নিষিদ্ধ প্রান্তর – ৫

পাঁচ

সদর দরজার কাছে হেমনাথের ভারী গলায় সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল—খাঁসাহেব, খাঁসাহেব আছো নাকি?

হেমনাথ খুব কমই এসেছেন এ বাড়ি। খুব একটা কারণ থাকলে তবেই এসেছেন। সাহানা মেজবাবুর সামনে পর্দা মানে না। বড় জোর ঘোমটাটা একটু বাড়িয়ে দ্যায় এবং কণ্ঠস্বর খাটো করে কথা বলে, এই মাত্র!

সেদিন সাহানার মনে অন্য ভাব—আকবর জামাই হবে এবং আকবর এখন রুবির ঘরে আড্ডা দিচ্ছে, মনটা ছিল খুশিতে ভরা। হাসির মার সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল। হেমনাথের ডাকটা সে শোনেনি।

সাড়া না পেয়ে হেমনাথ নিঃসঙ্কোচে উঠোনে চলে এলেন—কয়েকবার গলা ঝেড়ে কেশে তাঁর অর্থাৎ মুসলমানবাড়ি পরপুরুষের উপস্থিতি জানিয়ে দিলেন প্রথামত। …কই, খাঁয়ের পো গেল কোথায়?

শশব্যস্তে সাহানা বেরিয়ে এল এবার। তারপর হালকা পায়ে দ্রুত এগিয়ে বারান্দার আলনা থেকে কম্বলটা নামাল। বিছিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, বসুন মেজবাবু। উনি এক্ষুনি কোথায় বেরোলেন।

হেমনাথ পা ঝুলিয়ে বসলেন উঁচু বারান্দায়। ওপাশের ঘর থেকে আকবর—ঝুনুর হাসাহাসি ও কথা শোনা যাচ্ছিল। তিনি কান খাড়া করে বললেন, ঝুনু মনে হচ্ছে!

সাহানা একটু হেসে জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আপনার মেয়ে নিজের বাড়ি খায় আর এবাড়ি এসে আঁচায়।

হেমনাথ বললেন, আর কে আছে? নুরু এসেছে নাকি?

এবার ঘোমটা একটু বাড়িয়ে কণ্ঠস্বর আরও চাপা করে সাহানা বলল, আকবর—খালেক মিয়ার বড় ছেলে।

হেমনাথের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। কোনো কথা বললেন না।

সাহানার তর সইছিল না। বুকে কী একটা ভাবাবেগ শিসিয়ে উঠছিল মুহুর্মুহু। কী খবর এনেছেন মেজবাবু? ভালো, নাকি মন্দ? আর বেআক্কেলে লোকটাই বা দুম করে কোত্থেকে এসে কোথায় উধাও হল হঠাৎ? নাঃ এতটুকু যদি বিষয়বুদ্ধি থাকতে আছে ওনার। সাহানার মনে একটা প্রবল দ্বন্দ্ব—কী হল জানবার তীব্র ইচ্ছে, আবার অন্যদিকে যদি খবরটা খারাপ হয়, সইতে পারবে না সেই যন্ত্রণার ভয়—কারণ এই আকবর এসে পড়ায় সকালটা যে ইতিমধ্যে চরম আশা আনন্দে টলটলে ভরা পাত্রটি হয়ে উঠেছে। সাহানা মনে মনে বলছিল, খোদা—আমার এ খুশির জোয়ার শুকিয়ে ফেলো না!

হ্যাঁ, এই ছিল তার মায়ের মনের ভাবতরঙ্গ। শুধু তার নয়, হয়তো সব পাড়াগেঁয়ে বাঙালি মায়েরই—যাদের ঘরে রুবির মতো আঠারো বছরের মেয়ে আছে, যারা গরিবমানুষ, যারা মেয়েকে দুধেভাতে এবং চোখের সামনে থাকতে দেখতে চায়। সবারই।

হেমনাথ যেন টের পাচ্ছিলেন। অভ্যাসমতো দাঁতের কোনো গূঢ় ফাঁক দিয়ে একচিলতে থুথু সাবধানে দূরে ফেললেন তিনি। তারপর বললেন, বসব না বড়বিবি। উঠি। বরং খাঁকেই আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিয়ো। কথা আছে।

সাহানা আর অপেক্ষা করতে পারল না। দেয়ালে পিঠ রেখে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল সে। ঘরের ভিতর যে রুবি বসে আছে খাটের কোণে, লক্ষ্য করেনি তখনও। একটু কেশে বলল, মেজবাবু, খবর ভালো তো?

হেমনাথ যেন অন্যমনস্ক ছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কীসের?

সাহানার রাগ হল। ন্যাকামি করছেন কেন মেজবাবু, নাকি তাকে এসব ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন? আসলে রুবির ভালোমন্দ ভবিষ্যতের ন্যায্য মালিক তো সাহানা। হাজার হোক, আফজল খাঁ রুবির সৎ বাপ। …এবং ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই তার রাগ হচ্ছিল। কিন্তু রাগটা চেপে সে কণ্ঠস্বর একটু চড়ায় এনে বলল, মেয়ের ভাবনা মা ছাড়া আর কার বেশি হবে মেজবাবু? দেখছেন তো কাণ্ড—মিয়ার আর কাজের সময় ছিল না! ঠিক সময়েই বেপাত্তা। এ তো আমি জানিই। মেয়ে আমিই সঙ্গে করে এনেছিলুম। তার যা দায়িত্ব—তা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে লাভ নেই মেজবাবু। নেবে কেন সে, বলুন।

হেমনাথ ব্যাপারটা আঁচ করে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, না—সেটা ঠিক কথা নয়! তবে কী জানো, সব কথা সবসময় বলাও যায় না! তুমি অবশ্য মেয়ের মা আর আমি কিনা—ওই যে কী বলে তোমাদের ভাষায়, সাদির পয়গম্বর নিয়ে—

ভুলটা শুধরে দিলেন সাহানা—হাসিমুখেই, সাদির পয়গাম!

হ্যাঁ, হেমনাথ হেসে ফেললেন। …তোমাদের কথাগুলো কেমন গুলিয়ে যায় বাপু। মনে থাকে না। যাক গে।…বলে ফের গম্ভীর হলেন।…এত অধৈর্য হচ্ছ কেন বড়বিবি? মনটা শক্ত করো। যা বলার আমি, খাঁকেই বলব। খালেক আমার মাথাটা গুলিয়ে দিয়েছে।

সাহানা দু’পা এগিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, না মেজবাবু। আপনি শুধু বলে যান, ওরা হ্যাঁ বলেছে, নাকি না বলেছে?

পরক্ষণে একটা কল্পনাতীত অঘটন ঘটে গেল—যার পূর্বপ্রস্তুতি বা পটভূমিকা কারও জানা ছিল না। আচমকা রুবি বেরিয়ে এল ঘর থেকে আলথালু চুল, লাল চোখ, ভিজে মুখ স্ফুরিত নাসারন্ধ্র—হাতের মুঠোয় একটা দলাপাকানো কাগজ—সে তীব্রকণ্ঠে বলে উঠল, কী? কী ভেবেছ তোমরা? আমাকে কী পেয়েছ? আমি কি হাটের গোরুছাগল?

তার কণ্ঠস্বরে কান্নার কড়া ঝাঁঝ ছিল। হেমনাথ স্তম্ভিত হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। সাহানা হতচকিত—বিমূঢ়। তারপর তাদের চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেছে রুবি। বারান্দার শেষপ্রান্তে তার ঘরের দরজায় পৌঁছেছে।

রুবি রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করছিল, ছোটলোক, ইতর, বদমাশ! এখুনি বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। নয়তো অপমানের চূড়ান্ত করব তোমার। কী ভেবেছ আমাকে? বেরোও ছোটলোকের বাচ্চা!

ঝুনু ভিতরে পাথরের মূর্তির মতো স্থির। আকবরকে থমথমে মুখে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। বাড়িতে সব কণ্ঠ স্তব্ধ, সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। আকবর সদর দরজা আর রান্নাঘরের দেওয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড় করানো সাইকেলটা সজোরে টেনে নিল। ভীষণ স্তব্ধ বাড়িটা কেঁপে উঠল ঝনঝন শব্দে। তারপর সেটা শূন্যে তুলে দরজা পার করে ফেলল। তারপর সে অদৃশ্য হল বাহন সমেত।

এবার সাহানার জ্ঞান ফিরল। চেরা গলায়—বিস্ময়ে দুঃখে সে চিৎকার করে উঠল, রুবি, রুবি! এই হারামজাদি মেয়ে!

রুবিকে দেখা গেল নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। সাহানা কয়েক মুহূর্ত দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের পর ফের হেমনাথের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, দেখলেন, দেখলেন মেজবাবু? আমি—আমি কী করব বলতে পারেন? গলায় দড়ি দেব? নাকি বিষ খাব? হারামজাদি ইজ্জত সম্ভ্রম এমনি করে নষ্ট করে বসল!

হেমনাথ বললেন, তুমি আর মেয়ের মতো মাথা খারাপ করোনা তো বড়বিবি! যাও, যা করছিলে করোগে। ঝুনু অ ঝুনু, বাড়ি আয়।

ঝুনু বেরিয়ে এল। কিন্তু কোনো কথা না বলে সটান খিড়কির দরজা দিয়ে চলে গেল। হেমনাথ ফের বললেন, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। খাঁসাহেব এলেই আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। তারপর সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন হেমনাথ।

হাসির মা উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। জিভ বেরিয়ে পড়েছে, লালা ঝরছে, এতক্ষণে বলল, গোস্ত কষা হয়ে গেছে গো! কট্টকুন পানি দেবেন, দিয়ে যান।

সাহানা মুখ বিকৃত করে বলল, উড়েপুড়ে যাক মিয়ার গোস্ত! শ্যালশকুনে খাক।

সাহানাও মেয়ের মতো নিজের ঘরে ঢুকল। তারপর উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। অক্ষম অসহায় ক্রোধে ফুলে কাঁদতে থাকল সে।

হাসির মা রান্নাঘরে ঢুকল। বুড়ি অবশ্য হাসছিল সকৌতুকে। চামচে দিয়ে মাংস নাড়তে নাড়তে বলছিল, হুঁ, এই হয়েছে কী, আরও কত হবে। সবে তো রোজ কেয়ামতের শুরু গো! কবে থেকে ইশারায় বলছি, মেয়ের দিকে চোখটা রেখো—গরিবের কথা বাসি হলেই কাজে লাগে কিনা! যাক গে বাবা, এসব হচ্ছে মিয়ামোখাদিমের বাড়ির কাণ্ড। বাইরে চেকনাই, ভেতরে ইঁদুরচামচিকের উপদ্রুপ।

সেদিন আফজল বাড়ি ফিরেছিলেন দুপুর গড়িয়ে। বেনামী চিঠিটা রুবির হাতে গুঁজে দিয়েই বেরিয়েছিলেন। এভাবে বেরোনোর একটা উদ্দেশ্য ছিল। রুবিকে পুরোটা পড়ার এবং কৈফিয়ত তৈরির জন্য কিছু সময় দেওয়ার কথা তাঁর মাথায় এসেছিল। কারণ, নিজেকে সুবিবেচক ভাবা তাঁর স্বভাব। সব ব্যাপারেই কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটলে তিনি হঠাৎ রেগে যান যদিও—পরে তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেন, ভুলটা সম্ভবত তাঁর নিজেরই এবং কোথায়ই বা ভুল হল। নিজেকে সৎ এবং বুদ্ধিমান মানুষ মনে করেন আফজল খাঁ। এদিকে নিজের কাজে বা আচরণে তাঁর আস্থাও বেশ দৃঢ়। তা সত্ত্বেও আপস করার মতো নমনীয়তারও অভাব নেই তাঁর চরিত্রে। কেউ ভুল বুঝিয়ে দিলেও যদি নিজের বুদ্ধিতে সেটা ঠিক মনে করেন, তাহলেও শেষঅব্দি তিনি আত্মসমর্পণ করতে জানেন। কারণ, দুঃখ শোক বিষণ্ণতা বা সবরকম অ—সুখভাবের প্রতি তাঁর ভীতি আছে। পৃথিবী আর কুসুমগঞ্জ, কুসুমগঞ্জ আর তাঁর সংসার, তাঁর সংসার এবং ব্যক্তিগত জীবন—সবখানে সম্ভবপর আনন্দস্রোত অব্যাহত রাখার তিনি পক্ষপাতী। আনন্দস্রোতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের সম্ভবত সবচেয়ে স্থূল উদাহরণ তাঁর আহার—বিলাস। বিলাসই বলা যায়—চরম অভাবের মধ্যেও তাঁর রান্নাঘর থেকে প্রতিবেশীরা তেল ঘি মশলার সুগন্ধ শুঁকতে পারেন। এটা অবশ্যই একটা তাক লাগানো ব্যাপার। লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে। সাহানার জবানে, শরীরের গুহ্য ইজ্জতটুকুই যখন অসাবধানে হাঁটলে সবার সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে পড়ছে এবং ‘বেহায়া বেশরম’ মিয়াসাব এতটুকু ভ্রূক্ষেপ করছেন না, তখন হাতে দুটো টাকা এলেই সবার আগে আব্রু ঢাকবার চেষ্টা না করে উনি কিনা আনলেন হয়তো শেখপাড়া থেকে জব্বর দুটো মোরগ আর গোয়ালার বাড়ি থেকে একপো সরেস ঘি! মেয়েকে পাশে নিয়ে কোরমা খেতে খেতে আফজল অসাবধানে একটা হাঁটু তুললেই পরিবেশনরতা সাহানা ত্বরিতে মুখে আঁচল ঢেকে একটু ঘুরে হিসহিস স্বরে দুর্বোধ্য কী গর্জন করেছে। আফজল অমনি টের পেয়ে হাঁটুটা নামিয়ে ফেলছেন। পাশে মেয়ে—আর বালিকা নয়, রীতিমতো যুবতী—আপাতদৃষ্টে লাজুক, নম্র শান্ত, স্বল্পভাষিণী; তত্রাচ সেও স্বভাবত টের পেয়ে মুচকি হেসেছে আড়ালে। চতুর আফজল মুহূর্তে বেহায়ার মতো বলে উঠেছেন, হাসিস নে রে বেটি। হাসতে নেই। গুরুজন বটি না তোর? দ্যাখ না, শিগগির চাঁদু জোলার কাছে চাঁদমার্কা লুঙ্গি কিনলুম বলে! ….সাহানা হাসবে কী—গর্জে খুন।…কবে তোমার আক্কেল হবে শুনি? ছি, ছি ছি! জোয়ান মেয়ের সঙ্গে তামাশা, গলায় দড়ি জোটে না গা? আফজলের ভ্রূক্ষেপ নেই। মোরগের আস্ত রানটা দাঁতে কামড়ে অক্লেশে বলে উঠেছেন, যাও যাও! রুবি আমার শিক্ষিতা মেয়ে। তোমার মতন মক্তবপড়া নাকি? কী পড়েছিল রে তোর মা, রুবি? এই বলে আফজল মক্তবের পড়ুয়ার ঢঙে সুর ধরে পড়েছেন—আলেফ জের আ, বে জের বা, আবা!…পরক্ষণে খ্যাক খ্যাক করে হাসি। মুখের গোস্ত ছিটকে পড়েছে সামনের বাড়তি ভাতে। সাহানা ফের আগুন।….

এমনি মানুষ আফজল খাঁ। লোকে বলে খাঁ নয়, খা। খেয়ে খেয়েই ওনারা পুরুষানুক্রমে শেষ হয়ে আসছেন। লোকে আড়ালে বলে, তা—এই পুরুষেই সবটুকু শেষ। তিনবিঘেয় এসে ঠেকেছে। তারপর আর কী খাবেন? হেমনাথ এ নিয়ে বন্ধুকে অনেক বলেছেন। বন্ধুটি কানেই নেয় না। বরং সকৌতুকে বলে, আমার আগের পুরুষে নাকি তলোয়ার চালিয়ে মানুষের মাথা কাটতেন। তা বংশের ধারা যাবে কোথায় হে মেজবাবু? ওনাদের তলোয়ার ক্ষয় পেতে পেতে আমার এখন ছুরিতে ঠেকেছে। ওই দিয়ে আমি মুরগির মাথা কাটছি। যা বলবে বলো ভাই, যে ক’টা দিন বেঁচে আছি—ওই করেই চলুক। আফজল খাঁ কুসুমগঞ্জে আরও কিছু মজার কথা চালু আছে। সে খবর নাকি বিশদ দিতে পারেন বাজারের দত্ত মশাইরা। কাপড়ের দোকানে আফজলকে দেখলেই অবিক্রীত কিন্তু সবচেয়ে দামি কাপড়খানি গছিয়ে বললেই হল, হ্যাঁঃ, এ জিনিস খাঁসাহেব ছাড়া আর এ তল্লাটে নেবেই বা কে? শুধু টাকা থাকলেই তো আর হল না! নজর চাই। আছে আর কার এমন উঁচু নজর! নিন খাঁসাহেব, আপনার জন্যেই দিন গুনছে বেচারা। টাকা? আরে সেজন্যে ভাবনা কী? নিয়ে তো যান….হ্যাঁ, আফজল এ টাকা কোনোমতে ফেলে রাখবেন না। নিজের বংশগরিমা হোক, কিংবা আত্মমর্যাদা হোক, যেভাবে পারেন শিগগিরি টাকা এনে দিয়ে যাবেন। তার জন্য যদি ভিটেটাও বিক্রি হয়ে যায়, তার পরোয়া নেই।….

সাহানা ব্যাপার দেখে থ বনে যায়। মাথা কুটতে বাকি রাখে…। ঘরের ফুটো চাল দিয়ে বিষ্টি পড়ছে—আর আমি বাঁদির বেটি বাঁদি এই দামি মসলিন পরে ঘুরে বেড়াব? ছি, ছি, ছি! কবে বুদ্ধিসুদ্ধি হবে গা লোকটার!…বেশি রাগ হলে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায়। তখন আফজল চেঁচিয়ে রুবিকে ডাকেন।…রুবি, অ রুবি। এই নে—তুই—ই পর। ও বাঁদির বেটি বাঁদি জীবনে কখনও দেখেছে এ জিনিস। গা কুটকুট করবে না। সইবে কেন?…সাহানা পারলে আশমান ফাটিয়ে ফেলে—কিন্তু মিয়াবাড়ির বউ, পাঁচিলের বাইরে গলার স্বর পৌঁছানো বারণ—সে হাতের হাঁড়ি ঝনঝন শব্দে আছড়ে বলে, খবরদার! মা তুলে কিছু বললে আমি ভালোমানুষের ছেলের খোয়াব করে ছাড়ব। তখন আফজল অভ্যাসমতো বলে ওঠেন, কেন? কেন বলব না? আর যদি বলেই থাকি—বলো, বলো কী করতে হবে আমাকে? নাকখবদা দেব? দশহাত পাছা ঘঁষড়াব?…ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এবং রুবি মিটিমিটি হাসে। জানে তো, রাত্তিরটা আসুক, শোবার সময় হোক, তখন আব্বা—মায়ে চিরাচরিত ফায়সালা হতে দেরি হবে না।

কিন্তু ফের মজার কথা, পরবর্তী ইদের উৎসবের সক্কালে দেখা গেছে, সাহানা বেগম রীতিমাফিক স্নান সেরে রুবিকে ডেকে বলছে, অমা! সেই কাপড়খানা বের কর দিকি বাকসো থেকে! একটু পরে সেই শাড়িটিই পড়ে সাহানাবেগম যখন ইদের নামাজ প্রত্যাগত আফজলকে কদমবুসি অর্থাৎ পায়ে চুমু খেতে ঝুঁকেছে—স্পষ্ট দেখা গেছে দু’চোখ ছাপিয়ে ‘বেশরম বেপরোয়া’ খুশির অশ্রু গড়াচ্ছে।

রুবি কী বোঝে কে জানে! এসময় তারও—সবার আড়ালে চোখের কোনায় কয়েক ফোঁটা শান্তির কান্না টলমল করতে থাকে।…

সেদিন আফজল বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে গিয়েছিলেন হাইওয়ের ওদিকে ঘনগাছপালা ঢাকা গোরস্থানে। ওখানে কেন গেলেন, তিনিও জানতেন না। অন্যমনস্ক চলতে চলতে যখন হঠাৎ চমক ভেঙেছে, দেখে অবাক হয়েছিলেন। বুকটা মোচড় দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। অগাধ একটা শূন্যতা তার দু’চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

এখানে তাঁর গৌরবময় বংশের সবাই শুয়ে রয়েছেন। চরম কোনো দুঃখের দিনেও তিনি এমন করে তো এখানে এসে পড়েননি। আজ কেন এলেন?…ভাবছিলেন আফজল।

ভাবছিলেন, আর একটা গভীর অভিমান তাঁর মনের চারপাশে ক্রমশ দানা বাঁধছিল। এ অভিমান কোনো মানুষের ওপর নয়—যেন এ অভিমান এই দুনিয়াটার ওপর। তিনি ভাবছিলেন; দ্যাখো তাহলে—এ কমবখত হারামি দুনিয়াটা মানুষকে কেমন ঠকায় দ্যাখো! তুমি ভাবছ—সব বেশ ঠিকঠাক আছে, একটুও ভুলভাল গোলমাল নেই। দিব্যি মনের সুখে খাওদাও ঘুমোও। হঠাৎ টের পেলে, তোমার পায়ের নিচেই কখন দরিয়ার অথৈ পানি ধেয়ে এয়েছে! নাও, এখন মরো না ডুবে—কে বাঁচাচ্ছে! ….নাঃ হেমকে আর আমি মুখ দেখাতে পারব না। ছি ছি ছি, কী ভাববে ও? সেই এতটুকুনটি থেকে দুই ছোঁড়া মানুষ হলুম। একসঙ্গে পাঠশালায় ঢুকলুম। একসঙ্গে হাইস্কুলে পড়া হল। আবার একদিন একই সঙ্গে দু’জনে বললুম, ধুস বাঞ্চোত! পড়ে কি চারখানা হাত গজাবে, নাকি পায়ে দুটো ডানা হবে? দে ইস্কুলের খাতায় ঢ্যারা দেগে! এনট্রান্সের দরজায় গিয়ে দুই বদমাশে পিছু ফিরে পালিয়ে এলুম! ওর বাবা অবশ্য বেঁচে ছিলেন—নামকরা ডাক্তার। কিন্তু হেমের মতো আঁকড়া জোয়ানকে সামলানো তাঁর সাধ্যি ছিল না। তাছাড়া ওনার আবার ওই স্বদেশি হওয়ার বাতিক ছিল প্রচণ্ড। চালাক হেম করলে কী, সোজা বলে দিলে—সে গান্ধীজীর চেলা হচ্ছে। দিনকতক হেম খুব চেঁচামেচি করলে—’বিলিতি কাপড় গাধায় পরে! ইংরেজের স্কুলে পড়লে চাকর হয়, চাকর হয়’! ‘বন্দেমাতরম’! ব্যস, ওর বাবা ছেলেকে রসগোল্লা খাইয়ে বললেন, বা ব্যাটা, চমৎকার!….আর গতিক দেখে আমিও তখন হেমের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছি। মিটিং—এ যাচ্ছি। সে এক হইহই কাণ্ড কুসুমগঞ্জে। আব্বা ছিলেন এক খানবাহাদুরের ‘ধামাধরা’ মানুষ। আব্বা আমার মতিগতি দেখে রেগে আগুন। একদিন করলুম কী, খানবাহাদুরের মোটর গাড়ি আসছে—হেম আর আমি একদল স্বদেশি জুটিয়ে দলবেঁধে গাড়ির সামনে ওকে ‘মিরজাফর’, ‘ইংরেজ কুত্তা’ কত কী বলে গাল দিলুম, শাসালুম। সেই রাত্তিরেই পুলিশ আমাকে আর হেমকে ধরল। তখন নতুন যৌবনের রক্ত কিনা—টগবগ করে ফুটছে শরীরে—আমাদের নেশা ধরে গেল বেআইনির! হ্যাঁ, বেআইনির। আইন মানছি না, মানি না—ভাবতেই খুশির জোয়ারে মন টলমল করছে। কিন্তু শেষ অব্দি ওই হেমেরই হল ছ’মাস জেল—আমাকে দিলে ছেড়ে। কোর্ট থেকে বেরোতেই আজব কাণ্ড। কারা সব দৌড়ে এসে কাঁধে তুলে নিল। গলায় মালা পরিয়ে দিল। এখনও সেদিনটার কথা ভুলিনি। কুসুমগঞ্জে ঢুকেছি—সব দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে, বারান্দা থেকে হিন্দু মেয়েরা খই ছড়িয়ে দিচ্ছে। শাঁখ বাজাচ্ছে। উলু দিচ্ছে। কপালে এঁকে দিয়ে যাচ্ছে কীসব ফোঁটা। আমার বুকখানা যদিও ফুলেফেঁপে দ্বিগুণ বেড়েছে—কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা দুঃখ পোকার মতো কটকট করে কামড়াচ্ছে। আ ছি ছি! আমি যে ঠকাচ্ছি সবাইকে! আমার মধ্যে যে ফাঁকি থেকে গেছে! …পরে হেম জেল থেকে ফিরলে তাকেও এমনি সব করা হয়েছিল। হেম আমাকে খুলে বলেছিল তার মনের কথা। সেকথা আমারই কথা। আর, কুসুমগঞ্জের মুসলমানরা সেদিন তামাশা করে বলেছিল, ইস, খাঁয়ের পোর সাদী হচ্ছে গো, সাদী হচ্ছে! তা শুনে আমার আব্বা নাকি খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোরা এ হিরের দাম বুঝবি কী? আফজল তার খানদানের খাঁটি কাজটিই করেছে। তোরা জানিস, আমার পূর্বপুরুষ এমনি চিরদিন শেরের মাফিক (বাঘের মতো) কাজই করেছে?…হ্যাঁ আব্বা এইসব সম্মান দেখে শেষ অব্দি খুশিই হয়েছিলেন। এমনকি দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর থেকে খানবাহাদুরের সঙ্গে তাঁর চিরকালের মতো আড়ি হয়ে যায়। এমনকি নিজের জাত সম্প্রদায়ের সঙ্গেও আড়ি হয়। তা যাক, এজন্যে আফশোস তাঁর ছিল না। বরং আব্বা তারপর হিন্দুঘেঁষা হয়ে উঠলেন। এবং আমার তো ছিলই না আফশোস, পড়া ছাড়ার পরিণামটা ভালোই মনে হচ্ছিল—দিব্যি পাখির মতো আশমানে চক্কর মেরে বেড়ানো শুরু করলুম। আর হেম ফিরে এলে যেন সেই আশমানটা আরও বড় হয়ে উঠল।…

হেমের সঙ্গে আমার জীবন এমনি করে একই সুতোয় গাঁথা থেকে যাচ্ছিল। এতদিনেও সুতোটা এতটুকু পুরনো হয়ে পড়েনি। কিন্তু আজ দেখেছি, ওটায় জোর টান পড়েছে। ছিঁড়তে আর দেরি নেই। কী তাজ্জব কাণ্ড, ওই রুবি—এতটুকুন বাপহারা মেয়েটাকে আমি বাপের দুঃখ জানতেও দিইনি—আমার চোখের মণি, বুকের কলজে হয়ে রয়েছে যে—সেই কিনা ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এ লজ্জা ঢাকবই বা কোথায়? বুঝবেই বা কে? রাজ্যি জুড়ে ভেতরে ভেতরে অ্যাদ্দিন যে চাপা গুজব ছড়াচ্ছিল, এবার যে সব চাউর হয়ে যাবে! আমি শালা এক বুদ্ধুর বুদ্ধু, গোঁয়ারের বাদশা, কুঁড়ের যাশু—আমি যেন দেখেও কিস্যু দেখিনি অ্যাদ্দিন! কিন্তু একটুখানি ভেবে দেখলেই তো সব স্পষ্ট বোঝা যায়। ঘিয়ের পাশে রেখে দ্যাখো না কাণ্ড। ঘি গলবেই। ওদের দোষ কী? যত দোষ আমার—হ্যাঁ, হেম ঠিক একথাই বলবে। কেন আমি লক্ষ্য রাখিনি সময়মতো? কেনই বা এ হারামি চোখ দুটোয় ঠুলি পরে ছিলুম গা?…হেমের ছেলে আমার বাড়ি এসেছে দু’বেলা—আমার ঘরে ঢুকেছে, বিছানায় গড়িয়েছে, রান্নাঘরে গিয়ে বসেছে—দোষ তো আমারই। আর এদিকেও বড় মুশকিল—আমি মুসলমান, আমার ধর্ম কাকেও বারণ করে না, ছিঘেন্না করে না, তুচ্ছ করে না। আমার ঘরে সুনু আসছে যাচ্ছে, ঢুকছে—আমি তা বারণ করিই বা কী করে? আমার ধর্ম আমাকে তালিম দিয়ে বলেছে—সবাই মানুষ, সবাই খোদার কাছে সমান। আর, ওদিকে দ্যাখো, হেমের বাড়ি আমার মেয়ে হাজারবার যাক, তার তো যত মুরোদ ঘরের বারান্দা অব্দি! তাতে হেমের বউটি আবার ছোঁওয়াছুঁয়ি জাতবিচারে বড্ড কড়া মানুষ। হেমও গতবছরে গুরুর দীক্ষা নিয়ে এসব দিব্যি মেনেটেনে চলছে। কাজেই, বোঝা যাচ্ছে—রুবির সঙ্গে সুনুর যদি কোনো মনামনি হয়ে থাকে তো সে হয়েছে আমার বাড়িতেই। কাজেই, সব দোষ আমার ঘাড়েই পড়ছে।…

সাহানাও বলবে—দোষটা আমার। কেন, না আমার ধর্ম মানুষকে ছিঘেন্না না করতে শেখাক; এটা তো সত্যি—মেয়েদের পর্দা মানতে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কোন আক্কেলে আমি রুবিকে সুনুর সঙ্গে মিশতে কোনো বাধা দিইনি? তাছাড়া আরও মস্তো গলতির কথা—হয়তো গোনাহর কথা যে একটি হিন্দু ছেলের সঙ্গে আমি রুবিকে মিশতে দিয়েছি। বাড়ির জ্ঞানী মুরুব্বি হিসেবে এ কাজ একটুও ঠিক করিনি! নিজের বংশের গৌরব তো ধুলোয় লুটোবে; উপরন্তু ওই মেয়েটার জীবনটা যে বরবাদ হয়ে যাবে গা! ছি, ছি! আমি কী করব এখন? ক’হাত নাক খপদা দেব? কতটা পাছা উদোম করে ঘঁষড়াব?…

আফজলের চোখ ফেটে জল আসছিল। নির্জন গোরস্থানে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার বসে পড়লেন। জুতোদুটো অলক্ষ্যে কখন পা থেকে খুলে হাতে নিয়েছিলেন—মৃতদের প্রতি সম্মানে। এখন কোলে লুঙ্গির ওপর রাখতে গিয়ে দেখলেন, একচাবড়া গোবর দলেছেন। তক্ষুনি মুখ বিকৃত করে জুতো দুটো উপুড় করে ঘাসের ওপর রাখলেন। একটা কাঠি কুড়িয়ে নিবিষ্টমনে জুতোর তলা সাফ করছিলেন আফজল।…

রুবি এমনি একদলা গোবর মাখিয়ে দিয়েছে আমার মুখে। বোকা মেয়ে, এতবড় একটা পাশ দিয়েছিস, এটুকন বুদ্ধি হল না তোর যে কোন গাছে আমি বাসা বাঁধছি? ও গাছটাই তোর বৈরী, মা। মাথা কুটে মরলেও তো ও তোকে আশ্রয় দিতে পারবে না! আজ আমার নুরু যদি হেমের মেয়ের সঙ্গে ভাবভালোবাসা করত, বুকে ডঙ্কা বাজিয়ে চেঁচিয়ে বলতুম, বাহাদুর! সাবাস ব্যাটা! কেন বলতুম জানিস? নুরুকে আমি তোর মতোই স্নেহ করি। আমি এমন বাপ নই যে ছেলে যখন এসে বললে, এই ফলটা আমি খাব আব্বা—আমি তাতে মুখ বেঁকাব। না—তেমন বাপ হওয়া রক্তে আমার জন্ম হয়নি। আরে বাবা, সংসার ঘরকন্না করবি তুই—তোর পছন্দসই সঙ্গীটি দেখে নিবি—তাতে আফজল খাঁ মোটেও নারাজ নয়। কিন্তু রুবি, তোর ভুলের কোনো মাফ নেই। কার জন্যে তুই নিজের জানটা ইস্তেমাল করছিস? সুনুর সাধ্যি আছে যে সে তোকে নিতে পারবে? দেশময় ঢি ঢি পড়ে যাবে না? ওদের সমাজের কানুন কত কড়া, তুই শিক্ষিত মেয়ে হয়েও কি জানিস নে? আমার ছেলে নুরু যদি কোনো হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে, সমাজ খুব একটা আপত্তি করবে না। শুধু বলবে, ঠিক আছে মানিক। এবার মেয়েটিকে কলমা পড়িয়ে নিয়ো—ব্যাস আমরা খুশি। খুশি হবে আমার সমাজ। সে বলবে, আরে ভাইসাব—এ তো ভালো কথা। আল্লার দুনিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা আরও একজন বাড়ল। কিন্তু ওরা? হেমের মুখেই শুনেছি—হিন্দু হওয়া যায় না, হিন্দু হয়ে জন্মাতে হয়। বাসরে! কী সর্বনেশে সাংঘাতিক কথা তাহলে! তুই হতভাগী খোদার কাছে বরং কান্নাকাটি করে বল, হে খোদা, এ দুনিয়ায় তো হল না—পরের দুনিয়ায় যদি….

ধুত্তেরি! কী পোকা রে বাবা! …আফজল ঊরুর নিচে থেকে একটা পোকা বের করে টিপে মারলেন। একদলা সবজে মাংস ঘাসের ওপর এবং কিছু তাঁর আঙুলে লেগে রইল। ঘাসে মুছে দুটো আঙুলে ঘষে পরখ করলেন আর রক্ত বা রসের চিটচিটে ভাব কতটা আছে। তারপর শূন্যদৃষ্টে সামনের দিকে তাকালেন।…

হ্যাঁ মুহব্বৎ বলে একটা কথা আছে। আমি জানি, এ জিনিস খোদা সবাইকে সমান দেননি। আর যাকে বেশিটুকুন দিয়েছেন, হায়, তার দুঃখের সীমা থাকে না! মুহব্বতের কাজল চোখে থাকলে তখন কুঁড়েঘরের ছুঁড়িও দুনিয়ার বাদশার জন্যে ছটফট করে মরে। আবার বাদশাও ছটফট করেন ঘুঁটেকুড়ুনির জন্যে। মুহব্বৎ বড় আজব চিজ এ দুনিয়ায়। এ জাত মানে না। এর চোখে সবাই সমান। এর কাছে কোনো জাতবেজাত নেই। এই বড় ঝামেলা। তুই নাদান মেয়েমানুষ বাছা, মুহব্বতের কাছে তোর ও ইস্কুলপড়া বিদ্যের তো কোনো দাম নেই—ওর কাছে দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের শিখতে ঠেকতে সমঝাতে জীবন গেল—তুই তো একরত্তি মেয়েমানুষ। তাই তোরই বা দোষ কী? না রুবি, তোর কোনো দোষ নেই। যত দোষ আমার—এই শালা বুড়ো গাধাটার!…

আফজল খাঁ দুঃখিত মুখে মাথার ওপর গাছটার দিকে তাকালেন। একটা মোটা ডাল লক্ষ্য করছিলেন তিনি। …যাব নাকি ঝুলে? বেশ হয় কিন্তু। শালাদের ভিরমি লেগে যায় তাহলে। ওরা টের পেয়ে যায়—একজন সাচ্চা খাঁটি মানুষকে খামোকা উত্যক্ত করার ঠেলাটা কী।

এবং তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব হলে যেন খুশিই হতেন আফজল। তাঁর ধারণা, এর ফলে আফজল নামক একটি মানুষ আসলে কী ছিলেন, সেটা স্পষ্ট করা যেত।

অথচ যেন নানা কারণেই সেটা সম্ভব নয়।

কারণগুলো কী, তিনি ব্যাকুল হয়ে খুঁজছিলেন। স্পষ্ট ধরা পড়ছিল না। শুধু একটা জিনিস বারবার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল। হেমনাথকে চৌধুরীবাড়ি পাঠিয়ে তক্ষুনি ভোরবেলা কসাইখানা গিয়েছিলেন এবং টাটকা কিছু গোস্ত কিনে এনেছিলেন। সাহানা ভারি চমৎকার রান্না করে। সুস্বাদু গোস্তের বাটিটা তিনি অবিকল দেখতে পাচ্ছিলেন। এমনকি তার মিঠে গন্ধটাও যেন শুঁকতে পারছিলেন। এবং এইতে তাঁর মন চনমন করে উঠল। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

দুত্তেরি! চুলোয় যাক সব! আমার কী! …বলে আফজল উঠে পড়লেন। হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। কবরখানা পেরিয়ে যাওয়া মাত্র আচমকা তাঁর গা কাঁপল। কী সর্বনেশে কথাই না মাথায় আসছিল একটু আগে! যেন জোর বাঁচা বেঁচে গেছেন—এভাবে খুব জোর হাঁটতে থাকলেন আফজল।

মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন তিনি। নিজেও ক্ষমা করে দিচ্ছিলেন সবাইকে। না—কারও কোনো দোষ নেই। রুবির নেই, ঝুনুর নেই, হেমের নেই কিংবা সেই বেনামি চিঠি লেখকেরও নেই। সবাই নিজের সংগত কাজটিই করেছে। দোষ তুমি কাকে দেবে? কেনই বা দেবে?

মনটা খুশিতে ভরে উঠল এইসব কথা ভাবতে। এবং হঠাৎ খেয়াল হল, তাঁর পাদুটো খালি—জুতো ফেলে এসেছেন গোরস্থানে!

মুহূর্তে ধুত্তেরি বলে আফজল ফের হাঁটতে শুরু করলেন। বাড়ির কাছে এসে ফের একবার গা কাঁপল তার। ফের যেন এক সর্বনাশ বাস্তবের সামনে পৌঁছে গেছেন। রোদের তাপ লাগল প্রচণ্ড। এতক্ষণে লক্ষ্য করলেন, ঘামের শরীর স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। পাঞ্জাবিটা পিঠে সেঁটে গেছে। সূর্যটা হঠাৎ যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ভীত চোখে আকাশ দেখলেন আফজল। আকাশ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে মনে হল। পায়ের নীচে মাটিতে তাপ বেড়ে গেল। অস্থির আফজল একলাফে পুরনো জীর্ণ সদর দরজার মাথায় দেউড়ি সদৃশ ইটের স্তূপ থেকে যে ছায়া জমেছিল—তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন।

(রাঢ়বাংলার এইসব অঞ্চলে মিয়াবাড়ির বৈশিষ্ট্য বলতে এই প্রকাণ্ড দেউড়িটাই বোঝায়। ঘরের দেওয়াল হয়তো মাটির, উলুখড়ের ছাউনি—উঠোনের উঁচু জেলখানার পাঁচিলের মতো মাটির পাঁচিল—তারও ছাউনি খড়ের—কিন্তু সদর দরজাটা বিশাল এবং উঁচু এবং তা ইটের। দরজার মাথার ওপর অনেকটা উঁচু অব্দি সুদৃশ্য নকশির খিলান ইত্যাদি। ঘন নীল রঙের কিছু পোঁচ সেখানে লক্ষ্য করা যায়। কিছু আরবি—ফরাসি শ্লোক আনাড়ি রাজমিস্ত্রির হাতে খোদাই করা। নয়তো বাংলায় ঈশ্বর এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষের এক লাইন প্রশংসাবাণী থাকে উৎকীর্ণ। আর থাকে নির্মাণকাল, রাজমিস্ত্রির নাম ইত্যাদি। সম্ভবত ইটের দালানবাড়ির মর্যাদার কথা ভেবেই নিম্নবিত্ত খানদানি মুসলমান অন্তত সদর দরজাটিকে এমনি সুদৃশ্য করে নিজের মর্যাদার কথা জানিয়ে দিতে চাইতেন। অবশ্য কালক্রমে তার পলেস্তারা যেত টুটে। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকত মাথা উঁচু করে সুপ্রাচীন বংশমহিমার মতো।)

সদর দরজাটা বন্ধ ছিল। গভীর স্তব্ধতা ছিল চারপাশে। দরজার কপাটে কান পেতে কোনো আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলেন আফজল। না পেয়ে বুক কাঁপল। ফাটলে চোখ রাখলেন। বাড়ির ভিতরে শূন্য সাদা ধবধবে উঠোনটা চোখের ওপর জ্বলে উঠল। কোনো মুরগিবাচ্চাকেও হাঁটতে দেখলেন না।

তৃষ্ণায় বুক অব্দি শুকনো। আফজলের ইচ্ছে করছিল, এ মুহূর্তে অভ্যাসমতো রুবির হাতের এক গেলাস জল পেলে অসীম পরাক্রমে তিনি একটা বিরাট অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।

কিন্তু কিছুতেই করা গেল না। নিজের বাড়ির দরজা থেকে নির্বোধ চোরের মতো সরে এলেন আফজল। ফের অভিমান তাঁকে পেয়ে বসল। আস্তে আস্তে কষ্টের পা ফেলে তিনি রাস্তায় নামলেন। অন্য কোথাও যেতে হবে। যাবেন নাকি স্টেশনবাজারে মকবুল মিয়া দরজির ওখানে? পুরো দিনটা দিব্যি কেটে যাবে। চা—নাস্তাও জুটতে দেরি হবে না? দুনিয়াটাকে গাল দিতে দিতে আফজল খাঁ স্টেশনবাজারের দিকেই চললেন।