।।পাঁচ।।
বিস্তৃত আমবাগানের প্রান্তে আমাদের তাঁবু পড়েছিল। চৈত্রের ঘননীল আকাশের নীচে বিরাট ময়দানের উপর এই মেলাটা আমার চোখের পুরনো পর্দা সরিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল পৃথক এক মায়াজগতের মতো। যখন প্রবেশ করেছি, তখনই বদলে গেছি। মানুষের ছোটো ছোটো হাসি আনন্দ কণ্ঠস্বর বৃহত্তর ঐক্যে বিধৃত হয়ে যে রূপ পায়, তা এমনি করে কোনোদিন অনুভব করিনি।
মানুষ, মানুষ, মানুষ।
যেদিকে দেখি মানুষের মুখ। যেদিকে কান পাতি মানুষের স্মিত কণ্ঠস্বর। খেলার বাঁশি বেজে চলেছিল বিরতিবিহীন। শোভাযাত্রার ঘূর্ণিতে ছিল উজ্জ্বল সমারোহ। চুমুকে চুমুকে পান করেছিলাম। অনভ্যাসের ক্লান্তি ও আড়ষ্টতা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। দায়হীন বন্ধনহীন প্রীতিময় এ জগৎ। মানুষ যখন এখানে পা দেয়, তখন সে সব প্রাত্যহিকতার ঊর্ধ্বে।
গ্রামটা ঠিক গ্রাম নয়। ঠিক শহরও নয়। কলকারখানাও দু—চারটে রয়েছে। ইলেকট্রিক আলো আছে। প্রচুর ইটের বাড়ির আনাচে—কানাচে মাটির বাড়ির সংখ্যা কম নয়। দুর্গামোহন সঠিক জায়গাটি খুঁজে বের করে। পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠা জনপদ তার অপছন্দ। ‘কিছু গ্রামের গন্ধ কিছুটা শহরের’ দুর্গামোহন বলে, ‘সেখানেই আমার পসার জমে ভালো।’ পসার জমতে দেরি হয়নি।
খেতে বসে তুষ্টুরাম বলেছে, ‘পাত দেখেই বুঝতে পারি এটা। দু—এক পদ বাড়িয়ে দ্যান মালিকবাবু। ওদিকে হাতটা বেশ দরাজ। নইলে কে কবে কেটে পড়তো ঠিক নেই।’
চকবাজারে দুর্গামোহনকে আলাদা খেতে দেখেছি। এখানে সে আমাদের সঙ্গে খাচ্ছিল। নয়নকে কুটনোবাটনায় লাগিয়ে কোনো সময় সে নিজেই রান্নায় বসে। মোড়ায় স্থূল দেহ রেখে ভ্রূ কুঁচকে মাছ ভাজতে দেখলে মনটা নরম হয়ে যায়। আহা, লোকটি বড়ো ভালো।
এবং তারপর দুর্গামোহনকে পরিবেশন করতেও দেখি। আমার পাতে বৃহৎ এক টুকরো মাছ দিয়ে বলে, ‘লজ্জা করবে না নন্দ। তুমি আমার ছোটো ভাই।’ ডিব্বুকে বলে ‘ওরে শালা, বেশি বেশি খেয়ে চট করে বেড়ে ওঠ দিকি।’ বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকতাম মুখের দিকে। একি সেই জুয়াড়ি!
সে আবার বলত, ‘এই আমার সংসার ভাই। এর চেয়ে বড়ো সংসার কোথায় আর পাব। ওইটে আমার ভাই, ও হচ্ছে মেয়ে, ওটা নাতি। আর তুষ্টু? জানো নন্দ, ব্যাটা কী সম্পর্কটা বানিয়েছে আমার সঙ্গে? জামাই, ঘরজামাই!’ প্রচণ্ড হাসিতে ধকধক করে তার বিরাট শরীর কাঁপছে।
অথচ ঠিক সেই রাতে তুচ্ছ কারণে তুষ্টুরামের মুখে লাথি মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল দুর্গামোহন। আমি ছুটে গিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলাম।
দুর্গামোহন বাঘের মতো গরগর করে বলেছিল, ‘খবরদার নন্দ, এ সময় কক্ষনো সামনে এসো না। কী বলতে কী বলে বসব, দুঃখ পাবে।’
আমি টের পেয়েছি, এদের জীবনের রীতিনীতি ঠিক আমার জানাশোনা পছন্দের বাইরে। এবং তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারলে আমার টেকা কঠিন হবে এখানে।
একদিন ওসমান খাঁ হঠাৎ ক্ষেপে গেল যেন।
চরম মুহূর্তে স্টেজে কিছুতেই নামছিল না সে। ঘাড় বেঁকিয়ে গরগর করছিল। গর্জন করে উঠেছিল নাক তুলে। দুর্গামোহন একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে অপেক্ষা করছিল।
স্টেজে তখন পর্দা পড়ে আছে। পর্দার বাইরে দর্শকেরা ক্ষুব্ধভাবে চিৎকার করছিল। এই খেলাটি দেখার জন্যেই তারা হয়তো এত উদ্দীপনা নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করে।
একটু আগে খেলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাই সেই উদ্দীপনা তখন প্রখরতম। স্টেজের পর্দাটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ঢিল ছুঁড়ছিল দর্শকেরা। অশ্লীল খিস্তি করছিল বারবার।
নয়নতারার খুব কাছ ঘেঁষে আমি উইংসে বসেছিলাম। দেখলাম দুর্গামোহন ওসমান খাঁর শেকলটা তুষ্টুরামের হাত থেকে কেড়ে নিল। তারপর ছড়ির গুঁতো মেরে সজোরে টানতে থাকল। তুষ্টুরাম হাত জোড় করে চাপা গলায় নিষেধ করছিল তাকে।
নয়নতারা হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরল দৃঢ়ভাবে। তার মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম সে হাসছে সকৌতুকে। দারুণ উৎকণ্ঠার সময় তার এ হাসি বিরক্তির উদ্রেক করে। আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘এমন করছে কেন বাঘটা?’
‘তার ইচ্ছে।’
‘ইচ্ছে?’ আমাকেও হাসতে হল। ‘কিন্তু এমন ইচ্ছে কি কোনোদিন ছিল? নাকি আজ নতুন?’
‘নতুন।’
নয়নতারা আমার জানুর উপর তার শরীরের কিছু অংশ হেলিয়ে রাখল। আমার বুকে তার খোঁপার স্পর্শ। তার হঠকারিতায় আমি বিব্রত।
তুষ্টুরাম এতক্ষণে মুখ ফেরাল এদিকে। উইংসে কিছু অন্ধকার। অন্ধকারে তার দৃষ্টিপাত সাপের স্পর্শের মতো হিম হয়ে আমার ওপর পড়েছে।
উঠে দাঁড়ালাম তৎক্ষণাৎ। এগিয়ে গেলাম স্টেজের মাঝখানে। তুষ্টুরাম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে দুর্গামোহনকে সাহায্য করছে।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল ওসমান খাঁ। সে একটানা গরগর করছিল। এবং তার ওই গর্জন আরও ক্ষিপ্ত করছিল জনতাকে।
সজারু ও সাপটা টেনে বের করে তুষ্টুরাম ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝাড়ল। নয়নতারা ততক্ষণে প্রস্তুত। তার বুকের ওপর আমিনা, দু হাতে দুটি শেকলে ওসমান খাঁ আর বুঢ়ুয়া।
তারপর বাঁশি বেজে উঠেছে। মন্ত্রমোহিত জনতা রুদ্ধশ্বাসে একটি আদিম শিল্পবিলাসের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে।
ঘুঙুরের ধ্বনি, নটীদেহের তরঙ্গভঙ্গ, বাঁশির সুর। মধ্যে মধ্যে ওসমান খাঁর বিকট গর্জন সব আবেশ ছিন্ন করে।
সজারুর কাঁটাপালকগুলি খট—খট সড়—সড় করে কেঁপে কেঁপে খাড়া হয়। সাপের মুণ্ডুটা ঝুলে পড়ে নয়নতারার বুকের মাঝখান হতে। তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার স্বর্ণহার।
এখানে অন্ধকারে তুষ্টুরামের মুখ দেখি না। দুর্গামোহনের বিরাট শরীর তাকে আড়াল করেছে।
পর্দা পড়ল।
তুষ্টুরাম দ্রুত ছুটে গেল স্টেজে। আমিনা সাপিনী নয়নতারার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। দু—হাতে খোলাবার চেষ্টা করছে সে। দুর্গামোহনও লাফিয়ে অগ্রসর হল। সজারুটা নিজ বিবরে প্রবেশ করেছে। ওসমান খাঁও এখন শান্ত। সে লেজ গুটিয়ে ঢুকে গেল।
আমিনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তুষ্টুরাম যখন খাঁচার দিকে চলেছে, নয়নতারা হাঁফাচ্ছিল। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম বাইরে। বললাম, ‘একটুখানি শুয়ে পড়ো দিকি। খোলামেলায় থাকলে সেরে যাবে।’ আমার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল। তেষ্টা পেয়েছিল খুবই। নয়নতারা শুলে একটুকরো পিচবোর্ড খুঁজে আনলাম তার তাঁবু থেকে। হাওয়া দিতে থাকলাম। দুর্গামোহন স্টেজে ম্যাজিক দেখাচ্ছে ওদিকে।
অনেকসময় ধরে শিথিলভাবে শুয়ে থাকল নয়নতারা। চোখদুটি বুজে রাখল। তারপর একসময় তাকাল।
হ্যাসাগের আলোটা একটু দূরে রয়েছে। আধো—আলোয় তার অর্ধস্ফুট ক্লান্ত ভীত মুখখানি করুণা ও মমতায় কাতর করে। আমি তার বুকের ওপর ঝুঁকে পড়লাম, ‘নয়ন, নয়ন!’
সে সাড়া দিল। মৃদু হাসি তার ঠোঁটের কোণে।
‘কেমন বোধ করছ এখন?’
‘ভালো।’
‘আমিনাও আজ অমন করল কেন?’
‘তারও ইচ্ছে।’
‘কেন?’
আমাদের ওপর ছায়া। সংযতভাবে বসলাম। না, তুষ্টুরাম নয়। সে এখন স্টেজে। সেই ছারপোকার গানটা গাইছে। ভীষণ হাসির শব্দ তাঁর থেকে ভেসে আসছে। মিলিত কণ্ঠের ওই প্রকাণ্ড অট্টহাসি আমাদের এই নিভৃত ও তুচ্ছ সান্নিধ্যকে ব্যঙ্গ করছে যেন।
ডিব্বু এসে ডাকল, ‘মা!’
নয়নতারা হুড়মুড় করে উঠে বসল। ‘কী রে সোনা?’
‘কী হয়েছিল তোমার?’ ডিব্বু তার কাঁধে হাত রাখল। তার মৃদু কণ্ঠস্বরে গভীর উৎকণ্ঠা পরিস্ফুট।
নয়নতারা খিলখিল করে হেসে উঠল! ‘কিছু না তো!’
‘তুমি নাকি মরে যাচ্ছিলে?’
‘কে বললে?’
‘চাপাটিদা।’
প্রশ্ন করলাম ‘চাপাটিদাটা কে রে ডিব্বু?’
নয়নতারা বলল ‘যে তোমার নাম রেখেছে বাঁশিবাবু।’
তোমার! আমি একটুও বিস্মিত হইনি। বিকেলে স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে যখন চাঁপাফুল তুলে এনে তার হাতে দিয়েছিলাম, তখনি একবার ‘তুমি’ বলেছিল নয়নতারা। এ—মুহূর্তে মনে পড়ে গেল সে কথা। মনে পড়তেই তার খোঁপার দিকে তাকালাম। ফুলকুলি সেখানে রেখেছে সে।
ডিব্বু বলল, ‘আজ ওরা রেগে আছে, আমি জানতাম।’
‘সে কী রে!’ নয়নতারা বিস্মিতভাবে তার মুখটা লক্ষ্য করল। আমিও।
‘তুষ্টুকা সন্ধে থেকে খোঁচাচ্ছিল। বলছিল…’ ডিব্বু থামল।
‘কী বলছিল।’
‘কী জানি, কী সব কথা। আমি বুঝতে পারি না।’ ডিব্বু হাতের চেটোয় নয়নতারার আঁচলের একটা প্রান্ত ঘষতে থাকল। ‘তুষ্টুকাও রেগে আছে খুব।’
‘ভারি আমার রাগ? কে ধারে!’ নয়নতারা উঠে দাঁড়িয়ে বেশবাসটা ঠিক করে নিল। ‘তুই শো গে যা ডিব্বু।’
ডিব্বু চলে গেলে বললাম, ‘একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো নয়ন?’
‘কী কথা?’ মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল সে।
একমুহূর্ত ইতস্তত করে আমি বললাম, ‘তুষ্টু হয়তো তোমার—আমার মেলামেশাটা পছন্দ করে না।’
মুখ ফিরিয়ে চলতে থাকল নয়নতারা। তাঁবুর দরজার পর্দায় হাত রেখে বলল, ‘তুমি পছন্দ করো তো? তা হলেই চলবে।’
রাতের কাণ্ডটা নিয়ে দুর্গামোহন একটা কিছু করে বসবে, এ ভয়, আমার ছিল। সকালে ডিব্বুকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। যখন ফিরে আসছি, পথে চাপাটির সঙ্গে দেখা। বাজার করে ফিরছিল সে। বড়ো বড়ো দাঁত বের করে হাসল। ‘কী গো বাঁশিবাবু, ফুল আনতে গিয়েছিলেন বুঝি?’
‘তার মানে?’
চাপাটি পাশে পাশে চলতে থাকল। ওই ফুল ফুল করে ফ্যাকড়া বেঁধেছে যে। তুষ্টুদা নয়নদিকে চোখ রাঙাচ্ছিল। কেউ তো কম যায় না! শেষটা চড় মেরে বসল নয়নদির গালে।’
‘তুষ্টুরাম?’ থমকে দাঁড়িয়েছি।
চাপাটি বলল, ‘তা’ পরে মালিকবাবু তুষ্টুকে অ্যায়সা মার মাল্লে এখন হাঁ করে পড়ে আছে দেখুন গে।’
দ্রুত তাঁবুতে ফিরে এসেছিলাম। দেখলাম নয়নতারা নিবিষ্ট মনে বসে শায়া শেলাই করছে। দুর্গামোহনকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। তুষ্টুরাম আমগাছের নীচে চুপচাপ শুয়ে আছে।
চাপাটি আমার গায়ে একটু খোঁচা মেরে তাকে দেখিয়ে চলে গেল। এই খোঁচাটায় কিছু অশ্লীলতা প্রচ্ছন্ন ছিল হয়তো। আমি চারপাশে লক্ষ্য করলাম, পার্টির লোকেরা আমার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে। একটা গুরুতর দুষ্কর্ম ধরা পড়ার পর যেমন সংকোচে দীনতায় আড়ষ্ট হতে হয়, সেরূপ একটা অস্বস্তি আমাকে পীড়িত করছিল। এই লোকগুলির চোখে আমি আর চকবাজারের সেই আনন্দ হয়ে নেই। এখন আমি ভাগ্যঘরের মাতাল জুয়াড়িদের একজন—যারা পাশার ছকে নয়নতারাকেই জিতে নিতে চায়।
দুর্গামোহন ফিরল খানিক পরে। তার মুখ অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যে থমথম করছে। আমি অজ্ঞাত ত্রাসে গুটিয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে নিজের তাঁবুতে ঢুকলাম। আমার চলে যাবার সময় বুঝি এসে গেছে। এত দ্রুত সব ফুরিয়ে যাবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।
শরীর গুরুভার, চোখে ঘুমের আচ্ছন্নতা, এক সময় কে স্পর্শ করল এসে। চোখ মেলে দেখি, নয়নতারা। ‘কী গো বাঁশিবালেবাবু, খাবে না?’ হাসছিল সে।
উঠে বসলাম। চৈত্রের দুপুরে আমবাগানের নীচে ঘন ছায়ার বিস্তার। পাখির ডাক পাতার অন্তরালে। ওখানে উজ্জ্বল রৌদ্রে নির্জন মেলাটা ঝিমোচ্ছে স্তব্ধভাবে। গুটিকয় কুকুর বাতাসে ধাবমান উচ্ছিষ্ট শালপাতার পেছনে ছুটোছুটি করছে। মন্থর দুপুরের স্তব্ধতা ভেদ করে ওসমান খাঁ একবার গর্জন করে উঠল।
‘তোমার আবার কী হল?’ নয়নতারা প্রশ্ন করল।
‘নয়ন!’
‘উঁ!’ খোঁপা খুলে বেণী থেকে চুলগুলি উন্মোচিত করছিল নয়নতারা! বিবর্ণ চাঁপাফুলগুলি ঝরে পড়ছিল আমার শয্যায়।
‘এ বড়ো অন্যায় হচ্ছে। আমি চলে যাব, সেই ভালো হবে।’
‘কেন?’
‘তুষ্টু একটা ভুল ধারণা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে।’
‘ভুল?’ চকবাজারে প্রথম যে পাথরের নয়নতারাকে দেখেছিলাম, এ মুখ তারই। ‘নন্দ, তুমি বুকে হাত দিয়ে বলো তো ভুল!’
আমার মুখ খুলে দিল তার এই স্পষ্ট প্রশ্ন। ক্ষিপ্তভাবে বললাম, ‘তুমি যদি অন্য কিছু ভেবে থাকো, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি তোমার প্রেমে পড়িনি নয়নতারা।’
নয়নতারা একটুও হাসল না। বলল, ‘লোকে তো তা সত্যি বলে মানে!’
‘মানুক যা খুশি তারা। আমি ভালোবাসি যাকে, সে অন্য মেয়ে!’ এত উত্তেজিত হয়েছিলাম যে ভাবাবেগে একটা জটিল তত্ত্বের অবতারণা করতেও পরাঙ্মুখ হচ্ছিলাম না।
নয়নতারা বলল, ‘সে কি আকাশ থেকে নেমে আসে নন্দ?’
‘হ্যাঁ। সে আমার মনের সৃষ্টি।’
নয়নতারা আমার কথা ঠিক বুঝছে কি না টের পাচ্ছিলাম না। একসময় সে উঠে দাঁড়াল। বলল ‘আমি একজনই নন্দ। তবু লোকে ভুল বোঝে। তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে আমিও চিনি। কিন্তু সে মিথ্যে। ভীষণ একটা মিথ্যে। ওই হতভাগাও একই রোগে ভুগছে। এত পেয়েও সে বলে, কিছু পাইনি।’
নয়নতারার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। তার চোখ ছলছল করছিল। ‘নন্দ, ও একটা নেশার পেছনে ছুটেছে। তুমিও। আমার দুঃখ হয় নন্দ, তুমি শিক্ষিত মানুষ।’
মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম যেন। আমার ইচ্ছে করছিল, মদের গেলাস থেকে চুমুক দিয়ে সবটুকু মদ পান করে আমি শান্ত হই। কিংবা একটা প্রচ্ছন্ন মঞ্চে এসবই ছিল একটি ছোট্ট নাটিকা। আমরা দুটিতে ভূমিকা গ্রহণ করেছি। ‘নয়ন, চকবাজারে ত্রিলোচনের ঘরে বসে যখন গান গাইতাম, দেয়ালে ঝোলানো মেয়েদের ছবিগুলি দেখতে পেতাম। দেখতে দেখতে আমার মনের দেয়ালেও একজন এসে দাঁড়িয়েছিল। সে আমার খুবই চেনা।…’
চাপাটি এসে ডাকল। ‘বাঁশিবাবু, মালিকবাবুর তলব হয়েছে গো।’
দুর্গামোহন স্নান করে এসে মোড়ায় বসেছিল। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে একটা ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে রেখেছিল। আমাকে দেখে বলল, ‘নন্দও কি ওসমান খাঁর মতো খেপলে?’
‘না। ঘুম পেয়েছিল।’
‘যাও। স্নান করে এসো গে।’
দুর্গামোহন যেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, ঠিক সেদিকেই গুটিগুটি পা ফেলে চললাম। বশীভূত জন্তুর মতো।
ভেবেছিলাম এ—রাতে খেলা ভালো জমবে না।
কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তুষ্টু—কথিত সেই ‘বাকবাদিনী’ নাচের মঞ্চে আবির্ভূত হল। নয়নতারাকে এত বিমোহিনী কোনো রাতে দেখিনি। দেখিনি এত প্রগলভা উচছলিতা উচ্ছ্বসিতা। তার দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ—বিভ্রম ছিল। তার অঙ্গসঞ্চালনে লীলামৃগয়ার পথে উত্তরণের ইঙ্গিত ছিল। হাসিতে শতবসন্তের রক্তিমতা ছিল উজ্জ্বল হয়ে।
পরপর দুখানি ডুয়েট গাইলাম আমরা।
তারপর অত্যন্ত হঠাৎ তুষ্টুরাম উন্মোচিত মঞ্চে একটা নাটকের অবতারণা করে বসল।
গান শেষ হবার আগে সে মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে বলল, ‘বাস, বাস। দেখুন, দেখুন এখানে কী হল তবে। ওই একটা জওয়ান স্টেজে আসলো একটা জওয়ানি ভী আসলো। তারপর গাহনা হল, নাচনা হল। বসন্তবাহার রাগে আগুন জ্বালায়ে দিল আপনাদের দিলে। লেকিন, আমি এখন আসলাম। আমি কী করল? আমি তো একটা গাদ্ধা আছি। গাদ্ধা কী করে? গাদ্ধাভী গানা করে। কী গান? না, দুঃখুর গান। কেন দুঃখু? গত জন্মোতে ওটা আমার বহু ছিল ভাইরে…আমি গাদ্ধা হবো বলে আমাকে ছেড়ে দিলে…আমার লেজে লাথি ভি মারলে…লেকিন এটা আমার দোষ? বলুন তো আপনারা…’
দর্শকেরা হাসিতে ভেঙে পড়ছে। হাততালি দিচ্ছে প্রচণ্ড শব্দে। আমি ও নয়নতারা স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছি মঞ্চে। ‘বন্ধুগণ!’ গলা ঝেড়ে নিয়ে ফের শুরু করল তুষ্টুরাম। ‘আজ গাদ্ধাটা আপনাদের সামনে হাজির আছে। কথায় বলে দশ যেখানে ভগবানও সেখানে। আপনারা দশ ভগবান। আপনারা জজের জজ…সবসে বড়া জজ আছেন। বিচার তো করেন…’
ঈষৎ স্তব্ধতা তাঁবুর মধ্যে। তুষ্টুরামের কণ্ঠস্বর বারবার ভাঙাচোরা হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্তম্ভিত।
‘না। আপনারা পারবেন না। এ বিচার আমি নিজের হাতে করব। কেমন করে দেখুন…’
অনেকদিন একটা নরম কাঠের বোর্ড দেখেছি স্টেজের নীচে পড়ে থাকতে। আগে নাকি ওটা নিয়ে একটা মারাত্মক খেলা দেখাত তুষ্টুরাম। দুর্গামোহন এই খেলাটা পছন্দ করত না একেবারে। কালক্রমে ওটা তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। অন্তত আমি কোনোদিন দেখিনি এই খেলা।
সেই বোর্ডটা ক্ষিপ্রহাতে স্টেজে তুলে এনে দাঁড় করাল তুষ্টুরাম। তারপর ফের সে উইংসের ভেতর থেকে একটা ছোটো বাক্স এনে রাখল। বাক্সের ভেতর এক ডজনের বেশি টিনের ছুরি। ছুরিগুলি তুলে নিয়ে নয়নতারার হাত ধরে টানল সে। নয়নতারা ইতস্তত করছিল। চাপাস্বরে তুষ্টুরাম বলল, ‘আহা, দাঁড়াও না ওখানে। ভয় কেন?’
নয়নতারা আমার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে ভয়ের চিহ্ন ছিল।
বোর্ডে পিঠ রেখে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে টানল তুষ্টুরাম। তার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বলল, ‘চোখ দুটো আচ্ছাসে বাঁধুন স্যার।’
চোখ বেঁধে দিলে তুষ্টুরাম জনতাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি তাহলে ওকে সাজা দিচ্ছি। আপনারা আঁখ খোলা রাখুন। আমার আঁখ বন্ধ রাখলাম। দেখুন, দেখুন…’
নয়নতারা পুতুলের মতো বোর্ডের এককোণে আঙুলের শব্দ করে দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। অব্যর্থ লক্ষ্যে তুষ্টুরামের ছুরি সেখানে বিঁধেছে।
অতি শীঘ্র নয়নতারাকে ঘিরে ছুরিগুলি প্রতিমার চালচিত্রের মতো একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি পরিমণ্ডল রচনা করল। হাতে একটি মাত্র ছুরি অবশিষ্ট ছিল। তুষ্টুরাম ভীষণ জোরে হা হা করে হেসে উঠল। এতক্ষণে। ‘সবগুলো ফস্কে গেছে। ঔর একঠো হাতে রয়েছে। এ যদি ভুল করে, আমি একে আমার দিলে বিঁধিয়ে দেবো। কী বলেন আপনারা?’
কোনো প্রত্যুত্তর এল না দর্শকদের মধ্য হতে। সকলে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে।
নয়নতারা কি মূর্ছা গেছে? চোখ বুজে রয়েছে তার। নিস্পন্দ হয়ে গেছে শরীর। আঙুলে শেষ শব্দ করছে না। তুষ্টুরাম ছুরিটা নাড়াচাড়া করছে।
নয়নতারার কোনো সাড়া নেই। তুষ্টু ছুরি তুলল। একটু পিছিয়ে গেল। তারপর হুড়মুড় করে দুর্গামোহন প্রবেশ করল মঞ্চে। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার পশ্চাদ্দেশে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সজোরে লাথি মারল। তুষ্টুরাম ক্লাউনোচিত হাসছে।
দুর্গামোহন দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘বন্ধুগণ, রাজা বেঁচে থাকতে প্রজার হাতে বিচারের ভার দেওয়া যায় কি? আমি সেই রাজা। ও ব্যাটা আমার ভাঁড়। ভাঁড়ের কাজ হচ্ছে ভাঁড়ামি করা।’
দর্শকেরা তুষ্টুরামের দশা দেখে হাসছিল।
দুর্গামোহন নয়নতারার হাত ধরে টেনে আনল মঞ্চের পুরোভাগে। আমার হাতে তার হাত মিলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই হচ্ছে রাজার বিচার।’
নাটক, না বাস্তব? দর্শকেরা অশ্লীলভাবে চিৎকার করে উঠল। উলুধ্বনি দিল কারা। কান পেতে শুনি, নয়নতারা গান ধরেছে এগারোর পর্দায়। মঞ্চ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। আমার মাথা ঘুরছিল। মূর্ছার তরঙ্গ উঠছিল স্নায়ুদেশে।
ঘন অন্ধকারে আমবাগানের নীচে দাঁড়িয়ে আমি সব পূর্বাপর সাজিয়ে দেখছিলাম। আমার প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছিল, হঠাৎ কখন তুষ্টুরাম সেই অ—নিক্ষিপ্ত ক্ষুধার্ত ছুরি হাতে ছুটে আসবে এখানে। তবু দাঁড়িয়ে থাকলাম। যেন আত্মগোপনের উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলাম। আর সেই দুর্গম অন্ধকারের শেষপ্রান্তে বাঘটা থেকে—থেকে ডেকে উঠছিল।