নিষিদ্ধ প্রান্তর – ১৩

তেরো

গঙ্গার ধারে বাঁধের ওপর সাইকেল আস্তে আস্তে যাচ্ছিল কবীর। বিকেলের দিকে তখন কুঠিবাড়ির জঙ্গলে পরিপূর্ণ নির্জনতা। পাশেই ম্যুনিসিপ্যালিটির মেথরেরা আবর্জনা ফেলে যায়। তার ওপর জঙ্গল এবং সাপের আস্তানা। তাই ওদিকে কেউ বিনা কাজে পা বাড়ায় না।

পাখি ডাকছিল। লালচে রোদে ভরে ছিল সারা প্রকৃতিজগৎ। হাওয়া বইছিল অল্প অল্প। আর এই তো ভালোবাসার ঋতু। পাখিদের ঠোঁটে খড়কুটো। নির্জন বনে সাপেরাও জোড় বাঁধে। ঘাসফড়িঙেরাও সঙ্গ খোঁজে। প্রজাপতিরা ডিম পাড়ে গাছের ফাটলে।

বাঁধের ওপর থেকে কবীর দেখল, ঝুনু এসে গেছে। বিহ্বলতায় দুলে উঠল সে। কথা রেখেছে ঝুনু। বিস্ময় তার খুশিকে নাড়া দিচ্ছিল। ভাবতে পারেনি, সত্যি সত্যি এসে যাবে। এর আগেও অনেকবার দু’জনের এমন ‘রেঁদ্যেভু’ ঠিক করা হয়েছে—দু’জনেই এসেছে। কিন্তু আজ এই আসার মধ্যে ভিন্ন কিছু ছিল। একটা দারুণ আবেগ কাজ করছিল যেন দু’জনেরই মনে। এমন করে নির্জন জঙ্গলে পরস্পর চলে আসা—কিছু কি ঘটবে আজ? গুরুতর—কিন্তু গভীরতর সুখের?

ঝোপের আড়ালে সাইকেল শুইয়ে রেখে কবীর এগোল। ঝুনু দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েছিল। কবীর কাছে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল। ঝুনু তার পাজামার নিচেটা ধরে টানল! বলল, কী দেখছ অত? কেউ নেই।

কবীর বসল। …এলেই বা কী?

ইস! কী বীরপুরুষ!

আমরা তো কোনো অন্যায় করছি নে।

আজ্ঞে না। কিচ্ছু না। ডুডু বাটু খাচ্ছি!

কবীর হেসে উঠল। …খাওয়াবে নাকি?

ঝুনু একটু সরে বসে বলল, অনেক দেরি হবে। নুরুদা এসেছে, শুনেছ?

হ্যাঁ। রুবিকে নিয়ে যাবে।

মেয়েটার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। ও বাঁচবে না।

তোমার দাদাও কি বাঁচবে?

দাদার কথা ছেড়ে দাও। দাদা না হাঁদা। সাধু সন্নেসীরাও ওর চেয়ে বুদ্ধিমান।

ঝুনু।

উঁ?

আসতে পারলে? ভেবেছিলুম, অন্তত এখানে আসতে চাইবে না।

কেন? খেয়ে ফেলবে নাকি—এলে?

ছেলেদের অত বিশ্বাস করো না। ঠকে যাবে।

কী করবে শুনি?

কবীর সাহস পেয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল—এই, এমনি করে ধরে…

ঝুনু সবেগে সরে গিয়ে বলল, যাঃ! অত অসভ্য কেন তুমি?

কবীর কাঁচু মাচু হাসল। না, এমনি দেখাচ্ছিলুম।

হঠাৎ দুলে উঠে ঝুনু বলল, এই! আমরা যদি সুনীল—মঞ্জুর মতো তুই তোকারি করি, কেমন হয়?

করে ফ্যাল।

কবীর, তুই আজ কী দিয়ে ভাত খেয়েছিস রে? পরক্ষণে দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠল। তারপর ঝুনু ফের বলল, বেশ নতুন—নতুন লাগছিল কিন্তু।

ভালো তো। চালিয়ে যাই, আয়। হ্যাঁ রে ঝুনু…

হ্যাঁ রে কবরে…

এই! ওকি বলছিস?

তুই যে ঝুনু বলছিস—অমন সুন্দর নামটা—ঝর্ণাধারা। শ্রীমতী—থুড়ি—কুমারী ঝর্ণাধারা ঘোষ।

আমার নামটা কি খারাপ? কাজী কবীরউদ্দিন আহম্মদ।

যাঃ বড্ড বিদঘুটে। কবীর, তোকে বরং ছোট্ট নাম দিই—কবি।

বাঃ!

আচ্ছা কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুলও তো কাজী—তোদের মতো। কবি নজরুলের বউ হিন্দু—তাই না?

কবীর মিটিমিটি হেসে বললল, হুঁ।

ঝুনু হিসেবের ভঙ্গিতে বলল, স্বামী মুসলমান, স্ত্রী হিন্দু—বেশ। তাহলে তাদের ছেলেপুলেরা কী হবে? হিন্দু, না মুসলমান?

কবীর মুহূর্তে সিরিয়াস হয়ে বলল, হিন্দু মুসলমান আবার কী? স্রেফ মানুষ। তবে যার যে ধর্মটায় বিশ্বাস হবে, তাই নেবে। এটা কোনো সমস্যাই নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ঝুনু বলল, তুমি—থুড়ি, তুই, অনেকটা এগিয়ে এসেছিস কিন্তু। সরে বোস।

মোটেও না। তুই এগিয়েছিস।

ঠিক আছে। মধ্যে এই কাঠিটা রাখলুম। গণ্ডী কিন্তু। সাবধান!

কিছুক্ষণ স্তব্ধ দু’জনে। তারপর কবীর পকেটে হাত ভরে অস্ফুটে বলল, একটা সিগ্রেট খাব?

ঝুনু অন্যমনস্ক ছিল। চমকে বললে, কী খাবি বললি?

সিগ্রেট। তোর আবার গন্ধ শুঁকলে বমি আসে নাকি। গুল! কী ভেবেছিলি রে?

ঝুনু লাল গালটা ফিরিয়ে বলল, কিছু না।

আমি বলতে পারি।

যাঃ। শুধু অসভ্যতা।

ঝুনু, আমরা কি সত্যি সত্যি যা সব করছি—একেই প্রেমট্রেম বলে?

কে জানে! আমরা কিন্তু প্রেমট্রেম করছি নে।

ফের স্তব্ধতা। সাবধানে মুখ ঘুরিয়ে সিগ্রেট টানছিল কবীর। ঝুনু পায়ের কাছে একটা শুকনো কাঠি ভাঙছিল।

ঝুনু!

উঁ?

স্তব্ধতা। রোদ মুছে ধীরে—অতি ধীরে একটা পরিব্যাপ্ত ধূসরতা ঘনাচ্ছিল। দুর্গম হয়ে উঠছিল স্থাবরজঙ্গমসমাবৃত ঈশ্বরের বিপুল চরাচর। দিগন্তে এসে দাঁড়ালেন, কিন্তু তাঁকে দেখা গেল না—বোঝা গেল ওই তাঁর স্মিত সুন্দর হাসিটি।

আর সেই সময় পাখিগুলো ডেকে উঠল জোরে। ডাকতে ডাকতে গঙ্গা পেরিয়ে এসে গেল একদল শালিখ। ধূসর বালির চর থেকে ঘুরপাক খেতে খেতে একটা হাওয়া উঠে এল এদিকে। ঝোপঝাড় দুলতে থাকল। বাঁধের ঝাউগাছগুলো শন শন শব্দে মর্মরিত হল। সন্ধ্যার পৃথিবী শিহরিত হতে থাকল বারবার। দূরের মসজিদের উঁচু ছাদে দাঁড়িয়ে কে আজান দিল। ঘণ্টা বাজতে থাকল দেবী সিংহবাহিনীর মন্দিরে।

কবীর ডাকল, ঝুনু!

উঁ?

তোকে একবার চুমু খাব?

উঁ—ন্না!

কোনোদিন তোকে পাব কি না জানিনে—না পেলে বড় দুঃখ থেকে যাবে ঝুনু?

কী বললি?

ঝুনু, আমার ঝুনঝুন!

এবং সেই নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে একটি মেয়ের চোখদুটি যখন বুজে গেছে, সমর্পিত মৌন দুটো ঠোঁটের ওপর একটি ছেলের দুটি ঠোঁটের চাপ কিছুক্ষণের জন্যে ভালোবাসার সত্যকে প্রকাশ করে গেল। সেই কিছুক্ষণের জন্যে ওদের দু’জনের পৃথিবীতে হিন্দু ছিল না, মুসলিম ছিল না—ধর্মাধর্ম পাপপুণ্য শুভাশুভের বাইরে পৌঁছে ওরা দেখতে পেল মানুষের রক্তের অন্তর্গত গভীরতম সত্যটিকে। যে সত্য থেকে একটি পরম স্বাধীনতার আবির্ভাব হয় এবং যে—স্বাধীনতায় সূর্য বিকিরিত করে নিজেকে, জড় থেকে চেতনা আসে, পৃথিবীতে আসে প্রাণীসমূহ এবং উদ্ভিদ, ফুল ফল বীজ ঋতু আবর্তন এবং মৃত্যুহীন ধারাবাহিকতা।…

হাসপাতালে তখন অন্য একটি কাণ্ড ঘটছিল।

নুরু সকালেই মাকে ফ্রি বেড থেকে কেবিনে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। সাহানা গত রাত থেকে দু’বার সামান্য রক্তবমি করেছে। এতদিন পরে আজ ধরা পড়েছে, সাহানার হার্টের নীচে গুরুতর আঘাত লেগেছিল। ডাক্তার বলেছেন, খুব দুঃখিত খানসাহেব—তেমন কোনো সিমটম তো দেখিইনি তখন—তাছাড়া ওখানে আঘাত লাগবেই বা কী করে? কাজেই ও নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি। এখন বুঝছি, আছাড় খাবার সময় জোর ঢাক্কা বা ঝাঁকুনি লেগে থাকবে হার্টে। হার্টের অবস্থাও খুব ভালো ছিল না সম্ভবত। উনি তা বলেছেনও। যাক গে….যদ্দূর সাধ্য, কোনো ত্রুটি হবে না।

কলকাতায় কোনো বড় হাসপাতালে বা নার্সিং হোমের কথাও ভেবেছিলে নুরু। কিন্তু এখন যা অবস্থা—রোগীকে নড়াচড়া একেবারে বারণ। আর নিয়ে যাওয়াও মুশকিল। অনেক টাকাপয়সার দরকার। ভিসার মেয়াদ বাড়ানো চাই। ওদিকে আপিসে ছুটির ব্যাপার আছে। একটা এমারজেন্সি দপ্তরে তার চাকরি। ছুটি খুব কমই মেলে।

বিকেল থেকে ওরা তিনজনে সাহানার কাছে রয়েছেন। আফজল, নুরু আর রুবি। রুবির চেহারা আজ বিভ্রান্ত—রুক্ষ—কেমন যেন ঝড় খাওয়া গাছের মতো হতশ্রী। লাল চোখ। কথা বলছে কম। ওরা ভেবেছেন, রুবি মায়ের জন্যে উদ্বিগ্ন। এবং সেটা তো স্বাভাবিকই। সাহানা নুরুর সৎমা—কিন্তু রুবির যে গর্ভধারিণী।

অবস্থা দেখে আফজল বলছিলেন, বরং রুবি চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে তোমার কাছে থাক সানু। কেবিনে থাকবার অসুবিধে নেই। এখানেই নাইবে—খাবে। আমি খাবার—দাবার বইব’খন।

রুবি ঘাড় নেড়ে ছোট্ট করে হুঁ বলল।

সাহানা যন্ত্রণার মধ্যে হঠাৎ একটু হাসল। …নুরু কবে যাচ্ছে?

নুরু বলল, কাল দিন রাত্তিরটা আছি। পরশু ভোরে রওনা হব।

সাহানা চুপ করে থাকল।

রুবি বলল, আমি আর বাড়ি যাচ্ছি না বরং। আব্বা, আমার কাপড়জামা আর…

সাহানা বাধা দিল। …হচ্ছে। বাবা নুরু।

বলো মা।

তাহলে রুবির কী হল?

তুমি যা বলবে, তাই হবে।

রুবি উৎকর্ণ। আফজল বললেন, বলবে? কী বলবে আবার? ও না হয় পেটে ধরেছিল বা সাথে করে এনেছিল। তো আমিও তো বাপ বটি। বাপের কথাটা খাটবে না? বা রে বা! দুনিয়া জুড়ে চিল শকুন উড়ছে—আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার দাখিল। নুরু, ওকে নিয়ে যা।

রুবি সব জানে। তাই সে না হল বিস্মিত—না করল কোনো প্রশ্ন।

সাহানার শুকনো ঠোঁটে সেই হাসিটি তখনও লেগে রয়েছে। মেয়ের হাতটা টেনে বুকে রাখল। বলল, রুবি, তোকে পাকিস্তান নিয়ে যাবে বলছে। যাবি মা? কলেজে পড়ার এত সাধ—নুরু পড়াবে তোকে। আমি বলছিলাম, খোদার ইচ্ছেয় সেরে উঠি—তখন না হয় যাবি। তদ্দিন থাক। আমার মনটা তোকে ছেড়ে ছটছট করবে মা। এ বেমারির হালে তুই থাকবি নে! তো…দম নিয়ে সাহানা ফের বলল, যা শুনেছি…না গেলেও দুশমনের ডঙ্কায় কান তালা হয়ে যাচ্ছে। ….তো মনকে বুঝ দিলাম। যা। নারাজ হস নে মা। মেয়েদের আবার বাপ মায়ের ঘর বলে কিছু থাকে দুনিয়ায়? এর মায়া যখন একদিন কাটাতেই হবে—আজই কাটুক।

আফজল বললেন, বেশি কথা বলো না। বেমার বাড়বে।

সাহানা থামল না। বলতে থাকল, দুধের বাচ্চা—বাপটা চোখ বুজল। বাপের দুঃখটা আমি বুঝতে দিলুম না। ফের বাপ পেল। অনাথ এতিম বড় দুঃখী মেয়ে আমার—নুরু…হঠাৎ কেঁদে ফেললেন সাহানা। তারপর অন্য হাত বাড়িয়ে নুরুর হাতটা নিল সে।…নুরু, শরিয়তের খেলাপ হবে না বাবা। আমিও সুখে চোখ বুজব। গোরে গিয়ে শান্তি পাব রে সোনা! আমি—আমি রুবির মা—রুবির আসল জিম্মাদার। আর, ও—দুনিয়া থেকে সেও তাকিয়ে আছে আমার দিকে, তার সাধের মেয়ের কী গতিক আমি করি দেখবে—বাবা নুরু, ইসলামে এর বারণ নেই…

আফজল রুদ্ধশ্বাসে বললেন, সানু, সানু!

নুরু রুবির দিকে তাকিয়েই চোখ ফেরাল। রুবি লাল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

সাহানা রুবির হাতটা নুরুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, সঁপে দিলুম। কাজীসাহেবকে ডেকে বাকি কাজটুকু করিয়ে নাও—ওগো শুনছ? দেরি করো না!…হাঁফাতে হাঁফাতে সাহানা বলল, আজরাইল এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্পষ্ট দেখছি। ওগো ভালোমানুষের ছেলে, জলদি করো। আমাকে শান্তিতে যেতে দাও।

আফজল স্তব্ধ। নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন।

সাহানা ছটফট করতে থাকল। …যাও, দেরি করো না। আজ রাতেই লোক ডেকে কাজটা সেরে ফেলো। আজরাইল এসেছে। তোমাদের পায়ে পড়ি, জলদি যাও।

দু’টি অবশ হাত আস্তে আস্তে সরে গেল যে—যার জায়গায়। নুরু উঠে দাঁড়াল। তারপর হন হন করে বেরিয়ে গেল।

সাহানা ওর চলে যাওয়া দেখে ফুঁসে উঠল।…চলে গেল নুরু। কেন? আমার মেয়ে কি ওর এত অযুগ্যি? কী ভেবেছে নুরু! ওর টাকায় আমার চিকিৎসে হচ্ছে! ওষুধ খাচ্ছি! এ আমার জহর—বিষ! আমি খাব না—

আলুথালু চুল—ওঠবার চেষ্টা করছিল সাহানা। হাঁফাচ্ছিল। আফজল আর রুবি জোর করে ওকে ধরে শুইয়ে দিলেন। ঠোঁটের ফাঁকে রক্ত দেখা গেল সাহানার। আফজল চেঁচিয়ে উঠলেন, রুবি, রুবি—ওদের খবর দে মা। ফের খুন বেরচ্ছে!

রুবি দ্রুত উঠে গেল। দরজার বাইরে নুরু দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখল। পরস্পর তাকাল। কিন্তু কথা বলল না কেউ। তারপর নুরু ফের আস্তে আস্তে গিয়ে ঘরে ঢুকল। সাহানার কাছে গিয়ে বসল। সাহানা ফুঁসে উঠল, আমি মরি—তোমার কী বাবা? যাও—এসো না আমার কাছে! অ্যাট্টুকুন দুধের বাচ্চা মানুষ করেছিলুম বুক দিয়ে—সে তো মনে থাকবে না আর! এখন বড় হয়েছ। এখন আমার কথার কী দাম বাবা?…সাহানাকে থামানো যাচ্ছিল না। বীভৎস দেখাচ্ছিল ওর চেহারা। দাঁতের ফাঁকে, ঠোঁটে, কষায় রক্ত। আফজল রুমালে ঠোঁট মুছাতে চেষ্টা করছেন। সাহানা হাতের ধাক্কায় তাঁকে নিবৃত্ত করেছে।

তখন নুরু আস্তে আস্তে বলল, থামো মা, থামো। তাই হবে। তোমার ইচ্ছেই মানব। এবার থামবে?

সাহানা শান্ত হলেন। হাত বাড়িয়ে ওর গালে বুলোতে বুলোতে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলেন।

আর সেই সময় পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে রুবি। নুরুর কথাটা পুরো শুনেছে।

বারোয়ারিতলায় এসে হঠাৎ নুরু বলল, আব্বা, আপনি এগোন। আমি—আমরা আসছি।

আফজল বললেন, এগোব? বেশ, এগোচ্ছি। আয় রুবি।

নুরু বলল, রুবি আমার সঙ্গে যাবে। আপনি যান না।

অ বেশ। …বলে আফজল পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরলেন। ইয়ে, কথা বলবি তো বাড়ি গে বললে হত না? পথে বলে কী দরকার? আমি তো গিয়েই কাজীসায়েবের কাছে যাব। মসজিদে যাব। পাঁচজনকে তো বলতে—টলতে হবে। দুপুর রেতে লোকজন পাব কোথায়—এখন গিয়ে না ধরে আনলে?

নুরু বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ! আজ রাতেই যে সব করতে হবে, তার মানে কী আছে? সে সব কালও করা যেতে পারে।

উরে ব্বাস! আফজল আঁতকে বললেন, তোমার মাকে চেনো না বাবা। ওর যা কথা, তাই কাজ। কাল সকালে যদি শোনে, এখনও ‘কাজ’ হয়নি—রাগে হার্টফেল করবে।

রুবি স্তব্ধ। নুরু বলল, সে আমি দেখব’খন। আপনি বাড়ি গিয়ে বসুন গে। যাচ্ছি আমরা।

বেশ। যা ভালো বোঝ, করো বাবা। আমি এর সাতে পাঁচে নেই বলে আফজল চলে গেলেন। আপাতত হেমনাথের বাড়ি চুপিচুপি যাবেন এবং হেমনাথকে সব বলবেন। সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু সাহানা কাজটা কি ভালো করল? আফজল ভাবতে ভাবতে গেলেন সারাপথ। …আমি কিন্তু এদিকটা কখনো ভাবিনি কোনোদিন! হাজার হোক—স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। বেশ নরম জায়গায় কোপ মেরেছে।

বাড়ির কাছে গিয়ে আফজল একবার দাঁড়ালেন। মনটা উসখুস করছে। কে জানে কেন, মনে হচ্ছে—এটা ঠিক হবে না। মস্ত ভুল করা হচ্ছে। রুবি আর নুরু—দু’টি ভাইবোনের পরস্পরকে সারাজীবন দেখে আসছে। রুবিকে মেয়ে বলে দেখে এসেছি। এখন সে নুরুর বউ হবে—তার মানে, আমার বউবিবি। ধ্যুৎ! এ কেমনটা হল গা? সাহানা মরতে বসেছে তাই—নয়তো আম্মো তো ছেলের বাপ, ছেলের জিম্মাদার—আমারও একটা কথা খাটবে না? আমার ছেলের ভালোমন্দ আমাকে দেখতে হবে না তো দেখবে তার সৎমা? ধ্যুৎ, ধ্যুৎ! হেম শুনলে হয়তো হাসবে। লোক হাসানো কাণ্ডই বটে। আরে বাবা, শরিয়তে তো কত হাজারে হাজারে আইন—কানুন রয়েছে—কতগুলো লোকে মেনে চলছে শুনি? তাহলে তো দুনিয়াটা বেহেশত হয়ে যেত বাবা! আসলে আমরা দরকার পড়লে শরিয়তের জিগির হাঁকি—চালচলনে কাজে—কম্মে দুনিয়াদারিতে অহরহ তার উলটো কাজ করে থাকি। সে লোকটা গলা চড়িয়ে চড়িয়ে বলছে, আমি মোছলমান—সেই আবার বাগে পেলে চুরি করেছে, জ্বেনা (ব্যাভিচার) করছে, উঠতে বসতে বউ ঠ্যাঙাচ্ছে—এমনকি আদবকায়দারও ধার ধারে না। ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে বেগম, আমাকে তুমি ওসব বুঝিয়ো না।

তবে কী, তুমি কাল বেমারিতে রয়েছ—তোমার মুখ চেয়ে কথাটা ঠেলে ফেলা কঠিন হল। সেই সমস্যা। মুহব্বৎ আমার গলা টিপে ধরলে বেগম। ভাবলুম, মরুকগে। মানুষের সব সয়—রুবি নুরুরও এটা সয়ে যাবে। তোমার আমারও সইবে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগবে—তারপর গা—সওয়া হতে থাকবে। তারপর একদিন দুনিয়াদারির চাপে পড়ে সব একাকার হয়ে যাবে। জিন্দেগীর (জীবন) এই তো মজা। জিন্দেগীই মানুষকে খুশিমতো বদলায়। মানুষ তার হাতের পুতুল ছাড়া কী? তার ওপর গোস্বা (ক্রুদ্ধ) হয়ে কী করব?

জীবনের দিকে খুব ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছিলেন আফজল। হ্যাঁ—তাই—ই তো! আমার জীবন কি আমার এক্তিয়ারে চলে? তার নিজের ঝোঁকে নিজের গতিতে শক্তিতে এগিয়ে চলা। তা না হলে তো কত সাধ আশা—আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছেমাত্র মিটে যেত মানুষের। চেষ্টা করে কে কবে জীবনকে বদলাতে পেরেছে? সে যেন একটা অন্ধ ঘোড়া—তার পিঠে তুমি সওয়ার। তুমি কখনও ভয় পাও গতির দোলায়। কখনও খুশি হয়ে ওঠ চলার পুলকে। কখনও তার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিটের সুগম পথ। সুন্দর দেশ। কখনও এনে ফেলে সে দুর্গম মরুভূমি কিংবা অরণ্যে। মালভূমিতে। বন্ধুরতায়। চারদিকে বৃক্ষহীন কোথাও ঊষর প্রান্তর। ধু ধু ধুলো। ঝড়। পাথরের চাঙড়। এবং নিষ্ঠুর তৃষ্ণা। জল নেই। দু’জনেই জিভ বের করে হাঁফাতে থাকো। …

গ্রামের বাইরে হাইওয়েতে এসে নুরু ডাকল, রুবি?

উঁ?

কথাগুলো পথে বলাই ভালো। কারণ, ঘরে এসব বলা যাবে না। ঘরে গেলেই তো আমাদের সবটুকু পিছনের জীবনটা সামনে এসে দাঁড়াবে। বাধা দেবে। ঘরময় ছড়িয়ে রেখেছি আমরা হাজারটা স্মৃতি। তাকে অপমান করা—আমার পক্ষে সম্ভব হবে না রুবি। এবং আমি বুঝতে পারি, তোমার পক্ষেও সম্ভব হবে না। কারণ, আজ বিকেল অব্দি যে খাটটায় দু’জনে পাশাপাশি বসে তুমি তোমার ভবিষ্যৎ ভাবীকে নিয়ে রসিকতা করেছ, যেখানে তুমি ছিলে আমার ছোট্ট অবুঝ বোনটি, এখন সেই খাটে বসে…নাঃ, তা হয় না। অন্তত আমি তো পারতুমই না।

রুবি খুব আস্তে বলল, ওটা তোমার—আমারও হিঁদুয়ানি হতে পারে। ছেলেবেলা থেকে আমরা হিন্দুদের সাথেই মানুষ হয়েছি—হয়তো তাই।

নুরু অবাক হয়ে তাকে দেখল। রুবি কেমন চাপা হাসছে। কিন্তু ওকি তার ব্যঙ্গ? লাইট পোস্টটা ঢেকে আছে শিরিস গাছের আড়ালে। একচিলতে আবছা আলোয় দেখা ও হাসি কি স্বাভাবিক রুবির? সে কি মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছে তবে—এই আকস্মিক পরিণতিটাকে? নুরু ধাঁধায় আটকে গেল সে—মুহূর্তে।

তাকে চুপচাপ দেখে রুবি বলল, কী কথা আছে বলছিলে?

তুমি আমাকে আর দাদা বা নুরুভাই বলছ না?

বললে খুশি হবে? আর তুমিও তো তুই বলছ না আমাকে?

নুরু হাসবার চেষ্টা করল। …বলতে বাধো—বাধো ঠেকছে। এতদিন তোমাকে তো পূর্ণ নারী বলে টের পাইনি, আজ মা পাইয়ে দিলেন? এটা আমার সম্ভ্রমবোধ হতে পারে, রুবি।

কীসের?

তোমার নারীত্বের প্রতি।

তুমি পাকিস্তান থেকে কি এত ভালো ভালো কথা শিখে এসেছ!

রুবি, তুমি হাসতে পারছ?

পারছি।

তোমার দুঃখ হচ্ছে না? কষ্ট হচ্ছে না?

না। কেন হবে?

তুমি তো সুনন্দকেই ভালোবাস, রুবি।

রুবি চমকে উঠে কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকাল। তারপর মুখ নামাল। আস্তে আস্তে ফের হাঁটতে থাকল। নির্জন হাইওয়ে। মাঝে মাঝে দু’একটা রিকশো যাতায়াত করছে। দু’দিকে অজস্র গাছপালা—কিন্তু কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। আলোর এলাকা শেষ হল। অন্ধকারের মধ্যে ওরা একটু দাঁড়াল। দু’জনেই পরস্পরকে চেনার চেষ্টা করল। তারপর নুরু বলল, চলো—ওই ব্রিজটার ওপর গিয়ে বসি।

সামান্য তফাত রেখে ওরা বসল। ব্রিজের দু’ধারে কোনো গাছ নেই বলে অন্ধকার এখানে ঘন নয়। মাথার ওপর আকাশ। নক্ষত্রময় বিশালতা। রুবি দু’হাত ভর করে বুক চিতিয়ে আকাশ দেখছিল। নুরু বলল, তুমি যদি কথাটায় রাগ করো, তাহলে বলব, তোমার মধ্যে এখনও অনেক দীনতা আছে। এখনও তোমার মনকে তুমি বুঝাতে পারোনি। কিংবা নিজের সঙ্গে বিশ্রী লুকোচুরি খেলছ। রুবি?

উঁ?

ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি। না—এটা কোনো পাপ নয়। এটা মানুষের কোনো ছলনা নয়—এটা একটা ভয়ঙ্কর সত্য। তবে, সবার জীবনে এ জিনিসের দেখা মেলে না। তাদের দুর্ভাগ্য রুবি। যাদের জীবনে ভালোবাসা ঘটে যায়, তারা ছাড়া এর স্বরূপ কেউ টের পায় না। অন্যেরা নাক কুঁচকে বলে—ও, প্রেম? সে তো নিছক সেক্সের ব্যাপার! অমুকে—অমুকে প্রেম করছে? সে তো তাহলে একটা সেক্সুয়েল অ্যাডজাস্টমেন্ট? তারা মূর্খ। মানি, সেক্স ছাড়া প্রেম সোনার পাথরবাটি। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা কখনো শুধু সেক্স নয়। এটা মানুষের আদিম জীবনেও ছিল—আজও আছে। এ খুব রহস্যের ব্যাপার। আমার মাথাকে গোলমাল করে দ্যায়। সাইকলজি বলে, এ নাকি কোনো কমপ্লেক্স। ভালোবাসার পাত্রপাত্রী বাবা—মায়ের চরিত্রের আদলে মিলে গেলেই নাকি…বোগাস!

রুবি একটু কেশে বলল, তুমি প্রেম করছ নিশ্চয়!

নুরু অবাক হল না। কারণ, বস্তুত এসব সময়েরই একটা অনিবার্য ফসল—যা ওরা কুড়োবার জন্যে একই জমিতে বাধ্য হয়েছে। নুরু হাসল।…কে জানে! আমার কথা থাক। আমি তোমার কথা শুনতে চাই রুবি। আমি তো জানি, তুমি চাপা মেয়ে ছিলে—কিন্তু তোমার সে ছিল এতদিন একটা সঞ্চয়ের লম্বা মরশুম। জীবনের অনেকখানি তুমি এরই মধ্যে চিনে ফেলেছ। ওটা তোমাকে দেখেই টের পেয়েছি। এখন, আমার জবাব দাও। খুব ভেবে জবাব দেবে কিন্তু। সমস্যাটা মোটেও সহজ নয়।

কী জবাব দেব?

তুমি কি সুনন্দকে ভালোবাস? সত্যি সত্যি? নাকি তোমার কোনো ক্ষণিক খেয়াল?

রুবি স্তব্ধ।

ভেবে জবাব দেবে, বলেছি। তুমি ভাব—ততক্ষণ আমি সিগ্রেট খেয়ে নিই। ….নুরু সিগ্রেট জ্বালায়। নিঃশব্দে টানতে থাকল।

একটা ট্রাক উজ্জ্বল আলো ফেলে আসছিল। গাছের ছায়াগুলো সাঁৎ সাঁৎ করে সরে যাচ্ছিল মাঠের দিকে। ট্রাকটা চলে যাবার পর রুবি বলল, আমি কিছু ভেবে দেখিনি।

কী?

কাকে ভালোবাসি, না বাসিনে।

আমার কাছে লজ্জা করো না রুবি। তোমার কোনো ভয় নেই। আমাকে কি তুমি চেনো না? আমি একটুও বদলাইনি। তুমি খুলে বলো।

রুবি স্তব্ধ।

রুবি, তাহলে জানব, তোমার মধ্যে ফাঁকি আছে। তুমি স্বার্থপর হয়ে গেছ।

জোর করে একটা বলিয়ে নিতে চেষ্টা করছ তো?

মোটেও না।

তোমার যদি এত বিশ্বাস যে আমি ওকে ভালোবাসি, তাহলে আর জিগ্যেস করছ কেন?

রুবি। ছিঃ! কেঁদো না।

না, কাঁদব কেন? আমি কাঁদতে পারিনে।

শুধু তোমার মুখ দিয়ে শুনতে চাই—তুমি ওকে ভালোবাস কি না।

শুনলে কী করবে?

সে আমার ব্যাপার।

তাহলে মায়ের কথাটা রাখবে কিংবা রাখবে না—এই ব্যাপার তো?

হয়তো।

রুবি একটু চুপ করে থেকে বলল, বেশ। বলছি। আমি সুনন্দকে ভা—ভালোবাসি।

নুরু হেসে উঠল।…তবু গলাটা কাঁপল? ভীতু কোথাকার!

বলো, এবার কী বলতে চাও!

রুবি! ফের তুমি কাঁদছ?

না।

তুমি কাঁদছ!

না না না। আমি কাঁদিনি।

চলো, ফেরা যাক। ওঠো।

রুবি উঠল না। নুরু ওর হাত ধরে টানতেই সে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে ওর পা দু’টো জড়িয়ে ধরল। কান্নাভেজায় গলায় বলে উঠল, নুরু ভাই, তুমি আমাকে বাঁচাও। তোমার পায়ে ধরে বলছি—আমাকে তুমি মেরে ফেলো না। তোমাকে আমি বড় ভাই বলে চিরদিন জেনে আসছি—কেমন করে…

নুরু ওর মুখে হাত চাপা দিল।…রুবি, রুবি। ছিঃ কী ভেবেছিস তুই আমাকে! তুই আমার বোনই আছিস। ওঠ, কে দেখলে কী ভাববে!

ওরা ফিরে আসছিল। নিঃশব্দে।

বারোয়ারিতলায় পৌঁছে নুরু মুখ খুলল। তুই কষ্ট পাবি রুবি। ঠিক বলতে পারিনে—তবে আমার মন বলছে রে। সুনন্দকে আমি জানি। ওর মধ্যে সংস্কার নেই, সাহসও আছে—কিন্তু ওর মধ্যে আবার ছাপোষা সংসারী ভাবও বড্ড বেশি। সেইটেই খুব ভয়ের কথা। তাছাড়া—ওর পাস করে বেরোন, চাকরি—বাকরি—তারপর…সে ঢের দেরি। ততদিন কি তার টানটা টিকবে? অবশ্য আমি এখনও জানিনে, সে তোকে ভালোবাসে কি না। তোর কী মনে হয় রে? সে তোকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে?

রুবি খুব আস্তে বলল, আমি কেমন করে বলব?

না—মানে, তোর কী মনে হয়?

কিছু মনে হয় না। তুমি অন্য কথা বলো নুরুভাই।

নুরুভাই বলছিস যে! দাদা নয় কেন?

এত হিসেব করে কিছু বলতে পারিনে।

হ্যাঁ রে, রুবি। তাহলে ফের আমরা নিরাপদে ভাইবোন হয়ে গেলুম। কেমন?

এতক্ষণে রুবির মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, বাড়ি গিয়ে হয়তো দেখবে—আব্বা কাজীকে নিয়ে উঠোনে বিয়ের মজলিস বসিয়েছে। সামলাবে কী করে?

তুই বসে মজা দেখিস না? কী করি! নুরু হাসতে লাগল।

তারপর মাকে কী বলবে?

এ যুগে অতখানি পিতৃমাতৃভক্ত না হলেও চলে রে। ওঁরা সব ওঁদের যুগের ধারণা দিয়ে আমাদের চালাতে চান, বাস্তবে তা তো কখনো হয় না। সময়ের মজাটাই এই। এক যুগের শাসন—কানুন পরের যুগে কাজ দেয় না। বুঝতে পারলি? মা মনে কষ্ট পাবেন—এই তো? সে বরং কিছু মিথ্যে বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে।

রুবি বলতে যাচ্ছিল, মা এমন মানুষ—যা মাথায় আসবে…

কিন্তু পাশেই সাইকেল থেকে নেমেছে হাসপাতালের চাঁদঘড়ি জমাদার।

….এই যে মিয়াদিদি—যাচ্ছিলুম আপনাদের বাড়িই।…মিঁয়াদাদা যে! কবে এলেন গো? আদাব, আদাব। খবর ভালো তো?

নুরু বলল, কী ব্যাপার?

চাঁদঘড়ি বলল, ডাক্তার বোসবাবু আসতে বললেন। আপনার মায়ের অবস্থা ভালো না। মেয়ের নাম করছেন বারে বারে। তাই…

রুবি ঘুরল। নুরুও।

সাহানা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল, তখন রাত বারোটা। কোনো কথাই বলতে পারেনি। আফজল যখন পৌঁছলেন, তখন সাহানার লাশটা বিছানায় স্থির হয়ে আছে। এলিয়ে পড়া কালো চুলের মধ্যে ধবধবে একটা মুখ—এত সুন্দর দেখাচ্ছিল সাহানাকে। সে—মুহূর্তে রুবিকে তার পাশে দেখাচ্ছিল যমজ বোনের মতো। এবং মৃত্যুর পর যে মানুষকে সুন্দরতর দ্যাখায়, সে নাকি জীবনের পরম তৃপ্তিটিকে সাথে নিয়ে চলে যেতে পেরেছে। সাহানা তৃপ্ত। কিন্তু সে—তৃপ্তিটি কীসের? নুরু রুবিকে গ্রহণ করেছে—তাই?

সেও তো কথা। নুরুর মতো ছেলের কাছে রুবিকে গছাতে পেরে সাহানা স্বভাবতই সুখী হবে। নুরু রুবিকে এত বুঝতে পারে—এত স্নেহ করে! পরে কি অমন করে বুঝবে না দেখবে? সেখানে সম্পর্কটা তো নিছক স্বার্থের। ঘরকন্না করা, দুনিয়াদারি, বাচ্চা বিয়োন, দেহের সুখ দেওয়া!

সকালেই দাফন—কাফন (মৃতের স্নান এবং পোশাক পরানো) হয়ে গেল। লাশ যখন কবরে নিয়ে গেল, পিছনে—কিছু তফাতে হেমনাথ যাচ্ছিলেন। গোরস্থানে যতক্ষণ জানাজা পড়া (মৃতের জন্য প্রার্থনা) হল, তিনি চুপচাপ এক প্রান্তে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সবাই চলে গেলে তারপর আফজল এলেন তাঁর কাছে। ডাকলেন, হেম, এসেছ?

হেমনাথ ওঁর কাঁধে হাত রাখলেন। সহ্য করো ফজু। সতীলক্ষ্মী বেহশতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবেন।

তাছাড়া আর বলার কীই বা ছিল! কিন্তু এতক্ষণে আফজল আর পারলেন না—প্রচণ্ড শোকের বিস্ফোরণ ঘটল। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ভাঙছিলেন আফজল।

আর হেমনাথ ভালোই জানেন—এই লোকটির মধ্যে বরাবর একটি শিশু বেঁচে রয়েছে। তাকে এত ভালো লাগে বলেই তো যত সমস্যা।

ঘরে রুবির পাশে ঝুনু। প্রভাময়ী আগাগোড়া উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর বারান্দায় উঠেছিল। দরজায় গিয়ে কপাটে হাত রেখে কিছু সান্ত্বনা দিয়েছিল রুবিকে। এবং চলে আসবার সময় ইঁদারাতলার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল।

খিড়কির বাইরে সরু পথের ওপর কাঁটার বোঝাটা আজ ভোরে নিজেই সরিয়ে দিয়েছিল প্রভা।

এক সময় নুরু গোরস্থান থেকে একা ফিরে এল। বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। সেই সময় এল সুনন্দ। নুরু ডাকল, আয়। বোস।

সুনন্দ বলল, কাল থেকে ছিলুম না। এইমাত্র এসে সব শুনলুম। তুই এসেছিস, শুনেছিলুম—কিন্তু…হ্যাঁ রে, ওরা প্রথমে ডায়গোনেসিস করতেই পারেনি—না?

নুরু বলল, বোস। সিগ্রেট খা। তোকে খুঁজছিলুম।