নীল ঘরের নটী – ১

।। এক।।

ন্যাশনাল হাইওয়ে এখানে বাঁক নিয়ে চলে গেছে দূরের শহরে। এই বাঁকের এক পাশে গ্রাম অন্য পাশে হাসপাতাল খেলার মাঠ স্কুল থানা পোস্টাফিস। আবগারি দোকানও রয়েছে একটা। ঠিক তারই পাশে শুঁড়িখানা। তারপর ধুধু মাঠ—বন্ধুর নগ্ন একটা ব্যাপকতা, যতদূর চোখ যায়।

সপ্তায় দুদিন হাট বসে ধর্মরাজের প্রাচীন বটগাছের ছায়ার। কয়েকটি চায়ের দোকানও তার আনাচে কানাচে রয়েছে। এমনি এক দোকানে বসে তুষ্টুরামের সঙ্গে পরিচয়।

সেদিনই হাটবার ছিল। কোলাহলে মুখর ছিল পরিবেশ। অভ্যাস মতো ত্রিলোচনের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

ত্রিলোচনের দোকানটা ছিল বেশ মজার। সদর ও অন্দর দুটি ভাগে বিভক্ত। সদরে তার চায়ের সরঞ্জাম উনুন বিস্কুটের টিন গুটিকয় চেয়ার বেঞ্চ হাইওয়ের মুখোমুখি। তার পাশ গলিয়ে চটের পর্দা তুলে ঢুকলে অন্দর। সেখানে ঘরভর্তি একটা তক্তাপোশ—তাতে তেলচিটে মাদুর পাতা। উপরে ছিটে বেড়ার দেয়ালে মা কালীর ক্যালেন্ডার—যার নীচের দিকটা সিঁদুরের ছোপে অদ্ভুত হয়ে আছে। ব্রাকেটে দুটি—একটি ময়লা জামা কাপড়। তারপরই শুরু হল মোহিনী নারীমূর্তি—পৌরাণিক রাধিকার বস্ত্রহরণ থেকে শুরু করে বম্বের চিত্রতারকা অব্দি অগুনতি মেয়েমানুষ।

ত্রিলোচন বিয়ে করেনি। সে বলত, ‘এইতো তিন হাত জায়গার মালিক। নিজেরই কুলোয় না কোন হতভাগীকে এনে কষ্ট দোব।’ রামহরি মেকদার গোপনে দাঁত ছরকুটে মন্তব্য করত, ‘ব্যাটার জাতজাম্মোর ঠিক নেই। ভাসা হাঁড়ির মতো ঘাটে—অঘাটে ভেসে বেড়াচ্ছে। মেয়ে দেবে কে বলো?’ আমি জানতাম না কার কথায় সত্যতা আছে। তবে ত্রিলোচন তার মাথার পেছনটা দেখিয়ে একদিন বলেছিল, ‘দ্যাখো তো নন্দবাবু, মনে হচ্ছে কাদের যেন জাত গেছে; খুঁজে বের করো দিকি!’ নিঃসংকোচে সে আমাকে তার পেকে ওঠা চুলের খোঁজ খবর নিতে বলেছিল। পেছনের ছোট জানালা দিয়ে রোদের আলো ছড়িয়ে আসছিল ঘরে। সেই আলোয় সযত্নে তার দুটি পাকা চুল তুলে দিয়েছিলাম। তখন ত্রিলোচন ক্যালেন্ডারের দিকে ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকিয়ে ছিল। বলছিল, ‘এটা কত সাল?’ তারপর বিড়বিড় করে কী গোনার পর ফিক করে হেসে ফেলেছিল। ‘তাহলে পঁয়ত্রিশ পেরলাম। কিন্তু চুলের কী দোষ হল বলতে পার নন্দবাবু? নাকি গন্ধতেলের বিষ?’

আমি বলছিলাম, ‘অসম্ভব নয়। বরং নারকেল তেলই মেখো এবার থেকে।’

নিঃশব্দে মাথা নেড়েছিল ত্রিলোচন। তবলা জোড়া টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘চুলোয় যাক গে। এসো, খানিক হয়ে যাক।’ ডেনোর ওপর অনর্গল তেড়েকেটে তোলার পর হঠাৎ থেমে সে ফের বলেছিল, ‘নন্দবাবু মধ্যে মধ্যে খুবই ভয় পাই, জীবনটা তো চলেই যাচ্ছে ফুরোবার দিকে, কী যেন বাদ থেকে গেল। কিন্তু…’ কিছু সময় থেমে কথাটা শেষ করেছিল ত্রিলোচন, ‘এই জগৎটায় ডুবে গেলে সব তুচ্ছ হয়ে যায়।…কই লাগাও একখানা ঠুংরী গোছের বেশ জমাটি কিছু….’

সত্যি, সব তখন তুচ্ছ হয়ে গেছে। গানের গভীর সমুদ্রে আমাদের সবটুকু অস্তিত্ব ডুবুরির মতো খণ্ড খণ্ড অজ্ঞাত সত্যের মুক্তা সঞ্চয়ে ব্যাপৃত। আমরা বিশ্বাস করেছি, জীবনে ঈশ্বর যদি থাকে তা এই সুরের জগৎ। চেতনার সঙ্গে তা একাকার। শরীরের জৈব কোষগুলি সুরের আগুনে ফসফরাসের মতো জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে গেছে। তন্ময়তার এক উজ্জ্বল অগ্নিস্রোত লেহন করছে সত্তাকে। ত্রিলোচন ঝুঁকে পড়েছে তবলার ওপর। স্রোতে ভাসমান শবদেহের মতো তার শরীর শিথিল শীতল মাংসপিণ্ড মাত্র। এবং তখনই হঠাৎ জেগে দেয়ালের দিকে তার যত্নে টাঙানো ছবিগুলি আমি দেখে নিয়েছি। নগ্ন কালীমূর্তিতে সিঁদুরের ছোপ আর অপরূপা সব মানবী…দিনক্ষণসময়ের লালরঙে চিহ্নিত সংখ্যাবলী—যা নিয়ে ত্রিলোচন কোনো কোনো দুঃসহ বেঁচে থাকবার চেষ্টা করে।

বেকার ক্লান্ত বিক্ষত সেই দিনগুলিতে ত্রিলোচনের ছোট্ট অন্দর আমাকে টেনেছে নিবিড়ভাবে। মনে হয়েছে, না গেলে কত কী ফুরিয়ে যায়।

জীর্ণ মলিন মাদুরের ওপর হারমোনিয়াম, বাঁশী, খঞ্জনী আর তবলা দুটি ছিল ছাড়পত্রের কয়েকটি বিবরণ। হাতে নিলে আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে যায়।

ফাল্গুনের শেষ সময় তখন। হাইওয়ের ধারে কৃষ্ণচূড়ার গাছে থরে থরে ফুল ফুটেছিল। নগ্ন দূর মাঠের নিঃসঙ্গ শিমুলের শীর্ষেও রক্তবর্ণ ফুলের মালা বসেছিল। দক্ষিণের বাতাস বইছিল একটু করে। ত্রিলোচনের অন্দরে বসে আমি হারমোনিয়ামে এলোমেলো সুর তুলছিলাম। রিড থেকে রিডে ছেলেমানুষি বিহ্বলতায় আঙুলগুলি সঞ্চালিত হচ্ছিল।

সেদিন হাটবার।

ত্রিলোচন সদরে বসে খদ্দেরদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মধ্যে মধ্যে তার চামচ নাড়ার মিষ্টি শব্দ, ছাঁকনির ঠকঠক, পয়সা গোনাও শুনতে পাচ্ছিলাম। বাইরের তুখোড় হট্টগোল ভেদ করে তার এই জীবনযাত্রার ছোট্ট একটা দিক প্রকট হচ্ছিল এতে। আমার হাসি পাচ্ছিল। ত্রিলোচনের একটা কথা মনে পড়েছিল। সে বলত, ‘আচ্ছা নন্দবাবু, বিধাতা সবই দিলেন ইচ্ছা বাসনা কামনা; ষড়রিপুও দিলেন। তা বেশ করলেন। কিন্তু এইটে কেন দিলেন বাপু?’ পেটটা বাজিয়ে সে এইসব বলত। ‘শুধু ইনিকে বাদ দিলে যা হত না। সে এক মজার কাণ্ড!’ হিহি করে সে হাসত। তার এই হাসির গভীর দুঃখটা আমি বুঝতাম। আসলে সে একজন যথার্থ গুণীলোক। অথচ নেহাত পেটের জন্যই তাকে কী হাস্যকর চেহারা নিতে হয়। খদ্দেরের সঙ্গে বচসা, গরম জলের চিৎকার, উনুনের চোখ রাঙানি—এসবের মধ্যে বিপন্ন ত্রিলোচনকে মনে হত দীর্ঘমেয়াদি কয়েদির মতো—যে এগুলি ফাঁকি দিলে সতর্ক সেপাইয়ের বুট—বেটন খাবে। দুঃখিত হতাম তাকে দেখে।

ত্রিলোচনের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর শুনলাম। ‘মাফ কর দাদা, ওসব অনেক দেখেছি। তিল তাল হয়ে ওঠে দেব—দিচ্ছি করে। তারপর রাতারাতি বোঁচকাবুঁচকি বেঁধে উধাও। তখন মরো না পাছা চাপড়ে।’

অপরিচিত কণ্ঠ হা হা করে হেসে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে। তেমন প্রাণখোলা হাসি আমি জীবনে শুনিনি। ‘বাপরে বাপ। আপনি তো দেখছি পোড়—খাওয়া আদমি।’

ত্রিলোচন বলল, ‘সেবারে একটা সার্কেস এল। রংচং দেখে মনে হয়, না জানি সব কত মহাজন ব্যক্তি। টাই সুট বুট লাগিয়ে সপ্তায় চোদ্দশো কাপ চা খেয়ে গেল। একদিন সকালে উঠে দেখি, ও মা…শুধু মুরগির পালক, পেয়াজের গুচ্ছের খোসা, মাটির চাঙড় আর পোড়া ইট নিয়ে ময়দানটা দাঁত ছরকুট পড়ে রয়েছে। বাসি মড়া একেবারে।—’

লোকটা আর হাসছে না। বলল, ‘লেকিন এটা সার্কাস নয় রে দাদা। সার্কাসে ওসব হয়। আমাদের হচ্ছে ভ্যারাইটি শো। মালিকও মস্তো আদমি। দু—চারদিন শো বন্ধ থাকলে দুশো পাঁচশো পকেট থেকে হামেশা ছুঁড়ে দ্যান। আলাপ হলে দেখবেন, যা বলেছি ঠিক কি না।’

ত্রিলোচন দাঁত খিঁচিয়ে উঠল। ‘রাখুন মশাই। একই রোগা বাঘ আর একটা খোঁড়া সজারু নিয়ে আর গুমোর করবেন না। চেহারা দেখেই বুঝেছি।’

লোকটিও রেগেছে এবার। ‘ইচ্ছে হয় দেবেন, না হয়, না। তা বলে যা তা বলবেন না। আমাদের পার্টির একটা ইজ্জত আছে। শুধু বাঘ—ভেড়া নিয়ে খেল দেখাই নে। মোহিনী মেয়েছেলেও রয়েছে। গান শুনলে তামাম চকবাজার পায়ে সেলাম বাজিয়ে যাবে।…’

এমনভাবে কথা বলছে, যেন এই সুযোগে একটা বিজ্ঞাপনও ঘোষণা করছে সে। তারপর সত্যি সত্যি অনর্গল উচ্চকণ্ঠে সে তার পার্টির ক্রিয়াকাণ্ডগুলি বলে গেল। একটা অদ্ভুত সাপিনী—তার নাম আমিনা। তাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েমানুষ নাচে। নাচতে নাচতে গান করে। আর ওই ভয়ংকর বাঘটার নাম ‘ওসমান খাঁ’। সেও ভি নাচে আমিনাকে কোলে নিয়ে। আমিনা তার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। তারপর আছে বুঢ়ুয়া সজারু। সব সময় সে ঝিমুচ্ছে। দানাপানি খেতে ইচ্ছে নেই। গুটিসুটি বসে কী সব ভাবছে। কিন্তু স্টেজে এনে খাঁচা খুলে দিল। সব সে বঢ়িয়া আউরত তাকে গানের সুরে ডাক দিল। শেষে নাচতে ভি থাকল। তখন…বাস রে বাস, কাঁটাগুলি খিট খিট করে বাজছে তালে তালে। সে মাতাল হয়ে যাচ্ছে।

…আর জানো রে দাদা, বুঢ়ুয়া একটা সজারু। বনের জানোয়ার। কিন্তু সে মানুষের মতো কাঁদে। সজারুর চোখে জল। ঝরে পড়ে আঁসুর ফোঁটা। ধারালো কাঁটাগুলি বেয়ে খাঁচার শক্ত পাটাতনে টুপটাপ পড়ে। যদি বলেন, ও তো একটা অবোলা সজারু, লেকিন কাঁদে কেন?

…কেন? তো পুছে লিন ওর কাছে। ওর বাইরের কাঁটা ভেতরের দিলেও নাকি ঢুকে গেছে কখন। বুঢ়ুয়ার বহুটা মরে গেছে ভাই রে…নসিব!

আবার সেই প্রাণখোলা হা হা হাসি। স্থির থাকতে পারলাম না। বেরিয়ে গেলাম বক্তাকে দেখতে। দেখলাম ছোটখাটো একটি মধ্যবয়সি মানুষ। চুলগুলি ঠিক সজারুর মতোই খাড়া। বড় ডাঁসালো গোঁফ স্থূল নাকের নীচে এক হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কানের বাঁধে ঘন লোম। তেমনি ওর গলার নীচে শার্টের ফাঁকে উঁকি মারছে। হাত দুটি কনুই অব্দি খোলা। সেখানেও লোমারণ্য। প্যান্ট পরিহিত লোমবহুল হ্রস্ব শরীর এই লোকটি আমাকে আকর্ষণ করছিল।

ত্রিলোচন চুপ মেরে গেছে ততক্ষণে। আমাকে দেখেই মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে যা ভাবছিল তা নয়। একটা গুহ্যতত্ত্ব থাকলেও থাকতে পারে।

বললাম, ‘এসো দাদা। বসো এখানে।’

জোড়হাতে নমস্কার করে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। বসবো বৈকি। বসতেই তো এসেছি আপনাদের দেশে। কিন্তু দোকানদার মশাই কেমন বেরসিক দেখুন…’

পাশে বসে সে বলল, ‘আমার নাম আজ্ঞে, তুষ্টুরাম। শোতে দেখবেন হামেশা। খেলা কসরতও জানি, লোক হাসাতেও পারি।’

ত্রিলোচন বলল, ‘ও। ক্লাউন।’

তুষ্টুরাম ফের নমস্কার করে বলল, ‘ঠিক বলেছো দাদা। কালাউনই বটে।’

আমি বললাম, ‘চা দাও ত্রিলোচন। দুটো।’

ত্রিলোচন ভ্রূভঙ্গি করে লুকিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘গানের ব্যাপার আছে বলল গো, শুনেছেন?’

তুষ্টুরাম অন্দরের দিকে হঠাৎ ঝুঁকে উঁকি মেরে বলল, ‘ও হো! তাই বলুন। অনেকক্ষণ থেকে পোঁ পোঁ কানে আসছিল। কথায় বলে নাড়ির টান। তাতে জহ্বরি জহর না চিনলে চিনবে কে? বুঝলেন স্যার? আমিও অল্পস্বল্প চলাফেরা করি ও লাইনে। সঙ্গদোষ বলতে পারেন। নয়নতারা গাইতে বসলে সংগত—টংগত করতে হয়। পার্টিতে আর সবাই তো ও বিদ্যেতে অষ্টরম্ভা।…’

প্রশ্ন করলাম, ‘কে বললে?’

‘নয়নতারা।’ তুষ্টুরাম চোখ নাচিয়ে নিঃশব্দে হাসল।

‘সে—ই বুঝি ভালো গায়?’

‘শুধু গায় না, নাচেও ভালো। যাবেন, আলাপ করিয়ে দোব।’ তুষ্টুরাম গভীর তৃপ্তিতে চা খেতে থাকল।

তুষ্টুরামের হাত ধরেই প্রবেশ করেছিলাম সেদিন। আবগারি দোকান আর শুঁড়িখানার মাঝামাঝি ফাঁকা একটুকরো জমিতে ছোটবড়ো কয়েকটা কাঠের খাঁচা, সারবন্দী বাক্স—পেটরা লোহার রড আর খুঁটিখাম্বাগুলি পড়ে ছিল। একদল লোক শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ছিল। অদ্ভুত চিত্রবিচিত্র পোশাক পরা আরও কয়েকজন জমিটার চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল। ঠিক মধ্যখানে স্থূল ও দীর্ঘ একটি শালকাঠের মাস্তুল কপিকল রশারশি ও প্রকাণ্ড কাপড়ের বান্ডিল। তুষ্টুরাম না বলে দিলেও জানতাম ওটা তাঁবু। তুষ্টুরাম পরিহাসের ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘উও ভি একটা জানোয়ার। হাঁ করলে আদমিরা পেটে সেঁধিয়ে যায়।’ এবং বিকট মুখব্যাদানের অপেক্ষায় একটা রহস্যময় জন্তুর মতোই যেন জাবর কাটছিল গুটোনো তাঁবুটা। তাকে জীর্ণ ও ঝুলিমলিন দেখাচ্ছিল। ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। আর তার ঠিক পিঠের ওপর বসেছিল দৈত্যাকৃতি একটা লোক। স্থূল কিন্তু তীক্ষ্ন নাক, তুষ্টুরামের মতো গোঁফ, মাথায় টাক। তার পরনে ওই তাঁবুর রঙের ধূসর একটা পাঞ্জাবি ও ধুতি। পায়ের পাম্পশু জোড়াও ঈষৎ মলিন ও জীর্ণ। তারপর তার মুখের দিকে সোজাসুজি না তাকিয়েও হাতের ময়ূরমুখো কালো ছড়িটা সমেত ওই বিরাট অস্তিত্ব ঈষৎ সমীহ জাগিয়েছিল আমার মনে। ঠিক অন্য কোনো কারণেও নয়, তুষ্টুরামকথিত জন্তুটার যথার্থ মালিককে আমি অনুভব করেছিলাম তক্ষুণি।

তুষ্টুরাম হঠাৎ থেমে মিলিটারি কায়দায় জুতো ঠুকে স্প্রিঙের মতো একখানি সেলাম ঠুকেছিল। তারপর আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘মালিক। দুর্গামোহনবাবু।’

জানি না কে আমার হাত দুটি তুলে আমাকে নমস্কার করিয়ে দিল। আমার শিক্ষাদীক্ষার বোধ, সকল অহংকার দুর্গামোহনের প্রথম দৃষ্টিপাতেই জ্বলে খাক হয়ে গেল যেন। আমি গুটিয়ে যাচ্ছিলাম একটু করে। চকবাজারের সবচেয়ে গুণী ও জনপ্রিয় একটি ভালো ছেলে নন্দ ঠিক খাঁচায় পোরা প্রাণীদের মতো বশ মেনে গেল।

পরে বহুবার এই দীনতা ও সংকোচবোধ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল আমার মধ্যে। এ বিরোধ থেকে বিদ্রোহের বীজ এমনি করে উদগত হয়েছিল পরবর্তী জীবনে।

তুষ্টুরাম চুপিচুপি আমাকে বলেছিল, ‘নন্দবাবু, ও লোকটা বহুত জাদুর খেল জানে। ও জানোয়ারের সামনে এলে জানোয়ার ভি মাথা লুটিয়ে দ্যায় পায়ে। লেকিন, বলুন তো দাদা, আমরাও কি জানোয়ার? দেখুন তো, হাজার লোক তাঁবুর ভেতর খেল দেখছে। অপসন্দ হলে চেল্লাচ্ছে। পসন্দ হলেও ভি চেল্লাচ্ছে। কিন্তু মালিকবাবু যেই এসে বলল, চুপ, চুপ…আমার একটা কথা শোনেন আপনারা…বাস, সব চুপ। চুহা ভি দাঁতে মাটি কাটতে ভুলে গেছে।’

ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম এ কথা শুনে। প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই এই প্রশ্ন মনে জেগেছিল বলে ক্ষোভটা বুঝি চলছিল একটানা। আমাদের ভিতর বুঝি একটা নিতান্ত জানোয়ার লুকিয়ে রয়েছে। দুর্গামোহনকে তারা ভয় পায়। প্রথম দৃষ্টিপাতেই সে চমকে উঠেছিল। সম্মোহিত হয়েছিল।

নাকি অন্য কিছু?

তুষ্টুরাম তারপর আমাকে জমিটার শেষপ্রান্তে নিয়ে গেল। ঘন ফণিমনসা আর কাঁটামাদারের গাছে ছোটখাটো একটা দুর্ভেদ্য জঙ্গল সেখানে। গ্রামের পরিত্যক্ত মৃৎপাত্রের টুকরো ছড়ানো চারপাশে। কিছু আবর্জনা। আঁতুরঘরের নোংরা ছাইপাঁশ ও ন্যাকড়া। বীভৎস গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। তুষ্টুরাম নাকে রুমাল দিয়েছিল।

তার একপাশে শিরীষ গাছের নীচে ততক্ষণে একটা ত্রিপলের তাঁবু তৈরি হয়ে গেছে। ফাল্গুন মাসের কাঁটামাদার গাছ থেকে একটি মেয়ে লাল লাল ফুল তুলছিল। তার খোঁপাটা ঝুলে পড়েছিল পিঠে। চিত্রিত হলুদ শাড়ি থেকে আঁচলটাও লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। নগ্ন বলে পায়ের পাতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। থেমে যেতেই তুষ্টুরাম মুচকি হাসল। ‘জাদুকা খেল দেখুন স্যার।’

প্রশ্ন করলাম, ‘কে ও?’

তুষ্টুরাম হঠাৎ আমার হাত ধরে তালুতে একটু চাপ দিল। অশ্লীল ধরনের একটা ইঙ্গিত যেন প্রচ্ছন্ন তাতে। অথচ আমার ভালো লাগল। আমি কি ততক্ষণে ঠিক জানোয়ার হয়ে গেছি? আমি যখন পা তুললাম, মনে হয় বড়ো ক্লান্ত। আমার জানু দুটি ভারী বোধ হচ্ছিল। এবং বিস্মিত হয়ে আরও অনুভব করলাম, আমার বুক কাঁপছে। তুষ্টুরাম বলল, ‘নয়নতারা।’

তারপর নয়নতারা মুখ ফেরাল। পাথরের একখানি মুখ। যে উচ্ছলতার আশা করছিলাম, তা ছিল না ও মুখে। তারপর সে ফুলগুলি নিয়ে যত অগ্রসর হল, তাতে আমার প্রত্যাশিত আক্রমণাত্মক কিছু নেই। তার পদক্ষেপগুলি শান্ত। তার হলুদ শাড়ি কালো ব্লাউস খুবই নিস্তেজ। তুষ্টুরামকে দেখে সে একটু হাসল। তার হাসিটুকুও বেশ অনিচ্ছুক। পাণ্ডুর মুখের ওই হাসি, যতখানি ভেবেছিলাম, গ্রাস করতে পারছিল না আমাকে।

একদিন কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতে আমি নদীর ওপারে নিঃসঙ্গ চলে গিয়েছিলাম। বাঁশি বাজানোর একটা সেকেলে খেয়াল আমাকে সে—রাত এরূপ বিভ্রান্ত করেছিল। নদীপারের বিস্তৃত প্রান্তরে কাশবনের শীর্ষে কৃষ্ণাতিথির ক্ষীণ চাঁদটা দেখতে দেখতে ঠিক যেমন হতাশাব্যঞ্জক অনুভূতি আমাকে কাতর করেছিল, শেষরাতের সে ক্লান্তি ও অর্থহীনতা অবিকল মনে পড়ে গেল।

কোনো সুর কোনো দৃশ্য যেমন মনে পড়িয়ে দ্যায় কোনো অলৌকিক অথবা রহস্যময় ঘটনার কথা—যে—ঘটনার সবিশেষ আমরা জানি না…

অথচ মনে হয়। শুধু মনে হয়। ঠিক সেরূপ মনে হওয়া জেগে উঠতে আরও কিছু দেরি ছিল সে—মুহূর্তে।

অথচ সেই অজ্ঞাত জেগে ওঠার ক্ষণ ভ্রূণরূপে সুপ্ত ছিল আমারই মনে। তাই কি নয়নতারার পাথরের প্রতিমার চোখ দুটি আমাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে গেল?

স্পষ্ট জানতাম না। একটু হেসে প্রতি—নমস্কার করার সময়ও হঠাৎ জেগে—ওঠা লালিত আভিজাত্যবোধ ফের সংকুচিত করছিল আমাকে। তবু বাইরে পেতে রাখা তক্তপোশে আমি বসলাম। তুষ্টুরাম বলল, ‘জবরদস্তু গানেওলা গো। আপনা কানসে শুনে এলাম।’

নয়নতারা স্থিরচোখে আমাকে নিরীক্ষণ করছিল। এবার নীরসমুখে বলল, ‘বেশ তো। ভালো।’

উত্তরোত্তর আমার ক্ষোভের কারণ ছিল তার এই নিস্তেজ আচরণে। তাই এবার মুখোমুখি ওর দিকে তাকালাম। প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি ভালো গাইতে পারেন। তাই না?’

জবাব দিল তুষ্টুরাম। হাততালি দিয়ে বলল, ‘বাপ রে বাপ। স্টেজে দেখবেন, না শুনবেন? য্যায়সা নাচ, ত্যায়সা গান। বলছিলাম না বুঢ়ুয়াকে মাতাল করে দ্যায়। মানুষ তো মানুষ। আদমি!’ হা হা করে হাসতে থাকল সে।

বললাম, অসুবিধে না হলে হোক না একখানা।

নয়নতারা জবাব দিল না। তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেল। স্টোভের পাশে একটা থালায় আনাজ কোটা ছিল। একটা শূন্য বালতি নিয়ে সে বেরিয়ে এল। তারপর ডাকল, ‘ডিব্বু, ওরে ডিব্বু।’

বাঘের খাঁচায় ওপার থেকে একটি বছর সাতেকের ছেলে ছুটে এল। পরনে খাঁকি হাফপ্যান্ট। উদোম গা। পা—দুটিতে জুতো নেই সুশ্রী হাসিখুশি ছেলেটি নয়নতারার হাত থেকে বালতি নিয়ে হাটতলার দিকে চলে গেল।

বললাম ‘কে ও?’

তুষ্টুরাম ইতস্তত করছিল যেন। নয়নতারা বলল, ‘আমার ছেলে।’

বিস্মৃত হয়ে তার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকালাম। তখনই তার কপালে অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাটা দাগটা দেখতে পেলাম। এই দাগটা তার মুখের শ্রী—কে পরিস্ফুট করেছে। এবং বয়সের ব্যাপারে আমার হিসেবের গলতিটুকুও তখন ধরা পড়ে গেছে। কত বয়স হতে পারে তবে? চব্বিশ? ছাব্বিশ? আমার মন ঈষৎ কটু হয়ে গেল এই হিসেব—নিকেশে। দিদির বয়সি একটি মেয়ের সম্পর্কে আমি কিছু অশ্লীল চিন্তার অপরাধে অপরাধী। এবং এই বোধ আমাকে ছন্নছাড়া করছিল। নয়নতারার মাতৃত্বকে আমি অপমান করেছি মনে মনে। হয়তো এ দোষ তুষ্টুরামের ভঙ্গিগুলি থেকে জন্মেছিল। ক্ষুব্ধভাবে বললাম, ‘তুষ্টুরাম, এখন উঠি ভাই। পরে আসব।’

তুষ্টুরাম কিন্তু অন্যমনস্ক। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আসবেন। জরুর আসবেন।’

উঠে আসছিলাম। সুমুখে দুর্গামোহনকে দেখে দাঁড়ালাম। দুর্গামোহন হাসল। ‘চলে যাচ্ছেন যে? আপনাদের দেশে নতুন এলাম মশাই, আলাপ—টালাপ না হতেই কেটে পড়ছেন? বেশ লোক আপনি। আসুন আসুন…’ হাত ধরে টানল দুর্গামোহন। ‘মুসাফিরি লাইন আমার। তবু যেখানে দুদণ্ড বসি, সেখানেই নাড়ির টান বসে যায়। জীবনটা তো এই করেই কাটল…’

অনর্গল কথা বলতে বলতে সে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। তার মধ্যে ভীতিকর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। এবং রজ্জুতে সর্পভ্রমের নিরসনে সরল আনন্দ আমাকে পেয়ে বসেছিল। তক্তপোশটা রুমালে ঝেড়েপুঁছে দুর্গামোহন চাপড় মারল। বলল, ‘বসুন এখানে। এখনও কিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। সাঁইথে থেকে পৌঁছেছি সেই ভোর রাতে। লোকজন লাগিয়ে দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে। আজ সন্ধেতেই শো দেব।’ তারপর বলল, ‘বাবা, তুষ্টুরাম, এক কেটলি চা নিয়ে আয় দিকি।’

তুষ্টুরাম মুখ নিচু করে বলল, ‘এখানে দোকানগুলো যেন কী। বিশ্বাসই করতে চায় না স্যার। খুব ফ্যাসাদ বেধেছিল খানিক আগে।’

‘ঘাবড়াও মাৎ।’ দুর্গামোহন কেটলিটা তার হাতে গুঁজে দিল। তারপর পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ছুঁড়ে মারল ঠিক মুখের ওপর। তুষ্টুরাম সেটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।

দুর্গামোহন বলল, ‘কী রে নয়ন, চুপচাপ বসে কেন? রান্না চাপালি নে?’

নয়নতারা বলল, ‘ডিব্বু জল আনতে গেছে।’

‘কী মুশকিল!’ দুর্গামোহন হাটের দিকে ব্যস্তভাবে তাকাল। বলল, ‘কেন, ওকে পাঠালি কেন? আ হা, বেচারা।’

‘আর কে যাবে! সব্বাই তো ওদিকে ব্যস্ত।’

‘কেন, তুষ্টুরাম তো ছিল!’

নয়নতারা জবাব দিল না।

দুর্গামোহন বলল, মরুক গে। এখন আয় দিকি এখানে। বাবুজীকে একখানা শুনিয়ে দে। ঘরে গিয়ে নাম করবেন। ওনারা নাম করলেই আমাদের মানসম্মান। নইলে পোঁছে কে? কী বলেন মশাই?’

দুর্গামোহন জোর হাসছিল। তার শরীর দুলছিল। তক্তপোশটার কাঁপুনি অনুভব করছিলাম। কিন্তু সে হাসি ঘোর নিঃশব্দ। এত নিঃশব্দে প্রচণ্ড হাসি আমি কোথাও দেখিনি। নয়নতারা পেছন ফিরে একটা বাক্সর ওপর ঝুঁকে পড়ল। অস্ফুট স্বরে কী সে বলছিল। তারপর ডালা খুলে একটা হারমোনিয়াম বের করল।

তক্তপোশে এনে রাখবার সময় সে হাঁফাবার ভান করছিল। বলল, ‘বাব্বা! একটা সেকেলে সিন্দুক!’ সাড়ে তিন অক্টেভো সেই বিরাট হারমোনিয়ামটা দেখে আমি ঠিক বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দুর্গামোহন সোল্লাসে বলল, ‘আরে বাঃ বা! আপনিও দেখছি মশাই একজন গুণীলোক। নয়ন, তোর রান্নার লোক দিচ্ছি আমি। সকাল বেলাতেই শুভযাত্রা হয়ে যাক।’

বলতে বলতে তুষ্টুরামও হাজির এদিকে। দুর্গামোহন বলল, ‘বাবা তুষ্টু, খুব তুষ্টু হয়েছি তোর ওপর। তবলা বাঁয়া বের কর।’ নয়নতারা কাপে চা এগিয়ে দিল। হারমোনিয়ামের ওপর কাপটা রেখে, তবলায় সুর বাঁধবার আগেই গান গেয়ে উঠলাম। মীরার ভজন।

এই যন্ত্রটায় যে সুর উঠেছিল তা যেন দূর ও গভীর থেকে। যেন একটা প্রাচীন বিষাদ এর কাঠ ও ধাতুনির্মিত পাতগুলির খোলস অতিক্রম করে আসবার সময় শুধু একটা করুণ আর্তিকেই বহন করতে সমর্থ হচ্ছিল। হাইওয়েতে নিয়ত চলমান যানবাহনের গর্জন, হাটতলার কোলাহল, এখানে চারপাশে কর্মরত লোকগুলির শ্বাসক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর…সবকিছুর ওপর যেন একটা নিস্তল অসহায়তার সৃষ্টি করছিল সে। এবং এই বিষাদময় সুরাবরণের অন্তরালে দুর্গামোহনের মুখ ধূসর হয়ে উঠেছিল। তার ছড়িটা অস্পষ্টভাবে সঞ্চালিত হচ্ছিল। তুষ্টুরামের তবলার ধ্বনিপুঞ্জ দ্রুততালে সেই ঘোরঘন বিষাদের ওপর ক্ষিপ্র বুনুনিতে নকশা আঁকছিল। ঠিক বহুছিদ্রবিশিষ্ট বিস্তৃত জালের আড়ালে মৃত মৎস্যের মতো ভাসমান নয়নতারাকে দেখছিলাম।

স্ককপোলকল্পিত বিভ্রমের ঘোর মুহূর্তে কেটে গেছে তারপর।

অন্তরার শেষ কলি এবার নয়নতারাই গেয়ে উঠেছে।

শিরীষগাছের ভঙ্গুর কাচের মতো লঘু—ছায়ার তক্তপোশটা ইতিমধ্যে আবৃত হয়েছে। তুষ্টুরামের বোল বদলে যাচ্ছে এবার। নয়নতারা আড়চোখে চেয়ে বলল, ‘ঠিকসে বাজাও।’

সলজ্জমুখে হার স্বীকার করেছিল নয়নতারা। দুর্গামোহন ঘাড় কাৎ করে বসে ছিল। শেষে বলেছিল, ‘আপনি কী করেন?’

বলেছিলাম, ‘কিছু না। পড়াশুনা শেষ করে বসে আছি। চাকরি খুঁজছি।’

‘ঘরে কে আছে?’

‘বাবা। মা নেই।’

‘ভাইবোন?’

‘কেউ নেই।’

‘বাবা কী করেন?’

‘স্কুল মাস্টার।’

দুর্গামোহন কী বলতে যাচ্ছিল। তার কথা থামিয়ে নয়নতারার গান শুনতে পেলাম আবার। ‘পরজনমে…রাধা হয়ো তুমি প্রিয়…’

দুর্গামোহন আবার নিঃশব্দে সেই হাসি হাসতে থাকল। ভ্রূকুঞ্চিত করে চাপা গলায় বলল, ‘ছাড়ছে না আপনাকে। অনেক ঘাটের ইয়ে তো…’

তুষ্টুরাম তবলায় চাঁটি মেরে বলল, ‘মড়া।’

নয়নতারা একটু হাসল মেরে, ‘মড়া’।

নয়নতারা একটু হাসল মাত্র। লক্ষ্য করলাম একেবারে এগারো পর্দায় গলা দিয়েছে। হাসি পাচ্ছিল। শেষরক্ষা হলে হয়।

কিন্তু…কিন্তু আমাকে যথার্থ বিস্মিত করল সে। এবং এ বিস্ময় আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে তার গান আমাকে কেমন অস্থির করে তুলল। চারপাশ থেকে তার সুর আমাকে আক্রমণ করছিল। এ বিষাদ নয়। এ ছিল তীব্র, সুতীব্র এক জ্বালা। দাবানলের মতো তার গান গ্রাস করছিল আমার সত্তাকে। উজ্জ্বল অগ্নিশিখা আমাকে লেহন করছিল। তার কণ্ঠস্বরে সুরের যাত্রায় প্রতি বাঁকে একটি করে জ্বলন্ত মশাল সঞ্চালিত করে পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল।

ডিব্বু ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। তাকে ডেকে বললাম, ‘খোকা, একটা কথা শুনবে?’

সে মাথা নাড়ল।

‘ওই দোকানে একটা লোক আছে। তার নাম ত্রিলোচন। তাকে গিয়ে বলো, নন্দবাবু বাঁশিটা দিতে বললেন।’

একটা অমানুষি ধরনের ছেলেমানুষি আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাঁশি দিয়ে আমি আত্মরক্ষার ভান করছিলাম। এ খেলার কোনো অর্থ হয় না। শিক্ষাদীক্ষা রুচি সব ভুলে গিয়েছিলাম।

নাকি সবই দুর্গামোহনের আরোপিত একটা কারচুপি? তুষ্টুরাম তারই ম্যাজিকযষ্টির ইঙ্গিতে আমাকে এখানে ওতপ্রোত সংলগ্ন করতে পারল? আমার পরিচিত নিজ মাংসময় অস্থিময় বিস্তার খণ্ড খণ্ড ছিন্নভিন্ন হয়ে কোথায় মিশে গেল।

‘আমার মতন কাঁদিও…রাধা হয়ো তুমি প্রিয়, হে প্রিয়…’

রোদে এসে ছায়াকে সরিয়ে দিলে ঘর্মাক্ত শরীরে এক সময় আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুর্গামোহন কিছু বলার আগে নয়নতারা বলল, ‘আবার আসবেন। খুব ভালো লাগল।’

তুষ্টুরাম আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল। হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে সে নমস্কার করল। ‘আসুন তাহলে। ও বেলা শো দেখতেও আসবেন। ভুলবেন না।’

ত্রিলোচন ডাকছিল দেখতে পেয়ে। সেদিকে এগোতেই ফের তুষ্টুরাম পেছন থেকে বলল, ‘একটা কথা নন্দবাবু, আপনাকে আমার খুব পসন্দ হয়েছে, তাই বলছি। দয়া করে অন্য কান করবেন না যেন।’

বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘বলো।’

ময়দানটার দিকে দ্রুত একবার চেয়ে চাপা গলায় সে বলল, ‘এখানে আসবার সময় পকেটে যেন টাকা পয়সা কিছু আনবেন না।’

‘কেন?’

সে চোখ টিপল। ‘বলছি। মালিকবাবু আপনাকে খাতির করল কেন, তা তো জানেন না। পরে জানতে পারবেন। তবে নয়নতারা…সে অবশ্যি মেয়েমানুষ। মনটাও সাদা ছিল। এখন দুগগামোহনের হাতের গুটি হয়ে গেছে।’

আমার কৌতুহল চাঙ্গা করে হঠাৎ সে দ্রুত চলে গেল।

সারা দুপুর আমি অস্থির হয়ে থাকলাম সেদিন। প্রতিটি মুহূর্ত বিকেলের দিকে আর অগ্রসর হতে পারছিল না যেন। এত শ্লথগতি সময় কোনোদিন অনুভব করিনি।

এবং তুষ্টুরামের প্রতি অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া সঞ্চারিত হচ্ছিল। লোকটা কোনো কারণে দলের প্রতি অসন্তুষ্ট। তাই কি বিশ্বাসঘাতক? আস্তে আস্তে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিষ কেমন করে দানা বাঁধল আমার মধ্যে। সে শূন্য পকেটে যেতে বলছিল। আমি টাকা পয়সার কথা ভাবছিলাম। প্রয়োজন কী, জানতাম না তবু মনে হচ্ছিল এই দিয়েই হয়তো বা সে রহস্যে প্রবেশ করতে পারি। কিংবা ভাবছিলাম শূন্য পকেটে সেখানে যাওয়া আমার মর্যাদার পক্ষে ঠিক নয়। কিংবা এমনও হতে পারে দুর্গামোহন আমাকে আর গ্রাহ্য করবে না।

একটা গভীর নেশা বিস্তৃত হয়েছিল যেন। বিকেলে ত্রিলোচনকে বললাম, ‘দশটা টাকা হবে ত্রিলোচন? খুব দরকার।’

কোনোদিন নিইনি বলেই ত্রিলোচন নিঃসংকোচে টাকা দিয়েছিল আমাকে। এবং গর্বিত পদক্ষেপে তাঁবুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। দরজার ওপরে মাচায় জয়ঢাক ও ভেঁপু বাজছিল। তুষ্টুরাম অঙ্গভঙ্গি করে ক্লাউন সেজে চিৎকার করছিল। …আসুন, দেখে যান। আমিনা সাপিনী, ওসমান খাঁ বাঘ, সজারু….আর সব সে….দুনিয়ার সব সে বঢ়িয়া এসটার আউরত আপনার আঁখো কে তারা…

তাঁবু প্রদক্ষিণ করে যেতে—যেতে একটু থমকে দাঁড়ালাম। একটা ছোকরা পাশে দরজা টাঙাচ্ছিল। ওপরে লেখা : ‘মহিলাগণ’ সে পেছন ফিরে ভেতরে কাকে বলল, ‘শালা হামবাগ কাঁহেকা। স্টার আউরত! নিজের বউকে ভাঙিয়ে পেট চালাচ্ছে। লজ্জা করে না শয়তানটার।’

আমার সর্বাঙ্গ দারুণ চমক খেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওরা কি নয়নতারার কথা বলল? নয়নতারা তুষ্টুরাম ক্লাউনের বউ?

নয়নতারা তার তাঁবুতে বসে সাজছিল। মুখে সফেদা—মিনার পেন্ট। কাজলের ভ্রূ। কপালে লাল টিপ। দুহাত তুলে খোঁপায় ফুল গুঁজছিল সে। এবং ঠিক তখনই প্রথম—একেবারে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম তার সিঁথিতে দীর্ঘ উজ্জ্বল রক্তলাল সিঁদুর।

আমাকে দেখে মুখ তুলে সে হাসল। এ হাসি আগেকার সে পাথরের প্রতিমা—মূর্তির নয়। জীবন্ত মানুষের। যুবতী মেয়েমানুষের। এ—হাসি ভীষণভাবে প্রাণবন্ত। নিদারুণ অগ্নিময়। পুরুষ দ্রষ্টার সমুদয় কোষগুলি সে বারুদের মতো বিস্ফারিত করে।

ত্রিলোচনের টাকাটা আলতো হাতে একবার অনুভব করে নিয়েছিলাম তক্ষুনি।