।।চোদ্দ।।
ভোর হয়ে এসেছে। আকাশ পাখির ডিমের মতো চিত্রিত নীলে লালে। পূর্বের দিগন্তে উজ্জ্বল নক্ষত্রটা ক্রমে অপসৃত হচ্ছে গভীর দুর্গমতায়। আমবাগানের ভেতর তখনও কিছু আঁধার জমে রয়েছে।
তিনটি ট্রাক তৈরি রয়েছে শূন্য মাঠের ওপর। ইতস্তত টুকরো কিছু আবর্জনা পড়ে থাকল শুধু। তাদের মধ্যে কোনো চিহ্ন খুঁজে মিলবে না এই তাঁবুর জগতের—খুঁজে পাওয়া যাবে না আমাদের অদ্ভুত ধরনের নীতিজ্ঞানটুকুও—যা নয়নতারা নামক একটি বাঈজি যুবতীকে অন্য এক পতন থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল।
তারপর কী হবে? আমি কী করব এবার?
খুঁজছিলাম চাপাটিকে। নয়নের জন্যে আর ভাবছিলাম না। আজ রাতে কিছুক্ষণের জন্যে সে বিদ্রোহ করেছিল—পরের কোনো রাতে এ—বিদ্রোহ হয়তো তার নিজের কাছেও অর্থহীন মনে হবে।
একসময় দেখলাম গুটিয়ে রাখা তাঁবুর বান্ডিলের এককোণে—ট্রাকের ওপর সে হেলান দিয়ে বসে আছে। কতকটা গর্তে লুকিয়ে থাকা খরগোশের বাচ্চার মতো দেখাচ্ছে তাকে। এগিয়ে গিয়ে ডাকলাম—’চাপাটি!’
চাপাটি ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করল। বুঝলাম সে দল ছাড়তে রাজি নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁবুর জগতের সঙ্গে সে শেষ অব্দি পৌঁছতে চায়। সে যেন ওটার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। দুর্গামোহন তাকে লাথি মারবে—সে ক্ষমা চাইবে—কাঁদবে—পায়ে লুটিয়ে পড়বে।
রাগে দুঃখে গা জ্বালা করছিল। সরে এলাম নিঃশব্দে।
ট্রাকগুলি স্টার্ট দিল। সুমুখের ট্রাকে ড্রাইভারের সিটের পাশে নয়নকে দেখলাম বসে থাকতে—তার পাশে ডিব্বু। সেই ট্রাকটার চাকা গড়াতে থাকল। আমার বুকের উপর দিয়ে তার যাত্রা—বুক ভেঙে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়।
পরের দুটি ট্রাকও তাকে অনুসরণ করল। দুর্গামোহনকে দেখতে পেলাম না কোনোটাতে। অথচ খানিক আগে তাকে দেখেছি।
বিস্ময় ছিল না—সে—মুহূর্তে নয়নের নির্বিকার প্রস্থান আমাকে অসহায় ক্রোধে আড়ষ্ট করে রেখেছে। ঘৃণা ও অভিমান আমাকে চূর্ণ করে দিচ্ছে।
আস্তে—আস্তে কখন আমি এক বিচিত্র অনুভূতির জগতে পৌঁছে গেলাম তারপর।
কিংবা কোনো অনুভূতি নয়—এ এক বোধশূন্যতা। শূন্য পোড়া মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে দূরের পথে একটা অলৌকিকের নিষ্ক্রমণ দেখতে দেখতে প্রচণ্ড বিস্মৃতি আমাকে ঘিরে ধরছিল। স্বপ্ন নয়—জাগরণ নয়—স্থির নিশ্চল পুতুল হয়ে গেছি। আমার চারপাশে সুগভীর শূন্যতায় স্পষ্টতম হয়ে আছে তা। স্বচ্ছ হয়ে ওঠা অন্ধকারে তাকে প্রত্যক্ষ করছি।
তারপর কখন হাঁটতে শুরু করেছি। আমবাগান বাঁ পাশে রেখে পথের ওপর পা ফেলেছি। চড়াইয়ের পথ। দু—পাশে বৈঁচি আর শেয়ারকুলের জঙ্গল। একটা বাঁক পেরিয়ে যেতেই পেছনে ডাক শুনলাম—’নন্দ!’ ফিরে দেখে পলকে সারা শরীর ঝনঝন করে বেজে উঠল। সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে উঠে ওই ডাককে গ্রহণ করছিল। গভীর ঘুমের পর—কেননা পূর্বের সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম—পরিচিত প্রিয়জনের মুখ দেখার সুখ আমাকে নাড়া দিল।
দুর্গামোহন এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল—’নন্দ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম ভাই।’ দেবতার মতো রাজার মতো দুর্গামোহন আমাকে আকর্ষণ করল। জুয়াড়ি, পাপী, সমাজের ঘৃণ্যতম জীবস্বরূপ ওই নীচমনা মাতাল দুর্গামোহন হঠাৎ অনন্ত সর্বগ্রাসী শূন্যতার মধ্যে থেকে বেরিয়ে যেন ঈশ্বরের মতো বলল—’আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম নন্দ।’
মল্লারপুরে দুর্গামোহনের দালানবাড়ির একটি ঘরে ফের রাত নামল। সে ঘরে সারাদিনের পর এতক্ষণে নয়নতারা এসে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। —’কী গো, রাগ পড়ল?’
বিস্ময়ের কিছু বাকি নেই? ব্যঙ্গ আমার দাঁতে শিরশির করে কাঁপছিল। লোভী কুকুরের মতো তার পেছন পেছন চলে এসেছি—হয়তো এমনি করেই সে ব্যাপারটা ভাবছে—তাই জবাব দিলাম না কথার।
ঘরটা বেশ প্রশস্ত। কোণের দিকে একটা মস্ত খাট। আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। একটা আলনা আর সিন্দুক একপাশে—অন্য পাশে দেয়ালে বিরাট ড্রেসিং টেবিল। বেঞ্চের ওপর ঝালর দেওয়া কাপড়ে ঢাকা গুটিকয় বাক্স। তবলা বাঁয়া—তানপুরা—হারমোনিয়ামও দেখতে পাচ্ছিলাম মেঝেয় পড়ে থাকতে। এই বুঝি নয়নের ঘর। কখন সে কিছুটা গোছগাছ করে ফেলেছে।
পৌঁছনোর পরই ঘুরে ফিরে দুর্গামোহনের দালানবাড়িটা দেখে ফেলেছি। বেশ কয়েক বিঘে জমির ওপর নতুন বাড়ি করেছে সে। পুবদিকে খোলা পাঁচিলে ঘেরা জমিতে অনাদরে লাগানো কিছু ফুলগাছ—সারিবদ্ধ খোঁয়ার সদৃশ্য কয়েকটি টিনের ঘর পাঁচিলের গা ঘেঁষে? শুনলাম জন্তুগুলির জন্য ওই ব্যবস্থা। মরশুমে মেলায় বেরিয়ে গেলে শূন্য বাড়িতে বাস করে এক দূর সম্পর্কের পিসি। বয়সে বৃদ্ধা। সে পেছনের একটা ঘরে থাকে। আর থাকে একজন পাহারাদার। লম্বা—চওড়া দানবের মতো দেহ—অনন্ত। অনন্ত আমাকে ছোটোবাবু বলে সেলাম করলে গর্বিতভাবে একটু হেসেছিলাম মাত্র।
দুর্গামোহন ওপরের ঘরে বিশ্রাম করছিল। সন্ধ্যার পরও বেরোয়নি আর। পার্টির অন্যান্য লোকজন তাদের নির্দিষ্ট ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। কেবল নয়নতারাকে দেখেছিলাম ছোটাছুটি করে বেড়াতে। ডিব্বু দুর্গামোহনের কাছে রয়েছে—সেখানেই সে থাকে মল্লারপুরে ফিরে এলে।
আমাকে কথা বলতে না দেখে নয়নতারা খাটে ধুপ করে বসল! ফের বলল—’রাগ বাকি থাকলে তাও পড়ে যাবে—একটু দেরি আছে। রান্না এখনো নামেনি তো!’ সে মৃদু—মৃদু হাসছিল।
তবু আমি কথা বললাম না! কিছু বলার ছিল না তাকে।
‘আমি জানতাম, তুমি আসবে।’ নয়ন ফের বলে উঠল।
জবাব না দিয়ে পারলাম না এবার। —’আসতাম না। দুর্গাদা নিয়ে এলেন।’
‘তুমি কি আমার ওপর রাগ করে আছ, নন্দ?’
‘কেন?’
নয়ন সে—কথার জবাব না দিয়ে বলল—’যদি রাগ করে থাক, ভুল করেছ। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলিনি সত্যি—কিন্তু সবসময় তোমার জন্যে ভেবেছি।’
‘কী ভেবেছ?’
‘বিশ্বাস কর—তুমি সত্যি—সত্যি চলে গেলে আমি ওসমান খাঁর মুখে মাথা ঢুকিয়ে দিতাম!’
‘বাজে বোলো না!’
‘বিশ্বাস করো, নন্দ! বাবু আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই….’
‘তার মানে—তোমার জন্যেই আমাকে ফিরিয়ে আনল দুর্গাদা?’
‘আমার বিশ্বাস তাই। তুমি না থাকলে উনি সত্যি হয়তো আমাকে বেশ্যাগিরির পথে ঠেলে দিতেন।’
এরপর আর অনেক কথা পরস্পর দু—জনে বলেছিলাম সে রাতে। অনেক হাস্যকর প্রলাপোক্তি—তার মধ্যে হয়তো সত্য ছিল—পরস্পরকে বোঝবার একটা করুণ প্রয়াস।
ক’দিন পরে।
দুর্গামোহন সেই যে তার ঘরে ঢুকে রইল—আর বেরোয়নি। দেখা করতে চেয়েছি—অনন্ত বলেছে, ‘বাবুর বারণ আছে।’ নয়নও অবাক হয়েছিল কিছুটা। ইতিমধ্যে একটা অদ্ভুত আড়ষ্টতা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আটপৌরে নয়ন—তার সারাদিনের ও রাতের সাধারণ জীবনযাপনে আমাকে খুশি করতে পারছিল না। কই, কোথায় সে নটী,—যার জন্যে আমার সব সাধ সব সাহস গর্ব ত্যাগ করে এ পথে পা বাড়িয়েছি? তুষ্টুরামের মতো জনতার মদ চুমুকে—চুমুকে পান করার ইচ্ছায় আমি অধীর ছিলাম। এই একটি সাধারণ মেয়ের সংসর্গ অসহ্য বোধ হচ্ছিল।
এবং নটী নয়নকে ফিরে পেতে চেয়ে সে দিন সন্ধ্যার পর আমার ঘরে গান বাজনার আসর বসিয়েছিলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নয়ন নাচছিল। অনন্ত তবলা বাজায় বেশ। জমে উঠেছিল আসর। হঠাৎ সেখানে দুর্গামোহন এল টলতে—টলতে। সে কিছুক্ষণ নিষ্পলক লাল চোখে আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করল। আমরা তার আকস্মিক আবির্ভাব থতোমতো খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের সব কিছু স্তব্ধ হয়ে উঠেছিল।
দুর্গামোহন জড়ানো গলায় ডাকল—’নন্দ’।
‘বলুন।’ আমি উঠে দাঁড়ালাম।
‘আমি চাই না এ—সব, বুঝেছ?’
চুপ করে থাকলাম।
‘আমার এ—সব ভালো লাগে না আর, নন্দ। নরকের দরজার আমি পৌঁছে গেছি। এ—পথে থাকলে তুমিও আমাকে আটকাতে পারবে না—হয়তো কখন তোমারই টুঁটি টিপে ধরব। এ বড়ো লোভের পথ…’
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
দুর্গামোহন বলল—’অনন্ত, এই যন্ত্রগুলো সব সিন্দুকে পুরে তালা এঁটে দে। কেউ যেন আর না খোলে।’
অনন্ত উঠে একে—একে সব যন্ত্র সিন্দুকে পুরতে থাকল। আমরা চিত্রার্পিতের ন্যায় দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। শেষে অন্তত নয়নের পায়ের ঘুঙুর খুলে নিতে হাত বাড়ালে নয়ন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
দুর্গামোহন গর্জে উঠল—’হারামজাদির চুলের মুঠি ধরে আছাড় মারব!’
আতঙ্কে ফ্যাল—ফ্যাল করে চেয়ে থাকল নয়নতারা! দুর্গামোহন আমার দিকে তাকিয়ে বলল—’নন্দ, আমি পার্টি ভেঙে দিলাম। জন্তুগুলোর খদ্দের আসবে কাল কলকাতা থেকে। আর আমার কিছু ভালো লাগে না। এতে কোনো সুখ নেই নন্দ, কোনো সুখ নেই…’ বলতে—বলতে সে হঠাৎ বেরিয়ে গেল তেমনি নাটকীয়ভাবে।
কী সুখ খুঁজেছিল জুয়াড়ি দুর্গামোহন? কী সে পেল না?
আর আমি?
রাতের শয্যায় নয়নতারা একপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না। সব খেলা শেষ হয়ে গেছে—আমরা এখন প্রকৃতভাবে ক্লান্ত। আমার পাশে খেলার পুতুল স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুর্গামোহনের জাদুদণ্ডের সৃষ্টি সেই নটী ফের শূন্য মিলিয়ে গেছে চিরকালের মতো।
ঠিক মধ্যরাতে আমি ফিস—ফিস করে ডাকলাম—’নয়ন!’ সে ঘুমোয়নি। পাশ ফিরে শুয়ে থেকেই বলল—’বলো।’
‘কিছু না।’ কী বলব তাকে?
‘নন্দ, তুমি এবার সত্যি—সত্যি চলে যাবে, তাই না?’
‘কেন নয়ন?’
‘তোমার ভালোবাসার মেয়েকে তো আর দেখতে পাবে না কোনোদিন।’ বলতে বলতে একটু হাসল সে—’নাকি ঝুমুর দল গড়ে আমাকে সঙ্গে নেবে?’
জবাব দিলাম না।
‘তবে কী করবে?’
‘জানি না।’
নয়ন হঠাৎ উঠে বসল। আমার পা জড়িয়ে ধরল সে। ‘নন্দ, দোহাই নন্দ, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না। আমিও আর কী নিয়ে থাকব নন্দ?’
ক’দিন পরে।
সে—রাতে নয়নকে যে—প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সকালের রোদ ফোটবার পরই তা যেন মাথার খুব ভিতর দিকে কোথাও একখণ্ড পাথরের মতন আটকে থাকা অস্পষ্ট যন্ত্রণায় স্পষ্ট হতে থাকল ক্রমান্বয়ে। সারাটি দিন বিহ্বল চিত্তে সেই বাগানবাড়ির ভিতর ঘুরে বেড়ালাম একা। ওদিকে নয়ন কী গরবে গরবিনী—ঘর্মাক্ত মুখে গোছাচ্ছে, ঝাড়পোঁছ করছে, বারবার অনন্তকে ডাকাডাকিতে ব্যস্ত করে তুলছে। আমি যখন উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে ওসমান খাঁর ক্লান্ত লুন্ঠিত শরীরের দিকে তাকিয়ে আছি, আমিনার ঘননীল চোখদুটিতে অবোধ মেয়ে হৃদয়ের নিঃশব্দ যন্ত্রণাকে প্রতিফলিত হতে দেখছি, কিংবা বুঢ়ুয়া সজারুর মুখ—ফিরিয়ে—থাকা স্তব্ধ কাঁটার পালকে নিষ্ফল বিষের অট্টহাসি শোনবার জন্যে কান পাতছি—তখনই অনন্ত এসে বলে যাচ্ছিল, ‘ও ছোটোবাবু শিগগির এসো, জলদি!’
‘কী অনন্ত?’
‘ঘরে পট খুলে বসে আছে ছোটোগিন্নি…’
ছোটোগিন্নি! অনন্তও এতদিনে নয়নের মতো সুখী হবার নির্বোধ ইচ্ছায় আপ্লুত। তাকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বলেছিলাম। সে না বললেও আমি জানতাম, নয়ন কী করছে। কিন্তু দুর্গামোহন? ঘাড় ফিরিয়ে দোতলার জানালায় তাকে একবার মাত্র দেখতে পেলাম। চোখের ভুল কিনা কে জানে, সে যেন আমার অগোচরে এতক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
মুহূর্তে গা—ছমছম করে উঠেছিল আমার। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ওসমান খাঁর প্রতিচ্ছবি যেন তার প্রকাণ্ড মুখমণ্ডলে। মনে হচ্ছিল—শেষ ভয়ংকর গর্জন, শেষ রক্তপাতের অবিচল প্রতীক্ষায় সে চুপিচুপি আমাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করছে। নয়নের কাছে সমর্পিত আমার প্রতিশ্রুতি আক্রমণভীত শশকের মতো ক্রমশ মাথার আরও গভীরে লুকিয়ে যেতে চাইল।
দুর্গামোহন কী চায়, আমি এখানে নয়নের সঙ্গে অবশিষ্ট জীবনের জন্যে ঘর বাঁধি। সত্যি তো! এ—সম্মতি তো তার কাছে হতে নেবার প্রয়োজন ছিল।
তখনই নয়নের কাছে কথাটা তোলার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ক—পা এগোতেই আচম্বিতে পিছনে ওসমান খাঁর প্রচণ্ড গর্জন—ফিরে দেখি, সে খাঁচার শিকের উপর মুখ ঘষছে। বড়ো—বড়ো হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। প্রকাণ্ড জিভ থেকে লালা ঝরছে।
পরক্ষণেই হাসি পেল। আমার প্রতিশ্রুতি, দুর্গামোহনের সম্মতি! এক উচ্ছিষ্ট বাঈজিমেয়ের শবদেহের পাশে শুয়ে জীবনকাল অতিবাহিত করবার জন্যে ওই দুটি বিচিত্র ঘটনাকে নির্ভর করে থাকা। এ ছাড়া কি আর কিছু থাকতে নেই—যা পৃথিবীর সকল সাধারণ মানুষ ও মানুষীর জন্য সহজ হয়ে আছে?
সত্যি বলতে কী, ত্রিলোচনের জন্যে—একমাত্র ত্রিলোচনের জন্যেই এক বিপুল ক্ষুধা আমাকে তখনই কাতর করে ফেলল। এ—মুহূর্তে যদি তার কাছে ফিরে যেতে পারি—সেই পরিত্যক্ত তক্তপোশে, অবাস্তব নারীমূর্তিদের জগতে, পাশে অতি কাছে ন্যাশনাল হাইওয়ে, পরিচিতি পৃথিবীর কোলাহলে!
নয়নের নতুন করে সাজানো ঘরে মমতার আশ্বাস, ভালোবাসার স্পর্শ, সকলই খুব হাস্যকর মনে হচ্ছিল। ঘরে সত্যি পট খুলে বসে ছিল ‘ছোটোগিন্নি’ নয়নতারা। নিতান্ত পট। এক পটের খেলা গুটিয়ে গেছে। দুর্গামোহনের ঝাঁপিতে তা লুকিয়ে পড়েছে। এবার আর—এক নতুন পাট, নতুন ছবি। সে—ছবিতে নয়নতারার মুখে অন্য রং ভিন্ন উজ্জ্বলতা।
ভালো লাগছিল। অথচ শুধু মনে হয়, এর কোথাও একটা কারচুপি আছে। গুরুতর ভ্রান্তি রয়েছে। সব উজ্জ্বলতা ও আশ্বাসে ভরা নতুন পৃথিবীটা ঠিক শূন্যে ভাসমান এই পৃথিবীর মতো প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে নয়। তার অবস্থানটা যেন স্বাভাবিক নয়। নীচের কেন্দ্রে একটা সূক্ষ্ম সূচিমুখ শলাকা তাকে ধারণ করে আছে। সে অন্যনির্ভর। এবং সে—শলাকার নাম, আমার প্রতিশ্রুতি। অতি সহজেই যা ভেঙে পড়তে পারে।
ওই ‘প্রতিশ্রুতি’ কাল হয়ে পথ আটকাচ্ছিল বারবার। আর, আমি রীতিমতো অভিনেতার আচরণে নয়নকে তুষ্ট রাখতে চাচ্ছিলাম।
বাগানের ওদিক থেকে তারপর প্রায়ই ঘনঘন ওসমান খাঁর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। ক্ষুব্ধভাবে বলেছিলাম—’ওকে থামিয়ে দেবার কি কেউ নেই?’
নয়ন বলেছিল—’কলকাতা থেকে শিগ্রি খদ্দের আসবে শুনেছি। বেচে ফেললেন বাবু।’ একটু চুপ করে থেকে সে ফের বলেছিল—’সত্যি, আমাকেও বড়ো অসহ্য লাগে। সব কথা মনে পড়ে যায়। সেই আমবাগান, তাঁবু, পাশাখেলা….উঃ মাগো!’
পরের রাত থেকে বাঘটার গর্জন আর তীব্র হয়ে উঠল। ঘুমোতে পারছিলাম না। নয়নও ঘুমের ঘোরে বারবার চমকে উঠছিল। আমাকে আঁকড়ে ধরছিল। বিরক্তভাবে উঠতেই সে জেগে গিয়েছিল। —’ও কী? কোথায় যাচ্ছ?’
‘বাইরে।’
‘কেন?’ নয়ন ধুড়মুড় করে উঠে বসল। তারপর আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। তার এই আচরণে কেমন একটা অশালীনতা ছিল যেন।
‘এমনি। ঘুম আসে না।’
নয়ন কিছুক্ষণ তেমনি দৃষ্টিতে আমাকে দেখে তারপর বলল—’তোমার কি এ—সব আর ভালো লাগছে না নন্দ?’
‘এ—কথা কেন?’
বাইরে বিষণ্ণ জ্যোৎস্না। ঠিক মধ্যরাত। বাতাসের বিহ্বলতা রাত আর জ্যোৎস্নাকে অনর্গল কি বিষাদব্যঞ্জক কাহিনী শোনাচ্ছে মনে হচ্ছিল। নয়ন মুখ নিচু করে বলল—’আমি জানি, তুমি সুখী নও। আমার কাছে পাবার মতো আর—কিছু নেই…’
তারপর যখন সে মুখ তুলল, দেখি চোখে জল। —’কিন্তু নন্দ, তুমি….তুমি তো আমার কাছে ফুরিয়ে যাওনি। দোহাই তোমাকে আর অমন করো না….লক্ষ্মীটি,’
এ—কণ্ঠস্বর খুবই অপরিচিত। এতে অনুনয় নেই কাতরতা নেই; আছে দাবি। এক প্রবল আহ্বানের বন্যা ধীরসঞ্চারিণী—পায়ের কাছে তার স্পর্শ। ওই বন্যায় ডুবে গেলে হয়তো বা আর কোনো দ্বিধা থাকবে না, দ্বন্দ্ব থাকবে না—’প্রতিশ্রুতি’র দায় মুহূর্তে কোথায় তলিয়ে যাবে চিরকালের মতো।
আবেগের বশে কী করে ফেলতাম জানি না। কিন্তু সেই মুহূর্তে ফের বাগানের ওদিকে ওসমান খাঁ গর্জন করে উঠল। এবারের গর্জনে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। দীর্ঘকাল সংসর্গে থাকার ফলে কিছুটা বুঝতে পারতাম তার গর্জনের অর্থ। নয়ন তো বেশি বুঝত। কেউ না বললেও আমরা অনুমান করেছিলাম, তাকে ক্রমশ অভুক্ত রাখা হচ্ছে। আশঙ্কা হত—দুর্গামোহন কি তাকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলবার চক্রান্ত করেছে? আমরা শিউরে উঠতাম। যেন দুর্গামোহন একটা দারুণ প্রায়শ্চিত্তে ব্যাপৃত। নিজের জীবনের খাঁচায় পোরা বাঘটাকে বুঝি এবার শায়েস্তা করার পালা তার।
গর্জন শুনেই বেরিয়ে এসেছিলাম দু’জনে।
বাইরে খোলা বারান্দায় কেষ্টা—রঘু—চাপাটিরাও এসে দাঁড়িয়েছিল। কেবল অনন্তকে দেখলাম পলকে বাগানের দিকে ছুটে গেল লাঠি হাতে নিয়ে।
ওসমান খাঁর গর্জন ক্রমশ থেমে আসছিল। একসময় সে নিশ্চুপ হয়ে গেলে ম্লান জ্যোৎস্নায় বাড়ির প্রাঙ্গণটা কেমন ভৌতিক আচ্ছন্নতায় থমথম করতে থাকল। বাতাস মন্দ হয়ে এল। চারপাশে শ্বাসরোধকারী একটা প্রচণ্ড চাপ—কী ঘটেছে কে জানে! নয়ন আমার একখানি হাত আঁকড়ে ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
অনন্ত এতক্ষণে ও—দিক থেকে চিৎকার করে উঠল—’ছোটোবাবু’, ছোটোবাবু! রঘু, কেষ্টা!’
সংবিৎ ফিরে পেলাম সকলে। ছুটে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। তারপর যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। নয়ন আর্তনাদ করে উঠল—’বাবু, বাবু, এ তুমি কী করলে?’
ওসমান খাঁ খাঁচার বাইরে এসে পিছনের হাঁটুদুটি ভর করে একটা মানুষের উপর ঝুঁকে রয়েছে। মানুষটা একটুও নড়ছে না। চুপ করে শুয়ে আছে। কেবল ওসমান খাঁর বিরাট মাথাটা ঝাঁকুনি খাচ্ছে বার বার।
নয়ন না বলে উঠলে, ওই মানুষটা কে—আমি বুঝতে পারতাম না। বরং বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে নয়নকে দু’হাতে টেনে সরিয়ে এসেছিলেন—নতুবা সে ঝাঁপিয়ে পড়ত শিকারি বাঘটার ওপর।
চাপাটি বুক চাপড়ে চিৎকার করে উঠল—’বন্দুক, বন্দুক!’
জুয়াড়িদের রাজা ওস্তাদের ওস্তাদ দুর্গামোহন নিজেকে নিজের কাছে সমর্পণ করেছিল এমনি করে। এ—মহিমা পুণ্যের নয়। পুণ্যের যদি মহিমা থাকে, তাকে বড়াই করে দেখানোর মতো সম্পদ, পাপের নিশ্চিত আছে।
কিন্তু আজ এতদিন পরে মনে হয়, সেই পাপেরই সৃষ্টি ওই নয়ন—সে ভুল করে পুণ্যের দরজা চুপি—চুপি স্পর্শ করতে চেয়েছিল, আর তাই সে বিশ্বাসঘাতিনী। পাপও কোনো মহিমার জয়তিলক তার ললাটে এঁকে দেয়নি, পুণ্যও তাকে কোলে টেনে নিতে পারেনি। তার ও—কুল এ—কুল দু—কুল অবহেলায় গিয়েছিল।
অবশেষে একদিন জানোয়ারগুলিকে কলকাতা থেকে খদ্দের এসে নিয়ে গেল। শোকার্ত নয়ন দুর্গামোহনের দোতলা ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল সেদিন। আমি শূন্যমনে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আশ্চর্য, যে দুর্গামোহনের অস্তিত্ব আমার বা নয়নেরও সুমুখে অদৃশ্য বাধার মতো অবস্থান করছিল, সে চিরকালের জন্যে মুছে গেলে দেখছিলাম, আমরা সত্যি সত্যি যেন অনাথ হয়ে পড়েছি বিরাট পৃথিবীতে। মাথার ওপর পত্র—পল্লব—ছায়া বিস্তার করে একটা মহীরুহ ছিল, তা উন্মুল হয়ে গেলে অসীম নীল আকাশের শূন্যতা শুধু। শুধু মনে হয় এক ব্যাপক সর্বগ্রাস অন্তহীন ক্ষুধা নিয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
একসময় স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেন তা জানি না। বুঝি দূরে যাবার ব্যাকুলতা আমাকে টানছিল। তারপর ট্রেন এল। যাত্রীদের ভিড়েও কোলাহলে মুখর হয়ে উঠল প্ল্যাটফর্মটা।
অন্যমনস্কভাবে একটুখানি এগোতেই পিছনে কণ্ঠস্বর : ‘নন্দ!’
চমকে উঠেছিলাম। যেন দুর্গামোহন এসে ডাকছে পরিচিত কণ্ঠে। প্রেতলোক থেকে ফিরে আবার কি তার আদেশ কে জানে!
না। বাবা। এ কি চেহারা হয়েছে তাঁর? ষষ্টির ভারে ঝুঁকে পড়েছেন। কোটরগত চোখ থেকে চশমা ঝুলে পড়েছে। অস্থিসার শীর্ণ ক্লান্ত দেহ—জরা এসে ফিরে ধরেছে। ‘নন্দ, আমি আর অপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না বাবা?’
জানতাম। এ—সবই আমি জানতাম। এর জন্যই যেন প্রতীক্ষা ছিল দিনের পর দিন। স্খলিতকণ্ঠে ডাকলাম—’বাবা।’ নিজেকে সংবরণ করা দুঃসাধ্য ছিল।
ত্রিলোচনও সঙ্গে এসেছে। সামনে এসে বলল—’উঃ, কম খোঁজাটা না খুঁজেছি! এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চল দিকি বাপু। বুড়ো বাপের যে—হালখানা করেছ, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। …..যতসব মাগি নাচানো নেশায় জীবনটার একেবারে দিলে বারোটা বাজিয়ে।….’
চলতে চলতে বাবা মৃদুকণ্ঠে বললেন—’ওরা কেউ কিছু বলবে না তো?’
‘কারা?’
‘তোমার পার্টির সেই….’
ত্রিলোচন বলে উঠল—’নিকুচি করেছে। ওখানে আর যেতে দিচ্ছে কে? এখান থেকেই টিকিট কেটে সোজা চকবাজার একেবারে। মরুক না মাগি বুক চাপড়ে।’ বিকট উল্লাসে সে হাসতে থাকল।
শুধু বললাম—’ছিঃ ত্রিলোচন!’
একবারের জন্যও নয়নকে কথাটা বলে আসতে পারতাম—এ—সাহস তখন ছিল আমার মধ্যে। বাবাকে দেখে পুরোনো জীবনের সব শক্তি ফিরে এসেছিল মনে। কিন্তু ততক্ষণে বাবা এসে আমার হাত ধরেছেন। আমার হাত বাবার হাতে। ছেলেবেলায় সেই যে মেলায় একদিন তাঁবুর ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর বাবা খুঁজে পেয়ে বলেছিলাম—’শক্ত করে হাত ধরে থাকবি, যে ভিড়’…ঘরের পথে ফিরে আসছিলাম দু’জনে, তেমনি এই প্রত্যাবর্তন। তেমনি আশ্বস্ত, ঠিক তেমনি আনন্দিত ফেরা। তাঁবুর ভিতরে যা—সব দেখেছিলাম, বাঘের গর্জন, সাপিনীর দেহের দোলা, সজারুর ক্রুদ্ধ কাঁটাপালকের ধ্বনি আর নটীমেয়ের তনুহিল্লোলে ভ্রূ—ভঙ্গিতে নৃত্যে গীতে নূপুরের ঝংকারে জীবনের যে—অপরূপ আনন্দ—ছন্দ,—তাঁবুর বাইরে এসে যেমন তা মুছে যায়, মনে হয়, একটা অলৌকিক মায়াজগতে ছিলাম এতক্ষণ, এবং স্বপ্নভঙ্গের পর পর হতাশাময় মুহূর্তের মধ্যে স্পষ্ট পৃথিবীর উজ্জ্বলতায় ভিন্ন আলোর স্বাদ, তেমনি অনুভূতি আমার মনে।
তবু আজ দশ বছর পরে কোনো রাতে—স্তব্ধ নির্জন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। চমকে উঠি। কোথায় যেন আলোকিত শব্দ—মুখর মেলার প্রান্তে অন্ধকার আমবাগানে ওসমান খাঁ গর্জন করে উঠল এইমাত্র। এখনই যে শুনতে পেলাম পাশার গুটির শব্দের সঙ্গে মিশে নীলঘরের সেই নটীর পায়ে নূপুরের বিহ্বল ধ্বনিপুঞ্জ! বিষাদ আমাকে চুপিচুপি স্পর্শ করে।