নিষিদ্ধ প্রান্তর – ৮

আট

হেমনাথ বিড় বিড় করছিলেন বারবার—না, না! না, না, না!

প্রভা বলল, কী না না করছ?

হেমনাথ বললেন, ও একটা কথা। তা দ্যাখো প্রভা, ভাবতে বেশ লাগে, সংসারে যদি ধর্ম একটাই হত!

কেন?

খাঁয়ের মেয়েটি বেশ। লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো চেহারা। হাসলে যেন মুক্তো ঝরে। তেমনি শান্ত ভদ্র সভ্য। বেশ মেয়ে!

খুব গলে আছো মনে হচ্ছে?

তুমি গলোনি?

প্রজা চুপ করে থাকল।

তুমিই তো ঠাট্টা করে বলতে, সুনুর পাশে যা মানায়! বলতে না?

বলতুম।

ভাবতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রভা!

আমারও কি হচ্ছে না? কিন্তু কী করব?

আফজল আমার ছেলেবেলা থেকেই সাথী। পরস্পর জীবনের কোনোকিছু আমরা গোপন রাখিনি। আজ কী সুখের কথাই হত—যদি…

হ্যাঁ। হত বইকি!

হয়তো সুনুও সুখী হত।

কে জানে! এর সত্যমিথ্যে কতটুকুই বা জানি আমরা!

আমি কিছু কিছু টের পেয়েছিলুম, বুঝলে?

প্রভা উৎকর্ণ হল।

কিন্তু এ্যাদ্দিন তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আজ সকালে খালেক যখন এ নিয়ে আমায় পরিহাস করল—’মেজবাবুই বউ করে ফেলুন না খাঁয়ের মেয়েকে, যা সব শুনেছি ফিসফিস চাদ্দিকে’…জানো? আমি তখনই চমকে উঠেছিলুম। মনে হচ্ছিল—খুব জানা একটা ব্যাপারের ওপর খোঁচা দিচ্ছে খালেক। কবেকার মুখস্থ পদ্য ভুলে যাবার পর একটা লাইন ধরিয়ে দিলে যেমন পুরোটা মনে পড়ে যায়—ঠিক সেইরকম। তবে কী, খালেকের এ স্পর্ধা হল কেন, তাও জানি। ও বড়লোক—তার ওপর এখন প্রভাস মুখুয্যের পার্টিই চাঁই। আমি গরিব মানুষ। মুখুয্যেমশায়ের কাছে একজন গরিব হিন্দুর মানসম্মানের চেয়ে পার্টির চাঁইয়ের দামটা বেশি। এই তো হচ্ছে দিনকালের গতিক। যাক গে, বলল—বলল। না হয়, বন্ধুর জন্যেই কিঞ্চিৎ খেসারত দিলুম—এই বলে চলে এসেছিলুম। কিন্তু কথাটা আমি ভুলিনি। উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিলুম। একটু আগেও তো তোমায় বলছিলুম—ওটা ধর্তব্য নয়, ছেড়ে দাও। কিন্তু দ্যাখো, যত রাত বাড়ছে—আমার মাথায় রাজ্যের ভাবনা এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে—এ জিনিসটা খুব বাজে নয়। কোথাও যেন এর একটা গভীর গুরুত্ব আছে। তা ছাড়া তুমিও ঝুনুর ব্যাপারটা জানালে।

ঝুনুকে আমি দেখছি।…প্রভার কথায় প্রত্যয়ের দৃঢ়তা রয়েছে।

হেমনাথ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ঝুনুটা সমস্যা নয়। সমস্যা আফজলের মেয়ে। কারণ আফজল আমার বন্ধু। কাল থেকে আর কি সহজ মনে দু’জনে একসঙ্গে কথা বলতে পারব? বিকেলে দুই বুড়োয় ছড়িহাতে…ঔফ!

কী হল?

কিছু না।

কিছুক্ষণ নীরবতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আকাশে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। হেমনাথ আর প্রভাময়ী নক্ষত্র দেখছিলেন নীরবে।

প্রভা!

উঁ?

শোও গো। রাত হয়েছে।

আজ তোমার কাছেই গা—টা জুড়িয়ে নিই বরং। সরো একটু।

প্রভা!

উঁ?

মানুষ এমন কেন?

কেমন?

আমার ঠাকুর শ্রীচৈতন্য যবন হরিদাসকেও কোল দিয়েছিলেন। নীচ—অস্পৃশ্য—মুসলমান তিনি গণ্য করেননি। সবাই ঈশ্বরের জীব। অথচ মানুষ…

তুমি কাঁদছ গা?

প্রভাময়ী টের পাচ্ছিল, এ কান্না পরম বৈষ্ণবের প্রেমাশ্রুপাত নয়—এ কান্না মানুষের জন্যে দুঃখের। এবং সেও অনিবার্যভাবে সংক্রামিত হল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বলল, চুপ করো। কেঁদে কী হবে!

সুনু বারান্দায় শুয়েছিল। মাথাটা ইচ্ছে করেই একটু ঝুঁকিয়ে রেখেছিল—যাতে আকাশ দেখতে পায়। কী বিশাল ওই নক্ষত্রময় আকাশ! কতদূর—কতদূর! তুমি যেতে—যেতে—যেতে….চলে যাবে, শুধু চলেই যাবে…এক জন্মে কুলোবে না, জন্মজন্মান্তর ধরে হাঁটবে এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রের দেশে। ইচ্ছে হলে কোথাও ছায়াপথের কোনো গাছের নিচে বসে একটুখানি জিরিয়ে নিতে পারো। কিন্তু কী আশ্চর্য সে যাত্রা! কী সুখপ্রদ সে অলৌকিক ভ্রমণ!

এবং সেই ভ্রমণের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ তার গা শিউরে উঠছিল। কে যেন পিছনে দ্রুত আসছে—তাকে অনুসরণ করছে, কতদিন থেকে—কোনো জন্মের আগে কোনো জন্মের পরে—বলছে, থামো, আমি আসছি!

অনন্ত নক্ষত্রলোকে একবার পিছু ফিরতেই তুমি রুদ্ধশ্বাস। চমকে উঠেছ। কেন? তুমি কেন এলে?

এলুম। আমার ইচ্ছে।

বা রে! আমায় যে এখনও কতদূর যেতে হবে!

আমায় সাথে নাও।

পারবে যেতে?

পারব?

ক্লান্ত হয়ে পড়বে না?

যদি পড়ি, তুমিই তো আছোই।

না, না!

…বিড়বিড় করে উঠল সুনন্দ। হেমনাথের মতো বারবার অস্ফুটকণ্ঠে বলছিল সে—না, না। তা হয় না।

…তুমি আমায় চুমু খেয়েছ!

আমি নই আমার ঠোঁট—মানে, আমার দেহ।

দেহ আর তুমি কি আলাদা?

তা তো বটেই!

তবে ওই দেহটাই আমায় দিয়ে যাও।

………………..

কী হল, চুপ কেন?

দেহ নিয়ে তুমি কী করবে?

বাতি যখন পেলুম না, পিদিমটাই হাতে থাক।

কী হবে? যা আলো দিতে পারে না।

দিতে পারত। কিন্তু দিল না। সেই যন্ত্রণাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব ওই আঁধারের মধ্যে। সেই যন্ত্রণাই যত সুখ, তা তো জানো না তুমি।

…রুবির মধ্যে রহস্য আছে। বড্ড অল্পভাষী—কিন্তু যখন কথা বলে, তার উত্তাপ আর ভাব পলকে তোমায় আচ্ছন্ন না করে পারে না। সেই দিনটার কথা মনে পড়ে সুনন্দ? জানালার ধারে দাঁড়িয়ে স্কুলে যাবার আগে চুল আঁচড়াচ্ছিল—তোমাকে দেখেই হেসে উঠল, হাসি তোমার মনের ভিতর একটা আলো হয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল, তারপর কোথায় মিলিয়ে গেল—কিন্তু তুমি তারপর সেটা খুঁজে হন্যে হয়ে উঠলে—সারাটি দিন তুমি কেবল ভাবলে খাপছাড়া সব ভাবনা। তোমার মনে হল, পৃথিবীতে দুঃখদারিদ্র্য থাক, আরও কী একটা চমৎকার ব্যাপার আছে, যা জীবনকে কেবলই মাথা উঁচু করে চলতে শেখায়। পরীক্ষার ফি দিতে পারছিলে না বলে সেদিন তোমার মনে হতাশা আর কষ্ট ছিল। অথচ তোমার মনে হচ্ছিল না যে একটা সুন্দর কিছু ঘটবেই? এইসব দুঃখদারিদ্র্য কষ্ট গ্লানি কেটে যাবে এবং নির্মল পরিপূর্ণ রৌদ্রে সবুজ মাঠে আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে নেচে—গেয়ে ঘুরব?

রুবি তোমার দিকে তাকালে তোমার সব অন্ধকার মুহূর্তে আলো হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি, এমন নিজের প্রতি কত অসম্ভব অদ্ভুত বিদ্বেষ বা তিক্ততা বা ঘৃণাভাব তুমি কতসময় পোষণ করেছ। অথচ ওই মেয়েটির একটি সতেজ নীরব চাহনি তোমায় পলকে পৃথিবীকে ভাবতে শিখিয়েছে একটি মহতী সম্ভাবনা—ওই কর্ষিত উর্বর সিক্ত শস্যক্ষেত্রের মতো। মানুষকে সে পরিয়েছে অলৌকিক জ্যোতির্ময় পোশাক—পুরাণের দেবদূতের মতো, জীবনকে করেছে বল্গাবিহীন মুক্ত তেজস্বী ঘোড়া—যা স্বাধীনতার হ্রেষাধ্বনিতে দিকমণ্ডল প্রকম্পিত করে, এবং নিজেকে মনে হয়েছে এক মহান পুরুষ—যে ইচ্ছেমতো এ পৃথিবীটাকে বদলে বাসযোগ্য করে তুলতে পারে! একি মিথ্যে সুনন্দ?

হ্যাঁ, রুবি তোমার মতো একটি শান্ত নমনীয় ভীতু ছেলেকে দিনে দিনে সাহসী করে তুলেছিল। তাই নিষিদ্ধ মাংস খেতে তোমার সংস্কার হই হই করে ওঠেনি। প্রতিটি সংস্কারকে একেকটি নতুনত্বের চাবুকে তুমি জর্জরিত করে ফেলছিলে। তোমার হাতে মাংসের পেয়ালা কাঁপছিল—যেই রুবি বলল, খাও সুনুদা, তোমার কী যে হল—আর দ্বিধাটুকুও রইল না। বমিবমি ভাবটুকু যদি বা আসছিল পরে, রুবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে তুমি দেখলে—ইতিমধ্যে সবটাই হজম হয়ে গেছে। সেদিন তোমার কী আনন্দ সুনন্দ! যেন একটা রাজ্য জয় করে ফেলছে। উচ্ছ্বাসে উদ্দীপ্ত তুমি কাজি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করে শোনালে।

আমি মানিনাকো কোন আইন…

 …..টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন…

টর্পেডো! চমৎকার একটা শব্দ। সেই নিঃশব্দ বিস্ফোরণের পর তুমি ক্লান্ত হয়ে ভাবছিলে—কিছু হারালুম না তো? না সুনন্দ, হারাওনি—বরং লাভ করলে। দেখলে, মনের জোরটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। সেইটেই তোমার জীবনে প্রথম জয়। রুবিই তোমায় শেখাল, জয় করো—হেরে যেয়ো না। আর মাঝে মাঝে যখন রুবির কথা তুমি ভাবতে, তোমার মনে হত—পৃথিবীতে যেন বা তোমার জীবনটার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে—গুরুতর দায়িত্ব রয়েছে তোমার কাঁধে। এবং সে দায়িত্ব হচ্ছে—পৃথিবীটা মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা। যদিও কাজে কিছুই করোনি—কিন্তু বোধটা তোমার মধ্যে জন্মেছিল। এটুকুই তো যথেষ্ট, সুনন্দ।…

সুনন্দ মুখ ঘুরিয়ে উঠোনের পাঁচিলটার দিকে তাকাল। অন্ধকার পাঁচিলটা হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্তব্ধ বিশাল একটা বিরোধ।

(সচরাচর এমন পাশাপাশি দুটো অনাত্মীয়ের বাড়ির মধ্যসীমায় সমান্তরাল দুটো পাঁচিল থাকবার কথা। এবং দুটোর মাঝখানে সরু কুকুর বেড়াল চলা পথ। এ দুটো বাড়ির মধ্যে পাঁচিল মাত্র একটাই। এবং তার মালিক সুনন্দরা। বোঝা যায় এই দুটো বাড়ির মধ্যে বন্ধুতার সম্পর্ক প্রায় ঐতিহাসিক)।

হঠাৎ সুনন্দর মনে হল পাঁচিলটা ক্রমশ উঁচু হতে হতে উঁচু হতে হতে নক্ষত্রময় আকাশে উঠে গেল। আকাশের নক্ষত্র আর বিশালতাটা পলকে পলকে দু’ভাগ হতে থাকল। ওদিকেরটা আর দেখাই গেল না। সুনন্দ অবাক হল। খুব ভয়ের চোখে লক্ষ্য করতে থাকল পাঁচিলটাকে। অন্ধকার বিরাট এক জান্তব সত্তা—সহস্র চক্ষু দিয়ে তার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে যেন।

রাগে মাথার ভিতরটা জ্বলে উঠল তার। হাত নিসপিস করল। কিন্তু বড্ড নিরস্ত্র সে—অসহায় হাত দুটো কারও উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে।

শেষ রাতে ঘুমের ভিতর তলিয়ে যেতে যেতে সুনন্দ জানতে পারছিল—এতক্ষণ ঘাম ও ভাবনার পিচ্ছিল দুর্গমতায় কেবলই সে একটা শাবল খুঁজে হয়রান হয়েছে। ওটা কোথাও আছে। কোথাও ছিল। পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পেতে হবেই।…

ঝর্ণা প্রথমদিকে চুপিচুপি হেসেছে। বাঃ বেশ জমে উঠেছে! জমিয়ে দিয়েছিস রুবি! এখন শেষরক্ষে হলে হয়।…তারপর কিন্তু গম্ভীর হয়ে পড়েছে সে।

ঝর্ণা একালের মেয়ে। কলেজ যাচ্ছে। সে দিন গুনছে ভিন্ন এক বিপুল মুক্তির—যে মুক্তি তার মা—ঠাকমার মতো সামান্য ঘরকন্নাসংসারের ঘেরাটোপে নির্বোধ কোনো আপাত—পরিপূর্ণতার নয়। অঙ্কে তার মাথা ভালো খোলে বলে সুনুদা প্রায়ই বলত, ও নির্ঘাৎ মেয়ে—এনজিনিয়ার হবে। নাকি বিজ্ঞানী হবি রে ঝুনু? কিশোরী ঝুনু গাল ফুলিয়ে জবাব দিত—নাঃ, আমি দাদুর মতো ডাক্তার হব। সুনু ভ্যাংচাত—ডাক্তার! তাও আবার দাদুর মতো? সে তো ডাক্তারি পাশ করা লাগে না রে! দাদু ছিল কোয়াক—হাতুড়ে নিছক! সরকারি হাসপাতালের কম্পাউন্ডারি থেকে যা শিক্ষা। কথা কানে গেলে বাবা হাসতে হাসতে বলতেন, বাবার নিন্দে করছিস? শুধু পাশ থাকলেই হয় না রে! উনি ছিলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। বিদ্যে মুখস্থ করে ওই দিব্যদৃষ্টিটি মেলে না। ওটা ভগবানের দান।

ঝর্ণা এখন বিজ্ঞানের ছাত্রী। কিন্তু এ গরিব পরিবারের পক্ষে সেই স্পর্ধা স্বপ্ন দেখার উৎসে ওই খ্যাতিমান ধন্বন্তরী ভদ্রলোক। এ স্বপ্নে ছিল, ঝর্ণা যাবে কলকাতা। ভর্তি হবে ডাক্তারি কলেজে। হেমনাথের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় মেডিকেল কলেজের বড় ডাক্তার। তিনি প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছিলেন আগাম। কিন্তু সেটা কি হয়ে উঠল আর? অনেক বাধা আছে বা ছিল। হেমনাথ—প্রভার বাপমায়ের মন বলে নয়, বাধাগুলো অন্যরকম। ওঁদের চরিত্রে একটা জিনিস আছে—সেটা রূঢ় আত্মমর্যাদাবোধ। একপয়সাও দেওয়া যাবে না এ ছারকপালে সংসার থেকে—অন্যের নিতান্ত অনুগ্রহের উপর শেষ অব্দি নির্ভর করা বাঞ্ছনীয় মনে হয়নি ওঁদের । সুনু দুটো টিউশনি করছে। ঝুনুও একটা পেয়ে গেছে। কলেজের মাইনেটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ওই থেকে। অতএব এখানেই চলুক পড়াশুনা। সুনন্দ আর্টস, ঝর্ণা বিজ্ঞান। পড়া শেষ হোক। তখন একটা কিছু ঘটবে।

…..ঝুনু—ঝর্ণা, নিজের ভবিষ্যৎ ভাবছিল। তার সে ভবিষ্যতের ছবি বড় অস্পষ্ট—কিন্তু আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। মনে হয়, পৃথিবীর দুর্গম অজ্ঞাত স্থানগুলো থেকে তার ডাক আসছে—কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে, কোনো সমুদ্রের অভিযাত্রী জাহাজ থেকে, দূর আকাশের নভোযান থেকে,……কোথায় সব গড়ে উঠছে দিকপ্রসারী নগর ও বন্দর, সুউচ্চ স্কাইস্ক্রেপারের শীর্ষে উড়ছে পতাকা, জটিলতম বিশাল যন্ত্রলোক….চোখধাঁধানো নীল রশ্মি, মানুষের কান যা সইতে পারে না সেইসব নির্ঘোষ, মহাকায় চালকবিহীন ট্রেন—যার চুল্লি থেকে রক্তলাল আগুনের হলকা বিচ্ছুরিত….সেইসব ধাতব আস্ফালন!

কিন্তু সে একা। আর কোথাও কেউ নেই। কেন নেই? কেন থাকবে না?…খুব কষ্ট হল তার। অসহায় মনে হল নিজেকে। বিপন্ন বোধ করল হঠাৎ। এই দরজাবন্ধ ছোট্ট গুমোট ঘর—আলোবাতাসহীন। ওই খড়ের চাল। দেয়ালে ফাটল। কী তুচ্ছ আর নির্বোধ দেঁতো হাসি চারপাশে ঘেরা!

…জানো ঝুনু? পৃথিবীতে মানুষের যা কিছু কীর্তি—যা কিছু সম্পদ, আমরা প্রত্যেকে তার ন্যায্য শরিক। কারণ, এযাবৎ ‘সভ্যতা’ বলতে যা কিছু ঘটেছে, তা একের দান নয়। বলা হয়, গাছ থেকে টুপ করে আপেল পড়তে দেখেই নিউটন ‘মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব’ আবিষ্কার করে ফেললেন। কী হাস্যকর অপব্যাখ্যা একটি কীর্তির! যেন ওই আপেল কেন পড়ল ভাবলেই রামশ্যাম অমনি একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত! ভুলে যেয়ো না, তার আগেও নিউটন ছিলেন বিজ্ঞানী। তাঁর ওই বিজ্ঞানী থাকাটাই প্রকৃতপক্ষে এ তত্ত্বের উৎস। এবং তিনি যে বিজ্ঞানী ছিলেন, তাঁর সেই বিজ্ঞান—জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পিছনে ছিল আরও অনেক বিজ্ঞানীর দান। জেমস ওয়াট আবিষ্কার করলেন কেটলির ঢাকনা খুলতে পারে যে বাষ্প, তার একটা শক্তি আছে। কিন্তু তার আগে যে কেটলি তৈরি করেছিল, সেও এ আবিষ্কারের ন্যায্য অংশীদার। আকাশ থেকে হঠাৎ জ্ঞানের উল্কা ঝাঁপিয়ে পড়ে না কারও সামনে। সবাই পরস্পর নির্ভরশীল। একের আবিষ্কারের পিছনে আছে অনেকের আবিষ্কার। তা না হলে দ্বাদশ—শতাব্দীতেই আমরা পেয়ে যেতুম আইনস্টাইনকে। খ্রিস্টের সমকালেও পেতে পারতুম কোনো অ্যাটম বোমা আবিষ্কারক অটোহানকে। খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকে জন্মাতেন নীলস বোর! শেখপাড়ার এজলু হত কি না জগদীশ বোস—যে খরার সময় দুঃখ করে বলে, আহা, গাছগুলো বড় কষ্ট পাচ্ছে গো!

….না, ব্যক্তির কীর্তি আমি অস্বীকার করছিনে। কিন্তু সমষ্টির অভিজ্ঞতাই তার কীর্তির পিছনে শক্তিশালী উপাদান। তা না হলে কত আইনস্টাইন অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভেড়া চরাতেন! যাক গে, এখন আসল কথাটা শোন। কাল বিকেলে টিউশনি থেকে ফেরার পথে তুমি বকুলতলা হয়ে আসছ। সাইকেলের দোকানের পাশেই আমাকে দেখবে। না দেখতে পেলে একটু অপেক্ষা করো বাসস্ট্যান্ডে।

কবীর বিজ্ঞানের ছাত্র। সত্যি ওর চেহারায় আছে কতকটা বিজ্ঞানীর আদল—ল্যাবরেটরির মধ্যে তীক্ষ্নদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটা অদ্ভুত গড়নের জারের দিকে। যেন পিছনের শব্দ পেলেই বলবে, আঃ চুপ করো।

আমি ঝুনু।

পরে এসো। বিরক্ত করো না।

করছি না। দেখছি।

বেন পিছন ঘুরে তখন একবার হাসল। …তোমায় পারা যায় না! এবং লম্বা আঙুলটা তুলে পরক্ষণে তার জারের ব্যাপারটা গম্ভীরমুখে বোঝাতে থাকল।…

হ্যাঁ, এসবই মনে হয় কবীরকে দেখে। সবসময় অন্যমনস্ক আর ব্যস্ত—সবসময় গুরুতর তত্ত্ব যেন ওর মাথায়। পৃথিবী আর বিজ্ঞান সম্পর্কে ও যেন হেস্তনেস্ত করার দায়িত্ব পেয়ে গেছে। অথচ হঠাৎ যখন হাসে, মুহূর্তে মনে হয় কোথাও অন্ধকার রাত্রির পৃথিবীতে সূর্যোদয় হল। ভারমুক্তি ঘটল কোথাও। প্রচণ্ড ঢাকের বাদ্যির পর নীরবতার শান্তি। শুধু শান্তি নয়—যা অশ্রুত ছিল, শ্রুত হল—লোকসংগীতের মতো সরল দামাল সুর!

হঠাৎ অমন করে মুক্তির মুক্তো ছড়াতে জানে বলেই কবীরকে এত ভালো লাগে। রেলস্টেশনের রেস্তোরাঁয় দুপুরের দিকে ছাত্রছাত্রীদের আড্ডা চলে। কোণের দিকটা ওরা বেছে নেয়। কবীর হঠাৎ বলে, তুমি জাত মানো ঝুনু?

ঝুনু হেসে খুন।

কবীর গম্ভীর হয়ে ওঠে…হেসো না। ব্যাপারটা ভাবলে পিত্তি জ্বলে যায় না তোমার?

মোটেও না।

কেন, শুনি?

আত্মরক্ষার জন্যে।

ঝুনুর সূক্ষ্ম রসিকতার তারিফ করে কবীর বলে, শেষ অব্দি পারবে তো?

কে জানে!…বলে মুখটা নামায় ঝুনু। কান অব্দি লাল হয়ে ওঠে।

কবীর একটু ঝুঁকে ডাকে, ঝুনু!

ঝুনু পলকে মুখ তোলে—সুপ্রতিভ মুখ। চুলের গোছা সরিয়ে চাপা গলায় বলে, অসভ্যতা করো না। ওরা সবাই দেখছে আমাদের।

কবীর একটু ভয় পায় হঠাৎ। এই হঠাৎ—ভয় পাওয়া তার অভ্যাস। মনে হয়, চারপাশে একটা ষড়যন্ত্র চলেছে। ফিসফিস করে কারা যেন বলছে, এই নেড়েটা বড্ড বেড়েছে! ওকে মার। সে আস্তে আস্তে বলে, আচ্ছা ঝুনু, তোমার বাবা—মার কানে ওঠেনি তো কিছু?

অমনি ঝুনু ফের হেসে পদ্য বানায়…নাহি জানি অন্তঃপুরে কীবা ঘটিতেছে। ম্লেচ্ছ পশিয়াছে কি না গোপনে মার্জার যথা দুগ্ধে মুখ রাখে।…

কবীরও হাসে।….তুমি কবিতা লেখো না কেন?

তুমি তো লেখো!

লিখি। কিন্তু ধুৎ! সে নিছক খেয়াল। পরে আর মানেই বুঝতে পারিনে।

ঝুনু চঞ্চল হয় হঠাৎ! ওই রে সুনুদা!

কবীর ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। সুনন্দ কাকে খুঁজছে। এদের দিকে চোখ পড়তেই সে মুহূর্তের জন্যে চমকে ওঠে যেন। তারপর হাসিমুখে মাথাটা দোলায়। এই দিয়ে যেন সে আশ্বস্ত করে এদের। এরা সেটা টের পায়।

সুনন্দ চলে যায়। তখন কবীর ফিসফিস করে বলে, ঝুনু বাড়ি গিয়ে বলে দেবে না তো?

ঝুনু চোখ তাকিয়ে বলে, দিক না। ওরটা বলে দেবার লোক নেই বুঝি? আমি তো তোমার সঙ্গে আড্ডা দিই মাত্র—আরও ও যে…

এইসব সময় ঝুনু বড় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবীরের কাছে। ওকে থামতে দেখে কবীর বলে, কী? কী করে ঝুনু?

ঝুনু মুখ নামিয়ে বলে, জানো? দাদা গোমাংস খায়?

অ্যাঁ! চমকে ওঠে কবীর। বিপুল আশা ওকে গরম করে তোলে। ছিঃ! এটা কিন্তু উচিত নয়। গোমাংস খেলে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কুষ্ঠ হয়।

সত্যি?

হ্যাঁ।

তুমি খাও না?

কবীর অনায়াসে মিথ্যে বলে, নাঃ।

কিন্তু ঝুনুর মনে আছে, একদিন রুবিদের বাড়ি কবীর—হ্যাঁ, সে ছিল ইদের পরব,…ঝুনু বলে, তোমাদের ওই মাংস খাওয়া ইদের নাম কী যেন?

কোরবানি। কেন?

এমনি বলছি।…ঝুনু চাপা হাসে।…যাক গে। খেলেই বা কী? যার ভালো লাগে, সে খাবে। আমার ভালো লাগে না, খাই নে। কিন্তু যাই বলো, ওতে ভীষণ প্রোটিন আছে নাকি। যে দেশে এত খাদ্যাভাব, সে দেশে সবাই খাক না গোমাংস। খাদ্য সমস্যা দূর হবে।

যাঃ!…

আচ্ছা, এই যে কবীরের কথা ভাবছি, কবীর কি আমার কথা ভাবছে? ওদের বাড়িটা ইটের দোতলা। ওরা দিব্যি আছে। বাইরে থেকে দেখে খুব কৌতূহল হয়েছে, কীসব আছে ওদের ঘরে, কেমনই বা ঘরকন্না, জীবনযাপন! আর দোতালার পুবকোণের ঘরটায় কবীর থাকে। ওই ঘরটায় একবার যেতে ইচ্ছে করে। সে সাহস তো নেই। রাজ্যের লোক চেঁচিয়ে উঠবে যেন। হইচই পড়ে যাবে চাদ্দিকে। বিশ্বসুদ্ধ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রাজি নই বাবা। আজব জিনিসটি হয়ে উঠব কেন বলো তো? তার চেয়ে, এই দিব্যি আছি।

সুনুদাই বা এখন কী ভাবছে? আমি জানি, ও রুবিকে খুব—খু–উব ভালোবাসে। রুবি কতটা বাসে, ঠাহর পাইনি—যা গুমোট চাপা মেয়ে। হাজারটা খুঁচিয়েও ওর পেটের কথা বের করার সাধ্য নেই তোমার। মনে হচ্ছে, ও এবার কষ্ট পাবে। ঝুনুদাও কষ্ট পাবে। বাবা ওদের বাড়ি যেতে আমাদের নিষেধ করে দিয়েছেন আজ। চৌধুরী নাকি বাবাকে অপমান করেছে। ল্লে বাবা! কার দোষে কে শাস্তি পাচ্ছে মিছেমিছি! বেশ ছিলুম আমরা—দিব্যি চলছিল মেলামেশা, বনভোজন, ঘোরাফেরা। এখন নতুন করে আরেকটা জায়গা খুঁজে মরোনা!

হঠাৎ ঝুনু চমকে উঠল। রুবিকে কি খুব মারধোর করা হয়েছে? আহা, বেচারা! আর আমি…আমি যদি কোনোদিন ধরা পড়ি, তোমাকেও কি…

কেন? গভীর দুঃখে ঝুনুর চোখ ফেটে জল এল। বালিশের কোণটা আঁকড়ে ধরল সে। ডুবন্ত মানুষ যেমন অসহায়তায় খড়কুটো আঁকড়ে ধরে।