নীল ঘরের নটী – ৬

।। ছয়।।

ক—দিন পরে।

এ মেলার লাইসেন্সের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। নতুন করে মেয়াদ না বাড়িয়ে নিলে শো বন্ধ রাখতে হয়। দুর্গামোহন খুব ভোরে শহরের দিকে চলে গিয়েছিল। সঙ্গে নিয়েছিল তুষ্টুরাম আর ডিব্বুকে। এবং যাবার সময় সকলকে বলে গিয়েছিল, বাঁশিবাবুর নির্দেশ যেন তারা মেনে চলে তার অবর্তমানে বাঁশিবাবুই তাদের মালিক।

তারপর নয়নতারাকে বলেছিল, ‘বেচারির কোনো অসুবিধে হয় না যেন। একটু দেখিস, নয়ন।’

এ কথা বলার আবশ্যকতা কী, আমি জানতাম না। হয়তো নয়নতারাও না। রোদ উজ্জ্বল হয়ে উঠলে শুনি চাপাটি আমার নাম বদলে ‘ছোটোবাবু’ করে দিয়েছে।

দুর্গামোহনের কারচুপিটা ধরা পড়েছিল পরে। সে আমায় একটু নিশ্চিন্তে সুযোগ করে দিয়েছে যেন। নয়নতারার সঙ্গে নিভৃতে ইচ্ছেমতো মেলামেশার সুযোগ। সে রাতের সেই কাণ্ডের পর নয়নতারাও ঈষৎ ঝিমিয়ে যাচ্ছিল। নাচগানের খুব একটা জমাট আসছিল না। তুষ্টুরাম নেহাত কাজের কথা ছাড়া আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করছিল না। আবহাওয়াটা কিছু মন্দা চলছিল। নয়নতারার আকর্ষণে যত নতুন ও আনকোরা লোক জুয়োয় বসবে, তত লাভ তবু দর্শকদের আমরা কিছু টের পেতে দিইনি। মধ্যে—মধ্যে কেবল তুষ্টুরাম তার সঙের ছলে সব জানিয়ে দেবার তালে থেকেছে যেন। আর দুর্গামোহনের লাথি খেয়ে ‘অঁক’ করে বসে পড়েছে। লোকটাকে সে এত ভয় পায় কেন, আমি বুঝতে পারিনি।

নয়নতারা বলল, ‘নন্দ, বাবুর কাণ্ডটা দেখছো?’

মাথা নেড়েছিলাম। ‘দেখেছি।’

‘লোকটা বুড়িয়ে যাচ্ছে, তবু যেন নাবালক থেকে গেল।’

‘কেন, নয়ন?’

‘তোমায়—আমায় ভাব থাকলে কি সুযোগের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয়? সুযোগ ঠিকই জুটে যায়।’

সকৌতুক বললাম, ‘ভাব নেই বলতে চাও?’

‘তা আর নেই!’ নয়ন হাসল। ‘ভাবে ডুবে রয়েছি।’

এ সময় তাকে প্রগলভা ও চতুরা অভিনেত্রীর মতো দেখাচ্ছিল। গানের নয়নতারা এ নয়। কিংবা তুষ্টুরাম ক্লাউনের বাহুর নীচে মাথা যে—মেয়েটি শুয়ে থাকে, সেও ঠিক এ না। এ যেন ওই পাশার প্রান্তবর্তী বেশ্যাটা।

নাকি অ—ধরাকে যখন হাতের কাছে ধরা—ছোঁয়ায় পেয়ে যাই, মনে হয় এ তো একটা বানানো পুতুল, সে কই? তবু আমরা দুর্গামোহনের অলিখিত নির্দেশ পালনে তৎপর হয়েছিলাম। তাঁবুর ভেতর কানামাছি খেলছিলাম। পরস্পর কাতুকুতু দিচ্ছিলাম। লুটোপুটি করছিলাম ছেলেমানুষের মতো। তারপর একসময় হারমোনিয়াম বের করে একটা গান গেয়েছিলাম পালাক্রমে।

চাপাটি এসে বলেছিল, ‘ছোটোবাবু নাইবার সময় হল।’

‘ও নন্দ চলো—ওই দিঘিতে নেয়ে আসি দুজনে।’

‘বেশ তো। চলো।’

অনেকদিন বন্ধ অন্ধকারে আঁকুপাঁকু করার পর হঠাৎ মুক্তির আলো হাওয়া গায়ে লেগেছে। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুষ্টুরামের প্রতি একটুও ভয় অবশিষ্ট ছিল না। দুর্গামোহন আমার ঈশ্বর হয়ে মাথার উপর বিরাজ করছে। সেই ঈশ্বর আজ বলেছে, তোমাকে ছুটি দিলাম নন্দ—ভালোবাসার ছুটি।

চৈত্রের দুপুরে আমবাগানের ছায়ায় বন্ধনহীন পাখির মতো ভেসে চলছিলাম।

‘ও নন্দ, আমাকে ধরতে পারো?’

বিস্তৃত ছায়ার কেন্দ্রে সে মাঝে মাঝে চোখের আড়ালে লুকিয়ে যেতে চাইছে। ‘এই তো ধরেছি।’

শেষ প্রান্তে নেমে নয়নতারা বলল, ‘এইটুকু অব্দি বেশ ভালো। নদীর স্রোতে ভেসে চলার মতো। কিন্তু ঘাটে ভিড়লেই কপালে চোট খেতে হয়।’

‘তুমি খেয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ। এই যে’—কপালের দাগটা দেখাল সে।

‘কে মেরেছিল?’

সকৌতুকে হেসে উঠল নয়নতারা। আমার ভালোবাসার পুরুষ। সে বলতো, পাশার ছকে যাবে না, মদ খাবে না, কারুর গায়ে গা দেবে না’…দম নিয়ে ফের বলতে থাকল,…’ঢলাঢলি করবে না, হাসবে না…’

উচ্ছ্বসিত হাসিতে টলে—টলে পড়ছিল সে।

একটু পরে আবার বলল, ‘আচ্ছা নন্দ, তুমি তো অনেক লেখাপড়া জানো। বলো তো, আমার ভাগ্যের মালিক আমি, না ওই শয়তান জুয়াড়িটা?’

‘নয়ন!’ অস্ফুটভাবে চিৎকার করলাম। ‘সে তোমার বাবার মতো। তোমাকে সে—ই মানুষ করেছে।’

আমবাগান এখানে শেষ হয়েছে। একপাশে কিছু চষা জমি—অন্যপাশে বনঝোপ আগাছায় ভরা নির্জন একটা মাঠ। আমার কথা শুনে নয়ন একটুখানি দাঁড়াল। ফের চলতে থাকল। সে কিছু বলছিল বিড়—বিড় করে।

বললাম—’ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’ দিঘি তো এদিকে!

জবাব না দিয়ে আরও খানিক চলে একটা হেলে পড়া গাছের নীচে ধূপ করে বসে পড়ল। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, নয়নের চোখ দুটি একটু ভেজা—ভেজা। ‘কী হয়েছে তোমার?’ বিস্মিতভাবে না বলে পারলাম না এ কথা। সত্যি বলতে কি, আজ ছুটির দিনের মাধুর্যটিকে নিটোল রাখতে চেয়েছি—তখন হঠাৎ নয়নের এই দুঃখোচ্ছ্বাস বিরক্তির উদ্রেক করে।

কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারছিল। বলল—’আজ আমারও ছুটির দিন, নন্দ। ইচ্ছা করে যা খুশি বলি, যা খুশি করি…অনেক দিনের জমানো কথা, অনেক না—করা কাজ….

নয়নের মুখ একটু লালচে দেখাচ্ছিল। কিন্তু গাঢ় ছায়ায় ডুবে থেকে তার শরীর যেন স্মৃতির শীতল জলে উত্তাপ নাশ করছে—সেই আরামে তার চোখ দুটি স্থির।

মুখোমুখি বসলাম। হাসিমুখে বললাম—’তোমার সব কথা ও কাজের পাশে আমি তাহলে সাক্ষী রইলুম, কী বলো? তুমি বলবে আমি শুনব, তুমি করবে আমি দেখব!’

নয়ন একটু ঝুঁকে এল আমার দিকে। ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘আমায় পাহারা দিতে তোমাকে বলে গেছে বাবু না নন্দ?’ তারপর সে হাসতে থাকল। ‘যদি পালিয়ে—টালিয়ে যাই…’

‘কী যে বলো!’

‘বাবু আমার জন্যে একজন করে পুরুষ পাহারাদার রাখে, আমি বেশ বুঝি।’

‘নাঃ। দুর্গাদা তোমাকে মেয়ের মতো স্নেহ করেন। মানুষও তো করেছেন তোমাকে!’

‘মানুষ!’

ঘৃণা না ব্যঙ্গ, ব্যঙ্গ না কৌতুক—অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল নয়ন। ফের বলল—’অনেককেই বাবু এমনি করে মানুষ করেছে। ওই রঘু, কেষ্ট, চাপাটি—কে নয় নন্দ? তোমাকে কি মানুষ করছে না?’

হেসে বললাম—’তা করছে বইকি! ‘তুষ্টুরামকেও হয়তো—’

‘তাঁবুতে ভাগ্যের ঘরে যেখানে যত মানুষ এসে জড়ো হয়, সকলকেই ওই লোকটা ভগবানের মতো কোল দ্যায় আর মানুষ করে। আহা, অবতার একজন!’ ঈষৎ মাথা দোলাল সে। চোখ বুজিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। ‘নন্দ, আমি তোমার মতো লেখাপড়া জানি নে—কিন্তু অনেক ঘুরেছি, তোমার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দেখেছি জীবনে। আমার মনে হয় কী জানো? আমরা সবাই হয়তো অমনি এক জুয়াড়ি ম্যাজিকওলার হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে বসে আছি। আমি কি ভুল বলছি, নন্দ?’ নয়নতারা আমার অলক্ষ্যে দু—এক পাত্র মদ গিলেছে কিনা সন্দেহে আমি ওর একটু কাছ ঘেঁষে সরে গেলাম। ইচ্ছে করলে এ নির্জন বনভূমিতে তাকে চুমু খেতেও পারতাম—হয়তো সে আপত্তি করত না—কিন্তু যেরূপ গভীর আবেশে সে কথা বলছে, প্রায় সদ্য ধ্যানভঙ্গের পর সন্ন্যাসিনীর মতো। সুতরাং একটা পবিত্রতা যেন তাকে ঘিরে রাখছিল। আমি দ্বিধাভরে দু—একবার মদের গন্ধ শোঁকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম মাত্র।

‘নন্দ, ওই বজ্জাত পাপী জুয়াড়ি আমার মাকেও নাকি মানুষ করেছিল। মা মরবার সময় আমাকে বলেছিল এ কথা। আমি তখন বারো বছরের মেয়ে…’

নির্জন চৈত্রের দুপুরে বনভূমিতে ঘুঘুপাখির ডাক শুনতে শুনতে এক সময় যেন অনেক দূরে পুরানো দিনের হাসি—কান্নাময় জীবনের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

একটি বারো বছরের মেয়ের পায়ে ঘুঙুর বাজছিল ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। পাশার ছকের মতো চিত্রিত রঙিন সতরঞ্চের ওপর নির্ভুল তালে পা ফেলে ফেলে নাচছিল নয়নতারা। মনোমোহিনী বাঈজীর মেয়ে।

সেদিন এ তাঁবুর জগৎ ছিল না। ছিল না পৃথিবীটা এতখানি ব্যাপকতা নিয়ে। লখনৌ শহরের অন্ধকার এক গলির প্রান্তে প্রাচীন কোঠাবাড়ির নিভৃত ঘরে সেই প্রথম জীবনের দিনগুলি সবে একটি—দুটি পাপড়ি উন্মোচিত হচ্ছে—গন্ধ ছড়াচ্ছে চুপিচুপি। ক্ষুধার্ত চোখে শরাবি মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে—ওই ওসমান খাঁ বাঘের মতো।

কিন্তু শাসনের কমতি ছিল না। দুর্গামোহন তখনও পুরো জুয়াড়ি হয়ে ওঠেনি। সে তখন আসলে এক নামজাদা ওস্তাদ—লোকে বলত ওস্তাদজি। মনোমোহিনীর নামের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে ‘মোহন ওস্তাদ’ও বলত অনেকে। কালক্রমে মোহন ওস্তাদ আর মোহিনী বাঈজী লখনৌয়ের সংগীতসমাজেও হয়তো স্থান করে নিতে পারত—কিন্তু ওস্তাদেরও ওস্তাদ থাকে। মোহন ওস্তাদের সেই ওস্তাদ—যার নাম নিয়তি—যাকে লোকে বলে ভাগ্য—তার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন—লক্ষ্য ছিল অন্যখানে।

ছেলেবেলা থেকেই দুর্গামোহন জুয়াখেলায় আসক্ত। জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে সে দেশ ছেড়ে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু বন্ধুর অভাব তার কোনোখানেই হয়নি। মুখের গুণে বন্ধু সে পেয়েছে অনেক। জুয়ার নেশা যার রক্তে, অহরহ যার চলাফেরা জুয়াড়িদের ছকের আনাচে কানাচে, তার দোস্ত বন্ধু বলতে কাদের বোঝায় সে তো জানা কথা! এবং এই বন্ধুদের সঙ্গ ধরেই সে বারবনিতাদের ঘরে পৌঁছেছিল। নরকের অবশিষ্ট অন্ধকার জগতে সে প্রবেশ করেছিল একদিন।

মনোমোহিনীর সঙ্গে পরিচয় এমনি করে। দুর্গামোহন—তখন মোহন—বলেছিল, ‘এত সুন্দর তুমি গাইতে পারো, অথচ এই ভাগাড়ে পচে মরছো কেন মোহিনী।’

কেন? সে মুহূর্তে কথার জবাব দিতে পারে নি মনোমোহিনী। পরে কোনোদিন দিয়েছিল। বলেছিল—’কী করব তবে? তোমার মতো আমিও যে নিজের জীবনকে নিয়ে জুয়া খেলেছি মোহন। আজও খেলছি। এ খেলার নেশা বড়ো কঠিন।’…

দুর্গামোহন জানতে পেরেছিল মোহিনী বাঙালির মেয়ে। এক মুসলমান ওস্তাদের সঙ্গে দেশত্যাগ করে তার এই পরিণতি। সে বলেছিল—’তুমি মিথ্যা বলোনি মোহিনী। কিন্তু মনে রেখো দেবতারাও জুয়ো খেলেন। কে না খেলে! তবে কেউ খেলে হাড়ের গুটি নিয়ে পচা পাঁকের পাশে ছক পেতে, কেউ খেলে রাজপুরীতে সোনার গুটিতে। কেউ অন্ধকারে চুপিচুপি—কেউ ঝাড়বাতির আলোয়। আমি তোমায় আলোয় নিয়ে যাবো মোহিনী। তুমি যাবে?’

মোহিনী মোহিতা হয়েছিল। দুর্গামোহনের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে যেন একটি জাদুদণ্ড। তার চোখের দৃষ্টিতে যে আত্মবিশ্বাস, তা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, সাহসী করে তোলে। তার মুখের একটি কথায় যেন নিমেষে আগুনের কুণ্ডে ঝাঁপ দেওয়া যায়। সে আরও বলেছিল—’মোহিনী, গান মানুষকে যে ঘরছাড়া করার একটা দারুণ কারচুপি, এ কথা তুমি আমি যেমন করে বুঝি, আর কেউ বোঝে না। গান যেন বাইরের একটা আলোর দুনিয়া। বুকে হাত দিয়ে বলো তো, তুমি কি চেয়েছিলে যে এই অজানা—অচেনা দেশে এমনি এক অন্ধকার গলিতে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকবে অন্য কারুর জন্যে—যাকে তুমি ঘৃণা করো। চাওনি। চেয়েছিলে অন্য কিছু—সহজ কোনো পাওনা। কেন না, তোমার ভালোবাসা ছিল সহজ। আকাশের রং যেমন নীল—তোমার ভালোবাসাও তোমার রং। এ অব্দি হিসেব করে দেখলে কোনো অন্যায় নেই তোমার। অথচ সব সহজকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল তোমার গান। তুমি যাকে ভালোবাসলে, তাকে আসলে গানের ওস্তাদ বলেই ভালোবাসলে। নয় কি?’

মোহিনী অস্ফুটকন্ঠে বলেছিল—’কী জানি!’

দুর্গামোহন তার জানুতে থাপ্পড় মেরে বলেছিল—’আলবাৎ! মানুষ ভালোবাসার ব্যাপারে একটা অজুহাত খোঁজে। আমি বলি, শেষে একদিন—ওই অজুহাতটাই তার ভালোবাসার কাল হয়ে ওঠে।’

সত্যি, গান যেন বাইরের এক আলোর দুনিয়া।

সেই দুনিয়ায় নতুন জীবন শুরু হল মনোমোহিনীর। মোহিনী বাঈজীর রূপ আর কণ্ঠের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। তারপর একদিন দেখা গেল দুর্গামোহন গানের আসরের শেষে হারমোনিয়াম ঠেলে সরিয়ে রেখে পাশার ছক বিছিয়ে দিচ্ছে। হাড়ের গুটি ছড়িয়ে পড়ছে প্রেতের অট্টহাসির মতো নিশীথ রাত্রির নিস্তব্ধ পরিবেশে।

মোহিনীর হাতে মদের গেলাস গুঁজে দিয়ে সে ফিসফিস করে বলে উঠল—’নতুন খেলা শুরু হল মোহিনী, তোমার মদত ছাড়া সবই ভুল হয়ে যাবে।’

মোহিনী প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিল। সে ভেবেছিল—শহরের অন্যান্য নাম করা বাঈজীদের মতো সেও লক্ষপতি আমির—ওমরার মুখোমুখি নাচবে—গাইবে—বখশিশ কুড়োবে। কিন্তু মোহন—ওস্তাদ তাকে এ কোন পথে নিয়ে এল। এ যে সেই বেশ্যা জীবনেরই উলটো পিঠ।

দীর্ঘকাল পরে বারো বছরের মেয়ে নয়নতারাকে নাচ শেখাতে গিয়ে মোহিনী তাই একদিন হঠাৎ যেন নিজের জীবনকেই প্রতিফলিত দেখতে পাচ্ছিল মেয়ের জীবনে। সে তখনই মূর্ছিত হয়ে পড়েছিল ফরাসের ওপর। আর সে মূর্ছা ভাঙেনি।

বারো বছরের নয়নতারা মাতাল জুয়াড়িদের ঠোঁটে মদের পেয়ালা তুলে ধরেছে। সে ভাবত, এই তার কাজ জীবনে। এর জন্যই সংসারে তার জন্ম। বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার মতো সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল তার কাছে এই পরিবেশের সুখ—দুঃখগুলি।

কিন্তু শাসন ছিল দুর্গামোহনের। একটা অলিখিত সীমারেখা ছিল কঠোরভাবে দাঁড় করানো। সবসময় তাকে চোখে চোখে রেখেছে দুর্গামোহন। নিভৃতে কারও সঙ্গে মিশতে দেয়নি। বাইরে গেলে, সে নিজে তার সঙ্গে গেছে। আর, ছেলেবেলা থেকেই তো এমন কি হাঁটু গেড়ে ঘোড়া—ঘোড়াও খেলত তাকে পিঠে নিয়ে। নয়নতারা কাঁদলে সে গল্প শোনাত। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করত না কোনোদিন।

কেন এত স্নেহ শাসন চোখে চোখে রাখা? বুঝি তার মনে ভয় ছিল মোহিনী মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে তার হাত থেকে।

সাবালিকা হয়ে নয়নতারার এই সন্দেহটা প্রথম দানা বাঁধে মনে। বয়সের ধর্ম যখন প্রকট হয়েছে, ভালো—মন্দ সত্যাসত্য বোধের গভীর ইন্দ্রিয়টা বুঝি দুয়ার খুলেছে নিঃশব্দে। সে টের পাচ্ছিল—দুর্গামোহন তাকে সারাজীবন যেন অবিশ্বাস করেছে।

কাকে এই অবিশ্বাস? নয়ন একটু করে বুঝতে পারছিল। সেও তার নিজের মধ্যিখানে কাকে দেখতে পাচ্ছিল—সে অন্য সুরে কথা বলে চুপি—চুপি। সে বলে অন্য আকাশ অন্য সব পৃথিবীর কথা। দোতলার জানালার পাশে বসে নিঃসীম নীল আকাশের প্রান্তে—প্রান্তে যে বিস্তৃত পৃথিবী—অসংখ্য মানুষ ও জীবনযাত্রা—তাদের সঙ্গে পরিচয়ের জন্যে নয়নতারা ছটফট করে মরছিল। দুর্গামোহন এসে দেখতে পেত চুপিসারে। নিঃশব্দে পা টিপে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর হঠাৎ বলত—’কী দেখছিস রে নয়ন?’

ধরা পড়ার অস্বস্তিতে চমকে উঠত নয়নতারা। হুড়মুড় করে বসত ঘুরে সে। আমতা হাসত। ‘কিছু না বাবু, কিছু না।’

পিঠে হাত রাখত দুর্গামোহন—’মন খারাপ করছে নাকি রে?’

নয়ন হেসে ফেলত—’ধ্যেৎ! তা কেন?’

মাথায় গাল রেখে দুর্গামোহন বলত—’খুব একঘেয়ে লাগছে, না রে? আয়, একটু আসর পেতে বসি।’ একদিন হঠাৎ আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেনি নয়নতারা। হু হু করে কেঁদে উঠেছিল! সে যেন ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছিল ‘বাবু’কে। বলতে চেয়েছিল—’আমাকে আর ভালো লাগে না এ সব….দোহাই, তোমার দুটি পায়ে পড়ি—অন্য কোথাও নিয়ে চলো…’

‘তোর মায়ের জন্য মন খারাপ করছে নয়ন?’

‘কী জানি! আমাকে কিছু ভালো লাগে না বাবু।’

‘কী ভালো লাগে তোর?’ দুর্গামোহন যেন হতাশভাবে ধুপ করে নগ্ন মেঝেয় বসে পড়েছিল। তার নিষ্পলক চোখের দৃষ্টিতে সম্ভবত কোনো অসহায়তা প্রকট হয়েছিল সেদিন। নিরুত্তরা নয়নের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ফের সে প্রশ্ন করেছিল—’আমি তোর বাবার মতো, লুকোস নে মা!’

‘বাবার মতো!’ আজ কথাটা ভাবলে হাসি পায় যত, ঘৃণাও জাগে ততখানি। অথচ সেদিন সত্যি সত্যি বিহ্বল হয়েছিল নয়ন। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুর্গামোহনের বুকে। অবরোধহীন কান্নার উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ছিল সে। তবু স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কী তার ভালো লাগে।

সোনারওয়ালি গলির সেই পুরনো ভূতুড়ে কোঠাবাড়িতে সেদিন সন্ধ্যায় আর মজলিশ বসেনি গানের। বদ্ধ দরজায় নিষ্ফল কড়া নেড়ে ফিরে গিয়েছিল মাতাল জুয়াড়ি আমির—ওমরা আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। অশ্লীল চিৎকার করে স্খলিতকণ্ঠে দুর্গামোহনকে শাসিয়েছিল কেউ কেউ। মোহন ওস্তাদের জলসা বন্ধ হলে তাদের জীবনে সকল দরজা বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। উঁকি মেরে দৃশ্যগুলি দেখছিল তবলচি পিয়ারচাঁদ, রাঁধুনি, বুড়ি নান্নু মা। তারা দুটিতে এ শহরে অনেকদিনের বাসিন্দা। গলি সোনারওয়ালি হালচাল ও মেজাজ তাদের তাই অজানা ছিল না। দুর্গামোহনকে বলেছিল—’বহত খারাবি হো যায়গি ওস্তাদজি,…ইয়ে ঠিক নহি…’

দুর্গামোহন ধমক দিয়েছিল—’কৌন হ্যায় মেরা জিন্দেগিকা মালিক? উওলোক তো নহি। হাম আপনা হাতসে জিন্দেগিকা মওকা হাসিল করতা, ঔর কই নহি।’

‘ইয়ে তো ঠিক বাত হ্যায়। লেকিন ওস্তাদজি, ইয়ে মহল্লাকা বহত বদনাম হ্যায়—ইস লিয়ে আপকো সমঝ করনা লাগে…।’

সমঝ দুর্গামোহনকে কে দিতে পারে। যে সারাজীবন নিজেই নিজের নিয়তি—কালপুরুষের মতো অবিচল সেই লোকটি কী সমঝ করে আসর বন্ধ রাখল, তা আজও জানার কোনো উপায় নেই। এদিকে নয়ন হঠাৎ যেন বদলে গেছে। নান্নু মা বুড়ির কাছে রান্নাশালায় বসে বসে গল্প করছে। বাংলাদেশের গল্প—যে গল্প দিনের পর দিন মা তাকে শুনিয়েছিল। বলেছিল—’এখনও মনে আশা ছাড়িনি আমি। অদৃষ্টে কী আছে জানি নে, চেষ্টা তো করব!’ এবং শুনতে শুনতে নয়ন বলে উঠত—’অদৃষ্ট না ছাই! তুমি, দেখে নিয়ো মা, আমি বড়ো হলে কিন্তু আর এখানে থাকছি নে।’ কেন বলত, তা কি জানে সে? তার মনে হত—সেখানে গেলে যেন তাকে আর চোখে—চোখে রাখার মতো কেউ টিকে থাকতে পারে না; কারণ আকাশ ও পৃথিবী সেখানে অন্যরকম—এখানকার মতো এত ছোট্টটি নয়। এতো গোলমালে উত্তেজনায় ভরা নয়। বরং শান্ত আর নির্জন। সেখানে বুঝি দুর্গামোহনও অন্যরকম মানুষ হয়ে উঠবে। সেখানে হয়তো অবলীলাক্রমে বাইরে ঘোরাঘুরি চলে—পাহারা দেবার কেউ থাকে না।

মা তাকে সম্ভবত এরূপ ধারণা দিয়েছিল ক্রমে—ক্রমে। আর এই গল্প শুনতে শুনতে বুড়ি নান্নুমা বলে উঠেছিল—’বাংলা মুলুক আচ্ছা হ্যায়—বেটি—সব মুলুকসে আচ্ছা, হাম জানতি হ্যায়। হাম পুরা এক সাল থী উঁহা। মেরি বেটি হ্যায় কলকাত্তামে!’

দুর্গামোহনের মতলব না জেনেও নয়ন বলেছিল—’ব্যাস, তব তো তুমকোভি লেনে পড়েগা মেরি সাথ…’ আশ্চর্য, কত রাতে ক্লান্ত শরীরে শয্যায় শুয়ে পড়ার পর অতন্দ্র জেগে নয়ন তার মায়ের দেশের সরল সুন্দর হৃদয়বান মানুষগুলির কথা ভেবেছে। তারপর ভাবতে ভাবতে একসময় স্বপ্নের মধ্যে অবিকল প্রত্যক্ষ করেছে তাদের। খাপছাড়া অদ্ভুত সব দৃশ্য দেবদেবীদের মতো সুন্দর সব মানুষ, নয়ন তাদের গান শোনাচ্ছে, তারা হাততালি দিচ্ছে,…

‘বেটি নয়নতারা!’ হঠাৎ ফিসফিস করে উঠছিল নান্নুমা। ‘ওস্তাদ—জিকো বোলনা নহী ইয়ে বাত…’

নয়ন হাসি চেপে তাকিয়েছিল বুড়ির দিকে।

‘মুলুকমে যানা তো আচ্ছা হ্যায়…বেটি, লেকিন এক সাচ বাত সমঝ দেতি হ্যায় তুমকো…’

‘ক্যা বাত রী আম্মি?’

‘নাচনা গাহনা সব ছোড়কে এক আচ্ছা লড়কা কা সাথ মিল যাও।’

পরামর্শটা বড়ো মজার। খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, নয়ন। নান্নুমা বুড়ি তাকে সাদির কথা সমঝে দিচ্ছিল। সাদি…সাদি কী? তার মা অনেক সময় এই রকম কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যেত। সাদি সম্পর্কে কিছু গোপন সাধ ছিল যেন তার। সোনারওয়ালি গলির এই ছাদে বসে নীচের পথে অনেক সাদির মিছিল সেও দেখেছে। নহবতে সানাইয়ের করুণ মূর্ছনা আপ্লুত করেছে নয়নকে। সাদির দুলহান আর রাজপুরুষবেশী নওশার দৃশ্য তাকে কী যেন গভীর সুখ ও কৌতূহলে আবিষ্ট করেছে। এবং ঠিক তখনই আশেপাশে বা পেছনে দুর্গামোহনের কণ্ঠস্বর—’ওখানে কী হচ্ছে রে নয়ন? চল, একটুখানি আসর পেতে বসি!’ সানাইয়ে পূরবী শেষ হতে হতে এখানে শুরু হয়েছে ইমন। আলো জ্বলেছে ধূসর ঘরের আচ্ছন্নতায়। বাগেশ্রীতে চলে গেছে মোহন ওস্তাদ। মালকোষের দ্রুত ঝংকারে নয়ন হয়ে উঠেছে চঞ্চল উচ্ছ্বসিত। বহ্নিময়ী। তারপর কখন মধ্যযামের নিঃঝুম পরিবেশে, সব খেলোয়াড় একে—একে চলে গেল, ক্লান্ত নর্তকী নয়ন আবার কান পেতেছে। নওশা—দুলহানকে ঘুম পাড়াচ্ছে খাম্বাজ। আবার কখন ভোরের ধূসর আকাশের নীচে ভৈরোঁতে তান দিল দরদি সানাইদার—নয়ন অস্থির, উদভ্রান্ত কাতর। জাগো…মোহন প্যারে…জাগো…

সারাটি রাত জেগে ছিল দুলহান। রাজপুরুষ নওশার শিয়রে বসে এখন চুপি চুপি তার কপাল স্পর্শ করে বলছে—জাগো হে সুন্দর ভালোবাসার পুরুষ…।

ভালোবাসা—প্যার—মুহব্বত! এগুলি কী? যেন অপার্থিব কোনো সম্পদ—পেতে হলে একটা রক্তক্ষয়ী সাধনার প্রয়োজন।

কিন্তু কে তাকে ভালোবাসবে? কে তাকে বলবে—আমি তোমায় প্যার করি, তুমি আমার মুহব্বতের দুলারী! মোহন ওস্তাদের আখড়ায় অনেক তরুণ এসেছে। দুহাতে মুঠো মুঠো টাকা তারা ছুঁড়ে মেরেছে নয়নতারার শরীর লক্ষ্য করে। তাদের একজনও বলতে পারত!

পারেনি। হয়তো মোহন ওস্তাদের ভয়ে।

কিন্তু মানুষের চোখ তো সকল ভয়ের পাহারা এড়িয়ে হৃদয়ে পৌঁছতে পারে। নাঃ, আশা করার মতো কিছু ছিল না। ওরা আসলে হাড়ে হাড়ে রাক্ষুসে ক্ষুধা পোষণ করে—করে—যে ক্ষুধা টাকার, যে ক্ষুধা রক্তমাংসের। এক জোয়ান আমির তার হাত চেপে ধরেছিল একদিন। দুর্গামোহন তখন জুয়োর ছকে মগ্ন। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল নয়ন। আর সেই অবসরে সে তাকে বলেছিল—’হাম প্যার মাঙতা…’

ঠাস করে এক চড় কষে মেরেছিল বারো বছরের নয়নতারা। আসরের মধ্য দিয়ে পুরুষদের সঙ্গে অবিরত তার এমনি মেলামেশা। সাহস ও পেকে ওঠার পক্ষে এ অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক ছিল।

বুড়ি নান্নুমার পরামর্শ শুনে প্রথমে হাসলেও পরে শিউরে উঠেছিল নয়নতারা। যে সংগুপ্ত আগুনের কণা তার মর্মে জ্বলজ্বল করে যন্ত্রণা দিচ্ছে, তা যেন পরোক্ষে ধরা পড়ে গেছে অন্যের কাছে। নাচনা গাহনা খুব খারাপ কাম, জিন্দেগিকে সে কেবল বেহুঁশ করে রাখে। দুষ্টু ছেলেকে যেমন আফিম দিয়ে ঘুম পাড়ানো। লেকিন, বেহুঁশি তো জিন্দেগিকে সাচ বাত ছুপা রাখে—প্রকাশ হতে দ্যায় না। সাচ বাত হচ্ছে আরও হাজার হাজার মানুষ যেভাবে ঘরকন্না করছে। সুখেদুঃখে তারাও কি দুর্গামোহনের মতো জিন্দেগির মওকা হাসিল করছে না? আলবাৎ করছে। বেটি নয়ন, হাজার মরদের শরাবি আঁখোর খোরাক না হয়ে একজনের মুখোমুখি দিনগুজরান ভগবানের ভি হুকুম। ভগবান ঔরতকে বলেছেন একজনের সোপর্দ হয়ে থাকো—সে তোমার জিম্মাদার। আর একমাত্র সে—ই বলার হিম্মত রাখে—’হাম প্যার মাঙতা…’

কিন্তু কীভাবে নয়নের পক্ষে তা সম্ভব? দুর্গামোহন যে তার কয়েদখানা!

নান্নুমা বুড়িও তা বোঝে। সে তখন আরও চুপিচুপি বলেছিল—’ভাগ যাও, ভাগনেকা কোশিশ করো উনহিকা হাত ছোড়কে। বেটি, কয়েদখানাকি কয়েদি বন গেয়ি হো তুম, ইয়ে ঠিক নহি!’

কয়েদখানার কয়েদি। নয়ন বিমর্ষভাবে সরে এসেছিল। দুর্গামোহন একা আসরের ঘরে বসেছিল অন্ধকারে। সাড়া দিয়ে বলেছিল—’এদিকে শোন একটু!’

‘আলো জ্বালোনি কেন বাবু?’

‘থাক।’

কাছে যেতেই দুর্গামোহন বলেছিল—’আমি এখনই সব ছেড়ে দিতে পারি মা, কিন্তু আমার যে অনেক দেনা আছে। কী করি বল দিকি?’

কী করা উচিত, নয়ন কি তা বলতে পারে? এ বড়ো হাস্যকর প্রশ্ন বাবুর। দীর্ঘ নীরবতার পর সে জবাব দিয়েছিল—’ছাড়তে আমি তো বলিনি।’

মুহূর্তে বদলে গেল দুর্গামোহন। অন্ধকারে খুলে রাখা হারমোনিয়াম—এর বেলো বন্ধ করল সে সবগুলি রিডে চাপ দিয়ে। বাঘের মতো গর্জন করে উঠল যন্ত্রটা। ‘চালাকি করিস নে নয়ন, আমি বেশ বুঝেছি, তুই কী চাস।’

ক্ষুব্ধ নয়ন বলে উঠল—’কী চাই আমি?’

‘ভালোবাসার পুরুষ!’

‘বাবু!’

‘হ্যাঁ—তোকে একটা ভালোবাসার পুরুষ দিতে হবে—নইলে তুই আমাকে ডোবাবি।’

জীবনে সেই প্রথম দুর্গামোহন নয়নতারাকে ‘একটি ভালোবাসার পুরুষ দেবার’ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছিল।

মানুষের অনেক দিকে কিছু বদ্ধমূল বিশ্বাস থাকে—যা আসলে জেদ ছাড়া কিছু নয়। দুর্গামোহন জুয়াড়ি তার সম্পর্কে ওই একটি ধারণাই পোষণ করে—আজও নয়ন তা দেখেছে। এই তুলনাহীন ভুলের—অন্যের ভুলের গর্তে অসহায়ভাবে পড়ে থাকা যে কী মারাত্মক কেউ কি জানে?

জিন্দেগির মওকা হাসিল করতে গিয়ে সেদিন কিন্তু বিপন্ন হয়ে পড়েছিল দুর্গামোহন। নিজের শক্তি বা অধিকারবোধ সম্পর্কে ধারণায় যেন চিড় খেয়েছিল একবার। ঘরে আলো জ্বলেছিল। পিয়ারচাঁদ তবলচি এসে বসেছিল নিজ জায়গায়। সালোয়ার—ওড়নায় সেজেগুজে নিপুণা নটী নয়ন হাঁটু দুমড়ে সুমুখে বসে ছিল ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। নিজের হাতে বাইরের দরজা খুলে দিয়ে এসেছিল সে।

তখন মধ্যরাত।

কিন্তু কেউ আর আসেনি আসরে। হয়তো অন্য কোনো আড্ডায় জমে উঠেছিল তারা। আসলে ওই লোকগুলি মাছি ছাড়া তো কিছু নয়—যেখানে আবর্জনা যত আঠালো, সেখানে এঁটে যেতেই পছন্দ করে। এবং দুর্গামোহনও তখন আস্তে আস্তে একটা প্রকাণ্ড ভুলকে উন্মোচিত হতে দেখেছিল বুঝি। সে নিঃশব্দে বিনাপ্রতিবাদে নয়নের কাণ্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করছিল। তারপর গেলাসের পর গেলাস মদ খাচ্ছিল রাক্ষসের মতো। একসময় সে যথার্থ রাক্ষসের মূর্তিতে লাল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল নয়নকে। গর্জে উঠল—’হারামজাদি, আমায় ডাহা ঠকিয়েছে প্যারীচাঁদ, বুঝলি? দারুণ জুয়ো খেলেছে শয়তানিটা!’

সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। ‘আমার হার হয়ে গেছে এতদিন। ওরে প্যারীচাঁদ, টবে ফুল ফুটিয়ে ভোমরা জোটাচ্ছি ঘরে—কিন্তু মধু না পেলে ব্যাটা ভোমরারা তো চটে লাল হবেই…অসংলগ্নকণ্ঠে অশ্লীল চিৎকার করে সে বলতে লাগল—’চালাকি ধরা পড়ে গেছে ওদের কাছে—আর কেউ আসবে না রে প্যারী, কেউ আসবে না। আমারই ভুল হয়ে গেছে শালা….কে ও টা—ওই ছুঁড়িটা আমার কে, অ্যাঁ? কেন তার যৌবনের জিম্মাদার সেজে চুপচাপ বসে আছি রে? বেচবার মাল, চাকু দিয়ে কেটে কেটে বেচবো…লে লে বাবু ছে—ছে আনা…চাখবে আর ফের ছুটে আসবে…লে লে ছোঁড়ারা…লে লে ছে—ছে আনা…’

উদ্দাম কুৎসিত কণ্ঠস্বরে ঘরখানা যেন ভেঙে যাবে মনে হচ্ছিল। নয়ন কাঠ হয়ে গিয়েছিল ভয়ে।

পরের সন্ধ্যায় ফের আসর বসল।

প্রতি মুহূর্তে নয়ন আশা করছিল বাবু তাকে কারও সঙ্গে নিভৃত ঘরের দিকে চলে যেতে ইঙ্গিত দেবে। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে এই দারুণ আক্রমণের উৎকণ্ঠায় এত ব্যস্ত রাখছিল যে তাল কেটে যাচ্ছিল বারবার। সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংবরণ করছিল।

সে এক অমানুষিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ। শেষে জয়ী হল নটী নয়ন। নির্ভুল তালে পা ফেলে অপরূপ নাচল সে। তারপর ক্লান্ত হয়ে বসল ফরাসের ওপর। জুয়ার ছক খুলতে গিয়ে দুর্গামোহন হঠাৎ আড়চোখে এদিকে তাকাতেই নয়নের চোখে চোখ পড়ে গেল তার।

নয়নের চোখে কী ছিল সে মুহূর্তে কে জানে, আড়ষ্টভাবে আড়—মোড়া দিয়ে হাই তুলে দুর্গামোহন বলেছিল—’আজ ইঁহাসে খেল খতম মেরে দোস্ত …ফির কালসে শুরু হোগা!’

রুখে দাঁড়িয়েছিল জুয়াড়ি রসিকগুলি। ‘নহি, কভি নহি! দেখিয়ে না, আজ পকেটকা মেজাজ বহত আচ্ছা…’ পকেটের দিকে তাকায়নি দুর্গামোহন। ওরা কেটে পড়ছে না দেখে অবশেষে সে ছোরা বের করেছিল আচম্বিতে। গুন্ডার রাজা মোহন ওস্তাদকে সোনারওয়ালি গলির মহল্লায় কে না ভয়— সমীহ করে!

তারপর রাতে নয়ন একা শুয়ে আছে তার ঘরে। বদ্ধ দরজায় ডাক এসেছিল—’নয়ন, মা নয়নমণি!’

‘বাবু!’ দরজা খুলে দিয়েছিল নয়ন সঙ্গে সঙ্গে।

দুর্গামোহনের হাতে প্রকাণ্ড একটা সুটকেস। সে বলেছিল—’সব—কিছু নেবার দরকার নেই, তোর সুটকেসে যতগুলো ধরে, ভরে নে। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বো।’

বিস্মিতা নয়ন একটু চিৎকার করেছিল—’সে কী? কোথায়?’

‘দেশে। আমাকেও আর ভালো লাগছে না কিছু। আমিও তোর মতো হাঁফিয়ে উঠেছি মা।’

‘বাবু…’

‘কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি কর।’

যাবার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নয়ন বলেছিল—’হারমোনিয়ামটা।’

‘থাক।’

নয়ন ব্যাকুলকণ্ঠে বলেছিল—’বাবু, দোহাই বাবু, ওটা আমার মায়ের জিনিস…।’ সে কাঁদছিল।

স্টেশনের পথে যখন দুটিতে ঘোড়ারগাড়ির খোঁজ করছে—দেখলে হাসি পায়, অত বড়ো ভারী হারমোনিয়ামটা দুর্গামোহনের মাথায়, হাতে তেমনি প্রকাণ্ড সুটকেস।

পরের রাতে ট্রেন বদলে অন্য ট্রেনে চেপে একেবারে মল্লারপুরে।