নীল ঘরের নটী – ১১

।।এগারো।।

বুলু দত্ত আর হীরা উপলক্ষ্য মাত্র।

নয়ন আর রতন বুঝি পরস্পরের কাছে পৌঁছতে চেয়েই অন্য দু’টি মানুষকে অবলম্বন করছিল। কেবল এইটে নিজেদের কাছে স্পষ্ট হতে তখনও দেরি ছিল কিছুটা—এই যা ঝঞ্ঝাট।

চন্দনপুরের পাসের মেয়াদ ছিল একমাসের। তাতে এত বড় জমজমাট মেলা অন্য কোথাও বসে না। দুর্গামোহন রাতের পর রাত বুলু দত্তদের তিলে তিলে হজম করে যাচ্ছিল। তখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কি ওরা বুঝতে চাইবে? নেশা ব্রহ্মতালু ভেদ করে মগজে চড়ে গেছে একেবারে। আর এই তো হয় মানুষের পৃথিবীতে। ইষ্টদেবতাকে একসময় ভুলে—টুলে বিগ্রহকেই সর্বস্ব করে তোলে মানুষ। জুয়ার কবন্ধ শিলাদেবতার বেদিতে মাথা ঠুকে রক্তপাত করছিল বুলু দত্তরা। তারপর হঠাৎ একদিন হাবুল দত্ত হাজির। বুলু দত্তর বাবা।

চন্দনপুরে বুলু দত্তর কীর্তি—কলাপ কারও অজানা ছিল না ততদিনে। কিন্তু হাবুল দত্ত অন্য প্রকৃতির মানুষ। বাইরে মেশে কম। তার কানে কথাটা কে তুলেছিল কে জানে। সে এসেই সোজাসুজি বলে বসল—’তাঁবু গোটান মশাই, নইলে আমাকে হাত লাগাতে হবে।’

দুর্গামোহন অভিজ্ঞ লোক। সে ব্যাপারটা আঁচ করেছিল মুহূর্তেই। ‘আরে, কী সৌভাগ্য, মালিক মশাই স্বয়ং যে।’ সে হন্তদন্ত হয়ে চেঁচামেচি করছিল—’কই রে নয়নমণি, একবার আয়, খোদ কর্তাবাবু পায়ের ধুলো দিয়েছেন….’

হাবুল দত্ত কঠোরস্বরে বলেছিল—’ও সব রাখুন। কালকের মধ্যেই জায়গা খালি করা চাই—খোলাখুলি বলে গেলুম।’

দুর্গামোহন হাত জোড় করে বলল—’তা কী হয় স্যার, এই তো সবে এসেছি। আসর পাততেই মোটা খরচ হয়ে গেছে। তাঁবু গোটালে খাবো কী? মাইনে দেব কোত্থেকে এতগুলো লোকের। তাতে ওইসব জন্তু—জানোয়ার রয়েছে ডেলিই তাদের জন্য পঞ্চাশটি টাকা খরচ। আর আপনারও তো স্যার, কম হচ্ছে না—একগজ জায়গার দু’টি করে টাকা সেলামি!’

‘থামুন।’ গর্জে উঠেছিল হাবুল দত্ত। ‘অমন টাকায় আমি ইয়ে করি। দরকার নেই মশাই…..’

‘কেন অপরাধটা কী, তা তো বলবেন?’

এবার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে নয়নের দিকে আঙুল তুলে হাবুল দত্ত বলে উঠল—’ও—সব খানকিপনা এখানে চলবে না বুঝলেন? যত সব কচি কাঁচা ছেলেগুলোর মুণ্ডু খাবার জন্যে ফাঁদ পাতা! আমার অমন সচ্চরিত্র ছেলেটার সর্বনাশ করে ছাড়বেন, আর আমাকে তাই প্রশ্রয় দিতে হবে?’

জবাব দিল নয়ন এগিয়ে এসে। ‘খানকিদের ইজ্জতবেচা টাকা নিয়ে সিন্দুকে তুলছেন না দত্ত মশাই? ওই যে সার বেঁধে খানকিমহল বসিয়েছেন মেলা আলো করে—তখন ভাবেননি আপনার সচ্চরিত্র ছেলের মুণ্ডু ঘুরে যাবে! আগে ওদের উঠিয়ে দিন!’ নয়ন হাঁকছিল চোখ মুখ লাল করে।

হাবুল দত্ত আচমকা ঘা খেয়ে চুপ। সে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকল শুধু।

নয়ন বলতে লাগল—’মেলা কাকে বলে জানেন না বুঝি? চন্দনপুর বাজারেও তো মেলে এ সব—ওই মনোহারি তেলেভাজা পাঁপড়ভাজা পান—বিড়ি সিগারেট। খানকিরও কি অভাব আছে ঘরে—ঘরে? তবু এখানে আসে কেন মানুষ? কেন সাবান আলতা কেনে, কেনই বা ঠোঁট লাল করে পান খেয়ে যায় মেলায়? গেরস্থ খানকি ফেলে কুত্তি মাগিদের কোল ঘেঁষে বসে থাকে? আর—চন্দনপুরের কথা জানতে আমার বাকি নেই! জুয়ো মদ মেয়েমানুষের কটা আখড়া পাতা রয়েছে এখানে—তাও আমি জানি। ছেলের বিগড়ানো মুণ্ডু আর কতখানি বিগড়াতে পারি আমরা, নিজেই ভেবেচিন্তে বলুন দিকি?

নয়ন আরও কথা বলত—থামিয়ে দিল বুলু দত্ত স্বয়ং। এতক্ষণ সে নয়নের তাঁবুতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রতন ছিল যথারীতি হীরা ঝুমুরওয়ালির ওখানে। রতন আশেপাশে থাকলেও বুলু দত্ত থাকে। তবে তাঁবুর ভেতরে নয়নের বিছানায় গড়ায় না তখন—একপাশে ছোট্ট মোড়াটায় বসে বসে সিগ্রেট টানে আর গল্পসল্প করে।

বুলু বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল—’বাড়ি যান দিকি, আর সীন ক্রিয়েট করবেন না।’

হাবুল দত্ত বিস্ময়ে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে উঠল—’বুলু, তোকে আমি ত্যাজপুত্র করব!’

বুলু হেসে বলল—’ডোন্ট কেয়ার। ত্যাজ্যপুত্র তো হয়েই আছি—নতুন কী করবেন! এখনও ভালোমানুষের মতো চলে যান এখান থেকে।’

‘এ আমার জায়গা আমি এদের না তাড়িয়ে যাবো না।’

বুলু ইতিমধ্যে কয়েক পাত্র গিলেছে। তাতে চারপাশে লোকও জমে গেছে মজা দেখতে। সে হাঁকরে উঠল—’না গেলে আপনাকে বাধ্য করব যেতে!’

ক্রমশ পিতাপুত্রের কথা কাটাকাটির মাত্রা চরমের দিকে পৌঁছচ্ছিল! কেউ কম যায় না তো! পরস্পর দত্ত পরিবারের নানান খিস্তির ঝাঁপিও উদম করে দিচ্ছিল। জানা গেল—হাবুল দত্ত সৎভাইকে ঠকিয়ে কীভাবে এ জায়গাটার মালিক হয়েছে। এবং এতক্ষণ দুর্গামোহন চুপচাপ দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। নয়ন তার তাঁবুর দিকে সরে গিয়েছিল। লোকজনও জমেছিল চারপাশে। কিন্তু তারা সকলেই বিদেশি—মেলার দোকানদার বা খেলওয়ালা। ছাড়িয়ে দেবার চেয়ে মজা দেখতেই অভ্যস্ত তারা। একসময় রতন এসে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে। আর দেখা গেল হাবুল দত্তকে সে বিলক্ষণ চেনে। হাবুল দত্ত তাকে কম চেনে না। তার কথায় তখনই শাসাতে শাসাতে চলে গেল সে বাড়ির দিকে।

তবে কি হাবুল দত্তের কান ভারি করেছিল রতনই? বুলু পরে বলেছিল দুর্গামোহনকে—নয়নের সুমুখে। ওই মাস্টার লোকটি সুবিধে নয়—’ও আপনার সর্বনাশ করবে পাঞ্জাবিদা।’

দুর্গামোহন ঘাড় নেড়েছিল মাত্র। তাকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

সত্যি—সত্যি হাবুল দত্তের লোক এসে লিখিত নোটিশ দিয়ে গেল পরদিন। একদিনের মধ্যেই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে—নতুবা অন্য ব্যবস্থা করবে সে।

গুম হয়ে থাকল দুর্গামোহন।

নয়ন বলল—’মরুক গে, ঝামেলা করে লাভ নেই। চলো, অন্য খোঁজ নিয়ে সেখানে চলে যাই।’

দুর্গামোহন কথার জবাব দিল না।

নয়ন মুখ নিচু করে থেকে ফের বলল—’তাছাড়া আমারও শরীর ভালো যাচ্ছে না। জ্বরভাব হচ্ছে কিছুদিন থেকে—গা—বমি লাগে…’

দুর্গামোহন মুখ ফিরিয়ে একটু চমকে উঠল যেন। ‘ওষুধ খাস নে কেন? রতনকে বললেই পারিস।’

অনেকদিন ধরে গোপনে যে নিরুদ্ধ যন্ত্রণা জমে ছিল নয়নের মনের কোণে, ভীষণভাবে নাড়া খেয়েছিল সেই জায়গাটা। বাস্তবিক, এ তো মিথ্যা নয়—সংসারে দুর্গামোহন ছাড়া আর কোন মাটিতে তার অস্তিত্বের মূল আটকে রয়েছে? সে আর সংবরণ করতে পারেনি সে—যন্ত্রণাকে। যুক্ত করে দিয়েছিল মুহূর্তেই। ভেঙে পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। ‘কোন সর্বনেশে মানুষের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছিলে তুমি? কেন দিয়েছিলে? আমি তো বেশ ছিলাম। বাবু, দোহাই তোমার—পায়ে ধরে বলছি, ওর হাত থেকে বাঁচাও—আর পারিনে। আমি মরে যাবো বাবু গো!’

দুর্গামোহন বলেছিল—’কে জানে কার ভুল—তোর না আমার। কিন্তু আমার যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে রে নয়ন। কী করব, বল তো মা?’

রতন ঝুমুরের মেয়ে নিয়ে মেতে উঠেছে, দুর্গামোহন তা জানত। ইচ্ছে করলে সে হয়তো রতনকে নিবৃত্ত করতে পারত মুখের একটি হুকুমে। কিন্তু সব দেখেও না দেখার ভান করে কাটাচ্ছিল। নয়ন মুখ তুলে বলল—’তুমি যদি এখনই দল থেকে ওকে না তাড়াও, আমাকে বিষ খেতে হবে।’

‘বিষ!’ হেসে উঠল দুর্গামোহন। ‘বিষ কেন খাবি রে পাগলি? ওকে যদি ঘেন্নাই করিস, ও যা খুশি করুক, তোর কী?’

নয়ন ঝাঁঝালো স্বরে বলল—’কেন ও যা খুশি করবে? ও তোমার পার্টির লোক না?’

‘পার্টির লোক তো আরও রয়েছে। তারাও কি ওখানে মেতে ওঠে না? এটা এ লাইনে হবেই। আটকে কী লাভ!’

‘তাদের কারুর বউ নেই—তাদের সাজে। ওর সাজে না।’ উঠে যেতে যেতে নয়ন আরও বলেছিল মুখ ফিরিয়ে….’বাবু, ওই ছন্নছাড়া মাতালটাকে বলে দিও—ও ছেলের বাপ হতে চলেছে, ওর লজ্জা পাওয়া উচিত।’

দুর্গামোহন আগে সেটা অনুমান করেছিল। এবার সে হন্তদন্ত হয়ে উঠল—’বলিস কী রে নয়নমণি? অ্যাঁ?’ বলতে বলতে সে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি শুরু করল। ‘ওরে রঘু, ওরে কেষ্টা, চাপাটি…..’ শিশুর মতো সরল আনন্দে ছোটাছুটি করেছিল দুর্গামোহন।

নয়ন তার তাঁবুতে এসে শুয়ে পড়েছিল। বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে কাঁদছিল সে। সারা রাতের যত হাসির মূল্য এমনি করে কতবার না কান্না দিয়ে মিটিয়ে দিতে হয় তাকে! ভাগ্যিস, তার হাসি নিয়ে যেমন জুয়োর বাজি ধরে দুর্গামোহন, তার কান্না নিয়ে আজও ধরেনি। তাহলে কী থাকত নয়নের?

শো বন্ধ রাখার ইচ্ছে ছিল।

কিন্তু বুলু দত্ত এসে বলল—’নো, নেভার, শো চলবে। কোন শালার ক্ষমতা আছে, তুলিয়ে দ্যায় দেখি। থানার বড়োবাবুকে আমি ম্যানেজ করে এসেছি। একটু পরেই লালপাগড়ির ফুল ফুটবে মেলায়। বাবা তো তুচ্ছ—স্বয়ং যমকে আমি আজ খাতির করব না।’

দুর্গামোহন বলল—’কিন্তু নয়নের শরীর যে ভালো নেই।’

বুলু বলল—’সে কী! আজ যে আমার ক’জন বন্ধু আসবে লাক রুমে। সব এক একজন লাখোপতির বাচ্চা!’ বড্ড মুশকিল হয়ে গেল তা হলে—দুর্গামোহন মাথার পেছন চুলকোচ্ছিল হতাশভাবে।

‘মিস নয়নতারা কোথায়—দেখি আমি চেষ্টা করে।’

বুলু দত্ত ব্যস্তভাবে নয়নের তাঁবুতে এসেছিল। নয়ন চুপচাপ শুয়েছিল বিছানায়। তাকে দেখে হুড়মুড় করে উঠে বসল। ঈষৎ বিরক্তও হয়েছিল সে। সময় অসময় নেই, যখন তখন এসে এই লোকটা তাকে জ্বালাতন করে বড্ড। প্রশ্রয় পেয়ে একেবারে মাথায় উঠে গেছে। কড়া কথা বলবার জন্য তৈরি হচ্ছিল নয়ন।

বুবু দত্ত বলল—’কী ব্যাপার? আপনার নাকি শরীর খারাপ?’

নয়ন অস্ফুটকণ্ঠে ‘হুঁ’ বলল শুধু।

বুলু দত্তর কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। ব্যাগে হাত ভরে সে বলল—’ওষুধ এনেছি ক—বোতল। একেবারে খাস বিলিতি। একটুখানি পেটে পড়লেই—ব্যাস! বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখুন না স্বচক্ষে—দেশি নয় মাইরি—পড়ে দেখুন না, ইংরেজিতে লেখা রয়েছে….’

নয়ন কড়া কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলল ফিক করে। ‘বেশ তো। আপনি একাই মৌজ করুন। কালই আমরা চলে যাচ্ছি—মিছেমিছি যাবার সময় মায়া বাড়িয়ে আর কী লাভ?

মৌজ যথারীতি করাই থাকে বুলু দত্তর। সে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল—’না মিস নয়নতারা, আমি প্রাণ গেলেও আপনাদের যেতে দেব না। উঁ—হু—হু, ভাবতেও বুক কাঁপে—মেলা থাকবে, আপনি থাকবেন না’—বলতে বলতে ফোঁস ফোঁস করে দু’বার নাক ঝাড়ল সে। ‘শ্মশানে আমি বুক চাপড়াব, আর আপনি কোথায়….উঃ তার চেয়ে এই নিন বুক পেতে দিচ্ছি—ছুরি মারুন!’

নয়ন বলল—’কী করি, আপনার বাবা নোটিশ দিয়েছেন।’

‘বাবা’! বুলু দত্ত গর্জে উঠল। ‘ড্যাম, ইডিয়ট, রাস্কেল একটা। একট শয়তান। আপনি থেকে দেখে যান, কীভাবে ওকে শায়েস্তা করি আমি!’

ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র তাঁবুর চারপাশে জনতা মশার মতো ভনভন করছে। কী ব্যাপার, শো বন্ধ কেন? ব্যাপারটা জানাজানি হচ্ছিল ক্রমশ। হাবুল দত্ত তাড়িয়ে দিচ্ছে এদের। ক্রমশ রাত যত বাড়ছিল, জনতা ক্ষিপ্তভাবে হল্লা করছিল। দুর্গামোহন তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সব কথা খুলে বললে ওরা ফুলে উঠল—’হাবুল দত্তর বাপের সাধ্যি নেই, শো ভেঙে দেয়। আপনি আরম্ভ করুন পাঞ্জাবিদা, আমরা রইলাম!’

ওদিকে পুলিশও জুটে গেছে বুলু দত্তর ব্যবস্থামতো। শেষটা লোকে বাপ—ব্যাটার প্রতিযোগিতা টের পেয়ে আরও মেতে উঠল। ঢিল ছুঁড়ছিল তাঁবুতে। খিস্তি করছিল। আগুন জ্বালিয়ে দেবে বলে শাসাচ্ছিল।

দুর্গামোহন সব দেখে শুনে নয়নের কাছে এল। ‘উপায় নেই রে। নে, তাড়াতাড়ি সেজে ফ্যাল।’

নয়ন বিরসমুখে সাজতে বসেছিল।

কিন্তু রতন কোথায়?

খোঁজাখুঁজি করেও তার পাত্তা নেই। চাপাটি হীরাদের ওখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসে বলল—’বাজারের দিকে গেছে বিকেলে—আর ফেরেনি শুনলাম।’

‘হীরা আছে?’

তা আছে। স্টেজে ওঠবার সময় কান পাতল নয়ন। মেলার ঠিক মধ্যিখানে আসর বসিয়ে ঝুমুরওয়ালি কোন খানকি মেয়ে গান গাইছে—আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায়, আমারই আঙিনা দিয়া…।

হয়তো হীরা। রতন তাকে শিখিয়েছে গানটা? হয়তো তাই।

ঘৃণায় থুথু ফেলতে ফেলতে হারমোনিয়ামের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসল নয়ন। খাতা থেকে খুঁজে খুঁজে সেই পাতাটি বের করল। ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলে দিল। তারপর বলল—’বাবু, তোমার সেই গানের পর কলিটা মনে আছে—জামানা বদল গেয়া….?’

আছে। দুর্গামোহন গুনগুন করে উঠল। সময় বদলে যায়, হৃদয় কি বদলায়? হয়তো তাই। নইলে যে তুমি ছিলে সচদিল, তুমি এমন হলে কেন? ঈশ্বর, তোমার দুনিয়ায় ইনসান বদলে শয়তান হয়ে যায়; লেকিন—শয়তানকে কি তুমি ইনসান বানাতে পারো?

লখনৌয়ের কোনো ওস্তাদ তার মাকে এই গান শিখিয়ে দিয়েছিল। নয়নকে তার মা শিখিয়েছিল এই গান।

রতন নেই। বাঘের খেলা কে দেখাবে? দর্শকরা চিৎকার করছিল। অন্তত একেবারের জন্যেও বাঘটাকে স্টেজে আনা হোক। দেখলেই তারা খুশি। বাঘ কি তারা দ্যাখেনি? অনেক দেখেছে। কিন্তু রতন যখন বাঘটার গলার শিকল ধরে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে—নয়ন তার সুমুখে নাচে। সে বেশ রক্ত—চনমন করা নাচ। বনের জন্তু আবেগে হাঁকরে ওঠে তখন। রতন এইসব ব্যাখ্যা করলে দর্শকেরা উপভোগ না করে পারে না।

দুর্গামোহন আড়ষ্টভাবে ঘামছিল। সে জানে, জনতা বড়ো একগুঁয়ে। যেদিকে জেদ ধরবে, পূরণ করা চাই—ই। নইলে হুলুস্থুল বাধতে দেরি হবে না। অগত্যা চাপাটিকে তলব করছিল সে।

চাপাটিই খেতে দ্যায় বাঘটাকে। অবশ্য রতন কাছে—পাশে না থাকলে তার সে—সাধ্যি নেই। চাপাটি যখন শেকল ধরে টানছিল—ওসমান খাঁ বিরক্তভাবে গর্জন করছিল।

আসলে বাঘ দেখবার চেয়ে বাঘের গর্জনটাই উপভোগ্য বেশি।

টানতে—টানতে স্টেজে তাকে দাঁড় করিয়েছিল চাপাটি! রতনের মতো ইংরাজিতে বুকনি ঝাড়ার চেষ্টাও করছিল সে। মাস্টারি ঢং আনছিল তার চালচলনে। কিন্তু ওসমান খাঁ বড্ড বিরক্ত। যন্ত্রী ছাড়া যন্ত্রে হাত দিলে সুর তো বাজে না। যা বাজে, তা উৎকষ্ট শব্দ—বে—সুর। ঘনঘন গর্জন করছিল ওসমান খাঁ। চাপাটি তাকে ঠিকসে দাঁড়ানোর জন্যে তখন মরিয়াভাবে খোচাঁ—খুচি শুরু করেছে।

তার মানে চাপাটির সাহস বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। সে ওসমান খাঁর জারিজুরি টের পাচ্ছিল যেন। হুঁঃ, ভারি তো একটা বুড়ো জন্তু—তার আবার জাঁক।

দুর্গামোহন কী বলতে যাচ্ছিল ইশারায়। হয়তো বারণ করতে চেয়েছিল সে চাপাটিকে। কিন্তু নয়নও প্রায় মরিয়া হয়ে নাচ শুরু করেছে। যেন রতনকে ছাড়া তার—এটুকু দেখিয়ে দিতে জেদ বেড়েছে সে মুহূর্তে। সে গান গেয়ে উঠেছিল বাঘটার প্রতি বিলোল কটাক্ষ হেনে।

পরে চাপাটি বলেছিল সব খুলে। কিছুদিন থেকে রতন ওসমান খাঁকে নিয়মিত খেতে দিচ্ছিল না। চাপাটি প্রশ্ন করলে বলত—’অসুখে ভুগছে, এখন কিছুদিন এমনি চলবে।’ রোগা হয়ে যাচ্ছিল ওসমান। চাপাটি কাকেও বলে নি কথাটা। বলে কী হবে? জন্তুগুলি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছিল না আর। দুর্গামোহন তো কড়ি গুণেই খালাস—চোখেও দেখত না ওদের। রতন আছে, তারই জিম্মায় রয়েছে ওরা। দুর্গামোহন তার জুয়ো নিয়েই ব্যস্ত।

পরের কলিটা ফের জেনে নেবার জন্যে উইংসে দুর্গামোহনের কাছে ঝুঁকে এসেছিল নয়ন, আর তৎক্ষণাৎ ওসমান খাঁ প্রচণ্ড গর্জন করে লাফ দিয়েছিল। চাপাটির হাত থেকে শিকল খসে গিয়েছিল সঙ্গে—সঙ্গে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছিল ওসমানের—নয়ন উইংসের আড়ালে ঝুঁকে থাকার ফলে সে উইংসের ওপরই এসে পড়েছিল। মুহূর্তে একটা হট্টগোল হই—চই চারপাশে। দুর্গামোহন নয়নকে ক্ষিপ্রহাতে সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর পালিয়ে এসেছিল স্টেজ থেকে। সত্যি, জন্তুগুলিকে সে বড়ো ভয় করত।

আবার যখন ওসমান খাঁ লাফ দিতে যাচ্ছে স্টেজের সুমুখে—কোথা থেকে রতন হাজির। হয়তো আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল এতক্ষণ। সে চিৎকার করে ডেকেছিল—’ওসমান, ওসমান, ইউ ওল্ড ফুল!’

শিকল ধরতে গিয়েছিল সে—’স্টপ ইট, স্টপ ইট, আই সে…..’ এবং মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ক্রুদ্ধ ক্ষুধার্ত ওসমান খাঁ। এতদিনের সব ক্রোধ যেন সঙ্গে সঙ্গে ফেটে পড়ছিল তার। দারুণ গর্জন করে সে লাফিয়ে পড়েছিল রতনের ওপর। রতন সঙ্গে—সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠেছিল।

ওদিকে বুলু দত্তের ভীত কণ্ঠস্বর শোনা যচ্ছে বাইরে—’বন্দুক, বন্দুক!’

দুর্গামোহন বলে—’জন্তুর সঙ্গে ঘর করার ওই এক মজা। রাগগুলো বুঝে চলতে হয়। কখন কোনটায় কাঁপন লাগে।’

মেলা শূন্য বললেই চলে ততক্ষণে। দোকানে—দোকানে ঝাঁপ পড়ে গেছে। এদিকে বন্দুক নিয়ে পুলিশেরা তাঁবুর ভেতর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কে জানে এখন কোথায় লুকিয়ে আছে জন্তুটা—আচমকা লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে। বুলু দত্ত পালায়নি। তাদের পেছনে—পেছনে এসে উঁকি মারছিল তাঁবুর একটা ফুটো দিয়ে। সে ফিস—ফিস করে বলছিল—’আগুন ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

দুর্গামোহন ভাগ্যের ঘরে ঢুকে পাশার ছকের বাক্সটা নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। নয়নকে ছুটে যেতে দেখে সে চমকে উঠে বলল—’ওরে নয়ন কোথায় চললি!’

নয়ন রতনের আর্তনাদ শুনেছিল।

সে ছুটে গিয়ে দেখল—রতন পড়ে আছে ওসমান খাঁ থাবাটা চাটছে। মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। তারপর আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সাহস নিয়ে বাঘটার শিকল ধরেছিল সে। বনের বাঘ যদি আজীবন মানুষের খাঁচায় পোষ মেনে থাকে, হিংস্রতা অনেকখানি ক্ষয় পায় বইকি। না পেলে মানুষ তাকে নিয়ে খেলা দেখাত কেমন করে? বনের বাঘ আর ওসমান খাঁ ঠিক এক নয়। সে শুধু ক্ষুধার্ত ছিল। রতনের মাথার খানিক রক্ত চেটে খিদে শান্ত করছিল সে। আর নয়ন যখন তাকে টেনে খাঁচায় নিয়ে গেল সে ভেবে থাকবে, এবার খাবার দেওয়া হবে পেট পুরে। রক্তাক্ত থাবা চাটতে—চাটতে ওসমান খাঁ খাঁচায় ঢুকল। যে—মানুষটা সে মেরেছে, তার মাংসের জন্য তখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

অন্তত নয়নের আজ তাই মনে হয়। নাকি নটীরূপিণী নরনকে বহুদিন ধরে দেখে—দেখে ওই জানোয়ারটাও তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল? ভাবতে বেশ লাগে।

কিন্তু পরে আর—এক খেলোয়াড় একদিন নয়নকে বলেছিল—’বাঘটা আসলে রাগের বশেই থাবা মেরেছিল। বুড়ো বাঘের রকমই এমন। এই বাঘ, এই শান্তসুস্থ।’

কারণ যা—ই থাক—নয়ন আর ব্যাখ্যা করতে চায় কোনোদিন। ও তো একটা সুন্দর স্বপ্নের শেষটুকু—যা দুঃস্বপ্নেই দাঁড় করানো গোটাটা। শুধু একটা কথা বুঝতে পারে না সে। রতন বেছে—বেছে ওই তিনটি জানোয়ারকেই কেন এনেছিল দলে? একটা বুড়ো বাঘ, একটা সাপিনী, একটা ক্লাউনের মতো সজারু?

রতনের শিয়রে বসে সে বলেছিল—’তুমি তো জেনে গেলে না কিছু—কী তুমি রেখে গেলে আমার মধ্যে। জানলে কত খুশি হতে। ভাবতে, আমাকে শাস্তি দিয়ে যেতে পেরেছ। একটা রক্তের গিঁট বেঁধে আমাকে চিরজীবনের মতো তোমার বন্দিনী করে গেছ।’

নয়ন সিঁথির সিঁদুর মুছতে চায়নি। ‘আমি এয়োতি। কে বলে আমার স্বামী নেই! স্বামী যদি নেই, আমার জঠরে এ কার নড়াচড়া—এ কে ঘুমিয়ে আছে? একদিন সে বাইরে আসবে—বলবে আমি মিথ্যে না। তোমার মেয়েজন্ম পূর্ণ করতে আমি পৃথিবীতে এলাম।’

কাহিনী শেষ হল! নয়নতারা উত্তেজিত হয়েছিল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চোখ ছলছল করছিল। একটা সুদীর্ঘ গুপ্ত কাহিনী ফাঁস করে দিয়ে তারপরই গুম হয়ে গেল সে। অনেক সময় ধরে কথা বলল না। কিন্তু আমি শিউরে উঠেছিলাম। রতন মাস্টারের মৃত্যুর ঘটনা আমাকে দারুণ নাড়া দিয়েছিল। কী এই দুর্গামোহন? তার কোন আকৃতি বা প্রকৃতিটা সত্য? কিংবা তারও বিবেকবুদ্ধি রয়েছে একটা—যে গভীর পাপবোধে আচ্ছন্ন বলেই রতন মাস্টারের ছেলেকে বাঘের খাঁচার কাছে যেতে দেয় না।

আমার মনে প্রশ্ন জাগছিল বারবার। আমাকে দিয়ে আবার কী খেলার ষড়যন্ত্র রয়েছে তার—আমি একটুও জানি না।

দিঘির ঘাটে গুটিকয় স্নানার্থী নর—নারী ও শিশু ছিল। আমাদের দেখে ফিসফিস করে উঠল। নয়নতারা নিঃসঙ্কোচে জলে নামলে এক বৃদ্ধা ফিস করে হেসে উঠল। ‘সেই বাজি ঘরের মেয়েটি না? কাল তুমি বুঝি নাচছিলে?’ নয়নতারা সূর্যের দিকে জল কুলকুচো করে ছুঁড়ে মারছিল। কথা শুনে একটু মাথা দোলাল মাত্র।

‘ওম্মা, তুমি যে আবার এয়োতি দেখছি।’

নয়নতারা হাস্যকর ভাবে তার শাঁখাটা নাড়া দিল।

‘স্বামীও বুঝি দলের নোক?’

আমি নেমে গিয়ে নয়নতারার কাছাকাছি পৌঁছতেই সেই বৃদ্ধা হাসিমুখে দু—জনের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘বাঃ! বেশ মানিয়েছে।’

নয়নতারা কপট ভ্রূভঙ্গি করে উঠল, ছাই মানিয়েছে। ঠাকুমার যেন মাথা খারাপ হয়েছে। ছানি পড়া চোখে কিনা! এত কমবয়সি বর নিয়ে ঘর করার জ্বালা তো জানো না!’

হাসির ঝড় উঠল সঙ্গে সঙ্গে। বৃদ্ধা চলে যেতে—যেতে মন্তব্য করল, ‘বাবা, শহুরে মেয়ে, বাজার ফেরা। কথায় পারে কে!’

সেদিন সুযোগটুকু পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেছিলাম আমরা দু’জনে। একটা নাট্যামি আমাদের পেয়ে বসেছিল। জানতাম এর কোনোকিছু হয়তো সত্য না। যেন মেকি। মঞ্চের নাটিকার মতোই। তবু নিষ্ঠার সঙ্গে ভূমিকা দু’টির দায়িত্ব পালন করেছিলাম।

তারপর সন্ধ্যার আগে দুর্গামোহন ফিরে এল শহর থেকে। পাশের মেয়াদ আরও সপ্তাহটাক বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তুষ্টুরামকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ডিব্বু মায়ের কাছে শহরের গল্প শোনাচ্ছিল। আমি তাঁবুর সর্বত্র দেখাশুনা করছিলাম—যাতে সন্ধ্যার পর শো দেওয়া যায়। কিছু—কিছু নতুন প্ল্যানও আমার মাথায় এসেছিল। নাটিকা মনে—মনে রচনা করেছিলাম।

দুর্গামোহন সব দেখেশুনে আমার তারিফ করল পিঠ চাপড়ে। ‘আরে ব্যস, ব্যস! হঠাৎ যদি মরে টরে যাই, ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ ঠিকই চলবে।’ কানের কাছে চাপাস্বরে বলল, কিন্তু ছোটবাবু ভাগ্যের ঘরের জিম্মাদারি দিই কাকে? তুমি তো সেই দশটাকা হেরে পিঠটান দিলে, এমুখো হচ্ছ না।’

সোৎসাহে বললাম, ‘ডাকেন না তো একবারও?’

দুর্গামোহন বললে, ‘লেখাপড়া জানা লোক এ—বিদ্যা শিখলে তাকে ঠকায় সাধ্যি কার! তোমাকে আমি হাতেখড়ি দিতে চাই নন্দ। আজই।’

সে এক অদ্ভুত রাত্রি।

মেলা থেকে শেষ লোকটিও চলে গেছে, দোকানগুলিতে ঝাঁপ বন্ধ করা হয়েছে। ঘন অন্ধকারে কোথাও ঈষৎ আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা যাচ্ছে। একটা কঠোর স্তব্ধতা ব্যাপক হয়ে আছে দূরে মাঠের ওপর আমবাগানের মেলার প্রাঙ্গণে। আকাশে নক্ষত্রের শান্ত আলো। ক্বচিৎ কোনো কুকুরের ডাক ভেসে আসে। শ্যামচাঁদের নাটমন্দিরের চত্বরে কীর্তনীয়ারা খোল বুকে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দুর্গামোহন আমার পকেটে একগোছা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, ‘যাও, আমি আসছি।’

ভাগ্যের ঘরে চারজন লোক অপেক্ষা করছিল। নয়নতারা একটা টুলে বসে মদ ঢালছিল গ্লাসে। এগিয়ে ধরছিল। আমি যেতেই সে গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘শুভযাত্রা।’

লোকগুলি হেসে উঠল একসঙ্গে।

নয়নতারা বলল, ‘পার্টির ছোটোবাবু।’

আমি নমস্কার করলাম। কিন্তু কেউ হাত তুলে প্রতি—নমস্কার করল না। এবং তখনই আমার মনে পড়ে গেল, আমি কোথায়, কী আমার ভূমিকা। নিঃসংকোচে নয়নতারার হাত থেকে পূর্ণ পাত্রটা নিলাম। আশ্চর্য জ্বালা ও তিক্ততা সঞ্চারিত হল কণ্ঠে, বুকে, স্নায়ুদেশে।

ছকের প্রান্তে আসন করে বসে বাদামি চামড়ার কেসটা আমি নাড়া দিতে থাকলাম। গুটিগুলি শব্দ করছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়ল ছকের ওপর। ড্রাগন দুই…..বাকি সব শূন্য। কম্পিত হাতে ছকের ওপর থেকে বাজির টাকাগুলি পায়ের দিকে টেনে নিলাম।

কাঁধে হাতের স্পর্শ। দুর্গামোহন নিঃশব্দে হাসছে।

আর সাহস হয় না কোনোমতে। আসন ছেড়ে সরে গেছি সঙ্গে—সঙ্গে। দুর্গামোহন তার বিরাট শরীর নিয়ে ছকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নয়নতারা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘আরও একটু খাবে?’

আত্মসমর্পণ করেছিলাম ভাগ্যের ঘরে। নীলাভ পটভূমিতে পরপর কয়েক পাত্র গিলে আমি হা—হা করে হেসে উঠলাম। জুয়াড়িরাও সে—হাসিতে যোগ দিল।

কতক্ষণ ছিলাম জানি না। দুর্গামোহনের পাশার চাল দেখার প্রতি চোখ একটুও ছিল না। আমার বমি আসছিল। টলতে—টলতে বাইরে গেলাম। আমবাগানের ভেতরে ঢুকে ভীষণভাবে বমি করতে থাকলাম।

শুকনো পাতার ওপর নগ্ন মাটিতে শুয়ে দু—হাতে বুক চেপে ধরে হাঁসফাঁস করেছিলাম। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। স্মরণ নেই, কে আমাকে তাঁবুতে তুলে নিয়ে এসেছিল। রোদ গায়ে পড়লে যখন উঠে বসলাম, মনে হল সারা রাত ধরে শব্দহীন অগ্নিগর্ভ অন্ধকারে আমি কেবল বাবাকেই ডেকে ফিরেছি।

চোখ মুছে দেখলাম উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে চাপাটি দাঁত বের করে আমাকে দেখছে। তার দেখায় একটা করুণা ছিল। সে যেন সারারাত্রি সুখশয্যায় গভীর ঘুমের আরামে কাটিয়ে প্রত্যুষে পথপ্রান্তে শায়িত সর্বস্বান্ত ভিখারিকে দেখছে।

আমাকে সর্বস্বান্ত করেছে দুর্গামোহন। এই তার অভ্যাস। হাড়ে—হাড়ে এই স্বভাব তার বেঁচে আছে। প্রতি প্রত্যুষকালে সর্বস্ব—খোয়ানো মানুষ দেখে সে সুখী হয়। মানুষকে পরিপূর্ণভাবে সর্বহারা ও নগ্ন করার জন্যই তার অস্তিত্ব।

ধরা পড়ে গেল দুর্গামোহন জুয়াড়ি। তার স্নেহ—মমতা—প্রীতি—করুণা সবই মেকি। সে সব সু—তে কু—এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাকে জীর্ণ করতে চায়। এতে তার পৈশাচিক আনন্দ।

আমাকে সে এই উদ্দেশ্যেই লালন করছিল। দলে টেনেছিল।

তুষ্টুরাম এল। ‘শরীর কেমন গো নন্দবাবু?’

গা জ্বলে গেল আমার। জবাব দিলাম না।

‘আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন স্যার?’

‘কেন?’

‘কথা বলছেন না যে!’

‘ভালো লাগে না।’

‘অভ্যেস নেই! একদিনে হঠাৎ অতটা টানলে সহ্য হবে কেন?’

যেন স্বগতোক্তি করছিল সে। ‘ছিঃ, মাগিটার একটুও জ্ঞানগম্যি হল না। শিক্ষিত ভদ্দর মানুষকে নরকস্থ করে ছাড়লে।’

‘বাজে বোকো না তুষ্টু। খেয়েছি, সে আমার ইচ্ছে। কারুর কথায় খাইনি।’

‘না না। খাবেন বইকি। লাইনে যখন এসেছেন…’ হাসছিল তুষ্টুরাম। ‘আম্বো খুব খেতাম। আর সইতে পারিনে।’

চাপাটিকে ডাকলাম, ‘এক বালতি জল দে রে।’

চাপাটি জল এনে রাখল। মুখ ধুচ্ছিলাম। তুষ্টুরাম বসে পড়ল পাশে। নিজের কুশ্রী কালো দাঁতগুলি দেখিয়ে বলল, ‘দেখছেন মজাটা? ভেতর—ভেতর ক্ষয় হয়ে গেছে কতখানি। নিত্যি খেলে অকালে সব দাঁত ঝরে যায়। ভালো করে কুলকুচো করে নেবেন, ব্যস!’

যতক্ষণ চা খেলাম, তুষ্টুরাম একইভাবে বসে থাকল। অনর্গল কথা বলছিল সে। মদ, জুয়া, সার্কাস ও জীবজন্তু সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিল। মাঝে—মাঝে শুনছিলাম তার কথা। কখনো আমি স্মৃতির দিকে ছুটে চলেছিলাম। ধূসর দুর্গম—বড়ো তুষার সে—পথে, শীতকালীন মেরুপ্রদেশ। এক সময় হঠাৎ টের পেলাম, আমার পুরানো জীবনে আর একটুও সুখকর কিছু নেই। কোনোমতেই খাপ খাওয়াতে পারব না নিজেকে। আর এই বর্তমান—এও বড়ো সংশয়ময়, যন্ত্রণাদগ্ধ। কোন পথে যাই? আমি যে ভাগ্যের ঘরে সেই প্রথমদিনেই সব খুইয়ে বসেছি। আর জেতার আশা বৃথা। আমি বদলে গেছি। দেহ—মাংস—রক্ত—আত্মা কোনোকিছু আর আগের মতো নয়। এ এক নতুন আমি। ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’—র ছোটোবাবু।

‘বেশি খেয়ে ফেললে সটান এসে নিজের বিছানায় শোবেন।’ তুষ্টু বলছিল, ‘ভাগ্যিস কাল আমি ওদিকে গেলাম। শুয়ে—শুয়ে গোঙাচ্ছিলেন।’

‘আমি?’

‘না তো কে?’ তুষ্টুরাম হেসে ফেলল।

বিস্মিতভাবে তার হ্রস্ব শরীরের অগ্রসর হওয়া দেখছি। এ—লোকটি আমার যথার্থ শত্রু নয়। শত্রু অন্য কেউ—যে আমার চরম হননের জন্যে ছুরি শানাচ্ছে।

কিন্তু কী আশ্চর্য, এই তুষ্টুরামই একদিন আমার হাত ধরে নয়নতারার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। আমার হাতে সে অশ্লীল চাপ দিয়ে মন্দার ফুলের ওপর সাপিনীর মতো সংলগ্না নয়নতারা নটীকে দেখিয়ে ছিল। প্রকৃত ঘড়েল দালালের ভূমিকায় সে আজও অভিনয় করে চলেছে। …..দেখুন….দেখুন, দেখে যান, আপনার আঁখো কা তারা…..

সে কি এমনি করে মানুষী নয়নতারাকে তিরস্কার করে? কিংবা নিজের ক্লাউন সত্তাটাকে—যে ওই বারাঙ্গানা নটীর প্রতি ঘোরতর আসক্ত?

এই প্রশ্নের জবাব সেদিন রাতেই দিয়েছিল তুষ্টুরাম ক্লাউন।

সন্ধ্যার আগে থেকে সে বারবার মদ খাচ্ছিল। দুর্গামোহন টিকিটঘরে। আমার আপত্তি তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। নয়নতারা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পকেটে সর্বদা একটি বোতল পূর্ণ করে ফিরছিল সে। দ্বিতীয় শো’র শেষদিকে সে রীতিমতো টলছে। চলতে গিয়ে আছাড় খাচ্ছে। দুর্গামোহন মঞ্চের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, এবার শেষ খেলা।

নয়নতারাকে সুমুখে রেখে আগুনের চাকতিটা নিমেষে গলে গেল তুষ্টুরাম। তারপর গুরুভার দীর্ঘ ত্রিশূলটা হাতে তুলে নিল। দর্শকদের দিকে চেয়ে প্রথামতো বক্তৃতাটাও দিল স্খলিত কণ্ঠস্বরে। তারপর শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত গতিতে শুয়ে পড়ল মাটিতে।

নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী দু’জন ছুটে ত্রিশূলটা তোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারপরই তারা চিৎকার করে উঠেছিল। দুর্গামোহন লাফিয়ে পড়েছিল স্টেজ থেকে। ‘তুষ্টু ওরে তুষ্টু….এ তুই কী করলি!” আমার পা দুটো আটকে গেছে। ভিড়ের ভেতর একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সমস্ত সত্তা বধির হয়ে গেছে। ত্রিশূলের দু’টি ফলা বাম ফুসফুসে ও লিভারে আমূল প্রোথিত হয়ে আছে। রক্তের ক্ষীণ রেখা গড়িয়ে পড়ছে ক্লাউন পোশাকের ওপর। মুখটা একপাশে হেলিয়ে রেখেছে সে। টুপিটা খসে গেছে ধুলোয়। পায়ের চাপে পিষ্ট হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

তারপর একটা তীক্ষ্ন আর্ত চিৎকার সকল কোলাহলকে চিরে তাঁবুর আকাশে নিক্ষিপ্ত হল। নয়নতারা মূর্ছা গেছে স্টেজের ওপর। সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলাম সঙ্গে—সঙ্গে। তাকে দু—হাতে তুলে নিয়ে ডেকেছিলাম, ‘চাপাটি চাপাটি, ডিম্বু!’