নিষিদ্ধ প্রান্তর – ১২

বারো

এ ঠিক পুনর্মিলন নয়। বড় জোর বলতে পারি একটা নতুন আরম্ভ। নতুন কাজেই ভিন্ন একটা আকৃতি প্রকৃতি। যা ছিল, তার সঙ্গে এর তুলনা চলতে পারে না। আফজল—হেমনাথ পরস্পর ফের নিকটস্থ হলেন বটে—কিন্তু একটা গভীরতর অস্বস্তি দু’জনের মনের ভিতর থেকে গেল। এখন দু’জনেই কোথায়—কোথায় কদ্দূর পা ফেলবেন না ফেলবেন না, সেই রকম হিসেবি চালচলন এবং সতর্কতা অবশ্যই রয়ে গেল দু’পক্ষে।

প্রভাময়ীও দেখে এল সাহানাকে—সঙ্গে ঝুনু ছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারেনি। ঝটপট কিছু খবর জেনেই দুরুদুরু বুকে পালিয়ে এল মেয়েকে নিয়ে। লোকলজ্জার মাথা খানিক খেতে হল সজ্ঞানে। কিন্তু এ অনেকখানি হেমনাথের জেদে। হেমনাথ আফজলকে বলেছিলেন ঝোঁকের বশে—মেজবউও আসবে’খন। জেদি হেমনাথের স্বভাবচরিত্র স্ত্রীর জানা আছে। তাই ওটা কিছুটা নিতান্ত কথা রাখার ব্যাপার। স্বামীকে ছোট হতে দিতে প্রভাময়ীর কষ্ট হয়।

তবে শুধু এই অজুহাতটা দেখালে প্রভাকে ছোট করে দেখানো হয়। প্রভা তা নয়। তার মনে অনেকরকম ভালোমন্দ সংস্কার আছে। তার মধ্যে পরিচিত মানুষ বা প্রতিবেশীর প্রতি প্রীতির সম্পর্ক নামে যা আছে, তা কম গভীর নয়। ধারেকাছে যারা সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী, তাদের প্রায় সবার বৈষয়িক অবস্থাই হেমনাথের চেয়ে ভালো। কাজেই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো এই খাঁ পরিবার ছিল প্রভার প্রবলতম পড়শিক্ষুধার মধুরতম খাদ্য। এখানে কোনো প্রতিযোগিতার প্রশ্নই ওঠেনি। বরং খাঁ পরিবার টাকা—পয়সার হিসেব ধরলে একটু গরিবই বটে।

প্রভা সাহানাকে দেখে এল। তার কষ্ট হচ্ছিল। মিয়াবউর অমন শরীরটা কী হয়ে গেছে! বুকের ব্যথাটা বাড়ছে—কমবার লক্ষণ নেই। ডাক্তার বলেছেন, ওটা অন্য অসুখ। হার্টের দোষ আছে যে! প্রভার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। বুকে আঘাত লাগেনি তো আছাড় খাবার সময়? কথাটা হেমনাথকে বললে, তিনি জবাব দিলেন, আরে না, না! ডাক্তারেরা কি সেটা পরীক্ষা করেনি ভাবছ? আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। দেখেছি, রোগী পেট ব্যথা করছে বললে পিঠে স্টেথিসকোপ লাগাতেন! তবে বাবাকে লোকে বলে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একেলে ডাক্তারদের তুলনা হয়? খাঁয়ের বরাত। বাবার ভিটে ছেড়ে পালাতে চাইছে—ঈশ্বরের ইচ্ছে তা নয়।

প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সে যাক গে। লোকে তো এরই মধ্যে পাঁচ কথা গাইছে, এর পর আমরা দেখতে গেছি শুনে ঢি ঢি পড়ে যাবে দেখে নিয়ো।

হেমনাথ শুধু বললেন, না, না।

কিন্তু তাঁকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ভাবছিলেন, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হল। কিন্তু দেখতে না যাওয়াও তো ভালো দ্যাখায় না। বিবেক বলে একটা কথা আছে। যেমন কি না—ছেলেয়—ছেলেয় বিবাদ করল, দুই বাবার মধ্যে বিবাদ লাগল—এ হচ্ছে সেই রকম। খাঁ বা তার বউর সঙ্গে আমাদের বিবাদ কীসের? সুনু না গেলেই হল।

কিন্তু ক’দিন পরেই ধাক্কা খেলেন হেমনাথ। তারু চক্রবর্তীর ধানভানা কলের ওদিকে একটা কাজে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে একটু বসে এলেন। সেই সময় চক্রবর্তী এই ধাক্কাটা মেরে বসল। কী হে হেমচন্দর! বেয়ান কেমন আছে দেখলে?

হেমনাথ স্তম্ভিত। …বেয়ান কাকে বলছ?

চক্রবর্তী বললেন, আমি ভাই দু’কান কাটা মানুষ। আমার মুখেরও কোনো ঢাক গুড় গুড় নেই। শুনলুম, তুমি তোমার বউ ছেলে মেয়ে সব্বাই দু’বেলা হাসপাতালে ধরনা দিচ্ছ। টিফিন কেরিয়ারে খাবার যাচ্ছে। হুঁঃ…হুঁঃ…হুঁঃ! অদ্ভুত হাসেন তারু চক্রবর্তী।

হেমনাথ নিঃশব্দে উঠে এলেন। চক্রবর্তী তাঁর পয়সাওলা সতেজ খ্যানখেনে কণ্ঠস্বরে তখনও বলছেন, ওতে দোষ নেই হে। আজকাল বামুনের ছেলেরা মেম আনছে ঘরে। জলচল হচ্ছে সব। তার ওপর বেয়ানটি নাকি বেজায় সুন্দরী—হুঁঃ হুঁঃ হুঁ!

অস্থির হেমনাথ প্রভাকে কথাটা বললেন না বটে, সারারাত সেদিন ঘুমোতে পারলেন না। অনেক রাতে তাঁর মাথায় একটা প্রবল জেদ জাঁকিয়ে বসতে চাচ্ছিল। ….হ্যাঁ, যদি খালেকের মতো, নয়তো মুখুয্যেদের মতো পয়সা আমার থাকত—আমি এক্ষুনি তাই—ই করতুম। কলকাতা থেকে ব্যান্ডপার্টি আনতুম। ওমর মালাকারের বাজি পুড়ত সারারাত। কুসুমগঞ্জের কান ফাটিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে একাকার করে ফেলতুম। আমি হেমনাথ—আমি বুড়ো হয়েছি বলে কি একটুও ক্ষমতা নেই?

…তারপর রাত যত বাড়তে লাগল, হেমনাথ একটু করে সতর্ক হতে থাকলেন। আরে ছি ছি! কীসব ভাবছি! স্থিরবুদ্ধি বলে আমার সুনাম আছে। অথচ এমন আবোল তাবোল কথা মাথায় কেন আসছে? নাঃ, লোকে আমাকে পাগল করে ফেলবে দেখছি! তার চেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করা যাক।…

আর একদিন স্টেশনবাজারে রক্ষাকর চাটুয্যের সঙ্গে দেখা—প্রভাত মুখুয্যের শালা। বড় আড়ত আছে। টাকাপয়সাও আছে বিস্তর। সম্প্রতি ট্রান্সপোর্ট খুলেছে এখানে। কুসুমগঞ্জ রুটের নতুন বাসমোটর সেদিন সদ্য এসেছে গ্যারেজে। গাড়িটা কিনলে নাকি দাদু? হেমনাথ জিজ্ঞেস করেছিলেন। নাতির সম্পর্কেই আহ্বান করেন ওকে।

রক্ষাকর জবাব দিলে, হ্যাঁ। আপনার হাত দিয়েই আগে উদ্বোধনটা করে ফেলব ভেবেছি হেমদাদু।

হেমনাথ বুঝতে না পেরে বললেন, আমি তো নেতাফেতা নই ভায়া!

তা কেন? আমার কাকামশাইয়ের শুভকাজে বরযাত্রী যেতে হবে না? গাড়িটা প্রথম খেপে না হয় বরযাত্রীই বইবে।

একটু বুঝে হেমনাথ হেসে উঠলেন। …সুনুর কথা বলছ? আরে, আগে পাস করে বেরোক। চাকরি—বাকরি হোক। তারপর তো।

সুরসিক রক্ষাকর বিস্ময়ের ভান করে বলল, বা রে বা! তবে যে শুনলুম, এ মাসেই সব চুকে যাচ্ছে!

হেমনাথ ফের বোকা হয়ে গেলেন।…পাগল! কীসব উড়ো কথা শুনেছ!

হবে। তবে হতেই বা বাধা কীসের? আজকাল সবই চলছে। অসবর্ণে যদি আপত্তি না থাকে, তো ইয়ে—আরও এক পা বাড়িয়ে মুসলমানেই বা আপত্তি কি? সাতশো বছরের পড়শি।

হেমনাথ মুহূর্তে ফেটে পড়লেন। …রক্ষাকর, বাঁদরামির একটা সীমা আছে।

রক্ষাকর হাসতে থাকল। দাদু সবতাতেই রেগে যান। ধুৎ! ইয়ার্কিও বোঝেন না। ওরে অমলা, দাদুকে একটা কোকাকোলা দিয়ে যা। বসুন দাদু, বসুন।

হন হন করে হেমনাথ হাঁটতে থাকলেন। যদ্দূর গেলেন, পিছনে একদল মানুষের অট্টহাসি তাঁর কানে আসতে থাকল।

আফজল এই ঘোর বিপদের দিনে হেমনাথকে ফিরে পেয়ে মনে জোর পাচ্ছিলেন খুবই। নুরুর চিঠি এসে গেল। সেই হিন্দু ভদ্রলোকও এসে দেখা করে গেলেন। যশোরে বাড়ি তাঁর। তাঁর হাত দিয়েই টাকা পাঠিয়েছে নুরু। আফজল বললেন, ওয়াইফের অসুখ। প্লাস্টার এঁটে হাসপাতালে পড়ে আছেন! আপনি বরং সামনের মাসে আসুন। নুরুর কাছেই খবর পাবেন। আমিও নুরুকে খত লিখে সব জানাচ্ছি।

ভদ্রলোক বললেন, তা একটু দেখেশুনে যেতে চাই মিয়াসাব। বিনিময় যে হবে, আগে দেখাশোনা না হলে চলবে কেন?

আফজল ব্যস্ত হয়ে বললেন, মাফ করবেন ভাই। এখন আমার মাথার ঠিক নেই! ওয়াইফ হাসপাতালে। এখন কি ওসবের সময়? আপনিই বলুন!

হতাশ হয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। আফজল ছেলেকে চিঠিতে জানিয়ে দিলেন সব। কিন্তু যোগ করে দিলেন আরও একটি জরুরি এবং বাড়তি কথা। ….বাবা নুরু, তোমার মাজান আরোগ্য হইলে কপালে যদি খোদা লিখিয়া থাকেন, যাওয়া হইবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তুমি শীঘ্র শীঘ্র যেভাবে হোক, আসিয়া রুবিকে নিয়ে যাও। রুবির ভাবগতিক ভালো দেখি না। মা হাসপাতালে থাকায় আমার সন্দেহ, সে পুনরায় গোপনে সুনুর সহিত দেখাসাক্ষাৎ করিতেছে। এদিকে লোকের মুখে গঞ্জনা শুনে আমি পাগল হতে চলিয়াছি, অতএব বাবা নুরু…ইত্যাদি।

আফজল আগে সব চিঠিই রুবিকে দিয়েই লিখিয়েছেন। কেবল রুবি—সুনন্দ সম্পর্কে সাংঘাতিক প্রথম চিঠিটি তিনি নিজেই ওইরকম অনভ্যস্ত গদ্যে লিখেছিলেন। এবার লিখলেন এই চিঠিটি। লিখে নিজের হাতের লেখা ও বয়ানের প্রতি সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বাঃ, বেশ লেখা যায় তো! শুধু আলসেমি করে নিজের যেটুকু বিদ্যে ছিল জাহান্নামে দিয়ে বসেছিলুম।

এবং সেদিন অনেকটা সময় আফজলকে শুয়ে একটা পুরনো বই পড়তে দেখেছিল রুবি। বইটার নাম ‘বঙ্কিম দুহিতা’। লেখক একজন মুসলমান। রুবি বাবা বা তার দাদুর সংগ্রহে বা আছে, তা সবই পড়ে ফেলেছিল বলে, এই বইটার ইতিহাসও তার জানা। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ‘আয়েষা’ নামে মুসলিম নবাবনন্দিনীকে হিন্দু রাজপুত্রের প্রেমাকাঙ্ক্ষিনীরূপে চিত্রিত করেছিলেন তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে। এইতে এক মুসলিম লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর খেপে গিয়ে ওই উপন্যাসটি লিখে ফেলেন। এবং মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তাও পান। ওতে বঙ্কিম নামে এক ব্রাহ্মণের কন্যার সাথে এক মুসলিম যুবকের প্রণয় কাহিনি রয়েছে। গায়ের ঝাল অবশ্য যথেষ্টই হয়েছিল। রুবি সুনন্দ ঝুনু কবীর আরও অনেকে মিলে বইটা পড়েছিল। দোষগুণ আলোচনা করেছিল। কবীর বলেছিল, বিষয়টা মন্দ নয়—তবে লেখাটা বাজে। …মান্ধাতার আমলের ভাষা। সুনন্দর মতে—গল্পটা আসলে জমেইনি। ঝুনু কোনো মতামত দ্যায়নি—গুম হয়ে বসেছিল। আর রুবি চিমটি কেটে তার কানে কানে বলেছিল, বইটা নিয়ে যা। বুকে রেখে ঘুমোস। পরে একদিন ঝুনু ‘দুর্গেশনন্দিনী’ দিয়ে যায় রুবিকে। বলে, শোধ নিলুম। রুবি কিন্তু পড়ার পর ভয়ে আর লজ্জায় কতদিন মনমরা হয়ে থেকেছে। এই তো ক’মাস আগে এসব ঘটেছিল।

বইটা এতদিন পরে আফজল খুঁজে বের করে পড়ছেন দেখে সে অবাক হয়েছিল। বুড়োরা ওইসব সেকেলে বইগুলোকে ধর্মগ্রন্থের মতো পবিত্র মনে করে।

অবশ্য আফজল কিছু না ভেবেই পড়তে শুরু করেছিলেন বইটা—নিছক পড়ার খেয়ালে—চিঠি লেখার পর নিজের শিক্ষাদীক্ষার পর্যালোচনা ছাড়া সেটা অন্য কিছু নয়। কিন্তু যত পড়েন, খিক খিক করে আপন মনে হাসেন আর বলেন, বা রে! বেশ লিখেছে তো! লড়ে যাও বাবা!…ফের কিছুটা পড়েন আর বলে ওঠেন—বহুৎ আচ্ছা! …কখনও—ওরে ব্বাস!

একজন খাঁটি সমঝদার পাঠকের কাণ্ড। রুবি টের পাচ্ছিল। তার নতুন চপলতা সেই সময় তাকে একটা কথা বলতে সুড়সুড়ি দিল। এবং রুবি বলেও ফেলল, খুব ভালো বই বুঝি?

আফজল বই থেকে মুখ বের করে বললেন, জোর লিখেছে রে।

রুবি বলল, আব্বা, তুমি বঙ্কিমচন্দ্রের কোনো বই পড়েছ।

আফজল ফের বইতে চোখ রেখে বললেন, এটা শেষ করি। তা’পরে।

রুবি আর ‘দুর্গেশনন্দিনী’র কথাটা তুলল না। কিন্তু তার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল—’দুর্গেশনন্দিনী’ পড়ে বাবা কী বলেন জানতে। …

আফজলের এই নিশ্চিন্ত উপন্যাস পড়া, হাই তোলা, গড়িমসি ঢিলেঢালা ভাবটি ছিল এটা গভীর ভাবমুক্তির প্রকাশ। স্ত্রীর অস্বাস্থ্যের চেয়ে রুবিই তাঁর কাছে বড় সমস্যা। তিনি ভাবছিলেন রুবি চলে গেলেই আর ঝামেলা নেই। হেমনাথের সাথে তাঁর মিলমিশের কোনো বালাই থাকবে না। হেমনাথেরও অস্বস্তি থাকবে না। তারপর সাহানা সেরে উঠুক—তখন দেশত্যাগের কথাটা ফের ভাবা যাবে। নুরু বোনের দায়িত্ব নিলে আর সমস্যা কীসের? …শেষ অব্দি আফজল ভেবে ঠিক করলেন, পাকিস্তানে যাবেন না। নুরু রুবির বিয়ে লাগাক। তখন স্বামী স্ত্রী গিয়ে কাজটা চুকিয়ে ফিরে আসবেন কুসুমগঞ্জ। রুবি ঘর—সংসার করবে। কাচ্চাবাচ্চা হবে। মন্দ কি! তবে নুরু যদি ওকে আরও পড়াতে চায়—সেও উত্তম প্রস্তাব। সাহানা মেয়েকে ছেড়ে থাকতে না চায়, মাঝে মাঝে গিয়ে থাকবে। বর্ডার পেরোতে খুব একটা অসুবিধে নেই। কিংবা সাহানা যদি তাঁকে ছেড়েই বরাবর ওখানে থাকতে চায়, থাকবে। হ্যাঁ, তাতে কষ্ট হবে আফজলের। এই বয়সেও শয্যায় স্ত্রী না থাকলে তাঁকে বোবায় ধরে। তখন…

কথাটা খুলে হেমনাথকে একদিন বলে ফেললেন আফজল। শেষে রসিকতা করে বললেন, তবে কী জানো হে কায়েত, আমাদের ধর্মে সে ব্যবস্থাও করা আছে। আমাদের নবীসাহেবের ‘ছন্নত’ (হজরত মোহম্মদ যে কাজগুলো করেছেন, অথচ স্পষ্ট নির্দেশ নেই কোরানে—সেগুলো অনুসরণে নাম ছুন্নত।) মেনে চললেই হবে।

হেমনাথ কথাটা টের পেলেন—দীর্ঘকালের সাহচর্যে অনেক মুসলিম প্রথা বা প্রথাসিদ্ধ কৌতুক তাঁর পরিচিত। তিনি হো হো করে হেসে ফেললেন। …সে তো হাসির মা বুড়ি আছেই তোমার।

আফজল বললেন, তৌবা! এ আজরাইলের (মৃত্যুদূতের) অরুচি। তবে জানো হেম, হুজুর পয়গম্বরসায়েব অনেক গরিবগুরবো দুঃখিনীর শেষ বয়সের ব্যবস্থা করে রেখে গেছেন। তিনি নিজেও দয়া করে এক বৃদ্ধা স্ত্রীলোককে নিকাহ করেছিলেন। (জোর হেসে)…অবশ্যি, এ কম্ম করে ফেললে উটকো বিপদ ঘাড়ে এসে পড়বে। তখন তোমার সেবা সে করবে, না তুমি তার সেবা করবে, তাই দ্যাখো। হাঃ হাঃ হাঃ।

এই সব রসিকতায় হেমনাথও বেশ ভারমুক্ত হলেন। রুবি পাকিস্তানে চলে গেলে লোকের মুখে ছাই পড়বে। তিনিও বিরাট নিষ্কৃতি পাবেন। ব্রিজ থেকে ফেরার পথে তিনি আরও জোর দিয়ে বললেন, প্রস্তাবটা ভালো হে খাঁ। নুরু ওকে বরং কলেজে ভর্তি করে দিক। পাস করে বেরোলে তখন আর ভাবনা কীসের? ওখানে তো তোমাদেরই রাজত্ব—চাকরি পেতে অসুবিধে হবে না! তার ওপর এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে—চেহারা স্বাস্থ্যও ভালো। লুফে নেবে হে, দেখে নিয়ো।

আফজল বন্ধুর দিকে সগর্বে তাকালেন—আবছা অন্ধকার তখন। হয়তো হেমনাথের মুখটা তাঁর স্পষ্ট দেখে নেবার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তারপরই একটা অসচেতন দীর্ঘশ্বাস নামল আফজলের বুক থেকে। বললেন, হেম, ও চাকরি পাক না পাক, পড়াশোনা চুলোয় যাক, অন্তত তুমি তো বেঁচে যাবে ভাই। লোকে তোমাকে কীসব বলছে—টলছে, আমারও কানে আসে।

হেমনাথ বললেন, বলুক, বলতে দাও। অবস্থা হীন বলেই বলা সাজছে। হতুম যদি বড় ঘরের মানুষ—বলতে পারত? প্রভাত মুখুজ্যের ছোট ভাই এক মাদ্রাজি খ্রিস্টান মেয়েকে নাকি বিয়ে করেছে। কলকাতায় থাকে। মিলিটারি ডাক্তার। শুনেছ? গত পুজোয় বউকে নিয়ে দেশে এল। প্রভাতের বাড়ি কত ধূমধাম হল। গাড়ি করে ভায়ের বউকে নিয়ে প্রভাত নিজে ঘুরে বেড়াল। ওর বাড়ির ছেলেমেয়েরা কালকুট্টি মেমসাজা ছুঁড়িটাকে নিয়ে হেথাহোথা সবার সামনে ঘুরল। পিকনিক করল। তার বেলা? কী দর্প হে! যেন দেবরাজের কোনো অপ্সরা পেয়ে গেছে। আর …

আফজল ওঁকে থামতে দেখে তীব্র কৌতূহলে বললেন, আর?

হেম পরিতাপে মাথা নেড়ে বললেন, ছেড়ে দাও। আসলে হয়েছে কী জানো, দুশো বছর ধরে সায়েবরা দেশটা শাসন করে গেছে—’সভ্য’ করে দিয়েছে—নানান যন্তরমন্তর দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ওরা ছিল খ্রিস্টান। কাজেই বুঝতেই পারছ, অন্তত খাঁটি মেম না হোক, দিশি হলেও লোকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে—রাজার জাতের জাত মেরেছি। সায়েব হয়েছি। চাকরের মনোভাব। ধুর, ধুর!

আফজল টের পাচ্ছিলেন, হেমনাথ কী অনুক্ত রাখছেন। কিন্তু সেটা খুঁচিয়ে আর ঘা বিষিয়ে দিতে চাইলেন না। সকৌতুকে বললেন, পরম বোষ্টম হয়ে এ কী বুলি হে কায়েত! অ্যাঁ?

অপ্রতিভ হলেন না হেমনাথ। …তা যদি বলো, আমার ঠাকুর শ্রীচৈতন্যের কাছে ওসব জাতবেজাত বলে কিছু ছিল না। সবাই মানুষ—ঈশ্বরের জীব। তবে কী জানো, মানুষ বড় সংস্কারান্ধ হয়ে আছে। সমাজ মানেই তো সংস্কারের গিঁট। একসময় গায়ে জোর ছিল,—সব অস্বীকার করেছি। আজ তো তা নেই। নয়তো…

আফজল অসমাপ্ত বাক্যটা আর সমাপ্ত করতে দিলেন না। বললেন, মরুক গে। গঞ্জনা আমাকেও কম শুনতে হচ্ছে না। ঠাট্টার চোটে কান গরম হয়ে উঠেছে। লতীফ কাজীর একটখানি মৌলবি—মৌলবি ভাবসাব আছে। সেদিন কী বলছে জানো?

অন্যমনস্ক হেমনাথ বললেন, উঁ?

খ্যাল করে শোন। কথাটা ভারি মজার হে। আমি শালা একেবারে নিম—মোছলমান মাইরি! কথাটা জানতুম না।…আফজলের কণ্ঠস্বরে দূর অতীতের তুখোড় যুবকটি কথা বলছিল। …মুসলমানের সঙ্গে যদি কোনো অমুসলমানের বে হয়, আর সে যদি ‘আহলুল কেতাব’ বা গ্রন্থধারী ধর্মের লোক হয়, তাহলে তাকে কলমা পড়িয়ে মুসলমান না করলেও চলে। ‘আহলুল কেতাব’ কোন ধর্ম জানো? যাদের ওপর খোদাতালা কেতাব পাঠিয়েছেন—যেমন, খ্রিস্টান—ইহুদি। আমার ছেলেমেয়ে কোনো খ্রিস্টান বা ইহুদি বিয়ে করলে কারও নিজের ধর্ম ছাড়বার দরকার নেই। যে—যার ধর্ম মানবে আর ঘরসংসার করবে। বাচ্চা বিয়োবে। দিব্যি চলবে সব। লতীফ ঠাট্টা করে বললে, তোমার যে বড্ড মুশকিল খাঁসায়েব—ইয়ে—ওরা তো আহলুল কেতাব নয়। তা না হলে…

আফজল হা হা করে হেসে ফের বললেন, রাগ করিসনি কায়েত। আম্মো তামাশা করে বললুম, বা রে বা! সেটা কি কথা হল? আল্লার এতবড় দুনিয়া—তার মধ্যে এই ইন্ডিয়া। ভূমণ্ডলের ম্যাপখানা খুলে দ্যাখো দিকি কাজী সায়েব। এত বড় দেশটা—ছত্রিশ কোটি লোক বসবাস করে। সব জায়গায় সব জেতের কাছে খোদার কেতাব গেল, আর এখানে এল না—এ হতেই পারে না। আলবাত এয়েছে কেতাব। তা কাজী গুম হয়ে বললে, কী কেতাব এয়েছে শুনি? আমি বলে দিলুম, কেন? বেদ! বেদ এয়েছে। শুনে কাজী প্রথমটা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লে। কী রে হেম? কথাটা উড়িয়ে দিতে পারে কেউ?

হেমনাথ হেসে ফেললেন।

আফজল বললেন, শালাকে ধাঁধায় ফেলে দিলুম মাইরি। জবাব দিতে পারে না। আমি শালা খ’য়ে খচ্চর না খাঁয়ে খচ্চর—ইস্কুলে সব কী বলত মনে আছে তোর? নে—জবাব দে। তো খানিক গুম হয়ে থেকে গেছে কাজীর বাচ্চা যেন আশমান হাতড়ে কথা পয়দা করলে। হঠাৎ শালা লাফিয়ে উঠে বললে, ফজু (আফজলের ডাকনাম) আমি তোর মেয়ের বে পড়াব। ….জোর তামাশা জমে গেল। বুক ফুলিয়ে বললুম, আসিস। দাওৎ (নেমন্তন্ন) রইল। অমনি, মাইরি হেম, কসাইটা বুকে ছুড়ি চালিয়ে দিল হে।

হেমনাথ সকৌতুকে বললেন, কী করল?

আফজল নার্ভাস হেসে জবাব দিলেন, শুনবে? রাগ করোনা ভাই। আম্মো যখন রাগিনি, তুমিই বা রাগবে কেন? কাজী বললে, কিন্তু ওরা মোছলমানের মেয়ে নেবেই না। মুয়ে (মুখে) পেচ্ছাব করে দেবে!…উঃ! কী সাংঘাতিক কথা!

হেমনাথ অপ্রস্তুত। সতর্ক হলেন। দু’জনেই যেন একটা সীমা পেরিয়ে অসাবধানে লুকোচুরি খেলছিলেন। এটা সংগত ছিল না। গলা ঝেড়ে বললেন, ছেড়ে দে ভাই। মেয়ে তো চলেই যাচ্ছে। তখন আর এসব নিয়ে মাথাব্যথার কী লাভ?

আফজলও সতর্ক এদিকে। ভুল পায়ে অনেকখানি আসা গেছে। ফেরা দরকার। বললেন, হ্যাঁ—যা হয় না—হবে না, তা নিয়ে বকে লাভ নেই। একটু তামাশা করলুম আর কী! হ্যাঁ রে, আর খৈনি খাস নে?

নাঃ। কবে ছেড়েছি সব।

এমনি জানতে ইচ্ছে হল।

তুই একসময় তামাক খেতিস, ফজু।

আর ভাল্লাগে না।

হ্যাঁ, আবার কী! যৌবনটা গোল্লায় দিয়েছি দু’জনে। এখন ঈশ্বর সম্বল।

আফজল কতকটা নিজের মনেই বললেন, খোদা ভরসা।

মায়ের বুকে ব্যথাটা আরও বেড়ে গেছে। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। রুবি হাসপাতাল থেকে উদ্বিগ্নমুখে বাড়ি ফিরল সেই সন্ধ্যায়। ফিরেই অবাক হল সে। নুরুভাই এসে গেছে!

খুশিতে দুলে উঠল তার বুক। দৌড়ে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল নুরুর ওপর।…দাদা, কখন এলে? ইস, আমি এদিকে ভেবে সারা…

নুরু হেসে বলল, ফের দাদা বলছিস যে বুড়ি! এখনও ছাড়িসনি দেখছি।

রুবিকে সে বুড়ি বলেই ডাকে ছেলেবেলা থেকে। রুবি বলে দাদা। এজন্যে অনেক গালমন্দ খেতে হয়েছে—কিন্তু অভ্যাস ছাড়েনি। সে কান করল না এ প্রসঙ্গে। বলল, সত্যি তোমার কথা খুব ভাবছিলুম। মায়ের অবস্থা দেখে ভালো লাগছে না। এসে এত ভালো না করেছ। হাতমুখ ধোওয়া হয়েছে? ও হাসির মা, হাসির মা! শিগগির পানি দাও তো!…

রুবির ব্যস্ততা দেখে নুরু বলল, থাম। ব্যস্ত হোস নে। আগে তোর খবর বল।

আমার খবর আর কী! বেশ তো আছি।

নুরু একটু হাসল। …ঝুনুরা এ বাড়ি আসে না? তুই না—তুই একটা ক্ষুদে শয়তান বুড়ি। বুঝলি? তাক লাগিয়ে দিয়েছিস রে?

রুবি রাগ করে বলল, সে তো জানিই বাবা। এককথা ইনিয়ে—বিনিয়ে একশো করে লেখা হয়েছে। জেনেশুনেই তো এসেছি শাস্তিচাস্তি দিতে। দাও না। পাওনা যা—নিতেই হবে।

নুরু—আরও হেসে ফেলল। …জব্বর শাস্তি তোর পাওনা। বুঝলি? তবে সে সব হচ্ছে’খন। দেশের হালচাল কিছু বল। সব কে কেমন আছে—কে কী করছে।

রুবি জবাব না দিয়ে এক লাফে উঁচু বারান্দা থেকে নামল। হাসির মা জল তুলছিল ইঁদারা থেকে। বালতিটা কেড়ে নিয়ে বলল, কিছু খাবার—টাবার করো।

শুনে নুরু বলল, কিছু না। একেবারে ভাত খাব। কী রেঁধেছে হাসির মা? নাকি বুড়ি রেঁধেছে!

হাসির মা বলল, হুঁ, তাহলেই হয়েছে! ও বেলা ডালটা দেখতে বলে দোকান গেলুম লংকা আনতে—ফুরিয়ে গেছিল। আর তো বাবা গিন্নি নেই ঘরে যে কী আছে—না—আছে গেরস্থালিতে দেখবেন। তা, অম্মা! ফিরে এসে দেখি, মেয়ে ডাল পুড়িয়ে কালকুট্টি করে ফেলেছে।

রুবি ধমক দিল, এদিকে আলো দেখাও তো! গল্প পরে হবে।

নুরু বলল, কিন্তু বেশ তো গিন্নিপনা দেখাচ্ছে! নাঃ হাসির মা মিথ্যে বলছে।…

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলে সংসারটা উতরোল করে খুশির হাওয়া বয়ে চলে। তাতে রোজগেরে ছেলে। কত কী সব নিয়ে আসে। এবারও এনেছে। কাপড়—চোপড় স্নো—সাবান কত কী। চা খেতে খেতে নুরু হারিকেনের আলোয় সব বের করেছিল সুটকেস থেকে।

হঠাৎ রুবি অবাক হয়ে বলল, আমার শাড়ি কই? সালোয়ার উড়নি কে পরবে?

নুরু অপ্রস্তুত হেসে বলল, তুই পরবি। পরতে দোষ কীসের? আজকাল তো সবাই পরছে।

রুবি মুখ ঘুরিয়ে বলল, ধ্যুৎ। ও তুমি ভাবীর জন্যে রেখে দাও।

ভাবীটাবী হোক। তারপর তো। নুরু সকৌতুকে বলল।

আমি বাবা এসব মুসলমানি পোশাক পরব না!

দ্যাখ রুবি, যাই ভাব, যাই কর, তুই কিন্তু আসলে মুসলমান। সে শাড়িই পর, আর মেমসায়েবের মতো গাউনই পর…নুরু একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, । …যাকগে। হ্যাঁরে, এখন হাসপাতালে ঢুকতে দেবে? মাকে দেখে আসতুম। স্টাফ আগে যারা ছিল, তারাই আছে—না নতুন?

রুবি গম্ভীর হয়ে বলল, আগেরও আছে। নার্স রমাদি আছে। সিস্টার নতুন। চলো—আমিও সঙ্গে যাচ্ছি।

নুরু—লুঙি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরতে ব্যস্ত হল। জিনিসগুলো বিছানার ওপর ছড়ানো। রুবি গোছাতে গিয়ে গোছাল না। একঝুড়ি ফল এনেছে নুরু। রুবি বলল, এসব কে খাবে? মায়ের জন্যে তো?

নুরু বলল, মা মেয়ে দু’জনেই খাবে। কিছু নে। প্লাস্টিকের ঝুড়ি নেই?

আছে। …

দু’জনে বেরুতে যাচ্ছে, সেই সময় আফজল এলেন। পথেই খবরটা শুনেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসেছেন। …কই, নুরু কোথা? নুরু, অ নুরু!

ছেলে বাবার পায়ে ‘কদমবুসি’ করবার জন্য হেঁট হতেই আফজল তাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ….আজ আমার জান ফুলে একহাত হল বাবা! ওরে! আমি আর আমি নেই রে—জাহান্নামে জ্বলছি পুড়ছি। ওরে সবাই ভেবেছিল আমার কেউ নেই!

নুরু বাবার কাণ্ড দেখে অপ্রস্তুত হয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, ছিঃ কাঁদবেন না। কাঁদবেন কেন? আমি তো আছি।

অ রুবি, ভাইকে কী খাওয়ালি? কদ্দূর থেকে আসছে রে—সে কী এখানে? হ্যাঁ রে খোকা, দেশটা বেশ ভালো—না? এমন হারামি খচ্চরের বাস নেই—সুখে—স্বচ্ছন্দে আছে সব—না? এ কুসুমগঞ্জ কি জায়গা রে বাবা? শয়তানের গুয়ে ভর্তি। ছ্যাঃ ছ্যাঃ।

রুবি বলল, আব্বা আমরা হাসপাতাল যাচ্ছি।

অ। তা—তুই থাক। আমিই যাই। নুরু, চল, বাপব্যাটায় মিলে যাই। রুবি, আজ তো গোস্তটোস্ত নেই! কী দিবি নুরুকে? বুঝলি বাবা, তোর মা—ও গেছে—আম্মো খাওয়া—দাওয়া ভুলেছি! ডালভাত আলু করে খাচ্ছি! অ রুবি, আন্ডা পাড়েনি আজ?

রুবি বলল, সে তো দুপুরে হল।

তাই বুঝি! তাহলে হাসির মাকে বল, শেখপাড়া থেকে আন্ডা আসুক।

রুবি নিঃসঙ্কোচে বলল, আমার কাছে পয়সা নেই।

কেন? দুটো টাকা দিলুম যে সকালবেলা? সব শেষ!… আফজল হাসলেন। তুই যে তোর মায়ের চেয়েও এককাঠি সরেস রে! …বলে পকেটে হাত করলেন।

রুবি বললে, হিসেব নাও না! লিখে রেখেছি।

আফজল পকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে বললেন, নে। কম পড়ে তো ধারে আনবে’খন। রেতের বেলা আর টাকা ভাঙিয়ে কাজ নেই।

নুরু বলল, আব্বা, সুরেশবাবুর হাতে টাকা পাঠিয়ে ছিলুম দু’শো। পেয়েছেন তো?

আফজল সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, হুঁ। চল বাবা রাত হয়ে যাচ্ছে।

পেছন থেকে রুবি বলল, পেয়েছেন—খরচও করে ফেলেছেন। একগাদা করে ধার হয়েছিল লোকের। কদ্দিন ফেলে রাখবে তারা? অ্যাদ্দিন বাইরে বাইরে ছিলুম, টের পাইনি কিছু। এখন মা নেই ঘরে—সব জানতে পারছি। কী সংসার না চলছে!

হাসির মা সেই সুযোগে বলে দিল, শেখপাড়ায় ধারটার দেবে না রেতের বেলা। মাগিরা বড্ড কড়া বাপু। মু লষ্ট হবে মাত্তর!

আফজল চমকে উঠলেন। …খুব ধারি যে শেখদের!

নুরু বলল, রুবি—এই টাকাগুলো রাখ।

আফজল লোভার্ত চোখে তাকালেন মাত্র।

সে রাতে রুবির ঘুম আসছিল না। নুরুভাই সালোয়ার পাঞ্জাবি উড়নি কেন আনল, বুঝতে পারছিল না সে। গভীর অস্বস্তিতে ছটফট করছিল সে। বাইরের বারান্দায় ওরা বাপব্যাটা শুয়ে কথা বলছিল। দরজা বন্ধ থাকায় অস্পষ্টভাবে কানে আসছিল কথাগুলো। কিন্তু গরমে পচে মরলেও তো দরজা খুলে রাখার যো নেই। যুবতী মেয়ে। তার ওপর নানান গুজব। রুবিকেও তো আর বিশ্বাস করা যায় না।

কান পেতে রুবি টের পাচ্ছিল, বাইরে পরস্পর বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে চাপা স্বরে। এটা অবশ্য নতুন নয়। খরুচে স্বভাবের জন্যে নুরু বাবাকে চাকরির টাকা পাঠানোর পর থেকে বেশ গঞ্জনা দ্যায়। না—তার দোষ নেই। বেচারার পক্ষে কত টাকা পাঠানো সম্ভব? তার নিজের খরচ আছে সেখানে। এমন কিছু অঢেল মাইনে পায় না।

হ্যাঁ, সেই নিয়েই বচসা। রুবি অন্য কথা ভাবতে থাকল। ঝুনু ফাঁক পেলেই চুপিচুপি এবাড়ি আসে। কবীরও আসে। ওরা যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্রমশ। কিন্তু সুনুদার হল কী? ভারি গম্ভীর আর নির্লিপ্ত সে। জানালার দিকেও চোখ তুলে তাকায় না আর। প্রথম প্রথম রাগ হত, এখন কষ্ট হয়। দুঃখ লাগে। অভিমানে চোখ ফেটে আসে। কেন তুমি তাহলে আমাকে চুমু খেয়েছিলে? বুঝেছি, সব তোমার বদমাইশি। একটা হাবাগোবা মেয়েকে পেয়েছিলে, মজা লুটবে—তারপর গা বাঁচিয়ে নিরাপদে কেটে পড়বে। বিশ্বাসঘাতক! স্বার্থপর! আর তোমার কথা ভাবব না। ভাববই না।…..

কিন্তু স্মৃতি—স্মৃতি বড় দুশমন। স্মৃতি একহাতে বেহশত অন্যহাত জাহান্নামে। তার একহাতে জিব্রিলের মাটি—যা দিয়ে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন, অন্যহাতে ইস্রাফিলের শিঙা—যার আওয়াজে সৃষ্টি বিধ্বস্ত হয়।

কিংবা স্মৃতি নদনদীর মতো—মৃত্যুর সাগরগামী। এককুলে তাকিয়ে দেখি ভরে উঠেছে উর্বরতা—শস্যসম্ভার—সমৃদ্ধ জনপদ—কত ঐশ্বর্য। অন্যদিকে শুধু ভয়ঙ্কর ভাঙন। সব ভেঙেচুরে পড়ে গেছে।

রুবি স্মৃতির দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকে!…

হঠাৎ আফজলের কথা কানে এল রুবির। তাকে নিয়েই এবার কথা হচ্ছে। উঠে গিয়ে অন্ধকারে দরজার কপাটের ফাঁকে কান পাতল সে রুদ্ধশ্বাস।

….তোমার মায়ের কথা আবার কথা? ছেড়ে দাও। যা বলেছি, তাই করো বাপু। এসেছ যখন নিতে—নিয়েই যাও। মা সেরে উঠলে গিয়ে দেখে আসবেন। এর মধ্যে বলা যায় না—আজকালকার মেয়ে সব, কিছু বিশ্বাস নেই। কী করে বসলেই হল! ঠেকাচ্ছে কে? আমি হাজার তালে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চোখে—চোখে রাখবেই বা কে—আর রেখেই বা কী হবে? গাইবাছুরে ভাব থাকলে তোমার গে বনে গিয়ে দুধ দেবে। বুঝলে না কথাটা? এঁরা হিদুর ছেলে—বড্ড চালাক। মজা লুটে নিয়ে কেটে পড়বে। হেমকে আমি দেখেছি না? কত সর্বনাশ করেছে কতজনের। আরে বাবা, তুমি এখন লায়েক হয়েছ। তুমি ছেলেও বটো—দোস্তের সমানও বটো। হক কথা বলব—তাতে শরম কী? ওই হেম—বুঝেছ বাপ নুরু? হেম মোছলমানও কি বাদ দিয়েছে নাকি? ও পাড়ার সেই একচোখো পান্নার মাকে মনে আছে? সেই যে—সেই…লাইনে মাথা দিলে! মনে পড়ছে না? পড়বে না। তখন তোমার বয়েস আর কত? সাত কি আট। তা বুঝলে? কেন সোমত্ত মেয়ে লাইনে মাথা দিলে জানো?….আফজলের কণ্ঠস্বর আরও চাপা হল।….আজ হেম পরম হিঁদু বোষ্টম হয়েছে। বন্ধু মানুষ। সব পেটে রেখেছি বাবা। …মায়মুনা কানীর পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল। সে হেমকে শাসালে। সাতকুড়ি টাকা দাও—আর এটার ব্যবস্থা করে দাও। নয়তো ঢি ঢি ফেলে দোব। হেম করলে কী, চাকরি খোঁজার ছলে কলকাতা পালিয়ে রইল তিন মাস। মেয়েটা একদিন মনের দুঃখে…যাকগে। বলবে, জানের বন্ধুর খিটকেল করছি কেন। আরে বাবা, সাধে কি করছি?

নুরু বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ, চুপ করুন তো।

না বাবা। তোমার মায়ের কথা ধরো না। কবে সেরেটেরে বাড়ি আসবে—তারপর রুবি যাবে, সে একযুগের ব্যাপার। তুমি এসেছ কথামতো—আর দোনামোনা করো না। নিয়ে নাও। সেও বাঁচুক, আমরাও বাঁচি।

নুরু বলল, মাত্র তিনদিনের ভিসা। তারপর তো যেতে হচ্ছে। দেখা যাক—বরং মাকে বুঝিয়ে বলা যাবে। আমারও ইচ্ছে নেই যে রুবি এখানে আর একটি দিনও থাকে। স্টেশনে জয়নালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যা বলল, শুনে তো খুব ভয় হল। হিন্দুরা ঘোঁট পাকাচ্ছে নাকি। এদিকে আরেক কাণ্ড শুনে তো আরও ভয় পেলুম।

কী, কী, আবার কী শুনেছ?

ঝুনুর সঙ্গে নাকি কবীরকে জড়িয়ে কীসব হচ্ছে। নাকি আমাদের বাড়িতে এসবের ঘাঁটি!

আফজল চাপা গর্জে উঠলেন—সব তোমার ওই চৌধুরীর ব্যাটা আকবর করছে। এ আমি হলফ করে বলতে পারি। ওঃ! ওরে আমার চাঁদু! শেখের ঘরে আমি মেয়ে দোব ভেবেছ? আবার উলটে আমার খানদানকে ওই চৌধুরীর বউ মাগি কী বলে জানো? (মুখ ভেংচে বিকৃত স্বরে চৌধুরী— গিন্নিকে অনুকরণ করে)…হুঁ—ওনারা তো পাঠান। আমাদের চে’ও জেতে খাটো! মুয়ে ঝাঁটা মারবার লোক নেই গা? নিজের পাছার কাপড় তুলে দ্যাখ গে কুত্তীন মাগি কাঁহেকা।

নুরু বলল, আঃ ঘুমোন না। রাত হয়েছে।

হ্যাঁ, তুমি আবার অনেক দূর থেকে এয়েছ। পেরেসান (ক্লান্ত) ঘুমোও।

এক মিনিটের মধ্যেই আফজলের নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল। ….

রুবি টের পেল, তার গা চুইয়ে কাপড় ভিজেছে। তারপর পা গড়িয়ে ঘাম পড়েছে মেঝেয়। বুকে খিল ধরে গেছে। শরীর হয়েছে ভীষণ একটা বোঝা। অনেক কষ্টে সে সরে এল। বিছানায় বসল। তখনও থরথর করে কাঁপছিল সে।

আকাশ ফাটিয়ে কাঁদবার ইচ্ছে হল তার। পারল না। কাঁদা অসম্ভব। ত্রাস নয়, বিস্ময়—এবং দুঃখ নয়, ক্রোধ—অবশেষে তাকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। রি রি করে জ্বলতে লেগেছে সারা দেহ মন। অস্ফুট বেরিয়ে গেল তার কাঁপন্ত ঠোঁট থেকে—কুত্তার বাচ্চারা!