকে গিয়ে পড়েছে—সেখানে সমস্তই অভাবিত অভিনব, সেখানে কিছুই বাস্তব নয়, সেখানে প্রত্যেক ধূলিকণাও পৃথিবীর কোটিপতির কাছে লোভনীয়!

কুমার আচ্ছন্ন স্বরে বলে উঠল, ‘রূপকথায় এক দেশের কথা শুনেছি যেখানে সোনার গাছে ফোটে হিরার ফুল। আমরা কি সেই দেশেই এসে পড়েছি?’

রামহরি কিছুমাত্র বিস্মিত হবার সময় পায়নি, সে যতই অসম্ভব ব্যাপার দেখছে ততই বেশি ভীত হয়ে উঠছে। সে দুই চোখ পাকিয়ে বললে, ‘এসব হচ্ছে মায়া—ডাইনি—মায়া, ময়নামতীর ভেলকি! রূপকথা যে—দেশের কথা বলে, সেখানে বুঝি খালি সোনার গাছে হিরের ফুল ফোটে? সেখানে যেসব ভূত—পেতনি, শাঁকচুন্নি, কন্ধকাটা, রাক্ষস—খোক্ষসও থাকে, তাদের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?’

কুমার মৃদু হেসে বললে, ‘তাদের কথা ভুলে যাইনি, রামহরি! এখনই তো তাদের একজনের পাল্লায় পড়েছিলুম, তুমিই তো আমাদের বাঁচালে।’

—’আবার তাদের পাল্লায় পড়লে শিবের বাবাও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচতে চাও তো এখনও পালিয়ে চলো।’

—’তোমার এই শিবের বাবাটি কে রামহরি? নিশ্চয়ই তিনি বড়ো যে—সে ব্যক্তি নন, আর তাঁকে শিবের চেয়েও ভক্তি করা উচিত। তাঁর নাম কী? যদি তাঁর নাম বলতে পারো, তাহলে এখনই এই সোনার দেশ ছেড়ে আমরা তোমার সঙ্গে লোহার জাহাজে চড়ে তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হব।’

—’এ ঠাট্টার কথা নয় গো বাপু। শাস্তরে বলেছে, সুমুদ্দরের তলায় আছে রাক্ষসদের সুবর্ণ—লঙ্কা। আমরা নিশ্চয় সেইখানে এসে পড়েছি। শ্রীরামচন্দর না হয় রাবণ আর কুম্ভকর্ণকেই বধ করেছেন। ধরলুম রাবণের বেটা মেঘনাদও পটল তুলেছে। কিন্তু কুম্ভকর্ণের বেটাকে তো কেউ আর বধ করতে পারেনি। বাপের মতন হয়তো তার ছ—মাস ধরে ঘুমনোর বদ—অভ্যাস নেই, সে যদি এখন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ‘রে রে’ শব্দে তেড়ে আসে—তাহলে আর কি আমাদের রক্ষে থাকবে?’

কমল বললে, ‘দেখুন বিমলবাবু। এখানে মানুষ আছে, চতুষ্পদ জীবও আছে, ওই সরোবরের জলে হয়তো জলচরও আছে, কিন্তু কোথাও একটা পাখির ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।’

বিমল বললে, ‘ঠিক বলেছ কমল। আমি এতক্ষণ ওটা লক্ষ করিনি। এটা পুরোদস্তুর পাতাল—রাজ্যই বটে। কিন্তু আমি কি ভাবছিলুম জানো? সকলেরই মতে, এই দ্বীপটা এতদিন সমুদ্রের তলায় ডুবে ছিল, আজ হঠাৎ ভেসে উঠেছে, তাই নাবিকদের কোনও ‘চার্টে’ই এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। দ্বীপের উপরকার পাথরের মূর্তিগুলোয় আর ‘ব্রোঞ্জে’র দরজার গায়ে সামুদ্রিক শেওলা দেখে সেই কথাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি, এই দ্বীপ—পাহাড়ের গর্ভটা হচ্ছে বিরাট একটা গুহার মতো,—এমনকী এর সবচেয়ে উঁচু—শিখরটাও ফাঁপা, তার ভিতর দিয়ে অবাধে আলো আর বাতাস আসে। দ্বীপটা যখন সমুদ্রের তলায় ছিল, তখন ব্রোঞ্জের দরজা ভেদ করে সমুদ্রের জল না—হয় ভিতরে ঢুকতে পারত না। কিন্তু শিখরের অত—বড়ো ফাঁকটা তো কোনওরকমেই বন্ধ করা সম্ভব নয়, ওখানে সমুদ্রকে বাধা দেওয়া হত কোন উপায়ে?’

খানিকক্ষণ উপরের ফাঁকটার দিকে তাকিয়ে থেকে কুমার বললে, ‘তোমার প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হচ্ছে—সম্ভবত কেবল পাহাড়ের শিখরের অংশটুকু বরাবরই জলের উপরে জেগে থাকত। এটা নিয়মিত জাহাজ চলাচলের পথ নয় বলে কোনও ‘চার্টে’ই সামান্য একটা জলমগ্ন পাহাড়ের শিখরের উল্লেখ নেই।’

বিমল বললে, ‘বোধহয় তোমার অনুমানই সত্য।’

বিনয়বাবু এতক্ষণ একটিও কথা উচ্চারণ করেননি। তিনি স্তব্ধভাবে কখনও নীচের সেই অতুলনীয় দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দেখছেন এবং কখনও বা মাথা হেঁট করে অর্ধনিমীলিত নেত্রে কী যেন চিন্তা করছেন,—ওই দৃশ্য ও নিজের চিন্তা ছাড়া পৃথিবীর আর সব কথাই তিনি যেন এখন সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছেন।

হঠাৎ কুমার তাঁকে ডেকে বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনি একটাও কথা বলছেন না কেন?’

বিনয়বাবু চমকে বলে উঠলেন, ‘অ্যাঁ, কী বলছ? হ্যাঁ, এ—বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না।’

কুমার বিস্মিত স্বরে বললে, ‘কোন বিষয়ে কী সন্দেহ থাকতে পারে না?’

বিনয়বাবু বিপুল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঠিক যেন নৃত্য করতে করতেই বললেন, ‘লস্ট আটলান্টিস! লস্ট আটলান্টিস!’

বিমল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললে, ‘রামহরি, বিনয়বাবুকে ধরো! ওঁর কি ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল?’

বিনয়বাবু আরও চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওহো, লস্ট আটলান্টিস! লস্ট আটলান্টিস! ফাউন্ড অ্যাটলাস্ট!’

কুমার সভয়ে বললে, ‘কী সর্বনাশ! বিনয়বাবু কি শেষটা সত্যিই পাগল হয়ে গেলেন?’

বিমল তাড়াতাড়ি বিনয়বাবুর দুই হাত চেপে ধরে বললে, ‘লস্ট আটলান্টিস কী বিনয়বাবু?’

—’লস্ট আটলান্টিস! বিমল, তোমাদের যদি সামান্য কিছু ইতিহাসও পড়া থাকত, আমাকে তাহলে পাগল মনে করতে পারতে না! জানো নির্বোধ ছোকরার দল, আমরা আজ এক অমূল্য আবিষ্কারের পরে আবার আর এক অসম্ভব আবিষ্কার করেছি? ক্রো—ম্যাগনন মানুষ আর লস্ট আটলান্টিস!’

বিমল বললে, ‘কী মুশকিল, লস্ট আটলান্টিস পদার্থটা কী, আগে সেইটেই বলুন না!’

‘—লস্ট আটলান্টিস মানে ‘আটলান্টিস’ নামে একটা হারিয়ে—যাওয়া মহাদেশ! যখন সভ্য ভারতবর্ষ ছিল না, সভ্য মিশর ছিল না, বাবিলন ছিল না, গ্রিস—রোম ছিল না, আটলান্টিস উঠেছিল তখন সভ্যতার উচ্চতম শিখরে! আজ সেই আটলান্টিস হারিয়ে গিয়েছে, আর পণ্ডিতেরা তাকে খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছেন! সেই মহাদেশেরই নাম থেকে নাম পেয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। ওহো কী আনন্দ! আমরা আজ সেই কতকালের হারানো মহাদেশে এসে উপস্থিত হয়েছি—আমরা তাকে আবার খুঁজে পেয়েছি! আমরা যখন এখান থেকে স্বদেশে ফিরে যাব, তখন সারা পৃথিবীর পণ্ডিতেরা আমাদের মাথায় তুলে নৃত্য করবেন!’

বিমল বললে, ‘সেই আনন্দে আপনি কি এখন থেকেই তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন? কিন্তু বিনয়বাবু, এই দ্বীপের উপরটা মাইল পাঁচ—ছয়ের বেশি নয়, আর ভিতরটা না—হয় ধরলুম আরও—কিছু বড়ো! একেই কি আপনি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকার মতন একটা মহাদেশ বলতে চান?’

বিনয়বাবু ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘বিমল, তুমি হচ্ছ একটা মস্ত—বড়ো আস্ত হস্তীমূর্খ! কেবল গোঁয়ার্তুমি করতেই শিখেছ, তোমাকে বোঝানো আমার সাধ্যের বাইরে।’

কুমার মুখ বাড়িয়ে নীচের দিকে দেখতে দেখতে উদ্বিগ্ন স্বরে বললে, ‘বিমল প্রস্তুত হও! লস্ট আটলান্টিক চুলোয় যাক। ওদের সৈন্যরা আমাদের আক্রমণ করবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে।’

সেই পাথরের বারান্দার ধারে গিয়ে বিমল দেখল, সংকীর্ণ সিঁড়ির ধাপগুলো পাহাড়ের গা ঘেঁষে প্রায় দেড়শো ফুট নীচে নেমে গিয়েছে—সেই ধাপের সার অবলম্বন করে নীচে নামবার কথা মনে হলেও মাথা ঘুরে যায়। কিন্তু সেই সিঁড়ি বয়েই একে একে লোকের পর লোক উপরে উঠে আসছে এবং সোপান—শ্রেণির তলাতেও হাজার লোক তাদের পিছনে পিছনে আসবার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। শত্রুদের সম্মিলিত কণ্ঠের ক্রুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায়!

বিমল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বেশ শান্তভাবেই বললে, ‘কুমার, আমরা এখানে নির্ভয়েই থাকতে পারি। ওরা নিশ্চয়ই বন্দুককে চেনে না। ওরা জানে না, সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আমরা যদি গোটা—চারেক বন্দুক ছুড়তে থাকি, তাহলে ওদের পাঁচ লক্ষ লোককেও অনায়াসে বাধা দিতে পারি।’

পাতাল—রাজ্যের সৈনিকরা তখন সিঁড়ির দুই—তৃতীয়াংশ পার হয়ে এসেছে—তাদের কেউ করছে সোনার বর্শা আস্ফালন, কেউ ছুড়ছে ধনুক থেকে তির।

বিমল বললে, ‘কিন্তু ওরা যদি কোনও গতিকে একবার উপরে উঠতে পারে, তাহলে আমাদের আর বাঁচোয়া নেই। তাহলে কালকেই ওদের দেবতার পায়ের তলায় আমাদের কাটা—মুন্ডুগুলো ভাঁটার মতো গড়াগাড়ি যাবে। সুতরাং ওদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা না দিয়ে উপায় নেই।…সেপাই।’

সেপাইরা বিমলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

বিনয়বাবু ব্যস্তভাবে দৌড়ে গিয়ে বললেন, ‘বিমল, বিমল, তুমি ওদের উপরে গুলি ছুড়বে? বলো কী! ওরা যে অদ্ভুত এক প্রাচীন জাতির দুর্লভ নমুনা!’

বিমল রুক্ষ স্বরে বললে, ‘রাখুন মশাই আপনার প্রাচীন জাতির দুর্লভ নমুনা! আপনি কি বলতে চান, ওরা নির্বিবাদে এখানে এসে আমাদের এই আধুনিক মানবজাতির নমুনাগুলিকে দুনিয়া থেকে লুপ্ত করে দিক? মাপ করবেন, এতটা উদার হতে পারব না। আটজন নাবিককে ওরা কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, আপনি কি তা শোনেননি—না—তাদের ছিন্নমুণ্ড দেখেননি?’

বিনয়বাবু ম্লানমুখে নিরুত্তর হলেন।

বিমল বললে, ‘সেপাই! তোমরা পাঁচজন সিঁড়ির কাছে দাঁড়াও। পাঁচজনেই একবার করে বন্দুক ছোড়ো। তারপরেও যদি ওরা উপরে উঠতে চায়, তাহলে আবার পাঁচজন বন্দুক ছুড়বে!’

সেপাইরা যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়াল।

আগেই বলেছি, সেই সিঁড়ির ধাপে পাশাপাশি দুজন উঠতে বা নামতে কষ্ট হয়। শত্রুরাও একসারে একজন করে উপরে উঠে আসছিল। তখন প্রায় একশো—জনেরও বেশি লোক সেই অতি—সংকীর্ণ সুদীর্ঘ সোপানকে অবলম্বন করেছে! বিমলদের ভয় দেখাবার জন্যে তারা কেবল হই—হই শব্দ নয়—অনেক রকম ভীষণ মুখভঙ্গি করতেও ছাড়ছে না।

বিমল দুঃখিতভাবে মৃদু হেসে বললে, ‘বোকারা জানে না, মূর্তিমান যমের দলকে ওরা মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। আটজন নিরস্ত্র নাবিককে বধ করে ওদের বুক ফুলে গেছে।…নাঃ, আর উঠতে দেওয়া নয়। সেপাই, ‘ফায়ার’!’

একসঙ্গে পাঁচটা বন্দুক ভীষণ শব্দে ধমক দিয়ে উঠল।

পরমুহূর্তেই যা ঘটল, তা ভয়াবহ! সব—উপরের তিনজন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে নীচের লোকগুলোর উপরে ছিটকে পড়ল এবং তার পরেই দেখা গেল এক অসহনীয় ভীষণ দৃশ্য। হাজার হাজার কণ্ঠের সুদীর্ঘ ভীত আর্তনাদের মধ্যে, সেই অতি—উচ্চ অতি—সংকীর্ণ সোপানশ্রেণি থেকে প্রায় পঁচিশ—ত্রিশ—জন লোক উপরের পড়ন্ত দেহগুলোর ধাক্কা সামলাতে না পেরে সিঁড়ির বাইরে গিয়ে ঠিকরে পড়ল এবং তারা যখন অনেক নীচের মাটিতে গিয়ে পৌঁছোল, তখন তাদের দেহগুলো পরিণত হল ভয়াবহ মাংসপিণ্ডে। উপরের লোকদের অবস্থা দেখে নীচের সিঁড়ির লোকেরা কোনওরকমে দেওয়াল ধরে বা বেগে নেমে পড়ে এ—যাত্রা আত্মরক্ষা করলে।

বিনয়বাবু মাটিতে বসে পড়ে দুই কানে হাত—চাপা দিয়ে কাতর সুরে বললেন, ‘আর সইতে পারি না—আর আমি সইতে পারি না! বিমল, থামো, থামো!’

বিমল অটলভাবে বললে, ‘এখনও নীচের ভিড় কমেনি, এখনও অনেকে আস্ফালন করছে, এখনও সুবিধে পেলে ওরা উপরে উঠবার চেষ্টা করতে পারে। ওদের চোখ আর একটু ফুটিয়ে দেওয়া যাক, নরবলি দেওয়ার মজাটা ওরা টের পাক।…শোনো সেপাইরা, তোমরা সবাই মিলে এবার নীচের ওই ভিড়ের উপরে একবার গুলিবৃষ্টি করো তো।’

গর্জে উঠল এবার একসঙ্গে চব্বিশটা বন্দুক সেই প্রকাণ্ড গুহাজগৎকে ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত করে। নিম্নে সমবেত ভিড়ের ভিতরে পাঁচ—ছয়জন লোক তৎক্ষণাৎ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ল এবং হাজার হাজার কণ্ঠের ভয়—বিস্ময়পূর্ণ তীব্র ও উচ্চ আর্তস্বরে চতুর্দিক পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। মিনিট—পাঁচেক পরে দেখা গেল সেই বিপুল জনতা যেন কোন মায়াবীর মন্ত্রগুণে কোথায় অদৃশ্য!

বিমল বললে, ‘ব্যাস। বন্দুক যে কী চিজ, এইবারে ওরা বুঝে নিয়েছে।—সিঁড়ির উপরে বোধহয় কেউ আর পা ফেলতে ভরসা করবে না।’

বিনয়বাবু যন্ত্রণা—ভরা স্বরে বললেন, ‘এ তো যুদ্ধ নয়, এ যে হত্যা! আমরা সবাই হত্যাকারী।’

বিমল বললে, ‘কী করব বিনয়বাবু, আত্মরক্ষা জীবের ধর্ম!’

আরক্ত মুখে তীব্র কণ্ঠে বিনয়বাবু বললেন, ‘হুঁ, আত্মরক্ষাই বটে! চমৎকার আত্মরক্ষা! আমরা হচ্ছি লোভী দস্যু। ওরা কি আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে? আমরাই তো পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছি ওদের সোনার দেশ লুণ্ঠন করতে—একটা প্রাচীন জাতিকে ধ্বংস করতে। ছি, ছি, ঘৃণায় অনুতাপে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হচ্ছে! ধিক আমাদের!’

তখন বিমলের খেয়াল হল—সত্যই তো, পরের দেশ আক্রমণ করেছে এসে তারা তো নিজেরাই। সুতরাং তাদের বিদেশি শত্রু বলে বাধা দেবার বা বধ করবার অধিকার যে এই পাতালবাসীদের আছে, সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই নেই! তখন সে লজ্জিতভাবে বললে, ‘বিনয়বাবু, আমি মাপ চাইছি! লস্ট আটলান্টিস সম্বন্ধে আপনি কী জানেন বলুন। যদি বুঝি ওরা সত্যই কোনও প্রাচীন সভ্য জাতির শেষ বংশধর, তাহলে ওদের বিরুদ্ধে আমি আর একটিমাত্র আঙুলও তুলব না, এখনই এখান থেকে বেরিয়ে সোজা জাহাজে গিয়ে উঠব।’

—’প্রতিজ্ঞা করছ?’

—’প্রতিজ্ঞা করছি।’

তখন শিখরের মুখ থেকে সূর্যালোক ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েছে এবং সেই সঙ্গে নীচে থেকে অদৃশ্য হয়েছে পাতাল—রাজ্যের সমস্ত ঐশ্বর্যের চিত্রমালা। বাইরে শূন্যে আলোকোজ্জ্বল নীলিমাকে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু গুহার ভিতরে ঘনিয়ে এসেছে নিশীথের প্রথম অন্ধকার। সে—অন্ধকারের ভিতরে পাতালপুরীর কোনও ভীত হস্ত আজ একটিমাত্র প্রদীপও জ্বাললে না এবং সর্বত্রই থমথম করতে লাগল একটা অস্বাভাবিক বুকচাপা নিস্তব্ধতা।

কুমার বললে, ‘সেপাইরা। আজকের রাতটা আমাদের এইখানেই কাটাতে হবে। লণ্ঠনগুলো সব জ্বেলে রাখো, আর সিঁড়ির উপর—ধাপে পালা করে চারজন লোক বসে সকাল পর্যন্ত পাহারা দাও। খুব হুঁশিয়ার থেকো, নইলে সবাইকে মরতে হবে।’

বিমল বিনয়বাবুর সামনে বসে পড়ে বললে, ‘এখন বলুন আপনার লস্ট আটলান্টিসের গল্প।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘শোনো! কিন্তু জেনো, এটা গল্প নয়, একেবারে নিছক ইতিহাস। বড়ো বড়ো পৃথিবী—বিখ্যাত পণ্ডিত যা আবিষ্কার বা প্রমাণ করেছেন, আমি সেই কথাই তোমাদের কাছে বলতে চাই।’

একাদশ পরিচ্ছেদ – লস্ট আটলান্টিসের ইতিহাস

ধরো, এগারো বা বারো বা তেরো হাজার বছর আগেকার কথা। যা বলব তা এত পুরানো কালের কথা যে, দু—এক হাজার বছরের এদিক—ওদিক হলেও বড়ো—কিছু এসে যায় না। ওই সময়েই আটলান্টিস সাম্রাজ্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু তারও কত কাল আগে যে এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সে—কথা আর কেউ বলতে পারবে না।

যেসব পুরানো জাতি সভ্য ছিল বলে আজ পুরাণে বা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, সেই মিশরি, ভারতীয়, চৈনিক, বাবিলনীয়, পারসি ও গ্রিক জাতির নাম তখন কেউ জানত না, অনেক জাতির জন্ম পর্যন্ত হয়নি!

ক্রো—ম্যাগনন প্রভৃতি সত্যিকার আদি মানুষজাতেরা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছে, তখন পৃথিবীর চেহারা ছিল একেবারে অন্যরকম। আধুনিক খুব ভালো ছাত্ররাও ত্রিশ—পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগেকার পৃথিবীর ম্যাপ দেখলে কেলাসের ‘লাস্ট—বয়ের’ মতন বোকা বনে যাবে।

তখন রেলগাড়ি থাকলে একবারও জল না ছুঁয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডাঙা দিয়ে আনাগোনা করা যেতে পারত। এমনকী মাঝে মাঝে দু—একটা প্রণালী পার হবার জন্যে দু—একবার মাত্র ছোটো ছোটো নৌকায় চড়ে ভারতবাসীরা ব্রহ্মদেশের ভিতর দিয়ে পদব্রজেই অনায়াসে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে হাজির হতে পারত। তখন সিংহল ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি এবং আমরা—অর্থাৎ বাঙালিরা আজ যেখানে বাস করছি সেই বাংলাদেশের উপর দিয়ে বইত অগাধ সমুদ্রের জলতরঙ্গ। বাঙালি জাতেরও জন্ম হয়নি!

ইউরোপে তখন ভূমধ্যসাগর ছিল না, তার বদলে ছিল দুটি ভূমধ্যবর্তী হ্রদ। ইতালি ছিল আফ্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত। অর্থাৎ আফ্রিকা ও ইউরোপ ছিল পরস্পরের অঙ্গ—একই মহাদেশ। এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ আর ফ্রান্স ছিল অভিন্ন।

আটলান্টিস সাম্রাজ্যের অবস্থান ছিল আফ্রিকা ও আমেরিকার মাঝখানে। এক একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ! গ্রিক পণ্ডিত প্লেটোর মতে, এশিয়া, এশিয়া—মাইনর ও লিবিয়াকে এক করলে যত বড়ো হয় এই দ্বীপটি আকারে তত বড়োই ছিল। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কিছু ছোটো।

আটলান্টিসের উল্লেখ আধুনিক কোনও ইতিহাসেই পাওয়া যায় না। তার কারণ, যেখান থেকে আধুনিক ইতিহাসের আসল মালমশলা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেই মিশর ও গ্রিস যখন সভ্য তখনও আটলান্টিসের অস্তিত্ব ছিল না। মিশর ও গ্রিস সভ্য হবার কয়েক হাজার বছর আগেই পৃথিবী থেকে আটলান্টিস হয়েছে অদৃশ্য। কিন্তু তখন আটলান্টিসের বহু বাসিন্দা স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজেই লোকের মুখে মুখে ও জনপ্রবাদে আটালান্টিসের অনেক কাহিনিই তখন সারা—পৃথিবীতে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। আজ আমরা তার কথা প্রায় ভুলে গিয়েছি বটে, কিন্তু প্রাচীন মিশর ও গ্রিসের লোকেরা এই লুপ্ত আটলান্টিসের অনেক খবরই জানত।

গ্রিক পণ্ডিত প্লেটোর বিখ্যাত বর্ণনা থেকে জানা যায়, আটলান্টিস দ্বীপ ছিল অসংখ্য লোকের বাসভূমি। তার নগরে ছিল শত শত অট্টালিকা, বিরাট স্নানাগার, বৃহৎ মন্দির, অপূর্ব উদ্যান, আশ্চর্য সব খাল ও বিচিত্র সব সেতু প্রভৃতি। একটি খাল ছিল তিনশো ফুট চওড়া, একশো ফুট গভীর ও ষাট মাইল লম্বা! তার তীরে তীরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন্দর এবং তার ভিতর দিয়ে আনাগোনা করত বড়ো বড়ো জাহাজ। একশো ফুট চওড়া সাঁকোরও অভাব ছিল না!

মন্দির ছিল শত শত ফুট উঁচু এবং সেই অনুপাতেই চওড়া। মন্দিরের চুড়ো ছিল সুবর্ণময় এবং বাহিরের দেয়ালগুলো রৌপ্যময়। মন্দিরের ভিতরের অংশও সোনা, রূপা ও হাতির দাঁতে মোড়া ছিল। তাদের মধ্যে ছিল খাঁটি সোনায় গড়া মূর্তির ছড়াছড়ি!

শহরের পথে পথে দেখা যেত গরম জলের উৎস এবং ঠান্ডা জলের ফোয়ারা। রাজপরিবার, সাধারণ পুরুষ, নারী এমনকী অশ্ব প্রভৃতি পালিত পশুদেরও জন্যে ছিল আলাদা আলাদা স্নানাগার! নানা জায়গায় বড়ো বড়ো ব্যায়ামশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আটলান্টিসের মধ্যে পবিত্র জীবরূপে গণ্য হত ষণ্ডরা। এবং আটলান্টিসকে রক্ষা করবার জন্যে নিয়মিত মাহিনা দিয়ে পালন করা হত ষাট হাজার সৈন্যকে।

প্লেটো বলেন, কিন্তু আটলান্টিকের অধিবাসীরা নাকি ঐশ্বর্যের ও শক্তির গর্বে অত্যাচারী, অবিচারী ও মহাপাপী হয়ে উঠেছিল—শেষটা আর ধর্মের শাসন মানত না। সেইজন্যে দেবতারাও তাদের উপরে বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। অবশেষে দেবতার ক্রোধে আচম্বিতে সমুদ্র সংহারমূর্তি ধরে এক দিন ও এক রাত্রির মধ্যেই সমগ্র আটালন্টিসকে গ্রাস করে ফেললে।

এটা হচ্ছে রোম নগর প্রতিষ্ঠিত হবার নয় হাজার বছর আগেকার ঘটনা।

প্লেটোর বর্ণনা যুগে যুগে বহু লোককে কৌতূহলী করে তুলেছিল বটে, কিন্তু আগে সকলেই ভাবতেন, তাঁর আটলান্টিস হচ্ছে কাল্পনিক দেশ।

মিশর, বাবিলন, গ্রিস ও রোম প্রভৃতি দেশের পুরানো সভ্যতা আজ অতীতের কাহিনি হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু তাদের অস্তিত্বের অগুনতি চিহ্ন এখনও বিদ্যমান আছে। আটলান্টিসের অস্তিত্বের চিহ্ন কোথায়? এই হচ্ছে অবিশ্বাসীদের যুক্তি। কিন্তু ওঁরা ভুলেও একবার ভাবেন না যে, ওসব দেশ আটলান্টিসের মতো মহাসাগরের কবলগত হয়নি। কত যুগযুগান্তের আগে সে সভ্যতা অতল জলে ডুবে পড়েছে, আজ তার চিহ্ন পাওয়া যাবে কেমন করে?

কিন্তু এখনকার অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ, প্লেটোর আটলান্টিসকে আর অলস কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন না। তাঁরা বহু পরিশ্রম ও অনুসন্ধানের ফলে আটলান্টিসের অস্তিত্বের অসংখ্য প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন, এখানে সে—সমস্ত কথা বলবার সময় হবে না। এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। যদি তোমাদের আগ্রহ থাকে, তাহলে অন্তত Lewis Spence সাহেবের The History of Atlantis নামে বইখানা পড়ে দেখো।

একালের পণ্ডিতদের মত, উত্তর—পশ্চিম আফ্রিকার কাছে আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে কেনারি, অর্জোস ও মেডিরা প্রভৃতি যেসব দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়, ওগুলি হচ্ছে জলমগ্ন আটলান্টিসেরই সর্বোচ্চ অংশবিশেষ।

ফ্রান্সের Pierre Terminer (Director of Science of the Geographical Chart of France) সাহেব বলেন, পূর্বোক্ত দ্বীপগুলির কাছে আটলান্টিক মহাসাগর এখনও অশান্ত হয়ে আছে। ওখানে যে—কোনও সময়ে পৃথিবীর আর সব দেশের আগোচরে ভীষণ জলপ্লাবন বা খণ্ডপ্রলয় হবার সম্ভাবনা এখনও আছে। সুতরাং আটলান্টিস ধ্বংস হওয়ার সম্বন্ধে প্লেটো যা যা বলেছেন তা অসম্ভব মনে করা চলে না।

তোমাদের কাছে আমি আগেই বলেছি যে ক্রো—ম্যাগনন মানুষরা উত্তর—পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়েছিল, আর্যদের বহু সহস্র বৎসর আগে। এ—বিষয়ে সব পণ্ডিতই একমত।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বারংবার খণ্ডপ্রলয় বা সামুদ্রিক বন্যায় আটলান্টিস যখন ক্রমে ক্রমে পাতাল—প্রবেশ করছিল, তখন সেখানকার অসংখ্য বাসিন্দা আত্মরক্ষা করবার জন্যে উত্তর—পশ্চিম আফ্রিকায় ও আমেরিকায় পালিয়ে যায়। ক্রো—ম্যাগনন মানুষরা উত্তর—পশ্চিম আফ্রিকার মতন জায়গায় কেমন করে এসে আবির্ভূত হয়েছিল, এ—সম্বন্ধে সদুত্তর পাওয়া যায় না। ওদের উৎপত্তির ইতিহাস আগে ছিল রহস্যময়। কিন্তু এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, তারা আটলান্টিসেরই পলাতক সন্তান। কারণ আটলান্টিস দ্বীপ ছিল উত্তর—পশ্চিম আফ্রিকারই প্রতিবেশীর মতো।

Donelly Brasseur he Bourbourg ও Augustas La plongeon সাহেবরা বলেন—’অতীত যুগে আটলান্টিস তার সন্তানগণকে সারা পৃথিবীর সর্বত্রই পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাদের অনেকেই আজ আমেরিকায় ‘রেড ইন্ডিয়ান’ নামে বিচরণ করছে। তারা প্রাচীন মিশরে গিয়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে। তারা উত্তর এশিয়ায় গিয়ে তুরানি ও মঙ্গোলিয়ান নামে পরিচিত হয়েছে।’ (Some Notes on the Lost Atlantis : Papyras : March, 1921.)

বিমল, কুমার, কমল! তোমরা সকলেই দেখছ, আজ আমরা যেখানে এসে হাজির হয়েছি, প্লেটো আর অন্যান্য পণ্ডিতদের বর্ণনার সঙ্গে এর কতটা মিল আছে? অদ্ভুত খাল, সেতু, প্রাসাদ, মন্দির, সোনা—রূপার ছড়াছড়ি! এমনকী পবিত্র ষণ্ড ও ক্রো—ম্যাগনন মানুষদেরও আমরা স্বচক্ষে দেখেছি! হারা আটলান্টিস যে এইখানকার সমুদ্রের ভিতরেই লুকিয়ে আছে, পণ্ডিতরা আগে থাকতেই তা আমাদের বলে রেখেছেন। এখনও কি তোমাদের মনে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে?

সমগ্র আটলান্টিসের সামান্য অংশই আমরা দেখতে পেয়েছি। আসল দেশটা যখন ডুবে যায়, তখন এই আশ্চর্য আর অসাধারণ গুহার ভিতর আশ্রয় নিয়ে কয়েক শত লোক প্রাণরক্ষা করেছিল। তাদের বংশধররা আজ হাজার হাজার বৎসর ধরে এই ক্ষুদ্র পাতাল—রাজ্যের মধ্যে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছে, আর প্রাচীন অবিকৃত সভ্যতার প্রদীপ—শিখাটি এতদিন ধরে কোনও রকমে জ্বালিয়ে রেখেছে। দ্বীপের উপরে যেসব বিভীষণ, অতিকায় প্রস্তর—মূর্তি দেখেছ, তাদের বয়স হয়তো পনেরো—বিশ হাজার বৎসর। তারা সেই স্মরণাতীত কাল আগেকার অত্যাচারী নিষ্ঠুর আর এখনকার তুলনায় অর্ধসভ্য মানুষদের আকৃতি—প্রকৃতি ফুটিয়ে তুলেছে—তাদের মৌখিক ভাবের সঙ্গে তাই আধুনিক মানুষের মার্জিত মুখের ছবি মেলে না।

আটলান্টিসের যেসব সন্তান পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রস্থান করেছে, বিভিন্ন যুগের মানুষ আর বিভিন্ন সভ্যতার সংশ্রবে এসে তারা এখন নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে তাই আজ তার তাদের চেনা যায় না। কিন্তু এই পাতাল—রাজ্যের বাসিন্দারা সেই প্রাচীন সভ্যতারই খাঁটি নিদর্শন অবিকলভাবে রক্ষা করতে পেরেছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই বললেও চলে। কেবল মাঝে মাঝে—হয়তো যুগ—যুগান্তর পরে—সমুদ্রের জল সরে গেলে তারা ব্রোঞ্জের দরজা খুলে দ্বীপের উপরে এসে বাইরের জগৎকে বহুকাল পরে ফিরে পাওয়া বন্ধুর মতো এক—একবার চোখ মেলে প্রাণ ভরে দেখে নেয়। এমনভাবে কোনও একটি জাতি যে হাজার হাজার বৎসর ধরে বাঁচতে পারে, সেটা ধারণাই করা যায় না। কিন্তু এই ধারণাতীত ব্যাপারটাও সম্ভবপর হয়েছে। চোখের সামনে যাকে দেখছি তাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই!

আমরা ভাগ্যবান, তাই এমন বিচিত্র দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে পেলুম—পাতালবাসী অতীতকে পেলুম জীবন্ত রূপে বর্তমানের কোলে! এখানকার মানুষদের উপর আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত—কারণ এদেরই সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত—সভ্যতার অগ্রদূত। এরা আমাদের কোনও অপকার করেনি। তবে এমন—একটা দুর্লভ প্রাচীন জাতির উপর আমরাই বা অত্যাচার করব কেন?

জানি, আমাদের হাতে যে অস্ত্র আছে তার সাহায্যে আমরা এখনই এই বেচারাদের সবংশে ধ্বংস করতে পারি—এখানকার ধনদৌলত লুটে নিয়ে গিয়ে পৃথিবীর বড়ো বড়ো রাজা—মহারাজারও চোখে তাক লাগিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাহলে আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায় থাকবে? আরশিতে আমরা নিজেদের কাছেই কি আর নিজেদের কালো মুখ দেখাতে পারব?

বিমল! আমাদের উচিত, কাল সকালেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়া। দুঃখের বিষয় কেবল এই যে, আমাদের এমন অসাধারণ আবিষ্কারের খবরও পৃথিবীতে প্রচার করতে পারব না। কারণ তাহলে এই অসহায় সোনার দেশ লুণ্ঠন করবার লোভে পৃথিবীর চারিদিক থেকে দলে দলে দস্যু ছুটে আসবে।

বিনয়বাবু চুপ করবার পর অনেকক্ষণ ধরে কেউ কোনও কথা কইলে না।

তখন শিখরের ফাঁকে ফুটে উঠেছে রাতের কালো রং মাখানো আকাশের গায়ে তারকাদের আলোর আলপনা। শিখরের মুখের কাছে অন্ধকার উজ্জ্বল হয়ে আছে। কিন্তু ভিতরের চারিদিকেই অন্ধকার যেন দানা পাকিয়ে সুকঠিন হয়ে উঠেছে!

কমল একবার উঠে দাঁড়িয়ে দেখলে, নিস্তব্ধ পাতাল—পুরীর এদিকটাও অন্ধকারের ঘেরাটোপে ঢাকা, কেবল দূরে—বহুদূরে মাঝে মাঝে নিবিড় তিমির—পট ফুটো করে এক—একটা মিটমিটে আলোকশিখা দেখা দিচ্ছে। জীবনের কলঝঙ্কার এখানে যেন একান্ত ভয়ে বোবা হয়ে গেছে। কেউ কোথাও ক্ষীণ স্বরে কাঁদবার প্রয়াসও করছে না!

বিমল বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথাই ঠিক! এই প্রাচীন জাতির উপরে অত্যাচার করা মহাপাপ, আমরা যে ধারণাতীত অপূর্ব দৃশ্য দেখবার আর নূতন জ্ঞানলাভ করবার সৌভাগ্য পেলুম, সেইটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার। আমরা দস্যু নই—কাল সকালেই এখান থেকে বিদায় নেব।’

বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমরা ইচ্ছে হচ্ছে, এদের সঙ্গে আলাপ করে এখানকার ভিতরের যা—কিছু জানবার, জেনে নি। কিন্তু এ ইচ্ছা বোধহয় আর সফল হওয়া অসম্ভব, এরা আর আমাদের বন্ধুভাবে গ্রহণ করতে পারবে না।’

পরদিন প্রভাতে উঠে বিমল দেখলে, তখনও পাতালপুরীর রাজপথে জনমানবের দেখা নেই। সরোবরের দুইধারে সেই সোনার ও রুপোর গম্বুজওয়ালা দুখানা অট্টালিকার প্রত্যেক জানলা—দরজা বন্ধ, কোথাও একজন সৈনিক পর্যন্ত বাইরে এসে দাঁড়ায়নি।

যে অট্টালিকাকে তারা রাজবাড়ি বলে সন্দেহ করছে, তার চারিপাশে প্রায় চল্লিশ—ফুট উঁচু দৃঢ় পাথরের প্রাচীর রয়েছে। প্রাচীরটা এমন চওড়া যে তার উপর দিয়ে পাশাপাশি দুইজন লোক অনায়াসেই হেঁটে চলে যেতে পারে। প্রাচীরের মাঝে মাঝে এক—একখানা ঘর—বোধহয় সৈনিকদের থাকবার জন্যে। দুটো প্রকাণ্ড সিংহদ্বার, তার ভিতর দিয়ে হাওদাসুদ্ধ হাতিও ঢুকতে পারে। সিংহদ্বারের পাল্লাও পুরু ব্রোঞ্জে তৈরি।

কুমার বললে, ‘এই রাজবাড়িকে কেল্লা বললেও ভুল হয় না। যেখানে বাইরের শত্রুর ভয় নেই, সেখানে রাজবাড়িকে এমনভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে কেন?’

বিমল বললে, ‘মানুষ তো কোথাও নিরীহ জীবন যাপন করতে পারে না! বাইরের শত্রু নেই বটে, কিন্তু জাতি—বিরোধ প্রজা—বিদ্রোহ তো থাকতে পারে? রাজা তখন আশ্রয় নেন এই পাঁচিলের পিছনে!’

আচম্বিতে উপরে গুহার বাহির থেকে কারা একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল!

বিমল চমকে মুখ তুলেই শুনলে, কে চেঁচিয়ে ইংরাজিতে বলছে, ‘আরে আরে, বাঙালিবাবুরা যে দরজা ভেঙে আমাদের জন্যে সাফ করে রেখে গেছে!’

প্রথমটা সকলেই ভেবেছিল যে, পাতালবাসীরা হয়তো অন্য কোনও পথ দিয়ে গুহার উপরে উঠে আবার তাদের আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু ওদের স্পষ্ট ও আধুনিক ইংরেজি ভাষা শুনে বেশ বোঝা গেল, ওরা এই পাতালের বাসিন্দা নয়। তবে কি এখানকার খবর বাইরের লোকও জানে?

উপর—অংশের সিঁড়িটার চারিদিকে দেয়ালের আবরণ ছিল বলে কারুকে দেখা গেল না, কিন্তু কারা যে খট খট জুতোর শব্দ করে গুহার স্তব্ধতা ভেঙে নীচে নামছে এটা বেশ স্পষ্টই শোনা গেল!

কে এরা! নীচে নামে কেন?

আর একজন কে চেঁচিয়ে বললে, ‘গোমেজ, তোমার আলোটা একটু তুলে ধরো! এখানে পা ফসকালে সোজা নরকে গিয়ে হাজির হব!’

গোমেজ…..গোমেজ? এবং তার দলবল? একী অসম্ভব ব্যাপার!—বিমল হতভম্বের মতো কুমারের মুখের পানে মুখ ফেরালে।

গোমেজ তো এখন ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’—এর ডিটেকটিভদের পাল্লায়, কিংবা লন্ডনের জেলখানায়! সে কোন যাদুমন্ত্রে পুলিশ, কারাগার ও আটলান্টিক মহাসাগরকে ফাঁকি দিয়ে এই শৈলদ্বীপে এসে হাজির হয়েছে?

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – খণ্ডপ্রলয়

জুতো—পরা ভারী ভারী পায়ের আওয়াজ ক্রমেই উচ্চতর হয়ে উঠছে!

হঠাৎ কুমারের চোখ পড়ল সিঁড়ির পাশের গুহাটার দিকে—কাল যেখান থেকে শত্রু বেরিয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল। সে তাড়াতাড়ি বললে, ‘বিমল, মিথ্যে আর রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে লাভ নেই! এসো, আমরা ওই গুহাটার ভিতরে ঢুকে পড়ি। বোধ হচ্ছে ওখানে আমাদের সবাইকার জায়গা হবে।’

বিমল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সেপাইদের সেই গুহার ভিতরে ঢুকবার জন্যে ইঙ্গিত করলে। আধ—মিনিটের মধ্যেই জায়গাটা একেবারে খালি হয়ে গেল। এমনকী, চালাক বাঘা পর্যন্ত সে ইঙ্গিত বুঝতে একটুও দেরি করলে না!

গুহার মুখে গা—ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে বিমল ও কুমার শুনতে পেলে পায়ের শব্দগুলো একে একে বারান্দায় এসে নামছে।

তারপরে চমৎকৃত কণ্ঠে একজন বললে, ‘হে ভগবান! এ কী দেখছি!’—এটা হচ্ছে গোমেজের গলা!

আর একজন বললে, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য! পৃথিবীতে এমন ঠাঁই থাকতে পারে!’

আর একজন বললে, ‘মাথার উপরে আলোর ঝরনা! পাহাড়ের মাঝখানে অনন্ত গুহা! তার মধ্যে বিশাল স্বপ্ন—শহর! সোনার গম্বুজ—রুপোর গম্বুজ—সোনা—রুপোর সাঁকো!’

গোমেজ বললে, ‘কোথাও জনপ্রাণী নেই, কারুর সাড়াও নেই! আমরা কি রূপকথার সেই Sleeping Beauty—র দেশে এসে পড়লুম? এখানেও কি কোনও রাজকন্যা এক শতাব্দীর ঘুমে অচেতন হয়ে আমাদের জন্যে সোনার খাটে শুয়ে আছে?’

আর একজন বললে, ‘এখন তোমার কবিত্ব রাখো গোমেজ! এই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা আমার ভালো লাগছে না।’

কে একজন হঠাৎ সচকিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী ভয়ানক! কী এটা? ভূত, না মানুষ, না জন্তু?….অ্যাঁ! এ যে দেখছি মরে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে! বুকে বুলেটের দাগ!’

গোমেজ বললে, ‘এ সেই বাঙালি—বাবুদের কাজ! কিন্তু তারা গেল কোথায়, আমি যে তাদের জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারতে চাই।’

আর একজন চেঁচিয়ে উঠল, দ্যাখো, দ্যাখো! নীচেও কত মরা লোক পড়ে রয়েছে!’

গোমেজ বললে, ‘দেখছি এখানে ছোটোখাট্ট একটা লড়াই হয়ে গেছে! কিন্তু বাবুদের তো কোনওই পাত্তা নেই! আমাকে ফাঁকি দিয়ে তারা আগেই পটল তুলে ফেললে নাকি? না, বন্দুকের বিক্রম দেখিয়ে এখানকার লোকদের তারা বশ করে ফেলেছে?’

অন্য একজন বললে, ‘চলো আমরা নীচে নেমে যাই। এ দেশ আমরা দখল করবই। যদি কেউ বাধা দেয় তাকে যমালয়ে পাঠাব। হিপ হিপ হুররে!’

সকলেই একসঙ্গে হিপ হিপ হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠল—তারপরেই আবার নীচের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।

বিমল উঁকি মেরে দেখে নিলে, তাদের দলেও চব্বিশ—পঁচিশজন লোক আছে এবং সকলেরই হাতে বন্দুক।

পায়ের শব্দগুলো যখন মিলিয়ে গেল বিমল তখন আশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললে, ‘আর আমি ওদের কেয়ার করি না। ওরা যখন ওই সরু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেছে, তখন ওদের তো আমাদের হাতের মুঠোর ভেতরেই পেয়েছি।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কাল আমরা সমুদ্রে এদেরই জাহাজ দেখেছিলুম।’

কুমার বললে, ‘হুঁ। তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, গোমেজ বিলাতি পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পেরেছে।’

বিমল বললে, ‘আরও একটা কথা বোঝা যাচ্ছে। গোমেজ অসাধারণ কাজের লোক। এর মধ্যেই সে নতুন দল বেঁধে জাহাজ জোগাড় করে প্রায় আমাদেরই সঙ্গে সঙ্গে এখানে এসে হাজির হয়েছে। গোমেজের বাহাদুরি আছে।’

কমল বললে, ‘বোধহয় ওদের জাহাজখানা আমাদের চেয়ে দ্রুতগামী।’

—’সম্ভব। কিন্তু তাহলেও গোমেজের বাহাদুরি কম নয়। এখন চলো, বেরিয়ে দেখা যাক, নীচে আবার কী কাণ্ড বাধে। ওদের আর ভয় করবার দরকার নেই—সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ওরা নিজেদেরই মৃত্যু—ফাঁদে পা দিয়েছে।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু বিমল, আর এখানে হানাহানি করে আমাদের লাভ কী? এই ফাঁকে মানে মানে আমরা সরে পড়ি না কেন?’

বিমল তিরস্কার—ভরা কণ্ঠে বললে, ‘সে কী বিনয়বাবু! এই দস্যুদের কবলে সমস্ত দেশটাকে সমর্পণ করে? গোমেজ কী—জন্যে এখানে এসেছে জানেন না? লুঠ করতে, হত্যা করতে, অত্যাচার করতে! আমরা বাধা দেব না,—বলেন কী!’

বিনয়বাবু বলে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছ। আমার মনে ছিল না। হ্যাঁ, ওদের থেকে এই দেশকে রক্ষা করা চাই—ই!’

সবাই ছুটে বাইরে এল। বারান্দার ধারে গিয়ে হেঁট করে দেখলে, গোমেজ তার দলবল নিয়ে সরোবরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

কিন্তু তখনও পাতালপুরী তেমনি নিস্তব্ধ, কোথায় একটা প্রাণীরও দেখা নেই। শিখরের মুখে সূর্যের কিরণোৎসবের ঘটা যতই বেড়ে উঠছে, ততই বেশি সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতালপুরের দৃশ্যবৈচিত্র্য।

গোমেজ সদলবলে আগে আগে রাজপ্রসাদের দিকে গেল। কিন্তু সমস্ত প্রাসাদ—প্রাচীর প্রদক্ষিণ করেও ভিতরে প্রবেশ করবার পথ পেলে না। তারা তখন একটা বাগানের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হল সেই স্বর্ণরৌপ্যময় আশ্চর্য সেতুর দিকে।

আচম্বিতে কোথায় তীব্র সুরে একটা ভেরীর শব্দ শোনা গেল এবং পরমুহূর্তেই ঠিক যেন ভোজবাজির মহিমায় গোমেজ প্রভৃতির চারিপাশে শত শত বিপুলদেহ সৈনিকের মূর্তি হল আবির্ভূত! সঙ্গে—সঙ্গে সমগ্র পাতালরাজ্য আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল! কাছে, দূরে, উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে যেদিকে চোখ ফেরানো যায়, লক্ষে পড়ে কেবল জনতার পর জনতার প্রবাহ—কেবল বিদ্যুৎ—গতির লীলা—কেবল অগ্নিবৎ উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ষার নৃত্য। আর মেঘগর্জনের মতন সে কী গম্ভীর অথচ বিকট চিৎকার!

বিমল প্রশংসা—ভরা কণ্ঠে উল্লাস—ভরে বলে উঠল, ‘ধন্য ক্রো—ম্যাগনন মানুষরা, ধন্য! কুমার, এরা কতটা চালাক, বুঝতে পারছ? এরা বন্দুকের ধর্ম ঠিক ধরে ফেলেছে! এরা এরইমধ্যে বুঝে নিয়েছে যে, দূর থেকে বন্দুকধারীদের আক্রমণ করা আর আত্মহত্যা করা একই কথা। তাই এরা আমাদের ভুলিয়ে ফাঁদে ফেলবার জন্যে আনাচে—কানাচে নিঃশব্দে লুকিয়ে ছিল। ওরা ভয়ে কোথায় পালিয়েছে ভেবে আমরা যদি নীচে নামতুম, তাহলে আমাদেরও ঠিক এই দশাই হত। বাহবা বুদ্ধি!’

কুমার উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, ‘দ্যাখো বিমল, দ্যাখো। গোমেজের আট দশজন সঙ্গী একেবারে পপাত ধরণীতলে। গোমেজরা গুলিবৃষ্টি করে একদিকে পথ করে নিলে। ওই দ্যাখো, গোমেজরা সোনার সেতুর উপরে গিয়ে উঠল। ওদের দলে এখন মোটে এগারোজন লোক আছে।’

সেতুর ভিতরে খানিকদূরে বেগে ছুটে গিয়ে গোমেজ ও তার সঙ্গীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুই দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল এবং তারপর দুই দিকেই শিলাবৃষ্টির মতো গুলিবৃষ্টি করতে লাগল।

মুশকিলে পড়ল তখন পাতালবাসীরা। সেই বৃহৎ জনতা স্বল্প—পরিসর সেতুর ভিতর দিয়ে যথেচ্ছভাবে আর এগুতে পারলে না, যারা অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে তাদেরও অনেকেই হত বা আহত হয়ে সাঁকোর উপরে পড়ে গেল,—বাকি সবাই কেউ ছুটে পালিয়ে এল এবং কেউ বা পড়ল জলে লাফিয়ে।

গোমেজের দল তখন বাইরের জনতার উপরে দু—চোখো গুলি চালাতে শুরু করলে,—অধিকাংশ গুলি ব্যর্থ হল না, লোকের পর লোক মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়তে লাগল এবং আহতদের আর্তনাদে কান পাতা দায় হয়ে উঠল।

কমল বললে, ‘পাতালবাসীরা আবার পালিয়ে যাচ্ছে—পাতালবাসীরা আবার পালিয়ে যাচ্ছে।’

কুমার বললে, ‘এখন আমাদের কর্তব্য কী?’

বিমল কী বলবার উপক্রম করলে, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুবার আগেই সকলকার পায়ের তলায় পাথরের বারান্দা দুলে উঠল।

প্রত্যেকেই সবিস্ময়ে নীচের দিকে তাকালে, সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই অদ্ভুত দোল।

তারপরেই সকলে সভয়ে শুনলে, সেই সীমাশূন্য গুহার গর্ত থেকে, সেই মুখ—খোলা শিখরের বাহির থেকে, অনন্ত আকাশ থেকে, সুদূর সমুদ্র থেকে কী এক গম্ভীর ভয়ঙ্কর অনির্বচনীয় শব্দতরঙ্গের পর শব্দতরঙ্গ ছুটে—আর ছুটে—আর ছুটে আসছে! সেই ভৈরব অপার্থিব বিশ্বব্যাপী হুহুঙ্কারের মধ্যে—জলধি—কোলাহলের মধ্যে—ক্ষীণ তটিনীর কলনাদের মতো—কোথায় ডুবে গেল বন্দুকের চিৎকার, আহতদের কান্না, জনতার ভয়ার্ত রব! ঘন ঘন দুলছে পাহাড়, ঘন ঘন দুলছে বিমলদের পায়ের তলায় বারান্দা, ঘন ঘন দুলছে সমগ্র পাতালপুরী এবং উপর থেকে ঝরো—ঝরো ঝরছে ছোটো—বড়ো শিলাখণ্ড।

ভয়ে সাদা মুখে বিনয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ভূমিকম্প, ভূমিকম্প! এ—অঞ্চলের সব দ্বীপ আগ্নেয় দ্বীপ—ভূমিকম্প হচ্ছে। পালাও—পালাও।’

সকলে পাগলের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটল—পাহাড়ের দোলায় সকলেরই পা তখন টলমলিয়ে টলছে। তারপর সেই সংকীর্ণ সিঁড়ি বয়ে হুড়োমুড়ি করে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও দেওয়াল ধরে, কখনও হোঁচট খেয়ে এবং কখনও বা পড়তে পড়তে খুব বেঁচে গিয়ে তারা যে কেমন করে উপরে উঠে গুহার বাহিরে গিয়ে দাঁড়াল, এ—জীবনে সে—রহস্য কেউ বুঝতে পারবে না!

বাইরে বেরিয়ে দেখে, সমুদ্রেরও রুদ্রমূর্তি! তার লক্ষ লক্ষ জলবাহু ঊর্ধ্বে তুলে বারবার লম্ফের পর লম্ফ ত্যাগ করে জগৎব্যাপী একটা দুর্দান্ত বিভীষিকার মতো সে যেন উপরের বিপুল শূন্যতাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, তার গর্জনে গর্জনে তালে—বেতালে বাজছে যেন বিশ্বের সমস্ত বজ্রের সম্মিলিত কণ্ঠ এবং ফেনায় ফেনায় তার ফুটন্ত টগবগে জলের নীল রং আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। পাহাড় সেখানেও তার জড়তাকে ভুলে জীবন্ত এক অতিকায় দানবের মতো ক্রমাগত মাথানাড়া দিচ্ছে!

বিনয়বাবু চিৎকার করলেন, ‘সমুদ্রের জল বেড়ে উঠছে, শীঘ্র পাহাড় থেকে নেমে পড়ো!’

ঠিক যেন একটা উৎকট দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে প্রায় বাহ্যজ্ঞানহারার মতন তারা যখন কোনওক্রমে জাহাজে এসে উঠল, দ্বীপের উপরে ভূমিকম্প তখন থেমে গেছে বটে, কিন্তু দ্বিগুণ বেড়ে উঠেছে মহাসাগরের তাথৈ—তাথৈ নৃত্য।

বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘দেখুন বিনয়বাবু, দেখুন! সমুদ্রের জল দ্বীপের প্রায় শিখরের কাছে উঠেছে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কত যুগে কতবার ওই দ্বীপের সঙ্গে সমুদ্র যে এমনি ভয়ানক খেলা খেলেছে, তা কে জানে!’

কুমার বললে, ‘গোমেজের জাহাজ এখনও এখানে ছুটোছুটি করছে! কিন্তু গোমেজ তার দলবল নিয়ে আর ফিরে আসবে না!’

হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল আকাশ—ফাটানো একটা হাহাকার। যেন হাজার হাজার ভয়ার্ত কণ্ঠ একসঙ্গে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল তীব্র নিরাশায়!

কমল চমকে বললে, ‘ও আবার কাদের কান্না?’

কুমার বললে, ‘শব্দটা যেন ওই দ্বীপের দিক থেকেই আসছে!’

বিনয়বাবুর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দ্বীপের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বদ্ধকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বিমল, বিমল! সে ব্রোঞ্জের দরজা! সে দরজা আমরা ভেঙে ফেলেছি—তাই এতদিনের পরে যুগযুগান্তরের নিষ্ফল চেষ্টার পর—সমুদ্র প্রবেশ করেছে ওই পথে!’

বিমল অতিকষ্টে কেবল বললে, ‘সর্বনাশ!’

—’বিমল, লস্ট আটলান্টিসের শেষচিহ্নও এবারে হারিয়ে গেল। ওই শোনো পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার শেষ আর্তনাদ! আমরা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলুম—আমরা মহাপাপী!’

কুমার বাষ্পরুদ্ধস্বরে বললে, ‘না বিনয়বাবু। আমরা না ভাঙলেও গোমেজ গিয়ে আজ ওই দরজা ভাঙত। আমরা নিমিত্ত মাত্র। আটলান্টিস আবার হারিয়ে গেল মহাকালের অভিশাপে।’

বিনয়বাবু দুই হাতে প্রাণপণে জাহাজের রেলিং চেপে ধরে দাঁড়ালেন। তাঁর কম্পিত ওষ্ঠ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছিল—’লস্ট আটলান্টিস। লস্ট আটলান্টিস।’

___