নীল ঘরের নটী – ৯

।।নয়।।

আগের রাতে বাড়ি ছিল না দুর্গামোহন। তারপর সারাটি দিন গেল, ফেরার নাম নেই। অথচ রঘুকে বলে গেছে—’ভোরের দিকে ফিরব, দরজা খুলে দিবি তুই।’ আরও বলেছে—’ফিরতে দেরি হলে রামসহায়ের ওখানে একবার খোঁজ নিস।’ রামসহায়কে রঘু চেনে। নামজাদা আড়তদার। নানা ব্যাপারে দালালিও সে করে। এখানে তাকে চেনে না এমন কেউ নেই। সন্ধ্যার দিকে উদ্বিগ্নমুখে নয়নকে সব বলল রঘু। ‘যাওয়া উচিত ছিল অনেক আগে, ছি ছি, বাবু কী ভাববে।’

নয়ন তেড়ে গিয়েছিল—’নেমকহারাম কোথাকার!’

তখন রঘু বেরিয়ে গিয়েছিল তার স্থূল লাঠিটা নিয়ে। রতন বলেছিল—’রামসহায় বোধকরি নতুন সঙ্গী আজকাল? ঠিক ধরে ছিলাম তা হলে। ফের নরকের গর্তে ঢুকে গেছেন!’

উৎকণ্ঠায় অধীর হয়ে ঘুরছিল নয়ন। কোনো বিপদ—আপদ হয়নি তো! যতদিন দুর্গামোহন নিজের আড্ডায় জুয়ো খেলেছে, ততদিন রঘু আর কেষ্টা তার পাহারায় থেকেছে। কারোর টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। কিন্তু সত্যি যদি রামসহায়ের ওখানে জুয়োর আড্ডায় সে গিয়ে থাকে, জুয়াড়িদের রোখ তো জানা কথা—মুহূর্তে ছুরি মেরে বসবে বুকে। নয়ন ভাবছিল—ফিরে এলে অবশ্য স্বভাবমতো সেই একই কৈফিয়ত দেবে বাবু। ‘বসে খেলে রাজার ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়। একটা ব্যাবসা—ট্যাবসা কিছু করার তালে আছি রে।’

যা ভেবেছিল তাই।

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল টিপ টিপ করে। ঘন মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল। ঘোরতর আঁধার নেমেছিল পৃথিবীতে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে রঘু ফিরে এসেছিল হন্তদন্ত হয়ে। ‘নয়নদি, ও নয়নদি সর্বনাশ হয়ে গেছে!’

‘কী, কী হয়েছে রে রঘু?’

‘তোমার কাছে টাকা আছে?’

‘টাকা? টাকা কী হবে?’

‘বাবু বললে, শিগ্রি কিছু টাকা দাও—অন্তত শ’দুই কমপক্ষে!’

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে নয়ন বলল—’আমার কাছে টাকা নেই। আর থাকলেও দিতাম না, তোর বাবুকে বল গে যা।’

‘তোমার পায়ে পড়ি নয়নদি, দাও। নইলে বাবুকে ওরা ছেড়ে দেবে না।’

‘কেন, কী করেছে তোর বাবুর?’

‘খেলায় হেরে গেছে। রামসহায়েরা ওকে পিঠমোড়া দিয়ে সারাদিন বেঁধে রেখেছে—তোমার দিব্যি, বিশ্বাস কর—না হয় নিজের চোখে দেখে এসো গে!’

‘কেন?’ নয়ন তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল—’কেন? তোরা তো তার নন্দীভৃঙ্গী, হাতে মোটা লাঠি নিয়ে ফিরিস, যা না এবার, পালোয়ানি করে ছাড়িয়ে আন, দেখি! আমাকে কেন?’

‘তুমি টাকা না দিলে তাই করতে হবে বইকি।’ রঘু মাথায় ফেটা বাঁধতে থাকল। কেষ্টা অনন্ত ভূপতি ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে। তারাও রঘুর দেখাদেখি প্রস্তুত হচ্ছিল। কোমরে ভোজালি বেঁধে হাতে রামদা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তৈরি। রঘু চিৎকার করে বলল—’রতন মাস্টার, আপনি বাবুর অনেক নুন খেয়েছেন, মনে রাখবেন!’

রতন বলল—’তোরা কি সত্যি—সত্যি খুনখারাপি করতে যাচ্ছিস রঘু? বরং আমি থানায় যাচ্ছি একটু অপেক্ষা কর তোরা। পুলিশ যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়, তখন অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।’ রতন বেরিয়ে যাচ্ছিল। হাতে টর্চ নিয়ে ছাতাটা খুলে সিঁড়িতে নামতেই নয়ন ডাকল—’শোনো।’

‘বলো।’

‘আমি টাকা দিচ্ছি। মিছিমিছি হইচই করলে কেলেঙ্কারিই বাড়বে শুধু।’ আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল সে। বাক্স খুলে টাকা বের করল। তারপর বাইরে এলে পরে রঘু হাত বাড়িয়েছে—’কই, দাও শিগ্রি!’

টাকা দিতে গিয়ে হঠাৎ থামল নয়ন। দাঁতে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল সে। ভ্রূ কুঞ্চিত করে বৃষ্টি—অন্ধকারময় বাইরের পৃথিবীর দিকে চেয়ে সে ভাবছিল। এ টাকা দিয়েও কি শেষ হবে কোনোদিন? দুর্গামোহন আজ হয়তো আসর ছেড়ে উঠে আসবে। কিন্তু এ অপমান কিছুতে ভুলতে পারবে না সে। সারারাত সে জেগে থাকবে আর মুহূর্তে মুহূর্তে অমানুষিক জেদে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। জুয়াখেলার আসরে এই প্রথম নিদারুণ অপমান। হয়তো অন্যপথ না পেয়ে আত্মহত্যা করাও বিচিত্র নয় এ মানুষের পক্ষে।

মানুষ যে আসলে জন্মান্ধ। ঈশ্বরের মতো সংসারকে সে কতকিছু দিতে চায়। জুয়াখেলা যদি পাপ হয়—এই পাপ দিয়ে সে গর্ব করে ভাবে—’পুণ্য দিলাম’। এবং ভেদজ্ঞানহীন বোধহীন দেওয়ার পর তার গর্ব তাকে নিজের অস্তিত্বের প্রতি আশ্বস্ত করে। তারপর সেই স্বস্তির বোধে কেউ আঘাত দিলে তার সারা সত্তাই যে অর্থহীন হয়ে ওঠে।

‘ও পুণ্য নয়—পাপ দিয়েছো তুমি’—এই ধরা পড়ার আঘাত কত মর্মান্তিক, নয়ন সারাজীবন ধরে তা অনুভব করেছে যে!

না, না! নয়ন সে কথা কোনোমতে বলতে পারবে না দুর্গামোহনকে।

সে স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। রঘু বলল—’কী হল নয়নদি?’

নয়ন কঠোরভাবে আদেশের সুরে বলে উঠল—’একটু অপেক্ষা কর তো রঘু, আমি আসছি।’ বলে ফের ঘরে ঢুকে গেল সে। আয়নার সুমুখে বসল। ক্ষিপ্রহাতে সাজতে থাকল।

রতন পেছনে দাঁড়িয়ে। আয়নার তার পাণ্ডু হয়ে ওঠা মুখের প্রতিবিম্ব পড়েছে। সে কোনো কথা বলতে পারল না। নয়নের এই কঠোর ঋজু অথচ ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব সে কোনোদিনই কল্পনা করতে পারেনি। যে—নয়ন দুর্গামোহনের চোখের সুমুখে ফণা তোলা দূরে থাক, একটু নড়াচড়া করতেও যেন ভয় পায়।

এক সময় নিপুণ হাতে প্রসাধন শেষ করে অভিসারিকা রঙ্গনটীর মতো চঞ্চল লঘু পা ফেলে বৃষ্টির পথে বেরিয়ে গেল নয়ন। পেছনে টর্চ আর লাঠি হাতে নিয়ে রঘু তাকে অনুসরণ করল। আর রতন একইভাবে অনেকসময় আয়নার সুমুখে দাঁড়িয়ে থাকল। হতবাক, ক্ষুব্ধ।

হতে পারে, সবই দুর্গামোহনের জাদুর কারচুপি, বানানো নাটক একটা—কিন্তু রামসহায়ের ঘরে অনেকদিন পরে নাচতে নাচতে নয়ন যেন একটা দারুণ স্বস্তি অনুভব করছিল। পরিবারে কিছু ঘটে গেলে যেমন বিশ্রী গুমোট স্তব্ধতা—অথচ কার দোষ কেউ জানে না, তেমনি অস্বস্তির পর—কিংবা হঠাৎ কোনোরকমে কুঁকড়ে যাওয়া গ্রন্থিটা খুলে গেলে—যেমন জলে ডুবে থাকার পর মাথা তুলে নিশ্বাস নেবার সুখ, সেই সুখ ছিল এই মজলিশে। রামসহায়ও গানবাজনার বড়ো সমঝদার। তার ঘরে যন্ত্র ও যন্ত্রীর অভাব ছিল না। অনেক বছর আগে একসময় সে দুর্গামোহনের আড্ডাতেও এসেছে বারকয়েক। ক্রমশ মনে পড়ছিল নয়নের।

দুর্গামোহন রতনকে একদিন বলেছিল—’নয়ন জাহান্নমের আগুন। বাইরে নিয়ে গেলে দুনিয়াটা দাউ—দাউ করে জ্বলে উঠবে।’

রামসহায়ের মজলিশটা জ্বলছিল তেমনি করে।

অথচ নটী মেয়ে তো ঘরের মেয়ে নয়, সে বাইরের। সে বাইরে না এলে তার কী মূল্য? এবং বাইরে এসে সে যখন জ্বলে—সে নরককেই প্রকাশ করে। তখন লালসাও ইন্দ্রিয়কে পিচ্ছিল করে। বিন্দু বিন্দু জমে ওঠে। তাকে সামলাতে আর—এক গরলও তখন জরুরি হয়ে ওঠে। এইসব কথা দুর্গামোহনই বলত দিনের পর দিন—যখন সে হুঁশে থাকত।

নরকের আগুনকে সুমুখে দেখে সে আসরে হাত ধরাধরি করে এল তার অনুচরগণ। সরগরম হয়ে উঠেছিল রামসহায়ের বাগানবাড়ি সে রাতে। তারপর শেষরাতে বাড়ি ফিরল দুর্গামোহন—সঙ্গে রঘু আর নয়ন। নয়ন ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখল রতন ঘুমোয়নি। তার পক্ষে ঘুমানো সত্যি অসম্ভব। সে হয়তো মুহূর্তে মুহূর্তে অস্থির হয়েছে। ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই নিজেকে দংশন করেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের পর এখন যেন সে ক্লান্ত। নয়নকে শাড়ি বদলাতে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিল দেয়ালের দিকে।

নয়ন পাশে গা ঘেঁষে বসে বলল—’এখনো জেগে আছ যে? ভাবছিলাম, দরজা খুলবে কি না। যে ঘুম তোমার!’

রতন কথা বলল না।

‘ইস, পুরুষের রাগ হয়েছে দেখছি!’ ঝুঁকে পড়ে চুমু খেল নয়ন।

রতন তবু চুপ করে থাকল।

নয়ন দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল রতনকে। রতন এবার ঠেলে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিল—কিন্তু নয়ন নিবিড়ভাবে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছিল—বলছিল ‘বিশ্বাস কর, আমি তোমার, তোমারই আছি। সারাজীবন ধরে তোমারই থাকব। হাতে তুলে যে সিঁদুর আমার সিঁথিতে দিয়েছ, প্রাণ গেলে আমি কি তার অমর্যাদা করতে পারি?’ বিহ্বল কণ্ঠে অপরূপ ভাবাবেগে কথা বলছিল নয়ন। বলছিল—’উপায় ছিল না আমার। বাবুর অপমান আমি সইতে পারি নে। তবু যদি এটা অপরাধ বলে মনে কর, ক্ষমা চাচ্ছি—আমাকে ক্ষমা কর তুমি….’

একসময় তাকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিল রতন। স্খলিত কণ্ঠে বলল—’দেহ অশুচি হলেও তাকে আমি ঘৃণা করতে পারি নে নয়ন—কারণ ও তো জানোয়ারের আহার। কিন্তু মনের অশুচি আমি সইতে পারি নে—মনেই যে মানুষের সারবস্তু।’

‘তুমি জ্ঞানী মানুষ—ভুল কোরো না গো! মন আমার অশুচি হয়নি…’

‘হয়েছে। তোমার মনের সবটুকু তুমি কি বিলিয়ে দাওনি, যতক্ষণ আসরে নাচ—গান করছিলে?’

নয়ন এ কথার জবাব খুঁজে পাচ্ছিল না।

‘যতক্ষণ তুমি বাঈজী সেজে থাক, ততক্ষণ তুমি হাজার মানুষের; কারুর একার নও। অস্বীকার করতে পারো?’

‘আমি অত বুঝি না। শুধু বল, আমাকে ক্ষমা করেছ কি না?’

‘আমার করা না করায় কী যায়—আসে তোমার?’

‘তুমি যে আমার স্বামী! আমি তোমার স্ত্রী! এ কথা কি মিথ্যে?’

‘স্বামী!’ গর্জে উঠেছিল রতন। ‘ও তো সাজানো পুতুলের নাম।’

‘পুতুলখেলা এ নয়—তুমি অবুঝ হোয়ো না….’ উঠে গিয়ে পায়ে মাথা খুঁড়ছিল নয়ন।

রতন পা সরিয়ে নিয়ে বলে—’থাক। আর সতীপনায় কাজ নেই। ভোর হয়ে এল। আমি বেরবো।’

নয়ন দুর্গামোহনকে যত ভয়ই পাক, আসলে সে জন্মনটী। মানুষের চোখের ক্ষুধার আগুনে তার আজীবন সঞ্চরণ। এবং এই থেকে এক আশ্চর্য অহংকার তার হয়তো জন্মে থাকবে। সেই অহংকারে, সেই প্রচ্ছন্ন মর্যাদাবোধে সে তখন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল তীব্রতর। বলেছিল—’সে বোঝা গেছে খুব! অত মুরোদ থাকলে এখানে অন্যের আশ্রয়ে পড়ে থাকতে না নিজের বউকে নিয়ে। ওঃ, কী পুরুষ, কী তার অসম্মান জ্ঞান!’ এলিয়ে পড়া খোঁপা ঠিক করে নিতে নিতে ফের ফুঁসে উঠেছিল—’এত আত্মসম্মানজ্ঞান যার, কেন সে বাঈজী মেয়েকে বিয়ে করেছিল জেনে শুনে?’

এ কথার জবাব রতন দিতে পারে না। দেওয়া যায় না। শুধু রোখের মাথায় একটা কিছু বলতেই হয়।

সে বলেছিল—’বাঈজী আর বেশ্যা এক নয়।’

‘কী বললে?’ সাপিনীর মতো ফণা তুলে সুমুখে এসে দাঁড়াল নয়ন। ‘বেশ্যা! আমি…’

‘তা ছাড়া কী?’ রতন আরও ক্ষিপ্ত হয়েছে ততক্ষণে। ‘তোমার জাত—জন্মের কথা আমার জানতে বাকি নেই।’

নয়ন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এ আঘাত তার জন্মের ওপর—তার মায়ের ওপর। তাতে সে মেয়েমানুষ। চিৎকার করে সে বলেছিল—’তোমারও তো জাতজম্মোর ঠিক নেই মাস্টার, তুমি তোমার বাবা—মা’র নাম জানো?’

হইচই শুনে বাড়ির লোকজন বাইরের বারান্দায় হাজির। প্যান্টে বেল্ট পরছিল রতন—সেই বেল্টটা সজোরে নয়নের মুখ লক্ষ্য করে সে ছুঁড়ে মারল—আর বকলেসের আংটাটা কপালে কেটে বসল সঙ্গে সঙ্গে। রক্তে মুখ—চোখ লাল হয়ে গেল নয়নের। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে বসে পড়ল।

দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল রঘু কেষ্টারা। ইতিমধ্যে ভারী গলায় দুর্গামোহনকে বলতে শোনা গেল—’তোরা যা দিকি এখান থেকে—হতভাগা আহম্মক যতসব। ওদের স্বামী—স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব বেধেছে—ওরা নিজেরাই মিটিয়ে নেবে—তোদের কী রে?’

হয়তো হাসছিল দুর্গামোহন। সকলেই কেটে পড়েছে গুটিসুটি।

রতন মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেয়েছে এদিকে। নয়নের রক্ত দেখে তার হৃৎপিণ্ড ঝনঝন করে বেজে উঠেছে। সেও দু’হাতে মুখ ঢেকে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল—’নয়ন, ও নয়ন, আমি এ কী করলাম!’ যৌবনবতী নটী নয়নের সৌন্দর্যের ওপর কলঙ্কের প্রতীক চিত্র এঁকে সেদিন বুঝি পরস্পর একটা প্রায়শ্চিত্তের পালা শুরু।

সেই ক্ষত একদিন শুকোল।

আয়নায় মুখ দেখে নয়ন অপরূপ হেসে উঠল আবার। কপালে অর্ধচন্দ্র এঁকে দিয়েছে রতন জন্মের মতো। চারপাশে সবুজ পৃথিবীর নিরাবরণ সৌন্দর্য। আকাশ নীলিমায় প্রসন্ন। বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ আসে। রতন আর নয়ন হাত ধরাধরি করে মাঠের দিকে ঘুরে বেড়ায়। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। চারপাশে কুয়াশার ঘন নীল দুর্গমতা। দু’জনে দু’জনের দিকে চেয়ে সেই অপরূপ দুর্গমতাকেই যেন দেখতে পায়।

সেইসময় একদিন বিরস মুখে দুর্গামোহন বাইরে থেকে ফিরে বলল, ‘মা নয়ন, তোর কাছে কিছু টাকা আছে রে?’

‘টাকা!’ চিন্তিত মুখে স্থির দাঁড়িয়ে রইল নয়ন। তার গোপন সঞ্চয় যা কিছু ছিল, কবে নানা প্রয়োজনে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আগে দুর্গামোহন প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিত—ক’মাস থেকে তাও বন্ধ ছিল। দেবেই বা কোত্থেকে। আর তো কোনো আয় নেই। মোহিনী মরায় সময় মেয়ের হাতে কিছু দিতে পারেনি। কিছু অলংকার তার নাকি ছিল। নয়ন শুনেছিল মাত্র। কোনো পাত্তা পায়নি তার—প্রয়োজনও ছিল না।

দুর্গামোহন যখন ফের তাকে প্রশ্ন করল, নয়ন বলল—’দেখছি। ‘কিন্তু কী হবে টাকা?’

‘দেনা করে পাটের জন্য দাদন দিয়ে রেখেছিলাম। দর নেমে লোকসান হয়ে গেছে।’

‘মিথ্যা বোলো না বাবু। তুমি ফের জুয়ো খেলেছ!’ নয়ন ভর্ৎসনা করছিল। ‘সেদিন না তুমি আমার মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করলে!’

আমতা হাসল দুর্গামোহন। ‘না—না, তুই বিশ্বাস কর! এ কথা সত্যি রে নয়ন। দেনা শোধ না করলে আর সম্মান থাকবে না।’

‘থাকবে কী করে? এত বলছি, এতগুলো লোক রেখে কী হবে—কানেও যায় না তোমার!’

দুর্গামোহন কাঁচুমাচু মুখে মাথার পেছনটা চুলকোচ্ছিল। ‘তা হলে মার খাওয়া ছাড়া আর পথ নেই মা।’ নয়নের মন মমতায় করুণ হয়ে উঠল। আশ্চর্য, এই সেই কুখ্যাত ওস্তাদ জুয়াড়ি—নিয়তির মতো দুর্বার—বাঘের মতো ক্ষিপ্র আর চতুর সেই ওস্তাদ মোহন—যে ছিল এক অলৌকিক রাজ্যের সার্বভৌম রাজা! আজ যথার্থ কোনো নির্বাসিত রাজার মতো সে পরবাসে মলিন মুখে ভিখারির অধিক। আজ সে মৃত্যুর অন্ধকারে নিজের পরাজয়কে লুকিয়ে ফেলতে চায়।

আত্মধিক্কারে দুঃখে অনুশোচনায় বুক ভেঙে যাচ্ছিল নয়নতারার। সে আস্তে আস্তে বলল—’বাবু, আমারই জন্যে এ দুর্গতি তোমার। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।’

সৃষ্টি যখন স্রষ্টার বেদনা অনুভব করে, স্রষ্টার তখন অহংকার রাখবার স্থান থাকে না। দুর্গামোহন যেন বিস্মিত চোখে তার দিকে চেয়ে থাকল।

‘তুমি ছিলে রাজা, আমি তোমাকে পথের ধুলোয় টেনে নামিয়েছি। আমার পাপের সীমা নেই বাবু।’ কাঁপতে কাঁপতে পায়ের কাছে বসে পড়েছিল নয়ন।

একদিন ওই হাতে হাজার হাজার টাকা নিয়ে দুর্গামোহন জাদুর খেল দেখিয়েছিল—আজ সেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নয়নের দিকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। যে হাত আজ শূন্য, রিক্ত, সর্বহারা।

পুণ্য নিয়ে যদি গর্ব করার থাকে, পুণ্যের যদি থাকে শ্রেষ্ঠ ফসল—সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, নীতি, এইসব উজ্জ্বলতা—তা হলে পাপের নেই কেন? পুণ্যের যেমন আলো—পাপের তেমনি অন্ধকার। আলোর রাজ্যে যেমন আছে নানা শ্রেষ্ঠ ফসল—অন্ধকারের রাজ্যেও তো রয়েছে তেমনি শ্রেষ্ঠত্বগুলি। তেমনি পালটা সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, নীতি অহংকার! আলো ও অন্ধকারের দু’টি বিপরীত মূল্যবোধ।

পাপ—পুণ্যের বাইরে না দাঁড়ালে নিরপেক্ষ বিচার কি সম্ভব? পুণ্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে পাপের ফসলগুলিকে হীন মনে করা কি ঠিক? মানুষ কিন্তু তাই করে। কারণ মানুষ যে সংকীর্ণমনা। সীমিত—খণ্ডিত তার সত্তা। পাপের বেতন মৃত্যু—পুণ্যের বেতন জীবন—ঈশ্বরের পুত্র মানুষই বলতে পারে। কিন্তু ঈশ্বর তা বলেন না। বলা সাজে না তাঁর মুখে। তিনি যে সব আলো—অন্ধকারের ঊর্ধ্বে। তাঁর কাছে পাপের ফুলও ফুল, পুণ্যের ফুলও ফুল।

ঈশ্বরের কোল থেকে সেদিন দুর্গামোহনকে যেন নিরীক্ষণ করছিল নয়নতারা। তারপর সে রতনকে বলেছিল—’কী গো মাস্টার, তোমার সেই পুরানো রোগটা বুঝি ভালো হয়ে গেল? আর মাথা সুড়সুড় করছে না? স্টেজে ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না? আলজিভে আমার নাচ দেখার সাধ বুঝি ফুরিয়ে গেল?’

রতন অবাক।

নয়ন দুর্গামোহনকে বলেছিল—’বাবু, তাঁবু বের করো।’

‘সে কি রে?’

‘হ্যাঁ। আবার আমরা বেরবো।’

‘রতন যে রাগ করবে।’

‘রাগ করবে কী! উপোস করে তো মরতে চাইবে না। এবার আমরাও বাঘ সিঙ্গি রাখব দলে। ও তাদের নিয়ে খেলা দেখাবে। তা ছাড়া আর কী করব বল তো আমরা?’ ভ্রূভঙ্গি করে নয়ন বলেছিল—’না জানি মজুর খাটতে, না জানি মাটি কোপাতে ধান বুনতে। শুধু জানি ওই খেল খেলোয়াড়ি। সংসারে নিজের বিদ্যা ভাঙিয়ে কে না খায়। নইলে পেটে কাপড় বেঁধে পড়ে থাকতে হয় যে।’

আবার গুটানো তাঁবুর জগৎ মুখব্যাদান করে দাঁড়াল। রতন একমাসের মধ্যেই কলকাতা থেকে ফিরে এল ওই ওসমান খাঁ বাঘ, বুঢ়ুয়া সজারু আর আমিনা সাপিনীকে সংগ্রহ করে। পূর্বপরিচিত কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে সুলভ দামে এদের কিনে আনল সে। তারপর মেলার মরশুম এলে সে নিজেই তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ পার্টির নতুন অবদানের কথা ঘোষণা করল।

আবার দেশ থেকে দেশান্তর। মেলা থেকে মেলায়। শহর থেকে গ্রাম। হাজার হাজার মানুষ—চোখে তাদের দারুণ ক্ষুধা। হাজারকণ্ঠের উল্লাস—হাততালি। কানে তালা ধরে যায় বার—বার। কী দুঃখ, এই উমোহময়ল্লাসের জগৎ ফেলে কোথায় নামহীন পরিচয়হীন বিস্মৃতির মধ্যে বাস করছিল তারা দীনহীন বেশে!

তখন ভাগ্যের ঘরে নীলাভ আলো অনির্বাণ জ্বলছে। পাশার ছকের ওপর হাড়ের গুটি ছড়িয়ে দিয়ে নিঃশব্দে হাসছে ওস্তাদের ওস্তাদ রাজার রাজা জুয়াড়ি দুর্গামোহন। তখন হাজার রামসহায় তার করুণার প্রার্থী।

এবং তখন শেষ রাতে সব খোয়ানো মানুষের হাহাকার আর কান্নার ধ্বনি ঢেকে নয়নের খিলখিল হাসি ভেসে উঠেছে বার বার।