।।দশ।।
তবু নয়নের গা ছমছম করে।
উইংসের পাশে খাঁচার ভেতরে ওসমান খাঁ বাঘটা নীল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাচতে নাচতে পাশ ফেরে নয়ন। আড়চোখে তাকায়। দেখতে পায় নিষ্পলক ওই দুটি নীল আগুন। তাল কেটে যায়। বুঢ়ুয়া সজারুর কাঁটার শব্দ ওঠে অন্ধকার থেকে। ওদিকে আমিনা সাপিনী তারের জালে বসে অবিশ্রান্ত মুখ ঘষছে—তার বিরাট তে—কোনা মাথার নীচে লকলক করে কাঁপছে বেগুনি জিভটা। নয়নের মনে হয় অন্ধকারে যারা আছে—যারা ছিল এতদিন—হয়তো এই তাঁবুর জগতের পেছন থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে একটা সীমান্তে দাঁড়িয়েছে তারা। অপেক্ষা করছে বাইরের আলোতে আসবার জন্যে।
নয়নের গা ছমছম করে। তাল কেটে যায় বার বার।
তবলচি হাফিজ খলিফা ডেনোয় চাঁটি মেরে সামলে নেয়। দুর্গামোহন নিঃশব্দে ভুরু কুঁচকে নয়নকে ধমকাতে গিয়ে হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে জন্তুগুলিকে নিরীক্ষণ করে। হয়তো তারও গা ছমছম করে।
দিনের বেলায় স্টেজে জন্তুদের টেনে বের করে রতন। জন্তুগুলি কী কী খেলা জানে, কী তাদের স্বভাব বা অভ্যাস—সবই সে পকেটবুকে লিখে এনেছিল কোম্পানির কাছ থেকে। একে একে মিলিয়ে নেয় প্রতিদিন। গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করে—নতুন জায়গায় নতুন কী অভ্যাস ওদের গড়ে উঠছে। তারপর নিজের জানা খেলাগুলিতে তালিম দেয়।
‘এ বড়ো সাধনার বস্তু।’ রতন দুর্গামোহনকে বলে। কখনও ইংরেজি বলে ওঠে সে। ‘গ্রেট এশিয়ান সার্কাসে’র মাস্টার খেলোয়াড় রতন বোস এই জন্তুগুলি আসবার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল। এতদিন যেন বড় সংকোচে সে কালযাপন করেছে। একটা ছোট্ট নাচ—গানের বা ভ্যারাইটি শো পার্টিতে তার মূল্যও ছিল যৎসামান্য। দুর্গামোহন তাই বিস্মিত চোখে চেয়ে বলে—’যন্ত্র ছাড়া যন্ত্রীর রূপ কি জানা যায়?’
রঘু কেষ্টা ভূপতি এমনকি চাপাটিটাও সহায়তা করে রতনকে। পার্টির ইজ্জত যে বহুগুণে বেড়েছে, এই গর্বের শরিক তো তারাও। বাইরে বুক ফুলিয়ে বলে—’এ তোমার চারপয়সা টিকিটের ঝুমঝুমির খেল নয়—দস্তুরমতো জন্তু জানোয়ারের দল।’
পাশের ম্যাজিকওয়ালা ছোকরাটা মন্তব্য করেছিল—’তবে বনে গেলেই পার, এখানে কেন?’
চাপাটিকে পারা দায়। সে অমনি বিকট হাঁ করে জবাব দিয়েছিল—’মানুষ খেতে।’
ওসমান খাঁকে দু’পা তুলে দাঁড়ানো অভ্যাস করাচ্ছিল রতন। ওই চাপাটি তখন সোৎসাহে ছুটে গিয়ে পা’দুটো ধরে তুলে ফ্যালে আর কি! কিন্তু ওসমানেরও একটা পছন্দ—অপছন্দ রয়েছে—বনের জন্তু হলে কী হয়। সে অমনি এমন হাঁকড়ালো—তাঁবু তোলপাড়—চাপাটিও লাফ দিয়ে ‘বাপ’ বলে স্টেজের নীচে গিয়ে পড়েছিল। নয়ন হেসে বাঁচে না।
রতন ডেকেছিল—’নয়ন, এদিকে এসো তো। প্লিজ হেলপ মি, ডার্লিং।’
নয়ন চোখ বড়ো বড়ো করে আরও দূরে সরে গেল। ‘তুমি ইংরেজিই বলো আর উর্দুই বলো—আমি ওদের সাতে পাঁচে নেই। বাব্বা, বুনো জানোয়ারকে বিশ্বাস নেই।’
‘এবার বুনো জানোয়ারের সঙ্গেই ঘর করা হবে কিন্তু।’ রতন সকৌতুকে বলল।
‘ঘর কি আর করছি না! ওই করেই জীবন গেল আমার।’
‘তবে ভয় পাচ্ছ কেন?’
নয়ন কটাক্ষ হেনে নটীপনা করে জবাব দিল—’সে তো রাতের ব্যাপার। দিনে কী?’
‘ফাজিল মেয়ে!’ মৃদু হেসে ফের জন্তুগুলির প্রতি মনোনিবেশ করতে থাকল রতন। ‘ইউ ওসমান খাঁ—ইউ আর অ্যান ওল্ড ম্যান….অ্যান্ড ইউ মিস আমিনা—ইউ আর এ বিউটিফুল গার্ল….অ্যান্ড হিয়ার ইজ দি ফুলিশ চ্যাপ—এ ক্লাউন—মাস্টার বুঢ়ুয়া!’
দুপুর গড়িয়ে গেছে। চাপাটি ডেকে গেছে ক’বার। রতনের হুঁশ নেই। ওদের নিয়ে সে মেতে থেকেছে। এদিকে নয়ন স্নান করে ধবধবে সাদা শাড়ি পরে রোদে চুল শুকোচ্ছে। কপালে উজ্জ্বল লাল মোটা টিপ—সিঁথি পূর্ণ করে সিঁদুরের রেখা। কাঁটাতারের বেড়ার (নতুন দেওয়া হয়েছে ক’দিন থেকে) ওপাশে মেলার দোকান থেকে কারা কোঁচকানো চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। নয়ন জানে—ও তাকানোতে ঘৃণা ঈর্ষা যত—তত লোভ লালসা কাতরতা।
সে একটু হাসলে ওই দৃষ্টিগুলি নিমেষে বদলে যাবে। মানুষের চোখ যে আকাশের মতো। যে ভাবের মেঘ জমাই, সাদা কাল ধূসর নীল লাল হলুদ যেমন রঙ—তেমনি ফোটে পলকে পলকে। কখনও অস্থির—কখনও শান্ত। আবার কখনও ঘন নীল—শূন্য গভীর ভাবহীন। মাঝে মাঝে দুর্গামোহনকে সে যে চোখে তাকাতে দ্যাখে।
সে রাতে একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখল।
ঘন গহন দুর্গম এক অরণ্যের মধ্য দিয়ে ‘মোহিনী ভ্যারাইটি শো’ পার্টি চলেছে। কিংবা সে একা। কিংবা যেন সঙ্গে রতন আর দুর্গামোহন চারপাশে অসংখ্য জানোয়ার—সাপ বাঘ সজারু সিংহ। যেদিকে চলে দেখতে পায় একই অদৃশ্য। অথচ তাদের আক্রমণ করছে না কেউ। …তারপর দেখল দুর্গামোহনকে। দুর্গামোহন না অন্য কিছু…অদ্ভুত একটা সত্তা…বাঘের চেয়ে ভয়ানক—ছুটে পালাতে গিয়ে পা ওঠে না….’বাবু, বাবু তুমি অমন করছ কেন…’ আক্ষেপে দুঃখে অভিমানে সে কেঁদে উঠেছে….
রতন ডাকছিল—’নয়ন, নয়ন, কী হল?’
জেগে উঠে দেখল তাঁবুর দরজার বাইরে শেষরাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। জ্বলজ্বল করছে একটি নক্ষত্র।
‘স্বপ্ন দেখছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘মনে নেই।’ স্বপ্নটা বলতে লজ্জা করছে তার।
কিন্তু যা অন্ধকারের বস্তু—আলোয় আনলে তাকে যত কুৎসিতই দেখাক, গা ছমছম আর থাকে না একসময়। নইলে গেরস্থ ঘরের মেয়ে—বউ একদিন বেশ্যা হয়ে শহরের গলিতে সেজেগুজে দাঁড়ায় কোন সাহসে? যতক্ষণ পাপ বা দুঃখ বা ঘৃণা অন্ধকারে পুষেছি—ততক্ষণ সে ভয়ানক। নিজের বা অন্যের কাছেও। আলোতে এনে দেখি তার রূপ গেছে বদলে। ধার গেছে ক্ষয় পেয়ে। তাকে দেখাচ্ছে সবচেয়ে করুণ আর অসহায়।
তাই ভয় কাটছিল।
তখন দেখা যাচ্ছিল—আসলে ওই বাঘটা দু’খণ্ড মাংস পেলেই তো কৃতজ্ঞ। চাপাটির সঙ্গে তার আর দুশমনি নেই। সাপটা গলায় ঝুলে থেকে আরাম পায়। সজারুও তার কাঁটার পালক গুটিয়ে নেয়।
এ—ভয় নয়ন, দুর্গামোহন বা তার পার্টির লোকজনেরই একান্ত নিজস্ব ভয়। মনের বনে যে জন্তুগুলি রয়েছে, এ—ভয় আসলে তাদের প্রতি ভয়ের প্রতিচ্ছবি—বাইরের দর্পণে প্রতিফলিত। এবং তা ক্রমে ক্রমে কেটে যাচ্ছিল।
চাপাটি বাঘটাকে খেতে দিয়ে তাই খিস্তি করত—’এক কান কাটলে মানুষ চলে গাঁয়ের বাইরের পথে—দু—কানকাটার চলা সদর রাস্তায়। দড়ি জোটে না তোর গলায় রে বুড়োটা?’
রতন মিটিমিটি হাসত—’গাল দিচ্ছিস কেন রে ইডিয়ট?’
‘ও শালা এক পাক্কা জুয়াড়ি ছিল বাবুর মতো। তাই রামসহায়ের সেই বাঁধন পড়েছে গলায়।’
রতন ধমকাত—’চুপ, চুপ! শুনলে তোর পিণ্ডি চটকে দেবে বুদ্ধুর বাচ্চা কাঁহাকা!’
চাপাটি তখন নয়নের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলত—’দিদি, একটা মজার কথা শুনবে?’
‘কী রে?’
‘ওসমান খাঁর মুখখানা দেখেছ? একেবারে যেন…..ইয়ে’…..ঢোক গিলে চাপাটি বলত—’মারবে না তো?’
‘মারব কেন রে ছোঁড়া? বল না!’
চাপাটি চারপাশটা দেখে নিয়ে চতুর চোখদুটি পিটপিট করে বলত—’দুগগামোহন পাঞ্জাবি।’
নয়ন হেসে খুন। ‘কিন্তু পাঞ্জাবি কেন রে?’
‘ওম্মা, তাও জান না বুঝি, লোকে বাবুকে ওই নামেই চেনে যে। সকালে বাজারে গিয়েছিলাম কেষ্টদার সঙ্গে। লোকে আমাদের মুখপানে সব হাঁ করে চাওয়া—চাওয়ি করছে: তোমরা দুর্গামোহন পাঞ্জাবির লোক না? তা এবারে বাঘ ভাল্লুক এনেছ দেখেছি, গত বছর তো ছিল না—ব্যাপারটা কী?’
‘তুই কী বললি?’
‘বললাম—এবারে যে বড় সার্কাসের খেলোয়াড় সঙ্গে আছে—রতন মাস্টার। কোন রতন? সেই সিঙ্গিওলা রতন বোস? হ্যাঁ সে ছাড়া আর কে। …এ দলে জুটল কেন? আম্মো চোখ পাকিয়ে বললাম—জুটবে না কেন? বেজাত নাকি আমরা? ….শুনে শালার মামদোরা….চাপাটি হঠাৎ চুপ।
‘শুনে কী বলল?’
‘রাগ করবে না তো?’
‘না রে না, তুই আমার ছোটো ভাই’—নয়ন গাল টিপে দিত।
‘বললে—ছিঃ সে বড়ো অসভ্য কথা নয়নদি। তোমার কুচ্ছো।’
কুচ্ছো সারা জীবন ধরে নয়ন কি কম শুনেছে? কিন্তু বিয়ের পর থেকে এমন কথা শুনলে তার হৃৎপিণ্ডটা খুবই নাড়া খেত। দুঃখে অভিমানে অনেকটা সময় স্তব্ধভাবে বসে থাকত সে। কান্না পেত তার। এক সময় আয়না তুলে সিঁথির সিঁদুরটা লক্ষ্য করত। আর কখন এক অপরূপ অনুভূতিতে মন পূর্ণ হয়ে উঠত—লোকে যাই ভাবুক, আমি যে এয়োতি—আকাশের তলে আমারও একটা সংসার রয়েছে—সংসারী ইচ্ছা—বাসনা রয়েছে।
চন্দনপুরের মেলায় পৌঁছতে তখন সবে ফাল্গুন মাস পড়েছে। রাতের দিকে অল্প অল্প শীতের আমেজ থাকে। দিনের রোদ বেশ মিঠে। থেকে থেকে দক্ষিণের বাতাস আসে। গা শিরশির করে ওঠে। পাতা ঝরে পড়ে অশ্বত্থের তলে। তাঁবুর সুমুখে খোলা আকাশের নিচে তাস পিটতে থাকে রঘু কেষ্টরা। ভাড়াটে ব্যান্ডপার্টির লোকজন নিজ নিজ রঙিন পোশাক মেলে দিয়েছে ঘাসের উপর রোদে। অশ্বত্থগাছের পাশে উনুন জ্বেলে ভূপতি বাটনা বাটছে। নয়ন একা তার তাঁবুতে বসে একটা নতুন গান ঠিক করে নিচ্ছিল।
দুর্গামোহন থানায় চলে গিয়েছিল। নতুন জায়গা। ভাগ্যের ঘর সামলানোর ঝুঁকি অনেক। গুণ্ডামি—বাটপাড়ির ভয়ও রয়েছে। সবদিক সামলাতে হয় তাকে।
সেইসময় রতন এল টলতে টলতে। ‘আরে ক্যা মজাকা বাত—এ মেলায় জোর কম্পিটিশন!’
নয়ন মুখ তুলে প্রশ্ন করল—’তার মানে?’
‘তোমার পাল্লাদার—সরি, পাল্লাদারনিগণ। ওই দ্যাখো, ছোটো ছোটো তাঁবু ক’খানা।’
‘ও কাদের?’
‘সময় হলে দেখতে পাবে। খোপে খোপে এখন পোষা পায়রার মতো বকবকম করছে।’
একটুখানি দেখে নিয়ে নয়নের ভুরু দুটি কুঁচকে গেল। ঝুমুরের দল এসেছে একটা। এর আগেও এসেছে অনেক মেলায়। কিন্তু ‘পাল্লাদারনি কথাটা কেউ বলেনি। কেউ তাদের সঙ্গে নয়নকে তুলনা করেনি। আশ্চর্য, রতন তাকে এ কথা বলতে পারল?’
ক্ষোভে দুঃখে বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল সে। নিষ্পলক চোখে হারমোনিয়ামের রিডের ওপর খোলা খাতার পাতায় তাকিয়ে থাকল। অক্ষরগুলি অর্থহীন হিজিবিজির ন্যায় তার চোখে ভাসছিল।
রতন একবার ঝুঁকে দেখে বলল—’আরে বাঃ বাঃ, কেত্তন মনে হচ্ছে? তা হলে পাল্লাটা জমবে ভালো। ওরা তো কেবল রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়েই গায়। মাইরি, অমন কাঁচা রসের খিস্তি তো আর কোথাও মেলে না!’
হয়তো সহজভাবেই কথাগুলো বলে যাচ্ছিল রতন। কিন্তু নয়নের কানে তা গরম সিসার মতো প্রবেশ করছিল। সে ক্রমশ বধির হয়ে পড়ছিল।
রতন অপটু কণ্ঠে গুনগুন করল : সই কেমনে ধরিব হিয়া। আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া। তারপর বলল—’গানটা তো বেশ। কার রচনা? গুণী লোক ছাড়া এ কম্মো কার … প্রণাম।’
এই সকাল বেলায় কয়েকপাত্র গিলেছে। ঘৃণায় অভিমানে নয়ন বলে উঠল—’এখানে বসে বসে শোনাচ্ছ কাকে? ওখানে যাও না—শুনতেও পাবে অনেক!’
রতন হেসে উঠল হো হো করে—’ইয়েস, রাইট ইউ আর। আই মাস্ট গো—আমি যাব। কিন্তু বড়ো গা ঘিনঘিন করে মাইরি…কী নোংরা!’
‘একখানা সাবান সঙ্গে নিয়ে যেয়ো।’
‘সাবান? ইয়েস। অ্যান্ড এ বটল অফ সেন্ট। কিন্তু তখন আবার হইচই বাধাবে না তো? আমি সব সইতে পারি বাবা, কেবল ইজ্জতের বদনাম শুনলে বুকে ছুরি মারতে ইচ্ছে করে!’
‘ইজ্জত তোমার আছে?’
রতন কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল—’ইয়েস! আলবৎ আছে। গ্রেট এশিয়ান সার্কাসের মাস্টার রতন বোসের ইজ্জত নিয়ে জুয়া খেলা যায় না—এর দাম অনেক।’
কান লাল হয়ে উঠেছিল নয়নের। সে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে থেকে বলেছিল—’দাম যদি আছে, তবে আমার মতো একটা বেশ্যার কাছে পড়ে আছ কেন?’
রতন লাফিয়ে উঠেছিল—নো, নেভার। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। রীতিমতো মন্ত্র পড়ে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করেছি।’
‘বিয়ে করা বউ! বিয়ে করা বউকে ঝুমুরওয়ালির সঙ্গে তুলনা করে না কেউ।’ নয়ন মেয়েমানুষ। কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে তার পক্ষে যা সহজ, তাই সে বেছে নিয়েছিল সে মুহূর্তে। কেঁদে উঠেছিল মুখে আঁচল চাপা দিয়ে।
কান্না দেখে রতনের জেদ হঠাৎ বেড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। হয়তো সে ভেবেছিল—নয়ন যখন ভেঙে পড়েছে—সেই দুর্বল মুহূর্তের সুযোগে তার আচ্ছন্ন মেয়ে—বিবেকে চাবুক মেরে চাঙ্গা করাই উচিত হবে। তাতে সে মদ খেয়েছিল খানিক। ‘কেন তুলনা করব না ডার্লিং? কাল রাতে তুমি কী করছিলে? অন্য রাতের কথা আমি ছেড়ে দিচ্ছি। মানুষকে বাধ্য হয়ে ডিউটির খাতিরে অনেক কিছু করতে হয় আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইট। রাতের পর রাত তুমি আমার চোখের সুমুখে অন্যের সঙ্গে ঢলাঢলি করেছ, গায়ে গা মিশিয়েছো—তারা তোমায় জড়িয়ে ধরেছে….আই নেভার মাইন্ড ফর দ্যাট। বাট…বাট…লাস্ট নাইট লাস্ট নাইটে তুমি ধরা পড়ে গেছ।’
নয়ন একবার তাকিয়ে মুখ নত করল।
‘ভেবেছিলাম—হোয়াট ইউ ডু, ইউ ডু ফর সেক ইওর পার্টিস বিজনেস। বাট লাস্ট নাইট…আমি পর্দার ফাঁকে চুপি চুপি দেখি, ও মাই গড, সেভ মি…’ রতন একহাতে তার চোখ ঢাকল। ‘এ টেরিবল সীন অফ মাই মার্ডার—আমি…আমি বুক চাপড়ে কেঁদেছি। ইয়েস—আই নেভার ক্রায়েড সো ইন মাই লাইফ—আই অ্যাম অ্যান অরফ্যান ইন দিস ক্রুয়েল ওয়ালর্ড….’
নয়ন শ্বাসক্লিষ্ট কণ্ঠস্বরে বলে উঠল—’কী, কী দেখেছিলে তুমি?’
‘ইউ কিসড দ্যাট ইয়ংম্যান—এই মেলার মালিকের পুত্র—দ্যাট হামবাগ—অ্যান্ড দি ওল্ড টাইগার একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল মাত্র—খুশি হল—আর আমি কেঁদে ফেললাম—বিলিভ মি…..’
নয়ন কিছুটা সামলে নিয়েছিল। সে আস্তে আস্তে বলল—’তুমি ভুল বুঝছ।’
‘অ্যাম আই ফুল? ওই শয়তানটা তোমায় হুকুম দ্যায় নি বুলু দত্তকে তোয়াজ করতে? চুমু খেতে?’
‘ওটা আমার চাকরি।’ নয়ন হাসবার চেষ্টা করছিল।
রতন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ‘ও চাকরি চলবে না। আই সে, ইউ স্টপ ইট, নইলে…’
‘কী করবে? খুন?’
সে কথার জবাব না দিয়ে রতন চাপা গলায় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলল—’চাকরি! চাকরির জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে হবে—এ সহ্য করা অসম্ভব। আই উইল সী দ্যাট ওল্ড টাইগার, আই প্রমিজ।’ টলতে টলতে চলে গেল সে। নয়ন সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে দেখল—কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ফাঁকা জমিটাতে দাঁড়িয়ে আছে বুলু দত্ত আর দুর্গামোহন। দুর্গামোহন ছড়ি দিয়ে জায়গাটা বারবার দেখাচ্ছে। হয়তো পার্টির জন্যে আরও খানিক জায়গার দরকার—তারই আলোচনা চলেছে দু’জনের।
নয়ন আরও দেখল—রতন পকেট থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে মদ গিলল। তারপর বোতলটা ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। সে হনহন করে বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পালিয়ে যাচ্ছে না তো? অজানা উৎকণ্ঠায় নয়নের বুক কাঁপছিল।
বুলু দত্ত এগিয়ে এল। ‘নমস্কার মিস নয়নতারা।’
হাত তুলে মৃদু হেসে নয়নও নমস্কার করল। তাঁবুর সুমুখের খাটিয়াতে একটা সতরঞ্চিও বিছিয়ে দিল সে। দুর্গামোহন এসে বলল—’একটু চা—টা দেবে নয়নমণি?’
সত্যি বলতে কি ততক্ষণে নয়ন রীতিমতো আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে তাঁবুর জগতে যে নীলাভ আলোয় ভরা ভাগ্যের ঘর রয়েছে—সেখানে বাস করে এক রঙ্গনটী। যেন অলৌকিক মায়ায় তার জন্ম—অলৌকিকে তার লয়। তার কাছে পুরুষের নাম শুধু পুরুষ—লীলামৃগয়ার সঙ্গী। সে বুলু দত্ত নয়, রতন নয়, রামসহায় নয়। সে নামহীন। তাই আত্মসমর্পণ করায় কোনো দুঃখ নেই, ঘৃণা নেই, দ্বন্দ্ব নেই তখন। বিবেক—অবিবেক, ধর্মাধর্ম পাপ—পুণ্যের সে বাইরে। সে যে শুধু দুর্গামোহনের মায়াকন্যা।
কিন্তু দ্বন্দ্ব আসে, ঘৃণা আসে, দুঃখ আসে—যখন সেই অলৌকিক সত্তার আবরণ ফেলে দিনের আলোকিত পৃথিবীতে বেরিয়ে আসে এক নারী—তার নাম নয়ন। কারণ স্মৃতিকে তো বিসর্জন দেওয়া যায় না। স্মৃতি যেন দুই জগতের মধ্যে এক বিলম্বিত সেতুর মতো বিস্মৃত।
এবং স্মৃতি ক্রান্তিদর্শী ঈশ্বরের ন্যায় পরাক্রমশালী। সে বলে—আমি আছি। সে থাকে জরামরণহীন, অনির্বাণ, শাশ্বত।
দুর্গামোহন হাঁ হাঁ করে উঠল ‘আহা, দোকানের চা কেন? তুই নিজের হাতে কর।’
চাপাটি কেটলিটা নয়নের হাতে এক রকম ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল—বুলু দত্তের পেছনে বক দেখাতে দেখাতে। হাসি পাচ্ছিল না নয়নের। তার জানু ভারী বোধ হচ্ছিল—পা কাঁপছিল। হৃৎপিণ্ড ধকধক করছিল। যেন দিনের আলোর পৃথিবীতে—যখন সে নিজেই নিজের সম্রাজ্ঞী—দুর্গামোহন হঠাৎ প্রবেশ করে তাকে ক্রীতদাসী বলে তিরস্কার করছে।
একসময় কম্পিত হাতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে সে একপাশে দাঁড়াল। বুলু দত্ত বলল—’আপনি খাচ্ছেন না?’
মাথা নাড়ল নয়ন। ‘একটু আগে খেয়েছি।’
‘মাস্টার বোস কোথায়? তাকে দেখছি না যে?’
নয়ন মৃদুস্বরে বলল—’বেরিয়েছে কোথায়।’
দুর্গামোহন রঘুকে ডাকছিল, ‘হরমোনিয়ামটা স্টেজে নিয়ে চল তো বাবা।’
নয়ন বিস্মিতভাবে বলল—’স্টেজে কী?’
‘বাবুজি এল—একটু গানটান শোনা….’
‘খলিফা নেই যে। সে আসবে বিকেলে। বাজাবে কে?’
‘কেন? আমার ঠেকা বুঝি পছন্দ হয় না?’ দুর্গামোহন হেসে উঠল।
আড়ষ্ট গলায় কয়েকখানি গান শোনাতে হয়েছিল নয়নকে। শেষে মাথা ধরেছে বলে উঠে পড়েছিল। বুলু দত্ত যাবার সময় একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিয়েছিল তার হাতে। পরে দলাপাকানো নোটটা মুঠোয় নিয়ে দুর্গামোহনের দিকে তাকাতেই দুর্গামোহন বলেছিল—’তোর বখশিশ—রেখে দে।’
রতন ফিরল একেবারে বেলা গড়িয়ে। কোথায় ছিল কে জানে। কোনো প্রশ্ন করেনি নয়ন। রতনও তাকে কোনো কথা বলেনি। দু’জনে গুমোট মুখে বসে ছিল চুপচাপ। নয়ন ভাবছিল—পুরুষের মন এত অবুঝ, তা যদি সে আগে জানত! আশ্চর্য, এতদিনেও রতন তাকে স্পষ্ট করে চিনতে পারল না? সবচেয়ে খারাপ লাগছিল যে ওই রতন তা হলে রাতের পর রাত চুপিচুপি ভাগ্যের ঘরে উঁকি মেরে নয়নের কার্যকলাপ দ্যাখে। ছি ছি কী ঘেন্নার কথা? যে অত সুন্দর—তার মন অতটা কুৎসিত, সে ভাবতেও পারেনি।
দুর্গামোহন তার তাঁবু থেকে ডেকে বলল—’সকাল সকাল শো আরম্ভ করব আজ—তোরা তৈরি হয়ে নে।’
মেলায় ঝুমুর এসেছে বলেই হয়তো সে রাতে অত ভিড় ছিল। হল্লা হইচই উল্লাসে ফেটে পড়ছিল রাতের মেলাটা। উজ্জ্বল আলোয় একটা বিরাট পদ্মফুল অন্ধকারের সরোবরে ফুটে উঠেছিল যেন। না কি অগ্নিচাঁপা ফুল? উত্তাপে উত্তেজনায় উচ্ছ্বাসে থরথর কম্পিত। মত্তমাতাল জনতা থেকে থেকে চিৎকার করছিল বিকটভাবে। আর জীবনে যা কোনোদিন করেনি, তাই করেছিল নয়ন সে রাতে।
শো শেষ হয়ে গেলে যখন ভাগ্যের ঘরে নতুন উত্তেজনা শুরু হয়েছে সে বারবার চুপিচুপি পর্দা তুলে বেরিয়ে এসে রতনের খোঁজ করছিল।
না, শেষ শো’র পর থেকে রতনের পাত্তা নেই। তবে কি সত্যি—সত্যি ঝুমুরওয়ালিদের ওখানে গিয়ে জুটেছে? শেষ চাপাটিকে চুপিচুপি কথাটা বলে ফেলেছিল সে। একটু পরে চাপাটি ফিরে এসে বলল—’হীরের তাঁবুতে গড়াচ্ছে রতন দা।’
‘হীরা? সে কে?’
‘ওই যে বিড়ালচোখো ছুঁড়িটা….’
‘তুই চিনলি কী করে রে?’ নয়ন চেষ্টা করে হেসে উঠল অবশেষে।
‘দুপুরে গিয়ে ভাব করে এসেছি—মাইরি নয়নদি!’
‘ভাব করে এসেছিস তো—এখন গলা ধরে শো গে না হতভাগা!’
চাপাটি তার ছেলেমানুষি ভুলে—টুলে ঘড়েল আর চতুর কণ্ঠে ফিস ফিস করে বলল—’পাত্তা দিচ্ছে না। বলে, ছেলেমানুষ—গাল টিপলে দুধ বেরোয়—মাইরি কাপড়—জামা তুলে….’
চূড়ান্ত তুখোর হাবভাব দিয়ে নয়ন তার তীব্র অনুভূতিগুলি ঢেকে রাখতে চাচ্ছিল। তার দাঁতে দাঁত ঘষা খাচ্ছিল। সে চাপাটিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল—’ইতর কোথাকার! আমি তোর দিদি না?’
চাপাটি যেন অতর্কিতে নয়নের একটা হঠকারী প্রশ্রয়ের রজ্জু অবলম্বন করে কোনো পরিণতির দিকে ওঠবার চেষ্টা করছিল। হয়তো আর খানিক অগ্রসর হত সে—এইসব আকাশ থেকে খসে পড়া ছেলেগুলির ভাগ্যে যা ঘটে থাকে পৃথিবীতে—কিন্তু চরম মুহূর্তে সামলে নিয়েছিল নয়ন। এই করে কি সে রতনের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে?
যখনই ধরা পড়ে গেল এ কারচুপি—সে দ্রুত লাক—রুমের পর্দা তুলে ঢুকে গেল। বুলু দত্তর পাশে বসে বোতল থেকে মদ ঢালল গেলাসে। বুলু দত্ত একটা সোডাওয়াটারের বোতল খুলে মিশিয়ে দিতে দিতে বলল—’মেয়েদের অত কড়া খেতে নেই। ভিরমি যাবেন!’
হয়তো অমনি একটা কিছু চেয়েছিল নয়ন। সে চুপিচুপি বারবার গেলাসটা পূর্ণ করে
তক্তপোশের নীচের আঁধার অংশে মুখটা ঝুঁকিয়ে মদ খাচ্ছিল। একসময় খেলার খুব জমাটি মুহূর্তে যখন বুলু দত্ত মোটা দান ধরেছে, নয়ন মাথায় হাত দিয়ে বমি করে ফেলল।
এরপর স্বভাবত খেলা জমতে পারে না। বেহুঁশ নয়নকে নিয়ে রঘু কেষ্টরা তখন ব্যতিব্যস্ত। দুর্গামোহন সব সামলে বেরিয়ে এল একসময়। গর্জন করেছিল সে—’হারামজাদি, শয়তানি…..’ তারপর লাথি তুলেছিল। কিন্তু বুলু দত্ত বাধা দিয়েছে এসে। ‘আরে, ও কী করছেন? ছি ছি…..’
‘সরে যান মশাই, ও আমার ইজ্জত ডোবাল। ওকে আমি খুন করে ফেলব!’
বুলু দত্ত তাকে ঠেলতে ঠেলতে সরিয়ে নিয়ে গেল—’পুয়োর গার্ল—অভ্যাস নেই হয়তো। যেতে দিন!’
রতন ফিরেছিল একেবারে রাত পুইয়ে। নরনকে তখনও শুয়ে থাকতে দেখে সে বলেছিল—’এখনও খোয়ারি ভাঙছো দেখছি। ওঠ দিকি, একসঙ্গে দু’জনে নাইতে যাব। গতরে পাপগুলো ধুয়ে ফেলতে হবে না?’