নিষিদ্ধ প্রান্তর – ৩

তিন

অন্ধকারের সাপের উপমাই মাথায় এসে গেল—

ধরুন, অন্ধকারে একটা কিছু নিয়ে দিব্যি নাড়াচাড়া করছি খেলাচ্ছলে, সেই সেখানটাই আলো পড়ল দৈবাৎ, দেখি কি না—আ? কেউটের বাচ্চার মাথাটা চেপে ধরে দোলাচ্ছিলুম এতক্ষণ!

গা শিউরে ওঠে। গলা শুকিয়ে যায়! বুকে পড়ে হাতুড়ির ঘা। হঠাৎ নিজের প্রতি ভারি লোভও কি জেগে ওঠে না? জীবনের দামটা বেড়ে যায় না সঙ্গে সঙ্গে?

ঠিক সেই রকম!—

সেদিন রুবিকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আফজল খাঁ খাটের ওপর ধুপ করে বসে পড়েছিলেন। ক্লান্ত আর হতশ্রী দেখাচ্ছিল লোকটাকে। চোখদুটো লাল। মুখে চাপা উত্তেজনার বিকার। এবং খুবই ভয় পেয়েছিল রুবি। খাটের অন্য কোণে একটা বাজু ধরে নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছিল তার সৎবাপকে। পরস্পর তাকাতাকির মধ্যে কিছু জড়তা কুণ্ঠা হয়তো ছিল। তারপর আফজল পাশ পকেট থেকে একটা খাম বের করে সামনে ছুঁড়ে দিলেন। শুধু বললেন, পড়ে দ্যাখ।

রুবির মা তখনও রান্নাঘরে। কী ঘটছে তখনও সে টের পায়নি।

আফজল তারপর হঠাৎ উঠে গেলেন। কোথায় গেলেন, রুবি লক্ষ্য করল না। সে খামটার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, পোস্টাফিসের ছাপমারা চিঠি। আফজল সাহেবের ঠিকানা। প্রেরকের কোনো নামঠিকানা নেই। কিন্তু এ চিঠি যে নুরুঁভাইয়ের নয়, তা সে বুঝতে পারছিল। খামটাও পাকিস্তানি নয়। আস্তে আস্তে চিঠিটার দিকে হাত বাড়াল সে। তুলে নিয়ে একটুখানি নাড়াচাড়া করল। তারপর চিঠিটা বের করে ফেলল।

চমৎকার নীল ফুরফুরে কাগজে লেখা চিঠি। পরিষ্কার হস্তাক্ষর। ‘শ্রদ্ধেয় জনাব’ বলে আরম্ভ করেছে। ওপরে কলকাতার ঠিকানা! বুকে ছলাৎ করে উঠল রুবির।

চিঠিটা পড়তে থাকল সে। প্রথমে দ্রুত—ক্রমশ গতি কমাল—তারপর খুবই আস্তে। প্রত্যেকটি বাক্য খুঁটিয়ে, মানে বোঝবার চেষ্টা করে, দু’বার তিনবার পড়ে, একসময় যখন চিঠিটা শেষ করল সে—তার সারা দেহ যেন নিঃসাড় আর ক্লান্ত! টলমল করছিল জীর্ণ পুরনো ঘরের আসবাবপত্র। গায়ের ঘাম বেড়ে যাচ্ছিল। ঘাম জমছিল তার কপালে নাকের ডগায়, চিবুকে। দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু দুটো ঊরু অসম্ভব ভারী আর দেহে কোনো শক্তিই অবশিষ্ট নেই যেন।

চিঠির লেখক কতকগুলো প্রশ্ন করেছে মাত্র। ভঙ্গিটা খবরের কাগজ থেকে নেওয়া। আর কারও ব্যাপার হলে তো এতক্ষণ হাসতে হাসতে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়ত! যেমন, প্রথম প্রশ্নটা :—

—ইহা কি সত্য? (আন্ডারলাইন করা বড় বড় হরফে) গত এপ্রিল মাসের কোনো এক রবিবারে আপনার মেয়ে এবং এই ছেলেটি সারাদুপুর কুঠিবাড়ির জঙ্গলে অবৈধ সংসর্গে লিপ্ত হয়েছিল এবং খুব কাছেই আরও একজন আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল—এমনকি আপনার কানেও তুলেছিল, কিন্তু আপনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন!—

হ্যাঁ। সেই দিনটার কথা পুরো মনে আছে আমার।—রুবি দ্রুত ভাবছিল।…অতি দ্রুত কিছু দৃশ্য তার মনের ভিতর ভেসে আসছিল।

সে একটা আশ্চর্য দিন। সুনুদাটা বড্ড খামখেয়ালি। আগের দিন সন্ধ্যায় এসে হঠাৎ বললে কী, এই রুবি পিকনিক করবে? আমি লক্ষ্য করলুম সুনুদা আমায় ‘তুমি’ বলল। এই প্রথম তার তুমি সম্ভাষণ কী ভালো না লাগল! বললুম আপত্তি নেই। কিন্তু মা আবার ছাড়বে তো? সুনুদা বলল সে আমি দেখছি, তুমি যাবে কিনা বলো। ঘাড় দুলিয়ে রাজি হয়ে গেলুম। শুধু বলল, ঝুনু যাবে, শেফালি যাবে আর ভাবছি কবীরকে বলব! সুনুদা ভ্রূ নাচিয়ে হাসল হঠাৎ। এ হাসি ওর মুখে যা মানায় ভাবা যায় না। ওর চেহারা কতকটা গ্রিকদেবতা অ্যাপোলোর মতো। কোঁচকানো চুল একটু, লম্বা, শক্ত ঘাড়, খাড়া নাক, নীলচে চোখ, পাতলা ঠোঁট—আমি খুব খুঁটিয়ে দেখেছি বরাবর। কে জানে কেন ছেলেবেলা থেকে ওকে এমনি করে দেখাটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম প্রথম একটু লজ্জা হত। তারপর সেটা কেটে গিয়েছিল! ও যখন অন্যের সাথে কথা বলছে তখন যেমন মুহূর্তের জন্যেও ওর দিক থেকে চোখ ফেরাইনি—তেমনি আমার সাথে কথা বলবার সময়ও তাকিয়ে থেকেছি। ঝুনুটা বড্ড ঠোঁট কাটা। চিমটি কেটেছে। আড়ালে বলেছে এই! অমন প্যাটপ্যাট করে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস কেন রে, আমি রেগে গেছি। কিন্তু জবাবও দিয়েছি। সোজা বলেছি ওটা আমার অভ্যেস! ঝুনু বলেছে বদ অভ্যেস। দেখবি শেষে পস্তাতে হবে—কেন ওকথা ঝুনু বলত তখন বুঝতাম না। এখন তো বেশ বুঝি। যাকগে মরুকগে। ঝুনু কম বয়সেই পেকে গিয়েছিল। আমি লক্ষ্য করছি আকবরের দিকে কেমন যেন—ফের আজেবাজে কথা এসে পড়ল। সুনুদার হাসির কথা বলছিলুম। সুনুদা হেসে বলেছিল কবীরকে নিতে হবে। কারণ, ওদের বাড়ি অনেক মুরগি আছে। বিনি পয়সায় পেয়ে যাব। আর শোনো রুবি, তুমি শুধু দেবে পোয়াটাক চাল, একটু একটু তেল, কিছু পেঁয়াজ, আদা লংকা—ব্যস! মনটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল হঠাৎ। সুনুদার চাঁদার লিস্টি চোখের সামনে স্পষ্ট করছিল আমরা বড্ড গরিব। এত সব ধনসম্পদ স্ফূর্তিতে ভরা দুনিয়াটায় আমরা এই কটি বাড়ির ছেলেমেয়েরা ভীষণ নিঃস্ব, ভারি অসহায়। তবে বনভোজনের ব্যাপার তো! অনেকবার এটা হয়ে গেছে—নতুন কিছু নয়, সে বারে নদী পেরিয়ে কাদের খেত থেকে আমি আর ঝুনু টমাটো কাঁচালংকা আর পেঁয়াজ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার দাখিল। উঃ! এখনও বুক ধড়ফড় করে মনে পড়লে। ভাগ্যিস লোকটা ছিল ভারি ভালো। পিছন থেকে ডেকে বলল, শোনো খুকিরা পালিয়ো না। নিয়ে যাও কী নেবে!—লোকটার চেহারা কিন্তু ভয় পাবার মতো। ঢ্যাঙা মস্তো শরীর, ন্যাংটো বললেই চলে। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ। বড়বড় চুল হলদে দাঁত আর খোকাদের মতো লাল মাড়ি বের করে হাসছিল। আমরা ওর নাম রেখেছিলুম ‘বাবা আদম’। খোদা নাকি আদমকে পাপের জন্যে বেহেশত থেকে তাড়িয়ে দিলে সে এই দুনিয়ায় এসে চাষবাস শুরু করল। ভাবা যায়? সারা দুনিয়ায় এই একটিমাত্র মানুষ—আর কেউ নেই! একা অমনি কোনো নদীর ধারে সে খুরপি চালিয়ে মাটি থেকে ফসল ফলাচ্ছে। আমার তো গা শিরশির করছিল ভাবতে। সুনুদাকে বললে সে বলেছিল, তুই ভারি ভাবুক মেয়ে রুবি। নির্ঘাৎ কবি হবি।—

—তা সুনুদার কাছে ফের পিকনিকের কথা শুনে আমার মনে সেই পুরনো দৃশ্যটাই ভেসে উঠল। সেই অবাধ নির্জনতা, সবুজ খেত, হলুদ ফুল আর প্রজাপতিদের সুন্দর জগৎটা আমায় জোরে টান দিতে থাকল টের পেলুম। এই টানের জোরটা যে বেড়ে গেছে হঠাৎ তার পিছনে কী যেন রহস্যময় ব্যাপার আছে। একটা ফুলগাছের চারপাশ ওপর নীচেটা ঝোপঝাড় সাফ করে ফেললে সে যেমন হু হু করে বেড়ে ওঠবে—তেমনি বেড়ে ওঠা যেন আমার মধ্যেও ঘটে যাবে। এ আমার মুক্তির ডাক। আমি কি সাড়া না দিয়ে পারি? জানিনে ঝুনু বা আরও সব হিন্দু মেয়ে ঘরের মধ্যে বসেই এ মুক্তির স্বাদ পেয়ে যাচ্ছে কি না—ওরা তো কত স্বাধীন, কত সহজ স্বচ্ছন্দ? বয়স যত হচ্ছে টের পাচ্ছি আমি একটি মুসলিম মেয়ে, কোথায় কোন জাঁতাকলটিতে আটকা পড়ে আছি! চারপাশে সেই লক্ষ্মণের গণ্ডী ঘেরাটোপ সাবধান—পা বাড়ালেই রাবণরাক্ষস চুলের ঝুঁটি ধরে নিয়ে আকাশে পালিয়ে যাবে!

…যাকগে মরুকগে। এ আমার ভাবপ্রবণতা হয়তো। সুনুদাই বলে, রুবিটা বড্ড ভাবপ্রবণ। ও কষ্ট পাবে।

….এপ্রিলের সেই সকালটা সারাজীবন আমার মনে থাকবে। কী চমৎকার মিঠে রোদ্দুর উঠেছিল দুনিয়ায়। আর আকাশটা ছিল হালকা নীল। চারপাশে এক শুচিতা ঝকমক করছিল। কুসুমগঞ্জকে এত সুন্দর তো কোনোদিন দেখিনি! নাকি সবই ছিল আমার মনের মাধুরী। নুরুভাইয়ের চিঠিটার জন্যে রাগ হচ্ছিল। এইসব সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে সে কোথায় চলে যাবার ষড়যন্ত্রে আমাকে পাঠাচ্ছে? সত্যি যদি কোনোদিন চলে যাওয়া ঠিক হয়, আমি—আমি কী করব? পালিয়ে যেতে পারব কোথাও? সে সাহস কি আমার হবে? আশ্চর্য অনেকটা আগে সুনুদা যাচ্ছিল—প্রকাণ্ড একটা থলে তার কাঁধে। তাকে দেখামাত্র মনে কী যেন জোর এসে গেল। বুক ফুলে উঠল। মনে হল এইমাত্র আমার ভিতর এক চাঁদসুলতানার ঘুম ভাঙছে। আমি শিউরে উঠলুম।…

না—তখনও মনের আড়ালের আরও একটা ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর সত্যকে আমি টের পাইনি। কেউ তো এমন করে বলে দ্যায়নি তখনও যে, রুবি তুমি যা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো তা একটা কেউটে সাপ!….

একসঙ্গে দল বেঁধে যেতে বারণ করেছিলেন আমার মা। মুসলিম খানদান ঘরের মেয়ে, পর্দা নাহয় মানলুম না—কারণ লেখাপড়া শিখেছি বা কালের হাওয়া বদলেছে কিছুটা—কিন্তু তাহলেও ইজ্জত বলে একটা কথা আছে। মজার কথা সুনুদাকে অস্বীকার করাও আবার মায়ের পক্ষে ভারি কঠিন। সুনুদা মাকে কবে জয় করে রেখেছে যে! যাই হোক কবীর আর সুনুদা সবার আগে গেল। অনেকটা তফাতে আমরা তিনটি মেয়ে, আমি ঝুনু আর শেফালী। শেফালী বুদ্ধি করে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট ইত্যাদি নিয়েছে। ফ্রক যদ্দিন পরতুম তদ্দিন খেলেছি। এখন কি পারব? আমি নাকি গা—গতরে মুটিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। হবেও বা! আগের মতো ছোটাছুটি করলে হাঁফিয়ে উঠব—সেটা ঠিকই। কেন এমন হল? শুধু অভ্যাস? অমন চটপটে চঞ্চল স্ফূর্তিবাজ মেয়ে ছিলুম—হয়ে পড়লুম ঢিলেঢালা আলসে শান্ত দেহ। দেহটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছে। হিসেব করে দেখলুম শাড়ি পরার বয়স হল মোটে সাড়ে চার বছর। এই ক’বছরেই আমার ছেলেবেলাটা পুরো ঝরে পড়েছে বোঁটা শুকিয়ে। আর তাই যেন, বড্ড লোভ হল, জেদ চেপে গেল মাথায় আজ ফাঁকা মাঠে মুক্ত হরিণীর মতো দৌড়োদৌড়ি করতেই হবে। খুব গভীর থেকে কুঠিবাড়ির জঙ্গল আর নদীর দুনিয়া আমায় টান দিচ্ছিল, আর টান দিচ্ছিল, চলে আয় রুবি এই তোর আসল জায়গা। আমি তোকে আকাশ দেব—তুই হবি ছোট্ট একটা পাখি। তোকে দেব ফুলবাগিচা—তুই হবি তার প্রজাপতিটি।—

খুব ব্যস্তভাবে জায়গা খোঁজা হচ্ছিল। সুনুদা বড্ড অতৃপ্ত ছেলে। পিঠে প্রকাণ্ড থলে রেখে একটু কুঁজো হয়ে সে এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে। আমার চমক খেলে যাচ্ছিল। কবে কোনোদিন কি এমন কিছু ঘটেছিল? সে যেন অতীতের একটা আশ্চর্য কাহিনী। দুর্ধর্ষ হুননেতা অ্যাটিলা, নাকি গ্রিক আলোকজান্ডার, নাকি কোনো অভিযাত্রী বিদেশি সেনাপতি এমনি কোনো নদীর ধারে তাঁবু ফেলবার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছিল? তার মুখ, তার চেহারা যেন ছিল ওই সুনুদার মতো, রোমাঞ্চকর শরীর। ফ্যাকাশে গৌর রঙ, লম্বা পা ফেলে হাঁটা, শক্ত ঘাড় উন্মন দৃষ্টি—এ মানুষ কুসুমগঞ্জের মানুষ নয়। এ কখনও কায়েতবাড়ির মেজবাবুর বড়ছেলে নয়। এর সঠিক জাত আমি জানিনে। এ পুরুষ সম্পূর্ণ নবাগত। অথচ একে আমি যেন চিনি। এ পরিচয় কত—কতদিন আগের! এমনি সবুজ বন নদী ঘাসের দুনিয়ায় আমাদের পরস্পর দেখা হয়েছিল, যেমন করে বেহশতভ্রষ্ট আদম আর ইভের দেখা হয়ে যায়!

আমি মুসলমানের মেয়ে। পুনর্জন্ম আমার মানতে নেই। ওটা ঝুনুরা মানে, হয়তো সুনুদাও মানে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, জন্ম—জন্মান্তর বলে সত্যি কি কিছুই নেই? নেই যদি তাহলে এত হাজার মানুষের মাঝখানে কেন একজনকে দেখেই মনে হয়—চিনি, ওকে আমি চিনি, ওকে আমি চিনি! আর আব্বা সবসময় গল্প করেন, তাঁর খানদান নাকি পারস্য গ্রিকদেবতার থেকে এসেছিলেন! আমার রক্তেও নাকি কোনো বিদেশি জাতের ছিঁটেফোঁটা থাকা স্বাভাবিক—কারণ আমার দাদু—নানারাও খানদান ঘরের মানুষ। কে জানে কী, আমার মনে হয়—আমার শুধু একা কেন, ওই সুনুদারাও হয়তো বহিরাগত। তা না হলে ওর চেহারায় গ্রিকদেবতার আদল কেন?…

জায়গা অবশেষে ঠিক হল। উঁচুঝোপের ভিতর একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি! ছোট্ট শাবল দিয়ে উনুন খুঁড়তে থাকল ঝুনু। বাইরে পা বাড়ালুম। দূরে সুনুদা একটা নিচু গাছ থেকে শুকনো ডাল ভাঙছিল। এগিয়ে গেলুম কাছে। সুনুদা বলল, রুবি, এই ডালটা টেনে ধরো দিকি। আমি উঠে গিয়ে চাপ দিচ্ছি—নয়তো ভাঙতে চায় না।

প্রাণপণ শক্তিতে ডালটা ধরে থাকলুম। সুনুদা গাছে উঠে পায়ের চাপ দিচ্ছিল। হঠাৎ হুড়মুড় করে ডালসুদ্ধ সুনুদা আমার ওপর এসে পড়ল। দু’জনে জড়াজড়ি করে পড়ে গেলুম। সামান্য আঘাত লাগল। কিন্তু আমি নিচে, সুনুদা ওপরে—তার দেহের ভার নিয়ে আছি—হঠাৎ আমার মনে হল, সুনুদার চোখে কী খেলা করছে! আমার লজ্জা করল। চোখ দুটো বুঁজে ফেললুম। তারপর টের পেলুম, সুনুদা আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। এবং…

সেইটুকুই কি অবৈধ সংসর্গ? হ্যাঁ, সুনুদা হঠাৎ আমায় চুমু খেয়ে বসেছিল। আমার কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল, অবশ দেহে দাঁড়িয়েছিলুম। সরিয়ে দিতে হাত ওঠেনি। আর আস্তে আস্তে সুনুদা বলল, রাগ করলে রুবি? আমার…আমার হঠাৎ এত ভালো লাগল তোমাকে!…

…মাঝে মাঝে ভেবেছি সেই ছোট্ট ঘটনাটার কথা। আমার মন কি পানির মতো? তা নাহলে কোনো দানো কাটল না কেন? অল্পক্ষণের সামান্য শিউরে ওঠা, কাঁপন মাত্র, তারপর ঢেউটা চাদ্দিকে মিলিয়ে গেল কোথায়। মা বলে, আমি খুব বোকা মেয়ে। শুধু প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকতেই জানি। সাত চড়ে রা থাকে না মুখে। মা বলে, এ মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে সেই ভেবে চোখে ঘুম নেই গো! একটুখানি চটপটে চালাক—চতুর না হলে কি এযুগে চলে? শ্বশুরঘর তো করতেই হবে একদিন, তখন যে হারামজাদি মেয়ের আমার হাঁড়ির হাল হবে—এ আমি হলফ করে বলতে পারি।…মার কথা শুনে সত্যি ভয় করে আমার। কী হবে আমার, কী হবে! আমি যেন আস্ত ভূতের মতো রাস্তার মোড়ে উপুড়করা ওই কালো সাদা ড্রাম—ভিতরে অস্থির সবুজ ঘাস আলো—হাওয়ার অপেক্ষায় শুকোতে শুকোতে মরে যাচ্ছে। অথচ বাইরে থেকে কিছু বোঝবার উপায় নেই। বাইরেটা এত নিরেট আর বোকাহাবা দেখাচ্ছে।

ভালোবাসা শব্দটা কতদিন থেকে আমার কানে আসছিল—ওটা হয়তো মেয়েদের কাছে জীবনের একেবারে বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ। প্রকৃতির পাঠশালা থেকেই ওর শুরু। চারপাশ থেকে বানান করে, বানান করে, কলকণ্ঠে নামতা পাঠের মতো উচ্চারিত হয়—একটি পড়ুয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফাঁকি দিলেও তার শেখা হতে বাধে না। চুপ থেকে ফাঁকি দিয়েও আমার ও শব্দটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। অথচ ওর মানেটা বুঝিনি। বুঝিনি বলেই হয়তো সুনুদার চুমু খাওয়ার তাৎপর্য আমি টের পাইনি তখনও। শুধু চমক লেগেছিল। কাঁপন এসে গ্রাস করেছিল সারা দেহে। এইমাত্র।

কিন্তু একটা ব্যাপার আমার অজানতেই ঘটেছিল। সেদিন সারাদুপুর থেকে বিকেল অব্দি যতক্ষণ আমরা কুঠিবাড়ির জঙ্গলে বনভোজন করলুম, সব সময় বারবার আমার মনে হতে থাকল—একটা কিছু হবে, একটা কিছু হবেই। তা সুন্দর, তা আকাঙ্ক্ষিত, তা বরণীয়। অন্ধের চোখ ফোটার মতো দুনিয়ার কোনো দরজা খুলে যাবে এবং বেহশতের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে!

কবীর বারবার বলছিল, রুবি কী ভাবছে বলতে পারি, বুঝলে ঝুনু?

ঝুনু বলল, ছাই পারো। আমার কাছে শোনো, ও—বলব রুবি? থাক ভাই। অপ্রিয় সত্য না বলাই ভালো। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনও চটে চাঁটি মারতে আসবে।

ঝুনুটা যেন সব টের পায়। ও বাচাল হলেও খুব চালাক মেয়ে। ও কীভাবে সব টের পায় কে জানে! ওকে অপছন্দ করার পক্ষে এই দোষটাই যথেষ্ট—কিন্তু ওর মধ্যে আরও অঢেল গুণ রয়েছে। অন্য হিন্দু মেয়েদের মতো ও পায়ে পায়ে কুসংস্কারে জড়ত্ব পায়নি। আমার সহপাঠিনী অজস্র হিন্দু মেয়েকে দেখেছি। যেথাসেথা কপালে বুকে হাত ছুঁইয়ে কার উদ্দেশ্যে প্রণাম করছে। এটা ছোঁবে না, ওটা ছোঁবে না। জোড়া শালিখ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ঢিপ ঢিপ প্রণাম আর খুশিতে ফোয়ারা ছোটাবে। কথায় কথায় ঠাকুর দেবতার নাম করবে, আর ওদের বাড়ি গিয়েও দেখেছি, সেই পুজো—আচ্চা, ব্রত, ঢিপ ঢিপ প্রণাম, চটকানো প্রসাদ, গঙ্গাজল…আমার তো মোটে একটা গণ্ডী, ওদের গণ্ডীর কোনো সংখ্যা নেই। ওরা হাঁফিয়ে পড়ে না কেন তাই ভাবি। এনিয়ে প্রশ্ন করলে ঝুনু বা শেফালী বলেছে, ওসব বাবা আমরা করিটরি না—পোষায় না। যারা করে—টরে, তাদের শুধোও। দারোগাবাবুর মেয়ে অনিমা ছিল এসব ব্যাপারে সবার সেরা। তাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে একদিন যা অপমানিত বোধ করলুম, বলার নয়। অনিমা মেজাজে জবাব দিল—তোমরা মুসলমানরা ওসব বুঝবে না। গোরু খেয়ে খেয়ে তোমাদের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে। এসব সূক্ষ্ম ব্যাপার।… হবে!

‘উঁহু, ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছি, একটা ঝড় বইছে কোথাও—দিগন্তে চাপা মেঘের ইশারা আর বিদ্যুতের ঝিলিক। কোথায় এতক্ষণে কী সর্বনাশ হয়ে গেল কে জানে! এ বয়সেই টের পাই মনের অনেকখানি আমার অজানা। সেই অজানা জায়গায় একটা কিছু তোলপাড় ঘটতে লেগেছে, এটা ঠিকই। একটা গভীর চাপা গুরগুর শব্দ শুনছি যেন। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কী হারাচ্ছি অজানতে! অন্ধকার ঘরে চোর ঢুকে কীসব নিয়ে পালাচ্ছে। কোনো আলোর নাগাল পাচ্ছি না। চোখ ফেটে জল আসছে, গাল ভিজছে। হাত দুটো অবশ। আমি তো কাঁদতে চাইনে—কে কাঁদছে এখন?