নীল সায়রের অচিনপুরে – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ – ঝড়

ঢং!

বড়ো ঘড়িতে বাজল সাড়ে—সাতটা! এই হল বিমল ও কুমারের চা—পানের সময়। রামহরি চায়ের ‘ট্রে’ হাতে করে ঘরে ঢুকেই দেখলে, তারা দুজনে একখানা খবরের কাগজের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে, আগ্রহভরে।

এই খবরের কাগজ ও এই আগ্রহ রামহরির মোটেই ভালো লাগল না। কারণ সে জানে, রীতিমতো একটা জবর খবর না থাকলে বিমল ও কুমার খবরের কাগজের উপরে অমন করে ঝুঁকে পড়ে না। এবং তাদের কাছে জবর খবর মানে সাংঘাতিক বিপদের খবর! এই খবর পড়েই হয়তো ওরা বলে বসবে, ‘ওঠো রামহরি! বাঁধো তল্পিতল্পা! আজকেই আমরা কলকাতা ছাড়ব!’ কতবার যে এমনি ব্যাপার হয়েছে, তার আর হিসাব নেই।

অতএব রামহরি ওই খবরের কাগজগুলোকে দু—চক্ষে দেখতে পারত না। তার মতে, ওগুলো হচ্ছে মানুষের শত্রু ও বিপদের অগ্রদূত!

রামহরি চায়ের ট্রে—খানা সশব্দে টেবিলের উপরে রাখলে—কিন্তু তবু ওরা কাগজ থেকে মুখ তুললে না!

রামহরি বিরক্ত কণ্ঠে বললে, ‘কী, চা—টা খাবে, না আজ কাগজ পড়েই পেট ভরবে?’

বিমল ফিরে বসে বললে, ‘কী ব্যাপার রামহরি, সক্কালবেলায় তোমার গলাটা এমন বেসুরো বলছে কেন?’

—’বলি, খবরের কাগজ পড়বে, না চা খাবে?’

কুমার হেসে বললে, ‘খবরের কাগজের ওপরে তোমার অত রাগ কেন?’

—’রাগ হবে না? ওই হতচ্ছাড়া কাগজগুলোই তো তোমাদের যত ছিষ্টিছাড়া খবর দেয়, তোমরা পাগলের মতো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চাও!’

বিমল হো হো করে হেসে উঠে বললে, ‘নাঃ।—রামহরি আমাদের বড্ড বেশি চিনে ফেলেছে, কুমার!’

—’না, তোমাদের ছেলেবেলা থেকে দেখছি, তোমাদের চিনব কেন? ওসব কাগজ—টাগজ পড়া ছেড়ে দাও!’

—’হ্যাঁ, রামহরি, এইবার সত্যিসত্যিই কিছুকালের জন্য আমরা কাগজ—টাগজ পড়া একেবারে ছেড়ে দেব!’

রামহরি ভারী খুশি হয়ে বললে, ‘তোমার মুখে ফুল—চন্নন পড়ুক! আমি তাহলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি!’

—’বাঁচবে কী মরবে জানি না রামহরি, তবে আমরা যে ইচ্ছা করলেও আর কাগজ পড়তে পারব না, এ বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কারণ এবারে যে—দেশে যাচ্ছি সেখানে খবরের কাগজ পাওয়া যায় না।’

রামহরির মুখে এল অন্ধকার ঘনিয়ে। বললে, ‘তার মানে?’

—’আমরা যে শিগগিরই সমুদ্রযাত্রায় বেরুব।’

—’ওরে বাবা, সুমুদ্দরে? এবারে আবার কোন চুলোয়? পাতালে নয়তো?’

—’হতে পারে। তবে, আপাতত আগে যাব সাহেবদের দেশে—অর্থাৎ বিলাতে। সেখান থেকে একখানা গোটা জাহাজ রিজার্ভ করে যাব আফ্রিকা আর আমেরিকার মাঝখানে, আটলান্টিক মহাসাগরের এমন কোনও দ্বীপে, যার নাম কেউ জানে না।’

—’সঙ্গে যাচ্ছে কে কে?’

—’আমি, কুমার, বিনয়বাবু, কমল, বাঘা আর তুমি—অর্থাৎ আমাদের পুরো দল। এবারের ব্যাপার গুরুতর, তাই দু—ডজন শিখ, গুর্খা আর পাঠানকেও ভাড়া করতে হবে।’

রামহরি গম্ভীর মুখে বললে, ‘বেশ, তোমার যেখানে খুশি যাও, কিন্তু এবার আর আমি তোমাদের সঙ্গে নেই’—বলেই সে হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিমল চায়ের ‘ট্রে’ টেনে নিয়ে মুখ টিপে হেসে বললে, ‘রামহরি নাকি এবারে আমাদের সঙ্গে যাবে না! কিন্তু যাত্রার দিন দেখা যাবে সেইই হন হন করে আমাদের আগে আগে যাচ্ছে!……যাক, নাও কুমার না চাও! চা খেতে খেতে কাগজখানা আর একবার গোড়া থেকে পড়ো তো শুনি! বার বার শুনে সমস্ত ঘটনা মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে ফেলতে হবে।’

কুমার খবরের কাগজখানা আবার তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগল।

‘আটলান্টিক মহাসাগরে এক বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। যাঁহারা বলেন, এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীতে আর নতুন বিস্ময়ের ঠাঁই নাই, তাঁহারা ভ্রান্ত। ধরণী বিপুলা, মানবসভ্যতার সৃষ্টি—রহস্যের কতটুকু ধরা পড়িয়াছে? প্রতি যুগেই সভ্যতা মনে করিয়াছে, জ্ঞানের চরম সীমা তাহার হস্তগত, তাহার পক্ষে আর নতুন শিখিবার কিছুই নাই। কিন্তু পরবর্তী যুগেই তাহার সে—গর্ব চূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

গ্রিকরা নাকি সভ্যতার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল—জ্ঞান—বিজ্ঞানে তাহারা ছিল অগ্রগণ্য। কিন্তু আজিকার কলেজের ছাত্ররাও প্লেটো ও সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞান—বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর! গ্রিক সভ্যতা বিলুপ্ত হইল, পৃথিবীকে বিজয়—চিৎকারে পরিপূর্ণ করিয়া আবির্ভূত হইল রোমীয় সভ্যতা! তাহার বিশ্বাস ছিল ভূমণ্ডলকে দেখিতে পায় সে নিজের নখ—দর্পণে! কিন্তু, রোমানদের অঙ্কিত পুরাতন মানচিত্রে আধুনিক পৃথিবীর প্রায় অর্ধাংশকেই দেখিতে পাওয়া যায় না। মধ্যযুগের পরেও এই সেদিন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু এবং আরও কত বড়ো বড়ো দ্বীপের অস্তিত্ব পর্যন্ত কাহারও জানা ছিল না! অন্যান্য গ্রহের কথা ছাড়িয়া দি, আজও পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত নব নব দেশ নাই, এমন কথা কেহ কি জোর করিয়া বলিতে পারে? দক্ষিণ আমেরিকায় ও আফ্রিকায় এখনও এমন একাধিক দুর্গম দেশ ও দুরারোহ পর্বত আছে, এ যুগের কোনও সভ্য মানুষ সেখানে পদার্পণ করে নাই! ওইসব স্থানে অতীতের কত গভীর রহস্য নিদ্রিত হইয়া আছে, তাহা কে বলিতে পারে? হয়তো কত নতুন জাতি, কত অজানা জীব সেখানে নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র এক সমাজ বা বসতি গড়িয়া বসবাস করিতেছে, আমরা তাহাদের কোনও সংবাদই রাখি না!

অতঃপর আগে যে রহস্যের ইঙ্গিত দিয়াছি তাহার কথাই বলিব।

সম্প্রতি এস এস বোহিমিয়া নামক একখানি জাহাজ ইউরোপ হইতে আমেরিকায় যাত্রা করিয়াছিল।

কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের ভিতরে আচম্বিতে এক ভীষণ ঝড় উঠিল। এই স্মরণীয় দৈব—দুর্ঘটনার সংবাদ আমাদের কাগজে গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে এবং সকলেই এখন জানেন যে, ও—রকম ভূমিকম্পের সঙ্গে ঝড় আটলান্টিক মহাসাগরে গত এক শতাব্দীর মধ্যে কেহ দেখে নাই। উক্ত দৈব—দুর্বিপাকে আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যবর্তী বহু দ্বীপে ও তীরবর্তী বহু দেশে অগণ্য লোক ও সম্পত্তি ক্ষয় হইয়াছে। কোনও কোনও ছোটো ছোটো দ্বীপের চিহ্ন পর্যন্ত সমুদ্রের উপর হইতে একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! বহু বাণিজ্যপোত ও যাত্রীপোত অদ্যাবধি কোনও বন্দরে ফিরিয়া আসে নাই এবং হয়তো আর আসিবেও না।

‘বোহিমিয়া’ও পড়িয়াছিল এই সর্বগ্রাসী প্রলয়ঝটিকার মুখেই! কিন্তু ঝটিকা দয়া করিয়া যাহাদের গ্রহণ করে নাই, ‘বোহিমিয়া’ সৌভাগ্যবশত তাহাদেরই দলভুক্ত হইতে পারিয়াছে। গত আঠারোই তারিখে সে ক্ষতবিক্ষত দেহে আবার স্বদেশের বন্দরে ফিরিয়া আসিয়াছে। এবং তাহার যাত্রীরা বহন করিয়া আনিয়াছে এক বিস্ময়কর কাহিনি! জনৈক যাত্রী যে বর্ণনা দিয়াছে আমরা এখানে তাহাই প্রকাশ করিলাম!

অপার সাগরে ঝটিকা জাগিয়া ‘বোহিমিয়া’র অবস্থা করিয়া তুলিয়াছি ভয়াবহ! ঝড়ের ঝাপটে প্রথমেই তাহার ইঞ্জিন খারাপ হইয়া যায়। সমুদ্রের তরঙ্গ বিরাট আকার ধারণ করিয়া উন্মত্ত আনন্দে জাহাজের ডেকের উপর ক্রমাগত ভাঙিয়া পড়িতে থাকে,—সেই তরঙ্গের আঘাতে দুইজন আরোহী জাহাজের উপর হইতে অদৃশ্য হইয়া যায়। জাহাজের চারিদিকে বহুক্ষণ পর্যন্ত উত্তাল তরঙ্গের প্রাচীর ছাড়া আর কোনও দৃশ্যই দেখা যায় নাই। প্রলয়—ঝটিকার হুহুঙ্কার এবং মহাসাগরের গর্জন সেই অসীমতার সাম্রাজ্যকে ধ্বনিময় ও ভয়ানক করিয়া তোলে! আকাশব্যাপী নিবিড় অন্ধকার অশ্রান্ত বিদ্যুৎবিকাশে অগ্নিময় হইয়া উঠে। প্রকাশ, এত ঘন ঘন বিদ্যুতের সমারোহ এবং বজ্রের কোলাহল নাকি কেউ কখনও দেখেও নাই শোনেও নাই! এই মহা হুলুস্থুলুর মধ্যে, এই শত শত শব্দ—দানবের প্রবল আস্ফালনের মধ্যে, প্রাকৃতিক বিপ্লবের এই সর্বনাশা আয়োজনের মধ্যে নিজের নির্দিষ্ট গতিশক্তি হারাইয়া ‘বোহিমিয়া’ একান্ত অসহায়ভাবে বিশাল সমুদ্রের প্রচণ্ড স্রোতে এবং ক্রুদ্ধ ঝটিকার দুর্নিবার টানে দিগ্বিদিক ভুলিয়া কোথায় ছুটিতে থাকে, তাহা বুঝিবার কোনও উপায়ই ছিল না। জাহাজের ‘ইলেকট্রিসিটি’ জোগান দিবার যন্ত্রও বিগড়াইয়া যায়। ভিতরে বাহিরে অন্ধকার, আকাশে ঝড়, সমুদ্রে বন্যা ও তাণ্ডবের বিপ্লব, জাহাজের কামরায় কামরায় শিশু ও নারীদের উচ্চ ক্রন্দনধ্বনি, কাপ্তেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নাবিকেরা ভীতিব্যাকুল,—এই কল্পনাতীত দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়া ‘বোহিমিয়া’ ভাসিয়া আর ভাসিয়া চলিয়াছে—কোন অদৃশ্য মহাশক্তির তাড়নায়—কোন অদৃশ্য নিয়তির নিষ্ঠুর আকর্ষণে! প্রতিমুহূর্তে তার নরক—যন্ত্রণাময় অনন্ত মুহূর্তের মতো—পাতালের অতলতা কখন তাকে গ্রাস করে, সকলে তখন যেন কেবল তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছিল!

প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পরে ঝড় যখন শান্ত হইয়া আসিল, ভগবানের অনুগ্রহে ‘বোহিমিয়া’ তখনও ভাসিয়া রহিল। এ যাত্রা রক্ষা পাইল বুঝিয়া ধর্মভীরু যাত্রীরা প্রার্থনা করিতে বসিল।

কিন্তু জাহাজ এখন কোথায়? তখন শেষ—রাত্রি, চন্দ্রহীন শূন্যতা, চতুর্দিকে আঁধার—প্রপাতের বাঁধ খুলিয়া দিয়াছে। জাহাজের ভিতরেও আলোর আশীর্বাদ নাই। কাপ্তেন ডেকের উপরে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

আটলান্টিক মহাসাগর তখনও যেন রুদ্ধ আক্রোশে গর্জন করিতেছে, তাহার বিদ্রোহী তরঙ্গদল তখনও মৃত্যুসংগীতের ছন্দে রুদ্রতাল বাজাইয়া ছুটিয়া যাইতেছে, জাহাজ তখনও তাহাদের কবলে অসহায় ক্রীড়নক!

অনেকক্ষণ পরে কাপ্তেন সবিস্ময়ে দেখিলেন বহুদূরে অনেকগুলো আলোকশিখা জমাট অন্ধকার—পটে যেন সুবর্ণরেখা টানিয়া দিতেছে!

‘বোহিমিয়া’ সেইদিকেই অগ্রসর হইতেছিল।

আলোক—শিখাগুলি ক্রমেই স্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিতে লাগিল! দূরবিনের সাহায্যে কাপ্তেন দেখিলেন, সেগুলো মশালের আলো এবং তাহারা রাত্রিচর আলেয়ার মতো এদিকে—ওদিকে চলা—ফেরা করিতেছে!

কাপ্তেন বুঝিলেন, ‘বোহিমিয়া’ স্রোতের টানে কোনও দ্বীপের দিকে অগ্রসর হইতেছে এবং দ্বীপের বাসিন্দারা মশাল জ্বালিয়া যে—কারণেই হউক সমুদ্র—তীরে বিচরণ করিতেছে। সাগরতীরবর্তী দ্বীপের বাসিন্দারা ঝড়ের পরে প্রায়ই এইরকম বাহিরে আসিয়া অপেক্ষা করে, বিপদগ্রস্ত জাহাজ বা নরনারীদের সাহায্য করিবার শুভ—ইচ্ছায়।

খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ আলোগুলো অদৃশ্য হইয়া গেল। নিকটেই কোনও দ্বীপ আছে জানিয়া কাপ্তেন ভগবানকে বারংবার ধন্যবাদ দিলেন।

তাহার পর পূর্ব আকাশে কুমারী ঊষা যখন তার লাল—চেলির ঝলমলে আঁচল উড়াইয়া দিল, সাগরবাসী রূপসি নীলিমা যখন শান্ত স্বরে প্রভাতী স্তব পাঠ করিতে লাগিল, সকলের চোখের সামনে তখন ভাসিয়া উঠিল—স্বপ্নরঙ্গমঞ্চের অর্ধস্ফুট দৃশ্যপটের মতো এক অভিনব দ্বীপের ছবি!

সে দ্বীপটি বড়ো নয়—আকারে হয়তো চার—পাঁচ মাইলের বেশি হইবে না। কিন্তু তাহাকে সাধারণ দ্বীপের পর্যায়ে ফেলা যায় না। সে দ্বীপকে একটি পাহাড় বলাই উচিত!

তাহার ঢালু গা ধীরে ধীরে উপর—দিকে উঠিয়া গিয়াছে। নীচের দিকটা কম—ঢালু, সেখান দিয়া অনয়াসে চলা—ফেরা করা যায়, কিন্তু তাহার শিখর দিকটা শূন্যে উঠিয়াছে প্রায় সমান খাড়াভাবে। সাগরগর্ভ হইতে তাহার শিখরের উচ্চতা দেড় হাজার ফুটের কম হইবে না।

দূরবিন দিয়া কাপ্তেন দেখিলেন, সেই পাহাড়—দ্বীপের কোথাও কোনও গাছপালা— এমনকী সবুজের আভাসটুকু পর্যন্ত নাই! আর—একটি অভাবিত আশ্চর্য ব্যাপার হইতেছে এই যে, দ্বীপের গায়ে নানাস্থানে দাঁড়াইয়া আছে মস্ত মস্ত প্রস্তরমূর্তি,—এক—একটি মূর্তি এত প্রকাণ্ড যে, উচ্চতায় দেড়শত বা দুইশত ফুটের কম নয়! পাহাড়ের গা হইতে সেই বিচিত্র মূর্তিগুলিকে কাটিয়া—খুদিয়া বাহির করাই হইয়াছে! দূর হইতে দেখিলে সন্দেহ হয়, যেন প্রাচীন মিশরি ভাস্করের গড়া মূর্তি!

কিন্তু গতকল্য যাহারা এই গিরি—দ্বীপে মশাল জ্বালিয়া চলা—ফেরা করিতেছিল, তাহাদের কাহাকেও আজ সকালে দেখা গেল না। এই দ্বীপের পাথুরে গায়ে যেমন শ্যামলতাও নাই, তেমনি কোনও জীবের বা মানুষের বসতির চিহ্নমাত্রও নাই! এমনকী, সেখানে একটা পাখি পর্যন্ত উড়িতেছে না!

তিনি বহুকাল কাপ্তেনি করিতেছেন, আটলান্টিক মহাসাগরের প্রত্যেক তরঙ্গটি তাঁহার নিকটে সুপরিচিত, নাবিক—ব্যবসায়ে তিনি চুল পাকাইয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু এই দ্বীপটিকে কখনও দেখেন নাই, বা তাহার অস্তিত্বের কথা কাহারও মুখে শ্রবণও করেন নাই।……অথবা এই দ্বীপের কথা শুনিয়াও তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন? তাঁহার এমন ভ্রম কি হইতে পারে? দ্বীপের খুব কাছে আসিয়া নোঙর ফেলিয়া কাপ্তেন তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ছুটিয়া গেলেন। ‘চার্ট’ বাহির করিয়া অনেক খুঁজিলেন, কিন্তু তাহাতে এই শৈলদ্বীপের নাম—গন্ধও পাইলেন না! তবে এখানে এই দ্বীপটি কোথা হইতে আসিল?

অনেক ভাবিয়াও এই প্রশ্নের কোনও উত্তর না পাইয়া কাপ্তেন আবার বাহিরে আসিলেন। এবং তাহার পর জন—আষ্টেক নাবিককে বোটে চড়িয়া দ্বীপটি পরীক্ষা করিয়া আসিতে বলিলেন।

নাবিকরা বোট লইয়া চলিয়া গেল। দ্বীপের তলায় বোট বাঁধিয়া নাবিকরা উপরে গিয়া উঠিল—জাহাজ হইতে সেটাও স্পষ্ট দেখা গেল। তারপর তাহারা সকলের চোখের আড়ালে গিয়া পাহাড়ের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইল।

দুই ঘণ্টার ভিতরে নাবিকদের ফিরিয়া আসিবার কথা। কিন্তু তিন—চার—পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়া গেল, তবু কাহারও দেখা নাই! কাপ্তেন চিন্তিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন! আরও দুই ঘণ্টা গেল! বেলা ছয়টায় নাবিকেরা গিয়াছে, এখন বেলা একটা—তাহারা কোথায় গেল?

এবারে কাপ্তেন নিজেই সদলবলে নতুন বোটে নামিলেন। এবারে সকলেই সশস্ত্র! কারণ কাপ্তেনের সন্দেহ হইল, দ্বীপের ভিতরে গিয়া নাবিকেরা হয়তো বিপদে পড়িয়াছে! কল্য রাত্রে যাহাদের হাতে মশাল ছিল তাহারা কাহারা? বোম্বেটে নয়তো, হয়তো এই নির্জন দ্বীপে আসিয়া তাহারা গোপনে আড্ডা গাড়িয়া বসিয়াছে!

দ্বিতীয় দল দ্বীপে গিয়া উঠিল। মহাসাগরের অশ্রান্ত গম্ভীর কোলাহলের মাঝখানে সেই অজ্ঞাত দ্বীপ বিজন ও একান্ত স্তব্ধ সমাধির মতো দাঁড়াইয়া আছে। অতিকায় প্রস্তরমূর্তিগুলো পর্বতেরই অংশবিশেষের মতো অচল হইয়া আছে, তাহাদের দৃষ্টিহীন চক্ষুগুলো অনন্ত সমুদ্রের দিকে প্রসারিত। মানুষ—ভাস্কর তাহাদের গড়া মূর্তির মুখের ভাবে ফুটায় মানুষেরই মৌখিক ভাবের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই দানবমূর্তিগুলোর মুখের ভাব কী কঠিন!

কোনও মূর্তির মুখেই মানুষি দয়া মায়া স্নেহ প্রেমের কোমল ও মধুর ভাবের এতটুকু চিহ্ন নাই! তাহাদের দেখিলে প্রাণে ভয় জাগে, হৃদয় স্তম্ভিত হয়! প্রত্যেকেরই অমানুষিক মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে হিংস্র কঠোরতার তীব্র আভাস! বেশ বুঝা যায়, যাহারা এই সকল মূর্তি গড়িয়াছে তাহারা দয়া—মায়ার সঙ্গে পরিচিত নয়। তাহারা অতুলনীয় শিল্পী বটে, কিন্তু প্রচণ্ড নিষ্ঠুর!

কাপ্তেন সারাদিন ধরিয়া সেই দ্বীপের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইলেন। পাহাড়ের ঢালু গা বাহিয়া যতদূর উপরে উঠা যায়, উঠিলেন। তাহার পরেই খাড়া শিখরের মূলদেশ। সরীসৃপ ভিন্ন কোনও দ্বিপদ বা চতুষ্পদ ভূচর জীবের পক্ষেই সেই শিখরের উপরে উঠা সম্ভবপর নয়। প্রায় হাজার ফুট উপর হইতে কাপ্তেন ও তাঁহার সঙ্গীরা চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন, কিন্তু কোথাও নাবিকদের দেখা নাই। তাহাদের সচেতন করিবার জন্য বারংবার বন্দুক ছোড়া হইল, সে শব্দে নীরবতার ঘুম ভাঙিয়া গেল, কিন্তু নাবিকদের কোনওই সাড়া নাই।

সন্ধ্যার সময়ে কাপ্তেন সঙ্গীদের সহিত শ্রান্ত দেহে হতাশ মনে জাহাজে ফিরিয়া আসিলেন।

পরদিন আবার দ্বীপে গিয়া খোঁজাখুঁজি শুরু হইল। সেদিনও সূর্য অস্ত গেল, কিন্তু হারা—নাবিকদের সন্ধান মিলিল না।

এই দুই দিনের অন্বেষণে আরও কোনও কোনও অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কৃত হইল।

ঝড়ের রাত্রে দ্বীপে মশাল লইয়া যাহারা চলা—ফেরা করিয়াছিল, তাহারা কোথায় গেল?

আলো লইয়া পৃথিবীর একমাত্র জীব চলা—ফেরা করিতে পারে এবং সেই জীব হইতেছে মনুষ্য! কিন্তু দ্বীপে মানুষের বসতির কোনও চিহ্নই নাই! তবে কি সেগুলো আলেয়ার আলো? কিন্তু আলেয়ার জন্ম হয় জলাভূমিতে, এই পাষাণের শুষ্ক রাজ্যে আলেয়ার কল্পনাও উদ্ভট, মরুর বুকে আলোকলতার মতোই অসম্ভব।

মানুষ যেখানে থাকে, সেখানে জলও থাকে। কিন্তু সারা দ্বীপ তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ঝরনা, নদী বা জলাশয় আবিষ্কার করা যায় নাই।

কিন্তু যাহারা মশাল জ্বালিয়াছিল, তাহারা তো মানুষ? যদি ধরিয়া লওয়া যায় তাহারা কোথাও কোনও গুপ্তস্থানে লুকাইয়া আছে, তাহা হইলেও প্রশ্ন উঠে, কী পান করিয়া তাহারা বাঁচিয়া থাকিবে? জল কোথায়? নদী বা নির্ঝর তো ধন—রত্নের মতো লুকাইয়া রাখা যায় না। অন্তত তাহার শব্দও শোনা যায়! এবং এই পাহাড়—দ্বীপে কৃত্রিম উপায়ে জলাশয় খনন করাও অসম্ভব! সমুদ্রের লোনা জলেও জীবের প্রাণ বাঁচে না! তবে?

দ্বীপে যাহারা এমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মূর্তি বহু বৎসর ধরিয়া গড়িয়াছে, তাহারাও তো মানুষ? তাহারা কোথা হইতে জলপান করিত?

আর এমন সব বিচিত্র মূর্তি, ইহাদের পিছনে রহিয়াছে বিরাট এক সভ্যতার ইতিহাস! কিন্তু সমগ্র দ্বীপে কোথায় সেই সভ্যতার চিহ্ন? এতবড়ো একটা সভ্যতা তো কোনও গুপ্ত—সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে লুকাইয়া রাখা যায় না! এবং ‘চার্টে’ পাওয়া যায় না, এমন একটা দ্বীপ সুপরিচিত আটলান্টিক মহাসাগরে কোথা হইতে আসিল, সেটাও একটা মস্ত সমস্যা!

জাহাজের আট—আটজন নাবিক কি কর্পূরের মতন উবিয়া গেল?

‘বোহিমিয়া’র প্রত্যেক আরোহীর বিশ্বাস, এ—সমস্তই ভৌতিক কাণ্ড!

তৃতীয় দিনেও কাপ্তেন আবার দ্বীপে গিয়া নাবিকদের খুঁজিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কিন্তু ভূতের ভয়ে কেহই আর তাঁহার সঙ্গে যাইতে রাজি হয় নাই। কাজেই জাহাজের ইঞ্জিন মেরামত করিয়া তাঁহাকে আবার দেশে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের আজোর্স দ্বীপপুঞ্জ ও কেনারি দ্বীপপুঞ্জের মাঝখানে এই নূতন গিরি—দ্বীপের অবস্থান।

কিন্তু এই দ্বীপের বিচিত্র রহস্যের কিনারা করিবে কে?’

কুমার পড়া শেষ করে কাগজখানা টেবিলের উপরে রেখে দিলে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বিমল বললে, ‘কুমার, জীবনে অনেক রহস্যেরই গোড়া খুঁজে বার করেছি আমরা। এবারেও এ—রহস্যের কিনারা আমরা করতে পারব, কি বলো?’

কুমার বললে, ‘ওসব কিনারা—টিনারা আমি বুঝি না! সফলই হই আর বিফলই হই, জীবনে আবার একটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া গেল, এইটুকুতেই আমি তুষ্ট!’

বিমল সজোরে টেবিল চাপড়ে উৎসাহিত কণ্ঠে বললে, ‘ঠিক বলেছ!” হাতে হাত দাও!’

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ব্ল্যাক স্নেক

কলকাতা থেকে বোম্বে এবং বোম্বে থেকে ভারতসাগরে!

দেখতে দেখতে বোম্বাই শহর ছোটো হয়ে আসছে এবং বড়ো বড়ো প্রাসাদগুলোর চুড়ো নিয়ে বোম্বাই যত দূরে সরে যাচ্ছে, তার দুই দিকে ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে জেগে উঠেছে ভারতবর্ষের তরুশ্যামল বিপুল তটরেখা!

ক্রমে সে—রেখাও ক্ষীণতর হয়ে এল এবং তার শেষ—চিহ্নকে গ্রাস করে ফেললে মহাসাগরের অনন্ত ক্ষুধা! তারপর থেকে সমানে চলতে লাগল নীলকমলের রংমাখানো অসীমতার নৃত্যচাঞ্চল্য—নীল আকাশ আর নীল জল ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত পরিচিত রূপ চোখের আড়ালে গেল একেবারে হারিয়ে।

ডেকের উপরে জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বিমল বললে, ‘কুমার, ভারতকে এই প্রথম ছেড়ে যাচ্ছি না, কিন্তু তবু কেন জানি না, যতবারই ভারতকে ছেড়ে যাই ততবারই মনে হয়, আমার সমস্ত জীবনকে যেন ভারতের সোনার মতো সুন্দর ধুলোয় ফেলে রেখে, আত্মার অশ্রু—ভেজা মৃতদেহ নিয়ে কোন অন্ধকারে যাত্রা করছি!’

কুমার নিষ্পলক দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের বিলুপ্ত তটরেখার উদ্দেশে তাকিয়ে ভারী ভারী গলায় বললে, ‘ভাই, স্বদেশের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া কখনও হয়তো পুরানো হয় না! যে—ভারতের শিয়রে নির্ভীক প্রহরীর মতো অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে তুষারমুকুট অমর হিমাচল, যে—ভারতের চরণতলে ভৃত্যের মতো ছুটোছুটি করছে অনন্ত পাদোদক নিয়ে রত্নাকর সমুদ্র, যে—ভারতের পবিত্র মাটি, জল, তাপ, বাতাস আর আকাশ আজ যুগ—যুগান্তর ধরে আমাদের দেহ গড়ে আসছে লক্ষ লক্ষ রূপে জ্ঞান—বিজ্ঞান—সভ্যতার আদি—পুরোহিত, যে অপূর্ব মহিমার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আজ আমরা ভারতবাসী বলে গর্বে সব জাতির উপরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, আমাদের এমন গৌরবের দেশ ছেড়ে যেতে যার মন কেমন করে না, নিশ্চয়ই সে ভারতের ছেলে নয়!’

বিমল বললে, ‘যারা ভারতের ছেলে নয় তারাও তো ভারতকে ভুলতে পারে না, কুমার! অতীতের পর্দা ঠেলে তাকিয়ে দ্যাখো! ভারতকে শত্রুর মতো আক্রমণ করতে এল যুগে যুগে শক, হুন, তাতার আর মোগল, কিন্তু আর ফিরে গেল না! কেউ গেল ভারতের মহামানবের সাগরের অতলে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে, কেউ ডাকলে পরম শ্রদ্ধায় ভারতকেই স্বদেশ বলে! অমন যে আপন সভ্যতায় গর্বিত গ্রিকগণ, তাদেরও অসংখ্য লোক আলেকজান্ডারের দল ছেড়ে স্বদেশ ভুলে উত্তর ভারতেই বংশানুক্রমে বাসা বেঁধে রয়ে গেল! আমাদের এই ভারতকে স্বদেশের মতো ভালো না বেসে কেউ যে থাকতে পারে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।’

বিমল যা ভেবেছিল, তাই। বুড়ো রামহরির পুরানো অভ্যাসই হচ্ছে মুখে ‘না’ বলা, কিন্তু কাজের সময়ে দেখা যায়, তারই পা চলছে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি!

প্রৌঢ় বিনয়বাবু নিজের কেতাব আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে ঘরের চার—দেওয়ালের মাঝখানেই বন্দি থাকতে ভালোবাসেন, কিন্তু বিমল ও কুমার সারা পৃথিবীতে ছুটাছুটি করতে বেরুবার সময়ে তাঁকে ডাক দিলে তিনিও দলে যোগ না দিয়ে পারেন না! আর তিনি এলে কমলও যে আসবে, এটাও তো জানা কথা!

আর ওই বিখ্যাত দিশি কুকুর, বাঘের মতন মস্ত বাঘা! ঠিকভাবে পালন করলে বাংলার নিজস্ব কুকুরও যে কত তেজি, কত বলী আর কত সাহসী হয়, বিমল ও কুমারের নানা অভিযানে বহুবারই বাঘা সেটা প্রমাণিত করেছে। এবারেও আবার নতুন বীরত্ব দেখাবার সুযোগ পাবে ভেবে সে তার উৎসাহী ল্যাজের ঘন ঘন আন্দোলন আর বন্ধ করতে পারছে না।

এবারে দলের সঙ্গে চলেছে বারোজন শিখ, ছয়জন গুর্খা, আর ছয়জন পাঠান। এরা সকলেই আগে ফৌজে ছিল। অনেকেই ভারতের সীমান্তে বা মহাযুদ্ধে ফ্রান্সে ও মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশে লড়াই করে এসেছে। পাকা ও অভিজ্ঞ বলেই তারা তাদের নিযুক্ত করেছে এবং সকলকে বন্দুক, অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ও পোশাক—পরিচ্ছদ দিতেও ত্রুটি করা হয়নি। এতগুলি সশস্ত্র সৈনিক নিয়ে নতুন অভিযানে যাবার জন্যে সরকারি আদেশও গ্রহণ করা হয়েছে।

জাহাজ এখন এডেন বন্দরের দিকে চলেছে। তারপর ইউরোপের নানা দেশের নানা বন্দরে ‘বুড়ি ছুঁয়ে’ ফরাসিদেশের মারসেয়্য—এ গিয়ে থামবে। সেখানে নেমে সকলে যাবে রেলপথে পারি নগরে।…আধুনিক আর্ট ও সাহিত্যের পীঠস্থান পারি নগরীকে ভালো করে দেখবার জন্যে বিমল ও কুমারের মনে অনেকদিন থেকেই একটা লোভ ছিল। এই সুযোগে তারা সেই লোভ মিটিয়ে নিতে চায়।

পথের বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। কারণ আমরা ভ্রমণকাহিনি লিখছি না।

পারি শহরে গিয়ে প্রথম যেদিন তারা হোটেলে বাসা নিলে, সেইদিনই খবরের কাগজে এক দুঃসংবাদ পেলে। খবরটি হচ্ছে এই :

মিঃ টমাস মর্টন গত উনিশে নভেম্বর রাত্রে রহস্যময় ও অদ্ভুতভাবে হঠাৎ মৃত্যুমুখে পড়েছেন। এখনও বিস্তৃত কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি, তবে এইটুকু জানা গিয়েছে যে, তাঁর মৃত্যুর কারণ ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র দংশন। পাঠকদের নিশ্চয় স্মরণ আছে যে, সম্প্রতি যে এস. এস. বোহিমিয়া আটলান্টিক মহাসাগরের নতুন দ্বীপের সংবাদ এনে সভ্য জগতে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, মিঃ টমাস মর্টন ছিলেন তারই কাপ্তেন।

বিমল দুঃখিত কণ্ঠে বললে, ‘কুমার, ভেবেছিলুম প্রথমে লন্ডনে নেমেই আগে মিঃ মর্টনের দ্বারস্থ হব। তাঁকে আমাদের সঙ্গী হবার জন্যে অনুরোধ করব। কারণ ওই দ্বীপে যেতে গেলে পথ দেখাবার জন্যে বোহিমিয়ার কোনও পদস্থ কর্মচারীর সাহায্য না নিলে আমাদের চলবে না, আর এ—ব্যাপারে মিঃ মর্টনের চেয়ে বেশি সাহায্য অন্য কেউ করতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের প্রথম আশায় ছাই পড়ল।’

কুমার বললে, ‘ভগবানের মার, উপায় কী? আমাদের এখন বোহিমিয়ার অন্য কোনও কর্মচারীকে খুঁজে বার করতে হবে।’

‘কাজেই।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু বিমল, হতভাগ্য মিঃ মর্টনের মৃত্যুর ব্যাপারে যে একটা অসম্ভব সত্য রয়েছে, সেটা তোমরা লক্ষ করেছ কি?’

—’কীরকম!’—বলেই বিমল খবরের কাগজখানা আবার তুলে নিলে। তারপর যেন আপন মনেই বিড়বিড় করে বললে, ‘ব্ল্যাক স্নেক—অর্থাৎ কেউটে সাপ!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। ব্ল্যাক স্নেক। আমরা যাকে বলি কেউটে সাপ। ব্ল্যাক স্নেক পাওয়া যায় কেবল ভারতে, আর আফ্রিকায়। ইংলন্ডে অ্যাডার ছাড়া আর কোনওরকম বিষধর সাপ নেই।’

কুমার বললে, ‘এই ডিসেম্বর মাসের দুর্জয় বিলিতি শীতে ইংলন্ডে অ্যাডার সাপও নিশ্চয় বাসার বাইরে বেরোয় না। ভারতের কেউটে সাপও এখানে এলে এখন নির্জীব হয়ে থাকতে বাধ্য।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘যথার্থ অনুমান করেছ। এমন অসম্ভব সত্যকে মানি কেমন করে? এ—খবরে নিশ্চয় কোনও গলদ আছে।’

বিমল গম্ভীরভাবে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, মর্টনের মৃত্যুসংবাদের মধ্যে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ আছে বটে।

তিন দিন পরে তারা ফরাসিদের বিখ্যাত শিল্পশালা দেখে পথের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে, এমন সময়ে শুনলে রাস্তা দিয়ে একটা কাগজওয়ালা ছোকরা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটছে—’লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক, লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক!’

কমল তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে একখানা কাগজ কিনে আনলে।

পথের ধারেই ছিল একটা রেস্তোরাঁ। বিমল সকলকে নিয়ে তার ভিতরে গিয়ে ঢুকল। তারপর, এক কোণের একটি টেবিল বেছে নিয়ে বসে বিনয়বাবুর হাতে কাগজখানা দিয়ে বললে, ‘আপনি ফরাসি ভাষা জানেন, কাগজখানা অনুগ্রহ করে আমাদের পড়ে শোনান। আমার সন্দেহ হচ্ছে, আজকেও এতে এমন কোনও খবর আছে যা আমাদের জানা উচিত।’

বিনয়বাবু কাগজের মধ্যে খুঁজে একটি জায়গা বার করে পড়তে লাগলেন :

লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক!

লন্ডন কি ভারত ও আফ্রিকার জঙ্গলে পরিণত হতে চলল? লন্ডনে ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব কি স্বপ্নেরও অগোচর নয়?

তিনদিন আগে আমরা হঠাৎ—বিখ্যাত এস. এস. বোহিমিয়ার কাপ্তেন মিঃ টমাস মর্টনের ব্ল্যাক স্নেকের দংশনে মৃত্যুর খবর দিয়েছি। কাল রাত্রে ওই জাহাজেরই দ্বিতীয় অফিসার মিঃ চার্লস মরিস আবার হঠাৎ মারা পড়েছেন। এবং তাঁরও মৃত্যুর কারণ ওই ভয়াবহ ব্ল্যাক স্নেক।

এ—বিষয়ে কোনও সন্দেহরই কারণ নেই। ইংলন্ডে সর্প—বিষ সম্বন্ধে সর্ব—প্রধান বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, মিঃ মরিসের মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখেছেন। লাশের কণ্ঠদেশে সর্প—দংশনের স্পষ্ট দাগ আছে। শবদেহ ব্যবচ্ছেদের পরে পরীক্ষা করে দেখা গিয়াছে যে, ব্ল্যাক স্নেকের বিষেই হতভাগ্য ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

এবং এ—ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে মিঃ মরিসের শয্যার তলায় একটি মৃত ব্ল্যাক স্নেকও পাওয়া গিয়াছে। এ—জাতের ব্ল্যাক স্নেক নাকি ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। সাপটার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত। খুব সম্ভব মিঃ মরিস মৃত্যুর আগে নিজেই ওই সাপটাকে হত্যা করেছিলেন।

পুলিশ এখন নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর অন্বেষণ করছে :

ক।। লন্ডনে কেমন করে ব্ল্যাক স্নেকের আগমন হল?

খ।। এস. এস. বোহিমিয়ার কাপ্তেন মিঃ টমাস মর্টনের বাসা থেকে দ্বিতীয় অফিসার মিঃ চার্লস মরিসের বাসার দূরত্ব সাত মাইল। মিঃ মর্টনকে যে—সাপটা কামড়েছিল, লন্ডনের মতো শহরের সাত মাইল পার হয়ে তার পক্ষে মিঃ মরিসকে দংশন করা সম্ভবপর নয়। তবে কি ধরতে হবে যে লন্ডনে একাধিক ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব হয়েছে? কেমন করে তারা এল? কেন এল?

গ।। অধিকতর আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই : মিঃ মর্টন ও মিঃ মরিস দুজনেই এস. এস. বোহিমিয়ার লোক। ব্ল্যাক স্নেক কি বেছে বেছে বোহিমিয়ার লোকদেরই দংশন করছে, না দৈবক্রমে এমন অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেছে?

সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, বোহিমিয়ার আটজন নাবিক নিরুদ্দেশ হবার পর যে দ্বিতীয় নৌকাখানা শৈলদ্বীপে গিয়েছিল, তার মধ্যে কেবল তিনজন লোক পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরের তলদেশে গিয়ে উঠেছিলেন। বাকি সবাই অত উঁচুতে উঠতে রাজি হননি। পূর্বোক্ত তিনজন হচ্ছেন কাপ্তেন মিঃ মর্টন, দ্বিতীয় অফিসার মিঃ মরিস ও তৃতীয় অফিসার মিঃ জর্জ ম্যাকলিয়ড। এখন তিনজনের মধ্যে কেবল মিঃ ম্যাকলিয়ডই জীবিত আছেন।

বোহিমিয়ার প্রত্যেক যাত্রীর—বিশেষত যাঁরা ওই শৈলদ্বীপে গিয়ে নেমেছিলেন তাঁদের—মনে বিষম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের ধারণা তাঁরা ওই দ্বীপ থেকে কোনও অজ্ঞাত অভিশাপ বহন করে ফিরে এসেছেন।

কিন্তু আমরা এই অদ্ভুত রহস্যের কোনওই হদিস পাচ্ছি না। কোথায় আটলান্টিক মহাসাগরের নব—আবিষ্কৃত এক অসম্ভব বিজন দ্বীপ, কোথায় আধুনিক সভ্যতার লীলাস্থল লন্ডন নগর, আর কোথায় সুদূর এশিয়ার ভারতবাসী ব্ল্যাক স্নেক! এই তিনের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বার করতে পারে, পৃথিবীতে এমন মস্তিষ্ক বোধহয় নেই। লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়ো বড়ো ডিটেকটিভদের মাথাও গুলিয়ে গিয়েছে।

প্রত্যেক মৃত্যুর মধ্যে যে কার্য ও কারণের সম্পর্ক থাকে, এখানে তার একান্ত অভাব।

মিঃ মর্টন ও মিঃ মরিস—দুজনেই রাত্রিবেলায় শয্যায় শায়িত বা নিদ্রিত অবস্থায় সর্প দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সাপ বিনা কারণে কেন তাঁদের আক্রমণ করলে? যদি ধরে নেওয়া যায়, এর মধ্যে এমন কোনও দুষ্ট ব্যক্তির হাত আছে, সে সাপ লেলিয়ে দিয়েছিল, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে—কেন লেলিয়ে দিয়েছিল? ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুতে তার কী লাভ? অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে, মৃত ব্যক্তিদের কারুর কোনও শত্রু নেই।

রহস্যময় শৈলদ্বীপ, রহস্যময় আটজন নাবিকের অন্তর্ধান, রহস্যময় এই কাপ্তেন ও দ্বিতীয় অফিসারের মৃত্যু এবং সবচেয়ে রহস্যময় হচ্ছে লন্ডনে ভারতবর্ষীয় ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব। এডগার অ্যালেনপো, গেবোরিও এবং কন্যান ডইলের উপন্যাসেও এমন যুক্তিহীন বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায় না।

কাগজ—পড়া শেষ করে বিনয়বাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা ছিল একরকম, হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর—একরকম। আমরা যাচ্ছিলুম কোনও নতুন দ্বীপের রহস্য আবিষ্কার করতে, কিন্তু এখন যে সমস্ত ব্যাপারটা গোয়েন্দাকাহিনির মতো হয়ে উঠছে।’

কুমার বললে, ‘আমার বিশ্বাস, আসল ব্যাপার ঠিকই আছে, এই নতুন ঘটনাগুলো তার শাখা—প্রশাখা ছাড়া আর কিছুই নয়!’

বিমল বললে, ‘আমারও তাই মত। কিন্তু বিনয়বাবু, আজকের কাগজে আর একটা নতুন তথ্য পাওয়া গেল। শৈলদ্বীপের পাহাড়ে, সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছিলেন কেবল তিনজন লোক। তাঁদের মধ্যে বেঁচে আছেন খালি মিঃ জর্জ ম্যাকলিয়ড। আমাদের এখন সর্বাগ্রে তাঁকেই খুঁজে বার করতে হবে, কারণ আপাতত দ্বীপের কথা তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।’

—’কিন্তু কেউটে সাপের কামড়ে বোহিমিয়ার এই যে দু—জন লোকের মৃত্যু, এ—সম্বন্ধে তোমার কী মত?’

বিমল ওয়েটারকে ডেকে খাবারের ‘অর্ডার’ দিয়ে বললে, ‘আপাতত আমি শুধু বিস্মিত হয়েছি। মিঃ ম্যাকলিয়ডের সঙ্গে দেখা না করে ওসব বিষয় নিয়ে ভেবে—চিন্তে কোনওই লাভ নেই।’

কুমার বললে, ‘কিন্তু, ঘটনা ক্রমেই যে—রকম গুরুতর হয়ে উঠেছে, আমাদের বোধহয় আর পারিতে বসে থাকা উচিত নয়।’

বিমল প্রবল পরাক্রমে ‘ওয়েটারে’র আনা খাবারের একখানা ডিশ আক্রমণ করে বললে, ‘এসো কুমার, এসো কমল, আসুন বিনয়বাবু। পেটে যখন আগুন জ্বলে তখন ডিশের খাবার ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত নয়।…আমাদের স্বদেশের কেউটে সাপ কেন বিলাতে বেড়াতে এসেছে, সেটা জানবার জন্যে আমরা কালকেই লন্ডনে যাত্রা করব।’

বিমলরা সদলবলে যখন লন্ডনে এসে হাজির হল তখন দিনের বেলাতেও কুয়াশায় চারিদিক অন্ধকার এবং ঝুর ঝুর করে ঝরছে বরফের গুঁড়ো। পথে পথে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে যে জনতা—প্রবাহ ছুটছে, তাদের কিন্তু সেদিকে একটুও দৃষ্টি নেই। যেন তারা কুয়াশা ও তুষারেরই নিজস্ব জীব!

শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বিনয়বাবু ওভারকোটের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বিমলভায়া, বুঝতে পারছ কি, আমাদের ভারতীয় ‘নেটিভ’ আত্মার ভিতরে এখন খাঁটি বিলিতি জনবুলের আত্মা ধীরে ধীরে ঢুকছে? অনেক ভারতবাসী আজকাল এইটে অনুভব করার পর দেশে গিয়ে নিজেদের আর ‘নেটিভ’ বলে মনে করে না।’

কুমার দাঁতের ঠকঠকানি কোনওরকমে বন্ধ করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললে, ‘আত্মার উপরে যারা বিলিতি তুষারপাত সহ্য করে, যম তাদের গ্রহণ করুক! যে দেশের উপরে সূর্য আর চন্দ্রের দয়া এত কম, আমি তাকে ভালো দেশ বলে মনে করি না! বেঁচে থাক ভারতের নীলাকাশ, সোনালি রোদ, রুপোলি জ্যোৎস্না আর মলয় হাওয়া, তাদের ছেড়ে এখানে এসে কে থাকতে চায়?’

এমনকী বাঘার ল্যাজ পর্যন্ত থেকে থেকে কুঁকড়ে না পড়ে পারছে না।

সেদিন সকলে মিলে হোটেলের ‘ফায়ার—প্লেসে’র সামনে বসে বসে বিলাতি শীতের প্রথম ধাক্কাটা সামলাবার চেষ্টা করলে!

পরদিনেও সূর্যের দেখা নেই, উলটে গোদের উপরে বিষ—ফোড়ার মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তারই ভিতরে বিমল, কুমার ও বিনয়বাবু রেন—কোট চড়িয়ে এস. এস. বোহিমিয়ার লন্ডনের আপিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।

বিনয়বাবু বললেন, ‘স্বদেশ কী মিষ্টি! এমন দেশ ছেড়ে ভারতে যেতেও সায়েবদের নাকি মন কেমন করে!’

বিমল বললে, ‘হ্যাঁ, সাহারার অগ্নিকুণ্ডকেও বেদুইনরা স্বর্গ বলেই ভাবে।’

এমনি সব কথা কইতে কইতে সকলে গন্তব্যস্থলে এসে উপস্থিত হল! সেখান থেকে খবর পাওয়া গেল যে, মিঃ জর্জ ম্যাকলিয়ডের ঠিকানা হচ্ছে,—নং হোয়াইটহল কোর্ট।

তারা একখানা ট্যাক্সি নিলে। তারপর চারিদিকের বৃষ্টিস্নাত কুয়াশার প্রাচীর ঠেলে ঠেলে ট্যাক্সি হোয়াইটহল কোর্টের এক জায়গায় দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বিমলরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বাড়ির নম্বর খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেল।

কয়েক পদ অগ্রসর হয়েই দেখা গেল, একখানা বাড়ির সামনে অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক লোকের মুখেই ভয়ের চিহ্ন ফুটে রয়েছে এবং ভিড় ক্রমেই বেড়ে উঠছে।

পথের মাঝখানে একখানা বড়ো মোটরগাড়ি, তার উপরে বসে আছে দুজন কনস্টেবল। ভিড়ের ভিতরেও কয়েকজন কনস্টেবল রয়েছে, তারা বেশি—কৌতূহলী লোকদের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।

জনতার অধিকাংশ লোকই কিছুই জানে না, তাদের জিজ্ঞাসা করেও বিমলরা কিছুই আবিষ্কার করতে পারলে না।

বিনয়বাবু বললেন, ‘জনতার ধর্ম সব দেশেই সমান, পথের লোক ভিড় দেখলে ভিড় আরও বাড়িয়েই তোলে! বিমল, কিছু জানতে চাও তো ওই কনস্টেবলদের কাছে যাবার চেষ্টা করো!’

বিমল উত্তেজিত জনতার ভিতর দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে অনেক কষ্টে অগ্রসর হল। বাড়ির নম্বর দেখে বুঝলে, তারা সেই নম্বরই খুঁজছে। একজন কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘মি. জর্জ ম্যাকলিয়ড কি এই বাড়িতে থাকেন?’

—’হ্যাঁ! কিন্তু কাল রাত্রে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’

বিমল স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর শুধোলে, ‘কী করে তাঁর মৃত্যু হল?’

কনস্টেবল তার দিকে সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করে বললে, ‘আপনি কি ভারতবাসী?’

—”হ্যাঁ।”

—’তাহলে শুনুন। আপনাদেরই দেশের ব্ল্যাক স্নেক এসে মিঃ ম্যাকলিয়ডকে দংশন করেছে। ভারতবর্ষ তার ব্ল্যাক স্নেককে নিয়ে নরকে গমন করুক!’

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – গোমেজের প্রবেশ

তিনদিন পরের কথা। ঘড়ি দেখে বলা যায় এখন বৈকালী চা পানের সময়; কিন্তু লন্ডনের অন্ধকার—মাখা আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, এদেশে ঘড়ি তার কর্তব্যপালন করে না।

একখানা নিচু ও বড়ো ‘চেস্টারফিল্ডের’ উপরে বসে বিনয়বাবুর সঙ্গে কুমার চা ও স্যান্ডউইচের সদ্ব্যবহার করছিল। কমল শীতে কাবু হয়ে ‘রাগ’ মুড়ি দিয়ে বিছানায় পড়ে আছে, চা ও স্যান্ডউইচ দেখেও সে গরম বিছানা ছাড়তে রাজি হয়নি।

বিনয়বাবু একবার উঠলেন। ‘ফ্রেঞ্চ—উইন্ডোর’ ভিতর দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে হতাশভাবে বললেন, ‘লন্ডনে এসে পর্যন্ত সূর্যদেবের মুখ দেখলুম না, বিলিতি চন্দ্রকিরণ কী—রকম তাও জানলুম না, অথচ বিলিতি কবিতায় চন্দ্র—সূর্যের গুণগান পড়া যায় কত! কবিরা সব দেশেই মিথ্যাবাদী বটে, কিন্তু বিলিতি কবিরা এ—বিষয়ে দস্তুরমতো টেক্কা মেরেছেন।’

কুমার তৃতীয় ‘স্যান্ডউইচ’খানা ধ্বংস করে বললে, ‘যে দেশে যার অভাব, তারই কদর হয় বেশি!’

বিনয়বাবু আবার আসন গ্রহণ করে বললেন, ‘কিন্তু বিমল এখনও ফিরে এল না! সেই কোন সকালে সে বেরিয়েছে, সন্ধ্যা হতে চলল, এখনও তার দেখা নেই!’

কুমার নিশ্চিন্তভাবে চতুর্থ ‘স্যান্ডউইচে’ মস্ত এক কামড় বসিয়ে বললে, ‘বিমল যখন ফেরেনি তখন বেশ বোঝা যাচ্ছে তার যাত্রা সফল হয়েছে! হবে না কেন? কলকাতার পুলিশ কমিশনার সাহেব যে—রকম উচ্চ প্রশংসা করে তাকে পরিচয়—পত্র দিয়েছেন, তা পড়ে এখানকার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্তারা নিশ্চয়ই বিমলকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত হবেন!’

বলতে বলতে কুমার আবার পঞ্চম ‘স্যান্ডউইচে’র দিকে হাত বাড়াচ্ছিল, কিন্তু বিনয়বাবু বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘থামো কুমার, থামো! তুমি ভুলে যাচ্ছ, এখনও ‘ডিনারে’র সময় হয়নি! অনেকে মনে করে বেশি খাওয়া বাহাদুরি, কিন্তু আমি মনে করি বেশি খাওয়া অসভ্যতা! সামনে যতক্ষণ খাবার থাকবে ততক্ষণই মুখ চলবে, এটা হচ্ছে পশুত্বের লক্ষণ!’

কুমার অপ্রস্তুত স্বরে বললে, ‘কী করব বিনয়বাবু, বরফমাখা বিলিতি শীত যে আমার জঠরে রাক্ষুসে খিদে এনে দিয়েছে!’

বিনয়বাবু ডাকলেন, ‘আয় রে বাঘা আয়!’

পশমি জামা গায়ে দিয়ে বাঘা তখন খাটের তলার সবচেয়ে অন্ধকার কোণে কুঁকড়ে পিছনের পায়ের তলায় মুখ গুঁজে দিব্য আরামে ঘুম দিচ্ছিল। হঠাৎ কেন তার ডাক পড়ল বুঝতে না পেরে বাঘা মুখ তুলে অত্যন্ত নারাজের মতো বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলে।

কুমারের লোভী চোখের সামনে ডিশের উপর তখনও দুখানা ‘স্যান্ডউইচ’ অক্ষত অবস্থায় আক্রান্ত হবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেই দুখানা তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে বিনয়বাবু বললেন, ‘বাঘা, আমার হাতে কী, দেখছিস?’

বাঘা দেখতে ভুল করলে না। শীতের চেয়ে খাবার বড়ো বুঝে সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, তারপর একটা ডন দিলে, এবং তারপর দুইলাফে একেবারে বিনয়বাবুর কাছে এসে হাজির হল এবং সঙ্গে সঙ্গে কুমারের মুখের গ্রাস বাঘার মুখের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কুমার জুল—জুল করে খানিকক্ষণ বাঘার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, ‘নিরেট খাবার যখন অদৃশ্য হল, তখন তরল জিনিসই উদরস্থ করা যাক’—এই বলে সে পেয়ালায় দ্বিতীয়বার চা ঢালতে লাগল।

বিনয়বাবু বললেন, ‘কুমার, আমাদের সঙ্গে সেই দ্বীপে যাবার জন্যে, পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে রোজ কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তবু তো ‘বোহিমিয়া’র কোনও নাবিক—ই আজ পর্যন্ত দেখা দিলে না।’

কুমার বললে, ‘তার জন্যে দায়ী ওই তিনটি লোকের মৃত্যু। ‘বোহিমিয়া’র প্রত্যেক নাবিক—ই এখন ব্ল্যাক স্নেকের ভয়ে আধমরা হয়ে আছে।’

এমন সময়ে দরজার পর্দা ঠেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে বিমল।

কুমার বলে উঠল, ‘এই যে বিমল! এতক্ষণ কোথায় ছিলে, কী করছিলে?’

বিমল তার ওভারকোটটা খুলতে খুলতে বললে, ‘কী করছিলুম? স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকডিভ—ইনস্পেকটার ব্রাউনের সঙ্গে শার্লক হোমসের ভূমিকা অভিনয় করছিলুম!’

—’তোমার হাসি—হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে অভিনয়ে তুমি সফল হয়েছ!’

—’খনিকটা হয়েছি বইকী। সেই ‘অমাবস্যার রাতে’র ব্যাপারেই তো তুমি জানো, গোয়েন্দাগিরিতেও আমি খুব—বেশি কাঁচা নই!……কিন্তু আপাতত তুমি হোটেলের চাকরকে ডাকো। ঘটনা—প্রবাহে পড়ে সকাল থেকে দাঁতে কিছু কাটবার সময় পাইনি, উদরে দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা হই হই করছে! চা, গরম ‘টোস্ট’ আর ‘আসপারাগোস ওমলেটের’ অর্ডার দাও!’

কুমার ভয়ে ভয়ে বিনয়বাবুর মুখের পানে তাকিয়ে বললে, ‘কেবলই কি তোমার জন্যে ভাই? না, আমাদের জন্যেও ছিটেফোঁটা কিছু আসবে?’

বিনয়বাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমাদের মানে? আমি আর কিছু চাই না,—আমি তোমার মতো রাক্ষস নই!’

কুমার নির্লজ্জের মতো বললে, ‘আমিও রাক্ষসত্বের দাবি করি না, তবু আরও কিছু খেতে চাই!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘খাও, খাও—যত পারো খাও! তুমি ব্রহ্মাণ্ডকে গপ করে গিলে ফেললেও আমি আর টুঁ শব্দ করব না!’

কুমার হাসতে হাসতে খাবারের ‘অর্ডার’ দিয়ে এল।

বিমল একখানা ইজিচেয়ারের উপরে শুয়ে পড়ে বললে, ‘বিনয়বাবু, এই ব্ল্যাক স্নেকের বাপারটা বড়োই রহস্যময় হয়ে উঠেছে। গোড়া থেকেই আমরা লক্ষ করেছি, এই তিনটে ঘটনার মধ্যে কতকগুলো অসম্ভব বিশেষত্ব আছে। এক : তিনজন মৃত ব্যক্তিই এস. এস. বোহিমিয়ার লোক। দুই : যে তিন ব্যক্তি সেই অজানা দ্বীপের পাহাড়ে সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছিলেন, মারা পড়েছেন কেবল তাঁরাই। তিন : ভারতের কেউটে সাপ বিলাতে। চার : ইংলন্ডের প্রচণ্ড শীতেও কেউটে সাপের দৌরাত্ম্য। পাঁচ : যাঁরা মারা পড়েছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই বাড়ি পরস্পরের কাছ থেকে অনেক মাইল তফাতে আছে, অথচ সবাই মরেছেন কেউটের বিষে। সুতরাং এসব কীর্তি একটা সাপের নয়। ছয় : কেউটের আবির্ভাব সম্বন্ধেও কোনও সন্দেহ নেই, কারণ মিঃ চার্লস মরিসের শয়নগৃহে একটা মৃত সাপও পাওয়া গিয়ছে।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘ঘটনাগুলো এমন অসম্ভব যে, মনে সত্যি সত্যি কুসংস্কারের উদয় হয়! কোনও রহস্যময় হিংস্র অপার্থিব শক্তিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। সেই শক্তি যেন অজানা দ্বীপে মানুষের পদক্ষেপ পছন্দ করে না। যারাই সেখানে গিয়েছে, সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ অদৃশ্য শক্তির অভিশাপ বহন করে ফিরে এসেছে।’

বিমল একখানা ‘টোস্ট’ ভাঙতে ভাঙতে বললে, ‘আমি কিন্তু গোড়া থেকেই কোনও অদৃশ্য শক্তিকে বিশ্বাস করিনি।’

—’তবে কি তুমি এগুলোকে দৈব—দুর্ঘটনা বলে মনে করো?’

কুমার বললে, ‘দৈব—দুর্ঘটনার মধ্যে এমন একটা ধারা থাকে না। এখানে প্রত্যেক ঘটনার মধ্যে যেন কোনও কুচক্রীর একটা বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে।’

বিমল বলল, ‘ঠিক বলেছ। আমিও ওই সূত্র ধরেই সমস্ত খোঁজখবর নিয়েছি। ডিটেকটিভ—ইনস্পেকটার ব্রাউনের সঙ্গে আমি আজ তিনটে মৃতদেহই পরীক্ষা করেছি, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা কয়েছি, এমনকী যে ডাক্তার শবব্যবচ্ছেদ করেছেন তাঁর মতামত নিতেও ভুলিনি।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই একটা সিদ্ধান্তে এসে উপস্থিত হয়েছ?’

—’হ্যাঁ। এর মধ্যে কোনও অদৃশ্য শক্তির অভিশাপও নেই, এগুলো দৈব—দুর্ঘটনাও নয়!’

—’তবে?’

—’শুনুন, একে একে বলি। ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির দেহে সাপের বিষ পাওয়া গিয়েছে, তাঁদের দেহে সর্পদংশনের স্পষ্ট চিহ্ন আছে। কিন্তু মিঃ চার্লস মরিসের বাড়িতে গিয়ে আমি এক বিচিত্র আবিষ্কার করেছি। ওঁরই খাটের তলায় একটা ক্ষতবিক্ষত মৃত কেউটে সাপ পাওয়া গিয়েছিল। ডিটেকটিভ ব্রাউনের মতে, মিঃ মরিস নিজে মরবার আগে সাপটাকে হত্যা করেছিলেন। অসঙ্গত এ মত নয়। কিন্তু আমার প্রশ্নে প্রকাশ পেল যে, ক্ষতবিক্ষত সাপটা খাটের তলায় মরে পড়েছিল বটে, কিন্তু ঘরের কোথাও একফোঁটা রক্তের দাগ পাওয়া যায়নি! সাপের দেহের রক্ত কোথায় গেল? ডিটেকটিভ ব্রাউন আমার এই আবিষ্কারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তখনই মৃত সাপটাকে শবব্যবচ্ছেদাগারে মিঃ মরিসের লাশের কাছে নিয়ে যাওয়া হল! লাশের গলায় সাপের দাঁতের দাগ ছিল। মরা সাপের দাঁতের সঙ্গে সেই দাগ মিলিয়ে দেখা গেল, মিঃ মরিস মোটেই সাপটার কামড়ে মারা পড়েননি, তাঁকে অন্য কোনও সাপ কামড়েছে!…এখন বুঝে দেখুন বিনয়বাবু, ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! প্রথমত, মিঃ মরিসের ঘরে কি তবে একসঙ্গে দুটো কেউটে সাপ ঢুকেছিল? একটা তাঁকে কামড়ে পালিয়েছে, আর একটাকে তিনি নিজেই হত্যা করেছেন? কিন্তু লন্ডনে একসঙ্গে দুটো কেউটের উদয় একেবারেই আজগুবি ব্যাপার! উপরন্তু, মিঃ মরিস সাপটাকে মারলে ঘরের ভিতরে নিশ্চয়ই তার রক্ত পাওয়া যেত। দ্বিতীয়ত, সাপটাকে তাহলে নিশ্চয়ই কেউ আগে বাইরে কোথাও বধ করে ঘটনাস্থলে তার দেহটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কেন? পুলিশের মনে ভ্রম বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যে! তাহলেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এই তিন তিনটে হত্যার মূলে আছে এক বা একাধিক মানুষ! আমার এই অভাবিত আবিষ্কারে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে মহাচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ওখানকার প্রধান কর্তা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, ”ধন্য আপনার সূক্ষ্ম বুদ্ধি। আমাদের শিক্ষিত ডিটেকটিভরা এতদিন গোলকধাঁধায় পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, আপনিই তাদের পথ বাতলে দিলেন। এখন বেশ বুঝতে পারছি যে কোনও সুচতুর মানুষই কেউটে সাপের সাহায্যে এই তিনটে নরহত্যা করেছে!”—এখন বলুন বিনয়বাবু, আমার অনুসন্ধান সফল হয়েছে কি না?’

বিনয়বাবু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমিও বলি, ধন্য বিমল। বাঙালির মস্তিষ্ক যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকেও মুগ্ধ করবে, এটা আমি কখনও কল্পনা করতে পারিনি।’

বিমল ভুরু কুঁচকে বললে, ‘কল্পনা করতে পারেননি! কেন? সামান্য ওই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, বাঙালির মস্তিষ্ক যে বারবার বিশ্বকেও অভিভূত করেছে! সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, চিত্রে অবনীন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, ধর্মে বিবেকানন্দ আধুনিক পৃথিবীতে বাঙালির নাম যে সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন! এই সেদিনও বাংলার আঠারো বছরের মেয়ে তরু দত্ত বিলিতি সাহিত্যেও চিরস্মরণীয় কিরণ বিতরণ করে গেছেন! আগেকার কথা না—হয় আর তুললুম না। তবে শ্রীচৈতন্যের মতন ধর্মবীর পৃথিবীর যে কোনও দেশকে অমর করতে পারতেন! এমনকী জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু বুদ্ধদেবকে নিয়েও আমরা গর্ব করতে পারি, কারণ বুদ্ধদেবও জন্মেছিলেন বাংলারই সীমান্তে!

বিনয়বাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বিমল, তুমি শান্ত হও,—আমি অপরাধ স্বীকার করছি! হ্যাঁ, আমিও মানি, বাঙালি হয়ে জন্মেছি বলে আমরা সারা পৃথিবীতে গর্ব করতে পারি!’

বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে চা পান করতে লাগল। তারপর বললে, ‘বিনয়বাবু, আমি আর একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি।’

—’কী?’

—’খবরের কাগজের রিপোর্টেই দেখেছেন তো, বোহিমিয়ার কাপ্তেন মিঃ টমাস মর্টন সেই অজানা দ্বীপ ছেড়ে চলে আসতে রাজি ছিলেন না! জাহাজের লোকেরাই তাঁকে দেশে ফিরতে বাধ্য করেছিল। মর্টন সাহেবের পুরাতন ভৃত্যকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছি, তিনি নাকি আবার সেই দ্বীপে যাবার বন্দোবস্ত করছিলেন, আর তাঁর সঙ্গে যেতেন মিঃ চার্লস মরিস আর মিঃ জর্জ ম্যাকলিয়ড।’

—’কেন?’

—’সেইটেই তো হচ্ছে প্রশ্ন। ওঁদের উদ্দেশ্য ছিল যে কেবল সেই আটজন নিরুদ্দেশ নাবিকের খোঁজ করা, আমার তা মনে হয় না। আরও দেখা যাচ্ছে, কেবল যে তিনজন লোক দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু শৈলশিখরে গিয়ে উঠেছিলেন, দ্বিতীয়বার দ্বীপে যাচ্ছিলেন তাঁরাই। এর মানে কী?’

কুমার বললে, ‘আরও একটা প্রশ্ন আছে। কেউটের কামড়ে মৃত্যুও হয়েছে কেবল ওই তিনজন লোকের। এরই বা অর্থ কী? বিমল প্রমাণিত করেছে যে, এইসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মানুষের হাত আছে। কিন্তু সে মানুষ কে? বোহিমিয়ার যে—তিনজন কর্মচারী আবার দ্বীপে যাবার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের হত্যা করে তার কী স্বার্থসিদ্ধি হবে?’

বিমল বললে, ‘কুমার তুমি বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করেছ। আজ হাইড পার্কে বসে, পুরো দু—ঘণ্টা ধরে আমিও এইসব প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজবার চেষ্টা করেছি। গোয়েন্দার কাজ সত্য তথ্য নিয়ে বটে, কিন্তু সব কাজের মতো গোয়েন্দাগিরির ভিতরেও কল্পনা—শক্তির দরকার আছে যথেষ্ট।……ধরো, তুমি, আমি আর বিনয়বাবু বোহিমিয়ার কাপ্তেন মর্টন, প্রথম ‘মেট’ মরিস আর দ্বিতীয় ‘মেট’ ম্যাকলিয়ডের স্থান গ্রহণ করলুম। ঝড়ের পরদিন নিরুদ্দেশ নাবিকদের খুঁজতে খুঁজতে আমরা দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু শৈলশিখরে উঠছি। জাহাজের অন্যান্য লোকেরা নীচে অপেক্ষা করছে। আমরা নাবিকদের কোথাও খুঁজে পাইনি। দ্বীপে কাল রাত্রে যারা আলো জ্বেলেছিল তারাও অদৃশ্য। সুতরাং মনে মনে বেশ বুঝতে পারছি যে, এই দ্বীপের মধ্যে কোনও একটা গভীর রহস্য আছে। কারণ পৃথিবী হঠাৎ দ্বিধা—বিভক্ত হয়ে এতগুলো লোককে গিলে ফেলেনি। হয়তো এই দ্বীপে বোম্বেটের গোপনীয় রত্নগুহা আছে। হয়তো আমরা তিনজনে তারই কোনও প্রমাণ দেখতে পেলুম। তখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে স্থির করলুম, এ—কথা জাহাজের আর কারুর কাছে প্রকাশ করা হবে না। পরে কোনও সুযোগে দ্বীপে আবার এসে সমস্ত গুহা লুণ্ঠন করে টাকাকড়ি ভাগ করে নিলেই চলবে। এইভাবে আমরা সেদিনের মতো ফিরে এলুম। কিন্তু জাহাজের কুসংস্কার—ভীত নাবিক আর যাত্রীদের বিরুদ্ধতায় সে—যাত্রায় আর কোনও সুযোগ পাওয়া গেল না। তাই বিলাতে এসে আবার নতুন জাহাজ নিয়ে অদৃশ্য নাবিকদের খুঁজতে যাবার অছিলায় আমরা সেই দ্বীপে যাত্রা করবার ব্যবস্থা করতে লাগলুম। ইতিমধ্যে যে উপায়েই হোক আর এক ব্যক্তি আমাদের গুপ্তকথা জানতে পারলে। খুব সম্ভব, এ ব্যক্তিও বোহিমিয়া জাহাজের কোনও নাবিক বা যাত্রী। হয়তো জাহাজে বসে আমরা কোনওদিন যখন পরামর্শ করছিলুম, আড়াল থেকে সে কিছু—কিছু শুনতে পেয়েছিল। এখন তার প্রধান কাজ কী হবে? তার পথ থেকে জন্মের মতো আমাদের তিনজনকে সরিয়ে দেওয়া নয় কি?’

কুমার খানিকক্ষণ ভেবে বললে, ‘বিমল, তুমি মনে মনে যে কল্পনা করেছ, তার ভিতরে সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় বটে! তবু বলতে হবে, এ তো কল্পনা।’

বিমল বললে, ‘কিন্তু স্বাভাবিক কল্পনা। আসল ব্যাপারের সঙ্গে আমার কল্পনা হয়তো হুবহু মিলবে না, কিন্তু আমার হাতে যদি সময় থাকত তা হলে নিশ্চয়ই প্রমাণিত করতে পারতুম যে, এই কল্পনার মধ্যে অনেকখানি সত্যই আছে।……কিন্তু আমি গোয়েন্দাগিরি করতে বিলাতে আসিনি, এসব ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। হ্যাঁ, ভালো কথা। আজকেও দ্বীপে যাবার জন্যে ‘বোহিমিয়া’র কোনও নাবিক আমাদের বিজ্ঞাপনের আহ্বানে উত্তর দেয়নি?’

কুমার মাথা নেড়ে জানালে, না।

বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, তাহলে তোমার মতে, ‘বোহিমিয়া’র কোনও লোকই এইসব হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী?’

বিমল বললে, ‘হতেও পারে, না হতেও পারে। সবই আমার অনুমান। আর এ অনুমান যদি সত্য হয়, তবে এটাও ঠিক জানবেন যে, সে আমাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না।’

—’কেন?’

—’তার পথ থেকে সব কাঁটা সরে গেছে। তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এখন, সেই দ্বীপে যাওয়া। কিন্তু সে দ্বীপে জাহাজ লাগে না। সুতরাং আমাদের জাহাজ সেখানে যাচ্ছে শুনলে সে কখনও এমন সুযোগ ছেড়ে দেবে না।’

এমন সময়ে রামহরি ঘরে ঢুকে বললে, ‘খোকাবাবু, একটা সায়েব তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সায়েব বটে, কিন্তু রং খুব ফরসা নয়!’

—’তাকে এখানে নিয়ে এসো।’

একটু পরেই যে—লোকটি ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল, সত্যসত্যই তার গায়ের রং শ্যামল। লোকটি মাথায় লম্বা নয় বটে, কিন্তু চওড়ায় তার দেহ অসাধারণ—এত চওড়া লোক অসম্ভব বললেও চলে। দেখলেই বোঝা যায়, তার গায়ে অসুরের শক্তি আছে। লোকটির মাথায় একগাছা চুলও নেই, ছোটো ছোটো তীক্ষ্ন চোখ, থ্যাবড়া নাক, ঠোঁটের উপরে প্রকাণ্ড একজোড়া গোঁফ।

ঘরে ঢুকেই সে বললে, ‘কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে আমি এখানে এসেছি।’

বিমল আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলে, ‘আপনি কি সেই অজনা দ্বীপে যেতে চান?’

—’হ্যাঁ।’

—’আপনার নাম?’

—’বার্তোলোমিও গোমেজ। আমি এস. এস. বোহিমিয়ার কোয়ার্টার মাস্টারের কাজ করতুম।’

বিমল, কুমার ও বিনয়বাবুর দৃষ্টি চমকে উঠল!

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অনাহূত অতিথি

বোহিমিয়া জাহাজের ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ বার্তোলোমিও গোমেজ! বিমলদের সঙ্গে সেই অজানা দ্বীপে যেতে চায়!

আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ এইরকম একটি লোকের জন্যেই বিমলরা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, প্রচুর পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে। এবং এইরকম একটি লোক না পেলে তাদের পক্ষে যথেষ্ট অসুবিধা হবারই কথা!

কিন্তু বিমল যে—সময়ে বলছিল যে, বোহিমিয়ার তিনটি লোকের মৃত্যুর জন্যে ওই জাহাজেরই কোনও লোক দায়ী এবং হত্যাকারী তাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না, ঠিক সেই সময়েই গোমেজের অভাবিত আবির্ভাবে তাদের পক্ষে না চমকে থাকা অসম্ভব! এমনকী শয্যাশায়ী কমলও ‘রাগে’র ভিতর থেকে মুখ বার করে গোমেজকে একবার ভালো করে দেখে নিলে। এস এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে বিমলের মতামত শ্রবণ করছিল।

সে—চমকানি গোমেজের চোখেও পড়ল। সে দুই ভুরু কুঁচকে একে একে সকলের মুখের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিপাত করলে। তারপর বললে, ‘আমাকে দেখে আপনারা বিস্মিত হলেন নাকি?’

বিমল তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ মিঃ গোমেজ, আমরা একটু বিস্মিত হয়েছি বটে! আপনার নামটি হচ্ছে পর্তুগিজ, কিন্তু আপনার গায়ের রং আমাদের চেয়ে ফর্সা নয়! এটা আমরা আশা করিনি!’

তখন গোমেজের বাঁকা ভুরু আবার সোজা হল। সে হো হো করে হেসে উঠে বললে, ‘ওঃ, এইজন্যে? কিন্তু আমারও জন্ম যে ভারতবর্ষেই! আমি আগে গোয়ায় বাস করতুম।’

—’বটে, বটে? তাহলে আপনি তো আমাদের ঘরের লোক! আরে, এত কথা কি আমরা জানি? বসুন মিঃ গোমেজ, বসুন! এক পিয়ালা চা পান করবেন কি?’

—’না, ধন্যবাদ! আমার হাতে আজ বেশি সময় নেই। আমি একেবারেই কাজের কথা পাড়তে চাই! আপনারা আটলান্টিক মহাসাগরের সেই নির্জন দ্বীপে যেতে চান কেন?’

—’কোথাও কোনও বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পেলে আমরা সেখানে না গিয়ে পারি না। এটা আমাদের অনেকদিনের বদ—অভ্যাস। এই বদ—অভ্যাসের জন্যে আমরা একবার মঙ্গল গ্রহেও না গিয়ে পারিনি।’

—’কী বললেন? কোথায়?’

—’মার্স—এ!’

গোমেজ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললে, ‘মার্স—এ? আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন নাকি?’

—’মোটেই নয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আমরা সত্যসত্যই মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিলুম। সে কাহিনি পৃথিবীর সব দেশের খবরের কাগজেই বেরিয়েছিল। আপনি কি পড়েননি?’*

—’না। আমরা নাবিক মানুষ, জলের জগতেই আমাদের দিন কেটে যায়, খবরের কাগজের ধার ধারি না। বিশেষ ১৯১৪ হচ্ছে মহাযুদ্ধের বৎসর, তখন যুদ্ধের হই—চই নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলুম।’

—’আচ্ছা, আমাদের কাছে পুরানো খবরের কাগজগুলো এখনও আছে, আপনাকে পড়তে দেব অখন।’

—’দেখছি, আপনারা হচ্ছেন আশ্চর্য, অসাধারণ মানুষ!….তাহলে আপনাদের বিশ্বাস, ওই অজানা দ্বীপে কোনও বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে?’

গোমেজের মুখের দিকে তীক্ষ্ন চোখে চেয়ে কুমার বললে, ‘মিঃ গোমেজ, আপনিও কি বিশ্বাস করেন না যে, সেই দ্বীপে কোনও অদ্ভুত রহস্য আছে?’

গোমেজ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘অদ্ভুত রহস্য বলতে আপনারা কী বোঝেন, বলতে পারি না। রহস্য মাত্রই অদ্ভুত নয়।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘আটলান্টিকের মাঝখানে হঠাৎ ওই দ্বীপের আবির্ভাব কি অদ্ভুত নয়?’

—’মোটেই নয়। আটলান্টিকের মাঝখানে এর আগেও ওই—রকম জলমগ্ন দ্বীপ হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেছে। আটলান্টিক ঠান্ডা শান্ত সমুদ্র নয়। যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন, আটলান্টিকের পেটের ভিতরে এত ওলট—পালট হচ্ছে যে, যখন—তখন সে ছোটো ছোটো অজানা দ্বীপের জন্ম দিতে পারে।’

—’কিন্তু সেই জনহীন দ্বীপে রাত্রে আলো নিয়ে কারা চলা—ফেরা করছিল?’

—’আমার বিশ্বাস, চোখের ভ্রমেই আমরা আলো দেখেছিলুম।’

—’আপনাদের আটজন নাবিক সেই দ্বীপ থেকে কোথায় অদৃশ্য হল?’

—’কে বলতে পারে যে, তারা কোনও গুপ্ত গহ্বরে পড়ে যায়নি?’

—’সেই দ্বীপে আপনারা অনেক বিরাট প্রস্তরমূর্তি দেখেননি?’

—’দেখেছি। দ্বীপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কেবল সেই মূর্তিগুলোই। তাছাড়া সেখানে দেখবার আর কিছুই নেই। এমনকী একফোঁটা জল পর্যন্ত নেই! সেখানে দু—চারদিনের বেশি বাস করাও সম্ভব নয়!’

—’মিঃ গোমেজ, তাহলে আপনি কি আমাদের সেখানে যেতে মানা করছেন?’

গোমেজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না! যেতে আমি কারুকেই মানা করছি না! তবে আমার কথা হচ্ছে, দ্বীপে গিয়ে আপনারা কোনও অদ্ভুত রহস্য দেখবার আশা করবেন না।’

বিমল বললে, ‘মিঃ গোমেজ, আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি। আপনি বলছেন, দ্বীপে কোনও রহস্য নেই। তবে মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড সাহেব আবার সেই দ্বীপে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন কেন?’

সচকিত কণ্ঠে গোমেজ বললে, ‘তাই নাকি? কেমন করে জানলেন আপনি?’

—’যেমন করেই হোক, আমি জেনেছি!’

—’কিন্তু আমি জানি না। হয়তো তাঁরা সেই নিরুদ্দেশ নাবিকদের খোঁজেই আবার সেখানে যাচ্ছিলেন।’

—’হতেই পারে মিঃ গোমেজ, হয়তো এটাও আপনার জানা নেই যে, পাছে তাঁরা আবার সেই দ্বীপে যান সেই ভয়ে কেউ তাঁদের খুন করেছে!’

গোমেজ চমকে উঠল। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘আপনি কী বলছেন? সবাই তো জানে, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে ব্ল্যাক স্নেকের কামড়ে!’

—’হ্যাঁ, ভারতীয় ব্ল্যাক স্নেক! কিন্তু মিঃ গোমেজ, লন্ডনে হঠাৎ এত বেশি ব্ল্যাক স্নেক কেমন করে এল? যদি ধরা যায়, আপনার মতো কোনও ভারতবাসী বিলাতে শখ করে ব্ল্যাক স্নেক নিয়ে এসেছে, তা হলে বরং—’

বিমলকে বাধা দিয়ে গোমেজ সামনের কাচ—ঢাকা টেবিলের উপরে জোরে চড় মেরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, ‘মশাই, আমি সাপুড়ে নই! আমি সঙ্গে করে আনব ভারতের সর্বনেশে ব্ল্যাক স্নেক? উঃ, অদ্ভুত কল্পনা!’

বিমল সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ‘না, না, মিঃ গোমেজ! আমি আপনাকে কথার কথা বলছিলুম মাত্র, আপনার উপরে কোনওরকম অভদ্র ইঙ্গিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়!’

গোমেজ শান্ত হয়ে বললে, ‘দেখুন, পুলিশ কীরকম গাধা জানেন তো? অনুগ্রহ করে এ—রকম কথা আর মুখেও আনবেন না! পুলিশ যদি একবার এই কথা শোনে, তাহলে অকারণেই আমার প্রাণান্ত—পরিচ্ছেদ করে ছাড়বে! ও—প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে এখন কাজের কথা বলুন! আপনারা কবে সেই দ্বীপে যাত্রা করবেন?’

—’আমরা তো প্রস্তুত। একদিন কেবল বোহিমিয়ার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নাবিকের জন্যেই অপেক্ষা করে বসেছিলুম। এখন আপনাকে যখন পেয়েছি, তখন যে—কোনওদিন যেতে পারি!’

—’আমার কাছ থেকে আপনারা কী সাহায্যের প্রত্যাশা করেন?’

—’প্রথমত, আপনি দ্বীপের সমস্ত কথা সবিস্তারে বর্ণনা করবেন। খবরের কাগজে নিশ্চয়ই সব কথা প্রকাশ পায়নি। দ্বিতীয়ত, আমাদের জাহাজের পথপ্রদর্শক হবেন আপনি। তৃতীয়ত, গেল—বারে দ্বীপের যে যে জায়গায় গিয়ে আপনারা নাবিকদের খোঁজ করেছিলেন, আপনাকে সেসব জায়গা আবার আমাদের দেখাতে হবে। বিশেষ করে দেখতে চাই আমি দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরটা।’

—’কিন্তু সেখানটা তো আমি নিজেই দেখিনি। সেখানে উঠেছিলেন খালি মিঃ মর্টন, মিঃ মরিস আর মিঃ ম্যাকলিয়ড।’

—’হুঁ। আর সেইজন্যেই হতভাগ্যদের পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে! এ কথা পুলিশ জানে না, কিন্তু তাঁদের হত্যাকারী জানে, আর আমিও জানি!’

গোমেজ অবাক বিস্ময়ে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, ‘আপনার প্রত্যেক কথাই সেই দ্বীপের চেয়েও রহস্যময়।’

বিমল যেন আপন মনেই বললে, ‘দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরে গিয়ে উঠলেই সকল রহস্যের কিনারা হবে!’

গোমেজ হাসতে হাসতে বললে, ‘যদিও আমি সেখানে উঠিনি, তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে উঠে আপনি পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না! হতচ্ছাড়া সেই পাহাড়ে দ্বীপ! একটা জীব, একটা গাছ, একগাছা ঘাস পর্যন্ত সেখানে নেই! সমুদ্রের নীল গায়ে হঠাৎ যেন একটা কালো ফোড়ার মতো সে গজিয়ে উঠেছে! হ্যাঁ, আর একটা অনুমানও মন থেকে মোছবার চেষ্টা করুন। আমার সঙ্গীদের মৃত্যুর সঙ্গে সেই দ্বীপের বা কোনও মানুষ—হত্যাকারীর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, তাঁরা মারা পড়েছেন দৈব—গতিকে, ব্ল্যাক স্নেকের দংশনে!’

—’ও কথায় আপনি বিশ্বাস করুন, আমার বিশ্বাস অন্যরকম।’

এমন সময়ে ল্যাজ দুলিয়ে বাঘার প্রবেশ। গম্ভীরভাবে এগিয়ে এসে গোমেজের পদযুগল বার—কয়েক শুঁকে যে কী পরীক্ষা করলে তা কেবল সেই—ই জানে!

গোমেজ বললে, ‘ভারতের ব্ল্যাক স্নেক বিলাতে এসেছে বলে সবাই অবাক হচ্ছে, কিন্তু ভারতের দেশি কুকুরের বিলাত—দর্শনটাও কম আশ্চর্য নয়! আচ্ছা তাহলে উঠতে হয়! আপনাদের সঙ্গে আমার যাওয়ার কথাটা পাকা হয়ে রইল তো?’

—’নিশ্চয়! কাল সকালে অনুগ্রহ করে এসে নিয়োগ—পত্র নিয়ে যাবেন। আজ আমি বড়ো শ্রান্ত।’

—’উত্তম। নমস্কার।’

—’নমস্কার!’

গোমেজ প্রস্থান করল। বিমল একখানা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে দুই চোখ মুদলে।

কুমার বললে, ‘কী হে, তুমি এখনই ঘুমোবে নাকি?’

—’না, এখন আমি ভাবব।’

—’কী ভাববে?’

—’অতঃপর আমার কী করা উচিত? আগে এই হত্যারহস্যের কিনারা করব, না আগে দ্বীপের দিকে যাত্রা করব?’

কুমার বললে, ‘হত্যারহস্যের কিনারা করার জন্যে রয়েছে বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শত শত ধূর্ত লোক, তা নিয়ে তুমি—আমি ভেবে মরব কেন?’

বিমল বললে, ‘ভেবে মরব কেন? তুমি কি এখনও বুঝতে পারোনি যে, হত্যারহস্য আর দ্বীপরহস্য—এ দুটোই হচ্ছে একখানা ঢালের এ—পিঠে আর ও—পিঠে?’

কুমার একখানা চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসতে গেল, বিমল হঠাৎ চোখ খুলে ব্যস্ত স্বরে বললে, ‘তফাত যাও! আজ তোমরা কেউ এদিকে এসো না!’

কুমার হতভম্বের মতো বললে, ‘এদিকে আসব না? কেন?’

বিমল বিরক্তকণ্ঠে বললে, ‘কথায় কথায় জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই!….তারপর আরও শোনো। বাঘা আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে এই ঘরেই থাকবে। আজ যা শীত পড়েছে, বাইরে থাকলে পরে ওর কষ্ট হবে।’

লন্ডনের শীতার্ত রাত্রি। পথে জনপ্রাণীর পদশব্দ পর্যন্ত নেই—বাতাসও যেন শ্বাস রুদ্ধ করে আড়ষ্ট হয়ে আছে। চারিদিকে ঝর ঝর ঝর ঝর করে যেন তুষারের লাজাঞ্জলি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার আলোগুলোর চোখ ক্রমেই ঝিমিয়ে আসছে—দপ করে যেন নিবে যেতে পারলেই তারা বাঁচে।

গম্ভীর স্তব্ধতার অন্তরাত্মার মধ্যে যেন মুগুরের ঘা মেরে মেরে ‘বিগ বেন’ ঘড়ি তার প্রচণ্ড কণ্ঠে তিনবার চিৎকার করে উঠল—ঢং! ঢং! ঢং!

হোটেলে বিমলদের ঘরে এখন প্রধান অতিথি হয়েছে নিরন্ধ্র অন্ধকার। কয়েকটি নিশ্চিন্ত নিদ্রিত প্রাণীর ঘন ঘন শ্বাস—প্রশ্বাস ছাড়া সেখানেও আর জীবনের কোনও লক্ষণই নেই, জীবনের সাড়া দেবার চেষ্টা করছে কেবল একটি জড় পদার্থ! টেবিলের ঘড়িটার কোনও ক্লান্তি নেই, নীরবতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে—টিক টিক, টিক টিক, টিক টিক, টিক টিক!

আচম্বিতে আর—একটি শব্দ শোনা গেল। খুব আস্তে আস্তে যেন কোনও জানলার একটা শার্সি খুলে যাচ্ছে! জানলার কাছে অন্ধকারের ভিতরে যেন একটা তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে! কেমন একটা খুট খুট শব্দ হচ্ছে!

সে—শব্দ এত—মৃদু যে কোনও ঘুমন্ত মানুষের কানই তা শুনতে পেলে না।

কিন্তু শুনতে পেলে বাঘার কান! হঠাৎ যে গরর গরর করে গর্জে উঠল!

ডান হাতে রিভলভার তুলে বিমল দেখলে, জানলার কাছে শার্সির উপরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা স্তম্ভিত ও আড়ষ্ট মূর্তি! প্রকাণ্ড ওভারকোটে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা এবং তার মুখখানাও অদৃশ্য এক কালো মুখোশের আড়ালে!

* মৎপ্রণীত ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’ উপন্যাসে বিমল ও কুমার প্রভৃতির মঙ্গল—গ্রহে যাত্রার আশ্চর্য কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে।