নীল ঘরের নটী – ৮

।। আট।।

ঈশ্বর তাঁর পৃথিবীকে যতখানি দিয়েছেন—ততখানি দিতে চায় মানুষ তার সংসারকে। কিন্তু মানুষ তো জানে না যে সে জন্মান্ধ—ঈশ্বরের মতো মুক্তদৃষ্টি না। তাই ঈশ্বরের দেওয়ার মধ্যে শুধু বাছাই করা জিনিসগুলি—আর মানুষের দান নির্বিচার। সৎ অসৎ ভালো মন্দ আলো—কালোর ভেদাভেদহীন—যা কুড়িয়ে পায় সবই দেওয়া। তার পাপ দিয়ে মনে হয়—’পুণ্য দিলাম’। পুণ্য দিয়ে সে বলে—’হায়, পাপ দিয়ে বসেছি।’ আসলে এ সংশয় মানুষের নিত্য অনাস্থার—সে যে দু’চোখেই অন্ধ।

তাই ভুল একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব—বিধাতার নয়।

কত পুরুষ—কত রূপবান গুণী যুবক এসেছে মিস নয়নতারার আসরে। তৃষ্ণা ছিল তাদের আকণ্ঠ। তারা নিজ নিজ সংসারকে কিছু দিতে চেয়েছিল বলে এইরূপ আসা—যাওয়া। নটী নয়নের কাছে হাত পেতেছিল তারা।

মানুষের মতো নিঃস্ব কেউ তো নয়। সে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ভিখিরি। তাই যে রূপে রূপবান যে গুণে গুণী ছিল সেই তৃষ্ণার্তেরা তার কোনো মূল পায়নি নয়নের কাছে। নয়ন জানত—ভেতরের উলঙ্গ মানুষটিই আসল, যে জন্মান্ধ জাতভিখারি। ওই রূপ আর গুণ বাইরের চাপানো একটা পোশাক আশাক মাত্র।

দুর্গামোহন তার জাদুযষ্ঠির আঘাতে সেই আদত নগ্ন সর্বহারা মানুষটিকে নিষ্কাশিত করে নয়নকে বলেছে—’দ্যাখ রে বেটি এ হচ্ছে এই। ব্যস, ঔর কুছ ভি নহি।’

নয়ন চকিত ভিতু চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু।

তবু মন বলে একটা অলৌকিক আছে দেহের মধ্যখানে আর তার আছে একটা তৃষ্ণা—এটা তো কোনোমতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সেই তৃষ্ণা যেন মনকে দৃষ্টি দেয়। জন্মান্ধ মানুষ সে দৃষ্টির অনুভবে বাঁচবার সত্য খোঁজে ঈশ্বরের পৃথিবীতে। এ আমাদের লুকানো চোখ। এই তৃষ্ণার চোখ নিয়ে চুপিচুপি খোঁজাখুঁজির পালা আমরণ। এইটে শুধু ঐশ্বরিক নশ্বর জীবনে।

নয়নের মনে তৃষ্ণার হরিণী বেড়ে উঠছিল দিনে দিনে। মায়াময় অরণ্যের ছায়ায় রোদে জ্যোৎস্নায় সে কোনো অলৌকিক আহ্বানের দিকে কান পেতে ছিল।

কেশর ফুলানো সিংহের গলার শিকল ধরে রতন মাস্টার এসে দাঁড়াল মুখোমুখি। তারপর একদিন রূপকণ্ঠীর মেলা থেকে ‘দি গ্রেট এশিয়ান সার্কাস’ তাঁবু গুটিয়ে চলে গেল। নয়ন নিষ্পলক চোখে পথের ওপর তাদের ধাবমান ট্রাকগুলিকে যখন দেখছে, পিঠে মৃদু স্পর্শ তার। ফিরেই অবাক হয়ে গেল সে। রতন মাস্টার মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। রুদ্ধশ্বাসে নয়ন বলল—’তুমি গেলে না?’

‘যেতে দিল কই?’

‘সে কী!’

‘ওস্তাদজি তার ম্যাজিক ওয়ান্ডটা বুলিয়ে দিল গায়ে—কেঁচো করে ফেললেন একেবারে।’

কান্না রোধ করতে পারল না নয়ন। মুখ ফিরিয়ে স্খলিতকণ্ঠে বলল—’এ জুয়োর দলে তুমি কী খেলা দেখাতে এলে মাস্টার?’

রতন তার দু’কাঁধ ধরে মুখটা ঝুঁকিয়ে দিল নয়নতারার কানের পাশে। চাপা গলায় সকৌতুকে বলল—’ভালোবাসার খেলা। প্যার কি খেল সবসে বঢ়িয়া খেল মিস নয়ন!’

সবসে বঢ়িয়া খেল।

কিন্তু যা খেলা—তা শুধু খেলাই। দুর্গামোহন নকল সংসার বানিয়ে ধুলোবালির ঘর বাঁধতে দিয়েছে দু’টি উলঙ্গ শিশুকে। তারা সারাবেলা ঘর বাঁধে, ভেঙে ফেলে। আবার বাঁধে—আবার ভাঙে। অকারণ। কারণের সুতো আসলে যে ওই জুয়াড়ি ভাগ্যবিধাতার হাতে।

‘মাস্টার, আর আমি পারছি নে….’

‘কেন নয়ন?’

‘শুধু কি এই?’

‘আর কী তবে?’

‘আর কি কিছু থাকতে নেই?’

‘কী জানি! হয়তো আমি আছি, আর তুমি আছ—এরপর আর কিছু নেই।’

আছে। নয়ন অনুভব করেছে নিরন্তর। সেই যে নান্নুমা বুড়ি বলেছিল—বেহোঁশিমে কৈ ফায়দা নেহি বেটি! বেহেঁশি তো জিন্দেগির সাচ বাত ছুপা রাখে। হোঁশমে আও—তব তেরি আঁখ খুল যায়গি। দুনিয়া ভি বদল যাতি তব। নান্নুমা তার অভিজ্ঞ কণ্ঠে আরও বলেছিল—মুহব্বত জিন্দেগির সাচ বাত। লেকিন, মুহব্বত যবতক নেশা হয়ে থাকে, সে ঝুটারও অধিক।

দুর্গামোহন যেন নেপথ্য থেকে ঈশ্বরের মতো দৈবাদেশ জারি করেছে : তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসো। তারা সে আদেশ পালন করেছে মাত্র। ভালোবাসার মদে চুমুক দিয়ে বসে আছে দু’জনে।

‘দি গ্রেট এশিয়ান সার্কাসে’র কুশলী খেলোয়াড় রতন ফের আর এক সিংহের মুখে মাথা ঢুকিয়ে খেল দেখাচ্ছিল। ওরা চলে গেলে রতন ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র স্টেজে এসে দাঁড়াত। বলত : বন্ধুগণ, আমাকে আপনারা চেনেন, আমি দি গ্রেট এশিয়ান সার্কাসের ভয়ংকর সিংহটার মুখে মাথা ঢুকিয়ে খেল দেখিয়েছি—আমি সেই মাস্টার রতন বোস—আজ আমি এই নতুন পার্টির একজন খেলোয়াড় হয়েছি কেন, এখানে তো সিংহ নেই, বাঘ—ভাল্লুক হাতি—ঘোড়া নেই, রিং—স্টাপিজের খেল নেই? একটা কৈয়িফত আমাকে দিতেই হবে। আপনারা আমার মা—বাপ ঈশ্বর—ভগবান—আপনাদের কাছে কৈফিয়ত না দিলে আমার তো মুক্তি নেই বন্ধুগণ….!’

কৈফিয়ত স্পষ্ট কিছু দিত না সে। কিংবা দিতে গিয়ে তোতলামি করত কাঠগড়ায় অপরাধীর মতো। তারপর একটু কেশে কপালের ঘাম মুছে ফের শুরু করত : ‘ফ্রেন্ডস! সেই আঠারো বছর বয়স থেকে আপনাদের মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। আজ আমি আটাশে পৌঁছেছি। এই এই দশ বছর জবাবদিহি করতে হয়েছে এমনি করে। চিৎকার করে বলতে হয়েছে : সব মিথ্যা—শুধু পেট সত্য। পেটের জন্য হিংস্র বুনো জানোয়ার নিয়ে জীবন বিপন্ন করে খেল দেখাই। পেটের জন্যে জ্বলন্ত ইস্পাতের ছুরি বসানো চাকা গলিয়ে লাফ দিই। এই পোড়া পেটের জন্যে মালিকের চাবুক খেয়েও আহা—উহু বলি না—ক্লাউন সাজি, শূন্যে ঘুরপাক খাই, দড়ির ওপর দৌড় দিই…..কী না করি! …..কারণ, আমরা খেলোয়াড়। খেলোয়াড়ি না দেখালে দু—মুঠো ভাত জোটে না সংসারে।…

….বাট ফ্রেন্ডস, আই মাস্ট সে, আই অ্যাম এ লায়ার। মিথ্যার দালাল। পেট আমাদের অজুহাত। আসলে আমরা ছন্নছাড়া হা—ঘরের দল। আমাদের জন্মলগ্নে কপালে লিখে দেওয়া হয়েছে, ”তোমাদের কোনো ঘর নেই, কোনো প্রিয়জন নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই।’

এইসব ঘোষণার পর সে গুটিকয় খেলা দেখাত। জ্বলন্ত ছুরি উঁচানো চাকা গলিয়ে যাওয়ার খেলা। কাঁটাপেরেক বসানো তক্তার ওপর চিত হয়ে শুয়ে ওপরে দুটো লোক ছুটে যাওয়ার খেলা। শেষে কিছু ম্যাজিক। এ সময় দারুণ হাসাত সে। ক্লাউনের অঙ্গভঙ্গিতেও বড় পটুত্ব ছিল তার।

ক’দিনের মধ্যেই ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ জনতার ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠল। তিনটে করে শো দিয়েও রেহাই নেই। শেষ শো’র পর ক্লান্ত হয়ে সে ক্যাম্পখাটে শুয়ে অপেক্ষা করত নয়নের। প্রতি বারেই সে ভাবত নয়ন এসে বসবে তার পাশে। আরও কিছু আশা বুঝি তার ছিল। কিন্তু নয়নের পাত্তা নেই। সে তখন ভাগ্যের ঘরে মদের পাত্র পূর্ণ করছে বসে। খিলখিল করে অকারণ হাসছে। গুনগুনিয়ে গান গাইছে। সে নয়ন অন্য নয়ন। সে একান্তভাবে মিস নয়নতারা। উঁকি মেরে দেখে এসে রতনও মদের বোতল খুলে বসেছে। এক নিশ্বাসে সেটা খালি করে শুয়ে থেকেছে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের উপর। সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙলে সে দেখেছে, ক্যাম্পখাটে পরিপাটি বিছানা করে কে শুইয়ে রেখেছে। রাগে আক্রোশে সে গুম হয়ে থাকত দুপুর অবধি। কথা বলত না কারোর সঙ্গে। কেবল দুর্গামোহন এসে ডাকলে মুহূর্তে পোষা জানোয়ারের মতো শান্ত হয়ে যেত সে।

একদিন এমনি এক রাতের শেষদিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল রতনের।

নেশার আমেজ তখনও কাটেনি। অন্ধকারে সে অনুভব করল তার বুকের ওপর কে শুয়ে আছে। খোঁপাখোলা চুল দু—পাশে উপচে পড়েছে। ‘নয়ন, নয়ন!’ ত্রস্তে ফিসফিস করে উঠেছিল রতন মাস্টার।

নয়ন কোনো কথা বলেনি।

তখন রতন তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাঁবুর সীমানা পেরিয়ে। তারপর বলেছিল—’ভালোবাসা নিয়ে ছলনা করতে নেই। তুমি দিনের পর দিন তাই করছ আমার সঙ্গে। কেন নয়ন, কেন?’

‘ছলনা করলে আজ তোমার কাছে এমনি করে আসতে পারতাম না মাস্টার।’

‘এ আসার কোনো অর্থ হয় না।’

‘তবে কেমন করে আসব?’

‘চিরকালের মতো আসতে পার না?’

‘সে আবার কেমন?’ ঈষৎ কৌতুকে চাপা হেসেছিল। ‘বাব্বাঃ, এইটুকু আসতেই সব রক্ত জমে গেছে—টের পেলে বাবু গলা টিপে মেরে ফেলবে না!’

‘তোমার এত ভয়!’ রতন ক্ষুব্ধভাবে বলেছিল। ‘কেন ওই জুয়াড়িটাকে এত ভয় করো তুমি?’

‘তুমিও কি নিজের মালিককে ভয় করতে না?’

‘না। তাই আমি পালিয়ে এসেছি দল ছেড়ে।’

‘কিন্তু আমি….আমি যে মেয়েমানুষ মাস্টার!’

‘মেয়েমানুষ হলে বুঝি সাহস থাকতে নেই? নয়ন, এতখানি যখন এগোতে পেরেছ, আরও পারবে। তুমি শুধু একবার বল, আমার কথা শুনবে, দেখি ওই শয়তান জুয়াড়িটা আমার কী করে। আমি ওর মুখে লাথি মেরে তোমাকে নিয়ে চলে যাবো। অনেক বুনো জানোয়ার শায়েস্তা করেছি, এ তো একটা মানুষ!’

নয়ন একটু চুপ করে থেকে বলেছিল—’প্রথম যখন এলে, তুমি এমন কথা তো বলনি। তুমি বলেছিলে—আমরা কাছাকাছি রইলাম, এই থাকাই শেষ। এরপর আর কিছু থাকতে নেই।’

রতন ব্যাকুলভাবে বলেছিল—’আছে। দিনে দিনে বুঝেছি তা—ওই লাক—রুমের নরকে যে—তুমি, তাকে যখনই দেখেছি, মনে হয়েছে, আরও বড়ো পাওয়া ছিল—আমি বড্ড ঠকে গেছি।’

‘মাস্টার, ওই বেশ্যাটা পেলেই তুমি খুশি হবে, তাই না? বেশ তো, আমি তোমার মুখে মদ তুলে দেব, জড়িয়ে ধরব—তুমি লাক—রুমে যেয়ো….’

রতন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে হঠাৎ চলতে শুরু করেছিল। অনেকখানি উন্মত্তভাবে অতিক্রম করে একবার বুঝি মনে হয়েছিল—নাঃ, এও বড় হার হয়ে গেল তার। সে ফের ফিরে আসছিল তখন। আর তখনই দেখল—নয়ন, সেই নয়নতারাও তাকে অনুসরণ করছে। ছুটে আসছে শেষরাতের ধূসর আলোর পথে। ধুলোয় নগ্ন পা ফেলে দৌড়চ্ছে সে। রতনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নয়ন। রুদ্ধশ্বাসে বলেছিল—’আমিও যেতে চাই রতন, আমিও।’

সুমুখে মুক্ত অন্য আকাশ, ভিন্ন পৃথিবীর দরজা খোলা হয়ে যাচ্ছে। দুটিতে সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে ততক্ষণে দুর্গামোহনের তাঁবুতে সাড়া পড়ে গেছে। দুর্গামোহন পাগল হয়ে হন্তদন্ত ছুটে এসেছিল স্টেশনে। রঘু গিয়েছিল থানায়। কেষ্টা মেঠো পথে নদীর ঘাটের দিকে।

দুর্গামোহনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল রতন মাস্টার। প্রচণ্ড শক্তিতে ঘুঁষি মেরেছিল চোয়ালে। আছাড় খেয়ে পড়েছিল দুর্গামোহন জুয়াড়ি। পরমুহূর্তেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল—’নয়ন, মা নয়নমণি, তুই গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?’

আশ্চর্য, নয়নের বুকের ভেতর কোথাও দীর্ঘদিনের সঞ্চিত মমতা হঠাৎ গলতে শুরু করেছিল যেন। ওই সেই মোহন ওস্তাদ, তাকে সোনারওয়ালি গলির এক পুরনো ঘরের মেঝের কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, তাকে পিঠে চাপিয়ে ঘোড়া সেজেছে হাঁটু গেড়ে। নয়ন একটু মুখ ভার করলে সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে—যেন আকাশের চাঁদও মুঠোয় উপড়ে এনে দেবে। কী তাকে দেয়নি দুর্গামোহন? বাবার স্নেহ, আদর, মমতা। কত সাধ্যসাধনায় দিনের পর দিন নাচ—গান লেখাপড়া শিখিয়েছে। সুমুখে বসে খাইয়েছে নিজের হাতে। বাজারের সবচেয়ে সেরা জিনিস সেরা উপঢৌকন তার সুমুখে হাজির করে বলেছে—’এই নে মা নয়নমণি, তোর জন্যে আনলাম। বেশ মানাবে তোকে।’ একটু মাথা ধরলে কাতর চোখে পাশে বসে মাথা টিপে দিয়েছে। একবার দারুণ টাইফয়েডে ভুগছিল নয়ন। দুর্গামোহন অশ্রু সজলকণ্ঠে বলেছিল—’ঈশ্বর, আমি পাপী, মহাপাপী মানুষ। কিন্তু যদি কিছু পুণ্য করে থাকি, আমি তার বদলে আমার নয়নমণির আয়ু চাই।’

তার ‘সব পুণ্যের বিনিময়ে পাওয়া আয়ু নিয়ে নয়ন কিশোরী থেকে যৌবনবতী হল। আর সেই পুণ্যত্যাগী দুর্গামোহন আজ আবার মাথার চুল আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি করছে—’হে ঈশ্বর, ওর মনের মতি—গতি ফেরাও প্রভু। ওকে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ো না।’

রতন হাসছিল মৃদুমৃদু তার কাণ্ড দেখে। এ—জুয়ায় সে জিতে গেছে—সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে দুর্গামোহনের। দুর্গামোহন যা বাজি ধরেছিল, তা সে খুইয়ে বসেছে। ভণ্ড শয়তান। মুখে থুথু ফেলতে ইচ্ছে করছিল তার। এমনি করে কত মানুষ তার হাতে সব খুইয়ে চুল ছেঁড়ে। হাহাকার করে।

না, নয়ন হলফ করে বলতে পারে, দুর্গামোহন অভিনয় করছিল না। কারণ, কোনো প্রয়োজন তো ছিল না অভিনয়ের। সে ন্যায়ত ধর্মত—সব দিক দিয়ে নয়নের অভিভাবক। তা ছাড়া, সে তার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারত—রতন একা কতক্ষণ যুঝতে সক্ষম হত তার সঙ্গে?

আর দুর্গামোহন কি জানত না, নয়ন তাকে কতখানি ভয় করে?

সুতরাং এ কান্না নিতান্ত সবখোয়ানো জুয়াড়ির কান্না ছাড়া কিছু নয়। হাতের জিনিস আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে অবশ্য মানুষ কাঁদে—কিন্তু জাত—জুয়াড়ির কান্নার কারণ আরও গভীর। এই জাত—জুয়াড়িরা যে শুধু মানুষের জীবনকেই বাজি ধরে বসে!

নয়নের পা কাঁপছিল, সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিঃশব্দে। এত ভোরে নির্জন হয়ে আছে স্টেশনটা।

‘নয়ন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জুয়া ছেড়ে দেব। তোকে নিয়ে মল্লারপুরে ফিরে যাব।’ উঠে এসে নয়নের হাত ধরেছিল দুর্গামোহন। ‘মা, তোকে এতটুকু থেকে মানুষ করেছি, আমাকে একবারের জন্যে বিশ্বাস কর।’

আর স্থির থাকতে পারেনি নয়ন। বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে সে—ও কেঁদে উঠেছিল।

‘এ পাপের পথ আমি ছেড়ে দিলাম। আজ থেকে আমি সংসারী হলাম নয়ন।’

রতন স্তম্ভিত ততক্ষণে। হয়তো সে নয়নের ওপর ঘৃণায় বিদ্বেষে কাতর হয়ে উঠেছে মনে মনে। হয়তো ভাবছে, দুর্গামোহন তার ওস্তাদের মার শেষ হাতের খেল দেখিয়ে দিল এমনি করে।

তার মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। সে একবার মুখ তুলে নয়নের মুখটা দেখার চেষ্টা করছিল। নয়ন দুর্গামোহনের সঙ্গে চলতে থাকলে সে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হল।

নয়ন আর একবারের জন্যেও পেছন ফেরেনি। খানিক চলে সে দেখল রঘু আর কেষ্টা এগিয়ে আসছে। দুর্গামোহন একটা রিকশো দাঁড় করিয়ে বলল—’রঘু’ তুই মাকে নিয়ে যা। কেষ্টা, তুই আমার সঙ্গে আয়।’ বুক কেঁপে উঠল নয়নের। বাবু রতনকে মারবে না তো! ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখল, সত্যি দুর্গামোহন কেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। নয়ন পাগলের মতো বিড়বিড় করছিল—’আমার কী! কী দোষ আমার….ওকে যা খুশি করুক….ও কে?’

সারা দুপুর নয়ন ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল সেদিন। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছিল। যে সিংহটার মুখে রতন মাথা ঢুকিয়েছিল—সে যেন গলা থেকে মুণ্ডুটা দাঁতে ছিঁড়ে ফেলেছে। কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে—প্রকাণ্ড রক্তাক্ত জিভ হলুদ দাঁতেও রক্তের ছোপ—সেই ভয়ংকর আগ্রাসী সিংহ সোনালি কেশর ফুলিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রচণ্ড গর্জন করছে সে। আর সেই গর্জনের ব্যাপকতায় পুরিয়ার তান ধরেছে সানাই। কী আশ্চর্য!

নাঃ, সিংহের ডাক নয়। ঢাক বাজছে তাঁবুর সুমুখে! বসন্তের রক্তিম বিকেলে মুহূর্তের জন্যে যেন পৃথিবীটা ভিন্ন স্মৃতির গন্ধে আপ্লুত সহসা। সত্যি পুরিয়ায় আকুল তান ধরেছে সানাইদার। কোনো বিয়ের মিছিল চলেছে বুঝি পাশের পথে। তারপর দুর্গামোহনের ব্যান্ডপার্টিও যোগ দিল ঝলমলে পোশাক পরে। বিস্মিতা নয়ন দ্রুত উঠে এসে ময়দানে দাঁড়াল। এবং তখনই দেখতে পেল রতনকে।

রতন তাঁবুর শেষ প্রান্তে একটা পিপুলগাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর চাপাটি তাকে প্রচণ্ড হাত—পা নেড়ে কী বোঝাচ্ছে। অস্ফুট হাসছিল নয়ন। ঘৃণা না, দুঃখ না—বরং একটা আশ্চর্য প্রসন্নতা দীর্ঘ স্বপ্নসংকুল ঘুমের পর ক্লান্ত স্নায়ুতে নিবিড়তর হচ্ছিল। স্বপ্নের উত্তেজনায় তার মস্তিষ্কের যে কোষগুলি জাগার পরও আড়ষ্ট হয়ে ছিল, হঠাৎ এইসব অদ্ভুত দৃশ্যের দোলায় তারা পরিচ্ছন্ন হতে পারছিল। প্রশান্ত হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে।

এ কি সুখ না দুঃখ। এ অনুভূতির কোনো প্রকৃতি বুঝি মেলে না। খানিক পরে কেষ্টা একগাল হেসে বলল—’আসতে কি চায় মাস্টার, এরকম কোলে তুলে নিয়ে এল বাবু। তাও হাত—পা ছোড়াছুড়ি করছিল বাচ্চা ছেলের মতো। বাবু বললে—অপমান করেছ, তাতে কী হয়েছে—আমরা ঘরছাড়া মানুষ, ওসব ব্যাপার মনে রাখি না! তাতে তুমি আমার ছেলের মতো….’

রঘু এসে বলল, ‘ও নয়নদি, বাবু তোমায় শিগ্রি সাজতে বললে।’

নয়ন বলল, ‘কেন, আজ থেকে শো বন্ধ না?’

‘তা জানি নে বাপু। বললে, সাজতে বল গে, বললুম। শোনা না শোনা তোমার ইচ্ছে।’

‘আমি সাজব না, বল গে যা।’

‘বেশ, বলছি।’ রঘু গোমড়া মুখে চলে গেল।

একটু পরেই দুর্গামোহন এল। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, হাতে একটা ময়ূরমুখো ছড়ি।

‘কই রে নয়ন, এখনো সাজগোজ করলি নে? তোরা আমাকে পাগল করে ছাড়বি দেখছি।’

নয়ন চুপ করে থাকল। আবার কোনো নতুন খেলা শুরু হবে তা হলে।

দুর্গামোহন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল—’হতচ্ছাড়ি মেয়েটা দু’ঘা না খেয়ে ছাড়বে না আজ। ওরে বাছা, একটু চোখ—টোখ খুলে দ্যাখ দিকি—ওই রঘু কেষ্টা চাপাটি ভূপতি লক্ষ্মণ সব কেমন সেজেগুজে ফিটফাট…ছি ছি—তোর একটুও আক্কেল নেই….’

রঘু কেষ্টারা ততক্ষণে সত্যিসত্যি সেজেগুজে ফিটফাট। প্যান্টশার্ট পরে ঘোরাফেরা করছে। তাঁবুর ও—পাশে কী যেন বানাচ্ছে সব বাঁশ পুঁতে। রঙিন কাগজের ফুল জড়ো হয়ে আছে তক্তপোশের ওপর।

পুরিয়ায় তান তখনও শেষ হয় নি। দ্রুততর আলাপে দারুণ আকুলতা। বসন্তের রক্তরোদ উজ্জ্বলতর হচ্ছে বেলাশেষের মুখোমুখি। দুর্গামোহন গজগজ করছিল একটানা—’হা—ঘরেদের আবার বিয়ে! না মা, না বাবা, না সমাজ—সংসার! আকাশ থেকে খসে পড়া সব। দুত্তেরি!’

নয়ন এবার এতক্ষণে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল—’বিয়ে, কার বিয়ে?’

‘তোর।’

‘কার হাতে আমাকে তুলে দেবে তুমি?’ এ চিৎকার ছিল বিপন্ন মেয়ে—মানুষের। কিন্তু চোখে তার জল ছিল না—ছিল প্রচণ্ড জ্বালা। ক্ষিপ্তা নয়ন বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠেছিল—’না, না, না!’

বরবেশী রতন এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডাকল—’নয়ন, লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। দেরি কোরো না!’

দুর্গামোহন বলে, ‘পুরুষ মরে একবার, কাপুরুষ মরে হাজারবার। এই হাজারবার মরার ঘা খেয়ে খেয়ে সে কুত্তার মতো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে।’ রতন বোস হয়তো আসলে কাপুরুষই—সিংহের মুখে মাথা ঢুকিয়েও যে বাঁচার কথা ভাবত দেখত, তার আলজিভের ওপর নয়নতারার নাচ।

এই যে ঘরছাড়া যাযাবর মানুষগুলি, তাদেরও এমনি করে বিয়ে হয়, ছেলেপুলের জন্ম হয়। জলজ গাছের মতো তারা ভাসতে ভাসতে যায়—কিন্তু মূলও থাকে এমনি করে। মূল ছাড়া সংসারে কে বাঁচতে পারে? মূল একটা থাকেই কোথাও—দৃশ্য বা অদৃশ্য—নানা রূপে।

কাপুরুষ রতন বরবেশে যেন নতুন করে মরল। মরে আবার বাঁচল। ছোট্ট তাঁবুতে বাসর সাজানো হয়েছিল একটা। এদিকে রূপকণ্ঠীতে খবর রটতে দেরি হয়নি। ওদিকে মেলার লোকজন তো রয়েছেই। সবখানে একটা কৌতূহল। যাযাবর ইরানিদেরও এমনি করে বিয়ে হয়, বাজি পোড়ে, ফুলশয্যার রাত আসে—কে না দেখেছে! মেয়েরা এসেছিল দলে দলে। অদ্ভুত রকমের বিস্ময় নিয়ে নয়নতারাকে দেখে যাচ্ছিল তারা। রতনকেও দেখছিল। ফাজিল মেয়েও কম ছিল না দলে। ‘ও জামাইবাবু, ওই বুঝি তোমার নতুন সিঙ্গি!’

‘মেয়ে সিঙ্গি রে, মেয়ে সিঙ্গি।’

‘সেটা বুঝি পুরুষ ছিল?’

এক প্রৌঢ়াও এল ভিড় ঠেলে। আঃ, থাম দিকি তোরা। বলি, ওগো কনে বউ, তোমার ঘোমটা কোথায়? মরণ! এ—যুগের মেয়ে তো….

‘মা থাকলে কত খুশি হত, আহা!’

‘বাবা তো রয়েছে।’

‘অমন বাবার মুখে আগুন! মেয়ের নাচ বিক্রি করে খাচ্ছে….’

‘চুপ কর তো বাপু! আজ ওদের শুভরাত্রি—কুকথা বলতে নেই।’

উলুধ্বনি দিয়ে চলে গেল একদল। আবার অন্যদল এল। ‘বাঃ, কী মানিয়েছে!’

‘হ্যাঁগা, তোমরা কী জাত?’

‘জাত নিয়ে ধুয়ে খাবে। আকাশের তলে ঘর যাদের—তাদের আবার জাতবেজাত….’

‘কিন্তু দ্যাখ নীরু, মেয়েটির মুখ যেন কতকটা সেই…..কী নাম যেন, ঢপের দলে সেবার দেখেছিলুম….কী নাম ছিল রে?’

দুর্গামোহন ছড়ি হাতে তেড়ে এসেছিল। কী দেখছ সব এখানে, অ্যাঁ? ভাগো, ভাগ….’

‘কেন বাবা? এমন দিনে ওদের দেখবে না তো দেখবে তোমার খেলার আসরে? কী মানুষ তুমি বলো তো? আত্মীয়—স্বজন পাড়া—পড়শি থাকলে কাকে ঠেকাতে?’ সেই প্রৌঢ়া চোখমুখ লাল করে উঠে গেল।

তারপর রঘু আর কেষ্টা লাঠি হাতে দাঁড়াতেই সব ফাঁকা। রাত নেমেছে। মেলা তখন আলোয় আলোয় উজ্জ্বল। কোলাহলে টলমল করে কাঁপছে। খেলার বাঁশি বাজছে। ম্যাজিক পার্টির ওদিকে জয়ঢাক আর ভেঁপু বাজছে। এখানে হ্যাসাগের আলোর পাশে ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র প্রকাণ্ড ধূসর তাঁবুটা প্রায় নিস্তব্ধ। আকাশে নক্ষত্র জ্বলছে তার শীর্ষে। বসন্তের মরশুমি হাওয়া গায়ে লাগে। কী ফুলের গন্ধ আসে ভেসে। সামনের আলোটা কে সরিয়ে নিয়ে গেল। বাসর—তাঁবুতে হারিকেন দিয়ে গেল চাপাটি। মুখটিপে নিঃশব্দে সে হাসছে।

এর নাম সাদি। এরই জন্যে লখনৌর গলিপথে একদিন সানাই বাজছিল সারাটি রাত। ভোরের আগে সে তান দিয়েছিল—জাগো মোহন প্যারে, জাগো……

‘নয়ন, আমি কি ভুল করলাম?’

‘কেন ভুল?’ হঠাৎ ফণা—তোলা সাপের মতো সোজা হয়ে মুখ তুলে বলল নয়ন। এ—বলায় একটা প্রচণ্ড বিশ্বাসের আমেজ ছিল। ‘না, তুমি কোনো ভুল করোনি।’

‘কিন্তু বাবু যদি ফের তোমায়…..’ বলতে গিয়ে থেমেছিল রতন।

‘উনি তো প্রতিজ্ঞা করেছেন—আর জুয়ো খেলবেন না।’

‘যদি সে প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলেন?’

নয়ন ঘাড় নেড়েছিল। ‘অসম্ভব। আমি জানি, উনি এককথার মানুষ। তুমি ক’দিন দেখেছো আর?’

‘কিন্তু….’

কিন্তু কী?

‘নয়ন—আমি ঘর চেয়েছি, সংসার চেয়েছি! অন্য মানুষ যেমন করে বাঁচে, তেমনি করে।’

‘আমিও কি তা চাই নে?’

রতন এতক্ষণে হেসেছিল—’তবু কী মজা দ্যাখো না, অভ্যাস এত হাড়ে—হাড়ে দানা বেঁধে আছে—মনে হচ্ছে স্টেজে ঘণ্টা পড়ল—আমার পালা। সিংহটা উঠে দাঁড়িয়েছে খাঁচার ভেতর….’

নয়নও হাসছিল এ—কথা শুনে। ‘শুধু কি তোমার? জানো, কতবার আমি ছেড়ে দিতে চেয়েছি এ—সব নাচগানের লাইন, বাবুও অমত করেননি, অথচ আমার সব ফাঁকা মনে হয়েছে। ক’দিন পরেই পা সুড়সুড় গলা গুনগুন ….’ ভীষণ হাসছিল বলতে বলতে।

‘তোমার বাবুরও তো তাই। একই রোগ হাড়ে হাড়ে।’

নয়ন হাই তুলে বলেছিল—’মরুক গে ও—সব কথা। যা হবার হবে। ভেবে লাভ নেই। এসো, ঘুম পাচ্ছে আমার।’

বস্তুত তারা যে রোগাক্রান্ত, টের পাচ্ছিল একটু করে। এবং ক্রমান্বয়ে যেন ভিতরে ভিতরে একটা আপসের বোঝাপড়া চুকে যাচ্ছিল। মল্লারপুরে ফিরে এল দুর্গামোহন। তার কথা রাখল। তাঁবু আর খেলার জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরে ভরে দিল। নতুন সংসার পাতার হাবভাব তার আচরণে। কেবল মধ্যে মধ্যে নয়ন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠত। দেখত দুর্গামোহন তার ওপরের ঘরে একা একা দুপুর রাত অব্দি পাশার ছকের ওপর গুটি চলেছে। মুখের হাসি নির্জন ঘরে যেন ছড়িয়ে পড়ছে হাড়ের গুটির শব্দ হা—হা—হা—হা……! কত রাতে উঁকি মেরে সে দেখেছে, বোতল থেকে মদ ঢেলে খাচ্ছে দুর্গামোহন আর লাল চোখে ছকের দিকে তাকিয়ে আছে। একপাশে স্তূপীকৃত খুচরো পয়সা আর একগোছা নোট। নিজের সঙ্গে নিজেই জুয়ো খেলছে সে। তারপর একসময় বালিশে কাত হয়ে গুনগুন করে তার প্রিয় রাগিণী টোড়ি ভাঁজছে—লখনৌর সেই মোহন ওস্তাদ যেন আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে তার অস্তিত্বে—সেই গভীর সকাতর আহ্বান সুরে।

নয়ন আরও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল দিনে দিনে।

দুর্গামোহন একা বেরিয়ে যায় সন্ধ্যায়—কোনোদিন ফেরে গভীর রাতে, কোনোদিন ফেরে না। রঘুকে প্রশ্ন করলে বলে—’বাবা, বাইরে গেছে। বলে গেছে—আজ ও বেলা ফিরবে।’

নয়নের চোখে জল আসত। ‘কেন, আমি কি পর হয়ে গেছি? বলে যেতেও মুখে বাধে?’

রতন বলত—’নয়ন, একটা কথার জবাব দেবে?’

‘জবাব দেব না কেন? ও সব হেঁয়ালি ছাড়ো তো।’

‘জুয়োখেলা বা মদ ছাড়া বাবুর আর কোন নেশা আছে জানো?’

‘অ্যাঁ!’ ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো চোখেচোখে তাকিয়ে ছিল নয়ন। রতনের কথা সে বুঝতে পারছিল না।

‘উনি আমাদের গুরুজন। তবু বলা ছাড়া উপায় নেই….’

‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘বাবু কোনো মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়েছেন হয়তো।’

‘মিথ্যে, একেবারে মিথ্যে!’ নয়ন হাতমুখ নেড়ে প্রতিবাদ করেছিল। ‘আমার মা মরে গেলে কোনোদিন কোথাও বাবুকে ও পথে পা বাড়াতে দেখিনি। সেই বারো বছর বয়স থেকে আমি দেখছি। ওটা ঠিক নয়—ভুল সন্দেহ তোমার।’

‘তবে কি ফের জুয়ো খেলতে যান?’

নয়ন নীরবে চোখেচোখে তাকিয়ে ছিল। হয়তো তাই। শিউরে উঠেছিল সে। আর তো কোনো নিয়মিত রোজগার নেই। সম্পত্তির মধ্যে শুধু এই বাড়িটা, আর কিছু জমানো টাকা। তাতে এতগুলি লোক পুষছে। অনেকের মাইনেও দিতে হয়। ছাড়িয়ে দিতে বলেছিল নয়ন। দুর্গামোহন বলেছিল—’বড়ো মায়া হয় রে। অনেকদিনের সঙ্গী—ছেড়ে দিলে কোথায় যাবে? কী খাবে?’

‘হ্যাঁ—পাপের সঙ্গী তো! ছাড়তে পারা কঠিন!’

দুর্গামোহন একটু হেসেছিল। তা ঠিকই বলেছিস বাছা।’

‘তা হলে ছাড়বে না ওদের?’

‘ওরা যদি নিজে থেকে বিদায় না নেয়, আমি কী করি বল তো!’

চেষ্টা করেছিল নয়ন। রঘু আর কেষ্টা কোনো জবাব দেয়নি। মুখ গোমড়া করে সরে গিয়েছিল। সে বেলা খেতেও আসেনি। শেষে ডেকে সাধাসাধি করে আনতে হল। আর ভূপতি তো কেঁদে একাকার। চাপাটি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্বিকার থাকল। তখন বয়সে সেই সবচেয়ে ছোটো, নেহাত বাচ্চা—তাতে অনাথ। যাবেই বা কোথায়? ওদিকে দারোয়ান অনন্ত ট্যারচা তাকিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল—’বর্ষা পড়লে বাবুর মেজাজ এমন না হয়ে পারে না। আবার পুজোপাব্বন, মেলা টেলা আসুক। দেখবে, বাড়িঘর ফেলে দে ছুট হিল্লি—দিল্লি। তখন পাহারা দেয় কে? যে চোর—চোট্টার দেশ, চৌকাঠ জানালা খুলে সব ঝাঁঝরা করে ফেলবে না?’

ফের জুয়োয় বসলে জমানো টাকা শেষ হতে কতক্ষণ! কারণ, নিজের আসরে ‘ভাগ্যের ঘরে’ যে লোকটি সম্রাট—সে বাইরে অন্যের আসরে তো সাধারণ মানুষ মাত্র। তখন তো নয়ন—নটী পাশে নেই যে তুলাদণ্ডের ভার তার দিকে ঝুঁকিয়ে দেবে একটি বিলোল কটাক্ষে। নয়ন পাশে থাকলে প্রতিমুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে থাকে খেলোয়াড়রা। এ খেলার চেয়ে তখন নয়নের চোখের ছকে আগুনের গুটির চাল সামলাতে তারা ব্যস্ত।

শিউরে উঠেছিল নয়ন। রতনকে বলেছিল—’তুমি পুরুষমানুষ, চুপচাপ বসে এ সব দেখবে?’

‘কী করতে পারি আমি?’

‘বেশ, চুপ করে থাকো।’

রতন ক্ষুব্ধভাবে বলেছিল—’ও, রোজগার করতে বলেছ, তাই না?’

‘যদি তাই ভেবে থাকো, বেশ। কিন্তু রোজগার কি কোনোদিনই করতে হবে না তোমাকে?’

‘খুব সংসারী হয়ে গেছ দেখছি।’

‘সংসার বুঝি ভালো লাগে না তোমার?’

রতন হঠাৎ তার মনের কথা বলে বসেছিল—’না’ নয়ন—না। একটুও না। আজ চারটি মাস ধরে এই চুপচাপ বসে থাকা আর ভালো লাগে না আমার।’ আশ্চর্য, এতদিন ঠিক উলটো কথাটি সে বলে আসছিল।

‘তবে চাকরির চেষ্টা করো কোথাও।’

নয়ন সহজ মনেই এ কথা বলেছিল। কিন্তু রতনের মনে ততদিনে একটা ভিন্ন সুর—যে সুর তার রক্তের গভীরে চিরদিন বিচরণ করেছে। সে বলেছিল—’সংসারের ওইসব মানুষগুলোর মতো কুত্তা হয়ে বেঁচে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। নয়ন, একদিন হাজার হাজার মানুষ আমাকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠেছে—ওই মাস্টার রতন বোস, ওই সে ওস্তাদ খেলোয়াড়—আজ পথের ভিখিরিও আমার দিকে মুখ তুলে চায় না! এ বাঁচার কোনো মানে নেই।’

নয়ন ক্রুদ্ধ হয়েছিল। আর কোনো কথা বলেনি। সে ভেবেছিল—এই নতুন জীবনটা কোনো মাটির ওপর ফলে ফুলে বিকশিত করে তুলবে। কিন্তু তা যেন হবার নয়। কোথাও তার বোঝবার একটা ভুল ক্রমাগত থেকে যাচ্ছে। ওই দুর্গামোহনকেও সে চিনতে পারেনি, রতনকেও না—এমনকি হয়তো নিজেকেও।

নিজেকেও চেনেনি সে। তার প্রমাণ পেল কিছুদিন পরেই।