নিষিদ্ধ প্রান্তর – ৪

চার

তাহলে—

অন্ধকারে হাতের সাপের ওপর অপর আলো পড়ার উপমা দিয়েছিলাম আমি—এ কাহিনীর লেখক। মমতাময়ী পাঠিকা, আপনি কি টের পেলেন কিছু? ওই আলোটা লক্ষ্য করুন। যদি বলি—কল্পনা করুন, এক সুবৃহৎ প্রাচীন দুর্গের মধ্যে পৃথিবীর সব ঘটনাই ঘটছে, এবং মাঝে মাঝে তার দেওয়ালের বুরুজঘর থেকে কালান্তর হাবসী প্রহরী মশালটা উঁচু করে আলো ফেলছে—আপনি কি আমায় খুবই গোঁড়া রোমান্টিক ভাববেন?

এবং আলো পড়লেই, আ ছি ছি ছি! এ আমি কী করছি? এবং ঘৃণা, ত্রাস, বিস্ময়, শোক, যন্ত্রণা, বিপদ।

তা না হলে অবচেতনাময় সেই অন্ধকারে সবই আনন্দ আর শান্তির মতো মনে হয়। কিংবা হয়তো বা কিছুই মনে হয় না।

আঠারো বছরের মুসলিম মেয়েটি জীবনে এই প্রথম জানতে পারল—ভালোবাসা মানে আসলে যন্ত্রণা।

রুবি এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের দিকে চোখ রাখল।

‘ইহা কি সত্য যে এ ঘটনার মাত্র ক’দিন পরে বাড়িতে যখন আর কেউ ছিল না, আপনার মেয়ে একা—তখন এই দুশ্চরিত্র ছেলেটি গিয়ে পড়ে এবং তারপর দরজা বন্ধ করে একইভাবে অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়? তারা এমন মত্ত অবস্থায় ছিল যে প্রথমে আপনার স্ত্রী, পরে আরও একজন বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করবার পর দরজা খোলা হয়। আপনার মেয়ের চেহারা তখন ভীষণ ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। অবশ্য ইতিমধ্যে পাঁচিল ডিঙিয়ে লম্পট প্রবর কখন গা ঢাকা দিয়েছে।’…

…খুব যে হাসি পাচ্ছে আমার! আমি কি এখন একটু হাসতে পারি? কিন্তু খবরদার এখন যে আমার হাসতে নেই। কারণ ভালোবাসা আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলেছে আমায়। চোয়াল দুটো আঁটো করে ধরে রয়েছে। অনবরত সে বলছে, তুই কাঁদ রুবি, ভীষণ জোরে কাঁদতে থাক।

হ্যাঁ, সেই দুপুরবেলাটা আমার বয়সের কাছে আরেকটা সাংঘাতিক চমক বটে। কী মাস ছিল যেন সেটা! চৈত্র। হ্যাঁ বাইশে চৈত্র। দেখেছ? তারিখটা দিব্যি মনে পড়ল। বার? রোববার। বড় রাস্তার ধারে কোথাও আব্বার কিছু বাঁজা জমি ছিল। কোনো মাড়োয়ারি সেটা কিনতে চেয়েছে বলে আব্বা তাকে জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। মা গজগজ করছিল।…অমনি করে সব বেচে—বেচেই খেয়ে ফ্যালো! এর পর নবান্নের ধান কটাও আর ঘরে আসবে না তো! তোমার যা খুশি করো—আমি কী বলব? অ্যাদ্দিন না হয় ছেলেটাকে মানুষ করার অজুহাতে ‘বাপোতি’ সম্পত্তিটুকুন যা ছিল চোখ বুজে বেচে এলে। এবারতো নুরু চাকরি করছে। মাসে মাসে লোক এসে বর্ডার পেরিয়ে টাকা দিয়ে যাবে। তাতেও কুলোচ্ছে না তোমার? রোজ ঘি কালিয়া না খেলে মিয়ার মুখে ভাত ওঠে না। ওদিকে ধিঙ্গি মেয়ে বনের বাঘের মতো ঘাপটি পেতে রয়েছে। সে যে কবে ঘাড় ভাঙবে খেয়াল আছে? তখন কী বেচবে শুনি? কোন না হাজার তিনের কমে পার পাবে, অ্যাঁ?…আব্বা এমনিতে ভারি চমৎকার মানুষ। কিন্তু বড় সহজেই রেগে যান। আর আর রাগলেই তখন বাঁধা বুলি—বলো, বলো তাহলে কী করতে হবে আমাকে? নাকখপদা দেব? পাঁচ হাত পাছা ঘষড়াবো মেঝেয়? নাকি নিজেকে জবাই করে খুন এনে দেব?…ব্যাস! মা হাতের কাজ ফেলে ধুম করে গেল বেরিয়ে। যাবে আর কোথায়? মোল্লার দৌড় মসজিদ। হয় কায়েতবাড়ির উঠোন, নয় তো চৌধুরীর বিবির কাছে। আমি গা করছিলুম না এসবে। সারাজীবন তো এমনি দেখে আসছি! রাত্তিরটা হোক না। তখন ঠিকই মিয়াসাব বিবিজীর পায়ে ধরতে বাকি রাখবেন। শুনতে নেই—গুরুজন, তবু রাতদুপুরে কানে আসে—মা মেঝে থেকে খাটে যাবে না, আব্বা বেড়ালের মতো ম্যাঁও ম্যাঁও করে বলবেন, দ্যাখো দিকি কাণ্ড —আমি কি কখনও একলা বিছানায় শুয়েছি? বলো সাহানা। আমার একলা শুয়ে ঘুম হয়? বোবায় ধরে না?…

মা বেরিয়ে গেলে আব্বা কিছুক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করলেন। তারপর একেবারে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মিনিট। বাইরে মাড়োয়ারির লোকে ডাকাডাকি করছিল—দেরি হচ্ছে মিয়াসাব। মোহনলালজী এতক্ষণ গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন ওদিকে।

আব্বা হঠাৎ দুম করে বেরিয়ে গেলেন। হাসির মা মুখ টিপে হাসছিল। এবার বুড়ি ডেকে বলল, নাও ঠ্যালা! আমি ভাবছি, সকাল সকাল খানাপাকান সেরে একবার ঘর ঘুরে আসব, জামাই এয়েছে। ইদিকে কী জ্বালায় পড়লুম, দ্যাখো! অ রুবি, গোশত ধুয়ো রেখেছি, মশলাও বেঁটেছি, রাঁধতে পারবে না মা? আমি একবার হট করে ঘুরে আসি ঘর থেকে। আমার রান্না তো বিবিজীর পছন্দ হবে না!

রান্না আমি জানিনে মোটে। মা এর জন্যে মাথা ভাঙতে বাকি রেখেছে, আমি পাত্তাই দিইনি। মা যতই করুক, আমার ওপর শেষ অব্দি বেশি জোর খাটাতে চায় না বা পারে না সেটা বুঝতে পারি। তার ওপর আমার দিকে আব্বারও যেন সমর্থন ছিল পুরো। …বারে! মেয়েকে এদিকে লেখাপড়া শেখাচ্ছ—আবার হাতে হলুদ মাখতে বলবে নাকি। দুই একসাথে হয় না। হয় এটা করুক, নয় ওটা। …এরপর মা যা যা বলতে পারে, জানা কথা সবার। যাই হোক, মা ক্ষান্ত দিত শেষটা। তবে শুধু এ ব্যাপারে নয়—সবকিছুতেই লক্ষ্য করছি—মা আমায় মেনে নিয়েছে বা এখনও নিচ্ছে। সেকি আমি পিতৃহারা বলে? এমন চমৎকার একজন আব্বা থাকা সত্ত্বেও মায়ের বুঝি মন ভরে না! হয়তো মায়ের মতো কোনো মেয়েরই ভরে না। দ্বিতীয় স্বামী বুঝি বা মায়ের নিছক আটপৌরে প্রয়োজনের জিনিস, প্রথম স্বামী হয়তো তারও বেশি কিছু—স্বপ্ন—সাধ—আহ্লাদে রঙিন। কারণ এই প্রথম পুরুষটির প্রত্যাশা নিয়েই তো সব মেয়ের এগিয়ে আসা যৌবনের দিকে! কেউ যদি বলে, এত আমি কোথায় শিখলুম—তো বলব, সেই প্রকৃতির পাঠশালায়। মেয়েরা বয়সের আগে আগে দৌড়তে পারে। আর আমি—মুখটেপা চাপা মেয়ে, ভিতরে ভিতরে পেকে লাল হয়ে আছি। এবং এ কি না আমার পরম বান্ধবী সুখদুখের চিরসাথী ঝুনুর বয়ান!

তা হাসির মার কথা শুনে আমি বললুম তোমার বিবিমিয়ার ও বেহেশতি খানা আমি পাকাতে পারব না। শাকচচ্চড়ি মুড়িঘণ্ট দাও, আটকাবে না।

হাসির মা দাঁত ছরকুটে হাসল।…শোনো মেয়ের কথা। হেঁদুর বাড়ির হাঁড়ি খেয়ে আস্ত হেঁদু হয়ে গেছে রে বাবা!……সে হঠাৎ গলা তুলে বলল, বলব কায়েতগিন্নিকে—রুবির একটা হেঁদু বরই জুটিয়ে দিক। জাতভাইয়ে ওর মন ভরবে না গো!

ধমক দিয়ে ওর তামাশা থামিয়ে বললুম, খুব হয়েছে। যাও দিকি মাকে ডেকে নিয়ে এসো। তারপর যে দোজখে যেতে চাও যেয়ো। আমি একা শ্যাল—শকুন পাহারা দিতে পারব না বেশিক্ষণ।

আমার আক্রমণের লক্ষ্য আব্বার অতিপ্রিয় দৈনন্দিন খাদ্য গোরুর গোশত—বুড়ি সেটা টের পেয়ে জিভ কেটে বলল, ও মা! ছি ছি ছি। হালাল জিনিসকে হারাম করে ফেলবে গো মেয়েটা। কী জাতনাশা মেয়েরে বাবা! রোস, বলছি গে তোমার মাকে।

বুড়ি রেগে কাঁই। নড়বড় করে রোগা মুরগির মতো খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাগটা নিশ্চয়ই তার ধর্মজ্ঞানের খাতিরে নয়—সে আমার জানা। কারণ, ওকে কায়েতবাড়ি কতসময় পুজোপার্বণ কী উৎসবে একগুচ্ছের লুচি বুঁদে তরকারি বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। এদিক ওদিক চাইতে চাইতে বকের ঠ্যাং ফেলে হাঁটে তখন—বুকের কাছে কাপড়ের আড়ালে জিনিসগুলো লুকনো। একদিন হয়েছে কী, আমাদের কাজ সেরে বেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ ফের সে এল।…ওই যা, লাউশাকগুলো নিতে ভুলে গেছি। মা শাকের গোছাটা ওকে দিতে গিয়ে বলল, হাসির মা, তোমার পেট থেকে ও কী পড়ছে ফোঁটাফোঁটা? কিছু না, ইয়ে…বলে বুড়ি পালাতে পারলে বাঁচে। মা হাসছিল। ফোঁটাগুলো বোঁদের রস। মা বলল, নিয়েছে তাতে লজ্জা কীসের এত? গরিব মানুষ—পেটের দায়ে সবই খেতে হয়। ওতে দোষ কী বাবু? নবীসায়েব বলেছেন, জান বাঁচানো ফরজ (অবশ্য কর্তব্য)। আমি ঠাট্টা করে বললুম, আমি কিন্তু পেটের দায়ে কায়েতবাড়ির খাইনে—ইচ্ছে করেই খাই। তুমিও তো খেতে বলো! বলো না মা?…শুনে মা গেল রেগে। তোর আবার জাতটাত আছে নাকি? তুই তো আকাট হিদুঁ!

…কোথায় এসে পড়লুম! সেই চৈত্রের দুপুরে পৌঁছতে আমার কি সারাবেলাটাই কেটে যাবে? যাবে, যাবে। এ যে উজোন স্রোতে সাঁতার কাটা! আর আমার মেয়ের মন বলে, একগ্রাসে ঝটপট সব খেতে নেই। একটু একটু করে খাও। আগে খোসার ওপরটা, তারপর ক্রমে ক্রমে ভিতরের শাঁস তারপর সেই রসাল কেন্দ্রটুকু। বেশি তাড়াহুড়ো করতে নেই। একটা শিকারের বইতে পড়ছিলুম, বাঘিনি শিকারের জন্য একটা ছাগলকে টোপ করা হয়েছে। বাঘিনি করল কী, এসেই টোপ কেন্দ্র করে ঘুরতে লাগল। প্রথমে অনেকটা পরিধি নিল—তারপর ক্রমশ পরিধি ছোট হয়ে আসতে লাগল। তারপর আরও ছোট বৃত্ত, আরও, আরও—ব্যাস, এবার টোপ তার দাঁতের কাছেই।…

হাসির মা চলে গেল তো গেলই। ফেরবার নাম নেই। খিড়কির দরজায় উঁকি দিয়ে এলুম। দেখতে পেলুম না কাকেও। তাহলে নির্ঘাৎ চৌধুরীবাড়ি বিবিসায়েবা নরক গুলজার করছিল, বুড়ি গিয়ে তাতে জমিয়ে ফেলেছে। ওদের স্বভাব তো আমার জানা। বড়লোকের বাড়ি পাত্তা পেলে এই সব গরিব ঘরের মেয়েরা তো বেহুঁশ হয়ে নিজের ঘরের নাম ভুলে যায়। কতবার ওবাড়ি থেকে চৌধুরীর বউ আমায় ডেকে পাঠিয়েছে বা মা সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, আমি যাইনি। কেন যাব? ইলেকট্রিক ফ্যানের গল্প শুনতে? নতুন আলমারি দেখতে? বৈঠকখানা—ওদের ছেলেমেয়েরা বলে ড্রইংরুমের সোফাসেট দেখতে? শুধু একটা লোভ থেকে যায়, সেটা রেডিয়োর। থাক। মন চাইলে শেফালীদের বাড়িই যাব বরং। শেফালীর বাবা হোমিয়োপ্যাথির ডাক্তার। কোনোরকমে সংসার চলে যায়। রেডিয়োটা শেফালীর দাদা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছে। রুমাবউদি এত চমৎকার মেয়ে—কোনো জাতবিচার নেই, কায়েতবাড়ির মতো। ওরা পূর্ববঙ্গের লোক। আশ্চর্য লাগে, ওরা নাকি মুসলমানদের ভয়েই এদেশে পালিয়ে এসেছিল। অথচ আমি যে মুসলমান দিব্যি ওদের রান্নাঘরে ঢুকেছি, শোবার ঘরে খাটে গিয়ে গড়াচ্ছি—ওরা তো একটুও ঘেন্না করে না! নাকি আমাদের দেশের হিন্দুদের চেয়ে ওদেশের হিন্দুরা অনেক উদার অনেক বেশি সভ্য? কে জানে কী ব্যাপার—আমি এতবড় দেশটার কতটুকুই বা জানি!

…চলে এলুম খিড়কি থেকে। সর্বনাশ, ওদিকে সদর দরজা যে হাঁ হাঁ করছে, খোলা! তাড়াতাড়ি গিয়ে বন্ধ করে দিলুম। কিছু ভাল্লাগছিল না। ঝুনুটা গেছে মামাবাড়ি বেড়াতে। শেফালী গেছে বউদির সঙ্গে সকালের সিনেমায়। আমার কোথাও যাওয়া হল না!

হঠাৎ দেখি খিড়কির দরজা দিয়ে আকবর ভাই ঢুকছে। চমকে উঠতুম না। কিন্তু খিড়কির দরজাটা সে বন্ধ করে দিচ্ছিল। তাতেই আমার পাদুটো কেন কে জানে ভারী হয়ে উঠল। আকবর চৌধুরীবাড়ির বড় ছেলে। সবসময় সে এ বাড়ি আসে। আমার সঙ্গে কথা বলে, আমিও বলি। যদিও মাঝে মাঝে ওকে মনে হয় বড্ড হ্যাংলা—বিরক্তি লাগে। কিন্তু ও বড়লোকের ছেলে—গরিব—মানুষদের তো সব কিছু সাজে না! ইচ্ছে থাকলেও সইতে হয়। আঘাত দিতে গেলে ভয় করে—এই যাঃ, দুনিয়ার চালু ভদ্র নিয়মটা ভেঙে যাবে যে! তবে আঘাত দেবার মতো তেমন কিছু ঘটেনি তখনও। তাছাড়া কিছু কৃতজ্ঞতার বালাই আমার ছিল। গত শীতে এক মেঘলা দিনে আমি আর ঝুনু বাজারের দিকে গিয়েছিলুম—দুপুরের পর সময়টা—হঠাৎ ওর সঙ্গে দেখা! ঝুনুটা বড্ড বেহায়া। দুম করে বলে বসল, সিনেমা দেখাবে আকবরদা? আমি মুখে আপত্তি করলেও মনে তীব্র লোভ জেগে উঠেছিল। সিনেমা তো আমার দেখাই হয় না! কদাচিৎ আব্বা মাকে খুশি করার জন্যে নিয়ে গেলে, তখন! মা বুঝতে পারে না, আমিই তার দোভাষী। কাজেই মা গেলে আমার যাওয়া অবধারিত। যাই হোক, কত চমৎকার বই সব আসে যায়, দেখা হয় না। এবং খুব গোপন কথা, সুনুদার ওপর রাগ হয় মাঝেমাঝে। কোনোদিন তো বড় মুখ করে বলল না, চলো রুবি, সিনেমা দেখে আসি! একা যাওয়া হত না—ঝুনুকে সঙ্গে নিতে হত অবশ্যই। এদিকে মা নিজের সাথে ছাড়া কারও সাথে মেয়েকে সিনেমা দেখতে দিতে রাজি নয়—তাহলেও সেটা ম্যানেজ করা কিছু কঠিন ছিল না। যাই হোক, শেষে মনে হত—কী মিছিমিছি রাগ করছি! সিনেমা দেখানোর মতো পয়সা পাবে কোথায় বেচারা! আর সেই সব সময়, আশ্চর্য—ওর জন্যে একটা গভীর সহানুভূতি আমায় বেদনায় সিদ্ধ করে ফেলত!

আকবর ভাই সেদিন সিনেমা দেখিয়েছিল। আমার বাঁদিকে সে, ডানদিকে ঝুনু। ঝুনুটা চালাকি করে আমার ডানদিকের সিটটা বাগাল, তা বুঝতে পেরেছিলুম। ঝুনুর ওপর যা রাগ হচ্ছিল বলার নয়। আকবরকে আমি নুরু ভাইয়ের মতোই দেখি—অথচ তার আমার দিকে ঝুঁকে বসার ভঙ্গি, যখন তখন আবছা অন্ধকারে সেই হলের ভিতর মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে কী বলার চেষ্টা, অবশেষে হঠাৎ আমার পিঠের কাছে চেয়ারে বেড় দিয়ে থাকা তার ডানহাতটা আবিষ্কার, সবমিলিয়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি করছিল তাতে মনে মনে ঘেন্নাটা ঝুনুর ওপরই হচ্ছিল। রোস, এরপর কখনও কোনোদিন তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। এমন মতলববাজ মেয়ে তুমি! আমার বিশ্বাস হতে থাকল যে আকবরের সিনেমা দেখানোর মতো উদারতার পিছনে আমিই যে একমাত্র কারণ, তা ঝুনু বেশ জানে। কী ছাই দেখলুম কে জানে, সারাক্ষণ নিজের দেহের দিকে মনের সবটুকু পড়ে থাকলে, বাইরে কী কতটুকু দেখব? হ্যাঁ, আমি সেদিন ঠিক এই বাইশে চৈত্রের দুপুরবেলার মতো সারাক্ষণ দেহসচেতন হয়ে উঠেছিলুম। সম্ভবত আকবর ভাই—ই আমার মেয়েদেহটা সম্পর্কে সেই প্রথম সজাগ করেছিল। তারপর থেকে যতবার তাকে সামনে দেখেছি, অমনি মনে পড়ে গেছে, আমার একটা দেহ আছে এবং তা মেয়ের দেহ…

বাইশে চৈত্রের দুপুরে নির্জন বাড়িতে আকবরের হঠাৎ এসে পড়া এবং দরজা বন্ধ করে দেওয়া, আমার মেয়ে দেহটাকে হকচকিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্টই। কিন্তু ওই যে বলেছি, সে বড়লোকের ছেলে এবং আমি গরিব বাড়ির মেয়ে—দুনিয়া সংসারের নিয়মভঙ্গের দুঃসাহসে ছিছিক্কারের ভয়, এবং একটা অবাঞ্ছিত কৃতজ্ঞতা বোধ, সব মিলিয়ে আমি কুকুর বনে গেলুম। লেজ নাড়তে হল।

আমার দেহসচেতন মেয়ে মন বলল, উঠোনেই দাঁড়িয়ে থাকো। নড়ো না। আমি উঠোনেই দাঁড়িয়ে রইলুম। আকবর বলল, কী করছ রুবি? তোমার আব্বা কোথায়? তোমার মা তো দেখলুম আমাদের বাড়ি রয়েছেন। তোমাদের বুড়িটাও গিয়ে জুটেছে!

বললুম, হ্যাঁ।

আকবরকে কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল! যেন হাসবার চেষ্টা করে বলল, শুধু হ্যাঁ। আর কিছু কথা নেই? কী অল্পভাষী মেয়ে রে বাবা!

মুখ নিচু করে বললুম, কী বলব?

আকবর সিগ্রেট জ্বালাল। তারপর বলল, কলেজে অ্যাডমিশন নেবে না? আব্বা কী বলেন?

জবাব দিতে হল এ কথার।….রেজাল্ট বেরোক তারপর তো!

তাহলেও এখন থেকে তৈরি হওয়া দরকার। আকবর বলল।…তোমার নুরু ভাইকে লেখো। দ্যাখো না, সে কী জবাব দ্যায়। তারপর…

একটু হাসি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার ঠোঁটে উপচে এল।…তারপর কী?

তোমার পড়ার অসুবিধে হবে না—এটুকু আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি।

তুমি পড়াবে?

এই দ্যাখো! ফোঁস করে উঠলে ওমনি? সত্যি, বড় বিচ্ছু মেয়ে তুমি। যাক গে, চলো—দুপুরবেলাটা গল্পে গল্পে কাটিয়ে দিই। নাকি, সিনেমা যাবে আজ? খুব ভালো ফিলিম এসেছে কিন্তু। ঝুনুটুনু থাক, বরং…আকবর চোখ বুজে যেন উপায় ঠিক করে নিল।…বরং এক কাজ করা যাবে। তুমি…তুমি কারও বাড়ি যাচ্ছ বলে সোজা হলের সামনে গিয়ে থাকবে—আমাকে ওখানেই পেয়ে যাবে। রাজি?

সত্যি, লোভ হচ্ছিল একটু একটু। মিথ্যে বলব না। কিন্তু সে তো হয় না। আমি রান্নাঘরের দিকে অকারণ অদৃশ্য কাক তাড়ানো ভঙ্গিতে হাত নেড়ে চেঁচালুম, হুস! যাঃ যাঃ! তারপর খিড়কির দিকে পা বাড়ালুম।…বুড়িটা আসছে না কেন?

আকবর আচমকা আমার একটা হাত ধরে ফেলল।…আরে! কোথায় যাচ্ছ?

সঙ্গে সঙ্গে আমার দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল। একটা বোবা চিৎকার নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণার মতো কোষে কোষে ছটফট করতে লাগল। ঠোঁটে দাঁত এসে বসে গেল। আস্তে আস্তে বললুম, আঃ ছাড়ুন। লাগছে।

ছাড়তে কি ইচ্ছে করে? আকবরের দাঁতগুলো হয়তো বেরিয়ে এসেছিল এ কথা বলবার সময়, মুখ তুলে দেখিনি—তবে বলতে পারি। সে আরও জোরে টান দিয়ে ফের বলল, দুষ্টু মেয়ে? চলো, তোমায় একটা মজার ব্যাপার শেখাব। আহা চলোই না ও ঘরে!

আঠারো বছরের মেয়েকে ও কী মজার ব্যাপার শেখাবে? কিন্তু হঠাৎ আমি সাহানা বেগমের সেই বোকাহাবা মেয়েটি বনে গেলুম। ভুল নয়, ইচ্ছেকৃত নয়—আমি হলফ করে বলতে পারি। শুধু বলতে পারিনে, কেন তবু ওর টানকে বশ মেনে উঁচু বারান্দা পেরিয়ে সুড়সুড় করে ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। এক সর্বনাশের স্রোত আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যেন। নাকি ওর অবাধ্য হওয়ার মতো সাহস আমার ছিল না! নাকি নিজেকে একেবারে অসহায় ভেবে আত্মসমর্পণ করে বসেছিলুম।

খাটের ওপর আমায় ফেলে দিল আকবর। জানালাটা খোলা ছিল। হঠাৎ দেখি বেড়ার ধারে সুনুদা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের গাইগোরুটার মুখে একগোছা ঘাস তুলে দিচ্ছে। খালি গা, পরনে একটা ময়লা পাজামা, ধবধবে সাদা কিন্তু ফ্যাকাসে বুক, কিছু নীলচে লোম ছড়ানো, দুটো হালকা কিন্তু নিটোল বাহু—আর শক্ত ঘাড়, কোঁকড়ানো চুল, বড় বড় টানা চোখ—ওই তো আমার উজ্জ্বল উদ্ধার এত কাছে। আমি ডেকে উঠলুম, সুনুদা, সুনুদা।

অমনি আকবর সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল। সুনুদা দৌড়ে জানালার কাছে চলে এল।….কী বলছ রুবি?

আমার চেহারায় কণ্ঠস্বরে কিছু হয়তো ছিল—সুনুদার মুখেচোখে বিস্ময় ঝিলিক দিচ্ছিল। বললুম, শিগগির একবার আসবে?

ওখান থেকে আসতে হলে ওদের বাড়িটা পুরো ঘুরে খিড়কি হয়ে আসতে হয়। তাই একটু সময় লাগল। আমি বেরোলুম না। খিড়কির দরজায় ওর সাড়া পাবার সঙ্গে সঙ্গে আর নিজেকে সামলানো গেল না। উবুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করলুম।

কতক্ষণ পরে আমার পিঠে ওর হাতের চাপ এল।….রুবি, এই রুবি! কী, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

আমি কিছু না বলে হঠাৎ ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। তারপর মাথা ঘষতে থাকলুম। সুনুদা আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।….কাঁদিসনে, কাঁদিসনে রুবি। আমি জানি, কী হয়েছে। আকবরটাকে আমি চলে যেতে দেখলুম। কিন্তু বুঝতেই তো পারছিস, এ নিয়ে ঘাঁটাতে গেলে পরিণামে ওর কিছু হবে না—যা ক্ষতি হবে, তা তোরই। কারণ, তুই মেয়ে। ও পুরুষ। তাছাড়া তোর বাপের পয়সা নেই, ওর অনেক আছে। চোখ মোছ!

নিজেই আমার শাড়ির আঁচলে চোখ মোছাতে থাকল সুনুদা। তারপর দু’হাতে আমার মুখটা ধরে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর…সেই পিকনিকের দিনের মতো, চুমু খেয়ে বসল। না—সেদিনের মতো তাড়াহুড়ো নয়—ধীরে। আর আমিও তো বাধা দিচ্ছিলাম না। মন বলছিল, পাওনা মিটিয়ে নে হতভাগিনী! দুঃখের মধ্যে দিয়ে এমনি করেই তো সুখ আসে। অন্ধকার রাত পেরিয়ে আসে দিনের সূর্য।

আর—তারপর আমার চিবুকে মৃদু ঠোনা মেরে সুনুদা বলল, ওই গোরু খাওয়া মুখটা এবার রগড়ে ধুয়ে ফেলো গো। ছিরি যা করে ফেলেছ! কিন্তু খবরদার, মা—বাবার কানে তুলোনা এসব। সাবধানে থেকো, তাহলেই হল।

নির্মল হেসে পালটা বললুম, আহা তোমার মুখটা বুঝি গোরুখাওয়া নয়। যাও—তুমিও গঙ্গাজলে ধুয়ে নাও।

সুনুদা হাসতে হাসতে বেরোল।….