নিশীথ নগরী – ৫

পাঁচ

এখানকার আস্তানা আমার উঠল, এবার আমায় যেতে হবে, শুনছ অ্যাডলফ? রেনো আর ভালো লাগছে না!

পায়চারি করতে করতে কবি আমার সামনে এসে থেমে গেল। ওর ঠোঁটের কিনারে সেই তরল হাসিটি ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রাউজারের দুই পকেটে দুই হাত পুরে বললে, কেন? কাল রাতে ন্যান্সি তোমায় প্রেম নিবেদন করেনি বলে?

তারপর আবার পায়চারি করতে করতে গেয়ে উঠল:

‘Love them and love them…’

বললুম, না, ভবিষ্যতে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে, তাই—।

অর্থাৎ ভবিষ্যতে দেখা হলে পাছে সে আবার প্রেম নিবেদন করতে আসে, সেই ভরেয়? কিন্তু এবার থেকে নোটগুলো বুক পকেটে না রেখে মোজার ভেতরে রাখতে পারো। অত্যন্ত নিরাপদ জায়গা!

তোমার এই পরিহাসপটুতাই তোমার আকর্ষণ, তা জানি কবি, কিন্তু নোটগুলো বাঁচানো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। অতগুলো লোকের অপমান থেকে ন্যান্সিকেই আমি বাঁচাতে চেয়েছিলুম শুধু।

তার মানে, অতগুলো লোকের অপমান থেকে তাকে বাঁচিয়েছিলে নিজে অপমান করতে! তোমার দান—করা নোট সে নিতে যাবে কেন? পকেটমারা তার পেশা বটে, ভিক্ষে করা তো নয়!…ন্যান্সির কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত জয়, নোটগুলো ফেরত দিয়ে গিয়েছিল বলে নয়—দাতা বলে অহঙ্কার করবার সুযোগ তোমায় দেয়নি বলে!

বললুম, শেষের কথাগুলি বোধ করি ‘মথি—লিখিত সুসমাচার’ থেকে উদ্ধৃত। কিন্তু সোজাকে বাঁকাভাবে দেখলে বুঝতে হবে, দৃষ্টিই গেছে বাঁকা হয়ে।…জীবনের এক—একটি মুহূর্ত নিয়ে মানুষ নিজস্ব এক—একটি ধারণা গড়ে তোলে, সেই ধারণাই তো তার জীবনের সঞ্চয়! সেই ধারণা ভেঙে গেলে তার আর রইল কি? আদিম বর্বরতা বরং সহ্য করা চলে, কিন্তু গিলটি—করা সভ্যতা বারবণিতার মতোই অসহ্য।

কবি হঠাৎ হাততালি দিয়ে বলে উঠল ব্রাভো! তোমার বাকপটুতা, আমার পরিহাস—পটুতার চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয় দেখছি!…কালকের উত্তেজনা তোমার এখনও কাটেনি বোধ হয়, ভারমুথের গুণ একবার পরীক্ষা করে দেখলে পারতে! কিন্তু জয়…, কবি এবার বিছানার ওপর আমার মুখোমুখি হয়ে বসল: ইয়াঙ্কি সভ্যতার তুমি যত খুশি নিন্দা কর ক্ষতি নেই;—আজকের মানুষের এই সভ্যতা যে গিল্টি—করা, তা আমিও জানি বইকি! তা বলে মানুষকে ছোট করে দেখো না, এই নকল সভ্যতার চেয়ে মানুষ ঢের বড়—ঢের ভালো। কাল রাতে যে—ন্যান্সি তোমার পানে ফিরে তাকায়নি, যে—ন্যান্সি তোমার পকেট থেকে নোট চুরি করতে গিয়েছিল, তাকেই তুমি আজ সত্যি বলে ভাবছ! আর, সেই চাঁদের রাতে—যে রাতে সেই হোটেলের নাচের আসরে তোমাদের প্রথম আলাপ—সে রাতে ন্যান্সি তোমায় তার যৌবনের কয়েকটি যে মুহূর্ত উপহার দিয়েছিল, সেই মুহূর্তগুলি হয়ে গেল মিথ্যে! কালকের ন্যান্সির পানে তাকিয়ে তুমি সে রাতের ন্যান্সিকে নাই বা অবিশ্বাস করলে, জয়? কে সত্যি আর কে মিথ্যে, সে ধারণায় তোমার ভুল থেকে যেতে পারে।

বললুম, তর্ক আজ আর আমি করব না অ্যাডলফ। আমি কেবল বলছিলুম যে, আমার যাবার সময় হয়েছে। আমার কাছে রেনোর আর কোনো মোহ নেই।

আমার কাঁধে একখানি হাত রেখে কবি বললে, যাবে কোথায়?

কিছুই ঠিক করিনি। যেদিন এখানে এসেছিলুম, সেদিনও কিছু ঠিক ছিল না। পথই আমার পথ চিনিয়ে দেবে।

তবে তোমায় আটকাব না। —আমি আছি তোমার পাশে। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় বল দিকি?—মিনিটখানেক ভেবে কবি আবার বললে, পরশু খবরের কাগজে দেখেছিলুম, ‘গ্রিনউইচ ভিলেজ’—এ একটা কার্নিভ্যাল পার্টি এসেছে, তারা লোক খুঁজছে। চলো না, তাদেরই দলে ভিড়ে যাওয়া যাক।

বললুম, বেশ, সেখানেই চলো। কবে যাবে, কখন?

ওভারকোটটা গায়ে দিতে দিতে কবি জবাব দিলে, আজই—এখুনি। ছেড়ে যেতেই যদি হয়, তবে আর দেরি কেন?

ন্যান্সির ফেরত দেওয়া নোটগুলো কাল কুড়িয়ে আনিনি। ককটেল—এর বিল চুকিয়ে কবির পকেটে যা আছে, তাও যৎসামান্য। তবু, দুজনের পকেট হাতড়ে যা মিলেছে, গ্রিনউইচের ভাড়া তাতেই কুলোবে।

দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। তুষার—ঝরা থেমে গেছে, তার বদলে সকাল থেকেই নেমেছে ঘন কুয়াশা। কুয়াশা—ধূসর বিষণ্ণ রেনোকে আজ বৃদ্ধা গণিকার মতোই কুৎসিত লাগছে। বিদেশে রেনোই আমায় প্রথম আতিথ্য দিয়েছিল, রেনোই আমায় ফের পথে বের করেছে। তবু, দীপ নেভা কয়েকটি উৎসব—রাত্রির কথা স্মরণ করে টুপি খুলে, মনে মনে বললুম, গুড বাই!

কবি কিন্তু একটিবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। যাকে ও ছেড়ে যায়, তাকে এমনি করেই ছাড়ে। রেনোকে ও ভুলে গেছে, ভুলে গেছে বার্থাকে, হয়তো ক্লডেটকে পর্যন্ত! এগিয়ে চলতে চলতে গুনগুনিয়ে গান ধরেছে:

 দূর থেকে ফের হাতছানি দিল

 নতুন তীর,

 বনহংসী গো, কোথায় আবার

 বাঁধবে নীড়?

ছয়

গ্রিনউইচ ভিলেজ।

গ্রিনউইচ ভিলেজ—এ যখন পৌঁছলুম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ছোট মফঃস্বল শহর। স্টেশনের ধার ঘেঁষে কার্নিভ্যালের তাঁবু পড়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকেই দেখা যাচ্ছে আলোর জৌলুস। কানে আসছে বিচিত্র কলরব। কার্নিভ্যালের দর্শনী কিন্তু সস্তা—দু’ সেন্ট মাত্র। দুজনে ঢুকে পড়লুম। ভেতরে রং—বেরঙের বেলুন, টিনের ভেঁপুর আওয়াজ, ‘মেরি গো রাউন্ড’—এর কনসার্ট, গ্রাম্য নরনারীর ভিড়। প্রকাণ্ড এই গোলঘরের মধ্যে সারা শহরের জনতা যেন আবর্তিত হচ্ছে।

ফটকের ভেতরে পা দিয়ে কবি বললে, তুমি যাও ডান দিকে, আমি বাঁয়ে। দেখা যাক, কার সঙ্গে ভাগ্যের দেখা হয়!

ফেরবার সময় আবার এই ফটকের কাছেই দুজনের দেখা হয় যেন।—বলে ভিড়ে গা ভাসিয়ে দিলুম।

দু’ধার থেকে শুরু হয়েছে খাবারের দোকান, কফিখানা, শৌখিন খেলনার স্টল, তারপর সারি সারি খাকি রঙের মোটা চটের পর্দা ঘেরা ছোট ছোট ঘর। তারই মধ্যে বিচিত্র অনুষ্ঠান: ম্যাজিক, নাচ, আরো অনেক কিছু। জনসাধারণের জন্য নয়, বিশেষ দর্শনী যারা দিতে পারে, কেবল তাদেরই জন্য। দেখে, আমাদের গাঁয়ে চণ্ডীতলায় মেলার কথা মনে পড়ল।

ভেসে ভেসে চলেছি। মাঠের মাঝখানে ঘুরছে, ‘মেরি গো রাউন্ড’—এর রং করা কাঠের ঘোড়া আর দুলছে নাগরদোলা। এপাশে চলেছে ‘হেল্টার—স্কেল্টারে’র খেলা, অনেকে বলে, Joy Ride। উঁচু ঢালু একটা মসৃণ কাঠের তক্তা বেয়ে লোকেরা পিছলে এসে পড়ছে নিচেকার নরম খড়ের গদির ওপর—একসঙ্গে অনেকে ঠাসাঠাসি করে। ভঙ্গিটা নীতিবাগীশদের দৃষ্টিপীড়ার কারণ হতে পারে। অল্পবয়স্কা যুবতীদের ভিড়, দেখলুম, এইখানেই বেশি, সঙ্গে অবশ্য দু’একটি করে ‘বয়—ফ্রেন্ড’ আছেই।

আরো খানিকটা এগোতেই খানিকটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লুম। পর্দা—ঘেরা একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জিপসি পোশাক পরা একটি বুড়ি মোটা ভাঙা গলায় বলছিল: অন্ধকারে কোথায় ছুটে চলেছ একলা? পাশে তোমার বন্ধু রয়েছে, তাকে চেন? চেন না? জীবনে তুমি সুখ খুঁজে পাওনি, অথচ সে তোমায় কালই সোনার খনির সন্ধান দিতে পারে, এনে দিতে পারে তোমার হারানো প্রেমিকাকে। …এসো, এসো, আমার কাছে এসো, সেই বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই…

দাঁড়িয়ে পড়লুম, কথাগুলো অদ্ভুত শোনাল। বুড়ি হঠাৎ আমার সুমুখে এগিয়ে এসে বললে, পাবে, যাকে খুঁজছ, তাকে পাবে তুমি।

অবাক হয়ে শুধোলুম, কাকে খুঁজছি বলো তো?

হেসে বুড়ি বললে, কাকে আবার! তোমার সেই বন্ধুকে—ভাগ্যকে।

পাব! কোথায়?

পাবে বইকি। সন্ধান বলে দেব, এসো, এসো।—বলে, বুড়ি আমায় টেনে নিয়ে গেল তার পর্দা—ঘেরা ঘরের ভেতর। বিশেষ কিছু নেই, একটা টেবিলের ওপর শুধু একটা মড়ার খুলি, আর মুখোমুখি দু’খানা চেয়ার। আমায় বসতে বলে বুড়ি মড়ার মাথাটা দেখিয়ে বললে, জীবনের স্পষ্ট সত্য এই! ..ভারি অদ্ভুত লাগছে, না? এইমাত্র বাইরে দেখে এলে হাসি, আমোদ, রূপ, যৌবন—দেখে এলে কত নতুন মুখ, অথচ সবারই তলায় রয়েছে এই কঙ্কাল!

বহু পুরাতন সেই মড়ার খুলিটার শূন্য অক্ষিকোটরের পানে চেয়ে চেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলুম। বললুম, ভাগ্যের দেখা পাব কেমন করে, তা তো বললে না!

বুড়ি আমার সামনে বসে বললে, তিনটি প্রশ্ন আমার করতে পার—যে কোনো প্রশ্ন। তবে, আমার ফী দিতে হবে বারো সেন্ট।

পকেট হাতড়ে দেখি, সামান্য কিছু খুচরো পড়ে রয়েছে। বললুম, অত নেই, মাত্র পাঁচ সেন্ট আছে। আমি তাহলে যাই—

উঠতে যাচ্ছিলুম, বুড়ি আমার হাত ধরে বসিয়ে বললে, আচ্ছা, পয়সা না হয় নাই দিলে, খানিকক্ষণ গল্প করে যাও না। দেখো, আজ তিনদিন কার্নিভ্যাল খেলা হয়েছে, কিন্তু এদিকে কেউ আসে না। সবাই ভিড় করে ওদিকে, যেখানে নাচ, গান, হাসি হুল্লোড়! আমি এখানে শুধু মড়ার খুলি আগলে বসে থাকি—একা, একা। হ্যাঁ, কি জানতে চাও বলো?

আমার ভবিষ্যতের কথা জানতে চাই—বললুম।

বুড়ি আমার ডান হাতখানা তার চোখের সামনে টেনে নিয়ে রেখাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তারপর বললে, তোমার হাতে দুটো রেখা দেখতে পাচ্ছি, একটা উজ্জ্বল, আরেকটা অন্ধকার। উজ্জ্বল রেখাটি তোমার সুখ, আনন্দ—আর অন্ধকার রেখাটি তোমার দুঃখ, ব্যর্থতা!

হাসি পেল, এ আর এমন নতুন কথা কি? আনন্দ আর দুঃখ তো সবারই জীবনে আছে। আবার, প্রশ্ন করলুম, জীবনে আমি কি চাই বলো তো?

ঠিক এই প্রশ্নই তুমি করবে ভেবেছিলুম।—বুড়ি বলতে লাগল: তোমার বয়সী অনেক ছেলেই জানতে চেয়েছে, তারা কি চায়? আমি তাদের কাউকে বলেছি, টাকা, কাউকে বলেছি খ্যাতি, কাউকে বা সুন্দরী মেয়ে। তুমি?…তুমি চাও প্রেম। কেমন ঠিক নয়?

বুড়ির কথা শুনে যে কোনো যুবকের খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু আপাতত একটা চাকরি জুটলেই খুশি হই। তবু বুড়ির কথায় সায় দিয়ে বললুম, ঠিক বইকি!

বুড়ি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বললে, আমার গণনা মিথ্যে হয় না। দেখ, সবাই চায় সুন্দরী মেয়ে, প্রেম চায় না কেউ। তুমি অবিশ্যি তাদের দলে নও। …আমি জানি, কিসের খোঁজে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ। কিন্তু পাবে তুমি, পাবে। তোমার হাতে এই যে কালো রেখা দেখছ—এই রেখাটি যখন একেবারে মুছে যাবে, তখন হবে তোমার জীবনে সূর্যোদয়। সেদিন আসবে মেয়ে অনেক ভালোবাসা নিয়ে, ভারি ভাগ্যবান ছেলে তুমি!

এবার বুড়িকে আমার পাঁচ সেন্টই পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। জীবনে বহু নারীর ভালোবাসা পেতে পারি বলে নয়—আমরা—বিংশ শতাব্দীর ছেলেমেয়েরা—বস্তু—তন্ত্রবাদের যুগে বাস করেও মনে মনে যে আজও স্বপ্নবিলাসী, বুড়ি তা ধরে ফেলেছে বলে। কিন্তু এই পাঁচ সেন্টে রাতের খাওয়াটা আজকে চালাতে হবে। মনোবিলাসের চেয়ে শরীর—ধর্ম যে বড়, আধুনিক সাহিত্যের এই সত্য মাঝে মাঝে স্বীকার না করে উপায় নেই!

বুড়ি বলছিল, যেদিন ভাগ্যকে খুঁজে পাবে, সেদিন আমার স্মরণ কোরো। আমার নাম মারিয়া—মারিয়া পত্রোভিচ।

বললুম, নিশ্চয় মারিয়া, সেদিন তোমায় নিশ্চয় স্মরণ করব। এখন উঠি।—আচ্ছা, এই কার্নিভ্যালের মালিক কে বলতে পার?

মারিয়া বললে, চেনো না? বুড়ো পপ। সেই মালিক।

ও! ধন্যবাদ।

বাইরে বেরিয়ে এলুম। রাতের সঙ্গে সঙ্গে কার্নিভ্যাল জমে উঠেছে। ওদিকে ভিড়, হাসি, কলরব। এদিকটা তেমনি ফাঁকা। কয়েক পা এগোতেই শুনতে পেলুম, একা—একা দাঁড়িয়ে মোটা ভাঙা গলায় বুড়ি মারিয়া আবার ডাকছে: অন্ধকারে কোথায় ছুটে চলেছ?…

ফাঁকা জায়গাটুকু পার হতেই দেখি, একটা ঘরের কাছে লোক জমে উঠেছে অনেক। পর্দার গায়ে বড় বড় লাল হরফে লেখ:

HAWAIIAN ENTERTAIN-MENT

ঘরের সুমুখে একটা উঁচু মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে একটি অল্পবয়সী মেয়ে। নিরাবরণ বললে ভুল হয় না। পরনে রূপালি সার্টিনের ফুলে—ওঠা খাটো ঘাঘরা, আর বুকে শুধু জরির নকশা কাটা সার্টিনের একটা টুকরো বাঁধা, সংস্কৃত কাব্যের নায়িকার মতো। মেয়েটির গলায় পলার মালা, কানে রঙিন কড়ির দুল। ফর্সা মুখের চারপাশে ঘনকালো রুখু চুলের গুচ্ছ অন্ধকারের মতো ছড়ানো। আমরা যে সত্যিই আদমের বংশধর, নগ্নপ্রায় নারীদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তা উপলব্ধি করতে দেরি হল না। খুঁজলে হয়তো এই ভিড়ের মধ্যে দু’চারজন পাদ্রিসাহেবকে পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে!

মেয়েটির পেছনে ম্যান্ডোলা হাতে নিয়ে সাদা পালক লাগানো পোশাকে তিনটি লোক দাঁড়িয়ে। আর দর্শকের সুমুখে এগিয়ে এসে আধাবয়সী একজন জোয়ান পুরুষ মাথার স্ট্র—হ্যাটটা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে বলছিল: ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রব্যক্তিগণ! মিস লু—নিসেন’—এর সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছি। মিস লু এসেছে সুদূর হাওয়াই দ্বীপ থেকে—যে হাওয়াই দ্বীপের মেয়েদের গানে বুনো পশুরা ঘুমিয়ে পড়ে, যে হাওয়াই দ্বীপের মেয়েদের নাচে পরীদের ঘুম ভেঙে যায়! ইউরোপের শহরে শহরে মিস লু—র খ্যাতির সীমা নেই, ইন্ডিয়া তার নামে পাগল, এবার আমরা তাকে ডেকে এনেছি আমেরিকার। হাওয়াই দ্বীপের অপূর্ব নাচ দেখবার সুযোগ পেয়েছে এই গ্রিনউইচ ভিলেজ—মাত্র কুড়ি সেন্টের বিনিময়ে এই সুযোগ কি আপনারা হারাবেন?

কুড়ি সেন্ট! লোকেরা একবার পরস্পরের মুখের পানে তাকালে। টিকিটের দাম শুনে তারা বিশেষ খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। দরজার পাশে বসে টিকিট বিক্রেতা বৃথাই চিৎকার করছিল: Come on gentlemen! Hurry up!…

আধাবয়সী সেই লোকটি এবার স্ট্র—হ্যাট দোলাতে দোলাতে সুর করে শুরু করলে:

 যেথা বনভূমি ছেয়ে যায় এলাচি ফুলে,

 আর সাগরের গানে হাওয়া পড়ে গো ঢুলে,

 সেথা গেয়েছিলে গান তুমি প্রথম প্রেমের—

 সেই হাওয়াই দ্বীপের বনে সাগর—কূলে!

অমনি ম্যান্ডোলায় জাগল সুর আর মেয়েটির দেহে ঢেউ। ভিড়ে এবার চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। সুন্দরী মেয়ের নাচের কাছে কুড়ি সেন্ট যে নিতান্তই তুচ্ছ, এতক্ষণে ওরা বুঝতে পেরেছে! হঠাৎ দেখি, নাচের ফাঁকে মেয়েটি ঘরের ভেতর কখন সরে পড়েছে—ম্যান্ডোলা বাদকের দলও! টিকিট—বিক্রেতা চিৎকার করছে: Hurry up gentlemen, the show beging Jas’ Now !

সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কেনবার জন্য দর্শকদের সে কী প্রাণান্তকর আগ্রহ। দেখতে দেখতে সবাই গেল ভেতরে চলে। আধাবয়সী লোকটি তখন মৃদু হেসে চুরুট ধরাচ্ছে।

সাত

খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিলুম।—আধাবয়সী লোকটা কাঠের প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এসে সেই টিকিট—বিক্রেতাকে প্রশ্ন করলে, কত বিক্রি হল?

টিকিট—বিক্রেতা খুচরো পয়সাকড়ির হিসেব করছিল, টিকিটের শূন্য রিলটা দেখালে শুধু। আধাবয়সী লোকটা খুশি হয়ে একবার শিস দিয়ে উঠল, তারপর বললে, ব্যস, আজকের মতো এই শেষ শো।

স্ট্র—হ্যাটখানা মাথায় দিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফিরে এসে টিকিট—বিক্রেতার গা ঘেঁষে শুধোলে, Hello old donkey! Go tha any tips?

টিপস মানে উপরি রোজগার জানতুম। টিকিট—বিক্রেতা বারকয়েক ঘাড় নেড়ে বললে, নাঃ, আজ কিছু সুবিধে হয়নি।

কাঁধ দুটো একবার নেড়ে লোকটা আবার পা বাড়াল।

.

এমনি সময় অদ্ভুত একটি মূর্তি নাচ—ঘরের দরজার পর্দা ঠেলে প্রায় গড়াতে গড়াতে বেরিয়ে এল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে চেচিয়ে উঠল, সর্বনাশ! সর্বনাশ!

আধাবয়সী লোকটা চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে শুধোলে, What’s up?

হায়, হায়, আমি মারা গেছি—একেবারে মারা গেছি—

ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাসে বাকি কথাগুলো গেল আটকে। এখনো পাঁচ মিনিট কাটেনি। ভেতরে হাওয়াই দ্বীপের নাচ শুরু হয়েছে—ম্যান্ডোলার সুরের ছন্দে শুরু হয়েছে নগ্ন নারীদেহের লীলা—ভঙ্গী, এরই মধ্যে এমন কি সর্বনাশ ঘটল! ব্যাপারটা কিন্তু সুন্দরী যুবতীর নাচের চেয়েও মারাত্মক বলে মনে হচ্ছে। এগিয়ে গেলুম। সেই অদ্ভুত মূর্তিটি দৈর্ঘ্যে বোধ করি, পৌনে চার ফিটের বেশি হবে না। প্রস্থেও ঠিক সমান সমান। লোকটার ঘাড় বলে কিছু নেই, কাঁধের ওপরেই মাথাটা বসানো। গায়ে সেকেলে ধরনের লম্বা ঝুলের কোট, মাথায় গোল টুপি, আর প্রকাণ্ড গ্লোবের মতো প্রকাণ্ড ভুঁড়ির সঙ্কোচন—প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দুলছে মীনে করা ছোট একটি ক্রশ।

ক্ষুদে ক্ষুদে হাত দু’খানা টিকিট বিক্রেতার সামনে নেড়ে লোকটা বলছিল, ঈশ্বরের দোহাই, আমায় ঠকিও না! আমার নোটখানা ফেরত দাও—পাঁচ ডলারের সেই নোট—

এই অবধি বলেই সে হাঁপিয়ে পড়ল। উত্তেজনায় আর ঘন ঘন নিশ্বাসে তার ভুঁড়িতে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে!

আধাবয়সী লোকটা কাছে এসে ফের শুধোলে, অত গোলমাল কিসের? নাচ দেখলে না?

চুলোয় যাক, তোমার নাচ! আমার এদিকে সর্বনাশ হয়ে গেল!…ওঃ, আমি মারা গেছি!—লোকটা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠেছে। ক্ষুদে ক্ষুদে হাত দু’খানা এবার ঊর্ধ্বে তুলে সে বললে, আমায় ঠকালে তোমার ভালো হবে না, ঈশ্বরের কাছে তোমায় পাপী হতে হবে!

আধাবয়সী লোকটা প্রশ্ন করলে, কি হয়েছে, বলো না শুনি।

অতি কষ্টে দম নিয়ে গ্লোবসদৃশ, খর্বাকৃতি লোকটা বললে, নাচ আমার ভারি প্রিয়, বুঝলে? আমি আড়াই সপ্তাহ ‘ট্যাঙ্গো’ নাচ অভ্যেস করেছিলুম।…মিস ব্লু যখন নাচতে শুরু করেছিল…

ব্লু নয়, মিস লু!—আধাবয়সী লোকটা বললে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মিস লু!—খর্বাকৃতি লোকটা বলতে লাগল: মিস লু’র নাচ যখন শুরু হয়েছিল, তখন আমি কেমন আত্মহারা হয়ে পড়েছিলুম, বুঝলে? তারপর পকেট থেকে একখানা পাঁচ ডলারের নোট বের করে টিকিট কিনে ঢুকে পড়লুম—তাড়াতাড়িতে নোটের ভাঙানি নেওয়ার কথা মনেই ছিল না! তা আমার না হয় খেয়াল ছিল না, তাই বলে তোমার এই টিকেট বিক্রেতা নোটখানা গাপ করবে!…কী অন্যায়, কী অন্যায়!

টিকিট—বিক্রেতা আকাশ থেকে পড়ল। চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বললে, পাঁচ ডলারের নোট দিয়েছিলেন! কই, না! আপনার ভুল হয়েছে মশায়।

ভুল!—শিবের তাণ্ডব—নৃত্যে পৃথিবীর মতোই ভুঁড়ি এবার ভয়ানক কাঁপছে। বলল, পয়সা—কড়ির বিষয় হল মার্ক—এর কখনো ভুল হয় না। নতুন কড়কড়ে নোটখানা বের করে দিলুম, আর তুমি বলছ, ভুল হয়েছে!…দাও ভাই, দাও, আমার নোটের ভাঙানি দাও…

আপনি তো বড় মজার লোক মশায়!—টিকিট—বিক্রেতার বিস্ময়ের সীমা নেই: কোথায় নোট, তার ঠিক নেই, আর আপনাকে ভাঙানি দিতে হবে।…গোলমাল করবেন না—যান, শো এদিকে শেষ হয়ে এল!

তাহলে পাওয়া যাবে না! পাঁচ—পাঁচটা ডলার তাহলে সত্যি—সত্যি মারা গেল!…ওঃ!

পাঁচ ডলারের শোকে হল মার্ক—এর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। আধাবয়সী লোকটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, মনটা তার ভিজে উঠেছিল বোধ করি। হল মার্ক—এর কাঁধে একখানা হাত রেখে, নরম গলায় সে বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, নোট যদি তুমি সত্যিই খুইয়ে থাক, তবে সে—ক্ষতি, এসো আমরা ভাগাভাগি করে নিই। এই নাও—, পয়সার বাক্স থেকে এক ডলারের একখানা নোট নিয়ে সে হল মার্ক—এর হাতে গুঁজে দিল: কেমন খুশি তো?

হল মার্ক—এর মুখে এবার হাসি দেখা দিল। পাঁচ ডলার থেকে কুড়ি সেন্ট বাদ দিলে যদিচ চার ডলারের বেশি বাকি থাকে, তবু এক ডলারেই সে খুশি। গদগদ কণ্ঠে ‘ধন্যবাদ, মিস্টার ধন্যবাদ’ বলতে বলতে সে তেমনি গড়াতে গড়াতে আবার নাচঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

আধাবয়সী লোকটা তখন একটি চোখ ঈষৎ কুঞ্চিত করে, টিকিট—বিক্রেতার সুমুখে হাত পেতে বললে, Gee Jim, come on with the tips.

টিকিট বিক্রেতা আস্তে আস্তে তার কোটের আস্তিনের ভেতর থেকে একখানা নোট বের করে সেই প্রসারিত হাতের ওপর রেখে দিলে। নোটখানা পাঁচ ডলারেরই বটে! হল মার্ক সেখানা দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারত! আধাবয়সী লোকটা নোটখানা নিঃশব্দে ট্রাউজারের পকেটে পুরে ফেলল। টিকিট—বিক্রেতা শুধোল, আমার ভাগ?

লোকটি তেমনি ঈষৎ—কুঞ্চিত চোখে তার পানে চেয়ে বললে, একাই দাও মারবার চেষ্টায় ছিলে, না?…এ নোট আমার। (তারপর আমার দিকে তাকিয়ে) এখানে দাঁড়িয়ে কেন? কি চাও?

বললুম, বিশেষ কিছু না। পপ—এর ঘরখানা দেখিয়ে দিতে পার?

পারি বইকি। কি দরকার?

কাগজে দেখছিলুম, কার্নিভ্যালের জন্যে লোক চাই—

ও, কাজের সন্ধানে এসেছ।—লোকটা একবার আমার আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে নিল: জাতে কি? মেক্সিকান?

আমার সরু নাক আর তামাটে রং দেখে আমার মেক্সিকান বলে ঠাওরানো কিছু বিচিত্র নয়। বললুম, না, ইন্ডিয়ায় আমার বাড়ি।

ইন্ডিয়া! সে যে অনেক দূর! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ বুঝি?…দেখো, এই কার্নিভ্যাল বড় সুবিধের জায়গা নয়, টিঁকে থাকতে পারবে তো? আজ এখানে, কাল সেখানে—

বললুম, ভবঘুরে—জীবন আমার নেশা।

হুঁ। আচ্ছা, চল পপ—এর কাছে যাই।

আট

প্রকাণ্ড মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে ছোটখাটো একটা আলাদা তাঁবু। কার্নিভ্যালের কলরব থেকে দূরে বুড়ো পপ সেখানে একলা থাকে। আধাবয়সী লোকটা আমায় সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। দেখি, টেবিলের সামনে ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসে ছোটখাটো একটি মানুষ আরেকজনের সঙ্গে নিবিষ্ট মনে দাবা খেলছে। চওড়া কিনারাওয়ালা প্রকাণ্ড টুপির ছায়ায় তার মুখ চোখে পড়ে না, লম্বা পাইপের আগাটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে। কাঁচা তামাকের কড়া গন্ধে ঘরটার যেন দম আটকে গেছে।

আমরা যে ঘরে ঢুকেছি, তারা বোধ করি টের পায়নি। আধাবয়সী লোকটা এগিয়ে গিয়ে বললে, এই ছোকরাটি এসেছে—

চওড়া টুপি এবার কপালের ওপর উঁচু হয়ে উঠল। ছোটখাটো সেই মানুষটির চেহারা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলুম। বয়স হয়েছে বিস্তর, কপালের রেখায় রেখায় সুদীর্ঘ জীবন—যুদ্ধের ইতিহাস লেখা। ছোট করে ছাঁটা পাকা দাড়ি, ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে জমকালো একজোড়া গোঁফ চিনেদের বেণীর মতো ঝুলে পড়েছে—কাঁচা তামাকের ধোঁয়ায় তার অনেকখানি হয়ে গেছে কটা রঙের। লোকটির ছোটখাটো শরীরের সঙ্গে এই জমকালো গোঁফ জোড়াটি ঠিক ব্যালান্স রাখতে পারেনি। ঘন সাদা ভুরুতে চোখদুটো প্রায় আচ্ছন্ন। মুখে ওক—কাঠের বহু পুরাতন একটা লম্বা পাইপ।

বুঝলুম, এই বুড়ো পপ।

বুড়ো মুখে তুলে আধাবয়সী লোকটাকে শুধোলে, খবর কি জো? কাজ ঠিক চলছে তো?

জো ঘাড় নেড়ে বললে, হ্যাঁ, ওল্ড পপ। এই ছেলেটি এসেছে—

ও!—বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল: দাবা খেলায় ওস্তাদ বুঝি? তা বেশ, বেশ। বসো হে ছোকরা, বসো—এই দানটা শেষ হলেই তোমার সঙ্গে খেলব।—তারপর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশে: উঁহু, হল না, ঠিক চাল হয়নি। গজ ও ঘরে দিলে এদিকে কিস্তি পড়ে যাবে যে!

বুড়ো আবার খেলায় ডুবে গেল। আচ্ছা খেয়ালি লোক তো! জো আরেকটু কাছে সরে গিয়ে বললে, একটা দরকারি কথা বলতে এসেছি, ওল্ড পপ, শুনতে পাচ্ছ?

বুড়ো হঠাৎ চটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আঃ জো, আমায় কি এক মিনিটও বিশ্রাম করতে দেবে না! কেবল দরকার আর দরকার!

ধমক খেয়ে জো কিন্তু দমল না। বললে, এই ছোকরাটি দাবা খেলতে আসেনি। তবে এখানে কেন?

এসেছে কাজের সন্ধানে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, আমাদের ক্যার্নিভ্যালের জন্য লোক দরকার, তাই—

জো, তুমি আমায় পাগল করবে দেখছি।—রাগে ঘনঘন পাইপে টান দিয়ে বুড়ো তামাকে ধোঁয়ায় ঘরটা অন্ধকার করে ফেললে: সকাল থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশজন এসে চাকরির জন্যে আমার খেলা মাটি করে দিয়ে গেছে, আবার—লোক আমি রাখব না, যাও!—বুড়ো আবার দাবার ছকের ওপর ঝুঁকে পড়ল: আহা—হা ঘোড়া মারা পড়বে যে!

জো একবার কাঁধ দুটো নেড়ে, আমার পানে তাকাল। তার মানে, হল না! তোমার বরাত খারাপ। …কথাটা নতুন নয়, ভাগ্যের সঙ্গে আমার বরাবরই আড়ি। কিন্তু চাকরিটা এত সহজে ফসকালে তো চলবে না। আমেরিকার ভিখিরিদের পকেটেও পাঁচ সেন্টের বেশি থাকে। কাজ একটা জোগাড় করতেই হবে, নইলে কাল থেকে প্রায়োপবেশন।

জো—র ভরসা ছেড়ে দিলুম। বুড়োর সুমুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললুম, আঙ্কল পপ, আমায় তুমি চিনতে পারছ না?

ঘন ভুরুর আড়াল থেকে বুড়ো আমার মুখের পানে চেয়ে রইল। চোখে তার তীক্ষ্ন সন্দেহ। খানিকক্ষণ পরে ঘাড় নেড়ে বললে, না বাপু, চিনতে পারছি না। কে তুমি?

আমি? তোমার যে ছোট বোন ছিল—স্টেলা, আমি তারই ছেলে।

বুড়ো ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, আমার বোন! আমরা তিন ভাই শুধু। বোন—টোন কেউ নেই তো!

বললুম, তোমার সহোদরা নয়, খুড়তুতো বোন, মনে পড়ছে না?

উঁহু।—ঘাড় নেড়ে বুড়ো বললে, মনে পড়ছে না। তোমার মতলব ভালো নয় দেখছি।

গম্ভীর হয়ে বললুম, তুমি সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছ আঙ্কল পপ। নইলে তোমার অত আদরের বোন স্টেলা, তার কথা তোমার মনে নেই!

বার্ধক্যের প্রতি কটাক্ষ করায় বুড়ো বোধ হয় মনে মনে অপ্রতিভ হয়ে উঠল। বললে, এবার মনে পড়ছে বটে। তবে, তার নাম তো স্টেলা নয়, ক্যাথরিন।

আরেকটুকু হলেই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলুম, এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। যাক, নাম না মিলুক, বোন তো মিলেছে! বললুম, তুমি আদর করে ডাকতে ক্যাথরিন বলে।

ও! তাই বলো। আমাদের ক্যাথরিন? ছোটবেলায় যার ঘাড়ে একটা ফোড়া অপারেশন করা হয়েছিল?

অ্যাপেন্ডিসাইটিসও হতে পারে, কে জানে! তবু সায় দিয়ে বললুম, হ্যাঁ।

লিপজিগের এক সার্জেন্টকে সে বিয়ে করেছিল, না?

তোমার স্মরণশক্তি কী ধারালো, আঙ্কল পপ!

বুড়োর চোখ থেকে সন্দেহের ছায়া গেল মিলিয়ে। নরম গলায় বললে, ক্যাথরিনের ছেলে তুমি! বটে, বটে! কি নাম তোমার?

কবির দেওয়া নামই ব্যবহার করলুম। বললুম, জয়। আমায় তুমি খুব ছোটবেলায় দেখেছিলে কিনা, চিনতে পারোনি।

ওঃ, কতদিনের কথা সে!—বুড়োর চোখে স্মৃতির স্বপ্ন ঘনিয়ে এল: আমি তখন তোমার চেয়েও ছোট, জয়, ক্যাথি আর আমি রোজ সকালে যেতুম ইস্কুলে, আর দুপুরবেলা মাঠে মাঠে প্রজাপতি ধরে বেড়াতুম।—বুড়ো খামোকা চটে উঠল: তুমি তো আচ্ছা লোক জো! ক্যাথির ছেলে এসেছে, আমায় এতক্ষণ বলোনি? জানো, ওর শরীরে রয়েছে আমার বংশের রক্ত—পবিত্র জার্মান রক্ত।

বললুম, জো কি করে তা জানবে বলো?

ব্যাপার দেখে জো অবাক হয়ে গিয়েছিল। আমায় বললে, তবে যে একটু আগে বললে, তুমি ইন্ডিয়ান!

বিপদ বাধালে দেখছি! তাড়াতাড়ি বললুম, ইন্ডিয়ায় আমি বহুদিন কাটিয়েছি যে। বলি শোনো, ১৯০৮ সালে আমরা লিপজিগ থেকে মাদ্রিদ যাচ্ছিলুম। সেই সময় ভীষণ টাইফুনে আমাদের জাহাজ—ডুবি হল—খবরের কাগজে পড়েছিলে নিশ্চয়! (ঝড়টা কাল্পনিক হলেও বুড়ো ঘাড় নেড়ে সায় দিলে) জাহাজ ডুবির ফলে আমার বাপ—মা, আরো অনেক যাত্রী মারা পড়ল। দৈবাৎ বেঁচে গেছলুম আমি। তখন নিতান্ত শিশু! একটা পিপের মধ্যে আটকে গিয়ে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে চলেছি, এমন সময় আরেকটা জাহাজের একজন মাল্লা আমায় তুলে নেয়, তারপর নিয়ে যায় ইন্ডিয়ায়।

আমার গল্প শুনে পপ আর জো দুজনেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বলতে লাগলুম, বাপ—মা হারিয়ে আমি তখন একা, অসহায়! মানুষ হলুম ইন্ডিয়ার এক মিশনারি বোর্ডিং—এ। বড় হয়ে ভাবলুম, লিপজিগ—এ ফিরে যাই, কিন্তু সেখানে আমার কে—ই বা আছে! ছোটবেলায় মা’র মুখে আঙ্কল পপ—এর কথা শুনেছিলুম, কিন্তু কোথায় সে আছে, তাও জানতুম না। তারপর গ্রিনউইচ ভিলেজ—এর এই কার্নিভ্যালে কাজ খুঁজতে এসে দেখা!

বুড়োর চোখ দুটো ছলছল করছিল, ভেজা গলায় বললে, তুমি আজ থেকে এইখানেই থাকো জয়। আমার কাছে।

বেশ, তোমার কাছেই থাকব, আঙ্কল পপ।…আমায় দাবা খেলা শিখিয়ে দেবে? দাবা—খেলার ভারি ঝোঁক আমার।

বুড়ো অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল। বললে, নিশ্চয় ডার্লিং! তোমায় আমি চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় তৈরি করে দেব।

সোডার বোতলের মতো পেটের মধ্যে হাসি ঘুলিয়ে উঠছিল। তাড়াতাড়ি বললুম, আচ্ছা, আমি এখন কার্নিভ্যাল থেকে বেড়িয়ে আসি, তারপর খেলা শিখব।

.

বাইরে এলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম। যাক, ফাঁড়া কেটে গেছে। কিন্তু মনে মনে কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধছিল। বুড়োর স্নেহপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে এমন প্রতারণা নাই বা করলুম।

আমার তো একটা হিল্লে হল, এইবার কবির খোঁজ নিতে হবে। এত বড় কার্নিভ্যালের জনতায় মিশে কোথায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে জানে! পকেটে তার পাঁচ সেন্টও নেই জানি, তবু হয়তো কোনো নতুন বার্থা বা নতুন ক্লডেটকে সে এখন কবিতা শোনাচ্ছে!

আমার সঙ্গে সঙ্গে জো বেরিয়ে এসেছিল। চলতে চলতে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, দেখো, হল—মার্কা এর সেই নোটের কথা পপ—এর কানে না তোলাই ভালো। নোটখানা তাকে ফিরিয়ে দেব বলেই নিয়েছি।

এখন আমি পপ—এর ভাগ্নে, সুতরাং. . . মনে মনে হেসে বললুম, কিছু ভেবো না, ও—সব আমার জানা।

পপ—এর তাঁবু থেকে খানিকটা এগোতেই দুটি লোকের সঙ্গে দেখা। একজন বয়স্ক; হাত বাড়িয়ে বোধ করি গ্যাসের আলোয় সিগারেট ধরাতে পারে—এমনি ঢ্যাঙা। তার গলার সঙ্গে অনায়াসে রিজাফের তুলনা দেওয়া যায়। এর পাশে হল মার্ক—এর চেহারা মনে পড়ল। বিধাতার আঁকা দুখানি কার্টুন! বয়স্ক লোকটির সঙ্গে সতেরো—আঠারো বছরের একটি ছোকরা।

জিরাফ—গলা লোকটি শুধোল, এই কার্নিভালের ম্যানেজার কে?

জবাব দিলে জো। বললে, জো ক্র্যাবি।

কোথায় সে?

আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।

জিরাফ গলা লোকটি মিনিটখানেক চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ বোমার মত ফেটে উঠল : জোচ্চচুরির আর জায়গা পাও নি, ঠগ কোথাকার! ভাল মানুষদের এমনি করে ঠকিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছ। কার্নিভ্যালের নামে ছেলে ধরা ফাঁদ পেতে রেখেছ!

ব্যাপার কি?—অকস্মাৎ এই আক্রমণে জো হতভম্ব হয়ে পড়েছে।

জিরাফ—গলা লোকটি তখন কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছে : জানো, আমি আমি কে? উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্ক মগ্যান—টোরোণ্টোর সবচেয়ে নামজাদা বাসিন্দা। জানো, আসছে বছর আমি শহরের শেরিফ হতে পারি? আর আমার ছেলেকে তোমরা ঠকাতে চাও!. . . কী দুঃসাহস তোমাদের। জানো—

ভারতবর্ষের খেয়াল—গায়কদের মতই মিঃ মর্গ্যানের দম যেন অফুরন্ত। জো এবার বাধা দিলে। বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে বললে, জানি বইকি, ভাবি শেরিফ মশায়! কিন্তু কি হয়েছে, অনুগ্রহ করে, এইবার খুলে বলুন।

মিঃ মর্গ্যান অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলে উঠল, চালাকি করছে কেন? এই কার্নিভ্যালে কাল আমার ছেলের একটা ওপেনের আংটি খোয়া গেছে, জানো না? ভালো চাও তো আংটিটা ফেরত দাও শিগগির—

বাই জোভ! আমি কিচ্ছু জানি না। কে নিয়েছে?

তোমাদের এক নাচওয়ালি মেয়ে। কি নামটা তার, জিমি?

ছেলেটা উত্তর দিলে: লু নিসেন।

জো ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললে, লুনয়েছে! অসম্ভব! লু তেমন মেয়েই নয়। হয়তো ভিড়ের মধ্যে আংটিটা কেউ আঙুল থেকে খুলে নিয়েছে…আপনি মিছে আমাদের ওপর চটছেন মিস্টার মর্গ্যান!

মিঃ মর্গ্যানের ঠোঁটে বাঁকা হাসি দেখা দিল। গলা একেবারে খাদে নামিয়ে বললে, তবে আদালতের রাস্তাই ধরতে হল। কিন্তু আমার জিনিস হজম করা কঠিন। আমি হচ্ছি উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্ক মর্গ্যান—টোরোন্টোর সবচেয়ে নামজাদা বাসিন্দা।

ছেলেকে নিয়ে উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্ক মর্গ্যান চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে জো ডাকলে, শুনুন, শুনুন মিস্টার মর্গ্যান! আংটি যদি সত্যিই লু নিয়ে থাকে, তবে এখুনি আদায় করে দিচ্ছি।—যাও তো জয়, লু—কে ডেকে নিয়ে এসো তো। বোধ হয় এতক্ষণে তার শো শেষ হয়ে গেছে। ওই লাল রঙের তাঁবুটা লু—র। বলো গে, জো ডাকছে, এখুনি এসো।—তারপর কানের কাছে মুখে এনে: আংটিটাও নিয়ে আসতে বোলো।

বুঝলুম, এবার পাঁচ ডলার নয়, জো এবার বড় গোছের টিপস মারবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু লু—হাওয়াই দ্বীপের সেই সুন্দরী মেয়েটি, সে—ও তাহলে—

নয়

বুড়ো পপ—এর আস্তানা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে সেই লাল রঙের তাঁবু। ভেতর থেকে গানের আওয়াজ আসছিল। মেয়েলি গলার সুর। ঢুকব কি ঢুকব না, ভাবতে ভাবতে পর্দা ঠেলে ভেতরে পা বাড়ালুম।

দেখি, উঁচু একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর লু পা ঝুলিয়ে বসে—গান গাইছে সে—ই। শো এইমাত্র শেষ হয়েছে, এখনো সে নাচের পোশাক ছাড়েনি। পরনে সেই রূপালি সার্টিনের ফুলে—ওঠা খাটো ঘাঘরা, শরৎকালের মেঘস্তূপের মতো ধবধবে বুকে সাদা বিদ্যুৎ—রেখার মতো জরির কাজ করা সাদা সার্টিনেরই সরু একটা টুকরো বাঁধা। গলায় তেমনি দুলছে পলার মালা আর কানে কড়ির দুল। ঘন কালো রুখু চুলগুলি আরো এলোমেলো। তার দু’পাশে প্যাকিং বাক্সে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই ম্যান্ডোলা—বাদকদেরই দুজন, তৃতীয় লোকটি মেঝের ওপর পা ছড়িয়ে বসে ম্যান্ডোলার তারে টুংটাং শব্দ তুলছে। লু’র একহাতে রঙিন একখানা রুমাল, আরেক হাতে সস্তা দামের জিন—এর একটা বোতল। পা দুলিয়ে দুলিয়ে লু গাইছিল:

এসেছিল পরে’ ছেঁড়া ঢিলে ট্রাউজার,

(চিনতে পারোনি? সে যে মস্ত প্রেমিক)

জমকালো গোঁফজোড়া—যেন কাইজার,

(কার্নিভ্যালের রাজা। ঠিক বটে, ঠিক!)

গানের শেষ লাইনে পুরুষেরাও ধুয়ো ধরেছে। পর্দা ঠেলে ঘরে পা দিয়েছি, লু বোধ করি প্রথমে তা টের পায়নি। হঠাৎ গান গেল থেমে। আমার দিকে হাতের রুমালখানা নেড়ে লু বলে উঠল, এই যে কার্নিভ্যালের রাজা এসেছে— কার্নিভ্যালের রাজা!

তারপর খিলখিল করে হাসি। একরাশ ঠুনকো কাচের বাসন ভেঙে পড়ল যেন। মাতালগুলোও সে হাসির কোরাসে যোগ দিলে। কাঠের মূর্তির মতো আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। বেশ বুঝতে পারছিলুম, শরীরের সমস্ত রক্ত উঠে আসছে আমার মুখে, কানদুটো অসহ্য তেতে উঠেছে।…এ কোথায় এসে পড়েছি আমি?

লু হাসি থামিয়ে আমার পানে চেয়ে আবার বলে উঠল: এসো, এসো, কার্নিভ্যালের রাজা! তুমি নাকি মস্ত প্রেমিক? সত্যি? কিন্তু তোমার গোঁফ কই—কাইজারের মতো জমকালো সেই গোঁফ?

মাতালগুলো আবার হাসির শব্দে তাঁবু কাঁপিয়ে তুললে। লু’র এই অপূর্ব রসিকতার সমঝদার শুধু ওরাই বটে! প্যাকিং বাক্স থেকে লু এবার নেমে আমার দিকে এগিয়ে এল। এল আমার বুকের কাছ ঘেঁষে। আমার শরীর একতাল সীসার মতো ভারি, পা দুটো যেন কে পেরেক দিয়ে মাটিতে এঁটে দিয়েছে। আমার ঠোঁটের কাছে জিন—এর বোতলটা তুলে ধরে মেয়েটা বললে, কোনটা চাও কার্নিভ্যালের রাজা? এই জিন, না—

রুখু চুলের গুচ্ছ একবার দুলিয়ে সে তার মুখখানা আমার মুখের কাছে তুলে ধরলে।

এক সেকেন্ডে কি যে হয়ে গেল, জানি না। চেয়ে দেখি, লু’র হাত থেকে বোতলটা মেঝেয় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তুষারের মতো ধবধবে, তুষারের মতো নরম ওর গালে টকটকে রাঙা পাঁচটা আঙুলের দাগ—হ্যাঁ, আমারই আঙুলের দাগ! আমারই কলঙ্ক ওর গালে রাঙা হয়ে ফুটে উঠেছে।

লু প্রথমটায় হতচকিত হয়ে গেছল, পরমুহূর্তেই কিন্তু সে হেসে উঠল খিলখিল করে। নিশীথ—রাত্রে ট্রেনের হুইসল—এর মতো তীক্ষ্ন সেই হাসি। ব্যাপার দেখে মাতালগুলোর নেশা বোধ করি কেটে গেছল তৎক্ষণাৎ। কুৎসিত গালাগাল দিয়ে, জামার আস্তিন গুটোতে গুটোতে দুজন তেড়ে এল আমার দিকে।

শুয়োরের বাচ্চচা—

এক ঘুষিতে তোকে গ্রিনউইচ পার করে দেব—

ঘুষিটা আমি আটকাবার আগেই লু মাতালটার হাত ধরে ফেললে। ওর চোখের দৃষ্টি কঠিন, সারা শরীর কঠিন। তীক্ষ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, সরে যাও বলছি, জ্যাপ!…চলে যাও এক্ষুনি আমার তাঁবু ছেড়ে…

ওদের আগেই আমি যাচ্ছিলুম বেরিয়ে। পর্দার বাইরে পা দিতেই কানে এল: শোনো, শোনো—

ফিরতে হল। লু অত্যন্ত সহজ গলায় শুধোলে, চলে যাচ্ছ যে! এসেছিলে কেন?

বললুম, জো তোমায় ডাকতে পাঠিয়েছে, তাই এসেছিলুম।

কে? জো ডাকতে পাঠিয়েছে?…আঃ, জ্বালাতন।—লু বিরক্ত হয়ে উঠেছে: কি চায় সে?

এক ভদ্রলোক এসে জোকে বলেছে, তার ছেলের একটা ওপেলের আংটি চুরি গেছে।

তা আমি কি জানি? আমার সঙ্গে আংটির কি সম্পর্ক?…আমি যেতে পারব না, বলগে যাও—

লু তার বাঁ হাতখানি পিঠের দিকে লুকিয়েছিল, কিন্তু আমার চোখ এড়ায়নি। বাঁ হাতের অনামিকায় সোনার একটা আংটি—ওপেল বসানো। লু’র মুখে কি হঠাৎ বিমর্ষ ছায়া নেমেছে?

বললুম, তা হলে জো—কে বলি গে যাই, তুমি আসতে পারবে না।

দাঁড়াও, দাঁড়াও।—তাঁবুর গায়ে হুকে ঝোলানো ডোরাকাটা ছিটের একটা আঙরাখা টেনে নিয়ে লু গায়ে চাপালে, তারপর বললে, চলো—

.

টোরোন্টোর সবচেয়ে নামজাদা বাসিন্দা মিঃ উইলিয়াম ফ্রাঙ্ক মর্গ্যান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখনো ল্যুইস গান চালাচ্ছে। আমাদের আসতে দেখে তাঁর মুখ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল! জিমি চুপি চুপি তার বাপকে বললে, এই যে সেই মেয়েটা।

কিন্তু কাউকে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়েই হাসিমুখে লু সটান ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল: হেল্পো জিমি! কখন এলে? আজকে তুমি আমার নাচ দেখলে না? আমি রাগ করেছি কিন্তু!—মিঃ মর্গ্যানের দিকে তাকিয়ে: তোমার ড্যাড বুঝি? হাউ ডু ইউ ডু?

জিমি বাপের কাছ ঘেঁষে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিল। মিঃ মর্গ্যানও এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার গর্জন করে উঠল, তুমি আমার ছেলের আংটি চুরি করেছ? জানো, আমি কেস—

লু দু’পা পিছিয়ে এল। গভীর বিস্ময়ে চোখদুটো। বড় বড় করে বললে, কোন আংটি?—লু তার বাঁ হাতখানা সবার সামনে তুলে ধরলে। অনামিকায় দামি ওপেলের টুকরোটা রাতের আলোয় ঝিকমিক করছে: এই আংটির কথা বলছ?

মিঃ মর্গ্যানের মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিল। জোর দিকে কটাক্ষ করে বলে উঠল, এ ব্যবসা কতদিন ধরে চালাচ্ছ ম্যানেজার?

জো গম্ভীর মুখে শুধোলে, এই আংটিটা তুমি চুরি করেছিলে লু?

চু—রি!…চুরি করেছি!—লু’র গলা কেঁপে গেল: তোমার মনে নেই জিমি, কাল সন্ধেবেলা আমরা দুজন যখন কার্নিভ্যালের দোকানে বসে চকোলেট খাচ্ছিলুম, তুমি এই আংটিটা আমার আঙুলে পরিয়ে দিলে, তারপর আমার হাতখানা তুলে তোমার ঠোঁটে—এখন বলছ চুরি—

লু’র বড় বড় চোখদুটি জলে ছাপিয়ে উঠল। আংটিটা আস্তে আস্তে খুলে সে জিমির সামনে ধরলে। জিমি বেচারি মুখ কাঁচমাচু করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগে জো বলে উঠল, ও! ছেলেবয়েসের সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার!..নিন মিস্টার মর্গ্যান, আপনার আংটি ফেরত নিন, আংটির সঙ্গে আপনার চুরির চার্জও ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, কিন্তু নইলে…

মিঃ মর্গ্যান লু’র ভিজে চোখদুটির পানে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। আংটিটা নিয়ে বলল, যাকগে, যা হবার হয়েছে। —চল জিমি!

মিঃ মর্গ্যানের গলার স্বর আশ্চর্য রকম মোলায়েম হয়ে গেছে। যাবার সময় আরেকবার আত্মপরিচয় দিয়ে যেতেও ভুলে গেল দেখছি। লু’র গাল বেয়ে তখনো জল গড়িয়ে পড়ছে, জো তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতে লাগল, ছি ছি কেঁদো না। …কেন তুমি যার—তার সঙ্গে ভাব করতে যাও লু?

লু এখনো খুকির মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। কিন্তু টোরোন্টোর সবচেয়ে নামজাদা বাসিন্দার দীর্ঘ দেহ দূরে কার্নিভ্যালের জনতায় মিশে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পট—পরিবর্তন হয়ে গেল।

জো লু’র কাঁধদুটো ধরে এক ঝাঁকানি দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, এখুনি হাতে হাতকড়া পড়েছিল, শয়তানি কোথাকার! ফের যদি এমন বেয়েক্কেলে কাজ করিস তো দূর করে দেব—

লু একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করে বলে উঠল, ইস! …সেলাম ফাদার আব্রাহাম! আংটিটা হাতছাড়া না হলে আধ—বখরা চাইত কে?

জো রুখে উঠল, চুপ, চুপ কর শয়তানি…একি! গালে তোর দাগ কিসের?

চেয়ে দেখি, আমারই কলঙ্ক এখনো লু’র গালে রাঙা রয়েছে। আমার সমস্ত শরীর আবার আড়ষ্ট হয়ে গেল। লু কিন্তু অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিলে, গালের নিচে হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, তাই আঙুলের দাগ রয়েছে।

তারপর তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলে।