ছয়
রুবি ধুড়মুড় করে উঠে বসল।
সে কি ঘুমিয়েছিল এতক্ষণ? বাঃ রে! কী বোকাসোকা নিশ্চিন্ত অগাধ ধুম! নিজের প্রতি বিরক্ত হল সে। ঘামে দেহ ছপছপ করছে। ব্লাউজটা পুরো ভিজে গেছে। ঘরে এত গরম হত না—কিন্তু উত্তরের জানলাটা বন্ধ ছিল। দক্ষিণে দরজাটা হাট করে খোলা। জানালা খুলে দিলে হু হু করে একঝলক হাওয়া এসে ঢুকল। দেহ জুড়িয়ে গেল তার। প্রথমে জানালার বাইরের পৃথিবীটা দেখে বেলা আন্দাজ করার চেষ্টা করল সে। বেলা ঢলেছে। তারপর ঘুরে দরজার বাইরে তাকাল। উঠোনে কায়েতবাড়ির পাঁচিলের ছায়াটা সরে এসেছে। একঠ্যাঙে ধাড়ি মুরগিটা ঝিমোচ্ছে। কাল থেকে ওই লক্ষণ দেখা গেছে। মা বলছিল, ও বাঁচবে না। হয়তো দরমাসুদ্ধ সবগুলোই একে একে যাবে। তার আগে জবাই করে খাওয়া দরকার।…
আবছা গানের সুর ভেসে আসছিল ওদিকে শেফালীদের বাড়ি থেকে। এই সময়টা ভারি সুন্দর সুন্দর গান বাজে ওদের রেডিয়োতে। মন চনমন করে উঠল রুবির। কিন্তু না—আজ তার দুনিয়া যে দুশমন।
দুনিয়া দুশমন…কথাটা কে যেন বলছিল? রুবির মনে পড়ল—স্পষ্ট নয়। আবছা। যখন সে শুয়ে পড়েছিল, হয়তো ঘুমের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কাঁদছিলও—হাসির মা যেন এসে কিছু বলছিল তাকে।…দুনিয়াটা দুশমন করোনা মা! কিন্তু বুড়িটা কী টের পেল? কেমন করে টের পেল?
এ ঘুমের কোনো মানে হয় না। এমন অগাধ নিশ্চিন্ত ঘুম! যখন জেগে ওঠামাত্র তুমি টের পেয়ে যাবে যে পৃথিবী পুরো বদলে গেছে—কিছুই তোমার মনের মতো হয়ে নেই। তোমার সাজানো গোছানো ঘরটা গেছে তছনছ হয়ে। এমনকি অনেক কিছুর অর্থ বোঝা যাচ্ছে না। আগের মতো নিঃসঙ্কোচে পা ফেলা যায় না।
একটা স্বপ্ন দেখেছিল সে। মনে পড়ল। গ্রীষ্ম দুপুরের স্বপ্নগুলো নাকি এমনি আজগুবি হয়।…কতকগুলো ঘোড়া—অদ্ভুত সব চেহারা। নীল রঙ, লাল টানা চোখ। কারা সব এসেছে যুদ্ধ করতে—তারা নাকি পাকিস্তানের সৈনিক! কুসুমগঞ্জের দিঘির ওপর প্লেন উড়ছে। ভারি যুদ্ধ হবে। শেফালী কেঁদে বলল, দাদাকে ওরা মেরে ফেলেছে। …আর মস্তো মস্তো ডেকচিতে কী রান্না হচ্ছে। পদো সরকার কোমরে গামছা জড়িয়ে হাতে খুন্তি নিয়ে ঘুরছে। সর্বনাশ! কে বলে দিল—রুবি মুসলমান! রুবি পালাচ্ছে। উঁচুনীচু ধাপের মতো রাস্তা—শুধু কবর আর কবর। রুবির পায়ে পায়ে কবর। …নুরুভাই বলল, আয় রুবি। তারপর নুরুভাই ওকে জড়িয়ে ধরল। আঃ ছি ছি! …তারপর আরও কিছু ঘটেছিল। মনে পড়ছে না।
রুবির মনটা তেঁতো হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল সে। বাইরে এল। বারান্দায় হাসির মা খালি মেঝেয় আঁচল বিছিয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। রান্নাঘরের দরজায় ঝাঁপ বন্ধ। পা টিপে টিপে মায়ের ঘরের দরজায় উঁকি মারল। দেখল, সাহানা বেগমও শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
সরে এল সে। স্নান করতে হবে। গা ঘিনঘিন করছে। আরে! সেই চিঠিটা উঠোনে পড়ে রয়েছে যে! চিঠিটা তুলে আনল সে। ঘরে ঢুকে বইয়ের নিচে লুকিয়ে রাখল। তারপর আলনা থেকে শাড়ি টেনে নিল। অন্তত একবারের জন্যও নুরুভাইয়ের কথা তার মনে পড়ল। এই শাড়ি—সাবান ক’মাস আগে নুরুভাই পাকিস্তান থেকে এনে দিয়েছিল। একটু লজ্জা পেল রুবি। মনটা আরও তেঁতো হয়ে গেল! ছিঃ, কী বিশ্রী স্বপ্ন দেখল সে! নুরুভাইকে সে ভুলেও কোনোদিন অন্য চোখে তো দ্যাখেনি! তাহলে কেন এমন হল?
ইঁদারার ধারে এসে রুবি বালতি নামিয়ে দিল। একটু ঝুঁকে জলটা দেখে নিল। খরদাহনের দিনে অসীম আরাম খুঁজতে গভীর কালো ঠান্ডা জলের দিকে তাকিয়েছিল সে। কিন্তু পরক্ষণে ওই গভীরতা—আর বালতির ঝনঝন আর্তনাদ—আর ক্রমাগত নেমে চলার দৃশ্য, তার মনে একটা নির্বোধ আতঙ্ক আনল। মুখ তুলে সোজা হল। ইঁদারার ভিতর মসৃণ গোলাকার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তার পায়ের তলা সুড়সুড় করে উঠল।…
বালতির শব্দে জেগে ঝি বুড়িটা মাথা তুলেছিল—রুবিকে দেখে মুচকি হেসে ফের শুয়ে পড়ল। আহা, বেচারার এখনও খাওয়া হয়নি। চাট্টি ভাতের জন্যে এখনও অপেক্ষা করছে সে! এদের খাওয়া না হলে সে পাবে না। আর কেউ তো ছিল না এতক্ষণ যে বেলা বাড়ছে দেখে আগাম তার ভাতটা বেড়ে দেবে!
অনেকক্ষণ ধরে সাবান মেখে স্নান করতে থাকল রুবি। দেহমন স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। একটা বেপরোয়া ভাব তাকে ক্রমশ পেয়ে বসছিল। যেন পৃথিবীকে বুড়ো আঙুলটি দেখিয়ে যা খুশি করে যাবে।
মেয়ের প্রসাধনের হরেক বস্তু আফজল জুগিয়ে আসছেন। রুবি অবশ্য সাজেগোজে সামান্যই। একটা স্নো আনলে তা অনেক দিন চলে যায়। যেটুকু বা খরচ হয়, তার বেশিরভাগ ঝুনু—নয়তো শেফালী, কিংবা বন্ধুর প্রসাধন চর্চায়। রুবির জিনিসে ওদের অধিকার থাকবে না? আড়ালে সাহানা অবশ্য গজগজ করে। করবে না কেন? সংসারের দরকারি জিনিসটির বদলে আফজলের এই পাগলামির জোগান যে! এক নিশি গন্ধতেল আনলেই সাহানা ফোঁসে—কার জন্য আনছ? দুনিয়াসুদ্ধ বিলিয়ে দিতেই তো যাবে সবটুকুন! আফজল হাসেন। …কী কথা! সুবাস কি নিজের জন্যে বেগম? ফেলেছড়িয়ে কিনা এর ইয়ে সার্থকতা! কী রে রুবি? ভুল বলছি? তোর মতো পাশ না হয় দিইনি! …রুবিও হাসে। সৎ বাপের জন্যে নিজের প্রাণটা বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নিজের বাপটা কি এত ভালো মানুষ ছিল? বিশ্বাস হয় না।
বুক গলা কাঁধ—সবখানে পাউডার বোলাচ্ছিল রুবি। মুখে স্নো ঘষল। কপালে কুমকুমের টিপ আঁকবার সাধ হল—আঁকল না। চুলে চিরুনি চালাল। পিঠে ছড়িয়ে পড়ল একটা বিপুল প্রগলভতা যেন।
পরক্ষণে নিজেকে খুবই নির্লজ্জ মনে হল তার। মুখটা আঁচলে ঘষে ফেলল। পাউডার মুছে দিল যথাসাধ্য। কিন্তু আজ নিজের চোখে নিজেকে এত আশ্চর্য সুন্দর লাগছে!
বাইরে বেরিয়ে প্রথমে সে গেল হাসির মার কাছে। বুড়ি ঘুমোয়নি। নিঃশব্দে হাসছিল। রুবি চাপা গলায় বলল, তুমি ততক্ষণ ওই কাপড়গুলো রোদে শুকোতে দাও হাসির মা। আমি তোমার ভাতটা বেড়ে দিচ্ছি। এখানে খাবে, নাকি, নিয়ে যাবে বাড়ি? যা খুশি করো।
একটু পরে হাসির মা ভাতের থালা আঁচলে ঢেকে দ্রুত প্রস্থান করেছে। পাগল হয়েছ? …ওনাদের খাবার আগে চোখের ছামুতে আমি বসে বসে গিলব নাকি? খিদে পেয়েছে বটে—বাড়ি যেয়েই নিশ্চিন্তে চাট্টি গিলব।
রুবি হাত ধুয়ে বারান্দায় এল। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর ঘরে ঢুকে সাহানার পিঠে হাত রেখে মৃদুস্বরে ডাকল, মা! ও মা!
সাহানা ঘুমোয়নি—কিন্তু ওঁৎ পেতে এতক্ষণ সব আঁচ করছিল যেন। মুহূর্তে ধুড়মুড় করে উঠে বসল সে। তারপর—ছেনাল, খানকি, বেশ্যা! সরম হয়নি এখনও? এখনও তুই বেঁচে আছিস? বলে আচমকা এলোপাথাড়ি দুমদাম কিল চড় থাপ্পড় মারতে শুরু করল।…মা! আমার আহ্লাদের মা! হারামজাদির জানসুদ্ধ নিকালে দেব আজ!…ভিজে আঁচড়ানো সুন্দর কালো ঘন চুলের ঝুঁটি ধরে সাহানা রুবির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল বারবার।
তারপর ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিল সে। রুবি নতমুখে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মার হজম করছিল। এবার পা তুলতেই সাহানা গজরাল। ….কোথায় যাবি? থাক, তুই কয়েদখানায়। আজ থেকে দুনিয়ার চাঁদসুরুয তোর মানা।
দ্রুত বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। শিকল তুলে দিল। তারপর বদ্ধ কপাটে পিঠ রেখে হাঁফাতে থাকল। লাল উদভ্রান্ত চোখে নিজের এতদিনের ঘরবাড়ি উঠোনটা দেখছিল সাহানা বেগম।…
তখনও কিন্তু রুবির আসল কীর্তিটা কী, একটুও জানা ছিল না সাহানার। আকবরকে হঠাৎ সবার সাক্ষাতে অমন করে অপমান করে বসা, হেমনাথের গাম্ভীর্য আর রহস্যময় কথাবার্তা—সাহানাকে এমনি ক্রুদ্ধ করে ফেলেছিল।
যদি জানা থাকত—তাহলে…
কী ঘটত? সেটা অনুমান করা হয়তো বা কঠিন, কিংবা কঠিনও নয়।
অনেক রাতে হেমনাথ আর প্রভাময়ী চুপিচুপি কথা বলছিল। ঝুনু শুয়ে পড়েছে অনেক আগে। সুনন্দ ভিতরবাড়ির বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমাচ্ছে। হেমনাথ বাইরের প্রাঙ্গণে সেই মাচায় খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ছিলেন। প্রভা তাঁর পায়ে তেল মালিশ করছিল।…
…আজ রাত্তিরটা কিন্তু বেশ যাবে। …হেমনাথ বলছিলেন। …দেখছ? একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে যেন!
প্রভা হাসল।…তোমার মতিভ্রম। হাওয়া কোথায়? গাছের পাতাটিও তো নড়ছে না। তবে গরমটা একটু কম।
একটা ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলে ঘরেই শুতুম। ধুস! ফাঁকা আকাশের নিচে শুতে এমন গা বাজে!
ঘরে শুলেই পারো। হাতপাখা তো রয়েছে। আমার দিব্যি কেটে যায়।
তুমি পাখা দোলাবে? রক্ষে করো। তোমার তো সেই বালিকা বয়স থেকে দেখছি, শুলেই নাসিকাগর্জন এবং…হাঃ হাঃ হাঃ!
তুমিও কম যাও না!
আমার নাক ডাকে নাকি? কই, টের পাইনে তো!
তুমি কীই বা টের পাও! তোমার চোখ থেকেও নেই, কান থেকেও কালা।
কেন, কেন? কী হয়েছে?
হবে আবার কী? এমনি বলছি।
ধুৎ! খামাকা কিছু বলার পাত্রী তুমি নও। কী, বলোই না খুলে?
প্রভা চুপ করে থাকল। নিঃশব্দে পায়ে হাত বোলাচ্ছিল সে।
হেমনাথ বিরক্ত। …ওই এক বদ অভ্যাস তোমার। আদত কথাটি খুলেও বলবে না—অথচ গঞ্জনাটি পুরো দেবে। কী ব্যাপার? সুনুর কথা? ছেড়ে দাও—ভাল্লাগে না। সমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন একটু হয়েই থাকে। তাছাড়া পিঠোপিঠি বাড়ি—ধরো যদি ও আমাদের জাতি—জ্ঞাতিই হত—সে একটুখানি সমস্যা ছিল বইকি। সে ভিন্ন জাত—আমরা ভিন্ন জাত। কোনো কথাই ওঠে না এতে। আর—সুনুর এই বয়সটা কেমন জানো? কতকটা পালছাড়া বাছুরের মতো—এখানে মুখ দিচ্ছে, ওখানে দিচ্ছে—ছোঁক ছোঁক করে ঘুরছে। ও বয়স আমার ছিল না? ওতে তেমন দোষের কিছু নয়।…ওটা পুরুষ চরিত্রের স্বভাবধর্ম। এই বলে হেমনাথ ফের হেসে উঠলেন।
প্রভা বলল, সুনুর কথা কি আমি ভাবছি না ভাবব? কোনটা সম্ভব কোনটা অসম্ভব ও ভালোই জানে। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের আমি বাপু বুঝতে পারিনে! বুঝলে? ওদের চালচরিত্তির, স্বভাব—সব কেমন উলটোপালটা যেন! ভেতরে ভেতরে সব মেলেচ্ছর ডেঁপো। ঠাকুরদেবতায় রুচি নেই। জাতবেজাতের বালাই নেই। একসঙ্গে বনভোজন করে আসছে একজায়গায় খাচ্ছেদাচ্ছে।
সেটা যুগধর্ম। ছেড়ে দাও। আমাদের জীবনটা তো নমো নমো করে তীরে এনে ঠেকাতে চললুম—আমাদের আর কী?
প্রভা কান না করে নিজের কথার জের টানল। …বড্ড ভয় করে আমার। নিজের তো মরে হেজে গিয়ে মাত্র দুটিতে ঠেকেছে ঠাকুরের কৃপায়। কিন্তু ওই দুটিকেই কেমন ভয় করে। অবশ্যি, সুনু—সুনু আমার খুব গুণী ছেলে—বুদ্ধিমান। তাকে বরং বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু…
হেমনাথ সচকিত হলেন। …কিন্তু? কে? কার কথা বলছ? কী করেছে সে?
প্রভা গলা খাটো করে বলল, ঝুনু। ঝুনুটা…
অ্যাঁ? কী করেছে ঝুনু?…হেমনাথ ধুড়মুড় করে উঠে বললেন। প্রভা চাপা ধমক দিলেন। …সবতাতেই পৃথিবী তোলপাড় করো কেন? চুপ করে শোও।
হেমনাথ উত্যক্ত হয়ে বললেন, ঝুনু কী করেছে বলবে তো?
সেটা আমার পক্ষে বলা শক্ত। তবে—কেমন মনে হয় যেন। তেমন কোনো গুরুতর কাণ্ড চোখে অবশ্য পড়েনি। তাহলেও….
তাহলেও?
ওই ছেলেটা গো—ওই যে রোগা ফরসা মতো—চোখে চশমাপরা মুসলমান ছেলেটা—ঝুনুর সঙ্গে পড়ে। আমাদের বাড়িও তো আসে মধ্যে মধ্যে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও হল আমাদের মতিয়ুল কাজির ছেলে। কবীর! তাই বলো!
আমার কেমন মনে হচ্ছে, বুঝলে? ঝুনুর কাছে প্রায়ই ওর নামলেখা গল্পের বইটই দেখি—গানের খাতাও একটা দেখছিলুম। তারপর অবশ্যি, আমার ভুল হতেও পারে—আজকালকার কী ব্যাপার বুঝিনে।
হেমনাথ রুদ্ধশ্বাসে বললেন, আর কী দেখেছ?
প্রভাও রুদ্ধশ্বাসে বলল, একদিন দুপুরবেলা ঘুমোচ্ছি—হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকেলক্ষ্মীর ঝাঁপির ওপর বেড়াল উঠেছিল—ঝাঁপিটা পড়ে যেত আরেকটু হলেই। উঠে গিয়ে ধরে ফেললুম। মনে মনে বললুম, মা আমায় সময়মতো জাগিয়ে দিয়েছেন! কী অলক্ষুনে কাণ্ড! তারপর বেরিয়ে ঝুনুর ঘরে গেলুম। গিয়ে দেখি সেই মুসলমান ছেলেটি ঘরের মধ্যে ঢুকে বসে রয়েছে! ও হরি তাই এই কাণ্ড! ঝুনুর ওপর রাগ হল। কিন্তু কী বলব তখন? এদিকে ছেলেটি দৌড়ে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আর কী! একটু সরে এলুম। আশীর্বাদও করতে হল। তা—কথাটা বলব বলব করে তোমায় বলা হয়নি।
সুনু ছিল না তখন?
উঁহু।
দু’জনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন। তারপর প্রভা একটু শুকনো হেসে বলল, ছেলেটিকে দেখে কিন্তু মুসলমান বলে মনেই হয় না। দিব্যি বামুনের ঘরের ছেলে যেন।
আজকাল কাকেও দেখে জাত চেনা কঠিন—ও তুমি কী বলছ? তাছাড়া হাটেবাজারে শহরে যাও না—দেখবে এক গেলাসে হিঁদু—মুসলমানে চা খাচ্ছে। সেটা কোনো কথা নয়। কিন্তু…
ঝুনু আমার তেমন মেয়ে নয়। তবে, বয়সটা বড় শত্তুর কিনা। চোখে চোখে রাখতে হবে। আর তাও বা কেমন করে রাখব? বাইরে গিয়ে কী করছে—জানব কেমন করে? ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের পেটের ছেলেমেয়েরা কী হল সব? তেষ্টা পেলেই কি যেথাসেথা জল খেতে আছে? জন্তুজানোয়ার, না মানুষ সব?
সে কথা…বলে হেমনাথ পাদুটো ছড়িয়ে দিলেন। আকাশের নক্ষত্র দেখতে থাকলেন।
জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে—এতদিনে এই প্রথম দু’জনে নিজেদের একটা গভীর অসহায়তা আবিষ্কার করছিলেন। হতাশা ওঁদের মিইয়ে দিচ্ছিল। কোনো কথা বলতে পারছিলেন না কেউ। মনে হচ্ছিল—কী একটা প্রচণ্ড—ভয়ানক—অবিশ্বাস্য শক্তির প্রবাহ পৃথিবীতে আবহমানকাল ধরে চলেছে। কিন্তু আজ সে কোনো বাধাই আর মানবে না। তাকে আর কোনোমতে বশ মানানো যাবে না। তাকে রুখতে গেলে তার অপ্রতিরোধ্যতা পৃথিবীর এযাবৎকালের সব সাজানো সংসারকে ভাসিয়ে তছনছ করে বয়ে যাবে। চারদিক থেকে তার পায়ের পুরনো শেকলটা ভেঙে পড়ার ঝনঝন শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
আর প্রাজ্ঞ মানুষ হেমনাথ শুধু ভাবছিলেন—এ শক্তি কি মঙ্গলের না অমঙ্গলের? একি বিধ্বংসী, না সৃষ্টিশীল? একে বরণ করা ভালো, নাকি প্রত্যাখ্যান করা উচিত? কিন্তু শেষ অব্দি তাঁর একান্ন বছরের জমাট সংস্কারকে তিনি তাঁর সামনে সবেগে এগিয়ে যেতে দেখলেন! অস্ফুট কণ্ঠে হেমনাথ বলে উঠলেন, না, না!