এক
সে একটা মজার নোম্যানসল্যান্ড। এই বাংলা দেশে।
নোম্যানসল্যান্ড কাকে বলে জানেন তো? দুই রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কিছু জমি পড়ে থাকে—যার কোনো মালিক নেই। এ জমি যেন ঈশ্বরের। তাঁর অনুচরী প্রকৃতি যেখানে ইচ্ছামতো খেলাধুলো করে বা নাচে গায় কিংবা যা খুশি করে। কারও কিছু বলার নেই। ও জায়গাটা মানুষের নয়।
একালে কী হচ্ছে, খবর রাখিনে! কিন্তু বাংলাদেশের ছোট—বড় সব পাড়াগাঁয়েতেই এরকম কিছু নোম্যানসল্যান্ড ছিল। সেটা কোথায় জানেন? হাসবেন না। ওটা ছিল হিন্দুপাড়া আর মুসলমান পাড়ার মধ্যিখানটায়। দুটো পাড়া যখন রাষ্ট্র নয়, তখন ও জমিটাও কিন্তু একেবারে মালিকছাড়া নয়। বেশিরভাগ জায়গায় ওটা হয় সরকারি খাস সম্পত্তি, নয়তো কোনো ‘পীরান’ বা দেবোত্তর জমা। তার ফলে দরগা কিংবা ধর্মঠাকুরের মণ্ডপ, অথবা পোড়ো বাঁজা ডাঙা—যাতে কখন সখনও ছেলেরা খেলাধুলো করে থাকে—এইসব দিয়েই জমিটার অবস্থা বিচার করা চলে। আবার, অনেক গাঁয়ে আস্ত এক পুকুর থেকে ব্যাপারটা জটিল করে তুললেও আসলে ওটা নোম্যানসল্যান্ড বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কারণ কী? কারণ ওই দুই সম্প্রদায়ের জন্যে দু’দিকে দুটো আলাদা—আলাদা পাড়া রয়েছে যে! হিন্দুর ঘরের দেওয়ালের ওপিঠে মুসলমানের ঘর থাকা অর্থাৎ একেবারে নোম্যানসল্যান্ডবিহীন, এমনকি সীমাবিহীন অবস্থা নিছক ব্যতিক্রম। যেখানে তা রয়েছে, সেখানে বড় বিদঘুটে ব্যাপারও কম ঘটে না। এক বাড়ির এঁটো থেকে নিষিদ্ধ ভক্ষ্যের হাড় অন্য বাড়ির কোনো কুকুর কি বেড়াল নিয়ে গিয়ে তুলল—আর অমনি ব্যস! তক্ষুনি শকুনিমামার প্রবেশ, মন্ত্রণা এবং দ্রুত কুরুক্ষেত্র এগিয়ে আসতে থাকে।…..
এইবার বুঝতে পারবেন, একটা নোম্যানসল্যান্ড কেন জরুরি ছিল। হাড় ফেলেছে বলে নয়, নিরাপত্তা অর্থাৎ যে যার ঘাড়ে মাথাটি অক্ষত রেখে চমৎকার লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে—দু’পক্ষের সামনে এমন খানিকটা ফাঁকা জায়গা তো বড় দরকার! তা না থাকলে যার জোর বেশি সে তক্ষুনি হাত বাড়িয়েই মুণ্ডুটি পেয়ে যাবে, কিংবা অগত্যা ঘরের খোড়ো চালটাও তো সামনে ঝুঁকে রয়েছে—একটা দেশলাই কাঠির ওয়াস্তা মাত্র! তাই যেন ওই হিসেবি পাড়াগঠন ও বসবাসের অনবদ্য ভঙ্গি।
ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, পিঠাপিঠি এমন বাস যাদের, তাদের মধ্যে কিন্তু সংঘর্ষ ঘটে কদাচিৎ, ঘটে না বললেও চলে। কারণ, সারা বেলা দিনরাত্তির দেখাদেখি চোখাচোখি, বাক্যালাপ আর হাঁড়ির খবর চালাচালিতে মনও যেন এক শক্ত সুতোয় বাঁধা হয়ে পড়ে। ছিঁড়তে দু’পক্ষেরই ব্যথা বাজে। আর তাই—
অ, রুবির মা, এদিকে একবারটি আসবে?
ডাকছ মেজঠাকরান? যাচ্ছি।
অই দ্যাখো, দ্যাখো নচ্ছার হুলোটার কাণ্ড দ্যাখো। কীসব জড়ো করেছে কোত্থেকে! আমি বলি, আর কোত্থেকেই বা আনবে! মিয়াবাড়ি ছাড়া…(মুখে আঁচল ঢেকে হাসি) কাল রাত্তিরে তো ওনাদের ‘মেমান’ এয়েছিল।
ও মা ছি ছি ছি! গালে কালি কাণ্ড! বুঝেছি। এ আমাদেরই ভুলোর কাজ। তখন ভোরবেলা নামাজের জন্যে আজু করতে বসেছি, দেখি হারামজাদা মুখে একটা নিয়ে আড়চোখে তাকাচ্ছে প্যাটপ্যাট করে। তাড়া করলুম তক্ষুনি। কে জানে, কায়েতবাড়ি গিয়ে…(আঁচল ঢাকা হাসি) …তা এক্ষুনি ফেলতে বলছি। হাসির মা, ও হাসির মা! শিগগির এসো তো এদিকে, জলদি!
তাই করো! ভাগ্যিস পরশু সন্ধেবেলা ও বাড়ির ঠাকুরপো গঙ্গাজল এনেছিল একঘড়া! (হাসি ও চাপা গলায়) মেজবাবুর কানে গেলে আবার বাড়িসুদ্ধ গঙ্গাজলে চুবোবার ব্যবস্থা করবে, যা কড়া মানুষ! তা হ্যাঁ গো বউ, রুবিকে দেখেশুনে গেল?
দেখাশোনা আর কী করবে? আমাদের মেয়েদের তো পাত্রপক্ষের পুরুষদের দেখানোর রীতি নেই মেজঠাকরান। তবে শিক্ষিত পাত্র—ছবি ছিল, তাই দেখল। হাতের লেখা দেখল। স্কুলের সার্টিফিকেট দেখল। তাছাড়া সেলাই—টেলাই যা রুবির ছিল, সবই দেখালেন উনি।
পছন্দ হয়েছে বুঝলে?
মুখে তো বলে গেল পছন্দ হয়েছে। পরে কী করবে কে জানে? সর্বনাশী মেয়েটার কপালে খোদা কী লিখেছেন, তিনিই জানেন ভাই। যতজন এল, মুখে সবাই পছন্দের কথা বলে গেল। এমনকি দিনক্ষণও ঠিক হল কতবার। তারপর হঠাৎ সেই ভাঙচি—কোত্থেকে কার মুখে কী শোনে আর বিগড়ে যায়। (দীর্ঘশ্বাস)
বড় দুঃখ লাগে বউ। বুঝলে? খুব কষ্ট পাই মনে। যদি নিজের জাত হতে অমন সোনার প্রতিমা আদর করে তুলতাম ভাই। একটা পাঁচিলের বেড়া বই তো না! (দীর্ঘশ্বাস)
দুই মধ্যবয়সিনী মহিলা মাঝখানের পাঁচিলের দিকে বিষণ্ণ চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে। ওদিকে পেয়ারাগাছের ডালে হলদে ইস্টিকুটুম পাখিটা কখন থেকে ডাকছে। গ্রীষ্মের তাজা সূর্য আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিচ্ছে, ঝাঁঝালো রোদ্দুরের স্রোত উপচে পড়ছে খোদাতালা ও ঈশ্বরের সৃষ্টিটার ওপর। আকাশের নীলচে বিস্তার একটু পরেই ধূসর হয়ে উঠবে।
আমার জঠরে আস্ত একটুকরো দোজখের আগুন জন্মেছিল…
কেঁদো না বউ। ছিঃ কাঁদতে নেই। আমি বলি শোন—তোমার রুবির কোনো দোষ নেই। অমন মেয়ে হয় না গো হয় না। আমি বলছি। আমার কথাটা বিশ্বাস করবে কি না? ওই যে কথায় বলে না—পাঁকে পদ্মফুলটি ফুটেছে, গোবরে পোকাগুলোর তা সইবে কেন বলো? যাও, মনে বল রাখো। ধৈর্য ধরো। ভগবান যেমন আমার আছে, তেমনি তোমারও তো আছে—তাঁর কাছে প্রার্থনা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সুনন্দর মা ছিল এমনি মেয়ে। ঝোঁকের বশে কি না কে জানে, অমনি করে রুবির মাকে দু’জন ঈশ্বরের কথা বলে বসত। পরে সুনন্দ মাকে হাসতে হাসতে বলেছে—আচ্ছা মা, তুমি যে তখন রুবির মাকে ‘তোমার ভগবানের’ কথা বলেছিলে, সত্যি দু’জন ভগবান আছেন বুঝি? দেখে ফেলেছে, তাই না? তোমার উনির চেহারাই বা কেমন আর মাসিমারটাই বা কেমন বলতে পারো? একজনের টিকি অন্যজনের মস্তো দাড়ি। একজন পরেন ধুতি, অন্যজন লুঙ্গি…
চুপ কর তো সুনু। ছোটমুখে বড় কথা কসনে।
বারে! তুমিই তো বললে!
কখন বললুম? (হাসি) বেশ তো, যদি বলেই থাকি—কী ভুল বলেছি? তুই কলেজে পড়ছিস, আমি তো পাঠশালায় যাইনি—এই সহজ কথাটা বুঝতে পারলিনে? ভগবান এক—কিন্তু রূপ তো তাঁর অনেকরকম।
সেই কথাই তো জিজ্ঞেস করছি। রুবিদের ভগবানের রূপটি কেমন? আর আমাদেরই বা—
নাঃ! ছেলেটা মেলেচ্ছর হদ্দ দেখছি! যা তো সামনে থেকে।
বারান্দা থেকে সুনন্দর বোন ঝুনু বা ঝর্ণা বলেছে, দাদা—এবার বলে দিচ্ছি কিন্তু—আমার সেইটে দে।
কী বলবি তুই?
সেই—সেই যে কাল সন্ধেবেলা হুঁ, আগে দাও।
দেব না, যা।
তাহলে বলছি। মা, তোমার জ্যেষ্ঠপুত্র গতকাল সন্ধ্যায় জাতিঃপাত করিয়াছেন। উহার প্রায়শ্চিত্ত করা কর্তব্য।
কী? কী রে সুনু? ঝুনু কী বলছে?
সুনন্দা লাফ দিয়ে বারান্দায় পৌঁছতেই ঝুনু দৌড়ে পালিয়ে গেছে। তারপর খিড়কি খুলে পাড় দিয়ে সোজা রুবিদের বাড়ি হাজির। হাঁপাচ্ছে। বড় বড় চোখ ঠোঁটে আঙুল। রুবি এগিয়ে এসেছে কাছে।—কী রে? কী হয়েছে?
এই চুপ। সুনন্দা যা রেগেছে না আমার ওপর!
কেন?
কাল সন্ধের ব্যাপারটা প্রায় আদ্ধেক বলে দিয়েছি মাকে।
যাঃ। কেন বললি? তোর বাবা যা খটরাগী মানুষ—শেষে…
ওই দ্যাখো। ইনিও ক্রুদ্ধ হইলেন অবলার প্রতি। হবে নাই বা কেন? আলবৎ হওয়া উচিত। যাকে বলে—একের ব্যথা অন্যের প্রাণে বাজিয়া ওঠে। দুঁহু কাঁদে দোঁহা লাগি!
খবর্দার ঝুনু! যা—তা বলবিনে বলছি!
বা রে! যা—তা বলছি?
বেশ বাবা, বেশ। তাই হল। এই আমি মুখে তালা দিলুম। আর কদাপি খুলব না। যাক গে, চল। তোর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।
দু’জনে ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। তারপর রুবি মুখ তুলেছে—চোখে প্রশ্ন। ঝুনু বলেছে, বলছি বাবা, দম নিতে দে। তবে কথাটা ভারি গোপনীয়।…হুঁউ! হল তো! চমকে উঠেছিস সঙ্গে সঙ্গে। এখন তোর হৃদয়কে, থুড়ি! মুসলিম হৃদয়টাকে বল—হে হৃদয়, উদ্বেলিত হোয়ো না। হিন্দুহৃদয়ের বার্তা শুনিবার জন্য প্রস্তুত হও।
ঝুনু, যত বয়স বাড়ছে—তত ডেঁপো আর ফাজিল হচ্ছিস কিন্তু। এত জ্যাঠামি শিখলি কোত্থেকে?
শিখেছি। শিখছি। আরও কত শিখব। শোন, এইমাত্র শিখে এলুম যে দু’জন ভগবান আছেন। একজন হিন্দু ভগবান, অন্যজন মুসলিম ভগবান। সুতরাং বোঝা গেল, হৃদয় দু’রকম আছে। একটা হিন্দু হৃদয়, অন্যটা মুসলিম হৃদয়।
(জোর হেসে) তোকে পারা দায়। কিন্তু কথাটা হয়তো ঠিকই বলছিস রে।
বলেছি! তবে দে—প্রাইজ দে।
দিচ্ছি…..
সেই সময় সশরীরে আমি গিয়ে পড়লে কী দৃশ্য দেখতুম জানেন? দুটি মেয়ে বড়জোর আঠারোর মধ্যে বয়স তাদের, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে চুমু খাচ্ছে। তারপর ফের পরিহাসে ওরা পরস্পরকে বলেছে, এই যা? জাত মেরে দিলি যে! ওরা ঠোঁট মুছছে আঁচলে। অবশ্য সেটা নিতান্তই কাপট্য।
আর, এই ছিল ঝুনু বা ঝর্ণা আর রুবি। এই ছিল সুনন্দ আর তার মা। আর এই ছিল কি না রুবির মা।
সেই পাশাপাশি ঘরবাড়ি, নোম্যানসল্যান্ডবিহীন ঐতিহ্যবিরোধী পটভূমিই আমার এ কাহিনির পটভূমি।
এবং বাংলাদেশের হিন্দু মুসলিম অধ্যুষিত পাড়াগাঁয়ে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম ছিল এই কুসুমগঞ্জ। মুসলমানেরা যাকে কুলসুমগঞ্জ বলেই অভিহিত করত। সাম্প্রদায়িকতা হয়তো নয়—নিতান্ত আত্মীয়তার দাবি থেকেই নামের এ হেরফের। একে তুচ্ছ করা ভালো।
কুসুমগঞ্জে কোনো নোম্যানসল্যান্ড ছিল না। ছিল না, তার কারণটা ভারি স্বাভাবিক। কোনো এক মুসলিম জায়গিরদারের এ ছিল রাজধানী বিশেষ। পরবর্তী কালে তাঁর বংশধরেরা ছিলেন জমিদার। এখনও নদীর ধারে সে আমলের কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। সে আমলে কর্মচারী ও অমাত্য পারিষদ অনুচর বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। জায়গিরদারটিও ছিলেন কোনো কোনো মুসলিম শাসকের অনুরূপ প্রথাসিদ্ধ উদারতায় বিশ্বাসী। এবং তাঁদেরকে খুব কাছাকাছি রাখতে চেয়েছিলেন—যাতে হরবখত আজ্ঞামাত্র সামনে পাওয়া যায় বা খুশগল্প করা যায়।
এর ফলেই বস্তুত কোনো নোম্যানসল্যান্ড থাকার সুযোগ ঘটেনি—বা কেউ ভাবেওনি। তারপর বংশপরম্পরা ঘরবাড়িগুলো ওইরকম দেয়ালে দেয়ালে পাশাপাশি রয়ে যেতে বাধ্য হল। ইংরেজ আমলেও তা অব্যাহত রইল। স্বাধীনতার পরও আর কোনো রাজনৈতিক ভূমিকম্পে দুটো পাড়া দু’দিকে সরে মধ্যিখানে কোনো যক্ষভূমি সৃষ্টি হল না।
অথচ হতে পারত। অজস্র নতুন মানুষ নতুন মন ও জীবন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে এল কুসুমগঞ্জে। তাদের সঙ্গে সাবেকি বাসিন্দাদের মিলের চেয়ে গরমিলটাই বেশি। আচারে বিচারে পোশাকে আশাকে ফারাক হচ্ছে দুস্তর। তবু কোনো সংঘাতই ঘটল না।
এর কারণ একটাই। মাটির দাম বেড়ে গেল কুসুমগঞ্জে। একেলে সভ্যতার কড়া ঝাঁঝ গায়ে নিয়ে নাগরের মতো প্রবিষ্ট হল নগর। নদী আর রেলস্টেশন কেন্দ্র গড়ে উঠল নতুন বেনিয়ার মৌচাক। সরকারি পাঁচসালা যোজনার প্রভূত দাক্ষিণ্যে পুরনো কুসুমগঞ্জ তার অমার্জিত গেঁয়ো চেহারাটি মুছে ফেলে ছিমছাম নব্যসুন্দরী হয়ে উঠল—যেন ববছাঁট চুল, মিনি ব্লাউজ, সমুদ্ধত স্তনযুগল, দেহের প্রতিটি খাঁজে সুরম্য মাংসল সোপানরাজি…
থাক। কাব্য করে লাভ নেই। বেনিয়াবাজারে সবই পণ্য। টাকার বিনিময়ে আপনি কিনতে পারেন সেরদরুন মাংস, মানুষেরই মাংস! কাজেই মাটি তো সামান্য বস্তু।
কুসুমগঞ্জে মাটির দাম বেড়ে গিয়েছিল। কে হিন্দু কে মুসলমান, এ প্রশ্ন পরে—আগের রেওয়াজ মতো হিন্দুমাটি মুসলমানমাটি বলে আর দ্বিধাবিচার রইল না কিছু। কারণ, মরুভূমিতে যখন একফোঁটা জলের অভাবে সবাই হতশ্বাস, জলদাতার জাতবিচার করার মতো মনোবল কোথায়? এখানের মাটিতে একটা পা রাখতে পারলেই নাকি হাওয়া থেকে টাকা কুড়োন যায়। টাকা কুড়োতে রাজ্যের লোক জড়ো হচ্ছিল।
মিয়াবাড়ির একপাশে কায়েতবাড়ি, অন্যপাশে বামুনবাড়ি এবং তার পাশে ফের মিয়াবাড়ি—এইরকম গা ঘেঁষাঘেষি পুরনো কালের বসবাসের সঙ্গে আরও এলোমেলো নতুন বসবাস যোগ মেলাচ্ছিল। ফলে ছত্রিশ রাজ্যের ছত্রিশ জাতের এ হল এক অভূতপূর্ব সহাবস্থান।
অভূতপূর্ব। কারণ, এদিক ওদিক ইলেকটিরি পরিশোভিত নতুন ফ্যাসানোর দালানবাড়ির ভিড়ে কিছু সেকেলে গড়নের মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের হতশ্রী ঘরবাড়ি রয়ে গেল। ওই বিশাল তেঁতুল গাছটার দিকে তাকান। রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো ছিল তার অবস্থিতি। তাকে কেন্দ্র করে কত অলৌকিক কাহিনি না চালু ছিল! আজ তার বুকের কাছাকাছি ইলেকটিরির তার। কাঠের খুঁটিতে আলো জ্বলে সারাটি রাত। আজ সব রহস্যের ফর্দাফাঁই, সব কাহিনির বিয়োগান্ত পরিণতি।
পায়ের কাছে ছোট্ট পুকুর। অজস্র হলুদ তেঁতুলপাতা তিরতির করে জলে কাঁপে এখনও। পাড়ে—পাড়ে সবজিখেত আর ছিমছাম একতলা বাড়ি। শুধু উত্তর দিকটা বাদে। ওখানে পাশাপাশি দুটো মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, দারিদ্র্যের রুক্ষ গম্ভীর চেহারা। মেকি ইজ্জতের বড়াই নিয়ে দু’বাড়ির দুই প্রৌঢ় এখনও চারপাশটাকে তাচ্ছিল্য করার চেষ্টায় ব্যাপৃত। দুটি মানুষই এখনও প্রতি বিকেলে দুটি ছড়ি হাতে নিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে যান অভ্যাসমতো। রেললাইন ধরে কতদূর হাঁটতে থাকেন। ক্যানেলের ব্রিজে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। কিছু কথা বলেন কিংবা বলেন না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ওইসব বিস্তৃত শস্যক্ষেত্রের দিকে। কিংবা নদীর আঁকাবাঁকা রেখাটির দিকে। কিংবা হয়তো উঁচু ধ্বংসস্তূপগুলোর দিকে—মমতাময়ী প্রকৃতির যে প্রকাণ্ড অবক্ষয়িত আর ভুলুণ্ঠিত ইজ্জতকে পরম যত্নে মায়ের স্নেহে ঢেকে রেখেছে। ঘন সবুজ উদ্ভিদের প্রসারিত আবরণে রক্ষা করছে কোনো প্রাচীন কালের ট্রাজেডিকে।
হ্যাঁ—তাই—ই তো। প্রকৃতি ছাড়া একাজ কেই বা করে। প্রকৃতিই তো অবশেষে পরম সান্ত্বনা। সে কিনা জীবজগতের উৎস আর অন্তিম আশ্রয়। দুঃখে শোকে বেদনায়, তাই মানুষ তার কাছেই গিয়ে দাঁড়ায়। প্রার্থনা করে, আমায় গ্রহণ করো।
…ওই যেখানটায় সূর্য ডুবছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ আফজল, ওই যে, কী একটা…(একটু হেসে)…আমার লংসাইটটা একেবারে গেছে! তোমার আবার চশমারই দরকার হয় না। চোখের এত জোর পেলে কোথায় হে? গোরু খেয়ে? হেঁ হেঁ হেঁ!
…তোমারও কি বাদ গেছে ও কম্মো? দু’বেলা তো ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম হয়ে গেছে। হাঃ হাঃ হাঃ।
…আরে দ্যাখো, দ্যাখো! এখনও বিলে হাঁস নামছে ঝাঁকে ঝাঁকে। নামছে না? বন্দুকটা থাকলে…(দীর্ঘশ্বাস)
…বন্দুক? এখনও তুমি বন্দুকের কথা ভাবো? বোষ্টম মানুষ—তবু পক্ষীমাংসের লোভ? থামো, তোমার গুরুদেব আসুন!
(জিভ কেটে) ধুস শালা। ভুলেই যাই হে!
(কয়েক মিনিট নীরবতার পরে)
…খাঁ সাহেব!
…উঁ?
…মেয়েটাকে আর পড়ালে না?
…পারলুম কই? দেনায় সর্বস্ব বিকিয়ে আছে রে ভাই। নুরু আগের মতো টাকা পাঠাচ্ছে না। নাকি পাঠাতে পারছে না। বর্ডারে আজকাল ভীষণ কড়াকড়ি শুনেছি। চিঠিপত্রও পাইনি অনেকদিন—ভাবছিলুম একবার যাব নাকি…
…ওকে টিউশনি করতে দাও না! আজকাল টিউশনির অভাব হবে না। তাই করেও তো মাসের পড়ার খরচা চালিয়ে নিতে পারে। হাতের কাছে কলেজ—নাঃ তোমাদের আবার ওইসব সেকেলে শরিয়তি ব্যাপার বড্ড কড়া।
…ধুস। কট্টুকু মানি আমি? হেম, তুই তো সেটা ভালোই জানিস ভাই!
…তা ঠিক। আমার ঝুনুটারও তো ওই অবস্থা। সুনুর এবার থার্ড ইয়ার চলছে। ভাবছি, পরের বছর পাশ করে বেরোলে যদি চাকরিবাকরি একটা জোটে, সেই বরং বোনের দায়িত্বটা নিতে পারে। পারবে না?
…হ্যাঁ, সুনু ছেলে হিসেবে তো ভালোই। আজকালকার ছেলেদের মতো ডেঁপো ফক্কুরে নয়। দায়িত্ববোধ ওর আছে!
…খাঁ সাহেব!
…বলো।
(নীরবতা)
—কী হল হেম?
…না। কিছু না। আরে কী কাণ্ড! টোয়েনটি ডাউন এরই মধ্যে এসে পড়ল। সাড়ে ছটা বেজে গেল তাহলে! চলো, ওঠা যাক! আজকাল এদিকটায় পোকামাকড় বেরোয়। (বিড়বিড় করে)…রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরি হরি। জয় নিতাই।
…তুমি বেশ আছো হে ধর্মকর্ম নিয়ে। আমি শালা ভুলেও একবার খোদার নাম করলুম না। পাঁচঅক্ত নমাজ তো দূরের কথা।
….ঈশ্বরকে ভুলো না আফজল। আর কদ্দিন?
…ভুলিনি, হেম। কিন্তু কী জানো? শয়তান আমার হাত পা বেঁধে রেখেছে। এ বড় জ্বালা ভাই।
দুই প্রৌঢ়—হয়তো বয়সে প্রৌঢ়, কিন্তু তাদের দ্যাখায় বৃদ্ধদের মতোই, লাঠি ঠুকে ঠুকে রেললাইনের ধারে—ধারে বাড়ি ফিরতে থাকেন। টোয়েনটি ডাউনের তীব্র আলোয় দৃষ্টি ধাঁধিয়ে গেলে ট্রেনটা চলে না যাওয়া অব্দি চোখে করতল রেখে দাঁড়িয়ে যান। তারপর হঠাৎ দু’জনেরই যেন মনে হয়, চারদিক জুড়ে এক শোকাবহ স্তব্ধতা হঠাৎ ঘনিয়ে এল—ওই ধাতব শব্দময় গতিবান জ্যোতির্ময় আস্ফালনের পর এমনি স্তব্ধতা তো খুবই স্বাভাবিক এবং এই গভীর স্তব্ধতাটাই আজ তাঁদের জীবন। এবং তাই যত বিষণ্ণতা।
কিন্তু একটু আগে কী বলতে চেয়েছিলেন হেমনাথ? আফজল খাঁর গা শিউরে ওঠে! অনবরত মাথা নাড়েন। শুকনো জিভে নিরুচ্চারিত শব্দ কাঁপে—খোদা হাফিজ!
আমি কিন্তু জানি। কারণ, আমি—এ কাহিনির যে লেখক সেই আমি তো শুধু দ্রষ্টা নই, নির্লিপ্ত নির্বিকার কোনো সত্তা নই। আমি ওই অকথিত সংলাপ অনায়াসে উচ্চারণ করিতে পারি আপনার কাছে, মমতাময়ী পাঠিকা।
আপনার কি মনে পড়ে মেজঠাকরানের সেই সকালবেলার কথাটি?…খুব কষ্ট পাই মনে। বুঝলে বউ? যদি নিজের জাত হতে, অমন সোনার প্রতিমা…
থাক। এবার আপনার সবটা মনে পড়ে গেছে।
যেখানে থেকে শুরু করেছিলাম, তার আগের সন্ধ্যায় একটা কাণ্ড ঘটেছিল। সেটা বলা দরকার। আফজল খাঁর মেয়ে রুবিকে যাচাই করতে এক পাত্রপক্ষ এসেছিল বিকেলে। সকালেই আসবার কথা। দিনের আলোয় এসব কাজ সচরাচর ঘটে থাকে। কিন্তু পাত্র থাকে কলকাতায়। পৌঁছতে পারেনি সময়মতো। এদিকে কুসুমগঞ্জে খবর গেছে যথারীতি—শাদির পয়গাম যাচ্ছে। ওনারা বনেদি ভদ্রলোক। খানদানি বংশ। সুতরাং কথার খেলাপ করতে রাজি নন।
পাত্রের ইচ্ছে, স্বচক্ষে পাত্রীকে বাজিয়ে নেবে। সে একেলে যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বউ নিয়ে তার স্বপ্নের সীমা নেই। মুসলমান হলেও হিন্দু বন্ধুদের বিয়ের আচার—প্রথা বা আধুনিক প্রকৃতিও তার জানা। তার মানসিকতায় ইসলামি শরিয়তের চেয়ে এইসব আধুনিকতার দিকে ঝোঁকটা সবিশেষ তীব্র। তাই তার সশরীরে আগমন।
কিন্তু কুসুমগঞ্জের সমাজে অতখানি বেশরিয়ত বরদাস্ত হওয়া শক্ত। শুধু সামাজিক রীতি বলে নয়, একটু ব্যক্তিগত দিকও তো আছে। খাঁ—পরিবারে এমনটি কেউ ঘটতে দ্যাখেনি কস্মিনকালে। স্কুলে মেয়েকে পড়াক বা পর্দাপ্রথা না মানুক, অন্তত বরের সামনে কনের মাংস ওজন হবে—এটা ওদের রক্তে অসহনীয়। মেয়ে কি বাজারের মাল?
তবে পাত্রের জেদ—এবং পাত্রটি সুশিক্ষিত তো বটেই, রূপবান ও অর্থবান; কাজেই শেষ অব্দি ফটো দেখানো হল।
ফটো কিন্তু এ উদ্দেশ্যে তোলানো হয়নি। বাবা—মা জানতই না যে তাদের মেয়ের একটি ফটো রয়েছে। কথাটা জানিয়ে দিয়েছিল হেমনাথের মেয়ে ঝর্ণা।
ঝর্ণা অতশত কী জানে? এর আগে কোনো মুসলমান বাড়ির পাত্রী দেখানোর ব্যাপার তার জানা ছিল না। স্বভাবত সে ভেবেছিল যে তাদের মতোই কনে দেখানো হবে। এবং তাই সারাবিকেল সে পরম যত্নে ও সাধনায় বান্ধবী রুবিকে সাজিয়ে তিলোত্তমা তৈরি করে বসেছিল। আড়ালে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলেছিল, ওরে রুবি! আমার যে পুরুষ মানুষ হতে ইচ্ছে করছে ভাই! উঃ, আমি মরে যাব রে, মরে যাব!
রুবি বলেছিল, তোর যখন বর আসবে—তোকেও আমি সাজাব। তখন আমারও হয়তো পুরুষ মানুষ হতে ইচ্ছে করবে।
যাঃ! আমি তো একটা খেঁদিপেঁচি। শূর্পনখা। দাদা কী বলে শুনিসনি?
তোর দাদা একটা গাধা।
এই চুপ! দাদা বারান্দায় রয়েছে।
সত্যি?
দু’জনে দরজায় উঁকি মেরে পরক্ষণে থ। সুনন্দ একটা মোড়ায় বসে রয়েছে। রান্নাঘরের দরজার কাছেই। হাতে প্লেট, প্লেটভর্তি খাদ্য। ঠিক বেড়ালের মতো মুখ কাত করে করে যা চিবোচ্ছে, তা হাড় মাংস নিশ্চিত। এবং রুবি জানত, ওটা হিন্দুর অভক্ষ্য। মায়ের বুদ্ধিশুদ্ধি আর কবে হবে? ছি, ছি, ছি, খেতে চাইলেও কি দিতে আছে?
ঝুনু বলেছিল, তুই হঠাৎ ঝিম মেরে গেলি যে!
নার্ভাস রুবি জবাব দিয়েছিল, না না—এমনি।
কী খাচ্ছে রে দাদা?
কিছু না, মাংসটাংস হবে।
মুরগি কেটেছিস?…লোনার জল চুষে ঝুনু বলেছিল, কখন কাটলি দেখলুম না তো! বাঃ, ভাগ্য কী সুপ্রসন্ন!
রুবির মুখটা আরও গম্ভীর হল। ঝুনু কিন্তু দৌড়ে রান্নাঘরের দরজায় হাজির তক্ষুনি।…মাসিমা! ভারি দু’চোখো মানুষ তো তুমি!
কেন রে?
আমি বাদ পড়লুম?
সাহানা বেগম অপ্রস্তুত।…না, না, বাদ পড়বি কেন। বস, দিচ্ছি। হাসির মা, এই প্লেটটা ধুয়ে দাও দিকি। মেয়েকে খানিক ‘ফিরনি’ খাইয়ে দি।
‘ফিরনি’ আবার কী? দাদা যা খাচ্ছে, তাই খাব।
সুনন্দ চোখ পাকিয়ে বলল, যা দিচ্ছে তাই খাবি। এ বস্তু তোর সইবে না। এত মোটা হাড় চিবুতে পারবি? আছে দাঁতের জোর?
কী যেন সন্দেহ মুহূর্তে উঁকি দিল ঝর্ণার মনে। ফিরনির প্লেটটা হাতে নিয়ে সে রুবির ঘরে এল। ফিসফিস করে বলল, আচ্ছা রুবি, সত্যি বল তো—ও কীসের মাংস খাচ্ছে? তোর দিব্যি, কাকেও বলব না।
রুবি বলেছিল, বুঝতে পারছিস না? তোর দাদাটি আস্ত রাক্ষস রে। কুকুর বেড়াল যা দিবি, কড়মড় করে খেয়ে ফেলবে।
এই মা! দাদা ভগবান খাচ্ছে! ছি ছি ছি!….
এটা একটা তীব্রতর ঘটনা ঝুনুর জীবনে। কিন্তু সবই অভ্যাস। সহাবস্থানের গুণে এর ধারাটায় যেন মরচে ধরে গিয়েছিল। সে টের পেয়েছিল, তার দাদাটি এক খাপছাড়া অদ্ভুত মানুষ। শুধু এইমাত্রই।
প্রসঙ্গটা মনে দাগ কাটতে পারল না। ওদিকে সময় হয়ে গেছে। ঝুনু গম্ভীর মুখে ওকে শেখাচ্ছে পাত্রপক্ষের সামনে কী বলবে কেমন চলাফেরা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি! সেই সময় বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো দুঃসংবাদটা জানা গেল। রুবির মা এসে বললে, না, না আমাদের মেয়েদের এভাবে সেজেগুেজে ওনাদের সামনে যেতে নেই। সে কি হয়?
রুবির বাবারও আপত্তি। ঝুনু অবাক। অবশেষে হঠাৎ তার কী মনে পড়ে গিয়েছিল।…এই রুবি! তোর সেই ফটোটা আছে রে?
সাহানা বেগম বললে, ফটো? কোন ফটো?
তুমি জানো না মাসিমা। আমরা দু’জনে একসঙ্গে দুটো ফটো তুলেছিলাম।
তাই নাকি?
আফজল খাঁ বললেন, বাঃ! বাঁচা গেছে। ওনারা ফটো দেখালেও খুশি হবেন। কই, শিগগির বের কর তো ফটোখানা।….
রাত একটু বেশি হলে ভাইবোনে নিজেদের বাড়ি ফিরল। প্রভা বলল, কেমন হল রে সব? খুব ধুমধাম হল বুঝি?
প্রভার বিশ্বাস আছে, তার ছেলেমেয়ে ভারি ধার্মিক জাতধর্ম মেনেটেনেই চলে। প্রভার আরও কিছু ধারণা আছে। তার বাড়ির পুজোআর্চা পালাপার্বণে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার থাকলে রুবিকে প্রকাশ্যে ডেকেই খাইয়ে দেয়। বারান্দায় আসন পেতে রুবিকে খাওয়ায়। সামান্য তফাতে ঝুনু বসে। সামনে যথাযথ দূরত্ব রেখে প্রভা পরিবেশন করে। আলগোছে পাতে ফেলে দেয়। রুবি খায়…বাধে না।
রুবির মা প্রথম প্রথম আড়ালে মেয়েকে নিষেধ করত। তারপর আর এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এমনকি কায়েতবাড়ির প্লেট এলে তা গ্রহণও করে খুশিমনে। কিন্তু নিজে খায় না—খায় ঝি হাসির মা আর হাসি, এবং ওই রুবি।
তবু মনে জ্বালা কুটকুট করে।…ওনাদের খাবার আমরা দিব্যি নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের ঈদের সেমাই কী একবাটি ফিরনি দিতে যাই তো! তখন হাতে ধরে কোনোমতে নেবে না মেজঠাকরান! বলবে ওখানে রাখো বউ। নিচ্ছি! তাহলে দ্যাখো কাণ্ডখানা! জাত বুঝি ওনাদের একার আছে, আমাদের নেই।
আফজল সাহেব কিন্তু অন্য ধাতের মানুষ। তিনি বলেন, তাতে কী হয়েছে? তোমার কর্তব্য তুমি করে যাও। ওরা নিক না নিক, কিছু ক্ষতি নেই। নিজে কেন ছোট হবে? আর দ্যাখো, আমাদের ইসলামধর্মে ওইসব ছোঁওয়াছুঁয়ি জাতবিচার নেই। আমাদের কাছে মানুষ মানেই মানুষ—খোদা—তালার সৃষ্টি।
অমনি মুখ ঝাপটা বেগম সাহেবার।…থামো তো তুমি! ইস, পাঁচঅক্ত নামাজ পড়ে পড়ে তো কপালে ঘেঁটো ধরে গেছে—সে আবার ইসলামের নাম করে। কাফেরের এককাঠি সরেস যে, তেনার মুখে খোদার কথা। জীবনে কখনও দাড়ি রেখেছ? এখনও দু’বেলা নাপিতের সামনে গাল বাড়াতে সরম হয় না একটুও?
গালে হাত বুলিয়ে আফজল বলেন, তুমি সইতে পারবে তো বেগম? হঠাৎ অ্যাদ্দিন বাদে গালে জঙ্গল গজালে তুমিই তখন মুখ সরিয়ে শোবে।
কী হচ্ছে! ঘরে সোমত্ত মেয়ে—কানে তালা আঁটেনি খেয়াল আছে?
কে? অ—রুবির কথা বলছ?
সাহানা বেগম তীক্ষ্নদৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কিছুর খোঁজে। তারপর কতকটা নিজের মনেই বলে, সে তো বটেই। রুবি নামে এবাড়িতে যে কেউ আছে, তা সায়েবের মনেই থাকে না। হ্যাঁ, থাকত। যদি নিজের মেয়ে হত! সঙ্গে করে এনেছিলুম বলেই তো যত জ্বালা, তোমার ইচ্ছেতেই এনেছিলুম। দিব্যি দাদুর কাছে থাকত। অ্যাদ্দিন ভালো করে বিয়েও হত। তোমাদের খোঁটা খেতে হত না।
এই দ্যাখো। কী কথায় কী এনে ফেলল! আফজল খাঁ ক্ষুব্ধ।…কেন তুমি আমায় অমন ছোট ভাব বলো তো? কী? কী করতে বলো আমায়? এক্ষুনি বলো। নাকখবদা দেব মাটিতে? পাছা ঘেঁষড়াব দশহাত? নাকি কান ধরে ওঠবোস করব। বলো, কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?
আহত অভিমানী বুড়ো বাঘটাকে সামনে গজরাতে দেখে সাহানা বেগম কাঠ। আস্তে আস্তে সরে যায় অন্য কোথাও। হয়তো খিড়কির বাইরে পুকুটঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
কতদিনের কত কথা মনে পড়ে যায়। পুরনো একটা পরিত্যক্ত সংসারে চলচ্চিত্র ফোটে শ্যাওলাভরা জলের সজীব সবুজে, রঙিন গুচ্ছ। সাঁ সাঁ করে পর্দার মতো দৃশ্য আসে—যায়। নতুনহাটের সেই একতলা দালানবাড়িতে কবে একদিন এমনি গ্রীষ্মের দিনে এক বালিকাবধূ একটি কিশোরের হাতে ধরে সলজ্জ বলেছিল, আমায় একবার কুসুমগঞ্জ দেখিয়ে আনবে?
কেন? কী আছে ওখানে?
বারে! জানোনা বুঝি? ওখানে দাদাপিরের থানে মেলা বসেছে যে! সার্কাস এসেছে। আমি কখনও সার্কাস দেখিনি। সার্কাসে নাকি বাঘ দেখায়। সত্যি বলছি, আমি কখনও বাঘ দেখিনি। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। হ্যাঁ গা, বাঘ কত বড় হয়?…
তার বিশ বছর পরে সত্যিসত্যি কুসুমগঞ্জ দেখা হয়ে গেল। সার্কাস। এবং বাঘও।
শিরশির করে হাওয়া বয়। কলাপাতা কাঁপে। তেঁতুলগাছটা থেকে ঝরঝর থাকে থরেবিথরে হলুদ পাতার ঝাঁক। জল থিরথির করে চক্রাকারে। কোথাও সানাই বেজে ওঠে। মল্লিক বাড়িতে বিয়ে বুঝি!
…সামান্য দশবারোটা টাকার ব্যাপার। বুঝলে? আব্বা কিছুতেই ওপথে যাবেন না। সেই শালা নিমু কবরেজের পাঁচন গেলো—অসুখ সারুক আর না সারুক! আচ্ছা, তুমিই বলো তো সানু, ওই গুলঞ্চলতা কি একটা ওষুধ? অ্যাদ্দিন কুসুমগঞ্জে যদি যেতে পারতুম, দেখতে কী হত! দেবীডাক্তারের মতো বড় ডাক্তার তো আর এ তল্লাটে নেই। তাছাড়া ওনার মেজ ছেলে আমার সাথে কিছুদিন কুসুমগঞ্জের হাইস্কুলে পড়েছিল। হেমনাথের কথা তোমায় বলেছি না? সেই যে আমাদের বিয়ের পর এল—লম্বা রোগা ছেলেটি, কুসুমগঞ্জের রসগোল্লা এনেছিল মনে পড়ছে? আর কীসব যেন দিয়েছিল তোমাকে?
কঞ্জুষ বাপ কোনোমতে টাকা খরচ করতে চায় না। ভাবনা কী? সামান্য জ্বরজ্বারি, বড় ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই। নিমুর পাঁচনে এ তল্লাটে সব অসুখ সারছে, ওর না সারার কারণ নেই। ব্যস্ত হোয়ো না বাপু।
হঠাৎ রাতের দিকে কী হয়ে গেল। গা ঠান্ডা বরফ, চোখ দুটো নিষ্পলক। লম্ফের আলোয় ঝুঁকে পড়েছে সাহানা। পাশে কোলের মেয়েটা কাঁদছে।…চুপ চুপ হারামজাদি! দেখতে দে লোকটার কী হল! ওগো, শুনছ? কী হল তোমার? কথা বলছ না কেন?
কোরান পাঠ করছেন শাশুড়ি। বাপখাকি মেয়েটা এতক্ষণে ঘুমোচ্ছে। কিছু না বলেই চলে গেল লোকটা? হয়তো কত কী বলার ছিল, এতদিনে যা বলা হয়ে ওঠেনি—বলতে চেয়েছিল, হয়তো ডেকেছিল সাড়া পায়নি। পোড়া চোখে সে রাতে অমন কালঘুম এসেছিল কোত্থেকে কে জানে! আর দ্যাখো, আমারও তো কত কথা ছিল বলার কিছু বলা হল না!…
সানাই বাজছে মল্লিক বাড়ি। ষোলোবছর আগের সেই নিশুতি রাতের কোরানধ্বনি যেন কেঁপে কেঁপে আত্মপ্রকাশ করছে সানাইয়ের সুরে। মিলনের আনন্দ বিয়োগের বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। কায়েতবাড়ির পেয়ারাগাছে ইস্টিকুটুমটা বারবার ডাকতে থাকে। শিসিয়ে আসে হাওয়া। জলের ওপর পাতা ঝরে ঝাঁকে ঝাঁকে।
মা, ও মা! কী করছ ওখানে? রুবি এসে ডাকছিল।
যাচ্ছি। একটু ফুরসৎ তো দিবি নে তোরা। সংসারে ঘানি টানতে ঢুকেছি, আরাম কি আর পাব? গোরে না গেলে রেহাই নেই।