নীল ঘরের নটী – ২

।। দুই।।

স্টেজটা বেশ চওড়া। একপাশে উইংসগুলির সংলগ্ন বাঘ, সজারু ও সাপের খাঁচা। অন্যপাশে যন্ত্রী ও নাচিয়ে—গাইয়ের আগম—নির্গম ঘটে। স্টেজের নীচেও একপাশে কিছু খোলা জায়গা। সেখানে জ্বলন্ত লোহার রিং গলিয়ে তীরের মতো বেরিয়ে যাওয়ার একটা খেলা রয়েছে। উপরে ত্রিশূল ছুঁড়ে চট করে শুয়ে পড়ার পর দেখা যায় তিনটে ফলা পেটের দুপাশে ও দুই জানুর মধ্যখানে পাটাতনে বিঁধেছে—এমন একটি খেলাও রয়েছে।

এই মারাত্মক খেলাটি তুষ্টুরামই দেখায়। একেবারে শেষদিকে। স্টেজে নানা হাস্যরসাত্মক গান গেয়ে, দর্শকদের ভিড়ে কখনও নেমে এসে ক্লাউনগিরি ফলিয়ে, ফাঁক পেলেই সে হাসতে চেষ্টা করে। নয়নতারার গানে তবলাসংগত করার সময়ও এটা সে ছাড়ে না। নয়নতারা নাচতে থাকলে তখনও চরম কোনো জমাটির মুহূর্তে, সমে কি ফাঁকে, অত্যন্ত হঠাৎ সে একটি তুখোড় কথা বলে বসে। কোনো খিস্তি, কোনো রসালো মন্তব্য, যা তার লাগসই। তারপর শেষবেলায় ওই ভীষণ খেলা। তখন সে হাসে না। হাসায় না। যন্ত্রী বলতে দুর্গামোহন আর তুষ্টুরাম। কেবল নাচের সময় ব্যান্ডপার্টির লোকগুলি বাইরে মাচা থেকে নেমে এসে স্টেজের সুমুখে নীচের জায়গাটুকুতে বসে পড়ে। বিকটভাবে বাজিয়ে জমাটি আনার চেষ্টা করে।

কখনও স্টেজের পেছনে, কখনও সামনে দর্শকদের ভিড় থেকে ক্রমাগত ঘুরে ফিরে দুর্গামোহনের ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র সবকিছু দেখার চেষ্টা করছিলাম। দুর্গামোহন ম্যাজিকও দেখাচ্ছিল। স্টেজের পিছনের পটটা ছিল কালো কাপড়ের। তারও পেছনে একটা ঘর বানানো হয়েছিল। সেই তক্তপোশটা সে—ঘরে পাতা ছিল। ওপরে একখানা বাঘের ছবি আঁকা কমদামি পুরু কার্পেট। একবার উঁকি মেরে দেখে নিয়েছিলাম।

‘ওখানে কী হয়?’ তুষ্টুরাম তার শেষ খেলা দেখিয়ে এলে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম।

তুষ্টুরাম জামা পরছিল তখন। তার শরীর ঘামে জবজবে। সে ফোঁস—ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেছিল। আমার প্রশ্ন শুনে একটু মাথা নেড়েছিল শুধু।

ফের আমি নয়নতারার তাঁবুতে গিয়ে তাকেও প্রশ্ন করেছিলাম।

নয়নতারা বালতির জলে পেন্ট ধুয়ে ফেলছিল। হ্যাসাগের আলোয় আর মুখে সাবানের ফেনাগুলি চর্বির মতো জমতে দেখছিলাম। সে ভ্রূ কুঞ্চিত করে বন্ধ চোখদুটি ঈষৎ মেলবার চেষ্টা করেছিল। তারপর বলেছিল, ‘শেষ খেলা।’ স্পষ্ট বুঝতে পারিনি।

তারপর এক সময় সে তোয়ালেতে মুখ মুছল। আমি একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে বলল, ‘বসুন। দাঁড়িয়ে কেন?’

তাঁবুর ভেতর একটা কাঠের বাক্সে আমি বসলাম।

নয়নতারা বলল, ‘বাড়ি গেলেন না যে?’

তার এ—প্রশ্ন আমাকে আঘাত করল! কান অব্দি লাল হয়ে উঠেছে আমার। বললাম, ‘যাবো। রাত হয়ে গেছে। দুর্গাবাবুর জন্য অপেক্ষা করছি।’

‘ও মা! তাই নাকি?’ নয়নতারা একটু হাসল। ‘কেন?’

‘দরকার আছে।’ গম্ভীরভাবে বললাম।

ডিব্বু এককোণে ঘুমোচ্ছে। ফাল্গুনের গভীর রাতে মাঠের হাওয়ায় কিছু শৈত্য। আমারও শীতবোধ হচ্ছিল। নয়নতারা একটা শাড়ি দুভাঁজ করে তার গায়ে চাপিয়ে দিল। আড়মোড়া খেল দুহাত তুলে। তারপর ছোটো করে হাই তুলল মুখে হাত ঢেকে। বলল, ‘জায়গাটা বড়ো নোংরা। ভূতপ্রেত আছে নাকি!’

আমি জবাব দিলাম না।

‘লোকগুলো কি মারা গেল! কেউ এদিকে আসে না যে।’ নয়নতারা ফের বলল।

বড়ো তাঁবুর ভেতর স্টেজ থেকে দুর্গামোহনের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। আমি উঠে সেদিকে যাচ্ছিলাম। নয়নতারা পেছন থেকে ডাকল, ‘নন্দবাবু, চলে যাচ্ছেন নাকি?’

ফিরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, যাই।’

নয়নতারা বেরিয়ে এল। ‘বাবুর সঙ্গে দেখা করবেন না?’

মাথা নাড়লাম।

সে হেসে উঠল। ‘আজ বোধহয় জমবে না। একা—দোকা খেলা জমে না তত। মিছিমিছি রাত জেগে কী হবে? কাল আসবেন।’

‘কাল কী হবে?’

‘নতুন জায়গা। খবর ঠিক মতো পৌঁছায়নি। টনক নড়লে ঠিক হাজির হবে সব।’ দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে সে কথা বলছিল। তুষ্টুরামকে দেখা গেল পর্দা তুলে এদিকে আসতে। তার হাতে একটা হ্যাসাগ। রুমালে আংটা ধরে খুবই সাবধানে সে অগ্রসর হচ্ছে। হ্যাসাগটা দপদপ করে জ্বলে উঠছে। অস্পষ্ট খিস্তি করছিল তুষ্টুরাম।

আমাকে দেখে বলল, ‘এখনও যাননি দেখছি।’

‘হ্যাঁ। তোমাদের শেষ খেলার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।’

তুষ্টুরাম বড়ো—বড়ো চোখে আমার মুখ দেখার চেষ্টা করল। তারপর কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেল।

পর্দা সরিয়ে স্টেজে ঢুকলাম। দুর্গামোহন পা ছড়িয়ে বসে ছিল। বলল, ‘আরে নন্দবাবু যে! আসুন, সিগ্রেট খান।’

যখন বসলাম, এ—বসার মধ্যে কিছু হ্যাংলা ভিখিরির ভঙ্গি ছিল। কিংবা ভোজপর্বের পরও আরও কিছু আশা নিয়ে উৎসবগৃহের আনাচে কানাচে ঘুরে—বেড়ানো। পলকে—পলকে এ জানা আমাকে বিব্রত করছিল। অথচ উঠে আসবার ইচ্ছে করছিল না। আমাকে বসতে বলে দুর্গামোহন তার লোকজনদের সঙ্গে কথা বলছিল। সেই ফাঁকে হঠাৎ চলে আসতে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল। ভীষণ অস্বস্তিতে আমি ভুগছিলাম। মনে হচ্ছিল এভাবে স্থানত্যাগ—আমার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আগেই—বড়ো অসম্মানজনক। দারুণ ইচ্ছে করে ওরা কিছু কথাবার্তা বলুক আমার সঙ্গে যাতে ‘আচ্ছা, আসি’ বলে যথোচিত মর্যাদায় কেটে পড়তে পারি।

এবং সব থেকে আশ্চর্য এই যে বাবার কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।

স্টেজের ওপর দুটি উজ্জ্বল হ্যাসাগ পাটাতনে দাঁড় করানো ছিল। দুর্গামোহনের চিবুক অব্দি সে—আলোর স্পষ্টতা। তার মুখমণ্ডল খানিক অস্পষ্ট। উইংসের মুখে টেরচা হয়ে আলো পড়তেই ওসমান খাঁকে দেখলাম। অমনি আমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল।

বাঘটা প্রকাণ্ড জিভ বের করে ঠিক সোজাসুজি আমাকে দেখছে। সামনের দুটি পায়ের ওপর মুখটা নামিয়ে রেখেছে। উজ্জ্বল আলোয় নীলাভ চোখ থেকে যেন প্রশ্নের চিহ্ন। আমার গা ছম ছম করল।

একটু হেলে আমিনাকে দেখলাম।

বিরাট ময়াল সাপিনীও খাঁচার প্রায়ান্ধকার কক্ষ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কি? সজারুর খাঁচার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের সাহস ছিল না। শেষরাতের নিঃশব্দ পরিবেশে খানিক আলো ও খানিক অন্ধকারে কিছু স্পষ্টতা কিছু অস্পষ্টতা। দুজন নয়নতারা দুদিকে। নটী ও ভার্যা।

ঠিক মধ্যবিন্দুতে বসে আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি। কোনোদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি নে।

‘নন্দবাবু!’ দুর্গামোহন ডাকল।

‘বলুন।’

‘কেমন দেখলেন পার্টি? চলবে তো এখানে?’

‘ভালো চলবে।’

‘হ্যাঁ।’ দুর্গামোহন তার ছড়িটা খুটখুট করে ঘা দিল পাটাতনে।

‘আজকের নমুনা ভালোই বলা যায়। কিন্তু…

‘কিন্তু কী?’

তার প্রকাণ্ড মাথাটা আমার মুখের দিকে নেমে এল। ‘আসল খেলাটা না জমলে চলে না ভাই।’

আমি হেসে ফেললাম। অর্থহীন হাসি।

দুর্গামোহন বলল, ‘নয়নতারার নাচ দেখিয়ে আমাদের পেট ভরে না নন্দবাবু। পেছনে একটা লাক—রুমও তৈরি করে রাখি।’

‘কী রুম বললেন?’

‘লাক—রুম। ভাগ্যের ঘর।’

‘দেখেছি।’

আমার হাত ধরল দুর্গামোহন। তেমনি ভয়াবহ নিঃশব্দ হাসতে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘কোথাও এমন হয়নি। আমার লোকজন আগে থেকে সব খোঁজখবর নিয়ে রাখে। কিন্তু কী বেয়াড়া জায়গা মশাই, একজনও টিকি দেখাল না।’

বললাম, ‘বেশ তো, আমার সঙ্গেই একহাত হয়ে যাক।’

আমার বুকপকেট থেকে হঠাৎ ক্ষিপ্র হাতে দশ টাকার নোটটা তুলে নিল দুর্গামোহন। ফের রেখে দিল। বলল, নন্দবাবু, ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না। জাত যায় ওতে। তবু অব্যেস। এক রাত খালি গেলে হাত নিসপিস করে। আসুন…’

মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার সঙ্গে গিয়ে সেই ভাগ্যের ঘরে ঢুকে ছিলাম। কার্পেটের ওপর ছক পাতা ছিল। রাজমুকুট, ড্রাগন, চিড়িতন, এস্কাপন, হরতন আর রুইতনের ছটি ঘর। চামড়ার কৌটোয় ছ’টি হাড়ের গুটি। তারপর কে একজন এক বোতল মদ এনে রেখেছিল। দুর্গামোহন একমাত্র গিলে বলেছিল, ‘ইচ্ছে করে তো দু—এক পাত্র নিতে পারেন। আপনি গুণী লোক। জোর করব না।’ আমি অত্যন্ত হঠাৎ একটা দুষ্কর্মের জগতে প্রবেশ করার উল্লাস নিয়েও ছুঁতে সাহস পাইনি। বারবার আমার মধ্যে একটা বিষাক্ত লালসা নড়ে—চড়ে উঠছিল রাতের সেই শেষ যামে। তারপর ভীষণ শব্দ করে গুটিগুলি ছড়িয়ে পড়ছিল ছকের ওপর। হ্যাসাগের গায়ে একদিকে নীল সেলোফেন কাগজ মোড়া ছিল। অন্য দিকটা থেকে উজ্জ্বল আলো পড়ছিল ছকে। নীলাভ আলোয় ভাগ্য—ঘরের অবশিষ্ট পেছনের অংশ রহস্য ও অলৌকিকতার সৃষ্টি করছিল।

শেষ দানের সময় সেখানে একবার তুষ্টুরামকে দেখলাম যেন। এক সময় আমাদের খেলা শেষ হল। আমার টাকাগুলি সম্পূর্ণ জিতে নিয়ে দুর্গামোহন বলল, ‘চার আনার দানে খেলে সুখ নেই। খেলি না। ওসব বাইরের খেলা। জুয়াড়িরা গ্যাসবাতি জ্বেলে খেলে। তবু আপনার খাতির,—আমার হাতের সুড়সুড়ি।’ সে একটু হাসল বলতে বলতে। ‘কিন্তু নন্দবাবু, আপনি কি কিছু আনন্দ পেলেন?’

সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করে বললাম, ‘ভীষণ।’

আমার পিঠ চাপড়ে দিল সে। ‘হারারও আনন্দ আছে, ভাই। সেবার বন্যেশ্বরের মেলায় শেষ টাকাটিও হেরেছিলাম। সে এক ওস্তাদ খেলোয়াড়। ক্ষেত্রমোহন দারোগা। ওস্তাদ বলে পায়ে নমস্কার করেছিলাম। পরদিন কিন্তু সব ফিরে পেলাম। ওস্তাদেরও ওস্তাদ থাকে তো।’ দুর্গামোহনের কণ্ঠস্বর ক্লান্ত কিংবা শিথিল মনে হচ্ছিল। সে ঈষৎ চাপাস্বরে কথা বলছিল। ‘তাকে আমি পয়সা দিয়ে পুষছি। ওই জন্তুগুলোর মতো। তাকে এড়িয়ে যাওয়া বড়ো কঠিন। শুধু মধ্যে মধ্যে বড়ো খামখেয়ালি করে। দেখুন না, আজ কী করল…’

‘কী?’

সেদিকে কান না দিয়ে দুর্গামোহন হঠাৎ হাঁসফাঁস করে গর্জাল, ‘শয়তানির চুলের মুঠি ধরে আছাড় মারতে ইচ্ছে করে। নতুন জায়গা। প্রথম দিন। দিলে আমার বারোটা বাজিয়ে।’

স্পষ্টত সে নয়নতারার কথা বলছিল। শিউরে উঠে বললাম, ‘কেন! ও তো ভালোই নেচেছে—গেয়েছে। অনেকে প্রশংসা করছিল।’

”না।” দুর্গামোহন গম্ভীরভাবে ঘড়ঘড় করে বলল। ‘সেরূপ আপনি দ্যাখেননি মশাই। চকবাজারে কেউ দ্যাখেনি।’

‘তাই নাকি?’

দুর্গামোহন ডাকল, ‘তুষ্টু, তুষ্টুরাম!’

তুষ্টুরাম নীলাভ আলোয় এসে স্পষ্ট হল। সেলাম করছিল সে অভ্যাসমতো।

‘নয়নের কী হয়েছে রে আজ?’

‘কিছু না তো!’

‘তুষ্টু, ওকে এক্ষুনি বলে দে, আমার দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে।’

‘বলছি স্যার।’

‘বলে দে, কাল পার্টির নাম ডোবালে ওকেও আমি ডোবাবো।’

‘আচ্ছা স্যার।’

‘গিদধড় কা বাচ্ছা, ভাগ।’ হঠাৎ পা তুলে ওর পেটে লাথি মারল দুর্গামোহন। তুষ্টুরাম ছুটে পরদা তুলে পালাল।

এবার সে আমার দিকে তাকাল। ‘নন্দবাবু, তুমি এসো তাহলে।’

অপমানিত ও বিস্মিত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। কেন আমি এসব করছি—এই দ্বন্দ্ববোধ উৎকণ্ঠা, লোভ ও আকর্ষণ? কী পেতে চাই আমি?

অনিচ্ছুকভাবে দুর্গামোহনের সঙ্গে এক অলৌকিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি। ঘরে আমার রুগণ বাবা। স্কুলের জীবন তাঁকে শেষ দিকে অস্বাস্থ্য ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার ভবিষ্যৎ থেকে প্রতীক্ষিত আলো ও উত্তাপ তিনি অনুক্ষণ অনুভব করছেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে তিনি মৃত্যুর কথা ভুলে যাচ্ছেন।…এইসব যুগপৎ আমার মধ্যে প্রবেশ করছিল। আমাকে ছন্নছাড়া করে তুলছিল, উদভ্রান্ত ভাবে পথ চলছিলাম।

চুপিচুপি ঘরে ঢুকেছিলাম। বাবা জেগে ছিলেন। বললেন, ‘কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ?’

‘ত্রিলোচনের ওখানে।’

‘গানের জলসা ছিল বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’

এই জবাবটুকু যথেষ্ট ছিল বাবার কাছে। সংগীতকে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করবেন। কতদিন তাঁর পাশে বসে আমি গান শুনিয়েছি। তাঁর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে বার বার করে জল ঝরে পড়েছে। কলেজের পাঠ সমাপ্ত করার পর প্রায়ই বলতেন, ‘চাকরির চেয়ে বরং অন্য পেশা ভালো। তাঁর ইঙ্গিত আমি বুঝতাম। কিন্তু জীবন—ধারণের পক্ষে সংগীতের পেশা কতখানি উপযোগী, একথা স্পষ্ট করার মতো নিদর্শন আমরা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাঁর স্কুলের প্রতি তিনি বিরক্ত ছিলেন। ইচ্ছে করলে সেখানে আমার স্থান করে দিতে পারতেন, করেননি। যেন ভাগ্যের প্রতি নির্ভর করে কাটাচ্ছিলেন তিনি।

এবং আমিও।

বাবা বললেন, ‘খেয়ে এসেছিস নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

আমার খিদে মরে গিয়েছিল। কেবল তৃষ্ণা পাচ্ছিল। গলা ও বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, বাবার বিশ্বাস ও নির্ভরতায় এতদিন পরে অত্যন্ত হঠাৎ একটা ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছি আমি।

কিন্তু কেন?

পরদিন রাতের স্টেজে নয়নতারাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

বাঘ ও সজারুটা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আর দুটি শেকল ধরে মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা। শরীরে নাচের মুদ্রা। সাপটা তার গলায় জড়িয়ে থেকে বুকে মাথা ঘষছে।

তারপর সে ঈষৎ হিল্লোলিত হল। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে একবার করে ঝুঁকে ফের স্থিরভাবে দাঁড়াল। এ সময় কোনো বাজনা বাজছিল না। ডানপাশের উইংসে হারমোনিয়াম ও দুর্গামোহনকে দেখা যাচ্ছিল। তুষ্টুরাম অদৃশ্য।

এ বুঝি এক ভয়ংকর খেলা।

সমবেত দর্শক স্তব্ধ হয়ে দেখছে। এ—নয়নতারাকে আমিও প্রথম দেখতে পাচ্ছি। তার চোখে, ঠোঁটে দুটি বাহুতে যে লীলাবিভ্রম, তা ঠিক অশ্লীল নয়। ওই বাঘ, সজারু ও সাপের জগতের এক আদিম, অস্পষ্ট ও অলৌকিক অবিচ্ছিন্নতার অংশ। পৃথক করা যায় না কোনোমতে। নয়নতারা দুর্গামোহনের জাদুদণ্ডে খুবই গভীর এক প্রাকৃতিক সত্তা হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে নিজেরই অলক্ষ্যে কখন উঠে গেছি। গতকাল দুপুরে বাঁশিটা হারমোনিয়ামের রিড—কভারের নীচে রেখে গিয়েছিলাম। কখন দুর্গামোহনের পাশে বসে সেটা তুলে নিয়েছি। দুর্গামোহন মুখ ফিরিয়ে তাকাল। একটু হাসছিল সে। তারপর সুর দিল। ধীর ও শান্ত সুর। আমি নিশীথ রাত্রির আহ্বানের ব্যাকুলতা সঞ্চারিত করছিলাম বাঁশিতে। বাঁশি দ্রুত চড়াইয়ে ছুটে গিয়েছিল। ফের নেমে এল। মধ্যবর্তী স্তরে বিচরণ করতে থাকল। তুষ্টুরাম তবলার ওপর ঘাড় গুঁজে মৃদু—মৃদু বোল তুলল। তারপর ঘুঙুরের ঝুম—ঝুম ধ্বনিপুঞ্জ। ব্যান্ডপাটি দুর্গামোহনের ইঙ্গিতের অপেক্ষা করছিল। না পেয়ে থেমে আছে। ধুয়োয় ফিরে আসবার পরই বাঘটা হাঁকরে উঠল। সজারুর ডানার খটখট শব্দ শুনলাম।

চোখ বুজে বাজাচ্ছিলাম। শব্দগুলি পাশার গুটির মতো মনে হচ্ছিল।

এক সময় পর্দার শব্দ। স্ক্রীনের নীচের কোণে বাঁধা ইটের টুকরো আমার পায়ে সজোরে আঘাত করে স্টেজের মধ্যবিন্দুতে পৌঁছেছে।

দশকেরা হাততালি দিচ্ছিল।

নয়নতারা বলল, ‘আপনাকে চিনতে খানিক বাকি ছিল।’

বললাম, ‘আমারও।’

সে রাতে ভাগ্য—ঘরের পর্দা তুলে পিছিয়ে এসেছিলাম। চকবাজারের সেইসব ভদ্রজন যাঁদের গুরুজনের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করতাম, তাঁদের দেখছিলাম পাশার ছক ঘিরে বসে থাকতে। তাঁদের এক প্রান্তে আমাদের খঞ্জনিবাদক রামহরি মেকদারকেও দেখলাম। তারপর দেখলাম ত্রিলোচনকে। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।

পেছনে নীলাভ আলোয় একটা টুলে বসেছিল নয়নতারা। গ্লাসে মদ ঢেলে সে এগিয়ে এল আলোর দিকে। পাত্রটা একজনের সম্মুখে এগিয়ে দিল। তারপর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল।

বেরিয়ে সেই ছোট্ট তাঁবুর কাছে এসেছিলাম। ডিব্বু শুয়ে ছিল। তুষ্টুরাম হেঁট হয়ে বসে শুকনো ভাত গিলছিল। বারবার জল খাচ্ছিল ঢকঢক করে।

আমাকে দেখে একটু হাসল। ‘বসুন নন্দবাবু।’

চুপচাপ বসে তার খাওয়া দেখছিলাম। সামনের দিকে খুবই বেশিরকম ঝুঁকে গেছে তার শরীর। বাম হাতে বারবার গোঁফটা মুছে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। উদ্যেম পিঠের পাশে তেরচা হয়ে আলো পড়ায় পাঁজরের হাড় ও রঙের উজ্জ্বলতা স্পষ্ট। একটা সম্ভ্রান্ত কিছু ক্রমাগত বিপন্ন হয়ে পড়েছে—এ কথাই মনে হচ্ছিল তাকে দেখে। তার মস্ত ছায়া ঘুমন্ত ছেলেটিকে ঢেকে ফেলেছে। কোণে একটুকরো দড়িতে ঝুলন্ত নয়নতারার শাড়ির কিয়দংশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বাকিটা একই অন্ধকারে। বাক্সের ওপর আয়না ও প্রসাধনের কৌটাগুলি তখনও গোছানো হয়নি। ত্রিপলের মেঝেয় আলতা বা মিনার গুঁড়ো। কিছু পাউডার ইতস্তত ছড়ানো। কালো চিরুনিটাও দেখতে পেলাম এক কোণে। এবং এইসব জিনিসগুলি অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করছিল আমাকে। ভাবছিলাম আমার সঙ্গে এগুলির কি কোনো পরোক্ষ সংযোগ থাকতে পারে কোথাও? এদের স্পষ্টতা আমাকে আমারই গুহাহিত কোনো স্মৃতির দিকে আলো ফেলতে নির্দেশ করে। মনে হয়, রক্তের খুব ভিতরে এরূপ একটি ধূসর তাঁবুর জগতে ঘুমন্ত কোনো গায়িকার মুখ দুহাতে তুলে ধরার সংগুপ্ত প্রয়াস চলছিল এতদিন ধরে—এই তুচ্ছ বস্তু ও চিহ্নগুলি তার উপাদানের প্রতীকচিহ্ন ছাড়া কিছু নয়।

খুবই আকস্মিকভাবে ত্রিলোচনের ঘরের নারীমূর্তিদের কথা আমার মনে পড়ে গেল। সুর ও সংগীতের অবাস্তবতা কতবার মরে গেছে এদের প্রতি একবার দৃষ্টিপাতে। সুর ও সংগীত সব ব্যাতিরেকে ওতপ্রোত হয়ে উঠেছে, খণ্ড—খণ্ড বাস্তব নারীমূর্তির সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত। গান এমনি করে সহজ হয়ে উঠেছিল আমার কাছে—নিশ্বাসের বায়ুর মতো। অনুভব করেছি, আমি সেই অন্ধ ভিখিরি যে শূন্য পাত্র নিয়ত মেলে ধরে পথের প্রান্তে উপবিষ্ট—অকম্প্র হাতে ধরে আছে তাকে পূর্ণ করার জন্যে, যে কণ্ঠ দ্বারা আত্মপরিচয় ঘোষণা করে না…।

সহজ বাস্তবের পরিচ্ছন্নতায় অযৌক্তিকভাবে নয়নতারা প্রবেশ করেছে; তারপর দেখি সুর ও সংগীত আর সহজ হয়ে ওঠে না। বাস্তবতার চিহ্নও তাতে লিপ্ত নেই। একটা অলৌকিকভাব উত্থিত হচ্ছে।

তুষ্টুরাম পরিপাটি করে আহার সমাপ্ত করল। হাত—মুখ ধুয়ে কুলকুচো করল। এবং এতে তার জীবনের কোনো কোনো দিক সম্পর্কে দারুণ নিষ্ঠার পরিচয় মেলে।

সে মুখোমুখি একটু দূরে মাটিতে উবু হয়ে বসল। সিগ্রেট জ্বেলে দাঁত খুঁটল কিছুক্ষণ নিবিষ্টভাবে। তারপর বলল, ‘কাল আপনার কাণ্ড দেখেছি।’

‘তাই নাকি!’

‘একদিন ঠিক এমনি করেই আমি এ পার্টিতে এসেছিলাম।’ তুষ্টুরাম ফের দাঁত খুঁটতে থাকল। তার এ মূর্তি ঠিক গাম্ভীর্যের নয়। ক্লাউন তুষ্টুরাম তো হতেই পারে না এই বসে থাকা লোকটি। তার ভাষা ও শব্দাবলি কিছু মার্জিত। তাতে সে অভ্যাসমতো হিন্দি বুলি ও ঢং একটুও মেশাচ্ছে না।

শুকনো হেসে বললাম, ‘এমনি জুয়ো খেলতে। তাই না তুষ্টুরাম?’

তুষ্টুরাম বলল, ‘হ্যাঁ।’ তার মুখের আধখানা অন্ধকারের দিকে। আধখানা মুখে তৃপ্তি। বাকিটুকু বুঝি দুঃখ—যা সে ঢেকে রাখতে চায়। ‘বন্যেশ্বরের মেলায় একটা সার্কাসদলে আমি ছিলাম। সেটা জুয়াড়ির দল নয়। কিন্তু জুয়া খেলতে আমার ইচ্ছা করছিল। দুগগাবাবু সেখানে শো দিচ্ছিল। শেষ রাতে এমনি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছিলাম তাঁবুর পাশে…’

গা জ্বলে গেল আমার। ‘আমাকে কী মনে করো তুমি?’ উঠে দাঁড়ালাম সঙ্গে সঙ্গে।

মুখ তুলে আমার আপাদমস্তক দেখল তুষ্টুরাম। তারপর বলল, ‘আপনাকে অপমান করবার জন্য ও কথা বলিনি। মাফ করবেন স্যার।’

‘আমি জুয়ো খেলবার জন্য আসিনি।’

‘জানি।’

‘আমি নাচ—গান ভালোবাসি।’

‘জানি।’

‘তবে ও—কথা বললে কেন?’

ইশারায় আমাকে বসতে বলল তুষ্টুরাম। ‘এ লাইন বড়ো কষ্টের নন্দবাবু। ওই বনের জানোয়ারও কেঁদে ফ্যালে।’

‘তাতে আমার কী?’

তুষ্টুরাম একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আপনার রক্তে নেশা রয়েছে কিনা, তাই ভয় হয়। আপনি শিক্ষিত মানুষ। সাদা কাপড়ে কালি খুব ঘন হয়ে লাগে।’

‘যাও, যাও। মুখভঙ্গি করে বললাম, ‘ওই তো দেখলাম চকবাজারের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের। পাশার ছকে বসে মদ গিলছে।’

‘আমিও অনেক দেখেছি স্যার, বয়স তো কম হয়নি।’

তুষ্টুরাম উত্তেজিত হচ্ছে না বিন্দুমাত্র। তার ফলে আমি ক্রমশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। অথচ চলে গেলে মনে হয় কত কী ফেলে রেখে যাচ্ছি। কত আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ হতে যেন বাকি।

‘তুষ্টুরাম, তুমি কি এখানে আসতে নিষেধ করছ আমাকে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘আপনি গুণী লোক। এখানে সম্মান থাকবে না। কেউ দেবে না সে সম্মান।’

‘আমি কি খেলাও দেখব না তোমাদের?’

এ কণ্ঠস্বরে একটা অলক্ষিত দীর্ণ অসহায় চিৎকার ছিল।

তুষ্টুরাম আমার হাত ধরে টানল। ‘আপনি খুব অবুঝ নন্দবাবু। দুগগামোহন জাদুর টানে সারা চকবাজারকে লাক রুমে হাজির করবে দেখবেন। তারপর রাতারাতি খুটিখাম্বা তুলে উধাও হবে। তখন শুনবেন ওরা বুক চাপড়ে কাঁদছে। কেউ পোড়ামুখ লুকিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আর ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছে। এ বড়ো সর্বনেশে নেশা নন্দবাবু।’

‘কেন তুষ্টুরাম, কেন?’

‘পাশার একদিকে যে বসে থাকে, তাকে কি দ্যাখেননি আপনি?’

তুষ্টুরামের কণ্ঠে একটা কাতরতা ফুটে উঠল। তার চোখদুটি ঘোলাটে মনে হল। আমি চুপ করে থাকলাম।

‘আমার কপাল নন্দবাবু, আমি একটা বিদঘুটে কানামাছি খেলার বুড়ি হয়ে বসে আছি। আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেয়েটা ঘুরছে—তার দুচোখে কাপড় বেঁধে দিয়েছে দুগগামোহন।’

ঈষৎ ঝুঁকে আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ডিব্বু কার ছেলে?’

ভাগ্যের ঘর থেকে উদ্দাম হাসি ও স্খলিত কণ্ঠে চিৎকার ভেসে এল এতক্ষণে। খেলা বড়ো জমে উঠেছে বুঝি। নয়নতারার উচ্ছ্বসিত হাসিটি অনায়াসে ওই মিলিত কণ্ঠের হল্লা থেকে পৃথক করা যায়। তুষ্টুরাম দু’হাঁটুর ফাঁকে মাথা ঝুলিয়ে দিল। যেন শুনতে চাইছে না কিছু। এক সময়ে সে ফের মুখ তুলল। ‘রাতের পর রাত ওইসব শুনি। তবু অভ্যাস হল না। বড়ো বিচ্ছিরি লাগে। নিদ টুটে যায় আমার।’ ঐ স্বগতোক্তির মতো অর্ধস্ফুট স্বরে একথা বলল সে।

‘ডিব্বু কার ছেলে বললে না তো?’

তুষ্টুরামও এতক্ষণে তার ক্লাউনের হাসি হেসে উঠল। সেই প্রাণখোলা প্রচণ্ড হাসি। তারপর বলল, ‘আপনি বয়সে কাঁচা, স্যার। বুঝলেন? পাকতে দেরি আছে।’

‘হেঁয়ালি রাখ তুষ্টুরাম।’

‘আপনি যে সরকারি উকিলের মতো আইনের বুলি বলছেন নন্দবাবু! কী তাজ্জব!’

‘বলবে না?’

‘শুনে কী লাভ আপনার?’

‘ইচ্ছে করে জানতে?’

‘কেন?’

‘ওর চেহারা ঠিক তোমার মতো না। নয়নতারার মতোও না।’

‘তবে বুঝে লিন না।’

‘ওর বাবা কোথায়?’

‘জানি না।’

‘নয়নতারা তো তোমার বউ?’

‘তাও জানি না।’

‘থাক। বলতে হবে না।’ ছেলেমানুষি অভিমান নিয়ে আমি চলে এলাম। তাঁবু পেরিয়ে সড়কে উঠতেই শুনি, সে আমার পেছন পেছন আসছে। ফিরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘কী হল আবার?’

তুষ্টুরাম আমার হাত ধরে সড়কে হাঁটতে থাকল। তার হাতের স্পর্শে একধরনের আন্তরিকতা ছিল। ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না।

সে বলেছিল, নন্দবাবু, ‘প্রথম থেকেই আপনাকে আমার ভালো লেগে গেছে। মনের কথা বলার ইচ্ছে করে। কিন্তু….’

‘কিন্তু কী তুষ্টুরাম?’

‘কিছু না চলুন, খানিক হাওয়া খেয়ে লিই গায়ে। এখন বেশ আরাম লাগে হাঁটতে।’

হাঁটতে হাঁটতে নদীর পোল অব্দি গিয়েছিলাম আমরা। মধ্যবসন্তের ঠিক মধ্যরাত। তুষ্টুরাম তার জীবনের কিছু কিছু কাহিনী বলছিল। তার শৈশবের অনাথ পরিচয়হীন দিনগুলির কথা গভীর মমতায় বিশ্লেষণ করছিল। তারপর সে একটা ম্যাজিকের দলে আশ্রয় পায়। সেখান থেকে সার্কাসে। সায়েব কোম্পানির সার্কাস। বুনো জন্তু নিয়ে খেলা দেখানোর বিদ্যায় সেখানেই তার হাতেঘড়ি। কোম্পানি ভেঙে গেলে একটা দেশি সার্কাসে ফের সে ঢোকে। খুবই নাম বাড়ছিল। কিন্তু বন্যেশ্বর মেলায় এসে তার দিকভুল ঘটে যায়।

দুর্গামোহনও তার মতো একজন লোক খুঁজছিল। নয়নতারার নাচ—গানের সঙ্গে একটা ভয়ংকর কিছু জুড়ে দেবার মতলব তুষ্টুরামই দ্যায় তাকে।

সেই শুরু হল সাধনা। যে সাপিনীর খাঁচার কাছে যেতে নয়নতারা ভয় পেত, একদিন তাকে গলায় জড়িয়ে নাচতে পারল। বুড়ো বাঘটা আর হাঁকরায় না তাকে দেখে। হিংস্র সজারুটাও বশ মেনে গেছে।

ডিব্বু তখন দুধের ছেলে। দোলনায় শুইয়ে রেখে নয়নতারা ওইসব নিয়ে মেতে থাকত। ডিব্বু কাঁদতো ট্যাঁ—ট্যাঁ করে। আর আশ্চর্য, দুর্গামোহন তাকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যেত দূরের দিকে। ঘুম পাড়াত। গান শোনাত মেয়েলি সুরে।

তুষ্টুরাম অবাক হয়ে লক্ষ্য করত এ সব। প্রশ্ন করেও জবাব পেত না নয়নতারার কাছে।

একদিন ডিব্বুকে কোলে নিয়ে বাঘের খাঁচার কাছে গিয়েছিল দুর্গামোহন। সেদিন বাঘটা ক্ষুধার্ত ছিল। খাবার দিতে একটু দেরি হয়েছিল তার। ডিব্বুর উদ্দেশ্যে ক্ষিপ্তভাবে সে থাবা বাড়িয়ে দ্যায়। দুর্গামোহন ডিব্বুকে সরিয়ে না নিলে ঠিকই মেরে ফেলত। কেবল জামার টুকরো নিয়ে গালে পুরেছিল বাঘটা।

শিউরে উঠেছিল নয়নতারা। পরের রাতে বাঘের সঙ্গে নাচটা বাদ দিতে হয়েছিল। ফলে দর্শকেরা ক্ষেপে যায়। দারুণ মারামারি বেঁধে যায় দলের সঙ্গে। তাঁবুতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল তারা। দুর্গামোহনকে ঘিরে ফেলেছিল উত্তেজিত জনতা। হঠাৎ লোহার রড হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুষ্টুরাম। ক্লাউন তুষ্টুরামের এই দিকটা কেউ জানত না। দুর্গামোহনকে খুবই বাঁচিয়ে দ্যায় সে। নইলে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত ক্ষিপ্ত জনতা।

আর নয়নতারারও কিছু ভক্ত সবখানেই জমে যায়। সেখানেও ছিল। তারাই তাঁবুর আগুন নিভিয়ে ফ্যালে। এক সময় দুর্গামোহন নয়নতারাকে নির্জনে ডেকে বলেছিল, ‘এর কৈফিয়ত চাই, নয়ন। তুই আমার ইজ্জত খুইয়ে দিয়েছিস। তোকে আমি খুন করব। আর তার আগে ওই বাচ্চাটাকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলব।’

নয়নতারা জবাব দিতে পারেনি। সে বিভ্রান্তভাবে বসে ছিল চুপচাপ।

সত্যি সত্যি ছুরি বের করেছিল দুর্গামোহন। ‘সেই এতটুকু থেকে তোকে মানুষ করেছি। নাচগান শিখিয়েছি। তুই এমনি করে বার বার আমার ইজ্জত খোয়াবি কেন?’

তুষ্টুরাম বিস্মিত হয়েছিল। বাঘের আক্রমণ ব্যাপারটা তাহলে আজ নেহাতই উপলক্ষ্য, নয়নতারা এমনি কাণ্ড আরও অনেকবার করেছে!

‘সেবারে রতনের সঙ্গে রাতারাতি উধাও হয়েছিলি। স্টেশন থেকে ফিরিয়ে আনলাম। তোর ইচ্ছামতো বিয়েও দিলাম ওর সঙ্গে।….’

দুর্গামোহনের ছড়িটা আলোয় সঞ্চালিত হচ্ছিল। তুষ্টুরাম জানতে পেরেছিল নয়নতারার আগের স্বামী রতন—এ দলেরই একজন খেলোয়াড়। তার ছেলে ওই ডিব্বু। ডিব্বুর জন্মের আগেই রতন মারা যায়। সে মৃত্যুর কারণ তখনও জানত না তুষ্টুরাম। দুর্গামোহন ছুরি নিয়ে আর একটু অগ্রসর হতেই সে মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। ‘মালিক, আমাদের বাপ মা বলতে আপনিই। অবলা মেয়েমানুষ। পদে পদে দোষ করবে। নিজগুণে মাফ করুন স্যার।’

‘সরে যাও তুষ্টুরাম—খুনখারাপি আমার অনেক ধাতসওয়া। পুলিশে আমার একগাছা লোমও ছিঁড়তে পারবে না। ও মাগির রক্ত না দেখে আমার খিদে—তেষ্টা বারণ।….’

প্রচুর মদ গিলেছিল দুর্গামোহন। সে টলছিল। অশ্লীল খিস্তি করছিল নয়নতারার মায়ের নাম ধরে। মনোমোহিনী বাঈজীর নামে। সে মরে গেলে তার মেয়েকে সে কোলে তুলে নেয়। মেয়ের মতো লালন—পালন করে। তার প্রতিদান এমনিভাবে নয়নতারা দিয়ে যাচ্ছে।

নয়নতারার পাথরের মুখে কোনো বিকার ছিল না। ফ্যাল—ফ্যাল করে তাকিয়েছিল সে।

হঠাৎ তুষ্টুরামের হাত ধরে। ‘তুষ্টু, হারামজাদির ব্যাপারটা আমি বোধহয় ধরে ফেলেছি রে।’

তুষ্টু অবাক হয়নি প্রথমে। মাতাল হলে দুর্গামোহন অনেক অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে থাকে।

‘দ্যাখ তুষ্টু, ও আমার কথা আর মানবে না। ও ভালো জেনে নিয়েছে আমার মুরোদ কতখানি।’

তুষ্টু হেসে ওঠে। ‘হুজুর মালিক, আপনার বুক যত চওড়া দিলও ততখানি।’

‘এমন একজন দরকার, যে ওকে উঠতে বসতে শাসন করবে।’

‘তা কে পারে হুজুর?’

‘পারে, পারে।’ দুর্গামোহন হা হা করে হেসে উঠেছিল। মাতাল মানুষের মন। তাতে ওই দারুণ অপমান। টাকাপয়সা দিলেও লোকশান বড়ো কম নয়। সে বলেছিল, ‘আমার মতোই ছুঁড়ির মনটা কিছু নরম নরম আছে রে বাবা তুষ্টু। দ্যাখ না, কেমন বোবার মতো তাকাচ্ছে।’

‘তা ঠিক স্যার।’

‘ওকে একটা ভালোবাসার পুরুষ দিতে হবে।’

‘বাবু!’ চিৎকার করে উঠেছিল তুষ্টুরাম। ‘ও আপনার মেয়ের মতো। ওর ইজ্জতের দাম আছে।’

‘দাম!’ প্রচণ্ড অট্টহাসি হেসেছিল দুর্গামোহন। সে হাসি অবশ্যই ঘোর নিঃশব্দ। তার শরীর দুলছিল ঝড়—খাওয়া গাছের মতো। ‘রোজ রাতে ওর ইজ্জতের দাম আমি জুয়োর ছক থেকে কুড়িয়ে পকেটে পুরি।’

তুষ্টুরাম রাতের পর রাত এইসব অশ্লীলতা দেখেছে। নাচ—গান দেহভঙ্গি, জুয়ার ছক, মদ্যপান, লালসার ক্লেদ পুঞ্জ পুঞ্জ জমে উঠতে দেখেছে নয়নতারার জীবনে। তবু সে দুঃখ পাচ্ছিল। মেয়েমানুষের জীবন নিয়ে পাশাখেলার এই কুৎসিত পরিহাস সে মনে মনে কোনো সময় সইতে পারছিল না। দুর্গামোহন এক সময় স্খলিত পায়ে শয্যায় গড়িয়ে পড়েছিল। তখন নয়নতারাকে প্রশ্ন করেছিল তুষ্টুরাম। ‘তুমি কি বাঘটাকে ভয় করছ নয়ন?’

নয়নতারা জবাব দেয়নি।

‘আমি যতদিন আছি, তোমার ছেলের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ওসমান খাঁ। আমাকে বিশ্বাস করো।’

নয়নতারার চোখ থেকে এবার অশ্রুর ফোঁটা ঝরছিল নিঃশব্দে।

‘দুগগাবাবু তোমার বাপের মতো। মুখে যতই বলুক, সে তোমাকে মেয়ে বলেই জানে। তুমি দুঃখ করো না নয়ন।’

হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে ওর হাত চেপে ধরেছিল নয়নতারা। ফিসফিস করে বলেছিল, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে তুষ্টুদা।’

‘কেন নয়ন?’

‘তুমি আমাকে ভয়ংকর খেলায় নিয়ে গেলে। সারারাত ঘুমোতে পারি নে আমি। গা ছমছম করে। তুমি আমাকে বাঁচাও তুষ্টুদা, তোমার পায়ে পড়ি। ও খেলা আমি খেলতে পারব না।’

‘অবুঝ হয়ো না। এ ছাড়া উপায় কি বলো তো?’

‘তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে চলো।’ নয়নতারা ফিসফিস করে বলেছিল অশ্রুজড়িত কণ্ঠে। ‘তুমি বাজাবে আমি নাচব। ডিব্বুকে লেখাপড়া শেখাব।…’

‘নয়ন!’ তুষ্টুরাম ক্লাউন পাথর হয়ে গিয়েছিল শুনতে শুনতে। তারপর সে অস্ফুটভাবে বলেছিল, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে পারবে?’

‘পারব।’

‘সেবার একজনকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলে। পারোনি। এবার কি পারবে?’

‘তুমি কি পুরুষ নও?’

নয়নতারার পাথরের চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল। ঠিক এমনি করেই হয়তো সে রতনকে প্ররোচিত করে থাকবে। তুষ্টুরামের মনে হচ্ছিল এ কথা। একটা সংশয়ে দ্বন্দ্বে সে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।

বলেছিল, ‘কিন্তু … আমাকে তুমি সইতে পারবে?’

‘এতদিন ধরে সইছি তো।’

তুষ্টুরাম জানে না, এ ভালোবাসা, না বিপন্ন নারীর চিৎকার। নাকি মজ্জমান মানুষের তৃণখণ্ডের অবলম্বন। জীবনে বহু নারী সে দেখেছে। তাদের সঙ্গে কাটিয়েছে। বৈধ সম্বন্ধের সুযোগ কোনোদিনই অবশ্য ঘটেনি। ইচ্ছাও ছিল না। তার ভালো লেগেছে শুধু এই ভ্রাম্যমাণ জীবনযাত্রা, দেশ থেকে দেশে, জনতার সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে। জনতার মুখ না দেখলে তার অস্থিরতা ঘোচে না। জনতার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট চিহ্নটি খুঁজে পায় নিজ অস্তিত্বের। তার ইচ্ছে করে জনতার মুখ, কোলাহল, উত্তেজনা হাসি, নৈঃশব্দ্য উৎকণ্ঠা চুমুকে চুমুকে পান করে নেয়। সে জনতারই পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আবার তাদের উত্তেজিত করতে চায়, নিঃশব্দ করতে চায়, হাসায়, উৎকণ্ঠায় অধীর করে… নানা রূপ দিতে ভালোবাসে। এই তার জীবনে পরম মূল্যবোধ। জনতা তাকে গ্রাহ্য না করলে সে অর্থহীন।

নারীর অস্তিত্ব, নারীর প্রেম তার কাছে নিতান্ত আহার নিদ্রা শ্বাস—প্রশ্বাস গ্রহণের মতো জৈব প্রয়োজন।

নয়নতারার মুখের দিকে নির্নিমেষে চেয়েছিল তুষ্টুরাম ক্লাউন। এক অপরিচিত ভাবে আপ্লুত হচ্ছিল সে। একটা আকস্মিক কিছু নতুন বস্তু উপহৃত হয়েছে তার সম্মুখে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাতের মুঠোয় অলৌকিক পেলে যেমন বিভ্রান্ত হতে পারে মানুষ, তুষ্টুরাম তেমনি বিভ্রান্ত। তারপর গভীর সংশয়ে ও উৎকণ্ঠায় ঈষৎ ঝুঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে নয়ন?’ নয়নতারা তার দুহাতে মুখ রেখেছিল। হাত ভিজে যাচ্ছিল তুষ্টুরাম সঙদারের। পাথরের প্রতিমা বলে যাকে জেনেছে এতদিন, ধরাছোঁয়ার বাইরে এক ইষ্টদেবীর মতো সুদূর ও সুন্দর, তার হৃদয় হাতে গলে গলে পড়ছে।

তুষ্টুরাম বলেছিল, ‘বেশ তাই হবে। তোমাকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে।’

এবং তখনই বাঘটা ভয়ংকর গর্জন করে উঠেছিল খাঁচার ভেতর। নিশীথ রাত্রির অন্ধকারে তার প্রচণ্ড গর্জন সারা শূন্য তাঁবুকে তোলপাড় করেছিল। দুর্গামোহনও উঠে বসেছিল লাফিয়ে। তারপর বলেছিল, ‘তুষ্টুরাম!’

‘স্যার!’

‘তোদের কথা সবই শুনেছি।’ অভ্যাসমতো নিঃশব্দে হাসছিল দুর্গামোহন।