দশ
কতকগুলো মানুষ—অ্যাদ্দিন যারা একটা বৃহত্তর সমাজবৃত্তের মধ্যে ছোট ছোট কিছু অন্তরঙ্গতার বৃত্ত রচনা করে বাস করছিল, হঠাৎ দেখল কোত্থেকে ঝড় এসে সব ভাঙচুর হয়ে গেছে। তারা অসহায় বোধ করছিল এটা ঠিকই। কিন্তু তাদের কারও—কারও মনে হচ্ছিল, এ একরকম ভালোই হল। অভাবিত পরিণতি থেকে বাঁচা গেল। যে—পরিণতি হয়তো বা বড় ভয়ংকরই হতে পারত।
কিন্তু অভ্যাস!
বিকেলে হেমনাথ ছড়িটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন—রুবিদের বাড়ির পিছনে এক চিলতে সবজিখেতের বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ডেকে ফেলেছেন, কই হে খাঁ সাহেব?
পরক্ষণে বুকে পড়ছে আচমকা একটা ভারী হাতুড়ি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেছেন। যেন লজ্জায় কিংবা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কুমোর পাড়া ঘুরে মাঠ পেরিয়ে রেললাইনে গিয়ে উঠেছেন। ক্যানেলের ব্রিজে গিয়ে না বসলে বিক্ষুব্ধ বয়স্থ মনের শান্তি কোনোদিন মেলেনি। কিন্তু তার আগেই ব্রিজের রেলিং—এ কে বসে আছে ওই? সূর্যাস্ত দেখছে! ধূসর পাঞ্জাবি, টাকপড়া মাথা, লালচে মুখ ওই লোকটা!
উলটোদিকে চলে গেছেন হেমনাথ! বিড়বিড় করে গাল দিয়েছেন। আর কোথাও মরবার জায়গা পেল না ব্যাটা! স্টেশনের প্ল্যাটফরমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আপ—ডাউন দুটো ট্রেনের আসা—যাওয়া দেখা, কিছু চেনামুখের সঙ্গে হালকা দুটো কথাবার্তা, কামরার ভিতর নানা চেহারার মানুষকে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া—তারপর ঠিক যখন সূর্যাস্ত হচ্ছে, তখনই ওভারব্রিজে গিয়ে দাঁড়ানো—হেমলালের বিকেলের বেড়ানোটা এই সবেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু ওভারব্রিজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সারা ছেলেবেলা—পুরো কৈশোর—যৌবনের প্রান্ত অব্দি মনে ভেসে উঠেছে। প্রতি বিকেলটা তখন এমনি করে কেটেছিল তাঁর। সেই সব মোহময় দিন—যখন জীবনের অনেকখানিই স্পষ্ট বোঝা যায়নি এবং সেইসব আপ—ডাউন ট্রেনের আসা—যাওয়ার মধ্যে অনেক আশা—আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন—সাধের রঙিন সুতো বোনা হচ্ছিল। হয়তো বা ট্রেনের কামরার জানলায় একটি নারীর মুখই হয়ে উঠছিল সুন্দর কোনো সম্ভাবনার প্রতীক। সঙ্গী ছেলেটির গায়ে চিমটি কাটতেন হেমনাথ। সেও চিমটি কাটত। যে ট্রেন চলে যাবেই—তার জানালার ফ্রেমে আঁটা সুন্দরতম ছবিটি দিয়ে যেত হয়তো পৃথিবীর সকল যুবতীর জন্য অশেষ ভালোবাসা। এই দুটি ছেলে সেদিন কিন্তু একটুও ভাবতে বসেনি যে সে ছবি হিন্দু, না মুসলমান! তারা নিজেরাও হিন্দু না মুসলমান মনে রাখতে পারত না।
হেমনাথ ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে ভাবেন সেইদিনগুলো। তখন কি খুবই বোকা ছিলুম? তবে দ্যাখো, পৃথিবীর অনেক জিনিস কিংবা ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হিন্দুত্ব—মুসলমানত্ব পুরোটাই অদৃশ্য ও বিস্মৃত থেকে যায়।
এবং তখন মধ্যে মধ্যে হঠাৎ টের পান, তিনি খুব একা হয়ে গেছেন কুসুমগঞ্জে। এখানের কোনো মানুষের সাথে তো তাঁর তেমন কোনো অন্তরঙ্গতা কোনোদিনই ছিল না। ওই মুসলমানটা ছাড়া কারও সাথে তাঁর মনের মিল যেন হতে চাইত না। …হুম, এটা বদ অভ্যেস! গোড়া থেকে এটা হয়তো ভুল হয়েছিল। কারণ পৃথিবীটা তো ঠিক ততখানি সাদাসিদে নয়। তারু চক্রবর্তী, রত্নেশ আঢ্যি, কিংবা ভুবন দাসের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ওঠাবসা আছে নানা সূত্রে—সারাজীবনই আছে। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে তাদের কেউই হেমনাথ যেমনটি চান, তেমন নন। যেমন ধরা যাক, বিকেলের বেড়াতে আসার ব্যাপারটা। তারুবাবু ব্যস্ত লোক—গম পেষাই ধান ভানা কলের প্রাঙ্গণে বিকেলটা কাটিয়ে দেবেন পুরো। ইজিচেয়ারে বসে থাকবেন। খদ্দেরদের সাথে কথা বলবেন। ছেলে বারান্দায় বসে পয়সাকড়ির হিসেব রাখছে। তাতেও কড়া নজর। সে একদফা হিসেব করার পর উনি ডেকে বলবেন, কী রে? ক’ কিলো কত গ্রাম হয়েছে? তিন পয়সা দরে হচ্ছে তোমার গে…ইয়ে…
না—হেমনাথের চোখে আকাশ পৃথিবী ও জীবনকে দ্যাখেন না তারু চক্রবর্তী। ঠাট্টা করলে জবাব দেবেন—ভায়া হে, যদ্দিন আছি তদ্দিন এসব টুকটাক দেখাশোনা করে ছেলের আখেরটা গুছিয়ে দিয়ে যাই। যে কাল আসছে, কেউ তো তাকিয়েও দেখবে না বিপাকে পড়লে! তোমার তো এসব ঝক্কিও নেই—দায়ও নেই।…
হেমনাথ আহত হবেন মনে মনে। তা তো বটেই। হেমনাথের দারিদ্র্য আছে। কাজেই অবসর আছে। কাজেই বিকেল, সূর্যাস্ত, আকাশ কত কী দেখবার সুযোগ আছে। নেই কাজ তো খই ভাজ। হুম, তারু প্রকারান্তরে আমাকে অপমানই করে! ও পাক্কা বিষয়ী লোক। আর বিষয়ী লোকেদের প্রতি আমার বড্ড ঘেন্না হয়।
রত্নেশ আঢ্যি বাজারে তার দোকানের বারান্দা ছেড়ে নড়বেন না।
ভুবন দাশের একটু বেরোন অভ্যাস আছে মাঠের দিকে। কিন্তু পাল্লায় পড়া এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। সারা মাঠ জুড়ে যেখানে যেখানে ওর জমি আছে, বছরের সব সময়—দরকার থাক আর নাই থাক, সেগুলো দেখে বেড়ানোর জন্যেই তাঁর বিকেলে বেরোনো। গত দু’দিন তিনি ডেকে গেছেন। …চলো, হে, মাঠে ঘুরতে যাবে নাকি? …হেম জানেন। তাই এড়িয়ে থেকেছেন। আর ভুবন দাসও টের পেয়েছেন, হেমের সাথে খাঁয়ের আড়ি। কারণটা রটে গেছে ইতিমধ্যে। পল্লবিত হয়েছে মুখে মুখে। সে আরেক ঝামেলা। সবাই এসে মুখ টিপে হেসে যায়। কী শুনলাম মেজবাবু! বামন নাকি চাঁদে হাত বাড়িয়েছে। ঘোর কলি হে!
হেমনাথ একা হয়ে পড়েছেন। ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে মেজাজ খিচড়ে যায়। ওই মুসলমানটাকে তাঁর অস্তিত্ব থেকে মুছে ফেলা যায় না। সে স্মৃতির মধ্য থেকে হেঁড়ে গলায় বরাবার ডাকে, হেম, হেমনাথ!…
এদিকে আফজল খুব ব্যস্ত। নুরুর কাছে চিঠি গেছে। সম্পত্তি বিনিময় করা হবে। যত শিগগির সব ব্যবস্থা হয়, তত ভালো। ছেলেকে কিছু গোপন করেননি আফজল। লিখেছেন, আমার মান—ইজ্জতে বাজ পড়েছে বাবা। কী সাপের বাচ্চা ঘরে এনে পুষেছিলুম, দ্যাখো।…
সাহানা এ চিঠির বয়ান জানে না। জানলে ক্ষুব্ধ তো হতই। পোস্টাপিসের প্রাঙ্গণে বসে হাঁটুর ওপর কাগজ রেখে চোখের আড়ালে আফজল এ চিঠি লিখেছেন। খামে পুরে ডাকবাক্সে ফেলে স্বস্তি পেয়েছেন। নুরু এ চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে যাবে। তার অমন গুণের সৎমাই যে এ কুৎসিত কাণ্ডের পিছনে, সে জানতে পারবে। আফজল সব দোষ মা ও মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে ফেলেছেন চিঠিতে। ইচ্ছে করেই এ মিথ্যেটা বলতে হয়েছে ছেলেকে। তা না হলে শিক্ষিত বুদ্ধিমান বয়োপ্রাপ্ত ছেলে যদি রাগে বাপকেই শাস্তি দিয়ে বসে! তার চেয়ে বরং, যাক ল্যাঠা স্ত্রীলোকের ওপর দিয়ে। পরে ছেলেকে বুঝিয়ে দিলেই চলবে যে আউরত (স্ত্রীলোক) মাত্রই নির্বোধ। বুঝতেই তো পারছিস নুরু, কথায় বলে—ওরা নাক না থাকলে গু খেত। আফজল স্বভাবত একবার জোর হা হা হেসে দিলেই তখন সাহানা ও রুবির সাত খুন মাপ। নতুন করে জীবনটাকে আরম্ভ করা যাবে।
আফজল কাজে না হলেও বাইরে বাইরে ভীষণ ব্যস্ত। এবং সে ব্যস্ততা মনেও ঢুকেছে। মরীয়া হয়ে গেছেন কতকটা। হাজারবার স্ত্রীকে বলছেন, ছ্যা, ছ্যা! কুসুমগঞ্জ আবার একটা জায়গা! এখানে মানুষ থাকে নাকি? শুধু কুত্তার পাল। সব স্বার্থপর আর বেইমান। বেইসলামি চালচলন। শরিয়তের বালাই নেই। নামাজ পড়ে না। রোজা রাখে না। আদব—কায়দা জানে না। সব একেবারে হিঁদু হয়ে গেল গা! মতিয়ুলের ছেলে কবীর সেদিন আমাকে বলছে, নুরুদার খবর কি চাচাজি? অ্যাঁ—নুরুভাই নয়, নুরুদা! তুমি দেখে নিয়ো সানু, এপারের মুসলমান ভবিষ্যতে সব আধাহিন্দু হয়ে যাবে! রবিউদ্দীনের ছেলের নাম রেখেছে শুনেছ? গৌতম! মেয়ের নাম পুষ্প!…
সে এক ঝড় বইছিল আফজলের মুখে। সাহানা এবার কিন্তু হাসছিল না কৌতুকে বা রাগ করছিল না স্বামীর ওপর। মেনে নিচ্ছিল। অনেক ঠকে মিয়াসাবের আক্কেল এসেছে।
তার মানে—
হ্যাঁ, আফজল সাতদিন পেরিয়ে গেল, দাড়ি কাটেননি। মসজিদে গেছেন। বাড়িতেও নামাজ পড়ছেন। প্রতি ভোরবেলা সাহানাও এ বাড়িতে এই প্রথম কোরান পাঠ শুরু করেছে। চাপা ক্ষীণ সুরে প্রথম কয়েকটা দিন পড়েছে। দিনে দিনে আওয়াজটা আরও বেড়েছে।
প্রভাময়ী উচ্চকিত হয়ে পাঁচিলের ওপার থেকে শুনেছেন। হেমনাথ শুনেছেন। ঝর্ণা মুখ টিপে হেসেছে। ঝুনু গম্ভীর হয়ে থেকেছে।
তারপর প্রভাময়ীর পুজোআচ্চা বা ধর্মের দিকে ঝোঁকটা বেড়ে গেল। হেমনাথও ব্রাহ্মমুহূর্তে কিছুক্ষণ গুরুপ্রদত্ত রহস্যময় মন্ত্রটি জপ করার পর গীতা খুলে বসতে লাগলেন। ঝুনু হাসল। সুনন্দ আরও গম্ভীর হয়ে গেল মনে মনে আরও রেগে গেল।
আর রুবি!
সে স্থির। গম্ভীর। এবং নির্বিকারও। ছেলেবেলায় তাকে কিছুদিন আরবি উর্দু পড়ানোর চেষ্টা করেছিল সাহানা। আফজলের ঠাট্টাতেই সেটা সে সময় বেশিদূর গড়াতে পারেনি। কেবল পবিত্র কোরানের প্রথম দিকের কিছু অংশ মুখস্থ হয়েছিল মাত্র। তাকে নামাজও শিখিয়েছিলেন সাহানা। পরে গৃহকর্তার চালচলনের ফলাফলস্বরূপ ধর্মচর্চা এবং দৈনন্দিন পালনটুকুও আর দেখা যায়নি এ সংসারে।
এখন সাহানা রুবিকে বলছেন, খোদার দিকে মন রাখ মা। বুকে বল বাঁধ। তাঁকে বল মনে জোর দিতে।
মনে কি দুর্বল হয়ে পড়েছিল রুবি? সে এক প্রত্যুষে সাহানা যখন কোরান পাঠ করছে, তার নামাজ শেষ, হঠাৎ ‘অজু’ (বিধিমতে প্রক্ষালন) করে ঘরের মেঝেয় একটা আসন বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। অনভ্যাসে তার ভুল হচ্ছিল। ‘মোনাজাতে’ (যুক্তকর প্রার্থনায়) বসে যখন পাঠ করতে হয়—
‘হে খোদা, আমার ইহকাল ও পরকালের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো দাও’…
সে হু হু করে কেঁদে ফেলল হঠাৎ। এই শ্লোকটার মানে সে জানত। ‘…রব্বানা আতানা ফির দুনিয়া হাসানাতাও অ’ফিল আখেরাতে হাসনাতাও…..’
দুনিয়ার ‘হাসানাত’ অর্থাৎ ইহকালের শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর যা কিছু—আখেরাত বা পরকালের ‘হাসানাত’ যা কিছু—সবই চাইতে হয় ঈশ্বরের কাছে। প্রতিবার নামাজের শেষে এই প্রার্থনা করতে হয় মুসলমানকে।
রুবি কাঁদল। সাহানা কোরান পাঠের মধ্যেই টের পেলেন মেয়ে কাঁদছে। সাহানাও কাঁদল—পবিত্র—শ্লোকগুলো, যা ঈশ্বরের প্রেরিত বাণী—দূর আরবের হেরা পাহাড়ের নির্জন গুহায় পরম—মানুষটিকে যা দেবদূত জিব্রাইল শুনিয়েছিলেন,—তার উচ্চারণের সাথে গভীর অসহায়তার বেদনা গেল জড়িয়ে, আর বহুকাল পরে লিপিবদ্ধ সেই ঐশী বাণীসমূহের ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়ল এক সাধারণ বাঙালি মেয়ের কিছু অশ্রু…
আমি জানি না, ঈশ্বর সে মুহূর্তে কী ভাবছিলেন। তিনি বিভ্রান্ত বিমূঢ় মানুষের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন? নাকি সকৌতুকে হেসেছিলেন? কিংবা ব্যথিত হয়েছিলেন—যখন ঊষার আকাশে তখনও জ্বলজ্বল করছিল একটা নক্ষত্র, পাখিরা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছিল মাঠের দিকে, সারা প্রকৃতিজগতে সঞ্চারিত হচ্ছিল আবার একটা নূতন চেতনা?…’সঞ্চরমান দ্রুতগামী জ্যোতিষ্কপুঞ্জের শপথ, তোমাদের প্রতিপালক একজন আছেন….’ সাহানা তাঁকে বিশ্বাস করে কাঁদল।
হয়তো বা রুবিও বিশ্বাস করছিল। প্রার্থনা সম্পূর্ণ হল আরও একটি বাক্যে—’অ কি না আজাবন্নার’…এবং নরকের আগুন থেকে পরিত্রাণ করো। সে আগুনের বর্ণনাও রুবি শুনেছে। দুনিয়ার আগুনের চেয়ে আশি হাজার গুণ তীব্র সেই আগুন। অনন্তকাল তুমি যন্ত্রণায় ছটফট করবে।
রুবি যখন উঠল, তার মনে একটা প্রশ্নের আর্তি। কেন? সে কি খুব পাপ করে ফেলেছে? কবীর বলে, পাগল, পাগল! ঈশ্বর যদি কেউ থাকেনও, তিনি অত নিষ্ঠুর হবেন কেন, বুঝিনে। মানুষের যা সাজে, সৃষ্টিকর্তার তা সাজে না। কবীর তো মানেই না ঈশ্বর বলে কিছু আছে। মানে সুনন্দ। তবে তার ঈশ্বর একটু অন্যরকম। একদিন সে বলেছিল—একটা বই তোমাকে দেব রুবি, পড়ে দেখবে। বৈজ্ঞানিক জেমস জীনসের মিস্টিরিয়াস ইউনিভার্স। না—ইংরেজিতে নয় বাংলা অনুবাদ আছে। খুব ভালো লাগবে। জানতে পারবে, এ বিশ্বলোক জুড়ে যেন অঙ্কের নিয়মে কাজ করে চলেছে এক পরিব্যাপ্ত বা সর্বগত মন। জীনস অবশ্য বলেছেন, সে মন যেন পুরোটাই গণিতবিদের—গণিত ছাড়া আর তার কোনো অস্তিত্বই নেই। এদিকে রবীন্দ্রনাথের কথা ভেবে দ্যাখো। বিশ্বজুড়ে প্রাণপ্রবাহের লীলা তিনি লক্ষ্য করেছেন। ব্যক্ত ও অব্যক্ত সে লীলা। জড় ও অজড় সবখানে তার আভাস। হয়তো সেই ঈশ্বর। এদিক থেকে উপনিষদ আমাকে বেশ টানে। রুবি, তুমি পড়বে? পড়া ভালো। বুঝতে প্রথম প্রথম অসুবিধে হবে। পরে দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর, কোরানও আমার পড়া উচিত। বাংলা অনুবাদ কোথায় পাওয়া যাবে জানো? জানো না? তুমি ভারি নাস্তিক হয়ে গেছ রুবি। অবিকল একজন মানুষের প্রতিরূপ কোনো ঈশ্বরকে স্বীকার না করো, এই সর্বব্যাপী প্রাণের কেন্দ্রটিকে অস্বীকার করবে কেন?…
সম্ভবত ধর্মের কাজই এই। সময় হলে আত্মরক্ষার বিশাল আড়াল নিয়ে সে এগিয়ে আসে। আড়ালে ঢাকা পড়েছিল দুটি পরিবার। অস্তিত্বের মূল অব্দি ঠেসে জোর করে, হয়তো বা হাস্যকর ভাবেও, আড়ালটা পুঁতে দেওয়া হচ্ছিল। মেহের আলি পাগলার মতো চেঁচিয়ে সে বলছিল, তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়!
ধার্মিক হয়ে পড়ছিল দুটি পরিবার। এ বাড়ি সন্ধ্যাবেলা কথকতা—ভাগবতপাঠ—কীর্তন, তো ও বাড়ি পরের সন্ধ্যা ‘মিলাদশরিফ’। সংসারের ট্যাঁক থেকে কিছু পয়সাকড়ি খসছিলই।
কিন্তু অভ্যাস!
বিকেল হলেই আফজলের পা—দুটো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ভাবনা—বিভ্রান্তি—উদ্বেগ—প্রতীক্ষার জমাটবাঁধা ব্যস্ততা হঠাৎ মনে হয় বড় অকারণ। মুহূর্তে তা মিথ্যে করে তোলে কুসুমগঞ্জের ক্যানেলকাটা পশ্চিম মাঠের আকাশটা। সেই মাঠটা। ব্রিজটা। অভ্যাসে সেই উদাত্ত গম্ভীর শান্ত ছুটির আহ্বানটা ছুটে আসে। আফজল সাড়া দিতে চান, যা—ই—ই! পারেন না।
তারপর পারলেন।
বিকেলের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছিলেন! ব্রিজটা ফাঁকা। রেলিং—এ বসে থাকছিলেন। এত একা লাগে দুনিয়াটা! হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে লক্ষ্য করেছেন—রেললাইনের ধারে ধারে ওই একটা লম্বা ঢ্যাঙা শরীর, হাতাগুটনো সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি, হাতে ছড়ি—লোকটা আসছে! মুখ ঘুরিয়ে বসে থেকেছেন। এখানেই আসবে নাকি? ফের তাকালে অবাক হতে হয়। লোকটা ঘুরে যাচ্ছে উলটোদিকে। যেন এমনি হেঁটে বেড়াচ্ছে।
আফজল গজগজ করেছেন, এ জায়গাটা তো কারও বাপোতি সম্পত্তি নয়। রেলের। যার খুশি আসবে—বসবে। ওই তো ওপারে বসবার জায়গা রয়েছে। বসুক না যার খুশি! আমি তো কিনে নিইনি!
মাথায় আফজল একটা ছোট্ট আরবি টুপি পরেন আজকাল। টুপিটা একবার অকারণ খুলে ফের ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে পরেন। গরম লাগে বড্ড। তার ওপর অনভ্যাস। ফের খোলেন, হাঁটুর ওপর রাখেন, ফের পরেন। তারপর সূর্যাস্ত হয়ে গেলে নিচে ক্যানালে নেমে যায়। অজু করে উঠে আসেন। রেলিং চত্বরে নামাজে দাঁড়ান। হাঁটু দুমড়ে বসে দোওয়া পাঠের পর যখন ডাইনে—বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে দু’কাঁধের পাপপুণ্যের হিসাবরক্ষক দুই দেবদূত বা ফেরেশতার উদ্দেশ্যে ‘আসসালামু আলাইকুম…’ ইত্যাদি বলতে হয়, তখনই পিছনটা সুযোগমতো দেখে নেন আফজল। দূরে হেমনাথের মূর্তি। বিড়বিড় করে আরবি ভাষায় বলে ওঠেন আফজল, ‘হে খোদা, শয়তানের হাত থেকে পরিত্রাণ করো।’….
না—হেমনাথ স্বয়ং শয়তান নয়। শয়তান দু’জনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে।…
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে সাহানা দ্যাখে, আফজল উঠোনে পায়চারি করছেন। গুনগুন করে কী সুর ধরে আওড়াচ্ছেন। কতক্ষণ পরে বোঝা যায়, বাঙালি মুসলিম কবির কোনো গজল গাইছেন আফজল।
ঘুম না এলে মানুষটি বরাবর এই করতেন। চাপা গুনগুনিয়ে গাইতেন। কিন্তু সে তো এ গান নয়। সে ছিল নেহাৎ টপ্পা কী পাঁচালি, বড়জোর ভাটিয়ালি কী রেকর্ড সংগীত। সাহানার কানে এখনও ভাসে—
পরাণ আমার কাঁদে।
এমনি দিনে হারিয়েছিলাম আমার সোনার চাঁদে।
তখন এ গান শুনে অভিমান হয়েছে সাহানার। বুঝি মিয়া, বুঝি! তাতো কাঁদবেই। কাঁদতে কি মানা করছি? কাঁদো না সারা রাত্তির। আগের বউর জন্যে মিয়ার মনে এখনও তাহলে দুঃখুটুঃখু আছে? কপাল আমার, এত করেও মন পেলাম না গা লোকটার!
আজ সাহানা খুশি।
ওদিকে রুবি একদিন নামাজ পড়ে এবং কেঁদেকেটে—ব্যস! আগের মতোই রয়ে গেল। সাহানা ইদানীং মেয়েকে একটু মেনে চলতে চেষ্টা করছে। মন জুগিয়ে চলছে। পীড়াপীড়ি করে না কোনো ব্যাপারে। হেসেখেলে কথা বলে। আদর করে যখন তখন তার মনে তো গুরুতর ভয়—পাছে জেদের বশে অবুঝ গোঁয়ার মেয়ে ফের কী করে বসে! পেটের মেয়ে যখন চোখের আড়ালে লুকিয়ে অবাঞ্ছিতের সঙ্গে প্রেম করে এবং ধরা পড়ে যায়, তখন সব বুদ্ধিমতী মা তার মেয়েকে এই চোখেই দ্যাখে।
তাই সাহানা রুবিকে ধর্মের ব্যাপারে আর চাপ দেয়নি।
আর রুবি আরও গম্ভীর হয়েছে। নির্বিকার হয়েছে। চুপচাপ বসে থাকে। কখনও পুরনো বই বা মাসিক পত্রিকা পড়ে। শুয়ে থাকে চুপচাপ এবং ঘুমোয়। অগাধ ঘুম।
জানলার বাইরে কদাচিৎ দেখা যায় সুন্দরকে। গাইগোরুটা নিয়ে এসে বেঁধে দিল। নিভা গোয়ালিনি দুধ দুইতে এসেছে। সুনন্দ বাছুর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রমবালকের মতো। উড়ুক্কু বড়বড় রুক্ষু চুল, খাড়া নাক, কোটরগত কালো চোখজোড়া, মোটা ঘাড়—গ্রিক ভাস্কর্যের চেহারা। খালি গা, পরনে পাজামা খালি পা। বুকে নীলচে কিছু লোম।
পরস্পর একবার চোখাচোখি—তারপর অন্যদিকে তাকায় ওরা! রুবি বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। একটা অসহ্য অস্বস্তি তাকে অস্থির করে কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
ওখানে নিভা চ্যাঁচায়—এট্টু টেনে ধরো না বাবা। গুঁতো মেরে আমার কোমরটা ভেঙে দিলে দেখছ না?
সুনন্দ অন্যমনস্ক। রুবিরা কি তার জন্যেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে? নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয় তার। নুরুই বা কী ভাববে! সুনন্দর জন্যে তার বোন নিরাপদ বোধ করছিল না? ছি, ছি, এটা তার মোটেও উচিত হয়নি।…
আরেক দিকে কবীর আর ঝর্ণার মাঝখানেও এসে দাঁড়িয়েছে একটা হঠকারী নির্বোধ সীমান্তরেখা। নিজেদেরই তৈরি।
পরস্পর দেখা হচ্ছে—কিন্তু কথা বলা নয়, গাম্ভীর্য। রেলস্টেশনের রেস্তোরাঁয় ঝর্ণা যায়—বান্ধবীদের সাথে। কবীর যায় না।
এমনকি কবীর সুনন্দকেও কথা বলে না। এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। সুনন্দকে নিয়ে বন্ধূরা সবাই যখন রুবির কথা তুলে হাসাহাসি করে, কবীর রেগে ওঠে। তার মনে হয়, রুবি হিন্দু হলে হয়তো এতখানি হইচই করত না কেউ। কিন্তু কেন হাসে ওরা? রুবি মুসলমান বলে? রুবির কি কোনো যোগ্যতাই নেই সুনন্দকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কামনা করার মতো? সবচেয়ে রাগ হয়, যখন কবীর দ্যাখে আকবরটাও এ নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করছে। এমনকি কবীরকেও খোঁচা দেয় আকবর—কী হে বৈজ্ঞানিক! বিষণ্ণ কেন? একা বসে কী করছ চলো, পিকনিক করে আসি একদিন!
আকবর হো হো করে হাসে। …কবীর, আর মুরগি খাওয়াবিনে আমাদের? ঝিমুনি লেগে সব পটল তুলেছে দরমায়? অ্যাঁ?
কবীর সরে যায়। হনহন করে গেট পেরিয়ে গিয়ে নদীর ধারে বাঁধের ওপর বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
সেই সময় একদিন হঠাৎ ঝুনু এসে পড়ল—মানে, যেন সোজা বাঁধ ধরে কোথাও যাচ্ছে, এমনি গতি। কবীরের পাশ দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই কবীর ডাকল, ঝুনু!
ঝুনু যেন শুনতেই পেল না। হাঁটতে থাকল।
কবীর ফের ডাকল, ঝুনু, শোন।
ঝুনু দাঁড়াল। মুখ ফেরাল না। বলল, বলো—সময় কম।
কবীর একটু এগোল। এদিক—ওদিক তাকিয়ে নিল দ্রুত। তারপর বলল, ইয়ে—ঝুনু, তুমি রাগ করোনি তো আমার ওপর?
ঝুনু গম্ভীর হয়ে ভ্রূ—কুঁচকে তাকাল। …কেন?
আর যে কথা বলো না দেখা হলে?
(আরও গম্ভীর হয়ে) সে তো তুমিও বলো না।
বলি না—কিন্তু…তুমি ভয় পাওনি তো ঝুনু?
তুমি পেয়েছ বুঝি?
হয়তো।
তাহলে আমিও হয়তো। ব্যস, আর কিছু কথা আছে?
কবীর মাথা দোলাল—না। মানে, ব্যাপারটা খারাপ লাগছে কিনা—তাই…
খারাপ তো আমারও লাগছে।
মুশকিল হচ্ছে—আমি মু—মুসলমান, পার্টিসনের পরে…
ঝর্ণা বলে উঠল, এই! তোমার বুকে শুঁয়োপোকা!
কবীর লাফিয়ে উঠে বুক ঝাড়তে থাকল। তার ব্যস্ততাটা অসামান্য দেখাচ্ছিল। এবং ঠিক তখনই হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠল আগের দিনের ঝুনু। ….ইস! এত বোকা—হাবা—বুদ্ধু আর ভীতু হবে কি না সায়েনটিস্ট! কী খোকা, ছায়েনতিত হবে? উঁ? ডুডুবাটু খাও গিয়ে!
কবীর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, এসো। ওখানটায় বসা যাক। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। অ—নে—ক। উঃ, কী দিন না যাচ্ছিল আমার—ভাবা যায় না!
ঝুনু হাসতে হাসতে বটগাছের পিছনে একটা মোটা শেকড়ের ওপর বসল।
ক’দিন পরে খিড়কির ঘাটে হঠাৎ আছাড় খেল সাহানা।
পাশাপাশি দুটো ঘাট। একই পাড়ে—মধ্যে বড় জোর মিটার দশের ব্যবধান। ঘন স্থলকলমীর ঝোপ জলের ধার ঘেঁষে গজিয়েছে সমান্তরাল। তার মধ্যে একচিলতে পথে আগে দু’ বাড়ির যাওয়া—আসা চলত। তবে একঘাটে বসলে অন্য ঘাটটা পুরো দেখা যেত না। স্থলকলমীর ফিকে বেগুনি বড় বড় ফুল, চওড়া পাতা, ছড়ানো ডাঁটা—একটা আড়াল তৈরি করেছিল। ছোট্ট পুকুর—মালিক তার হেমনাথ। খরার সময় জল কমে যায় একেবারে। মাছের চাষ করা হত আগে। কিন্তু খরার সময় পর পর ক’বছর মাছ চুরি হয়ে যাওয়ায় হেমনাথ উত্যক্ত হয়ে জটিল বাগদিকে ভাগে দিয়েছিলেন। জটিল সেই থেকে খরচ খরচা করে খরার সময় ওদিকের বড় দিঘি থেকে জল আনিয়ে ভরে রাখে পুকুরটা। রাতবিরেতে ঘুরে যায়। মাছ ধরলে হেমনাথ তাঁর ভাগটা পান এবং সেই ভাগ থেকে খাঁয়ের বাড়ি স্বভাবত কিছু যায়। ওদিকে বিবেচক জটিলও খাঁসায়েবকে ডেকে দিয়ে যায় একটা আধসেরী পোনা। তবে কি না মাছে খাঁয়ের খুব একটা আসক্তি নেই।
সকালে জটিল মাছ ধরেছিল। খিড়কির দরজায় উঁকি মেরে সসম্ভ্রমে বলেছিল, কই গো মা জননী, রইল।
সাহানা গম্ভীর মুখে হাসির মাকে বলেছিল, দ্যাখো তো। চিলে ছোঁ দেবে।
হাসির মা লাফাতে লাফাতে মাছটা এনেছিল। এটাই তার দস্তুর। প্রায় তিনপো’টাক একটা মিরগেল মাছ। সাহানা বলেছিল, ওটা তুমি নিয়ে যেয়ো হাসির মা। আজ দু’বেলাই তো গোস্ত হচ্ছে।
কথাটা সত্য মিথ্যে যাই হোক, হাসির মা খুশি। সবতাতে তলিয়ে কিছু ভাবে না সে। কিন্তু সাহানা সেই মুহূর্তে অভ্যাসবশে আরও একটা আশা করেছিল। মেজবাবু কী করেন দেখা যাক। বেলা গড়াল। মেজবাবুর বাড়ির মাছ এল না। সাহানা আরও গম্ভীর হল। ঝাল ঝাড়তে থাকল নানা ভাবে। কারণে—অকারণে হাসির মা গাল খেল। মাঝে মাঝে এটা ওটা সশব্দে নাড়াচাড়ার মধ্যে ঝালটা খুব বেশি আত্মপ্রকাশ করছিল। রুবি সারাক্ষণ মুখ টিপে হাসল। কিন্তু সেও শেষ অব্দি দুঃখ পেল। যা কিছু হোক, যত সামান্য হোক, পেতে পেতে একদিন অভ্যাসের বশে তার ওপর যেন একটা গভীর দাবি তৈরি হয়ে যায়। তাতে ছেদ পড়লে রাগ দুঃখ ঝাল তো স্বাভাবিকই। আঃ, ভাবতে কী লাগে! এক সময় ফ্রকপরা রুবি হাফপ্যান্ট পরা সুনন্দর দ্যাখাদেখি ওই পুকুরের পাঁকভরা জলে মাছ ধরেছে খরার সময়। পাঁকে বিচিত্র হয়ে গেছে ওরা। দুই খিড়কির দুটি ঘাটে দাঁড়িয়ে দু’বাড়ির দু’জন মা হেসেছে আর ধমক দিয়েছে ছেলেমেয়েদের। সুনন্দর হাত ফসকে আসা একটা বড় জাতের পুঁটিমাছ ধরতে পেরে রুবির একদিন কী আনন্দ!
মাছ এল না দুপুর অব্দি। আফজল বাড়ি ফিরে জটিলের মাছ দেওয়ার কথা শুনেছিলেন। লাফিয়ে উঠেছিলেন, কই, দেখি, দেখি! কিন্তু সাহানার ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন। তারপর হেমনাথের মাছের কথা জানতে তাঁর তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু কোনো অছিলাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। একবার ভাবছিলেন—তা কি হয়? হেম এত ছোট নয়। মাছ নিশ্চয় পাঠিয়েছে। হয়তো ওবেলা পাতে দেখতে পাবেন। আবার ভাবছিলেন, না—পাঠায়নি। হেম খুব গোঁড়া মানুষ। বড্ড জেদি। মাছ নিজে বা তার বউ খায় না আর। তবে ওর ছেলেমেয়েরা খায়। বাকি মাছ বেচে দ্যায় জটিলকেই। এবার হেম মাছ পাঠাবে কোন মুখে? তাছাড়া তার চক্ষুলজ্জা বা লোকভীতিও আছে তো!
তবে কী, ব্যাপারটা বড্ড খারাপ দ্যাখায়, এই যা। আফজল মনের কৌতূহল মনেই শেষ অব্দি নষ্ট করতে বাধ্য হলেন। কারণ, সতর্ক চোখে রান্নাশাল থেকে আস্তাকুঁড় অব্দি ঠাহর করেও মাছের আঁশটি দেখা গেল না। হেমের ওপর তাঁর তীব্র ঘৃণা হচ্ছিল। তিনি দলিজ ঘরে একটু গড়াবার চেষ্টা করে বেরিয়ে পড়েছিলেন বাজারে মকবুল দরজির কাছে। তারপর তো ক্যানালের রেলব্রিজ আছেই। ওটা তো কারও নিজের সম্পত্তি নয়—খোদ রেল সরকারের।
এবং সেই দুপুরেই ঘাটে আছাড় খেল সাহানা বেগম।
কোনো কারণ ছিল না ঘাটে যাবার। সেই কাণ্ডের দিন থেকে নিজে বা মেয়েকে পা বাড়াতে দ্যায়নি। হাসির মাকেও দ্যায়নি। বলেছে, ধোওয়া পাখলানো যা করার, ইঁদারার পানিতে করবে। পরের পানির ট্যাকসো লাগে।…হাসির মা বুড়ো মানুষ। তার কষ্ট হচ্ছে ইঁদারার জল তুলতে। সে গজগজ করে। গতিক দেখে রুবি এসে জল তুলে দ্যায় কখনও।
কিন্তু আজ সাহানার মনে যেন মাছের আঁশটে গন্ধ। কী খেয়াল হয়েছিল—খিড়কির দরজা খুলে ঘাটে গিয়ে হাজির হল সে। জালের চিহ্ন দেখতে পাড়ের মাটিতে? দামগুলো ভাংচুর হয়েছে কতখানি—বালিকার মতো তাই কি অবলোকন করতে? অবশ্য দুঃখের সময় এখানে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে সে। কতসব চিহ্ন তখন জলের ধারে, ঘাটের ওপর, স্থলকলমীর বিস্রস্ত ঝোপঝাড়ে। সরু মোটা গুগলি আর পচাপাতা মেশানো চাপ চাপ পাঁক এখানে ওখানে। ঘাটের ওপরেই জাল ঝেড়েছে জটিল। ভিজে আছে দরজা অব্দি। এক পা পাড়িয়ে উঁকি মেরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়েছিল স্থলকলমীর ঝোপ চিরে পাঁচিলের গাঘেঁষা সরু চলাচল পথটির ওপর। চোখ জ্বলে উঠেছিল মুহূর্তেই। ওটা কী? কেন দিল ওটা? কে দিল?
পথের ওপর একটা শুকনো কাঁটাঝোপ পড়ে রয়েছে। তার মানে পথটা কাঁটা দিয়ে আটকানো হয়েছে।
বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাগে দুঃখে ঘৃণায় অস্থির হচ্ছিল সাহানা। আর সেই অস্থিরতার মধ্যে ফের একটা পা ফেলতে পিছল মাটিতে সে আছাড় খেল সশব্দে। ককিয়ে উঠল ‘মা গো’ বলে।
প্রভাময়ী ঘাট থেকে উঠে যাচ্ছিল। আওয়াজটা শুনেছিল সে। সরু পথের ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে দেখল, মিয়া বউ আছাড় খেয়েছে। পা ছড়িয়ে বসে আছে বিকৃতমুখে। নিষ্পলক একটুখানি দেখে নিতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ল পরস্পর। কিন্তু কেউ কাকেও এ জন্মে চেনে না। দু’জনেই যেন অন্ধ মানুষ। প্রভা দ্রুত বাড়ি ঢুকে পড়ল।
এ বাড়ি রুবি তখন একা। সদ্য স্নান করে ঘরে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। হাসির মা ভাত নিয়ে কখন চলে গেছে।
কতক্ষণ পরে সে বেরোল। ডাকল, মা!
কোনো সাড়া পেল না। তখন সে পাশের ঘর—শেষে রান্নাঘরও দেখল। তারপর চোখ পড়ল খিড়কির দরজাটা খোলা। সে ভাবল তাহলে ঘাটের দিকে গেছে সাহানা। তার ওখানে পা বাড়ানো বারণ, সে এখন কি না অসূর্ষম্পশ্যা! মনের রাগেই রুবি অসূর্যম্পশ্যা হয়ে থাকতে চায়। তার মা যদি মাথা ভেঙেও বলে একবার বাড়ির বাইরে যেতে—রুবি যেন পণ করে বসে আছে—এক পাও নড়বে না এ বাড়ি থেকে। আসলে এ একটা দারুণতম অভিমান। তা হোক, রুবি সে অভিমানের মধ্যে তো সুখও পাচ্ছে।
রুবি ফিরে এল নিজের ঘরে। জানালার ধারে বসল।
ও বাড়ি প্রভা কিছুক্ষণ আপনমনে খিলখিল করে হেসেছে। কাকেও আছাড় খেতে দেখলে মানুষের হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। তার ওপর মিয়া বউ অমন মুটকি মেয়ে—থলথলে গা গতর। ঝুনু বলল, হাসছ কেন মা?
হাসছি। প্রভা জবাব দিল।
বারে! মিছেমিছি হাসে কেউ?
প্রভা রমণীসুলভ চপলতায় চাপা গলায় বলল, ও বাড়ির বিবি…বুঝলি? ঘাটের ধারে…যেই না …হাসিতে ভেঙে পড়ছিল প্রভা।…ধপাস করে আছাড়!…মা গো, কী কাণ্ড!
ঝুনু লাফিয়ে উঠল।…মাসিমা আছাড় খেয়েছে?
তুই যাচ্ছিস কোথা? এই ঝুনু!…চাপা ডাক দিল প্রভা।…যে আছাড় খেল—খেল, তোর তাতে কাজ কী? ঝুনু! ভালো হবে না বলছি!
ঝুনু একদৌড়ে বেরিয়ে দেখল, সাহানা তখনও বিকৃতমুখে পা ছড়িয়ে বসে আছে। একটু—একটু ককাচ্ছে। জোর লেগেছে বোঝা যায়। উঠতে পারছে না সম্ভবত।
ঝুনু মুশকিলে পড়ে গেল। এও এরকম বিদ্রোহিতা—নিয়মভঙ্গের দুঃসাহস। কিন্তু ওই কাঁটাটা কে দিল? হয়তো বা সে কথা বলে উঠল, দৌড়ে যেতও—অন্তত এটুকু সে পারতও—কিন্তু হঠাৎ কাঁটাঝোপটা চোখে পড়ামাত্র তার বুকের ভিতরটা খিল ধরে গেল যেন। একটা চকিত শিহরন খেলে গেল তার শরীরে। বিস্ময়ে দুঃখে সে হতবাক হয়ে পড়ল!
এবং সেই সময় আচমকা প্রভা এসে তার হাত ধরে নিয়ে গেল। ঝুনু হয়তো যেত না—কিন্তু তখন সে হতচকিত—কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
বাড়ির ভিতর গিয়ে ঝুনু আর নিজেকে চুপচাপ রাখতে পারল না। বলে উঠল, এইজন্যে তুমি হাসছ মা? ছিঃ! বেচারা পড়ে গেছে—হয়তো কোমর ভেঙে গেছে—আর তুমি…ধিক তোমাকে।
প্রভা রেগে লাল হয়ে গেল।…থাম তো! কলেজেপড়া বিদ্যে ফলাতে হবে না।
ঝুনু সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
প্রভা ডাকছিল, ঝুনু ঝুনু! এই হতচ্ছাড়ি মেয়ে! ভালো হবে না বলছি! হেমনাথ ঝিমোচ্ছিলেন প্রাঙ্গণের নিমগাছটার তলায়। খালি গা। একটা মোড়ায় বসে অকারণে গামছা দোলাচ্ছিলেন—যেন বাতাস লাগবে হাতপাখার মতো। যা গরম পড়তে শুরু করেছে এরি মধ্যে! ঝুনুকে দেখে বললেন, তোদের ছুটি কবে পড়ছে রে ঝুনু? এবং তক্ষুনি মনে পড়ে গেল, গ্রীষ্মের ছুটি তো আজ থেকেই। সুনু বলছিল না?
ঝুনু কোনো জবাব দিল না। দৌড়ে চলে গেল ওদিকে। হেমনাথ একটু বিস্মিত হলেন। সেই সময় প্রভা এসে গেল। হেমনাথ বললেন, ঝুনু অমন করে কোথায় গেল গা?
প্রভার মুখটা গুম।….
ওদিকে রুবি এতদিন পরে ঝুনুকে দেখে চমকে উঠেছে। ঝুনু জানালার সামনে আসামাত্র রুবির ঠোঁটটা কুঁচকে গেছে—সব্যঙ্গ হাসিতে। …কী রে? জাত যাবে যে! আবার কেন? মাথায় গঙ্গাজল ঢালা যাবে না? মাথাটা ন্যাড়া করে ঘোল ঢালতে হবে না?
ঝুনু ধমকে উঠল, মেলা ফ্যাঁচ—ফ্যাঁচ করিসনে। মাসিমা…
মাসিমা আবার কে তোর? ভাগ! গোবর খাইয়ে দেবে।
ঝুনু রেগে খেপে গিয়ে বলল, মর ছাই! কথাটাতো শুনবি, খিড়কির ওদিকে মাসিমা পড়ে গেছেন—শিগগির যা।
এবার রুবি লাফিয়ে উঠল।…মা পড়ে গেছে?
হ্যাঁ—উঠতে পারছেন না। কোমরে লেগেছে। ঝুনু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল।
রুবি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। …তা আমার মা পড়েছে, বেশ করেছে। তোর কী এত? এত হাঁফাচ্ছিস কেন তুই?
ঝুনু আরও রাগতে গিয়ে হেসে ফেলল। …কী রে তুই! এখনও বাচ্চা মেয়ের মতো ঝগড়া করতে পারছিস! যা না শিগগির! বেচারা কঁকাচ্ছে ওদিকে।
রুবি অনেক কষ্টে হাসি চাপল। …আমার মা পড়েছে—আমার মায়ের কোমর ভাঙুক। সে কারও দেখতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে গে। ভাগ!
যা বাবা! বিপদের খবর নিয়ে এলুম—আর চোখরাঙানি!
তুই আসিসনে কক্ষনো। আমারও জাত আছে না? প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না?
করছিস তো বাবা।
বেশ করছি!
আরে, শিগগির যা!
যাব না। মা মরুক! যেমন সাধ করে গেছে ওদিকে—যেন বাবার সম্পত্তি আছে! না দেখলে চলছিল না।
ঝুনু হঠাৎ একটু ঝুঁকে এল। …এই রুবি, সুনুদা আজ তোর কথা জিগ্যেস করছিল। কিছু বলবি ওকে? চোখের দিব্যি, সুনুদা ঘুমোয় না সারারাত্তির।
রুবি চোখ পাকিয়ে বলল, কুটনিগিরি করতে হবে না তোকে। পালা!
ঝুনু হাসল। …শুদ্ধভাষায় বল। অপমান করছিস কেন? বৃন্দে দূতী বল। আরে! যা শিগগির!
রুবি ধীরে সুস্থে পা বাড়াল।
ঝুনু তখনও জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ডাকল, রুবি—একটা কথা শুনছি। তোরা কি সত্যি চলে যাচ্ছিস পাকিস্তান?
রুবি, ‘যাবোই তো…যাব না কেন’ বলে চলে গেল। আস্তে আস্তে হেঁটে উঠোন পেরোল। তারপর খিড়কির দরজা পেরোতেই দেখল, সাহানা ওঠবার চেষ্টা করছে।
রুবিকে দেখে সে এতক্ষণে হিঁপিয়ে কেঁদে উঠল। …তোরা আছিস না মরেছিস রে বাছা! উহুহু, আমি এখানে মরে পড়ে থাকলেও তোদের হুঁশ হত না! লাশটা শ্যালশকুনের পেটে যেত মা গো!
রুবি মাকে টেনে তুলতে তুলতে বলল, থাক। আর আকাশ মাথায় করো না। লোকে হাসবে। মুসলমানের মেয়ে হয়ে এত বাড় কেন?
সাহানা অনেক কষ্টে মেয়েকে ভর করে পা বাড়াল। বলল, হাসবে কী মা, হাসছে! কান করে শুনলুম, ওবাড়ির দুশমন হিহি করে হাসছে। আঃ, আহা হা—কোমরের হাড় আর আস্ত নেই মা গো! পাপের জায়গায় না আসব, না এমন হবে। শয়তান ওঁত পেতে ছিল গা!
গুনগুন করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে ধরে সাহানা বাড়ি ঢুকছিল। …
ওবাড়ির নিমতলায় সব শুনে হেমনাথ একটু হেসে বললেন, সানুবউ আছাড় খেয়েছে? আরে ও তো বরাবরই আছাড় খাওয়া মেয়ে। সেবার ওদের পরবের সময় হাত ভেঙেছিল না? সানুবউ প্রথম যেবার ও বাড়ি এল…
প্রভা বলল, আ মর! সানুবউ আবার কে?
চমকে উঠে হেমনাথ দেখলেন, এতক্ষণ পুরনো হেমনাথ তাঁর গলায় কথা বলছিল। সুতরাং গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, মরুক গে। তুমি ঘাটের দিকে সাবধানে পা ফেলো। জটিল ঘাটের ওপর জাল ঝেড়ে পিছল করে দিয়েছে। তা হ্যাঁ গা, ইয়ে—মাছ কিছু তো রেখেছিলে।
প্রভা টের পেয়ে বলল, কে দিতে যাচ্ছে বলো? যেচে পড়ে দিতে গেলে যদি মুখের ওপর না বলে দ্যায়? সাধ করে বেজাতের হাতে অপমান হতে পারব না। তাছাড়া লোকে কী বলবে? ঘরে মেয়ে আছে—একদিন তাকে তো শ্বশুরঘর করতে হবে—না কী? এতেই যা হয়েছে—
হেমনাথ বললেন, তা তো ঠিকই।
প্রভা নিষ্ঠুর মুখে বলল, কবে দেশ ছেড়ে পালাবে সেই দিন গুনছি। আরে! ঝুনু—ঝুনু পোড়ারমুখী আর আমাদের মানসম্মান রাখবে না। দেখছ কাণ্ড? খবরটা দিতে গেলি, দিয়েই চলে আসবি। তা নয়…প্রভা পা বাড়াল।
হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ, দ্যাখো তো এতক্ষণ কী করছে। দূর থেকে ডেকে নেবে। কার চোখে পড়বে, বলবে—দেখছ? ফের দিব্যি শুরু হয়েছে।
প্রভা বলল, চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে আনব না! কলেজে পড়ছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে? ওসব আদিখ্যেতা যেখানে সাজবে, দেখাক গিয়ে।
তার আগেই ঝুনু এসে গেল অবশ্য। হাসতে হাসতে এল। কোনো পাপ করিনি বাবা। ছুঁইনি, মুসলমান—মাটিতে পা দিইনি, শুধু খবরটা জানিয়ে দিয়েছি—ব্যাস! এবং সে অবিকল আফজলের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ….বলো—তার জন্যে কী করতে হবে আমাকে? ক’হাত নাক ঘষব—কতখানি পাছা….জিভ কেটে সে থামল। পাছা শব্দটা অশ্লীল না?
স্বামী—স্ত্রীকে হাসাবার পক্ষে এই যথেষ্ট ছিল।