নীল ঘরের নটী – ৪

।। চার ।।

‘অদ্য শেষ রজনী।’ তাঁবুর দরজার উপর উঁচু বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে তুষ্টুরাম ক্লাউন চিৎকার করে বলেছিল, ‘আসুন আসুন, দেখে যান, অদ্য শেষ রজনী। বাঘ—সজারু—সাপ ঔর সবসে বড়িয়া খেল…আপনার আঁখো কা তারা…’ তার ছুঁচলো লাল টুপির শীর্ষে একটা কাগজের ফুল ক্ষিপ্তভাবে সঞ্চালিত হচ্ছিল। তার পরিধানে ঘননীল রঙের আঁটো ফুলপ্যান্ট—পা দুটি কীভাবে ঢুকিয়েছে কে জানে। খাটো লাল কোর্তায় ছবি ছোপানো। দুহাতে কালো দস্তানা। পায়ে কিম্ভূত গঠনের নাগরা জুতো।

ব্যান্ডের বাজনা থামিয়ে মধ্যে মধ্যে সে এইরূপ ঘোষণা করছিল। নয়নতারার তাঁবুতে বাক্সে হেলান দিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে আমি বসেছিলাম। নয়নতারা সাজছিল। এই সজ্জায় তার নিষ্ঠার চিহ্নগুলি লক্ষ্য করছিলাম। কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে প্রত্যাশী কিছু দর্শকের ভিড়। পার্টির লোকেরা তাদের বার—বার তাড়া করছিল। তবু তারা বেহায়ার মতো ফের ভিড় করছিল। নিষ্পলক চোখে নয়নতারার দিকে তাকাচ্ছিল। সেই জনতার দিকে চেয়ে আমি কেমন অভিভূত হচ্ছিলাম। অপ্রমেয় ক্ষুধা নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে। এবং মুক্তির হাওয়া আমার গায়ে, এই ঔৎসুক্য, হল্লা, নটী, মঞ্চ আমার নতুন পৃথিবী, বাইরে ওই অপেক্ষমাণ মুখগুলি এইভাবে চেয়ে থাকবে সারা জীবন, গভীরতর অবিনশ্বর ক্ষুধা বেঁচে থাকবে…ভাবতে ভাবতে আমার রোমাঞ্চ হচ্ছিল।

‘আসুন, আসুন। দেখে যান, লিয়ে যান। শেষ খেলা….খেল খতম।’

তুষ্টুরামের কর্কশ চিৎকার করাতের মতো সব ভাবাবেগ ছিন্ন করছে।

‘ভাই রে…দুদিনের দুনিয়াদারি…আঁখ খুললে আছি, বন্ধ করলে নেই। তখন মুসলমান যাচ্ছে আল্লাতালার কাছে, হিন্দু যাচ্ছে পরমাত্মা ভগবানের কাছে। লেকিন আল্লা পুছলেন বল, কী দেখে এলি, কী লিয়ে এলি দুনিয়ার থেকে! ভগবান ভি পুছলেন, কী সেরা চীজ দেখেছিস সংসারে…তো কী বলবেন বলুন দেখি মেরে দোস্ত? আমি বলি, …জবাব তো তৈরি।’ এক মুহূর্ত থেমেছে তুষ্টুরাম। ফের হাতে তালি দিয়ে চিৎকার করে উঠেছে।

‘হা�, হাঁ, স্যার…দেখেছি, ঔর লিয়ে ভি এসেছি। এই দেখুন, আমার দিলের দিকে তাকান…এক আচ্ছা সে আচ্ছা নাচনা—গাহনা ঔর দেখনা চীজ…নয়নতারা!!’ হা হা হা হাসছে মোহিনী ভ্যারাইটি শোর ক্লাউন। ভ্রূ আঁকতে আঁকতে হঠাৎ থেমে গেল নয়নতারা। আয়নায় কিছু দেখছিল সে।

‘বন্ধুগণ, লোহার চাকাটা ঘুরছে—তার অন্দর চল্লিশটে ছুরির ফলা, ফলায় ন্যাকড়া ভি জড়িয়ে দিলে, তারপর আগুন জ্বাললে…আর একটা নাদান আদমি, আপনাদের পায়ের ধুলো কুড়িয়ে তার জন্মো…সে কী করলে? না, হাওয়ায় ভেসে তার অন্দরটা পার হয়ে গেল। আগুনের আঁচ লাগল না, ছুরি ভি বিঁধল না।’

গর্জন করে উঠল তুষ্টুরাম। ‘কেন, কেন লাগল না আগুন, ছুরি কেন বিঁধল না? না, চাকার ওপারে খাড়া আছে নয়নতারা।’

বিপজ্জনক ত্রিশূলের খেলা বর্ণনা করার পরও তুষ্টুরাম ফের নয়নতারার উল্লেখ করছে। তার আজকের ঘোষণায় নয়নতারা অতিশয় প্রকট। এমন করে কোনোদিন বিজ্ঞপ্তি পাঠ করেনি সে।

‘ওসমান খাঁ বনের রাজা, আমিনা সাপিনী বনের রানি। ঔর বুঢ়ুয়া? ওই সজারু? কী বলুন তো দাদা? আরে…উও তো একটা কেলাউন আছে! লেকিন তার আঁখ থেকে আঁসু নিকলাচ্ছে। কেন? বহু দুঃখে? ভুল, ভুল, কথা ভাই রে!…

‘নয়নতারা’ দিয়ে তার কথা শেষ হল। ব্যান্ড বেজে উঠল সশব্দে। ভিড় বাড়ছিল একটু করে। হল্লা শুরু হচ্ছিল। নয়নতারা শুধু চেয়ে ছিল আয়নার দিকে। কপালের অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাটা দাগটা সাদা সফেদাবিন্দু দিয়ে লুপ্ত করে আলপনা আঁকছিল সে। এঁকে বলেছিল, ‘চন্দ্রকলা। নবমী, না দশমী?’

প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ওই দাগটা কীসের?’

নয়নতারা মুখ তুলেছিল। এবার সে নটী। সে এবার সম্পূর্ণতা পেয়েছে। তার চোখে অন্য রং। হাসিতে লীলা—মৃগের ক্ষিপ্র সঞ্চরণ। তার রক্তিম অধরোষ্ঠে স্মিত সংরাগের বিভ্রমণ।

‘যদি না বলি?’

‘তোমার খুশি।’

হঠাৎ নয়নতারা আমার পাশ ঘেঁষে এল। ‘আপনি তো আর পর নন। পার্টির লোক। বললেই বা ক্ষতি কী?’

হৃৎপিণ্ড দ্রুততালে ধকধক করে উঠল। আমি নিজেকে সংযত রাখছিলাম।

‘শুনবেন?’

‘ইচ্ছে হলে বলতে পারো।’

‘হাসবেন না তো?’

‘হাসব কেন?’

কানের কাছে মুখ নিয়ে এল নয়নতারা। তার নিশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সফেদা—মিনা—কুমকুমের গন্ধের সঙ্গে অন্য একটা গন্ধ ছিল। আমার কাছে খুবই নতুন সে গন্ধ। আমার রক্তে আগুন ধরে যাচ্ছিল। নয়নতারা ফিসফিস করে বলল, ‘পুরুষের দাঁতের দাগ।’

হেসে উঠলাম। ‘যাও! ফাজলেমি হচ্ছে।’

নয়নতারাও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিল।

দুর্গামোহন আজ প্যান্ট কোট পরেছিল। শেষ রজনীতে একটা স্থায়ী স্বাক্ষর চকবাজারে রেখে যাবার ইচ্ছে তাকে যেন পেয়ে বসেছে। তুষ্টুরাম বলেছিল, ওইটেই রেওয়াজ। সবখানে শেষ রাতটা জমিয়ে দিতে হয়।’ একটা ছোটো নাটকও অভিনয়ের ব্যবস্থা ছিল সে রাতে। রাজা গেলেন শিকারে, সঙ্গে কোটাল। ঘোর অরণ্যে পথ হারিয়ে পাথরের পুরী দেখলেন চোখের সুমুখে। সে পুরীর তোরণদ্বারে বিকটমূর্তি রাক্ষস। তাকে নিধন করতে ছুটে এল পাথরপুরীর রানি—বাঘের পিঠে জগদ্ধাত্রী…যেন হাতে মায়াদণ্ড…মোহিনী মায়ায় তার বশীভূত স্থাবর ও জঙ্গম। রাজা ও কোটাল পাথর হয়ে গেল তার জাদুদণ্ডের স্পর্শে। (এইখানে তুষ্টুরামের কোটাল বেশে পাথর হয়ে গড়িয়ে পড়ার এক রহস্য কাণ্ড রয়েছে।) তারপর?

তারপর এল বালক রাজপুত্র পিতার উদ্ধারে। বাঘ থাবা তুলে গজরাচ্ছে পথ রোধ করে। সজারু ক্ষিপ্ত কাটার পালক নেড়ে তেড়ে আসছে। সাপিনী অগ্রসর হচ্ছে ধীর গতিতে।

তখন রাজপুত্র তার মোহন বাঁশিতে ফুঁ দিল। বশীভূত হল অরণ্যের শ্বাপদকুল। মায়াবিনী রানি এলেন সুমুখে। চোখে বাৎসল্যের অশ্রুজল।

মুক্তি পেয়েছে রাজা ও কোটাল। রাজধানীতে ফিরে আসে। সঙ্গে পাথরপুরীর মোহিনী রানি ও অরণ্যচরগণ।

রাজপুত্র বাঁশির সুরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।

নেপথ্যে আমিই বাঁশি বাজাব। ডিব্বু শুধু ঠোঁটে একটা বাঁশি ধরে রাখবে।

ডিব্বুকে স্টেজে নামাতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তুষ্টুরাম ও নয়নতারাও। কিন্তু দুর্গামোহনের মনের কথা টের পাওয়া যায় না। কখন মনে মনে একটা নাটকটা বানিয়েছে সে। সংলাপও রচনা করেছে। তারপর দুপুরে একদফা রিহার্সাল দেওয়া হয়েছে। একেবারে শেষদিকে এটা অভিনীত হবে। তখন দুর্গামোহন ও ডিব্বু সেজে নেবে। তুষ্টুরামের সাজবার দরকার নেই। হয়তো নয়নতারা বেশভূষা একটু পালটে নেবে।

তুষ্টুরাম যখন আগুনের চাকার খেলা দেখাচ্ছিল, পার্টির একজন এসে ডাকল আমাকে, ‘বাঁশিবাবুকে খোঁজ করছে ওখানে।’

‘কাকে?’

‘আপনাকে। ওই যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।’

বাঁশিবাবু! ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে লোকটার অনুসরণ করলাম। তারপর দেখলাম ত্রিলোচনকে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরিলার মতো দুলছে। আঙুলের শব্দ করে বাজনা বাজাচ্ছে। আলো—আঁধারি পরিবেশে তার এ মূর্তি দেখে একটু হাসি পাচ্ছিল। দুর্গামোহনের আর—এক শিকার যার জন্য আর কোনো মমতাও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই কেবল আছে খানিক করুণা।

‘ত্রিলোচন?’ আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। তার মুখে তীব্র মদের গন্ধ।

ত্রিলোচন হাসছিল। ‘খুব মজায় আছ গো নন্দবাবু। চেলাদের একেবারে, ভুলে গেছ দেখছি!’

‘ফাজলেমি কোরো না তো। কাজ আছে আমার।’

‘কাজ? কী কাজ তোমার নয়নবালা নাচবে, নন্দবালা বাঁশিতে ফুঁ দেবে …তুরু, তুতুর তুরু…’ বাঁশি বাজানোর ভঙ্গি করল সে। ‘কোথায়, না শিরীষ তলায়। কেন, না চিরাধিকে…এদিকে আয়ানশালা ভেরেন্ডা ভাজছে…’

‘ত্রিলোচন, তোমার মাতলামি শোনার সময় আমার নেই।’

বুকে দুহাতে চাপড় মারল ত্রিলোচন। ‘কুছ পরোয়া নেই। কপাল তো পকেটে নে ঘুরছি রে বাবা। এই দ্যাখ না…’ পকেটে হাত ভরে এক গোছা নোট বের করল সে।

তাঁকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ ত্রিলোচন? এরা চলে গেলে তুমি খাবে কী? টাকাগুলো সব জুয়া খেলে শেষ করে ফেললে।’

‘কই, অ্যাদ্দিন সে কথা বলোনি।’ ত্রিলোচন চোখ মুছল। সত্যি সত্যি কাঁদছিল সে। মাতালের কাণ্ড। ‘আমার ঘরখানা পড়ে পড়ে কাঁদছে, তুমি একদিকে মৌজ করছ। তখন তো বলোনি, ও ত্রিলোচনদা, আমরা ঠিকসে আছি। যে কে সেই। একচুল নড়িনি..’ স্থিরভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল ত্রিলোচন।

‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘এট্টুখানি প্রার্থনা নন্দ, এট্টু ছোট্ট কথা। আরজি মঞ্জুর করুন হুজুর।’ হাত জোড় করেছিল সে। আমি স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ‘নয়নমণিকে দুটো কথা বলব।’

‘কী কথা?’

‘আমি একবার বাজাব, সে নাচবে।’

স্টেজের ও—দিক থেকে ডাক এল, ‘বাঁশিবাবু, মালিকবাবু ডাকছেন।’

চলে আসছিলাম। হাত ধরে সজোরে টানল ত্রিলোচন। ‘নেমকহারামি কচ্ছো নন্দবাবু। খবরদার।’

তার স্পর্ধা আমাকে ক্রুদ্ধ করেছে। ধাক্কা দিতেই সে মাটিতে আছাড় খেল। কুৎসিত গাল দিয়ে উঠল। পার্টির সেই লোকটি তার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে চলেছে। আমি দ্রুত সরে এলাম।

সারা তাঁবু লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। উত্তেজিত জনতার উল্লাসধ্বনি মাতিয়ে দিচ্ছিল আমাদের।

একেই তুষ্টুরাম বলে ‘মানুষমদ’। চুমুকে চুমুকে পান করে হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে। এক সময় শো শেষ হয়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে সে নাটিকার অভিনয় দেখল সমবেত দর্শক। তারপর দুর্গামোহন তাড়াতাড়ি বেশ বদলে নিয়ে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছিল। জোর হাতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে তার বিদায় ভাষণ দিয়েছিল। উচ্ছ্বসিত করতালি দিয়ে তাকে বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করছিল তারা। স্পষ্ট দেখছিলাম, দুর্গামোহনের মুখ বারবার রক্তোজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

আশ্চর্য, এই দুর্গামোহন এবার এগিয়ে নরকের দুয়ার খুলে দেবে। নিয়তির হাত ধরে তাকে টেনে প্রবেশ করবে ভিন্ন মঞ্চে অনারূপ ভূমিকায়।

আজ শেষ রজনী। মুসাফিরের জীবন। ফের গাঁটরি তুলে যাত্রা করবে অন্য দেশে। এদিকে সে মানুষের মুখে ছুঁড়ে দেবে মুঠো মুঠো হাসি ও আনন্দের চূর্ণিত পুষ্পপরাগ। অন্যদিকে দেবে আর—এক উপহার। সর্বহারার কান্না। ভুলের মায়াজালে আবদ্ধ শবদেহগুলির হাহাকার।

নয়নতারাকে কেন্দ্র করে এই আলো অন্ধকারময় মায়াচক্র ঘূর্ণমান রেখেছে দুর্গামোহন।

ভাগ্যের ঘরে শেষ খেলা চলছিল।

উৎকট হাসি ও হল্লা শুনতে পাচ্ছিলাম। শুনতে শুনতে তুষ্টুরাম, আমি ও ডিব্বু পাশাপাশি বসে খাওয়া শেষ করেছিলাম একসময়। তারপর ডিব্বুকে শুইয়ে তুষ্টুরাম অভ্যাসমতো উবু হয়ে সিগ্রেট টানছিল। দাঁত খুটছিল।

নয়নতারার আসতে কিছু দেরি হবে। আজ একটি মাত্র শো। তাই রাত বেশি হয়নি। দুটো বাজলে তাঁবু গোটাতে হবে এ মতো নির্দেশ রয়েছে। দুটো লরিও সময়মতো এসে পৌঁচেছে। দিনের দিকে লোক পাঠিয়েছিল দুর্গামোহন। চকবাজার থেকে এবার অন্য কোথাও যাত্রা।

‘কোথায় সে জায়গাটা?’ আমি প্রশ্ন করলাম তুষ্টুরামকে। তুষ্টুরাম মাথা নাড়ল। জানে না। কোনোদিনই হয়তো দুর্গামোহন গন্তব্যস্থান কাউকেও জানায় না। প্রয়োজনও নেই জানানোর। তবে বিকেলের দিকে কে বলেছিল, কোথায় একটা মেলা বসেছে। শ্যামচাঁদ পুজোর মেলা।

‘তুষ্টুরাম।’ ফের আমি ডেকেছিলাম।

‘বলুন।’

‘আমার যাবার কথা শুনছ। তাই না?’

তুষ্টুরাম মাথা দোলাল।

‘তুমি কী বলো?’

তুষ্টুরাম মুখ তুলে চেয়ে থাকল আমার দিকে। ভাবলেশহীন।

‘বলবে না কিছু?’

‘কী বলব, বলুন?’

‘আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?’

একটু হাসল সে। ‘আমাকে সে কথা পুছলেন কেন? আপনার মালিক তো আপনি নিজে।’

‘তুমি এ লাইনে অনেকদিন আছ।’

তুষ্টুরাম পা ছড়িয়ে মাটিতে বসল। ‘আমি বললেও তো আপনি শুনবেন না। নতুন করে পুছে কী লাভ!’

জবাব দেবার মতো কিছু ছিল না। তবু আমি বললাম, ‘তুমি রাগ করবে না তো?’

কথাটা বলা ঠিক হয়নি। তুষ্টুরাম যেন চমকে উঠল। ‘কেন নন্দবাবু। এ কথা বলছেন কেন?’

মরিয়া হয়ে বললাম, ‘তুমি হয়তো ভাববে…’

‘কী ভাবব?’ তুষ্টুরাম ক্লাউনের হাসি হেসে উঠল।

চুপ করে গেলাম। নিজের দুর্বলতা যেন নিজের কাছেও হঠাৎ ফাঁস হয়ে গেছে। নয়নতারাকে দেখে আমি মোহগ্রস্ত হয়েছি—অঘোষিত এ ঘোষণায় ক্লাউন তুষ্টুরাম হা হা করে হাসছে। কান অব্দি গরম হয়ে গেল। নতমুখে ঘামছিলাম।

তুষ্টুরাম একইভাবে হাসতে হাসতে বলল, ‘নয়নতারা কি আমার, যে আমি রাগ করব নন্দবাবু?’

রাগে—দুঃখে কাঠ হয়ে গেছি সঙ্গে—সঙ্গে। ‘তুষ্টুরাম তুমি কী ভেবেছ আমাকে?’

‘কিছু না।’

‘কখনো তুমি ও সব কুৎসিত কথা বলবে না। জানো, আমি একজন শিক্ষিত লোক? ভদ্রবংশে আমার জন্ম?’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছিলাম।

তুষ্টুরাম আমার হাত ধরল এসে। ‘আরে বাপরে বাপ! আপনি দেখছি দুর্গাবাবুর ছোটো ভাই একেবারে! চুপ করুন স্যার, চুপ করুন। রাতদুপুরে চেল্লাচেল্লি করলে পেটের ভাতভি হজম হবে না, নিঁদভি আসবে না।’

শিরীষগাছের নীচে আমার বিছানা পাতা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বারবার ভাবছিলাম, এখনই ছুটে বাড়ির দিকে চলে যাই। বাবার পা দুটি ধরে ক্ষমাভিক্ষা করি। এই পরিপূর্ণ আদিম নগ্নতার পৃথিবীতে আমার জন্যে কোনো আশ্বাস থাকতে পারে না।

তারপর একসময় সত্যি—সত্যিই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। দারুণ ভয়ে আমার গা কাঁপছিল এতক্ষণে। তুষ্টুরাম যদি আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোনোদিন হত্যা করে ফেলে!

আমাকে সত্যই কি সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছে? নানা তুচ্ছ ঘটনা আমার মনে পড়েছিল। সেগুলি বিরাট আকার ধারণ করে অতর্কিতে কোনোদিন আক্রান্ত হবার গুরুতর ভয় সৃষ্টি করছিল। তুষ্টুরামের সঙ্গে আমার পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে বর্তমান সময় অব্দি ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার আমার স্নায়ুকে অস্থির করে তুলছিল।

পা বাড়াতেই ভাগ্যের ঘর থেকে ত্রিলোচনের চিৎকার শুনলাম। ‘ঠক, জোচ্চোর, বদমাস! দে, ফিরে দে আমার টাকা….’ একটা হল্লার শব্দ তার চিৎকার ঢাকল। কে তাকে ঠেলে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁবুর বাইরে থেকে তার তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল। ‘হায় হায়…আমার সর্বস্ব মেরে দিলে বাবা গো…’

নেশা ছুটে গিয়েছে হয়তো। সে হাইরোডের পিচ্ছিল পিচের চত্বরে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। আমার ইচ্ছে করল এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ি ভাগ্যের ঘরে। আগুন জ্বেলে দিই। দুর্গামোহনের গলা টিপে ধরি। এবং এ—সময় বাঘটা হাঁকরে উঠল। নয়নতারার খিলখিল হাসিও শুনতে পেলাম। কে প্রমত্তকণ্ঠে জড়িয়ে জড়িয়ে গান গাইল…তুমি আমার নয়নের তারা…ল্লে! এই লে খুকি, যা আছে সব লে! কলজেটা সুদ্ধু উপড়ে লে…বেঁচে যাই…ব্যস…

তারপর উদভ্রান্ত হাসি হা হা হা হা হা…

পাশার গুটি খড়খড় করে নড়ে উঠে শেষ দান চালা হয়েছে। রাজমুকুটে শূন্য। ড্রাগনের দুই। এস্কাবনে তিন। রুহিতন—চিড়িতন—হরতন এক এক এক।

ভাগ্যের ঘরে যারা বসেছিল, কেউ মুখ তুলে দেখল না আমাকে। দুর্গামোহন মাঝখানে বসে নিঃশব্দে হাসছে। নয়নতারা ছকের ওপর ঝুঁকে আছে কনুইয়ে শরীর ভর করে। হ্যাসাগের আলোয় তার পেন্ট—রাঙা মুখ নরকের মশালে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা কোনো মুখের মতো। দেহগুলি পেছনে চক্রাকারে বিরাট ছায়া ফেলেছে কাপড়ের দেয়ালে। বাতাসে কাঁপছে ছায়াগুলি। নীল সেলোফিনের মোহময় দ্যুতির প্রান্তে।

সেই কম্পমান ছায়ায় দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম, চকবাজারের খেলা সেদিন আমার হাত দিয়ে শুরু, আমার পরাজয় দিয়ে সূচনা তার। আজ শেষ হচ্ছে এতক্ষণে। এই শেষলগ্নেও কি পরাজয় বরণ করে নেব?

আস্তে আস্তে সরে এলাম। আমি ক্রমশ খেলার গভীরতর স্তরে পৌঁছে গেছি। চরম অব্দি অপেক্ষা করতেই হবে। আমি হার মানব না। না। না। না।