নীল ঘরের নটী – ৩

।। তিন।।

তুষ্টুরামের কাহিনী আমার মনে একটা ভিন্ন রকম অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। নয়নতারার কথা ভাবতেই মনে হচ্ছিল ওসমান খাঁ বাঘের মতো তুষ্টুরামের অতি নিকটে থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে। যে পরিণতি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তার সুখকর অংশে তার হ্রস্ব শরীরের বিরাট হয়ে ওঠা ছায়াপাত ঘটছে।

একটি বয়সি মানুষের ক্লান্ত ক্ষুধার্ত যৌবন নয়নতারার জীবনকে গ্রাস করে আছে, ভাবতে গা ঘিনঘিন করে। অথচ সন্ধ্যার পর আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে নটী নয়নতারাকে দেখে সবই বড়ো হাস্যকর মনে হয়। হাস্যকর ওই তুষ্টুরামের সঙের মতো। ছুঁচলো টুপি, কিম্ভূত কোর্তা, ডিগবাজি, ছারপোকা সংক্রান্ত একটা হাসির গান—তুষ্টুরামের নিজের বাস্তবতাগুলির খণ্ড খণ্ড প্রতীক ছাড়া কিছু নয়।

বাঁশি বাজাতে বাজাতে গভীর আবেগে আমি অনুভব করেছি, সুরের বিস্তারে দীর্ঘ বন্ধুর সঞ্চরণের পরে ওই অবাস্তব নটীমূর্তি আমারই আরোপিত। যেন নিজের দুর্গমতা থেকে নিক্ষিপ্ত করেছি মোহিনী নারীকে নির্ধারিত ভূমিকায়—লৌকিক মঞ্চে সে এক অলৌকিক সত্তা। বাঘ, সজারু ও সাপিনীর খণ্ড খণ্ড বাস্তবগুলি তার রূপেরই এক জটিল অংশ। পেছনের ঘরে দুর্গামোহনের পাশার গুটির শব্দ, মাতাল জুয়াড়িদের অট্টহাসি, মদের গ্লাসে হাত রেখে এগিয়ে আসা নয়নতারার কথা একেবারে ভুলে যেতে হয় তখন। সেখানে সে ঠিক আমার আরোপিত কোনো সত্তা নয়। তাকে দুর্গামোহন গ্রাস করেছে। সে ক্ষুধার্ত কাতর বাঘের কান্না—যা গর্জন বলে ভুল হয়।

তারপর রক্তমাংসের নয়নতারা তুষ্টুরামের রোমশ শরীরে শরীর মেলায়—তখন আমি দিবালোকের হাটতলায় পৌঁছে গেছি। এই স্পষ্টতা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে। ঈর্ষায় ঘৃণায় কাতর হয়ে গেছি।

তবু আমি বার বার গেছি। নয়নতারার মুখের একটি নির্দেশের অপেক্ষায় বাঁশি হাতে নিয়ে প্রস্তুত থেকেছি। সে ইঙ্গিত করেছে স্টেজ থেকে। দুর্গামোহন চাপা হেসে মাথা দুলিয়ে বলেছে, ‘চালান নন্দবাবু।’

মুখে আপত্তি করেছি। ‘থাক না। ব্যান্ডপার্টি তো রয়েছে।’

‘না। যার সঙ্গে যার মানায়।’

তুষ্টুরাম কেবল চুপ করে থেকেছে।

তারপর ওইটেই রেওয়াজ হয়ে গেল ক্রমে। কদিন পরে শুনলাম দর্শকেরা চিৎকার করছে, ‘বাঁশি, বাঁশি!’ দুর্গামোহন আমার জানুতে চাপড় মেরে বলল, ‘নন্দবাবু, এতদিনে আপনার পরীক্ষা পাশ হল।’

‘তার মানে?’

‘মানুষ নিয়েই আমার কারবার ভাই। ওদের খিদে রয়েছে। ওরা খিদে নিয়ে এখানে এসে ঢোকে। কিন্তু কী খাবে জানে না। আমাদের জোগাতে হয় সেই খিদের খাবার। প্রথমে হয়তো যা দিই মনঃপূত হয় না। আস্তে আস্তে সয়ে যায়। তখন বিষ গেলালে চোখ বুজে গেলে।’

হাঁ করে ওর কথা শুনছিলাম। কথাগুলি বড়ো অস্পষ্ট ছিল। পরদিনই দুপুরে দুর্গামোহন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বাবা শুধু একবার মুখ তুলে দেখলেন। কিছু বললেন না। ওদের দলে বাঁশি বাজাচ্ছি বা মেলামেশা করছি, এ খবর তাঁর কানে পৌঁছেছিল। তিনি বলেছিলেন সে কথা। অথচ মুখ ফুটে তাঁর বিরক্তির কথা জানাননি। তিনি কী ভেবেছিলেন আমি জানি না।

ত্রিলোচনের দোকানে আর যেতাম না। ত্রিলোচনও দূর থেকে দেখলে আর অভ্যাসমতো ডাকত না। দীর্ঘ সময়ে আড্ডাটা হঠাৎ ভেঙে গিয়েছিল আমাদের। আমার মনে হচ্ছিল, ত্রিলোচন এবার সেই নারীমূর্তির জগতে প্রবেশ করেছে। আমার হাসি পাচ্ছিল।

দুর্গামোহনের সঙ্গে যেতে যেতে দেখলাম ত্রিলোচন নয়নতারার তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসছে। আমাকে দেখে একটু আমতা হাসল সে। তারপর দ্রুত পাশ কাটাল। সে ঠিক ধরা পড়ার ভঙ্গিতে দীন ও চকিতভাবে সরে যাচ্ছিল। এতে অবাক হইনি।

তাঁবুতে নয়নতারা একা শুয়েছিল। আমাদের দেখে উঠে বসল। দুর্গামোহন বললে, ‘তুষ্টু কোথায় রে?’

নয়নতারা বলল, ‘ডিব্বুকে নিয়ে খেলা শেখাচ্ছে ওদিকে।’

দুর্গামোহন থমকে দাঁড়াল। এত স্থির হয়ে গেছে তার শরীর যে কাঠের পুতুল মনে হয়। তারপর সে যেন হাঁসফাস করতে থাকল। উজ্জ্বল সূর্যালোকে তার মুখমণ্ডল দারুণ লাল হয়ে উঠেছে। ছড়িটা মুঠোয় কাঁপছে একটু করে।

নয়নতারা মুখ নিচু করে ছিল। তার কপালের কাটা দাগটা খুবই করুণ দেখাচ্ছিল। এক সময় দুর্গামোহনকে বড়ো তাঁবুর পর্দা তুলে এগিয়ে যেতে দেখলাম। আমি অনুসরণ করতেই নয়নতারা ডাকল, ‘নন্দবাবু!’

‘বলো।’

‘এখন ওদিকে যাবেন না।’

‘কেন?’

আবার মুখ নামাল সে। খুবই নির্বিকার মুখ। আস্তে আস্তে বলল, ‘অনেক কিছু এখানে দেখবেন, যা সইতে কষ্ট হবে আপনার।’

‘কী নয়নতারা, কী?’ আমার হাতের মুঠি দৃঢ় হচ্ছিল।

‘এখনই শুনতে পাবেন।’

পরক্ষণেই শুনতে পেলাম। স্টেজের কাঠের পাটাতনে একটা হুটোপুটির শব্দ। তারপর তুষ্টুরামের অস্পষ্ট আর্তনাদ। আনাচে—কানাচে পার্টির লোকজন ছুটে এসে উঁকি দিচ্ছিল।

ছুটে পর্দা তুলে স্টেজে ঢুকলাম। দেখলাম তুষ্টুরাম উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার কোমরে পা রেখে দুর্গামোহন ছড়িটা দিয়ে মুখে আঘাত করার চেষ্টা করছে। দুহাতে মুখ ঢাকছে তুষ্টুরাম। তার হাত রক্তাক্ত।

ডিব্বু জড়োসড়ো হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল।

আমাকে দেখে পা নামিয়ে সরে এল দুর্গামোহন। বাঘের খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল। খাঁচার দরজার একটা তালা ও চাবি ঝুলছিল। সে তালাটা এঁটে চাবি পকেটে রাখল। তারপর বলল, ‘চলুন নন্দবাবু।’

নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করলাম। একটা সাপ নিয়ে খেলা করছি, এরূপ ভয় ও ঘৃণা আমাকে জড়িয়ে ধরছিল। শিরীষ গাছের ছায়ায় একটা ত্রিপল পেতে বসল দুর্গামোহন। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ থাকল।

আমি চলে আসবার কথা ভাবছিলাম।

‘নন্দবাবু।’

‘বলুন।’

‘দেখলেন কেমন করে আমি জানোয়ার শায়েস্তা করি!’

জবাব দিলাম না।

‘আমি একশোবার বলেছি, ছোড়াটাকে ও সব শেখাবি নে। তবু কথা শোনে না। বনের জানোয়ার, তাতে পেট পুরে খেতে পায় না। কখন কী বিপদ হয়ে যায়!’

আমি উত্তেজিত হয়েছিলাম। বললাম, ‘কিন্তু তুষ্টুরাম তো সার্কাসের লোক। জানোয়ারের খেলা ও ভালো জানে।’

‘জানতে পারে।’ দুর্গামোহন সিগ্রেট জ্বালল।…’তা আপনাকে ও সব বলেছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

‘জানোয়ারকে বিশ্বাস করতে নেই। আমি বিশ্বাস করি না। ও সব আমার কাছে একটা বোমার মতো।’

‘তবে পুষেছেন কেন?’

‘কেন?’ কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকল দুর্গামোহন। তারপর বলল, ‘আমি আজীবন জুয়ারি নন্দবাবু। তবে আমার জুয়ার সঙ্গে একটু বেশি কিছু ছিল। বাইজি মেয়ে। এটা এ লাইনে রাখতে হয়। ডিব্বুর বাবার নাম ছিল মাস্টার রতন। নয়নতারাকে দেখে সে এদিকে ভিড়ে যায়। জন্তু—জানোয়ার আনা তারই কথায়। নয়নতারার সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিলাম। বেশ চলছিল সব। ও একটা মাস্টার খেলোয়াড় ছিল। অথচ জানোয়ারের মর্জি টের পেত না। এই এক আশ্চর্য। একদিন ওসমান খাঁ তার মাথায় থাবা মারল। সে বড়ো বীভৎস দৃশ্য নন্দবাবু। অনেক খুন—খারাবি এ লাইনে আমি দেখেছি। কিন্তু যাকে আমি ভালোবাসি, তাকে এমনিভাবে মরতে দেখে আমার দেমাগ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে মেরে ফেলার কথা ভাবছিলাম। সে সময় জুটল ওই তুষ্টুটা…

একটু থেমে আবার বলতে থাকল দুর্গামোহন, ‘নয়নতারা প্রথমে ভয় পেয়েছিল। তার স্বামীকে খুন করেছিল ওসমান খাঁ। কিন্তু মেয়ে মানুষের মন, অন্তত আমি তো টের পেলাম না মশাই, বয়স কবে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে ওদিকে। … ওই হতভাগা তুষ্টু তাকে খাঁচার দিকে এগিয়ে নিতে পারল। আশ্চর্য, বড়ো আশ্চর্য লাগে আমার। যেন মেয়েটা বাঘের ওপর এমনি করে শোধ তুলবার চেষ্টা করছিল… কিংবা ওই লোকটাকে নতুন করে পছন্দ হয়েছিল তার। তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল…

দুর্গামোহন তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেল এবার। হাসতে থাকল।…’আমি অতো বুঝিনে নন্দবাবু। পাশার গুটি কোনদিকে চিত হয়ে শোয় এইটে বেশ বুঝতে পারি। আমি আড়চোখে নয়নতারার তাঁবুটা দেখে নিলাম। ডিব্বু চুপচাপ শুয়ে আছে। পাশে নয়নতারা বসে—বসে পায়ের নখ কাটছে ব্লেড দিয়ে। তার চুলগুলি খোলামেলা ঝুলছে বুকের ওপর। মুখটা ঢেকে ফেলেছে।

‘আজ আমি একটা কথা ভাবছিলাম নন্দবাবু। তাই আপনাকে ডেকে এলাম!’

দুর্গামোহনের কথা শুনে উৎসুকভাবে তাকালাম তার মুখের দিকে।

‘একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে আসছে। রতন আর তুষ্টুরাম একটা করে নতুন খেলা এনেছিল আমার পার্টিতে। এবার আপনি আনলেন।’

হেসে উঠলাম। ‘কী আর খেলা! তুচ্ছ বাঁশি…’

‘তুচ্ছ নয় ভাই। গুণীলোক ছাড়া কাকেও আমল দ্যায় না দুর্গামোহন। আপনাকে দেখে আমি ভেবেছি সেই নতুন খেলাটা বেশ জমে ওঠে। আপনার গান, বাঁশি, নয়নতারার নাচ…’

‘কিন্তু জন্তু—জানোয়ার দেখে আমি যে ভয় পাই দুর্গাবাবু।’ খুবই সম্মোহিত এবং জড়িতস্বরে এ—কথা বলে উঠেছিলাম। দুর্গামোহনের বিরাট থাবা আমার কাঁধে নামল। ‘ডরো মাৎ ইয়ংম্যান। লেখাপড়া শিখেছেন। খুব ভালো কথা। মনুষ্যত্ব অর্জন করেছেন। কিন্তু ওটা তো লক্ষ্মণের গণ্ডি ভাই। না পেরোলে জীবন মোটেও জমে ওঠে না’।

‘দুর্গাবাবু, আমাকে কি আপনার পার্টিতে আসতে বলছেন?’

‘শুধু আমি বলিনি। নয়ন বলেছে, অন্যেরাও বলেছে…’

‘তুষ্টুরাম?’

‘সেও বলেছে।’

‘মিথ্যা কথা।’

দুর্গামোহন দুলে—দুলে হাসতে থাকল। ‘ওর বলা না—বলায় কী আসে যায়। কবে দেখবেন ওর পাছায় লাথি মেরে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘তবে বিয়ে দিয়েছিলেন কেন নয়নতারার সাথে?’

‘ব্যাটা আপনার মাথাটা খেয়ে ফেলেছে দেখছি। নন্দবাবু একদিন যদি দেখি আপনিও নয়নকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন, আমি অন্যমত করব না। একটা পুরুষ ওর বড়ো দরকার। নইলে বাগ মানানো যায় না।’

তার স্পর্ধা ও কুৎসিত দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে দারুণ বিচলিত করল। কী বলব, খুঁজে পেলাম না। উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। দুর্গামোহন আমার হাত ধরে টানল। ‘রাগ করবেন না। একটু তামাশা করছিলাম।’

‘এ তামাশার জন্য বাড়ি থেকে ডেকে আনার কোনো মানে হয় না।’

দুর্গামোহন আমার হাত ধরে বড়ো তাঁবুতে প্রবেশ করল। যন্ত্রচালিতের মতো তার পাশে পাশে যাচ্ছিলাম। স্টেজে উঠে তুষ্টুরামকে আর দেখতে পেলাম না। আমাকে দেখে বাঘ উঠে দাঁড়াল। একবার ঘুরে আবার দু—থাবার ওপর মুখ রেখে শুল।

হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে দুর্গামোহন বলল, ‘ডেকেছিলাম একটু সংগত করে রাখা দরকার। মেজাজটা একেবারে গড়বড় করে দিলে হারামিটা। আসলে ও নয়নকে খেপাবার তালে আছে। বুঝলেন! কী—সব আজেবাজে বুঝিয়েছে হয়তো। নয়ন অমনি রাজি হয়ে গেছে। ডিব্বুও খেলা শিখুক। ভবিষ্যতে ওই করে খেতে হবে তো…বুঝুন মজাটা। ওসমান খাঁ আবার একটা থাবা চালাক ডিব্বুর ওপর, ব্যস।’ হারমোনিয়ামের সুর তার বাকি কথাগুলি ঢেকে ফেলল।

তারপর দুর্গামোহন একখানা গান গেয়েছিল। বিস্মিত হয়েছিলাম। এক সময় ওস্তাদ গাইয়ে ছিল লোকটা। এ—পথে এল কে জানে। বললাম, ‘নয়নতারার নাচও তো আপনার কাছে শেখা?’

বেলো টানতে—টানতে দুর্গামোহন বলল, ‘কিছুটা ওর মা শিখিয়েছিল। কিছুটা আমি।’

‘ওর বাবা কে?’

জোরে বাজিয়ে দিল হারমোনিয়াম। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে গুনগুন করে টোড়ি ভাঁজছিল দুর্গামোহন।

কোনো কোনো মানুষের মুখ আমাদের খুবই চেনা এই পৃথিবীতে। পথে ঘরে নগরে মঞ্চে যেখানে দেখি, চিনে ফেলি। এই তো, সেই তুমি। তোমার সবই জানা আমার কাছে। ওই হাসি, ভ্রূভঙ্গি, মুখরেখাগুলি, ওই ইচ্ছা বাসনা চলাফেরা—সবকিছু আমার জানা হয়ে আছে। ভালোবাসতে ঘৃণা করতে কিংবা মায়ামমতা প্রেম—প্রীতি—স্নেহ করুণায় জড়িয়ে দিতে আমি পারি তাকে। আমার কাছে এ অতি সহজ ও স্পষ্ট।

নাকি আমারই মনের জাদুঘরে থরে—থরে সাজানো একটি করে ওই সব মুখের আদল জীবনের ছাঁচ! জনারণ্যে দেখামাত্র মিলিয়ে নিই মাপে। বলে উঠি, ভালোবাসি অথবা ঘৃণা করি ওই মুখ।

দুর্গামোহনের মুখে নেই নেই আদল? নয়নতারার? এবং যেন তুষ্টুরামেরও।

যেন বা আমার মধ্যে প্রবিষ্ট ছিল নিভৃতে এক ওস্তাদ জুয়াড়ি রাজা, উর্বশী নটী ও রাজসভার ভাঁড়। কিংবা এমনও হতে পারে তাদের ইচ্ছা বাসনা, মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর পৃথক পৃথক খণ্ডে ছাঁচের আকারে সন্নিবিষ্ট ছিল আমার মন।

তারপর দিনের নির্জন স্টেজে সারাদুপুর আমাদের রিহার্সাল চলেছে। নয়নতারাকে মনে হয়েছে আমার হারিয়ে যাওয়া সেই গানের খাতাটা, প্রতি পাতায় শব্দহীন গানের রেখা, যার মলাটটা ক্রমে জীর্ণ হয়ে এসেছিল, পাতাগুলি কোণের দিকে দুমড়ে গিয়েছিল ভাঁজে ভাঁজে। আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হলেই সে সম্পূর্ণতা পায়—তখন একবারও মনে পড়ে না ওই জীর্ণতা, কীটের দংশনচিহ্ন, ভাঁজগুলির বিকৃতি। হয়তো কান্নার জলে ভিজে কিংবা অসতর্ক উলটে যাওয়ার ফলে কোথাও ঈষৎ ফাটল…কিছু অক্ষর ও বাক্য হয়ে গেছে অস্পষ্ট; তবু ক—বার গাইলেই ঠিক মনে পড়ে যায়। স্মৃতির দেশের আলোকপাতে সব পুনরুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গানের খাতা তখন তাপ বিকিরণ করে। অগ্নিময় অসহনীয়তা জেগে ওঠে। সে—জ্বালা বড়ো মধুর। সে—যন্ত্রণা স্বপ্নের জগতের। নাচতে—নাচতে নয়নতারা হঠাৎ ঝুঁকে এসেছে আমার দিকে। ঠোঁটের কোণ চুঁইয়ে কয়েক বিন্দু হাসির ফোটা ঝরিয়ে আবার দ্রুত উত্থিতা, দুলতে দুলতে পিছিয়ে গেছে দূরে। এই লুকোচুরি খেলা কোনোদিন আমরা করেছিলাম কি? কোনো জন্মে, জন্মান্তরে? বাঁশি থেমেছে—কখনও গান গাইতে গাইতে থেমে গেছে আমার কণ্ঠও। দুর্গামোহন কনুইয়ে গুঁতো মেরেছে, ‘কী হল নন্দবাবু?’

‘উ?’ নির্বোধের মতো মুখোমুখি চেয়ে থেকেছি।

‘থামলেন কেন?’

‘এমনি?’

‘থামবেন না। জমাটি আসছে।’ ফের ইঙ্গিত করে ঝুঁকে গেছে দুর্গামোহন। তার বিরাট শরীর, স্থূল জানু তালে—তালে দুলছে। ভুরুদুটি কুঁচকে গেছে। চোখ বুজে এসেছে। তার গণ্ডদেশ বেয়ে ফোঁটা—ফোঁটা ঘাম। চওড়া কপাল চকচক করছে। পাঞ্জাবির সোনার বোতাম খুলে গেছে।

একজন পরিশ্রমী মানুষকে দেখছিলাম। যে প্রাণপণে একটা পাথরের বন্ধুর চড়াই পেরিয়ে যেতে চাইছে। কিংবা অন্ধকার বদ্ধ গুহার পাথর দরজাটা খোলার জন্যে হাঁফাচ্ছে। এই উত্তরণ কিংবা মুক্ত করার পরই যে পরিস্থিতি—তাকেই দুর্গামোহন বলত ‘জমাটি’। সে বড়ো অনিশ্চিত—প্রচুর ঘর্মও তাকে আনতে পারে না। আবার অতি সহজেই নিজ ইচ্ছায় সে উদ্ভূত হয় যেন। তখন একটুখানি প্রয়াসেই তাকে সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায়।

আর তুষ্টুরাম তাকে বলত ‘বাকবাদিনী।’ সে এক বিদেহী অলৌকিক। মঞ্চের ওপর আসরের শীর্ষে অকস্মাৎ কখন এসে সঞ্চারিতা হয়। তুষ্টুরামও দুর্গামোহনের মতো টের পেয়ে যায় এটুকু। নয়নতারাও পায়।

তখন তুষ্টুরামের তবলার ধ্বনি—তরঙ্গ অন্য রূপ ধরে। অপরূপ দ্রুততায় গভীর নদীর স্রোতের মতো উদ্দাম। দুর্গামোহনের হারমোনিয়ামে অন্য সুর বাজে। রিড থেকে রিডে ক্ষিপ্রতায় তার স্থূল আঙুলগুলি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। পুরনো যন্ত্রটা হঠাৎ নতুন হয়ে ওঠে তখন! তখন দুর্গামোহন তার বিরাট শরীরসহ উপবিষ্ট অবস্থায় মূর্তিমান নৃত্যকলা। আমার হাসি পেত। আমি লক্ষ্য করেছি, চারপাশে তখন সকল দর্শক বাঘ—সজারু—সাপ—লোকজন—মঞ্চ—তাঁবু—আলো নিদারুণ নেশায় বুঁদ হয়ে গেছে। তখন অন্য সময়ের মতো অশ্লীল টিম্পনী নেই, খিস্তি নেই ‘কেয়া বাত’—বাহবা নেই—এক শোকাবহ সুগভীর নিস্তব্ধতা গুম গুম করছে। আলো তখন অদ্ভুত অন্ধকার। তাঁবু তখন আশ্চর্য প্রশস্ত গুহা। থমথম করছে কোনো অশরীরী আবির্ভাব। অথচ আমি—শুধু আমি এদের থেকে পৃথক হয়ে গেছি কিছুক্ষণের জন্যে। আমার হাসি পেয়েছে—নেশাগ্রস্ত দর্শক, নৃত্যময় দুর্গামোহন, শিথিল ভাসমান মৃতদেহ তুষ্টুরামকে দেখে।

মুখ তুলেছি নয়নতারার দিকে। মুহূর্তে আবার সেই সর্বগ্রাসে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেছি। অত সুন্দর বাঁশি, অমন মধুর কণ্ঠ…সে কি আমার? এরা কি যত্নচিহ্নিত দীর্ঘলালিত আমারই সৃষ্টি! সংশয় জেগেছে।

আমি এই ‘জমাটি’ বা ‘বাকবাদিনীর আবির্ভাব’কে বলতাম সমবেত মুড। এবং সমবেত বলেই ব্যক্তির ইচ্ছা অভিপ্রেতের ঊর্ধ্বে সে। তাই সে অনিশ্চিত। বহুর অনুগামী সে—যে বহু কোনো—কোনো মুহূর্তে কোনো আকস্মিক কারণে এক অখণ্ড ঐক্যে অভিষিক্ত হয়।

কিন্তু ওই হঠাৎ জেগে ওঠা চেতনা আমার কেন—যে কেবল আত্মা বাদ দিয়ে রক্তমাংসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে?

সেকি আমার শিক্ষাদীক্ষার সংস্কার? নাকি আমারই মধ্যে বাস করছিল এক বুদ্ধিদীপ্ত যন্ত্রবিজ্ঞানী—যে হঠাৎ চাবুক মেরে বিদ্রূপ করত আমার ক্লাউন অন্য সত্তাটাকে চরম জমাটির মুহূর্তে, যখন তার যন্ত্রগত ফলাফলের অতিরিক্ত কিছু উদ্ভূত হত, পান—চুন—খয়েরে লাল রঙের মতো?

নয়নতারা তার নটীত্বের মায়ায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বারবার এমনি করে। তার মুখভঙ্গি হাসি কথা কণ্ঠস্বর পদক্ষেপগুলি আমারই সুপরিচিত ও প্রিয়তম মনে হয়েছে। প্রিয় নারী নটীর পুনরুত্থান ঘটছিল আমার দৃষ্টির জগতে। মন থেকে চোখের পর্দায় সে পৌঁছেছিল।

তুষ্টুরাম বলত, ‘নন্দবাবু, বাকবাদিনী বড়ো খামখেয়ালি মেয়ে। যখন আসেন, অল্প শ্রোতার মধ্যে, ভাঙা যন্ত্রের সুরে, কাঁচা নাচিয়ে—গাইয়ের আসরেও আসেন। যখন আসেন না, তখন হাজার লোক, নতুন যন্ত্র, পাকা ওস্তাদের মাঝখানেও আসেন না। সে তো ইচ্ছে তাঁর। খুশি হলে আসবেন, নয় তো না।’ দুর্গামোহন তাকে ধমকাতো। ‘ব্যাটা পণ্ডিত! আমি বলি কি জানেন নন্দবাবু? অনেক সময় জমাট এসেও আসে না। আমি তখন দোষটা খুঁজতে চেষ্টা করি। হয়তো একটু খাটুনির অভাব ঘটেছে কোথাও। যেই সবে মিলে গা ঘামাতে শুরু করলাম….ঠিকই এসে গেল। আসলে ও জিনিসটি খানিক বাড়তি দাবি করে আর্টিস্টদের কাছে। একটু মনোযোগ, একটু চেষ্টা…ব্যাস।’ হাততালি দিত দুর্গামোহন।

তুষ্টুরামের মনঃপূত হত না কথাটা। সে তার অলৌকিকের প্রতি বিশ্বাস অটল রাখত।

তারপর দুর্গামোহন বলত, ‘রিডে হাত দিয়েই আমি টের পাই, জমবে কি না।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। এই যন্ত্রটা বড়ো পুরনো। নয়নের মা বড়ো পছন্দ করত একে। প্রায় বুড়িয়ে গেল বলতে পারেন। অথচ জমাটি আসবার সময় হলে রা রদলায় তক্ষুনি। আর…আর আমার ওপর যেন প্রেতের ভর হয়ে যায়।’ এবং এর প্রমাণস্বরূপ হারমোনিয়ামের চাবি টিপেই দুর্গামোহন আমাকে তার অনুভূতি জানিয়ে দিত। আশ্চর্যভাবে মিলে যেত। কারণ খুঁজে পেতাম না তার এই অদ্ভুত জ্ঞানের। একি তারই এক ক্ষমতা? পরে দেখছিলাম, ওই জ্ঞান আমারও আয়ত্তে এসেছিল। কিন্তু দুর্গামোহন ও তুষ্টুরাম দুটি পৃথক মতবাদ, দুটি দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতীক ছিল বাস্তব জীবন সম্পর্কে।

তুষ্টুরাম যেন নিয়তির কোলে আত্মসমর্পণ করে বাঁচছিল। আর দুর্গামোহন? সে একজন সচেতন শ্রমিক। সে বিশ্বাস করত কর্মফলে। এবং ফল পেলেই সে বুঁদ হয়ে যেত নেশায়। জুয়াড়ি দুর্গামোহন সে নয় তখন। সে এক গানেওলা ওস্তাদ।

নয়নতারা এদের একেবারে বাইরে। তার কিছু আমি বুঝতে পারি নে।

সে আমাদের এ সব আলোচনায় যোগ দিত না। তাল—লয়—মাত্রা নিয়ে তর্ক করত না। কেবল ওই তুষ্টুরামটা বুড়ো বেয়াড়া। দুর্গামোহনের ছড়ির গুঁতো বা লাথি না খাওয়া অব্দি আঙুল গুনে মাত্রার অঙ্ক বোঝাত। এবং এতেও তার মানসিক গঠনটা ধরা পড়েছিল আমার কাছে। নিয়তির সবকিছু নির্ধারিত বলে কোনো হিসেবের ভুল—চুক থাকা উচিত নয়। ভুল হলেই সে ক্ষুব্ধ।

দুর্গামোহন বলেছে, ‘ভুল টুল হবেই। মাত্রাজ্ঞান আমাদের জন্মগত হতে পারে, দুনিয়াটা আসলে যে বড়ো ঝামেলার জায়গা। কেবলই ভুল হচ্ছে—কেবলই ভুল আর ভুল…’

তুষ্টুরামের পশ্চাদভাগে পাম্পশুর দাগ দেখেছি। আমি বড়ো দুঃখিত হতাম। আশ্চর্য লাগত যত, তত উদ্ভট। এই ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ বাঘ—সজারু—সাপ ক্লাউন নটী আর দর্শকের উল্লাস, সবই তো এক বাইরের চাপানো আলখেল্লা—যা কারুকার্যময়। এ তো আরোপিত। অভিনীত। আসল সত্য ওই ‘ভাগ্যের ঘর’ আর জুয়াড়ি দুর্গামোহন। টাকা আর পাশার ছক। গুটি। মদের পাত্র। বেশ্যা নয়নতারা।

তখন তুষ্টুরাম জনান্তিকে ভেংচি কেটেছে। ‘বাঈজীর দল খুলছিল দুগগাবাবু। ভুলতে পারে না সেটা।’ বলতে বলতে খোঁচা মেরেছে বাঘটার গায়ে। ‘লে দিকি ওসমান চাচা, একবার হাঁকরে ওঠ দিকি। একটু জানান দে আসল কথাটা! জুয়াচুরি ফাঁস করে দে দিকি চাচাজান!’

ওসমান খাঁ গর্জন করেছে।

তুষ্টুরাম হা হা হা হা হেসে কুঁজো হয়ে যেত। ‘দেখলেন, দেখলেন স্যার?’

আমি বলতাম, ‘ভুলে যাচ্ছ কেন তুষ্টুরাম, দুর্গাবাবু তো আসলে নাচ গানের ওস্তাদ ছিলেন।’

তুষ্টুরাম ক্লাউনের মুখে ভেংচি কাটত। ‘ওস্তাদ, না ফোস্তাদ। লয়—তাল জ্ঞান নেই, ব্যাটা বেজন্মা।’

এবং চকবাজারের পরিচিত পটভূমি আমার চোখের সুমুখে আস্তে আস্তে এমনি করে বদলে গিয়েছিল।

লজ্জা—সংকোচ ভয়—দ্বিধা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। চকবাজারের মানুষের মুখগুলি আমি আড়ালে রাখার চেষ্টা করতাম। শেষ রাতে চুপি—চুপি ঘরে ফিরতাম। রাত্রির খাওয়াটা এখানেই চুকে যেত। অনেক রোদের আলোয় জেগে আবার বেরিয়ে আসতাম তাঁবুতে। দুপুরের খাওয়াও ক্রমে দুর্গামোহনের তাগিদে এখানে হতে থাকল। বাবার কাছ থেকে, তাঁর স্নেহ—শাসন—ইচ্ছা—কামনার অধীনতা থেকে আমি দূরে চলে আসছিলাম এমনি করে। বাবা ঘোর ঔদাসীন্যে মগ্ন ছিলেন। তখন বাবাকে মনে হত বড় স্থূল, অতীব নির্বুদ্ধিতার প্রতীক, খুবই জড়পিণ্ড—যা আমার জীবনে নিতান্ত একটি পরিত্যক্ত মাইলস্টোন ছাড়া কিছু নয়। কী ভাবছিলেন তিনি? কেন তাঁর ওই ঘোরতর নির্লিপ্ততা? আমার কান্না পেয়েছে। বাবা, আমি পথ হারিয়ে এ কোন দুর্গম দেশে চলেছি, ঘন অরণ্য, মায়াময় বৃক্ষ—ফুল—ছায়া, আলেয়া! ছেলেবেলায় একবার সার্কাসের তাঁবুতে বাবার সঙ্গ হারিয়ে চিৎকার করে ডেকেছিলাম, ‘বাবা, বাবা, কোথায় তুমি?’

‘এই যে খোকা, এখানে!’

বাবার হাতে আমার হাত মিশেছিল।

আজ আমি হারিয়ে যাওয়া ভীত নিঃসঙ্গ হাত বাড়িয়ে আছি। বারবার সেই দীর্ঘ সবল যুবক হাত এখন লোল শিথিল ক্লান্ত। সে গুটিয়ে গেছে নিজের স্ব—খাত গভীরে।

এইগুলি ঘটেছে আমার সেই হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা চেতনার ঘোরে। তাঁকে সত্যই অন্বেষণ করছিলাম। তিনি নিঃশব্দ ও গুহাহিত ছিলেন।

তারপর একদিন তিনি শেষরাতে আমার পায়ের শব্দে বিছানায় উঠে বসলেন। ‘আমার ইচ্ছা, তুমি আর এখানে এসো না আনন্দ।’

খোকা না বলে ‘আনন্দ’ বলায় বিস্মিত হয়েছিলাম।

‘তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছ। নিজের জীবনের ভালোমন্দ নির্বাচন করার অধিকার হয়েছে।’

একটা চিহ্ন অঙ্কিত করেছেন কবে, আমার অলক্ষ্যে। এবং তাঁর কণ্ঠস্বরে পরিচিত অভিমান ছিল না। যথার্থভাবে অনুভব করছিলাম আত্মিক অখণ্ডতার বৃহৎ পাথরে, উচ্চ চূড়ার ওপর সূক্ষ্ম ফাটলটা এতদিন বিশাল হয়ে গেছে। আমি স্খলিত হতে পারি বিপুলবেগে নীচের দিকে। ঘূর্ণমান জলস্রোতে কিংবা অন্য মালভূমিতে অন্ধকারে কোনো গুহামুখে আমার পতনশীল চিৎকারে কারুর কিছু যায় আসে না।

‘কোনোদিনও যেন তোমার মুখ না দেখি। তুমি চলে যেয়ো আনন্দ।’

সবেগে ঘুরে দ্রুত বাইরে চলে এসেছিলাম। সকল অভিমান রুদ্ধ পুঞ্জীভূত ক্রোধের রূপ নিয়েছিল। যখন বিদীর্ণ হল, আমার চোখে জল। কেন বাবা, আমাকে ছেলেবেলার মতো আঘাত করলেন না। চুলের ঝুঁটি ধরে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন না তাঁর পৃথিবীতে? সে কি তাঁর দুর্বলতা? তাঁর মনের সব ভালোর আদলে গড়ে ওঠা নন্দ, হঠাৎ এত ভিন্নরূপ হয়ে গেছে যে তাকে আর আহ্বান নিরর্থক?

কিন্তু আর ফেরার পথ ছিল না। সংশয় সব ঢেকে ফেলেছিল। দুর্গামোহনের পার্টি, না বাবার ঘর? বাবা আর আমাকে কতখানি সুখী করতে পারেন? আমার মনের ছাঁচে যে সুখের আদল, তা ওই ঘরে ছিল না আর। বাবা যথার্থ বলেছেন—আমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি।

হাইরোডে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষ রাতের আবছা আলোয় তাঁবুটা ধূসর পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছিল। তার গহ্বরে গভীর বিশাল মায়ারাজ্য। রাজা, নর্তকী ও বিদূষক। বন্যপ্রাণী। অগ্নিময় লৌহবলয়। গুরুভার দীর্ঘ ত্রিশূল। তার অন্তরালে বিস্তৃত ছকের ওপর চিহ্নিত অস্থিখণ্ডগুলি ছড়িয়ে পড়ে বারবার। পানপাত্র ফেনিল হয়। লালসা জেগে ওঠে।

আজই দুর্গামোহনের পার্টির শেষ খেলার দিন।

তাঁবুর দিকে অগ্রসর হলাম। পর্দা তুলে চলতে থাকলাম। দর্শকশূন্য প্রশস্ত চত্বর পেরিয়ে মঞ্চে উঠলাম। মঞ্চের উপর নগ্ন শরীরে লোকগুলি ঘুমিয়ে আছে। তাদের অতিক্রম করলাম সন্তর্পণে। বাঘের খাঁচার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। সে শুয়ে ছিল। ঘুমোচ্ছিল শরীর ছড়িয়ে। মুখটা ওপাশের কাঠের দেওয়ালে সংলগ্ন ছিল। আমি সজারুটাকে দেখলাম কোণের দিকে গুটিসুটি বসে থাকতে। সাপটা তারের জালের আড়ালে চুপচাপ শুয়ে আছে।

ফের আমি ঘুমন্ত লোক ও জন্তুগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করলাম। খণ্ড—খণ্ড মাংস কিম্ভূত আকৃতিতে বিক্ষিপ্ত। এদের আত্মা কি কোনো স্বপ্নে অন্তর্লীন? এরা কত নিশ্চিন্ত। এই পরিব্যাপ্ত ঘুম ও স্বপ্নের জগৎ থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেলাম। নয়নতারার তাঁবুতে গিয়ে যা দেখলাম—তা আমার অকল্পনীয় ছিল।

তুষ্টুরাম ক্লাউনের নগ্ন বুকের কাছে মাথা রেখে নয়নতারা শুয়ে আছে। তুষ্টুরামের একটি হাত তার গলার নীচে। কানের পাশে পেন্টের চিহ্ন নিয়ে সে ঘুমোচ্ছে। সেও বড়ো নিশ্চিন্ত।

তাঁবুতে প্রবেশ করার পর আগাগোড়া এইসব বাস্তবোচিত আরাম ও দৃশ্যাবলি আমাকে কোনো সান্ত্বনা দিচ্ছিল না। বিক্ষিপ্ত পায়ে এগিয়ে শিরীষ গাছের নীচে দুর্গামোহনের ঘুমও আমি দেখলাম। সে প্রকাণ্ড হাঁ করে আছে। নাক ডাকছে শব্দ করে। অনেক সময় ধরে তার মুখ নিরীক্ষণ করলাম। বয়সের ভাঁজ আকীর্ণ তার প্রকাণ্ড মুখমণ্ডলে। এই ঘুম তাকেও বাস্তব করেছে। তার রোমশ ভ্রূদুটি, দীর্ঘ স্থূল ও সূক্ষ্মাগ্র নাক, প্রশস্ত কপাল এখন এ ঘুমের সংশ্লিষ্ট কিছু। কিন্তু তার পুরু হাতের তালু, আঙুলের লোম, লালপাথর বসানো আংটি, বাদামি চামড়ার কৌটো, হাড়ের গুটি, প্রতীকচিহ্ন, ছক এ সবকিছুর সঙ্গে জড়িত হয়ে নেই। সে এখন ভিন্ন সত্তা। ঘনীভূত দৃঢ় ও কঠোর বাস্তব।

হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নিদ্রাহীন চোখদুটি জ্বালা করছিল। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, একসময় পিঠে মৃদু স্পর্শ অনুভব করে চমকে উঠেছিলাম।

নয়নতারা। ধূসর আলোয় তার মুখের রেখা বড়ো অস্পষ্ট।

‘নন্দবাবু!’

আমার দুচোখে জল এসে গিয়েছিল। যেন বা প্রকৃত উদ্ধার অলৌকিকতার আকাশ থেকে ডানা মেলে এসে কবে আমার হাত ধরবে এই আশায় আমি বেঁচেছিলাম এতদিন—অথচ তারপর যাকে সম্মুখে দেখলাম এতক্ষণে, সে তুষ্টুরাম ক্লাউনের বউ মাত্র। নতুন করে এ আবিষ্কার আমাকে কাতর করেছিল। নয়নতারাকে স্পর্শ করতে দেখে তাই আমি অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। কই, কোথায় সে অলৌকিক উদ্ধার, যে বহিময়ী নারী, পাশার গুটিতে যার প্রতীকচিহ্ন খোদিত? এ যে এক বহুস্পৃষ্ট মাংসখণ্ড—অসংখ্য দাঁতের দাগ তার ভাঁজে ভাঁজে!

ফের নয়নতারা বলেছিল, ‘নন্দবাবু, এত ভোরে যে।’

হঠাৎ ব্যাকুলভাবে তার হাত চেপে ধরলাম, ‘নয়ন, আমি যদি তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই, রাগ করবে না তো?

নয়নতারার চোখদুটি বড়ো হয়ে উঠল এক মুহূর্তে। সে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল যেন। তারপর ভাবলেশহীন মুখে হাসল একটু। ‘আমার ভালো লাগবে নন্দবাবু। কিন্তু…’ বাধা দিয়ে বললাম, ‘কোনো কিন্তু নেই। আমি স্থির করে ফেলেছি সব। এ ছাড়া আমার যাওয়ার পথ নেই।’ নয়নতারা আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকল।

পেছন ফিরে দেখি কখন দুর্গামোহন উঠে বসেছে। তেমনি নিঃশব্দে প্রচণ্ড হাসছে দুলে দুলে।