নয়
কবীর দোতলার ঘরে সোজা হয়ে বসেছিল চেয়ারে—জানালার ধারে। এখান থেকে কুসুমগঞ্জের বাইরে দূরের মাঠ ও নদী দেখা যায়। এখন অন্ধকার। শুধু কুসুমগঞ্জের এক বিস্তীর্ণ অংশে আলোর সাজানোগোছানো মালাটা লক্ষ্য করা যায়। ইলেকট্রিফায়েড গ্রাম কুসুমগঞ্জ। গ্রামনগরী। সেকালে একালে একাকার এক বিচিত্র বস্তু—ভারতবর্ষের পাঁচসালা যোজনার গর্ভ থেকে সদ্যোজাত এক কিম্ভূতদর্শন প্রাণী।
টেবিল ল্যাম্পটা নিবিয়ে তারপর ছাদে উঠে গিয়েছিল সে। একটা বালিশ আর মাদুর নিয়েছিল। ফ্যানের হাওয়ার গা জ্বালা করে।
আলিসায় ঝুঁকে দূর দিগন্তটা লক্ষ্য করছিল সে। রহস্যময় রাত্রির পৃথিবী ওখানে আকাশের সীমান্তে একটা চাপা আহ্বান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। প্রস্তুত হও নভোশ্চর, যাত্রা তোমার জানা থেকে অজানায়। সেখানে হয়তো অপেক্ষা করে আছে কোনো অজ্ঞাত প্রাণী। তোমার মতোই তার ফুসফুস, নাড়িভুঁড়ি, সৌন্দর্য, এবং সকল ব্রিজের প্রতি তার আছে বিস্ময়। …ফিজিকসে ‘ল অফ প্যারিটি’ বলে একটা সূত্র আছে। প্রকৃতি যেন সব্যসাচীর মতো ডানহাতে বাঁহাতে দু’হাতেই সৃষ্টিতে পটু। অজস্র জিনিসে এই প্যারিটি বা সাদৃশ্য তুমি লক্ষ্য করবে। অজস্র জিনিসে যেন জোড়া জোড়া অবস্থান করছে। আণবিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে একে বলা যায় একটি আরেকটির অবিকল মিরর—ইমেজ বা দর্পণবিম্ব। একটা আরেকটির ঠিক উলটো। তুলনা দিলে বলতে হয়—তোমার ডানহাত আর বাঁহাত। এবং মজার কথা এ্যাসিমেট্রিক বা অসমানুপাতিক গঠনের বস্তুর মধ্যেই এই পরস্পর উলটোচেহারার ভাবটি প্রবল। কিন্তু সমস্যা শুরু এখানেই। বস্তুত অবিকল প্রতিরূপ যে প্রতি—বস্তু, তার অন্তর্নিহিত শক্তিটাও উলটো, যেমন কিনা বিদ্যুতের নেগেটিভ, পজেটিভ। দুটো মিশলেই…উঃ, মুহূর্তে জ্বলে ছাই হয়ে যাবে সব! ধরো, তুমি নভোশ্চর, যাত্রা করেছ অজ্ঞাত মহাকাশের দিকে। পথে একটা অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটল। দ্বিমাত্রিক অর্থাৎ দৈর্ঘ্য—প্রস্থ বিশিষ্ট একটা পুতুল—আঁকা ছবিকে ত্রিমাত্রা অর্থাৎ উচ্চতার সাহায্যে উলটে দিলে কী হবে? পুতুলের ডানহাতটা হয়ে যাবে বাঁহাত—তার মানে পুতুলটা পুরো উলটো হয়ে যাবে। মহাকাশযানের দুর্ঘটনাটা এভাবেই ঘটল। বিশ্বলোকে বস্তুত এ তিনটি মাত্রা ছাড়া আরও একটি মাত্রার কথা আইনস্টাইন বলেছেন—সেটা হচ্ছে সময়। চতুর্মাত্রিক বিশ্বের সেই মহাকাশে যদি ওই পুতুলটার মতো নভোযানটি উলটে যায় চতুর্থমাত্রা বা সময়ের মধ্যে দিয়ে—তাহলে? সেটা হচ্ছে সময়। চতুর্মাত্রিক বিশ্বের সেই মহাকাশে যদি ওই পুতুলটার মতো নভোযানটি উলটে যায় চতুর্থমাত্রা বা সময়ের মধ্য দিয়ে—তাহলে? তাহলে তোমার যানসমেত তুমি একেবারে উলটো মানুষটা হয়ে পড়বে। তার মানে তোমার ডানহাত হবে বাঁহাত, ফুসফুস থাকবে উলটো দিকে, পিলে ডাইনে—বাঁয়ে যকৃৎ। কিন্তু তুমি টেরই পাচ্ছ না। টের পাচ্ছ না যে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ডের’ ক্ষুদে নায়িকার মতো তুমি আয়নার ভিতর পৌঁছে গেছ। তারপর নামল কোনো অজ্ঞাত গ্রহে। সামনে দেখলে হঠাৎ—আ! যেন বড্ড চেনা ওই মুখ, কবে কোথাও দেখেছিলুম, ভালোবেসেছিলুম, সেই মেয়ে!
বললে, তুমি!
সে হাসল। এগিয়ে এল।
হাত বাড়ালে। সে বাড়াল।
তোমার ঠোঁটে তৃষ্ণা—তৃষ্ণা তার ঠোঁটে। আরও কাছাকাছি হচ্ছে দু’জনে। হঠাৎ নভোযানের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র পৃথিবী থেকে বজ্র কণ্ঠে ঘোষিত হল, সাবধান! ওকে ছুঁয়োনা!
তুমি বিস্মিত। বললে, কেন?
তুমি উলটোমানুষ! তুমি নেগেটিভ। ও পজিটিভ। ছুঁলেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। অতএব লক্ষ্মীছেলেদের মতো সরে এসো।
হায়, তোমার দৃষ্টিজুড়ে শুধু শূন্যতা, তোমার মনজুড়ে অসহায় আর্তি এবং বিষাদ। শুধু বিষাদ…
একি শুধুই বিজ্ঞানীদের হাইপোথিসিস? এমন ঘটে না—ঘটছে না এ পৃথিবীতেই? কুসুমগঞ্জে? কোনো নিয়ন্ত্রণঘাঁটি থেকে রোবোটের কণ্ঠে গর্জন ভেসে আসছে। কবীর, তুমি উলটো মানুষ—কারণ তুমি মুসলমান। কবীর, হেমনাথের মেয়ে ঝর্ণাকে তুমি ছুঁতে যেয়ো না। বিস্ফোরণ হবে।…
কবীর সরে এল। মাদুরটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। আকাশের নক্ষত্র দেখতে ইচ্ছে হল। চশমাটা খুলে রাখল সে। নাঃ সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। যাকগে। কানের দু’পাশটা ব্যথা করছে।…
একটার পর একটা সিগ্রেট খেয়ে গলা জ্বালা করছিল এতক্ষণে। আকবর বেরিয়ে এল। খোলা ছাদে এসে দাঁড়াল। ভালো লাগল না। নেমে গেল। ফের ঘরে ঢুকল। রেডিয়োর চাবি টিপল। কাঁটা ঘোরাল উদ্দেশ্যবিহীন। কোথায় দুর্বোধ্য কী আওয়াজ হচ্ছে। কী ভাষা? তারপর একটা সুর ঢেউ—এর মতো ভেঙে ভেঙে গড়িয়ে এল। বিশ্রী! চাবি বন্ধ করল সে। ঢক ঢক করে জল খেল। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় টেবিলে স্পোর্টসের ট্রফিগুলো ঝকঝক করছে। দেয়ালে আবছায়ায় ঝুলছে শাণিত তলোয়ারের মতো ক্রিকেট ব্যাট, ব্যাডমিন্টন র্যাকেট—এই সব। খেলোয়াড় হিসেবে তার সুনাম আছে সারা জেলায়। এর পর রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় তার যোগ দেবার কথা আছে।
কিন্তু খেলাধুলো কি খুবই আবশ্যিক ছিল জীবনের পক্ষে? শুধু ওই কঠিন নিষ্প্রাণ কিছু ট্রফি! কিছু খসখসে মোটা কাগজের সার্টিফিকেট! ও দিয়ে কী হয়? কী কাজে লাগে? বড়জোর পেতে পারো কিছু বিস্মিত চোখের চাউনি। বোকার মতো হাততালি শুনে পুলকিত হতে পারো। খুব বেশি উঁচুতে উঠে গেলে হয়তো বা কোনো সুন্দরী অভিনেত্রী তোমার পাণিটি প্রার্থনা করতে পারে আচমকা খেয়ালে—সে তুমি নিগ্রো হও কিংবা মুসলমান। কিন্তু এই চিরপরিচিত কুসুমগঞ্জ—যা তোমার একান্ত নিজস্ব একটি কুসুমগঞ্জ, যা তোমার স্বপ্নসাধসংস্কার আর অভিজ্ঞতা দিয়ে বানানো, সেখানে বৃথা উদ্দেশ্যবিহীন লাফ দিয়েছ পোল ভল্ট, হাইজাম্প—অকারণ চালিয়েছে হাতের বর্শা, বিদ্ধ করেছে নিছক একটুকরো কাঠ। নদীর বহতা স্রোত উজান কেটে সবার আগে এগিয়ে ছুঁয়েছে রঙিন একটা দড়ি—ভিজে, ঠান্ডা, ফ্যাকাশে, নীরক্ত, ক্লান্ত, আর অবশ হাতটা কেউ উষ্ণ নরম ভালোবাসার হাতে ছোঁবে ভেবেছিলে। এবং এইসব নীড়াভিমুখী যাত্রার শেষে সত্যি সত্যি ছিল না কোনো নীড়। ছিল শুধু বিশাল এক গাছ—কোটরে যার সাপের বাস।…
…ধুস শালা, কোনো মানে হয় না! কোনো মানে হয় না!
…জুলেখার কথা নতুন করে মনে পড়ছে। আশ্চর্য, আকবর কিন্তু সত্যি সত্যি যাকে বলে মেয়েদের ভালোবাসা, তা পেয়েছিল! আজ এত দিনে ধরা পড়ছে। তখন চোখ জুড়ে মন ভরে ছিল শান্তা ভীতা নম্রা অল্পভাষিণী ওই রুবি। তাই জুলেখার সঠিক ছবিটি ফোটেনি। কাঞ্চনপুরের এক গরিব চাষির মেয়ে জুলেখা। আধান্যাংটো নিরক্ষর বাপ তার এখনও মাঠে লাঙল চাষে। মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখতে দিয়েছিল। সেখানে প্রাইমারি পাশ করে সে এল কুসুমগঞ্জ হাইস্কুলে। কো—এডুকেশন আছে এখানে। দশবছরের মেয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়বাজিতে তাক লাগিয়ে দিল! শেখপাড়ায় মামুর বাড়ি তাকে রেখেছিল শিক্ষাব্রতী চাষি বাপ। এলাকার বড়লোকেদের কাছে মেয়ের পড়ার সাহায্য মিলছিল। ক্লাশে ফার্স্ট, খেলাধুলায় ফার্স্ট, আশ্চর্য চাষির মেয়ে জুলেখা! আকবরের সাথে বেশ মিশে গেল নিঃসঙ্কোচে। কিন্তু ওর গড়নে যেমন, কিশোরী বয়সের সাধারণ লালিত্যটুকু থেকেও খোদাতালা তাকে বঞ্চিত করেছিলেন যেন। দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হত একটা গরিলা হেঁটে আসছে। ক্লাশ টেনে সবাইকে ডিঙিয়ে ও চলে গেল কলকাতার রাজ্যস্তরে এক দৌড় প্রতিযোগিতায়। বাজি জিতল। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হল। ক্রীড়া সাংবাদিক ওকে খ্যাতির তুঙ্গে তুলে দিলেন। পরের বছর আন্তঃভারত প্রতিযোগিতায় বোম্বেতে গেল জুলেখা। সেখানেও বাজি জিতে নিয়ে ফিরে এল। তারপর এশিয়ান গেমসের ডাক। …জীবনের এ এক বিচিত্র পরিহাস—ওই জুলেখা!
…হঠাৎ শোনা গেল, সে পড়াশুনো ছেড়ে দিচ্ছে। তার বাপ বেঁকে বসেছে। জুলেখার সাদি হবে। খবর শুনেই আকবর দৌড়ল কাঞ্চনপুর। হাতেম শেখ সবিনয়ে জানাল, আর না বাবা, যথেষ্ট হয়েছে। মেয়েকুলে জন্মো, স্বামীর ঘর তো করতেই হবে। সে আজ করুক, বা কাল। এর পর বয়স বাড়লে তখন ওই রাক্ষুসে মেয়েটাকে কে সাদী করবে বাপু?
আকবর বলেছিল, না না! তা হয় না। ওর মধ্যে কী আছে, তুমি জানো না। সারা দুনিয়াজোড়া নাম ওর—
হাতেম বলেছিল, নামের মুখে আমি পেচ্ছাব করি। কই, নাম দিয়ে তো আমার ভাঙা কুঁড়ে ঘরখানা দালান হয়নি। এখনও দু’বেলা বুড়ো হাড়ে রোদপানি মাথায় নিয়ে খেতে খাটছি। নাম দিয়ে কি আমার মেয়ে রাজরানি হবে বাছা?
আকবর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, হতে পারে।
তেঁতো হেসেছিল হাতেম। …চৌধুরীর ব্যাটা তুমি—গঞ্জের চৌধুরী আমির লোক। তা বাবা, শুনে রাগ করো না—বলো দিকি, এই তুমি—তোমাকেই বলছি, বিয়ে করবে আমার মেয়েকে? বলো?
আকবর বিব্রতকণ্ঠে বলেছিল, আহা, বিয়ের কথা হচ্ছে না। খেলাধুলায়…
বাধা দিয়ে গর্জে উঠেছিল হাতেম, খেলাধুলো। হুঁ—শুধু খেলাধুলো। ওই সার। এদিকে জেবনটা তোমার ব্রেথা কেটে গেল, সে হুঁশ নেই। খেলাধুলো। কী—কী পেয়েছে আমার মেয়ে? কোন রাজপুত্তুর ডেকে বলেছে, আয়, তোর গলায় মালা দিই? বাপ আকবর, ও যে আসলে ঘুঁটেকুড়ুনির মেয়ে—ঘুঁটেকুড়ুনিই থেকে গেল আসল জায়গায়। গেল না? বলো? ওরা নারীজন্মোর কী কাজে লাগবে গো খেলাধুলো?….
হয়তো খুবই সত্যি কথাটা বলেছিল সেদিন হাতেম বুড়ো। একদিকে তুমি ফুলে ওঠ, ছড়িয়ে পড় যেন বিপুল জোয়ার—অন্যদিকে তোমার জীবনের খরা হু হু করে জ্বলে, সেই গভীর পাঁচিলটা ভাঙে না! আজ এতদিনে সত্যের ঝাঁপি থেকে ফণা তুলেছে জীবনের নিগূঢ় পরম প্রশ্নটা।
কতক্ষণ পরে জুলেখা বেরল ঘর থেকে। ও কী চেহারা তার। ও কী বেশ! ছেঁড়া ময়লা শাড়ি, রুক্ষু চুল, চোখে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। চমকে উঠেছিল আকবর। জুলেখা কাছে এসে চাপা তীক্ষ্ন প্রশ্ন করেছিল, কেন এসেছ?
এ কী শুনছি? আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে জুলি—বিশ্বাস করো।
জুলেখার পুরু ঠোঁটে ব্যঙ্গের কুঞ্চন দেখা দিল। মোটা নাকের গর্ত দুটো কাঁপল। পুরু ভুরুতে ছড়িয়ে গেল শিহরন।…..কষ্ট? কীসের কষ্ট?
না, না। তোমার বিয়েকরা হতেই পারে না। তুমি প্রতিবাদ করো। দরকার হলে—
দরকার হলে?
তোমার সব দায়িত্ব আমার।
জুলেখা যেন অনেক কষ্টে হাসল। …..দায়িত্ব? কীসের দায়িত্ব শুনি?
তোমার থাকাখাওয়া—খেলাধুলো চালানোর—আর…
আর?
এইসব আর কী…..আকবর পাংশুমুখে হাসছিল।
আর কিছু না?
এবার আকবরের একটু রাগ হয়েছিল। ক্ষুব্ধকণ্ঠে সে বলেছিল, আর কিছু মানে বুঝি বিয়ে? তোমার বিয়ে না করলেই চলছে না?
কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে থেকে জুলেখা বলেছিল, বিয়ের কথা আমি বলিনি। সে তুমি বুঝবে না।…
সত্যি বোঝেনি আকবর। বাজি জেতার ট্রফি কেন জুলেখা প্রথমে আকবরের হাতেই তুলে দিয়ে বলত, একটু ধরবে আকবরদা? জুলেখা ‘আকবরদা’ বলত হিন্দু মেয়েদের মতো। ওর চালচলনেও হিন্দু মেয়েদের ছাপ পড়ছিল প্রচুর। …একবার দৌড় প্রতিযোগিতায় শেষ সীমায় পৌঁছেই জুলেখা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সামনে দাঁড়িয়ে—থাকা আকবরের বুকে। যেন—কারণ ওটা কারও টের পাবার কথা নয়—সবাই ভেবেছিল, ওটা দৌড়ের ঝোঁক মাত্র। আর আশ্চর্য, যেন ভয় পেয়ে তাকে পালটা ধাক্কা দিয়ে বসেছিল আকবর। জুলেখা পড়ে গিয়ে চাপা গলায় বলেছিল, ধরতে পারলে না আকবরদা? পড়ে গেলুম যে!
…চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে আকবরের। এতদিনে সব স্পষ্ট হচ্ছে। আঃ, ভালোবাসা এসেছিল! এসেছিল! চিনতে পারেনি।
কুসুমগঞ্জের গঙ্গায় দশমাইল সাঁতার প্রতিযোগিতা। জিয়াগঞ্জ থেকে কুসুমগঞ্জ। নৌকোয় সাথে চলেছে আকবর। শেষসীমায় পৌঁছানো মাত্র জুলেখা চিৎকার করে উঠেছিল হাত বাড়িয়ে—আকবরদা!
কিন্তু ওর ভিজে ক্লান্ত অবশ হাতটা অবশেষে ধরে ফেলল আকবর নয়—অন্য কেউ। জুলেখা টলতে টলতে হাঁটছিল। স্পোর্টসক্যাম্পে জেলাশাসক অপেক্ষা করছেন। আকবর সেই খবরটা ওকে দিতে—দিতে পাশে হাঁটছিল। হঠাৎ জুলেখা বলেছিল, কিন্তু তুমি কী দিচ্ছ শুনি?
আকবর শুধু হেসেছিল। কোনো জবাব দিতে পারেনি।
জুলেখা ফের বলেছিল, যদি হঠাৎ পথেই এলিয়ে পড়তুম, আকবরদা, তুমি ঝাঁপ দেবে সবার আগে—এই ভেবে সারা পথ বড্ড জোর পাচ্ছিলুম মনে।
তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলে?
বারে! পাচ্ছিলুম না? চিৎ সাঁতারের সময় চোখদুটো ছিল তোমার দিকে—আর…
হট্টগোলে ভিড়ে বাকি কথাটা শোনা হয়নি সেদিন। বাকিটা কী ছিল আজ যে জানতে ইচ্ছে করে!
একটা নাড়িছেঁড়া আর্তনাদ আকবরকে জোর ঝাঁকুনি দিল। সে চুল খামচে ধরে বসে রইল নতমুখে। কোথাও কোনো শব্দ নেই কেবল দেয়াল ঘড়িতে দোলকটা দুলছে ধারাবাহিক—এবং টিক টক, টিক টক , টিক টক….
কাঞ্চনপুর থেকে চলে আসার সময়টা স্পষ্ট মনে পড়ছে। আকবর জেদের সাথে বলেছিল, ওই মূর্খ নিরক্ষর বাপের মতো—মতোই তুমি চলবে ঠিক করলে?
আমার বাবাকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই আকবরদা!
জুলেখা, তোমার শক্তি আছে, সাহস আছে। তুমি যা পারো, কোনো মুসলিম কেন—হিন্দুমেয়েও তা পারে না বা পারবে না। তুমি রুখে দাঁড়াও।
বিদ্রোহী হতে বলছ?…জুলেখা ফের স—বিদ্রূপ হেসে উঠেছিল।
নিশ্চয়?
কেন?
তোমার জীবনটা যে অন্যের মতো নয়—খুবই দামি।
তোমার তাই মনে হয় বুঝি?
আলবাৎ হয়।
এ দামি জীবন কী কাজে লাগবে শুনি?
বা রে! মূর্খের মতো কথা বলো না। দুনিয়া জুড়ে তোমার নাম হবে…
বাধা দিয়েছিল জুলেখা। …হ্যাঁ, হাজার লোকের সামনে বাহবা নেব। হাততালি কুড়োব। ওরা চমকে উঠবে। আকাশ ফাটিয়ে জয়ধ্বনি দেবে। পায়রা ওড়াবে জুলেখার নামে। হয়তো ঠোঁটেও আমার ফুটে উঠবে তৃপ্তির হাসি। ট্রফি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব। টেলিভিশনের পর্দায় আমার ছবি উঠবে! আকবরদা, সার্কাস দেখেছ তো? সার্কাসের রিং—এ একটা জানোয়ার কেমন একচাকায় সাইকেল চালায়, ডিগবাজি খায়, কত আজব খেল দেখিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দ্যায়!
আকবর চমকে উঠেছিল। …ছি, ছি, কী বলছ জুলি!
গর্জে উঠেছিল জুলেখা। …ঠিকই বলছি। তুমি এসো আকবরদা!
এবং তারপর মুখটা দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে, যেন কান্না চেপে, দৌড়ে সেই কুঁড়েঘরে গিয়ে ঢুকেছিল অভিমানিনী কৃষাণনন্দিনী জুলেখা। আকবর সাইকেলের সামনের চাকাটা ঘুরিয়ে—বেরোতে সময় লেগেছিল মনে পড়ছে, আস্তে আস্তে চলে এসেছিল। কাঁচা পথ—দু’পাশে নিশিন্দাঝোপ। সে ছিল বসন্তকাল। চমৎকার একটা বিকেল। কতক্ষণ সাইকেলটা ঠেলে পায়ে হেঁটে আসছিল সে।…
গতমাসে খবর পেল। জুলেখার সাথে গাঁয়েরই এক প্রাইমারি শিক্ষকের বিয়ে হয়েছে। জুলেখা কেমন ঘরকন্না করছে, দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল। কাঞ্চনপুর তার মামাবাড়ি—চাষি শেখ পরিবারেই তার মায়ের জন্ম। গিয়েছিল আকবর। আশ্চর্য, জুলেখা বাড়ির পিছনের দেয়ালে, চাষিবউর মতো, কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঘুঁটে দিচ্ছিল—তার সাইকেলের ঘণ্টি শুনে তাকে দেখামাত্র একমাত্র ঘোমটা টেনে বাড়ি ঢুকে গেল!…
আজ মধ্যরাতের পৃথিবীতে নিজেকে খুবই অযোগ্য আর নির্বোধ মনে হচ্ছে আকবরের। চোয়াল আঁটো হয়ে যাচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠছে। তীব্র ব্যর্থতাবোধ তাকে অস্থির করছে।
…রুবি তাহলে চিঠিটা তার হাতের লেখা, ধরতে পেরেছিল! এও একটা মারাত্মক ভুল। ঝোঁকের বশে কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু সুনন্দ—কায়েতবাড়ির ওই হাভাতে ছোকরা একটা মুসলিম মেয়েকে নষ্ট করছে সবার আড়ালে। এও তো সহ্য করা যায় না! কথাটা আরও রটলে বড়জোর রুবির আর বিয়ে হবে না। মুসলমানদের সাধ্য নেই সুনন্দর গায়ে হাত ওঠায়। আর এই কুসুমগঞ্জের মুসলমানরাও কেমন ছাড়া—ছাড়া হয়ে পড়েছে। ছেলেবেলায় যেটুকু ঐক্য সে দেখেছে, আজ আর তা নেই। সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লোক। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধলে তারা প্রাণের দায়ে একজোট হবে বটে—কিন্তু ফের যা ছিল তাই। আর সে—সংঘর্ষও এখানকার ধাতে নেই। কাছেদূরে কোথাও তা ঘটে—কুসুমগঞ্জের হিন্দু—মুসলমান তাতে মোটেও মাথা গলায় না। পূর্ববঙ্গের অনেক লোক এখানে ঘরবাড়ি ব্যবসাবাণিজ্য করছে বটে—কিন্তু তারা ঠিক রিফিউজি নয়। তারা ঝানু ব্যবসায়ী। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জমিদার আর মুসলমান জোতদার মিলে ঠিক করা হয়েছিল—কোথাও কোনো উদ্বাস্তুশিবির বসতে দেওয়া হবে না। হয়নিও। জমিদারি উঠতে উঠতে পোড়ো খাস জমিগুলোর ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কাজেই সরকারের দখলে বাড়তি কোনো জমিই রইল না। একটা পোড়ো জায়গা অবশ্য আছে—সে ওই কুঠিবাড়ির জঙ্গল। কিন্তু তার মালিক রায়বাবুরা। মাঝে মাঝে অনেকটা ফাঁকা করে চাষবাস হচ্ছে। বাগানের চারাগাছ মাথা তুলেছে। ক’বছর পরে ওটা পুরো আবাদ হয়ে যাবে। বাকি কিছু অংশ রয়েছে গঙ্গার পাড়ে—সেখানে বনদপ্তর ভূমিক্ষয়রোধী বনের পত্তন করেছে। ওইটেই হচ্ছে পিকনিক স্পট।
এবং ওখানেই সুনু আর রুবি—
আকবর অস্ফুট বলেই ফেলল, ঝাড় শালাকে। ঝেড়ে ফ্যাল। …এবং হঠাৎ যেন অন্ধকারে আলো দেখল সে। কলেজের ছাত্র ইউনিয়নে দলাদলি আছে। সুনুটা কবীরের বিরুদ্ধে দলে না? আকবর খেলাধুলো নিয়ে থাকে। দলবাজি করে না। ওর দারুণ পপুলারিটি আছে ছাত্রদের মধ্যে। এবার কি ভিড়ে যাবে কবীরের দলে? ঢিট করবে শুয়োরটাকে? কবীর ওর বোনের সঙ্গে প্রেম করছে। ব্যাপারটা মারাত্মক হবে।…
ঢকঢক করে জল খেল সে। শান্তি পেল। শুল। কিন্তু ঘুম এল না। বুকে দুটো হাত রেখে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকাল সে। আরে! ঘুরছে না যে! তখন ছাদে ওঠার সময় বন্ধ করে গিয়েছিল। ফিরে এসে আর খোলেনি। কী কাণ্ড দেখছ! তাই এত গরম আর ঘাম!
ফ্যানটা খুলে দিয়ে উবুড় হল আকবর। একহাতের আঙুলে মাথার পিছনে চুলের ওপর আলতোভাবে তবলা বাজাতে থাকল। আজ পুরো ইনসমনিয়া। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে।
রুবি কিন্তু গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিল। অগাধ নিশ্চিন্ত ঘুম। নাকি যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়াটা গলে গলে যে আরাম আসে, তাই?
শেষরাতে একবার সাহানা বেরিয়ে মেয়ের দরজা ঘুরে গেল। কাককোকিল ডেকে উঠছে বারবার। ভোর হতে দেরি নেই।…