নিষিদ্ধ প্রান্তর – ৭

সাত

ঈশ্বরের কুসুমগঞ্জে এই রাতটি ছিল একটু ভিন্ন।

ভিন্ন—কারণ, এর কিছু মানুষ বা মানুষী এযাবৎকালের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন একটা কথা ভাবছিল। আলোড়িত হচ্ছিল। তাদের সবারই সামনে এসে বারবার দাঁড়াচ্ছিল সেই ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস্য শক্তি! তাদের সবার মনে একটা ভয় হচ্ছিল, সাজানো বাগান এবার বিধ্বস্ত হতে চলেছে। যুগযুগান্তকালব্যাপী কোনো গুহার ভিতর যেন পাথরচাপা দেওয়া হয়েছিল কোনো এক স্বাধীনতাকে—যে স্বাধীনতা বস্তুপুঞ্জে প্রাণের ক্রিয়াকারিতার মতো সাবলীল ও সরল,—বৃক্ষের বেড়ে ওঠার মতো স্বচ্ছন্দ ও অবাধ—নদনদীর বহমনতার মতো স্ব—স্বভাবী—এবং যে স্বাধীনতায় সূর্যের উদয়াস্ত, পৃথিবীতে ঋতুচক্র, জন্মদান ও ধারানুক্রমিক বংশবহন ঘটে থাকে। আর—সেই স্বাধীনতার চাপা পাথরটা থরথর করে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল প্রকৃতির গুহাস্রাবী সেই স্বাধীনতাস্রোত এবার সবেগে ধেয়ে আসছে দিকপ্রান্তর ভাসিয়ে।….

আফজল খাঁ চাপা গলায় কথা বলছিলেন সাহানা বেগমের সাথে।

রুবি বারবার চেষ্টা করছিল তার বিদ্রোহের মধ্যে অসংগতি খুঁজতে। সে একটা পরিপূর্ণ চেহারা তৈরি করছিল তার স্বাধীনতাবোধের—অবিকল যে নিষ্ঠায় বাজিকর তার বাজির মশলা দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করে।…

আর সুনন্দ! সুনন্দরও ঘুম আসছিল না। রুবির আচরণ এবং খালেক চৌধুরী তার বাবাকে কীসব ইশারায় বলে নাকি পরোক্ষে অপমান করেছেন—এসবের মধ্যে নিজের সঠিক এবং প্রকৃত জায়গাটা কোথায়, সে ব্যাকুলভাবে খুঁজছিল। সে বিস্মিত উত্যক্ত, বিমূঢ় হয়ে পড়ছিল। প্রচণ্ড জ্বালায় সে অস্থির হচ্ছিল।…

আর ঝুনু—ঝর্ণা? সেও সচকিত। রুবি ও সুনুদার এতদিনের সব আচরণকে একটা পটভূমি বানিয়ে নিজের কিছু আচরণের মানে বুঝতে চেষ্টা করছিল সে। বিপন্ন বোধ করছিল ঝুনু। তার মনে হচ্ছিল, এরপর আগামী দিনের পৃথিবীতে তার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা পরিণতি—যার উলটো নাম স্বাধীনতা, কীর্তি ফাঁস করে দেওয়া সেই সরল কিংবা বোকা, নির্লজ্জ আর শক্তিমান মুক্তি—তাকে কেমন করে সামলাবে ভাবছিল সে।…

এবং কবীর, বিকেলে শেফালীদের বাড়ি এসে ঝুনুর কাছে রুবির ব্যাপারটা শুনে গেছে সে। শুনেছে খালেক চৌধুরীর হেমনাথকে অপমানের দারুণ খবরটাও। সে একটু চিন্তাশীল ভাবুক প্রকৃতির ছেলে হলেও তার সক্রিয়তার শক্তি অসাধারণ। রাজনীতির প্রতি তার উদ্যম আছে। তার পৃথিবীটা অনেকের চেয়ে আরও বড়ো। তাই তার ত্রাস অন্যখানে। এযাবৎকাল কুসমগঞ্জে যা ঘটেনি, তাই যেন ঘটে যাবে—শিগগির রক্তের হোলিখেলা শুরু হবে। গুরুতর ত্রাসে সে কাঠ হয়ে পড়ছিল। এবং তার বিপন্ন স্বাধীনতার ওপর ঝুনুকে বিপর্যস্ত ছোটাছুটি করতে দেখছিল—যে ঝুনু কোনো বিরাট গাছের গুঁড়িতে সতেজ সুন্দর এবং আকস্মিক একটা পাতার অঙ্কুর—আপাতদৃষ্টে খাপছাড়া এবং যে গাছটা ঝড়ে দুলতে শুরু করেছে।

এবং আকবর। আকবরের চোয়াল আঁটো হয়ে যাচ্ছিল বারবার। সে শুধু একটার পর একটা সিগ্রেট টানছিল। অ্যাসট্রেটা পুরো জমে গেলে সে তখন মেঝেয় ছাই ফেলছিল। ফ্যানের হাওয়ায় সে ছাই তার চোখে এসে পড়ছিল। কী যে ঝামেলা।

আফজল, মকবুল দরজির আড্ডায় সারা দুপুরটা কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বিকেলে। হঠাৎ খুব চমৎকার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সাহানাও ততক্ষণে রুবিকে ঘরবন্দি করার সুখে শান্ত আর নিশ্চিন্ত। গায়ের ঝাল অনেকটা ঝাড়া গেছে। তার ওপর খিদে, খিদে অনেক সময় মানুষকে বাস্তববাদী এবং স্বাভাবিক করেও ফেলে! স্বামী স্ত্রীর পক্ষে এই জিনিসটিই বেশ ফলদায়ী হয়ে উঠেছিল সম্ভবত। আফজল বাড়ি ফিরেই বলেছিলেন, কই শিগগির খানা নিকালো। পেটের কুত্তা বেদম চিল্লাচ্ছে!

সাহানা স্বামীকে দেখামাত্র স্বস্তি পেয়েছিল। একটু হেসেও ফেলেছিল সে। অনেকদিন পরে খাঁয়ের বাচ্চা ‘ইসলামি জবানে’ কথা বলছে। হিন্দু সংসর্গে ঘুরে—ফিরে লোকটার জবানও যেন বদলে গেছে অনেকখানি। সুরুয়াকে বলে বসে, ‘ঝোল’ গোস্তকে বলে ওঠে ‘মাংস’, ‘খানা নিকালো’ না বলে ‘ভাত বাড়ো’, ‘হাত ধোব’র বদলে ‘আঁচাবো’, ‘গোসলের’ বদলে ‘চান’ এমনি সব কতরকম।

এবং খেতে বসে অভ্যাসমতো আফজল রুবির খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। সাহানা নিঃসঙ্কোচে বলেছিল, ওর খাওয়া হয়ে গেছে। এখন তুমি খাও তো দেখি…তারপর তার মায়ের মন মোচড় দেবারই কথা—দিয়েছিলও।

স্বামীর খাওয়া শেষ হলে—তখন বিকেলেও গড়াচ্ছে, সাহানা তাঁকে বলেছিল, অবেলায় আর গড়িয়ে কাজ নেই। দলিজে গিয়ে বরং বসো খানিক। গায়ে হাওয়া লাগবে।

দলিজ—মিয়াবাড়ির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ—সেটা ছিলই একটা। বাইরের দিকে ছোট্ট বারান্দা সমেত এ ঘরেরই একটা ছোট্ট কামরা। তাতে আছে খান তিনেক ভাঙা চেয়ার আর একটা নড়বড়ে টেবিল। তাকে কিছু উইকাটা পুরোনো পত্রপত্রিকা, খবরের কাগজ—তাদের মধ্যে অনেকগুলো তথাকথিত ‘মুসলিম’ সম্পাদিত মুসলিম লেখকদের গল্প কবিতা প্রবন্ধে ভরা পত্রিকা—যার মধ্যে ‘মুসলিম জাহান’ শীর্ষক সচিত্র বিবরণীগুলো রুবিকে অনেকবার পড়ে শোনাতে হয়েছে মাকে এবং তা আব্বার তাগিদেই, কারণ এর মধ্যে দুনিয়ার গুণী মুসলিম মহিলাদের পরিচিতি এবং ছবি থাকত সবচেয়ে বেশি। এবং আফজল তাঁর হিন্দু বন্ধুর সংসর্গে পড়ে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতা বিষয়ে যথেষ্ট সংক্রামিত হয়ে পড়েছিলেন এবং শরিয়তভীতা সাহানা বেগমের মুখের ওপর তুড়ি বাজানোর জন্যে ওইসব উদাহরণ ছিল মোক্ষম। পরে পরাজিত এবং পিছু হটে যাওয়া সাহানার পক্ষ থেকে আর শরিয়তি আক্রমণের আশঙ্কা না থাকায় পত্রিকাগুলো এ বাড়ির খানদানি চিৎপ্রকর্যের নমুনা হিসেবে দলিজ ঘরের তাকে স্থান পেয়েছিল।

দেয়ালে ঝুলন্ত মক্কা মদিনার ছবি সমেত কিছু ক্যালেন্ডার যেমন রয়েছে, তেমনি আছে অনেক দেশনেতাদের ও ‘হিন্দু’ কবির। তারা তিন থেকে দশবছরের পুরনো। চুনকাম ওঠা ফাটা দেওয়ালের বেইজ্জতি ঢাকবার জন্যে তারা এখনও রয়েছে। জিন্নাসাহেবের ছবিও একসময় ছিল। দেশভাগের প্রথমদিন সকালেই আফজল তাকে অপসারিত করেছিল। তার মানে কিন্তু এই নয় যে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিংবা দেশখণ্ডনের ব্যাপারে তাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত ছিল। জিন্নাসাহেবের ছবি রাখা তৎকালে কুসুমগঞ্জের প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারে একটা সংক্রামক প্রথার পরিণত হয়েছিল—এ যেন ছিল একটা সামাজিক সংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ—যেন বা একটা শিষ্টাচার। এবং বস্তুতপক্ষে রাজনীতি নিরাসক্ত আফজল—যিনি সময় বিশেষে বা প্রকারান্তরে নিজের জীবন ও সংসার সম্পর্কেও কমবেশি নিরাসক্ত, তিনি ওই ছবিটা কোনো সবিশেষ তত্ত্বভেদে রাখেননি। নিজ সমাজের আরও ছোটখাটো ব্যাপারের মতোই এ ছিল একটা তুচ্ছ সংক্রমণ মাত্র। এবং কোনো ক্যালেন্ডারের ছবির প্রতি তাঁর না ছিল ঔৎসুক্য, না ছিল কোনো ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপার। তারিখ দেখারও তাঁর দরকার হত না। ওরা ছিল নিছক দেয়ালের পোশাক।

কিন্তু দেশভাগের সকালে সেই প্রথম তিনি ক্যালেন্ডার সচেতন হয়ে পড়েছিলেন এবং সে ছিল মারাত্মক ধাক্কার মতো।

সারা কুসুমগঞ্জে শঙ্খধ্বনি হচ্ছে রাত বারোটার পর থেকে—তারপর মিছিল বেরিয়েছে। প্রতি বাড়ির শীর্ষে তেরঙা পতাকা উড়েছে। আফজল উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন, একটা কিছু ঘটছে। হ্যাঁ—স্বাধীনতা। কী এই স্বাধীনতা? হেম যার উপলক্ষে ছ’মাস ফাঁকির কষ্টে জেল খেটেছিল? আর কী এই ভারত—পাকিস্তান? খুব বিব্রত বোধ করেছিলেন আফজল। দুঃ ছাই! এতে তাঁর ভূমিকাই যেন নেই। কেউ যেন পাত্তা দেবে না তাঁকে। বিব্রত কুণ্ঠিত মুখে তিনি বন্ধুবাড়ির দিকে তাকালেন। দেখলেন হেমনাথের বাড়ির ওপর লম্বা বাঁশে তেরঙা পতাকা উড়ছে। হেমনাথের বউ শাঁখ বাজাচ্ছে।

…..সেদিন ইদের পরব। এমনিতে বড় দুঃখের দিন তার এ আনন্দের শুভ দিনটিতে। ঘরে নেই ঘরনি। দড়ির দোলনায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে এক বছরের মা হারা ছেলে ওই নুরুল। সারা রাত সে ঘুমোতে দ্যায় না। চোখ জ্বালা করছিল আফজলের। ধার্মিক মুসল্লী না হলেও জীবনে এই প্রথম তাঁর ইদের নামাজে যাওয়া হচ্ছে না। ছেলে ফেলে কেমন করে যাবেন? হাত পুড়িয়ে নিজেই রান্না করেন। ইচ্ছামতো তেল মশলা খরচ করার সুযোগ অবশ্য মিলেছে। ভোজনবিলাসী মানুষের পক্ষে এটা অবাধ স্বাধীনতা হলেও বেশ কষ্টকর। তার ওপর ওই কচি শিশু। ইদের দিনে এই এক মুসলিমবাড়ি সেমাই পায়েস ফিরনি হচ্ছে না! অবশ্য পড়শিরা খাঞ্চা সাজিয়ে প্রথামতো এসব খাবার দিয়ে যাবেই। কিন্তু তাতে কি তৃপ্তি মেটে? দুঃখিত আফজলের হঠাৎ চমক খেলে গেল হেমনাথের বাড়ির আকাশে রঙিন পতাকাটা দেখে। সবকিছু ভুলে গেলেন তিনি।

…পরক্ষণে চৌধুরীবাড়ির দিকে চোখ গেল। আরে? কোথায় গেল কালকের সেই সবুজ নিশানটা? তার বদলে বাঁশের ডগায় উড়ছে তেমনি তেরঙা ঝান্ডা। কাজীবাড়ি দেখলেন। সেখানেও একই রদবদল। যেদিকে চোখ যায়, একই দৃশ্য। সব সবুজ নিশানা রাতারাতি যেন মারাত্মক ত্রাসে নাকি লজ্জায় তেরঙায় পরিণত হয়েছে।

মুহূর্তে তেমনি কী দুর্বোধ্য লজ্জা বা ত্রাসে তাঁর বুক কেঁপে উঠল। চোরের মতো পা টিপে দলিজ ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। সেই ছবিটা পেরেকসুদ্ধ উপড়ে নিলেন। ঝরঝর করে কিছু চুনের পলেস্তারা খসে পড়ল। ভিতরের মাটির অংশ দাঁত বের করল। ছবিটা ছিঁড়ে ফেললেন। উনুনে গুঁজে দিয়ে স্বস্তি পেলেন। …

ত্রাস না লজ্জা, ভীতি না অনুতাপ—কেন রাতারাতি কুসুমগঞ্জের সব সবুজ নিশানা বদলে তেরঙা হয়ে উঠেছিল সেদিন, সে বিচার করার দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীর, সে দায়িত্ব ঐতিহাসিকের—তা আমার নয়, প্রাজ্ঞ পাঠিকা! এখানে আমি এ কাহিনির লেখক ছিলুম শুধু দ্রষ্টা—নিতান্ত নিরাসক্ত এক দ্রষ্টা মাত্র। সমস্যাটা কোথায় জানেন? যে মুহূর্তে এ কাহিনি শোনানোর প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি জাতিচ্যুত দেশবিহীন রাষ্ট্রসীমানা বর্জিত এক অখণ্ড মানুষের মধ্যে হারিয়ে বসেছি নিজেকে। সারা পৃথিবী এমনকি যদি দূর গ্রহে বা নক্ষত্রে কোথাও কোনো প্রাণী থাকে—আমি সেই নিখিল বিশ্বলোকের এক বিমূঢ আত্মসচেতন সন্তান ছাড়া কিছুই নই। অনাদিকালের প্রাণপ্রবাহে আমি এক কীটাণুকীট হতে পারি—কিন্তু অবিচ্ছেদ্য সত্তা তো বটেই। আশা করি, আমার সমস্যাটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি। আরও কি স্পষ্ট করব? হিটলারের জার্মানিতে লক্ষ লক্ষ ইহুদি নিধনে আমার যেমন যন্ত্রণা হয়েছিল, সেই নিধনযজ্ঞের মূল হোতা আইখম্যানের ফাঁসিতেও আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়। গান্ধীজীর বুকের গরম সিসের গুলি যেমন আমার বুকের ভিতর রক্তপাত ঘটিয়েছিল, তেমনি ফাঁসির দড়িতে শ্বাসরুদ্ধ নাথুরামের যন্ত্রণাও আমি অবিকল টের পেয়েছিলুম। আঃ, এর নামই তো মানুষজীবনের পরম যন্ত্রণা! অনেক দুঃখে আমাদের—এই হতভাগ্য লেখকদের শিখতে হয়েছে, জীবন মানেই যন্ত্রণা। আমরা শুধু আর্তকণ্ঠে যুগযুগান্তকাল চিৎকার করে বলি, মানুষ! মানুষ! তুমি কী করছ? এবং এই একই চিৎকার তো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল একদিন মহিমময় পবিত্র পুরুষ সেই যন্ত্রণাদগ্ধ পয়গম্বরের মুখে—ঈশ্বর, ঈশ্বর! এদের তুমি ক্ষমা করো। এরা কী করছে তা জানে না।

তবে কিনা আবেগ পাপ। আবেগ সত্যকে গোপন করতে শেখায় এবং তা শিল্পের দুশমন। কিন্তু এ কাহিনি যাতে আবেগবর্জিত হয়, তার প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত। কারণ, কুসুমগঞ্জে উনিশশো সাতষট্টি খ্রিস্টাব্দের সেই গ্রীষ্মকালটা একটা প্রচণ্ড আবেগের স্রোত এনে ফেলেছিল কিন্তু নরনারীর জীবনে। আর, সেইটাই যা হঠকারিতা।….

শান্ত তৃপ্ত দেহমন। তাই আফজল স্ত্রীর কথা মেনে নিলেন। দলিজের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে থাকলেন। শেখপাড়ার ফজল পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছিল। তাকে ডেকে তার সঙ্গে চাষবাস নানা কথায় মেতে উঠলেন। খুব বর্ষা হবে এবার, চাষবাস ভালো হবে এবং দুনিয়ার মানুষের ঘরে ঘরে ফসলের বান ডাকবে। ইত্যাদি।….

ওদিকে সাহানাও শান্ত আর আশ্বস্ত। দরজার শিকল খোলার ঝনঝন শব্দটা তার মাতৃত্বে একটা ঝংকার তুলল। বাপহারা ‘এতিম’ মেয়েটার জন্য ‘কলিজা’ কেমন মোচড় দিল এতক্ষণে। সে দেখল, রুবি চুপচাপ বসে আছে অন্ধকার ঘরে। কারণ এ ঘরের জানালার সামনে বাক্সের পাঁজা। পর্দাভীতু সাহানার এই কাণ্ড। জানালা খুললেই পথটা নজরে পড়ে কিনা।

সাহানা মুখে হাসি নিয়ে মেয়ের পিঠে হাত রাখল। …পাজি মেয়ে আমার এখন মাথা খারাপ করে দ্যায়, দ্যাখো না! নে ওঠ, খাবি চল।

রুবি জবাব দিল না। তার মায়ের এ স্বভাব তার জানা। কিন্তু কোনোদিন তো মা তার গায়ে হাত তোলেনি!

ওঠ—মা আমার, সোনা আমার! …সাহানা আদর করছিল মেয়েকে। রাগ মানাচ্ছিল। …যা করেছিস, বেশ করেছিস! ওসব বড়লোকের বড়মানুষি আমার একটুও সয় না মা। ওই হারামজাদাটাই যে অ্যাদ্দিন রাজ্যি জুড়ে তোর খিটকেল করে বেড়াচ্ছে, বিয়েতে ভাঙচি দিচ্ছে—তা কি জানতুম? জানলুম, তুই ওকে তেড়ে গেলি দেখে। সত্যি রে, তখন বুঝিনি—পরে ঠিকই বুঝলুম কেন তুই ওকে অপমান করে বসলি। …বেশ করেছিস! দু’ঘা মেরে দিলেও এখন খুশি হতুম। তবে কী জানিস? মেজবাবুর সামনে ঝুনুর সাক্ষাতে কাণ্ডটা হল কিনা—তাই আমার মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল। …কই, আয় দিকি। ..মাথার চুল নেড়ে দিল সাহানা। …গোসল করে ভালো করেছিস। আমার হল না মা—গা পচে বজবজ করছে। যাই—অবেলাতে একটুখানি পানি ঢেলে দিই বরং। নাকি—তখন মায়েঝিয়ে একসঙ্গে খাব?

রুবি স্তব্ধ। কাঁদছিল না মোটে—চোখদুটো লাল, পাপড়ি ফোলা—মুখটা থমথমে।

স্তব্ধতা সম্মতি জেনে সাহানা দ্রুত ইঁদারার ধারে গেল এবং কোনোমতে স্নানটা সেরে নিল। ভিজে কাপড় বদলাতে ঘরে ঢুকে দেখল, রুবি তখনও চুপচাপ বসে রয়েছে।

অগত্যা সাহানা কাপড় বললেই মেয়েকে কতকটা কোলে তুলে হাঁফাতে হাঁফাতে এবং হাসতে হাসতে বেরোল। বারান্দায় এলে রুবি আস্তে বলল, আঃ ছেড়ে দাও।

বিকেলের চমৎকার আলোয় মেয়ের মুখটা দু’হাতে ধরল সাহানা। খুঁটিয়ে দেখে নিল কোথাও মারধোরের দাগ আছে কিনা। কানের নিচে অব্দি জোর করে মুখ ঘুরিয়ে দেখে আশ্বস্ত হল। …এমন সোনার চাঁদ আমার! গুখেকোর ব্যাটাদের ঘর আলো করতে দেব ভেবেছ তোমরা? ওই চাষামাগির বাঁদি হতে যাবে? ঝাড়ু মারো, ঝাড়ু মারো মুয়ে (মুখে)।

…সুতরাং রুবিকে খেতে বসতে হয়েছিল। কিন্তু—হয়তো খিদে পড়ে গিয়েছিল অত বেলায়, অথবা দুঃখে—সে কিছু ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েছিল। তারপর নিজের স্বাধীনতার সীমা বাজিয়ে নিতে প্রথমে নিজের ঘরে গিয়েছিল। পরে খিড়কিতেও উঁকি দিয়েছিল—এবং তখনই সাহানা শুধু বলেছিল, সোমত্ত মেয়ে সন্ধেবেলা ওখানে দাঁড়াতে নেই, সরে আয়। সেটা জিনপরীর দৃষ্টি পড়ার কিংবা পূর্ব ঘোষিত বন্দিত্বের একটি হুঁশিয়ারি, রুবির অনুমান করা কঠিন। সে সরে এসেছিল।

না—তখনও সাহানা চিঠির ব্যাপারটা জানত না। জানতে পারল অনেকটা রাত্তিরে। রুবিকে পাশে নিয়েই আজ সে শুত। কিন্তু আফজল চোখ টিপে বলেছিলেন—কিছু জরুরি কথা আছে বেগম। রুবি ওঘরেই থাক।…

এবং আফজল চাপা গলায় একথা ওকথার পর সেই গুরুতর দুঃসংবাদটা দিলেন। আরও জানালেন, খালেক চৌধুরী হেমনাথকে কীসব বলে নাকি অপমানের চূড়ান্ত করেছেন—সকালেই সে খবর তাকে জানিয়ে গেছেন কাজীসাহেব। কবীরের বাবা।

সাহানা কিছুক্ষণ নিঃসাড় পড়ে রইল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। রুবি—তার মেয়ে রুবি ‘বেগানা’ (পর) ছেলের সঙ্গে ‘বদ কাম’ (অসৎ কাজ) করেছে? ওই রুবি—যার দেহের প্রত্যেকটি জায়গা এখনও সাহানার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে। এই তো সেদিন—সেদিনই তো তাকে ন্যাংটো গোসল করিয়েছে সে—সাবান মাখিয়ে দিয়েছে! সেই রুবি? রুবিরও একজন পুরুষ দরকার এবং এই বোধ থেকেই জামাই খোঁজার ব্যস্ততা সাহানার মনে। কিন্তু আশ্চর্য, বোধটা যেন আরও হাজার গুণ উজ্জ্বল হয়ে গেল মুহূর্তে। ভয়ঙ্কর হল। মারাত্মক হয়ে উঠল।

সাহানা ত্রাসে কাঠ হয়ে গেল। আঃ হারামজাদি বোকা—হাবা মেয়ে কতখানি কী করেছে, এবং সত্যি সত্যি সে—করার সীমানাটা কদ্দূর আঁচ করতে না পেরে সাহানা ভয় পাচ্ছিল। সত্যি যদি শয়তানিটা বেশি কিছু করে থাকে—সে তো প্রচণ্ড ভয়—ঘেন্নার কথা! ওর ওই কচিকাঁচা নরম তাজা দেহটা থেকে বিয়ের হাঁকুর গজায় যদি। খুব ব্যস্ত দিক থেকেই ভাবছিল সাহানা—এবং এই সম্ভবত স্ত্রীস্বভাব। একটা মৌন হাহাকার তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার মাথা ভাঙতে সাধ যাচ্ছিল—রুবি—তার আদরের রুবির নতুন জঠরের কথা ভেবে এ যন্ত্রণা সাহানার। ওই পবিত্র নিষ্পাপ জঠরে শয়তানের থাবার দাগ পড়েনি তো?

সাহানার ভাবনাযন্ত্রণাবোধটা এমন যেন—কোনোমতে যদি আশ্বস্ত বা নিশ্চিন্ত করা যায় তাকে যে রুবি এখনও দেহের দিকে সত্যি সত্যি নষ্ট হয়নি—যা কিছু ঘটেছে মনের ক্ষেত্রে—তাহলে হেলায় তুচ্ছ করবে এ ঘটনাটা। বলে উঠবে—দুস! ও একটু আধটু হয়েই থাকে মনামনি বয়সকালে। বলি, গাছটা যখন মাথা তুলে উঠেছে, ছায়াটা তো নাথাকা হবে না! ছায়াও থাকবে। এবং কোনো না কোনোখানে পড়বেই!

কথাটা কিন্তু আফজলই বলছিলেন। …না, এ তেমন কিছু ধর্তব্য নয়। গাছের কথাই ধরো। বলি, গাছটা যখন মাথা তুলে উঠেছে…

এ পর্যন্ত শুনেই সাহানা যেন জল থেকে ভুস করে মাথা তুলে প্রশ্বাস ফেলল। কিন্তু পরক্ষণে স্তিমিত হয়ে বলে উঠল, কিন্তু ধর্তব্য নয়ই বা কেন? ওরা যে ভিন্ন জাত। ওনারা হিঁদু—আমার মোসলমান। অ্যাদ্দিন কানঘুঁষো শুনেছিলুম। ভাবতুম—পাশাপাশি বাড়ি, শিক্ষিতা মেয়ে—বাইরে বেপর্দা ঘোরে। লোকে তো পাঁচকথা বলবেই। তাতে মেয়ের যা চেহারা—টুকতে নেই, এ তল্লাটে আর কারও ঘরে তো মিলবে না—তাই ভাবতুম, ওরা সব হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছে আর পাঁচকথা রটাচ্ছে। কিন্তু হা খোদা! এ যে একেবারে সত্যি সত্যি কাণ্ড! জাত কুলনেশে মেয়ে আমার এ কী করে বসল গো! আঃ ছি ছি ছি!

আফজল চুপ করে কিছু ভাবছিলেন।

সাহানা ডাকল, বড় মিয়া?

উঁ?

আচ্ছা, এসব মিথ্যেও তো হতে পারে! উড়োচিঠির খবর। কে বললে, চিলে তোমার কান নিয়ে গেল! আগে কানটি তো দেখবে? না কী?

বড় আশা নিয়ে একথা সাহানা বলেছিল, কিন্তু তাকে মুহূর্তে হতাশ করে আফজল বললেন, আমি দেখেছি।

সাহানা নড়ে উঠল।—দেখেছ? কী দেখেছ তুমি? কই, আমার তো কোনোদিন তেমন কিছু চোখে পড়েনি।

আফজল ঘোঁৎঘোঁৎ করে বললেন, তুমি আবার কিছু দ্যাখো নাকি? তোমার চোখ থাকে মাটিতে, পাদুটো আশমানে। বাড়ি থাকো তুমি, আমি থাকি বাইরে—তুমি গিন্নিবান্নি মানুষ, আমি পুরুষ মদ্দ লোক। দেখার কথা ছিল তোমারই—তা মানো?

বিচলিত সাহানা রুদ্ধশ্বাসে বলল, তা মানি। কিন্তু কী দেখেছ তুমি?

আফজল চুপ।

ওগো! বড় মিয়া?

আফজল বিরক্ত হয়ে বললেন, ধুত্তেরি, রাতদুপুরে আর বড় মিয়া—বড় মিয়া করো না। কানে বাজে।

বলো না কী দেখেছিলে? আর দেখেছিলে যদি, আমাকেই বলোনি কেন? আমি তক্ষুনি সাবধান হতুম।

আফজল এবার রেগে অভ্যাসমতো ‘নাকখপদা’, ‘পাছাঘষড়ানো’ ইত্যাদি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সামলে নিয়ে বললেন, ছেড়ে দাও ভ্যানতারা। কথায় বলে চোখের দ্যাখার রকমফের আছে। নিজের মনের আয়নায় পারার দোষ থাকলে সব চিজই (জিনিসই) এলোমেলো দেখাবে। ধরো হঠাৎ দেখলুম—সুনু ওর গালে ঠোনা মারল—হঠাৎ একপলকের দেখা, এর খারাপ ভালো সবরকম মানে হতে পারে। সেইরকম। তবে জেনে রাখো, আমি ভুল করছি না। যা দ্যাখার ঠিকই দেখেছি। আজ উড়ো চিঠি পাবার পর একসাথে সবগুলো মিলিয়ে নিয়ে স্পষ্ট পটের ছবিখানা সামনে এসে গেছে। বুঝলে?

সাহানা সাহস পেয়ে জেদের সাথে বলল, ভালো। কিন্তু রুবি যে সত্যি সত্যি নষ্ট হয়েছে—তা কি তুমি দেখেছ?

প্রশ্নটা গুরুতর। আফজল এর ওজনটা যেন বুঝে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, দ্যাখো, জাহেলের (মূর্খের) মতো কথা বলো না। স্ত্রীপুরুষে যখন নষ্ট হবার কাম করে তখন শয়তান চাদ্দিকে পুরু পর্দা ঘিরে থাকে। আব্বা বলতেন কথাটা। এ তো গেল ‘জেনা’র (ব্যাভিচারের) কাণ্ড। এমনকি স্বামীস্ত্রীও যখন—

এ পর্যন্ত শুনে লজ্জা পেয়ে সাহানা বলল, নাঃ, আমার মন বলছে, অদ্দূর গড়ায়নি ব্যাপারটা। সে সুযোগ ওরা পাবেই বা কোথা?

আফজল আশ্চর্যভাবে উলটো প্রশ্ন করে বসলেন, পাবে না? বনজঙ্গল দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে নাকি? কবে যে সব বনভোজন করতে যাওয়া হয়েছিল না?

সাহানা প্রতিবাদ করল। …যাও। ওরা দল বেঁধে ছিল তখন।

আফজল কেমন হাসলেন। …আরে, বাবা, গাইবাছুরে ভাব থাকলে বনে গিয়ে দুধ দ্যায়। তাছাড়া, এ বাড়ির মধ্যেই বা কিছু হয়নি, কে বললে?

তার মানে?

অমন জোয়ান মেয়েকে একা আলাদা ঘরে শুতে দিয়েছে।

বলার পরই আফজল টের পেলেন, ভুল হয়েছে। সাহানা ফোঁস করে উঠল, বাঃ। আমি দিয়েছি? শরম লাগে না বলতে? বিবিকে না পেলে মিয়ার এদিকে ঘুম হবে না—বদ খোয়াব (দুঃস্বপ্ন) দেখবেন। তুমি—তুমিই তো আমার মেয়ের জন্যে জাহান্নামের দরজা খুলে দিলে!

আফজল শান্তভাবে সব হজম করে বললেন, নাঃ। সব ফায়সালা আমি করে ফেলেছি মনে মনে। সময় থাকতে থাকতে গিঁট কাটা পড়বে। খোদা যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন। নুরুর কাছেই চলে যাব। শিগগির।

সাহানা স্বামীর দিকে ঘুরল এতক্ষণে। বুকে হাত রাখল। হাতটা বোলাতে থাকল।

আফজল বলছিলেন, হ্যাঁ—আজ দিনমান ভেবে তাই সাব্যস্ত করলুম। পাকিস্তানেই চলে যাই। একদিন তো যেতেই হবে। বুড়ো বয়সে কেই বা দেখবে—শুনবে? যে দিনকাল পড়েছে, কেউ আর একমুঠো দিয়ে সাহায্য করবে ভেবেছ? কেউ করবে না। তাছাড়া মিয়ামোখাদিমের সে ইজ্জতই বা কোথা পাবে? শ্যাখের পো তোমার সামনে সায়েব সেজে গট গট করে হেঁটে যাচ্ছে—সালাম দেওয়া তো দূরে থাক। আগের দিনে আশরাফকে আতরাফ মান্যি করেছে। আশরাফ (উচ্চবর্ণ) আর আতরাফ (নিম্নবর্ণ) বসেছে আলাদা আলাদা আসনে। দুটো—তিনটো চেয়ার থাকলেও আশরাফের ব্যাটা বসবে চেয়ারে, আতরাফের ব্যাটা মাটিতে। আজকাল কোথাও এমন দেখবে না। সেবার মঙ্গলকোট গিয়েছিলুম না লতিফ কাজীর বোনপো’র বিয়েতে? বরাতদের আসনে ডাক দিতে গিয়ে বললে, দু’তরফই আছে ভাইজান—যে যার নিজের তরফে গিয়ে বসে পড়ুন। দলে ক’জন শেখপাড়ার মাতব্বর ছিল—তারা বসল মেঝের ফরাসে। অবশ্যি সেও বড় ভালো বন্দোবস্ত। গদি আর তাকিয়াও ছিল। ওদিকে মিয়ারা বসলেন গে তোমার তক্তপোশের ওপর। সেখানেও গদি আর তাকিয়া।

সাহানার হাতটা ঘুরছিল বুক থেকে গলায়—গলা থেকে বুকে—শব্দহীন। ভাবাপ্লুত। সে উদ্ধারের দ্রুত অগ্রসরমান নৌকাটিকে অন্ধকারে ভেসে আসতে দেখছিল।

—বুঝলে সাহানা? এ একটি আজব বানবন্যার ব্যাপার। সেই বানবন্যার স্রোতে সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তোমার আশরাফ আতরাফ ছোট—বড় সব কোথায় গায়েব হয়ে যাবে। তখন হেমই বা কোথা, আমি বা কোথা? হিঁদুর খাওয়া গেলাসে মোসলমানে পানি খাচ্ছে, মোসলমানের এঁটো গেলাসে হিঁদুর পিয়াস মিটছে। দেখে এসো গে না বাজারে—শহরে—তামাম মুল্লুকে আর জাত মানামানির বালাই—ই নেই। আমাদের ছেলেপুলেরাই যা সব কচ্ছে, দেখলে, ভাবলে তাক লেগে যায়? যায় না? হেমের ছেলে তোমার হাতে গোরুর গোস্ত খায়। অ্যাঁ? ভেবে দেখেছ কখনও কথাটা?

সাহানা শুধু বলল, আঃ চুপ করো। ঘুমোও।

—তুমি ভাবোইনি। নাদান মেয়েমানুষ। হেমের খানদানে ধস ছেড়েছে, টের পাচ্ছ না।

সাহানা নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, বেশ তো। মেজবাবুর ছেলে কলমা পড়ুক—এত যখন করে ফেলতে পারে। আমি ডঙ্কা বাজিয়ে রুবিকে ওর হাতে সঁপে দেব।

হার মেনে আফজল বললেন, ধস আমার খানদানেও ছেড়েছে। কাকে দোষ দেব? এখন আল্লা—আল্লা করে ওপারে কেটে পড়তে পারলে জান—মান—ইজ্জত বেঁচে যায়। তারপর…দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন আফজল।

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকার পর ফের বললেন, কিন্তু ভাবতে কষ্ট হয়। ওই হেম আমার জানের দোস্ত। তার ছেলে, আমার মেয়ে। হা খোদা! কেন আমরা একজাত হয়ে জন্মালুম না! এ যে কত সুখের ব্যাপার হত—কে বুঝবে সেকথা?

আচমকা স্বামীকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতে দেখে সাহানা স্তম্ভিত। হাতটা দ্রুত গাল পেরিয়ে চোখের ওপর গেল। আঙুল ভিজতে থাকল। পরক্ষণে সাহানাও কেঁদে ফেলল।…হ্যাঁ, সেকথা কি আমি ভাবিনি? ভেবেছি! ভেবে বুকখানা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। মেজ গিন্নি কতবার বলেছে—আহা, অমন সোনার চাঁদ মেয়ে কার ঘর আলো করবে গো! যদি জাতেধর্মে এক হত, আমি কি ছেড়ে দিতুম ভাবছ? ছাড়তুম না কক্ষনো। আমার ঘরে লক্ষ্মী প্রতিমা আসত গা, সে আমার কত সুখ?…হ্যাঁ, আমারও ওই কথা ছিল। অমন আশমানের সুরুয ছেলে—যেমন চেহারা—তেমনি চলন! দুনিয়াময় মাথা ভাঙলে কোথাও মেলে না। আঃ!…নিজের বুকে চেপে ধরল সাহানা। …আল্লার দুনিয়ায় চাঁদসুরযে মিলন হল না।

এবং, পরস্পর পরস্পরকে কতক্ষণ ধরে দুটি মানুষ সান্ত্বনা দিচ্ছিল। চুপ করিয়ে দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু দু’জনেই ছটফট করে উঠছিল গভীর আক্ষেপে।