নীল ঘরের নটী – ১৩

।।তেরো।।

‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ দারুণ বেগে স্খলিত হচ্ছে অন্ধকারের অন্য এক প্রান্তে—কী আছে সেখানে অপেক্ষা করে, হয়তো জুয়াড়ি দুর্গামোহনও জানে না।

তাই প্রতি রাতের আসরে তার মুখ হঠাৎ—হঠাৎ অমনি গম্ভীর হয়ে ওঠে। তবলার তাল কেটে যায়। নোটের মালা গলায় পরে নয়ন নাচতে নাচতে ভুরু কুঁচকে তাকায়।

নয়ন নির্বিকার। এবং তার এই নির্বিকারপনা আমাকে সাহস জোগাচ্ছিল। আস্তে আস্তে ক’দিনের মধ্যেই তার মুখোমুখি যথার্থ স্বামীর মর্যাদা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম। সেও তার আচরণে স্ত্রী—সুলভ চরিত্র বজায় রাখছিল। সে সকালে সুমুখে চায়ের কাপ হাতে ডাক দেয়—’কই গো ওঠো!’

অবিকল স্বামীর মতো আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বলি—’কটা বাজল?’

‘আটটা।’

‘ডিব্বু পড়তে বসেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে পাঠিয়ে দাও।’ সে চলে যেতে থাকলে ফের ডেকে বলি—’গেঞ্জিটা ময়লা হয়েছে’ যা গন্ধ ছুটেছে….’

‘কেচে দেবো খন।’

‘এখুনি দাও। খানিক পরে বেরোব।’

নয়নতারা ঝাঁঝালো স্বরে বলে—’কী আমার কাজের লোক হয়েছ! একদিনও তো বেরোতে দেখলাম না। বসে থেকে হাতে—পায়ে জং ধরে যায় না তোমার?’

‘আজ ঠিকই বেরোব। সকাল সকাল রান্না করে রাখো।’

‘কোথায় যাবে শুনি?’

‘থানায়। দুর্গাদা রাতে বলছিলেন যেতে।’

নয়ন ফিরে আসে কাছে। ‘দেখো বাপু ওঁদের সঙ্গে কোনো কথা—কাটাকাটি কোরো না কিন্তু। যা বলবে মেনে নিয়ো।’ তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলে—’আর বাজার থেকে একটা লিপস্টিক এনো দিকি—পুরোনোটা ফেলে দিয়েছি।’

হেসে ফেলি। ‘এমনভাবে বলছ, যেন নতুন বউ—শাশুড়ি কানাচি পেতে শুনছে।’

নয়নও হাসে। জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে—’স্বর্গ থেকে শুনছেন বইকি।’

সে চলে গেলে অকারণে আমার চোখ ছাপিয়ে জল আসে। মা তুমি যেখানেই থাকো, আমাকে ক্ষমা কোরো, এবং তখনই হঠাৎ ধরা পড়ে যায় নিজ ভূমিকার আড়ালে এক বিদ্রোহীর সতর্ক পায়ের শব্দ। নন্দকে খুঁজি—সেই পুরোনো নন্দকে—অথচ ততক্ষণে দুর্গামোহন মোড়ায় বসে দাঁত ঘষতে ঘষতে ডেকেছে—’কই রে নন্দ, উঠেছিস? আজ একবার ওদিকে যাস ভাই—তুই শিক্ষিত মানুষ, সামলে নিতে পারবি….’

থানার সঙ্গে একটু বিসংবাদ শুরু হয়েছিল।

এ—মেলায় আসবার আগে যথারীতি একটা চুক্তি হয়েছিল পরস্পর। রাত—পিছু পঞ্চাশ টাকা করে সেলামি। এ—ভাবেই দেওয়া হচ্ছিল বরাবর। তুষ্টুরামের মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে নাকি আমাদের আয় বেড়ে যাচ্ছে—থানাওয়ালাদের এই ধারণা। তার ফলে হঠাৎ বড়োবাবু বলে গিয়েছিলেন—’রেটটা ডবল করতে হবে।’

আয় বাড়ছিল নিঃসন্দেহে। দর্শকরা নয়নতারাকে টাকার মালা পরিয়ে দিচ্ছিল প্রতি রাতে। ভাগ্যের ঘরে বড়ো বড়ো দান ধরা হচ্ছিল। এলাকার তুখোড় লোকগুলি প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলে যেন। সারা রাত তারা ভাগ্যের ঘরে হা—হা করে হাসে, জড়ানো কণ্ঠে অশ্লীল গান গায়, নয়নকে জড়িয়ে ধরতে যায়—নয়ন খিলখিল করে হেসে পালিয়ে আসে। তাই ভাগ্যের ঘরে কালান্তক যমের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় রঘুবীর আর কেষ্টকে। আমি এতদিন ধরে টের পাইনি দুর্গামোহন তার দলে এই দুটি মারাত্মক লোক পুষছে। ভাবতাম অন্য লোকগুলির মতো এরাও বুঝি সাধারণ কুলিকামিন। হঠাৎ যেদিন টের পেলাম—এরা দুটি খুনে—স্বভাবের গুণ্ডা, চমক খেয়েছিলাম খুব।

নিরীহ আকৃতি—প্রকৃতির আড়াল তুলে রঘু আর কেষ্টা কোমরে ভোজালি ঝুলিয়ে দুটি লাঠি হাতে ভাগ্যের ঘরে দু—পাশে দাঁড়ালে দুর্গামোহনের ওপর আতঙ্ক বেড়ে গিয়েছিল আরও। কিন্তু তাতে কী? ওরা তো আমারও অনুগত—আমি ওদের ছোটোবাবু। দুর্গামোহন বলেছে—সে মরে গেলে নন্দ এই সবকিছুর মালিক হবে। একটা অদ্ভুত ভবিষ্যৎ আমার জন্য দুর্গামোহন তৈরি করে রেখেছে—ঠিক এ—কথাই আমার মনে হয়। সুতরাং একটা গর্ববোধও পাশাপাশি বেড়ে উঠছিল। মাথা উঁচু করে চলাফেরা করছিলাম।

শেষ অব্দি মেনে নিলাম থানাওয়ালাদের জেদটা। দুর্গামোহন শুধু বলল—’ঠিক আছে।’

নয়ন বলল—’পারবে তো জোগাতে শেষ অব্দি? এতগুলো লোক, জন্তু—জানোয়ার, মেলাওয়ালাদের ভাড়া রয়েছে ওদিকে…’

‘তুমি পারলে সবই পারা যায় নয়ন!’

‘বৃষ্টি—বাদলা হলে? সে—রাতে সেলামি দিতে হবে না তো?’

‘তা ছাড়বে না বলেছে। যতদিন এ—মেলায় আমরা আছি, ততদিন ওটা দিতেই হবে।’

নয়নের মুখ ঈষৎ রুগণ দেখাল। একটু পরে সে বলল—’তুমি খুব বোকা হয়ে গেছ গো!’

‘কেন?’ বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলাম।

‘বড়োবাবুর এ—জেদের কারণ বুঝতে পারোনি?’

‘না তো!’

‘তার মতলব ভালো না।’

আরও বিস্ময়ে অস্ফুট চিৎকার করে বললাম—’কী চায় সে? তোমাকে?’

নয়ন খিলখিল করে হেসে উঠল। —’শিকারি বেড়ালের গোঁফ দেখলে চেনা যায়। সে—রাতে আমি ঠিকই টের পেয়েছিলাম।’

‘দুর্গাদা জানেন এ—কথা?’

‘জানেন বইকি।’ নয়ন অপরূপ ভ্রূ—ভঙ্গি করল। ‘আমাকে বলেছিলেন….’

বাধা দিয়ে বললাম—’কী বলেছিলেন?’

‘বলবো না।’

ফের অস্ফুট চিৎকার করলাম—’বলতে হবে তোমাকে।’

‘যদি না বলি?’

ক্রোধে চুপ করে বসে থাকলাম। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।

‘ইস স্বামীগিরি ফলানো হচ্ছে!’ নয়ন আমাকে দু—হাতে জড়িয়ে ধরল। ‘বউকে বাঁচাও না এবার। দেখি কেমন বীরপুরুষ।’

একসময় চাপাস্বরে বললাম—’নয়ন, এর আগে কোনোদিন কি এমন ঘটেছিল?’

নয়ন চোখ নাচিয়ে বলল—’ও, বুঝেছি। স্ত্রীর সতীত্ব যাচাই হচ্ছে!’

‘যদি বলি, আর ও—পথে তোমাকে পা বাড়াতে দেব না?’

একটুখানি চুপ করে থেকে নয়ন বলল—’কোনোদিন এমন ঘটেনি। বাবু ওদিকে খুব কড়া। কিন্তু কিছুদিন থেকে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছেন—তুমি বিশ্বাস করো, আমি ভাবতে পারিনি—উনি এমন বললেন।’

‘তুমি নিশ্চয়ই মানবে না ‘ও—হুকুম?’

‘আমি মানা না—মানার কে? বাবুকে বলো ও—কথা।’ নয়ন হঠাৎ উঠে চলে গেল।

পেছনে পেছনে গিয়ে তার কাঁধ ধরে বললাম—’বাবুকে যা বলার আমি বলছি। কিন্তু আমি জানতে চাই—তুমি কেন এর প্রতিবাদ করবে না? তুমি কি জানোয়ারের মতো বশ মেনে থাকবে নয়ন?’

নয়ন পিছন ফিরে মুখ তুলে সোজাসুজি তাকাল আমার চোখের দিকে। বলল—’এ—কথা তোমার মুখে সাজে না।’

আস্তে আস্তে আমি সরে এলাম। নয়নতারা মিথ্যে বলেনি। আমিও তার মতো জানোয়ার—প্রতি রাতে তার শরীরের ওপর জানোয়ারের নিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকি। তার নারীত্ব তার মর্যাদা আমিও কি দিতে পারছি? পতনের স্রোতে আমি ও নয়ন গা ভাসিয়ে দিয়েছি। তাকে ফিরতে বলার কী অধিকার আছে আমার?

কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল—নয়নতারা আমাকে ভালোবাসে না। আমি শুধু রাহুর মতো তাকে গ্রাস করে আছি।

এলোমেলো ভাবে সারা দুপুরে আমবাগানে একা হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। নারী, নটী ও ভালোবাসা—এই তিনটি শব্দ সেতারের তারে তিনটি স্তরের ধ্বনি হয়ে বাজছিল। আমি নারী চাই, নটীকেও চাই—তাদের ভালোবাসাও আকাঙ্ক্ষা করি। পৃথিবীতে আমার মতো উন্মাদ ভিখারি কেউ আছে কি? আমবাগানের ছায়ায় পাখি ডাকছিল। মাঠে প্রজাপতি ও ঘাসফড়িঙেরা উড়ে বেড়াচ্ছিল। দূরের গ্রাম, নদী, তালবন, নগ্ন মাঠ, নির্জন ভ্রাম্যমাণ মানুষ—সবকিছুর জগতে আমি কেবল একটা অর্থ খুঁজছিলাম। ভালোবাসার অর্থ। কী এই ভালোবাসা? বিড়বিড় করে উঠেছিলাম—ভালোবাসা কী? কেন তার আক্রমণ আমাকে এক চোরাবালিতে নিক্ষিপ্ত করল? আমি কি তাকে চেয়েছিলাম কোনোদিন? ত্রিলোচনের ঘরে, আমার অতীত জীবনের কোথাও কোনো নারীর দিকে ভালোবাসা প্রার্থনা করেছিলাম কি?

কোনো নজির নেই। অথচ আজ আমি আক্রান্ত।

রাতের আসরে নয়নতারার দিকে তাকালাম। গান গাইতে গাইতে দেখলাম তাকে। আমার গানের সৃষ্টির মতো—আমারই কণ্ঠস্বরের প্রতিমূর্তির ন্যায়, ইতস্তত সঞ্চালিতা নটী নয়ন পলকে—পলকে ভালোবাসাকেই প্রকাশ করতে ব্যগ্র। ওই তো সে—যা আমি চাই।

প্রতিটি দিনের মোহভঙ্গ, প্রতিটি রাতে সে—মোহের পুনর্জন্মলাভ—এই কঠিন অসহায় যন্ত্রণা আমাকে কাতর করে তুলছিল ক্রমে ক্রমে।

সে—রাতে নয়নতারার উদ্দেশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দুর্গামোহন—’মেয়েটা বুঝি সব খুইয়ে বসল, নন্দ!’ সব খোয়ানোটা কী তা হলে? এইটে আমাকে অবাক করে। বাকি কিছু ছিল নয়নের? দুর্গামোহনই কি তাকে বারবার খোয়ানোর পথে ঠেলে দিচ্ছে না?

দুর্গামোহনের ওপর অব্যক্ত যে—ক্রোধ আমার মধ্যে দানা বেঁধেছিল—হঠাৎ সুযোগ পেয়ে তা আত্মপ্রকাশ করল এতদিনে।

কাল—বোশেখির দিন এখন। বিকেলে দারুণ ঝড়বৃষ্টি শিলাপা শুরু হয়েছিল। তাঁবুর ভেতর ভয়ে কাঠ হয়ে বসেছিলাম আমরা। ভাগ্যের ঘর উড়ে যাবার আবেগ নিয়ে থরথর করে কাঁপছিল। দুর্গামোহন সেই ঝড়ের মধ্যে ভাগ্যের ঘরে বসে মদ খাচ্ছিল অভ্যাসমতো। ত্রিপলের পুরু ছাদ সরে যাচ্ছিল বারবার। উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম সব। নয়ন বলছিল—’এমন অনেক ঝড় গেছে অনেক মেলায়। কোনোদিন উড়ে যায়নি তাঁবু। উড়ে গেলে কিন্তু বেশ হয়, না?’

মুখ টিপে হাসছিল সে। বলেছিলাম—’মরে যাবে সব—বাঁচতে তো পারবে না!’

‘সেও ভালো। তুমি আমি একসঙ্গে জড়াজড়ি করে মরে থাকব!’

পরিহাস ভালো লাগার মতো পরিবেশ নয়। বলেছিলাম,—’আজ শো বন্ধ নির্ঘাৎ।’

রাত একপ্রহর অবধি বৃষ্টি থামল না। সত্যি সত্যি শো বন্ধ রইল। দুর্গামোহন ভাগ্যের ঘর থেকে বেরোয়নি। যতবারই গেলাম, দেখলাম সে মদের গেলাস হাতে ছক পেতে বসে রয়েছে। মুখ তুলে শুধু বলেছে—’আয় রে নন্দ, দুহাত খেলি।’ কিন্তু খেলবার কোনো লক্ষণ তারপর তার দেখিনি। চলে এসেছি কিছুক্ষণ বসে থাকার পর। ঘাসে জল ছপছপ করছে রাত্রির অন্ধকারে। আমবাগানের পোকামাকড়ের একটানা ডাক। মেলাটা নিঃঝুম হয়ে গেছে একেবারে। কোথাও পর্দার ফাঁকে ক্ষীণ আলোর রেখা মুহূর্তে হাওয়ার দোলায় ঝিলিক দিচ্ছে। জনমানবহীন মেলাটা পোড়া দালানবাড়ির মতো ভৌতিক ও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আমার তাঁবুর দরজায় ফিরে ডেকেছিলাম—’নয়ন, ও নয়ন!’

কোনো সাড়া না পেয়ে দুর্গামোহনের তাঁবুতে—আগে যেখানে নয়নতারা থাকত—সেখানে গিয়ে সরাসরি পর্দা তুলে ঢুকলাম। পরমুহূর্তে আমার চোখের ওপর উজ্জ্বল টর্চের আলো—একটা চাপা গর্জন : ‘এই উল্লুক, ভাগ য়িহাসে, ভাগ….’

হতচকিতভাবে বেরিয়ে আসতেই রঘুর কণ্ঠস্বর। ‘কে ওখানে? ছোটোবাবু?’

এগিয়ে গিয়ে বললাম ‘ও—ঘরে কে রে রঘু?’

রঘু চাপাস্বরে বলল—’থানার বড়োবাবু। অনেকক্ষণ এসে বসে আছেন ও—ঘরে।’

উত্তেজিতভাবে বললাম—’নয়ন, নয়ন কোথায়?’

রঘু বলল—তাকেই তো খুঁজছি। গেল কোথায়? মালিকবাবুর কাছে যাচ্ছিলাম—হঠাৎ দেখি আপনি বেরিয়েছেন….’

বড়ো তাঁবুর ভেতর গিয়ে ডাকলাম—’নয়ন, নয়ন!’ আমার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। এক লাফে স্টেজে উঠে ফের ডাকলুম—’নয়ন’! কোনো সাড়া পেলাম না। ভাগ্যের ঘর থেকে দুর্গামোহন বলল—’কী হয়েছে নন্দ?’ জবাব না দিয়ে দ্রুত আমার তাঁবুতে ঢুকলাম। দেখলাম ডিব্বু একা বসে আছে। বললাম—’তোর মা কোথা রে?’

ডিব্বু বলল—’বেরিয়ে গেছে।’

‘কোথায়?’

‘তা জানিনে।’

সে তার বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ক্ষিপ্রহাতে টর্চটা বের করে আমবাগানে গেলাম। কাদায় পিছল হয়ে আছে মাটি। বারবার টর্চ জ্বালছিলাম। ডাকছিলাম—’নয়ন, নয়ন!’

বাগানের ও—প্রান্তে সেই দিঘি। ভাঙাঘাটের ওপর আলো পড়তেই চমকে উঠলাম। দেখলাম ভেজা শ্যাওলা—ধরা চত্বরে নয়ন বসে আছে একা। চুল খোঁপা খুলে উপচে পড়ছে পিঠে। ঈষৎ ঝুঁকে বসে আসে সে। কী করছে নয়নতারা?

টর্চের আলো পড়তেই মুখ ফেরাল একবার। ছুটে তার হাত ধরে টানলাম—’কী করছ এখানে?’

নয়ন হঠাৎ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিঃশব্দে সে কাঁদছিল ফুলে—ফুলে।

বললাম—’কেঁদো না। তোমার কোনো ভয় নেই নয়ন, আমি যতক্ষণ আছি…’

‘আমি বেশ্যা নই নন্দ!’

‘জানি।’

‘কোনোদিন বাবু আমাকে এমনি করে ঠেলে দেননি। আজ কেন এমন হলেন নন্দ?’

ঠিক এই কথাটা আমিও ভাবছিলাম।

ফিরে এসে সোজা ভাগ্যের ঘুরে ঢুকলাম। দুর্গামোহন মুখ তুলে বলল—’এসো নন্দ।’

‘আমি একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে।’

‘কী কথা বল তো?’ দুর্গামোহন পা ছড়িয়ে দিল ছকের ওপর। নীলাভ আলোয় তার চোখ জ্বলছিল।

‘নয়নকে দারোগাবাবুর কাছে যেতে বলেছেন কেন?’

‘কৈফিয়ত চাচ্ছ নন্দ?’

‘যদি বলি তা—ই?’

‘কী অধিকার তোমার?’ দুর্গামোহন অভ্যাসমতো দুলে—দুলে নিঃশব্দে হাসছিল।

‘আপনি দিয়েছেন সে—অধিকার।’

‘জানি, তুমি লেখাপড়া—জানা মানুষ—জানতাম, তুমি এটা মানতে চাইবে না।’

‘তবে কেন এ—হুকুম দিয়েছেন?’

‘কেন?’ দুর্গামোহন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ফের বলল—’যদি না বুঝে থাকো, বোঝাতেও আমি চাইনে। তবে হুকুম যা দিয়েছি—রদ হবে না।’

‘বাবা হয়ে মেয়ের দেহ নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন আপনি…’

বাধা দিয়ে দুর্গামোহন বলল—’আমি নেশা করেছি নন্দ, বেশি উত্ত্যক্ত কোরো না! এখন যাও।’

‘যেতে হলে একেবারেই চলে যাব।’

‘তাতে আমার কিছু যায়—আসে না নন্দ। তুমি রতন মাস্টার নও, তুষ্টুরামও নও—আমার কোনো ক্ষতি হবে না। তা ছাড়া—লোকের অভাব আমার কোনোদিনই হবে না। একটা যাবে—আর একটা আসবে…..’

‘বেশ তাই যাচ্ছি।’

বেরিয়ে নিজের তাঁবুতে এলাম। নয়ন বসেছিল মুখ নিচু করে। কিছু না বলে কাপড়চোপড় গোছাতে থাকলাম ব্যাগে। নয়ন মুখ তুলে দেখল মাত্র। কিছু বলল না।

আমবাগানের ভেতর দিয়ে পথটা চলে গেছে স্টেশনের দিকে। বাগানের অন্ধকারে পা বাড়ানোর মুহূর্তে পেছন ফিরে তাঁবুটা দেখবার সাধ হল মুহূর্তের জন্য। এবং সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালাম। আমার শরীরের কোষে কোষে আর্তনাদ বেজে উঠল। স্নায়ুতে মজ্জায় রক্তে মাংসে কান্না গলে গলে ঝরতে থাকল অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার ন্যায়। স্মৃতি আমার হাত ধরল ছায়ার আড়াল থেকে : সব ফেলে গেলে নন্দ, ভালোবাসা, সংগীত, কোলাহল, জনতার মুখ, আনন্দ—ফেলে চললে তোমার নটীকে—যার স্পর্শে তোমার জীবন অলৌকিককে অনুভব করেছে দিনের পর দিন!

এত নিঃস্ব, এত অসহায় নিজেকে কোনোদিন ভাবিনি! এরপর কি রইল আমার? ধু ধু শূন্যতার সীমানা মুখব্যাদান করে আছে সুমুখে—যেখানে সবই অর্থহীন। নয়ন যেখানে নেই, সেখানে কিছু নেই—কোনো অর্থ নেই!

সুমুখে সর্বগ্রাসী শূন্যতা—পেছনে আমার ভালোবাসা—দুর্যোগে পঙ্কিলতার ক্লেদে জীর্ণ—তবু ভালোবাসা—তবু জীবনের একটা প্রবল পূর্ণতার আলোড়ন—জনতার চিৎকারে, সংগীতে, তাঁবুর জগতে দিন—রাত্রি—যাপনের দয়াহীন অবসরে।

নয়নতারা এসে আমাকে ডাক দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাক। কিংবা অন্য কেউ—আমাকে একবার বলুক, ‘ফিরে এসো!’ আমার সারা জীবন দাসখত লিখে দিতে পারতাম তার পায়ে।

ছেলেমানুষের হৃদয়ের মতো আমার যুবকহৃদয় ভেঙে পড়ছিল। কাঁপতে—কাঁপতে বসে পড়েছিলাম কাদার ওপর। এ কী দুর্মর দুশ্ছেদ্য কঠিন মায়া—কী দারুণ অভিশাপ…..এ—বাঁধন যে রক্তে ওতপ্রোত হয়ে গেছে, কেমন করে ছিঁড়ে ফেলি! দু—হাতে মুখ ঢেকে সত্যই আমি কাঁদছিলাম—উদ্ধার প্রার্থনা করছিলাম ঈশ্বরের কাছে। মাথার চুল ছিঁড়ে বিড়বিড় করছিলাম—এ আমি কী করেছি, কী করছি? কেন এই তাঁবুর জগতে চলে এসেছিলাম নিষ্ফল মোহের বিভ্রমণে!

ভালোবাসা এত ভয়ংকর এত সর্বগ্রাসী আমি জানতাম না। উন্মত্তের মতো সে আমাকে চাবুক মারছিল।

কতক্ষণ এইভাবে বসেছিলাম জানি না, যখন উঠে দাঁড়ালাম—দেখলাম আমার তাঁবুর দরজায় একটা হ্যাসাগ হাতে দুর্গামোহন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ওই দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা আশ্চর্য স্বাভাবিকতা রয়েছে। আমি চলে যাবার পরও ওই তাঁবুর জগৎটা এই স্বাভাবিকতাকে নিটোল রাখবে। দুর্গামোহন নিজেই তো ওই তাঁবুর জগৎ। সে স্থির থাকলে তার সৃষ্টিও স্থির থাকবে। আমার না—থাকায় কোনো পরিবর্তন জাগবে না।

নয়নতারা একই নিষ্ঠায় অভ্যাসে আয়নার সুমুখে সাজতে বসবে। কপালের কাটা দাগ ঘিরে আলপনা আঁকবে অর্ধচন্দ্রাকৃতি। ডিব্বুও সকালে উঠে বলবে না—’নন্দমামা, চলো একটু বেড়িয়ে আসি।’ হয়তো সে চাপাটিকেই বেছে নেবে। এমনকি একদিন দুর্গামোহন ওই চাপাটিকেই নয়নতারার শয্যায় ঠেলে দেবে! স্বামী—স্ত্রীর খেলা শুরু হবে নতুন করে।

‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র জগৎ আমি ছাড়াও বেঁচে থাকবে—অব্যাহত গতিতে দিনযাপন করবে।

মেলা থেকে মেলায়, জনতা থেকে জনতায়—কোলাহলে—ধারাবাহিক তার যাত্রা।

অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। নিতান্ত মূল্যহীন আমি—হেলায় কুড়িয়ে নিয়ে হেলায় ফের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ পার্টি।

হঠাৎ দেখলাম—রঘু নয়নকে টেনে বের করছে তাঁবু থেকে। নয়নের কাতরোক্তি ও প্রতিবাদ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। কেষ্টও তার হাত ধরল এসে।

আমার মাথার ভেতর দিকে চাবুক পড়ল একবার। পলকে দ্রুত ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সুমুখে।

‘ছেড়ে দাও বলছি!’

দুর্গামোহন গর্জন করে উঠল, ‘সরে যাও নন্দ!’

রঘু ও কেষ্ট অবাক হয়েছিল আমার আচরণে। শুধু রঘু বলল—’আপনি সরে যান ছোটোবাবু!’

সেই মুহূর্তে পেছনে ওসমান খাঁর গর্জন। তার গলায় শেকলটা ধরে চাপাটির আবির্ভাব। দুর্গামোহন আঁতকে উঠে বলল ‘সর্বনাশ, ছোড়াটা মরবে দেখছি! যা, রেখে আয় ওটাকে….’

চাপাটিকে দেখে বিস্মিত হলাম। রাগে তার সারা শরীর ফুলছিল সাপের মতো। মরিয়া হয়ে সে বাঘটা বের করে এনেছে বুঝতে পারলাম। নয়নতারাকে সেও ভালোবাসে। হা ঈশ্বর! ওসমান সুমুখে এসে আড়মোড়া দিয়ে ফের গর্জন করল। রঘু ও কেষ্ট ভয়ে—ভয়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছে সঙ্গে—সঙ্গে। দুর্গামোহন চাপাটির দিকে নিঃশব্দ ক্রোধে তাকিয়ে আছে। নয়ন চাপাটির হাত থেকে শেকলটা নিয়ে বলল—’ঘরে চল ওসমান!’

দুর্গামোহনের তাঁবু থেকে বড়োবাবু এতক্ষণে বেরিয়ে এল, ‘কী ব্যাপার? এত গোলমাল কেন সব?’

রাগে ক্ষোভে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওদিকে নয়ন অদ্ভুত হেসে বলে উঠল—’জানোয়ার নিয়ে ঘর করি বড়োবাবু। দেখছেন না, কেমন পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। আপনার পিস্তল দিয়ে আগে মেরে ফেলুন দিকি একে….’ মুখে আঁচল চেপে খিলখিল করে হাসল সে।

তার হাসিতে গভীর কারুণ্য ছিল।

বড়োবাবু বেল্ট টাইট দিয়ে একটু হাসল মাত্র। তারপর হঠাৎ পেছন ফিরে মার্চের ভঙ্গিতে চলে গেল অন্ধকারের দিকে।

দুর্গামোহন এতক্ষণে মুখ খুলল—’তা হলে নন্দ, গেলে না?’

‘না।’

অভ্যাসমতো সে হাসল না। একটু একটু টলছিল—অথচ উত্তেজিত দেখাল না আর। শান্তকণ্ঠে বলল—’একটা বাজে ব্যাপার নিয়ে অনেক বেশি হইচই করা হল শুধু। পার্টি তো তুলে দিতেই হবে—না—হয় আজই দিলাম তুলে, কী বল নন্দ?’

ফের দৃঢ়স্বরে বললাম—’না’।

‘না!’ দুর্গামোহন এক পা এগিয়ে এল! ‘তুমি, না আমি পার্টির মালিক?’

‘যেই মালিক হোক, আমি বলছি পার্টি থাকবে। আমি চালাব পার্টি।’

‘তাই নাকি! কিন্তু নন্দ, বেশ্যাগিরি যার চোখে পাপ, জুয়াখেলা তার চোখে পাপ নয় কেন বল তো?’

এর জবাব দেবার মতো কিছু ছিল না। বললাম—’আপনি আমার গুরুজনের মতো। যদি অন্যায় বলে থাকি মাফ করবেন। কিন্তু দোহাই আপনার,—অন্তত নয়নকে আর ছকের গুটির মতো ব্যবহার করবেন না।’

‘নন্দ, ইচ্ছে করলে তোমাকে আর চাপাটিকে আমি হজম করতে পারতাম—কিন্তু…..’

‘কিন্তু কী?’

‘আর এমন করে দেশে দেশে যখন ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে নেই, তখন মিছিমিছি হাতে পাঁক মেখে লাভ কি? কে তুমি? কে ওই চাপাটি? পথের চেনা, পথেই চলে যাবে যে—যার দিকে।’

‘খুন করার ভয় দেখাচ্ছেন?’

সে—কথার জবাব না দিয়ে দুর্গামোহন রঘুকে বলল—’এখুনি তাঁবু গোটা—ভোরের ট্রেন ধরতে হবে।’

রঘু বলল—’তাঁবু যে ভিজে ভারী হয়ে গেছে!’

‘তা হোক। আমি ট্রাকের খোঁজে যাচ্ছি। তোকে সব ভার দিয়ে গেলাম।’ দুর্গামোহন টলতে টলতে চলে গেল।

একটু পরেই কয়েকটি হ্যাসাগ জ্বলে উঠল। লোকজন জেগে উঠল ঘুম থেকে। ব্যস্ততা শুরু হল মধ্যরাতের অন্ধকারে। আমি কী করব? চাপাটি?

এবং নয়ন?