নিশীথ নগরী – ৩০

ত্রিশ

ডন তাহলে তোমার প্রথম প্রেম?—শুধোলুম।

ডন!—মিমি হাসল কিনা, ঠিক বোঝা গেল না: ডন হচ্ছে আমার সেই অন্ধকার ছোট ঘরের বাতায়ন, যেখান দিয়ে আমি প্রথম আলো দেখেছিলুম! এগারো বছর আগেকার সেই ক্রিসমাস—সন্ধ্যার দূত হল ডন! কিন্তু ডনকে ভালোবাসতে পারলে আমি সত্যি সুখী হতুম ওজয়! তার মতো সাদাসিধে সোজা ছেলে এখনকার দিনে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। ডন আমায় লিল্যাক—এর যে তোড়া দিয়েছিল সে—ই হল আমার জীবনের প্রথম ফুল, কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ কি জানো ওজয়? সে—ফুলের বদলে তাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি।

জীবনে কাকে তুমি প্রথমে ভালোবেসেছিলে মিমি?

নিজের পানপাত্রে মিমি আরেকটু স্যাঁৎরুজ ঢাললে। কিন্তু মুখে না তুলে বললে, ঠিক এই প্রশ্নই নিজেকে আমি মাঝে মাঝে করি, জানো ওজয়? অনেক রাতে হঠাৎ যখন ঘুম ভেঙে যায়, যখন শুনতে পাই তুষার বিছানো অন্ধকার রাস্তায় দমকা হাওয়ায় পাগলের মতো কাকে যেন ডেকে ডেকে ফিরছে, তখন নিজেকে আমি শুধাই: ‘কে তোমার প্রথম প্রেম মিমি?’…জবাব পাই না! জীবনে আমার অনেক লোকের আনাগোনা, সেই ভিড়ে আমি আমার প্রথম প্রেম খুঁজে পাই না।

স্যাঁৎরুজের গেলাসটি মিমি মুখে তুললে। বললুম, যাক, তার পরের ঘটনা বলো—বাড়ি থেকে মিমি পালাল?

পালাল বইকি—সানফ্রান্সিসকো থেকে শিকাগোতে। রক্তাক্ত কপাল নিয়ে মাতাল বাপ পড়ে পড়ে গোঙাতে লাগল, প্রতিবেশীর ঘরের আড্ডায় মায়ের নির্বোধ খেলো রসিকতা তখনো শেষ হয়নি, কিন্তু ক্রিসমাস ইভ—এর সন্ধ্যা তখন মিমিকে ডাকছে! বাইরে যে অনেক আলো, অনেক ফুল! ডন—এর হাত ধরে মিমি রাস্তায় পা দিল, বুক ভরে নিল নিশ্বাস। মিথ্যে নীতির বিরুদ্ধে সেই তার প্রথম বিদ্রোহ—নিজের স্বেচ্ছা—মৃত্যুর বিরুদ্ধেও বলতে পারো…হ্যাঁ, শিকাগোতে এসে তারা সস্তা একটা সরাইখানায় আস্তানা পাতল। ডন—এর পকেটে সামান্য যা পুঁজি ছিল, দু’দিনেই তা গেল ফুরিয়ে, তবু আরেকটা দিন কাটল ধারে। তারপর আর চলে না। মিমিকে মুক্তি দিয়েছিল ডন, এবার ডনকে মুক্তি দিল মিমি। চার দিনের দিন রাত্রে সরাইখানা তখন নিঝুম—নিঃশব্দে মিমি বিছানা ছেড়ে উঠল। গভীর ঘুমে ডন ডুবে গেছে, মিমির চোখে কিন্তু ঘুম নেই। মোমবাতির ফিকে আলোয় মিমি একবার ঘরের দিকে তাকাল, এক কোণে লিল্যাকের সেই তোড়াটা রয়েছে পড়ে—এই চারদিনেই ফুলগুলো শুকিয়ে হলদে হয়ে উঠেছে! ডনের মুখে ক্লান্তির রেখা! নিচু হয়ে মিমি ঘুমন্ত ডনের কপালে আলগোছে একটি চুমু দিলে, তারপর বিছানার চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে ছায়ামূর্তির মতো বেরিয়ে গেল। আবার পথ, অন্ধকারে ঝিরিঝিরি তুষারবৃষ্টি। পুলিশের নজর এড়িয়ে শিকাগোর নির্জন রাস্তায় একা সেই মেয়েটি ঘুরে বেড়াতে লাগল সারারাত। বাইরে যখন পা বাড়িয়েছে, তখন পথ সে পাবেই!

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মিমি ফের শুরু করলে: সারারাত কখনো রাস্তায়, কখনো পার্কে কাটিয়ে, ভোরের দিকে মিমি এসে দাঁড়াল এক হোটেলের সুমুখে! হোটেলের দরজা সবে খুলেছে, এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে মিমি সটান ভেতরে ঢুকে গেল। প্রকাণ্ড মোটা চেহারার এক বুড়ি তখন চাকরদের সঙ্গে বকাবকি লাগিয়েছে, মিমি, আস্তে আস্তে জানালে, এই হোটেলের মালিকের সঙ্গে সে দেখা করতে চায়। মুখ না ফিরিয়েই বুড়ি চিৎকার করে উঠল, ‘কেন, কেন? সুয্যি না উঠতেই জ্বালাতে এলে কেন শুনি?’ ভাঙা একটা ঘণ্টা যেন বেজে উঠল হঠাৎ। চেঁচিয়ে কথা কইলে বুড়ির মুখের মাংসপেশীগুলো কুৎসিতভাবে নড়ে ওঠে। মিমি ভয়ে—ভয়ে বললে, যা হোক একটা কাজ পেলে সে বেঁচে যায়। গলা তার কাঁপছিল। ভাঙা ঘণ্টা ফের বেজে উঠল, ‘এটা অনাথ আশ্রম নয় বাপু, সরে পড়ো।’ চাকরদের হো হো করে সে কি বিশ্রী হাসি। মিমির পায়ের নিচে মেঝে হঠাৎ দুলে উঠল, হাত বাড়িয়ে একটা কিছু ধরতে যাচ্ছিল, তার আগেই মোটা একখানা হাত তাকে ধরে ফেলল। মিমির সর্বাঙ্গে তুষার জমে উঠেছে, ঠান্ডায় তার মুখ হয়ে উঠেছে নীল। সেই দিকে তাকিয়ে বুড়ি মিনিটখানেক চুপ করে রইল, তারপর বললে, ‘জোসেফ, একে ফায়ার প্লেসের ধারে নিয়ে যাও—’

একটু থেমে মিমি বলতে লাগল, গল্প আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ওজয়।…তারপর সেই হোটেলে মিমি একটা কাজ পেয়ে গেল। ছোটখাটো কাজ—দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের টুপি আর ছড়ি নিয়ে ব্র্যাকেটে সাজিয়ে রাখা। খুশি হয়ে কেউ দু—এক সেন্ট বকশিশ দিত, কেউবা মুখ ফিরিয়ে তাকাতও না। দু’হপ্তা এমনি করে কেটে গেল। মিমির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা এইখান থেকেই। বলছি শোনো, সেদিন কি একটা বিশেষ উৎসব, দুপুরে রঙিন কাগজের ঝুরি দিয়ে মিমি হলটাকে সাজাচ্ছিল, বুড়ি হোটেলওয়ালি ডেকে শুধোলে, ‘নাচ জানিস মেয়ে?’ নাচের ক—খ’ও মিমি জানত না, তবু বুড়িকে খুশি করবার জন্যে উৎসাহে ঘাড় নেড়ে বললে, জানি বইকি! খুশি হয়ে বুড়ি বললে, ‘বেশ বেশ!’ কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, মিমি তা বুঝতে পারেনি। সন্ধের পর বুড়ি তাকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের ঘরে, রংচঙে একটা পোশাক পরতে দিয়ে জানালে, আজকের এই উৎসবে তাকেই নাচতে হবে। শুনে ভয়ে ভাবনায় মিমির সারাদেহ হিম হয়ে গেল, জীবনে সে যে নাচেনি কখনো। কিন্তু তখন আর উপায় নেই। ওদিকে তখন অর্কেষ্ট্রা শুরু হয়ে গেছে। যেন স্বপ্নের ঘোরে মিমি এসে দাঁড়াল হলে।—ঝকঝকে সাদা আলোয়—অনেক, অনেক চোখের দৃষ্টির সামনে। তার রূপালি পোশাকে সাদা আলো অভ্রের কুচির মতো পড়েছে ছিটিয়ে, কোমর থেকে লুটানো রামধনু রঙের সাতটা সরু সিল্কের টুকরো সাত—রঙা আগুনের শিখার মতো কাঁপছে। হলের গুঞ্জন এক নিমেষে থেমে গেল। অর্কেস্ট্রায় তখন বাজছে ‘Blue Donube’ সুর, সে সুর মিমি জানত না, তবু আশ্চর্য, আপনা থেকেই তার শরীরে জাগল ঢেউ, শè#রের রেখায় রেখায় জাগল ছন্দ। নিজেরই অজান্তে মিমি শুরু করে দিল এক অদ্ভুত নাচ। যে নাচের নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি হয়তো ছিল না, তবু তার দেহ—লীলায় যে ছন্দ জেগে ছিল, সুরের সঙ্গে তা আশ্চর্যভাবে খাপ খেয়ে গেল। মিনিট পনেরো বাদে অতিথিদের অভিবাদন জানিয়ে মিমি যখন বিদায় নিলে, সমস্ত হল তখন সেই অচেনা মেয়েটির প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছে। পোশাক বদলে মিমি আবার এসে দাঁড়াল দরজায় পাশে তার সেই পুরোনো জায়গায়। আধাবয়সী লম্বাটে একটি পুরুষ টুপি আর ছড়ি ফেরত নিতে গিয়ে থমকে দাড়াল। মিমির কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলে, ‘এ নাচ তুমি শিখলে কোথায়? মিমি বাধো বাধো স্বরে জবাব দিলে, ‘কেউ শেখায়নি, এ নাচ আমার নিজের তৈরি।’ লোকটির দুই চোখ ঝকঝক করে উঠল, ‘তোমার নিজের তৈরি। বাঃ, বেশ তো। তা তুমি এই হোটেলে পড়ে আছ কেন? জানো, ভাল করে নাচ শিখলে দেশে দেশে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়তে পারে? আমি মার্টিন অগাস্ট, আমার একটা অপেরা পার্টি আছে, যাবে আমার সঙ্গে? তোমায় অভিনয় করতে শেখাব। শুনতে শুনতে মিমির মুখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল, সারা দেহে কেঁপে উঠল উত্তেজনার নেশা। সে—রাতে উৎসব শেষে বুড়ি হোটেলওয়ালি যখন মিমির খোঁজ করল, মিমি তখন অগাস্টের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার পথে—

একত্রিশ

মিমির কথায় পড়ল বাধা, দরজার বাইরে থেকে নাটাশার গলা শুনতে পাওয়া গেল। রাত যে কাবার হয়ে এল মিমি, গল্প তোমাদের আর ফুরোয় না।

সত্যিই রাত কত হল, কে জানে। মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। যে—দেশের আকাশ মিমির চোখের মত গাঢ়—নীল, সেখানে হয়তো তারা নেভবার সময় হয়ে এসেছে। আর এই কুয়াশার দেশে সময় হয়েছে উষ্ণ আগুনের তালে আর পার্শ্ববর্তী উষ্ণ শরীরের তাপে নিশীথ—কামনার স্বপ্ন দেখবার। প্রহরের পর প্রহর কখন যে পার হয়ে গেছে, উপন্যাসের চেয়ে রোমান্টিক মিমির জীবন—কথা শুনতে শুনতে সেদিকে আমারও খেয়াল ছিল না। নাটাশার গলায় আওয়াজে চমক ভাঙল, একটু অপ্রস্তুত বোধ করলুম।

দরজার দিকে তাকিয়ে মিমি জবাব দিলে, বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে থাকার চেয়ে বসে বসে গল্প করা ভালো নয় কি নাটাশা?

নাটাশা বকবক করতে লাগল: একে দিনভর খাটুনি গেছে, তার ওপর ঠায় বসে রাত জাগা! শরীরের ওপর মায়া নেই এতটুকু! …না বাছা, তোমায় নিয়ে আমি আর পারি নে…

মিমি এবার হাসলে। বললে, আজকের রাতটা আমার অবাধ্য হতে দাও নাটাশা, কাল থেকে ঠিক লক্ষ্মী মেয়ে হব দেখো! কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও জেগে আছ কেন, শুনি? যাও, শুয়ে পড়োগ—নইলে এবার তোমায় আমি বকুনি দেব বলছি—

নিজের মনে বকবক করতে করতে বুড়ি চলে গেল।

বললুম, আজ না হয় এই অবধি থাক, গল্পের বাকিটুকু আরেকদিন শোনা যাবে। তুমি আজ সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছ মিমি!

কিন্তু আজকের রাত যদি আর ফিরে না আসে!—মিমির কণ্ঠ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, না, ওজয়, বাকিটুকু তুমি শুনে যাও, গল্প আমার শেষ হয়েই এসেছে।…আরেকটু স্যাঁৎরুজ?

আমার পানপাত্র ভরে দিয়ে মিমি ফের শুরু করলে, হ্যাঁ, সেই রাতে, হল যখন ফাঁকা হয়ে এসেছে, অগ্নিকুণ্ডু এসেছে নিভে তখন বুড়ি হোটেলওয়ালি নিশ্চয়ই মিমির খোঁজ করেছিল। কিন্তু কোথায় মিমি? মার্টিন অগাস্টের সঙ্গে সে তখন ক্যালিফোর্নিয়ার পথে অনেক দূরে চলে গেছে! যেমন করে চলে গিয়েছিল সানফ্রান্সিসকোর মজুর—পাড়ার সেই ব্যারাক থেকে, শিকাগোর সেই ঘুমন্ত সরাইখানা থেকে। পথে যখন মিমি পা দেয়, তখন ফিরে তাকাবার অবকাশ তার থাকে না। নিজেকে নিয়ে তখন তার নতুন এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছে, জীবন নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্টের নেশা মদের চেয়েও তীব্র ওজয়। …যাক, গল্পটা শেষ করি। ক্যালিফোর্নিয়ায় মিনি রইল মাস দেড়েক। মার্টিন অগাস্ট তাকে প্রথমে নাচ শেখাতে লাগল—গ্রাম্য—নাচ ‘মে—পোল’ থেকে শুরু করে শহুরে নাচ ‘ইয়েল ব্লু’, ‘ভ্যালেটা’ পর্যন্ত। নাচের পা যেন মিমির তৈরি হয়েই ছিল, দেড় মাসেই তার আশ্চর্য উন্নতি দেখা গেল। দেড় মাস বাদে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মার্টিন অগাস্টের জাহাজ ছাড়ল—এবার পাড়ি আরো দূরে, মাদ্রিদের পথে। মাদ্রিদ শহরের একটি স্টেজ ভাড়া নিয়ে মার্টিনের ‘টুরিং অপেরা পার্টি’ রোজ সন্ধেয় শো দিতে লাগল। ছোট একখানা অপেরা—In gay Evening। তাতে ফলওয়ালি নিগ্রো মেয়ে সেজে মিমিকে প্রথম স্টেজে নামাতে হল। হাতে ফলের টুকরি, মাথায় রঙিন পালকের টুপি আর মুখে গান: ello oos your lady-friend Johnny ? দু’চার দিনের মধ্যেই মাদ্রিদের কাফে আর রেস্তোরাঁয় প্রতিধ্বনি শোনা যেতে লাগল: Hello, who’s your lady-friend Johnny?’ নর্তকী মিমিকে প্রথমে চিনলে মাদ্রিদ! মাদ্রিদই তার জীবনে এনে দিল প্রথম খ্যাতির স্বাদ।

একটু থেমে মিমি বললে লাগল: মার্টিন অগাস্ট এতদিন তাকে শুধু নাচের ‘লেসন’ই দিয়ে এসেছিল, অভিনয় করতে মিমি তখনো জানত না, চিনতা না পেন্ট আর গ্রিজ, পারত না ওজন করে হাসতে আর কথা কইতে! তখনো মিমি কানের দু’পাশে দুটি বেণী দুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, অপেরা পার্টির লোকেরা গেঁয়ো বলে ঠাট্টা করে, তখনো পর্যন্ত সতেরো বছরের সেই মেয়েটির স্বভাব যেন বনভূমির কাঁচা সুগন্ধে ভরপুর!…কিন্তু গ্রাম্য প্রকৃতি শহরের ছোঁয়াচ লেগে কেমন করে বিষাক্ত হয়ে ওঠে, জানো ওজয়? সেই কথাই বলি শোনো—কেমন করে সতেরো বছরের সেই গেঁয়ো মেয়েটি গেল মরে।—বলতে বলতে মিমির গলা কেঁপে গেল, দুই চোখে নিরশ্রু রোদন উঠল ছলছলিয়ে: একদিন সকালে অপরিচিত একটি বৃদ্ধ মিমির সঙ্গে দেখা করতে এল—অনেক বয়স, চুল ভ্রূ সব তুষারের মতো সাদা। লোকটির নাম গ্যাব্রিয়েল সামারা, প্যারিসের এক বিখ্যাত থিয়েটারের ডিরেক্টর! বুড়ো বললে, মিমিকে তার থিয়েটারের জন্য চায়, তাকে নিয়ে যাবে প্যারিসে। মাইনে হিসেবে হপ্তায় হপ্তায় মিমি যা পারে, তা মিমির ধারণার বাইরে। সে যদি রাজি হয়, তাহলে…

এক্ষুনি…, বলতে গিয়ে মিমি হঠাৎ থেমে গেল। মার্টিনের সঙ্গে তার দু’বছরের চুক্তি, ছ’মাসও কাটেনি এখনো। কিন্তু মার্টিন তার রাস্তা আটকাল না, নিজে মিমিকে গ্যাব্রিয়েল সামরার গাড়িতে তুলে দিয়ে হাসিমুখে বলল, Cheer you, my girl !

তারপর?

তারপর প্যারিস! প্যাশন আর ফ্যাশানের রাজ্য প্যারিস! বুড়ো গ্যাব্রিয়েল সামরা নিজে মিমিকে শেখাতে লাগল অভিনয়। মিমি যখন অভিনয়ের মহলা দিত, সাদা ভুরুর নিচে বুড়ো স্তিমিত চোখ দুটো তখন হঠাৎ জ্বলে উঠত। কিছুদিন বাদে থিয়েটারে একটি নতুন নাটক খোলা হল—’প্যাশন—ফ্লাওয়ার’। মাদাম ফ্যানির ভূমিকায় মিমি প্যারিসকে প্রথম অভিনন্দন জানালে, তুমি তা শুনেছ ওজয়। সমস্ত প্যারিস হয়ে উঠল কৌতূহলী, মাদাম ফ্যানির প্রশংসায় মুখর! ফ্যানির নাম, ফ্যানির গান যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে! সঙ্গে সঙ্গে মিমির জীবনে হল পট—পরিবর্তন! এল খ্যাতি, এল রাশি রাশি ফুল আর উপহার, এল সমস্ত অভিজাত প্যারিস তার দরজায় ভিড় করে। মিমি তখন অভিনয় করতে শিখেছে, জেনেছে পেন্ট আর গ্রিজের ব্যবহার, তার চোখে জেগেছে সঙ্কেত, হাসিতে মোহ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেকআপ করতে করতে মিমি নিজেকে চিনতে পারত না। চিনবে কেমন করে? সতেরো বছরের সেই গেঁয়ো মেয়েটি তখন যে মরে গেছে। অভিনেত্রী মিমির প্রশংসার গানে তার মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি গেছে চাপা পড়ে! এখন রোজ রাতে ক্যাসিনোতে মিমির নামে শ্যাম্পেন ওঠে ফেনিয়ে, আর মিমির প্রেমিকের নামে চলে তর্ক আর শপথ। প্যারিসের প্যাশন মিমি। মিমির নামে সমস্ত প্যারিস উন্মাদ!

হেসে বললুম, প্যারিসের সত্যকার সৌন্দর্যবোধ আছে, বোঝা যাচ্ছে! ট্রয় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল হেলেনের জন্য, পুরাণের ট্রয় এ যুগে নিশ্চয় প্যারিস হয়ে গড়ে উঠেছে!

তাই ট্রয় নগরের সেই আগুনের শিখায়—, মিমি জবাব দিল: ফরাসি সভ্যতা আজো পুড়ে পুড়ে মরছে!—কিন্তু একথা থাক! সেদিন অভিনয় শেষে গ্রিনরুমে এসে মিমি সবে পেন্ট তুলতে বসেছে, এমনি সময় তার হাতে এসে পৌঁছল মস্তবড় একটা ফুলের তোড়া, তার মধ্যে লুকানো একছড়া হীরের নেকলেস আর একটুকরো চিঠি। চিঠিতে লেখা: ‘অমুক ক্যাসিনোতে তোমায় পৌঁছে দেবার জন্যে আমার ব্রুহাম গাড়ি অপেক্ষা করছে।’ চিঠি যে লিখেছিল, তাকে তুমি জানো ওজয়। সে ডিউক, প্যারিসের নামকরা লেডিস—ম্যান।

একটা প্রশ্ন আমার ঠোঁটে এসে পৌঁছেছিল, তার আগেই মিমি অদ্ভুত হেসে বলে উঠল, তুমি যা জানতে চাইছ, আমি তা বুঝেছি। খুব সোজা ভাষায় জবাব দিতে গেলে বলতে হয়, মিমির কয়েক রাত্রির প্রেমের জন্য সবচেয়ে চড়া দাম দিয়েছিল ডিউক। মিথ্যে বলব না ওজয়, ডিউক মন দেওয়া—নেওয়ার খেলার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী বটে! কিন্তু সেই হীরের নেকলেস—সর্বনাশা সেই হীরের নেকলেস কেমন করে বার্ধক্যকে পর্যন্ত হিংসায় হিংস্র আর কামনায় কুৎসিত করে তুলেছিল, এ শুনলে বোধ করি তোমার বিশ্বাস হবে না ওজয়। একদিন রাত্রে হঠাৎ মিমির ঘুম ভেঙে গেল, কার উষ্ণ নিশ্বাসে তার মুখ যেন ঝলসে যাচ্ছে! চোখ মেলে দেখে, তীব্র আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে, বিছানার পাশে তার মুখের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে—গ্যাব্রিয়েল সামারা! নিজের গলা থেকে হীরের নেকলেসটা কেমন করে যে বুড়োর কঠিন মুঠোর মধ্যে এসেছে, ঘুমন্ত মিমি তা টের পায়নি। স্পষ্ট আলোয় মিমি দেখলে, তার সামনে কঠিন লোমশ মুঠোর ফাঁকে বড় বড় হীরের টুকরোগুলি বড় বড় আগুনের ফুলকির মতোই জ্বলছে, আর কপালের লোল চামড়া আর সাদা চুলের নিচেও ঠিক তেমনি দৃষ্টি!—অন্য কোনো মেয়ে হলে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠত নিশ্চয়, কিন্তু মিমি জানত, বুড়ো নেকলেস চুরি করতে আসেনি—এসেছে সেই নেকলেসের অক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে! ধীরে—সুস্থে মিমি বিছানার উঠে বসল। তারপর মিষ্টি একটু হেসে বললে, ‘আমার চুমু তো তোমার দেবই গ্যাব্রিয়েল, কিন্তু তার আগে আমার গলায় ওটা তুমিই পরিয়ে দাও।’ দেখতে দেখতে বুড়োর চোখ দুটো নিভে এল, শিথিল মুঠি থেকে নেকলেসটা খসে পড়ে গেল মেঝেয়, দু’হাতে মুখ ঢেকে বুড়ো ঘর থেকে ছুটে পালাল। সেই রাতে মিমি আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল বহুক্ষণ। সত্যিই সে সুন্দরী! সাপের মতো ধবধবে মসৃণ, শ্যাম্পেনের ফেনার মতো নরম এই আশ্চর্য সুন্দর শরীর নিয়ে সে কী না করতে পারে? পরদিন সকালেই গ্যাব্রিয়েল সামারার থিয়েটার সে ছেড়ে দিল, প্যারিসকে বললে, গুডবাই!

তারপর?

গ্যাব্রিয়েলের থিয়েটার ছেড়ে দিলে তার কি আসে যায়? মিমি জানত তার জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে! তারপর লন্ডন, বার্লিন, আমাস্টার্ডম—শেষকালে আবার নিউইয়র্ক। প্যারিস ছেড়ে সে চলে এল, তবু সঙ্গে সঙ্গে এল খ্যাতির বন্যা, রাশি রাশি ফুল আর উপহার, এল আরো অনেক ডিউক। ক্লাবে আর হোটেলে তেমনি করে ফেনিয়ে উঠতে লাগল মদ। বাতাসে বাতাসে গান হয়ে বাজতে লাগল তার শরীরের—সাপের মতো সাদা আর ফেনার মতো নরম এই শরীরের স্তুতি। ভাষা আলাদা হলেও ওজয়, সে স্তুতির মানে সব দেশেই এক!

কিন্তু রাতের পর রাত ধরে সে—ফুল আর উপহার, সেই স্তুতিই কি মিমি কামনা করেনি?—শুধোলুম।

হ্যাঁ, কামনা করেছিল বইকি। যতদিন সেই স্তুতির মানে সে বোঝেনি, ততদিন। কিন্তু তারপর—আফ্রিকার অসভ্যেরা নরমাংস নিয়ে কেমন আনন্দ করে, জানো ওজয়? কোনো কোনো রাতে ক্লান্ত হয়ে মিমি যখন একা ঘরে ফিরত, তখন অন্ধকারে মনে হত, মুগ্ধ আর লুব্ধ অসংখ্য পুরুষ তার শরীরটাকে ঘিরে তেমনি বন্য উল্লাসে চিৎকার করছে! উঃ, কী অসহ্য সেই একঘেয়ে চিৎকার করছে, তুমি বুঝবে না ওজয়। ঘরের সমস্ত দরজা আর শর্সি এঁটে পাগলের মতো মিমি দুই হাতে তার কান চেপে ধরত। একদিন আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিমির মনে হয়েছিল, আশ্চর্য সুন্দর তার শরীর। কিন্তু আজ যদি সে আয়নায় তার ছায়া দেখে, কি মনে হবে জানো? মনে হবে, সুন্দর শরীরের চেয়ে কুৎসিত পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

মিমির ঠোঁটে শুকনো একটু হাসি দেখা দিল: নিজের ওপর যার ঘৃণা এসেছে, কি নিয়ে সে বাঁচবে বলো তো?

বললুম, কিন্তু তুমি কি মনে কর, দেশে—দেশে এতখানি খ্যাতি, এত স্তুতির কোনো দামই নেই?

কিছুই না ওজয়, কিছুই না। সবাই চিনেছে অভিনেত্রী মিমিকে, চিনেছে সুন্দরী মিমিকে, কিন্তু সানফ্রান্সিসকোর সেই অতিসাধারণ মেয়েটিকে চিনল কে? কে বুঝল তার স্বপ্ন? কেউ বোঝেনি, বুঝতে চায়নি! তাই তো আটাশ বছর ধরে অনেক লোকের ভিড়েও মিমি রয়ে গেল একা, তাই কামনার তীরে তীরে পিপাসার শূন্যপাত্র নিয়ে বৃথাই সে এতদিন ঘুরে বেড়াল।

সারা দেহে অস্থিরতা নিয়ে, সোফা ছেড়ে মিমি উঠে দাঁড়াল, তারপর জানলার কাছে গিয়ে শার্সি দিলে খুলে। অন্ধকার রাত, তুষার পড়ছে বাইরে। মিমির উত্তপ্ত কপালে নিশীথ—হাওয়ার স্নিগ্ধ সান্ত্বনা এসে স্পর্শ করুক। আর একবার সে তারই মতো একাকিনী এই অন্ধকার নিশীথিনীর মুখোমুখি দাঁড়াক। দুই চোখ ভরে তার ঘনিয়ে আসুক সেই স্বপ্ন—সান—ফ্রান্সিসকোর সেই সতেরো বছরের মেয়েটি যে স্বপ্ন দেখেছিল। কামনার নয়—কামনার ফুলের স্বপ্ন!

মিমিই আবার স্তব্ধতা ভাঙলে। ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, গল্প শেষ হয়ে গেছে ওজয়, কিন্তু আমার কথা এখনো শুরু হল না।

বললুম, তোমার কথাই তো আমি শুনতে এসেছে মিমি।

মিমি এসে আমার পাশে দাঁড়াল। বললে, আমেরিকার কুয়াশা—ঢাকা আকাশে তারা ফোটে না, কিন্তু আটাশ বছর পরে আমি প্রথম তারা দেখলুম।

তারা দেখলে, কোথায়?

মিমির মুখ নত হয়ে এল, আমার দুই চোখে দুটি চুমু দিয়ে বললে, এইখানে দেখতে পেলুম আমার প্রথম তারা! My harvest moon !

আবেগে মিমির কণ্ঠ কাঁপতে লাগল। গাঢ়—নীল ওর চোখের তারায় ঘরের নীল আলোর মতোই ঘনিয়ে এসেছে স্বপ্নাতুর বিহ্বলতা! মুখে লেগেছে এখন বসন্তের সুষমা! আটাশ বছরের ক্লান্ত—যৌবন মিমি হঠাৎ এ রূপ কোথায় পেল?

আমার পাশে বসে তেমনি গলায় বলতে লাগল: হার্লেমের সেই উৎসব—রাত্রির কথা তোমার মনে পড়ে ওজয়? সে—রাতে তুমি দেখেছিলে শ্যাম্পেনের রং, আর আমি দেখেছিলুম প্রথম তারা। এগারো বছর বাদে হঠাৎ সেদিন সতেরো বছরের সেই মেয়েটি আমার মধ্যে আবার বেঁচে উঠল!…কী আশ্চর্য মানুষের জীবন ওজয়! সেদিন কিন্তু আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলুম!

শাঁখের মতো সাদা ওর গলায় চুমু দিয়ে বললুম, ভয় কেন মিমি?

হ্যাঁ, ভয়! সতেরো বছরের মিমি যদি আবার মরে যায়। নিজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সেদিন এই ভয়ই হয়েছিল! তাই তো অত কাছে থেকেও দিনের আলোয় তোমায় ছুঁতে পারিনি। এবার—এবার কিন্তু সতেরো বছরের মেয়েটিকে আর মরতে দেব না, কিছুতেই না। আজ আমি সুখী—সত্যি সুখী! …রাত ভোর হয়ে আসছে, গুড নাইট ডার্লিং!

দীর্ঘ একটি চুম্বন শেষে মিমি দরজার কাছে আমার এগিয়ে দিতে এল, তখন গাল বেয়ে তার নেমেছে অশ্রুধারা, অথচ স্ফুরিত ঠোঁটে হাসি। কুয়াশার দেশে সূর্য উঠেছে যেন।

.

নিজের ঘরে যখন ফিরলুম, তখন রাত্রির শেষ প্রহর। অন্ধকার ঘরে মিমির সত্তা মৃদু সুগন্ধের মতো আমায় আচ্ছন্ন করে রইল সারা রাত!

কখন তন্দ্রা এসেছিল, টের পাইনি। ঘুম যখন ভাঙল, ঘরে তখন সকালের হলদে আলো এসে পড়েছে। ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ল গাঢ় নীল চোখ একটি মেয়েকে—আমার চোখে যে দেখেছিল প্রথম তারা! রাস্তায় বেরিয়ে একটা ক্যাব নিয়ে বললুম, হাই স্ট্রিট!

মিমি হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে প্রথম কিশোর দিনের প্রথম প্রেমের।

গাড়ি এসে থামল হাই স্ট্রিটে—সেই বাড়ি, সেই দীর্ঘ সোপানশ্রেণী! সারারাত তুষারবর্ষণে ম্যাগনোলিয়া ফুলগুলি ম্লান। দরজার গোড়ায় ভ্যালে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তার মুখ অমন বিবর্ণ কেন?

শুধোলুম, মাদাম ঘুম থেকে উঠেছেন

আস্তে আস্তে সে জবাব দিলে, নেই!

নেই! কোথাও বেরিয়েছেন?

লোকটা এবার দুই হাত দিয়ে নিজের বুকে ক্রস করে বললে, না, তিনি আত্মহত্যা করেছেন!

মুহূর্তে মনে হল, বরফের সমুদ্রের মধ্যে আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি! সর্বাঙ্গ হিম কঠিন হয়ে উঠছে! মাথার মধ্যে অসংখ্য পোকার অদ্ভুত গুঞ্জন! চেতনা ফিরে আসতে প্রশ্ন করলুম, কেমন করে?

লোকটি তেমনি বিবর্ণ মুখে বললে, কাল রাতে আমি চলে যাওয়ার পর মিমি নিঃশব্দে পাশের ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে কি যেন বের করে আনে। নাটাশা সেই ঘরে ঘুমুচ্ছিল, পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই তার কেমন সন্দেহ হয়, টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখে, রিভলভার নেই! চিৎকার করতে করতে বুড়ি মিমির ঘরে ঢুকল, তখন দেরি হয়ে গেছে।

নিশি—পাওয়ার মতো আস্তে আস্তে মিমির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলুম।

সমাপ্ত