নিশীথ নগরী – ২৫

পঁচিশ

প্যাশন—ফ্লাওয়ার নিয়ে ক’দিন থেকে জকি খুব খাটছে। ব্রডওয়ে স্টেজে একসময় এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। লাইম লাইট থিয়েটারে সাধারণত পুরোনো নাটকের অভিনয় হয় না, এই থিয়েটার আমেরিকার আধুনিকতম রুচিতে, নাটকে এবং প্রয়োজনায়। আসলে লাইম লাইট থিয়েটার হল নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টের জায়গা। কিন্তু ‘প্যাশন—ফ্লাওয়ার’ পুরোনো নাটক হলেও সাধারণ নয়, এতে এমন একটি চিরন্তন সুর আছে, যা কোনোকালে পুরোনো হতে পারে না।

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে দুটি সত্তা: একটির জন্ম বর্তমান শতাব্দীর বস্তুতান্ত্রিকতার যুগে, আরেকটি আত্মার পরম কামনার সৃষ্টি। এই দুটি বভিন্ন সত্তার বিরোধ, বাস্তবতা আর স্বপ্নজগতের এই সংঘাতকে আমরা বলি জীবন। ‘প্যাশন—ফ্লাওয়ার’ সেই সংঘাতের ইতিহাস, জীবনের একটি রূপক। আর, মাদাম ফ্যানির চরিত্র হল সেই রূপকের রূপ। প্রত্যেক নারীর জীবনেই একদিন না একদিন মাদাম ফ্যানি আসে, আসে উৎসব—রাত্রির মাঝখানে হঠাৎ একটি ক্লান্ত মুহূর্তে, আসে সেই অলক্ষ্য কামনা—কুসুমের জন্য পরম পিপাসা নিয়ে।

মূল নাটকটি ছিল তিন অঙ্ক, পেত্রোভিচ সেটাকে দাঁড় করিয়েছে একাঙ্কে, প্লে হতে সময় লাগে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু মহলা চলেছে রোজ অন্তত পাঁচ ঘণ্টা করে। এই পাঁচ ঘণ্টা ছাড়াও দিনে আরো চার—পাঁচ ঘণ্টা জকির সঙ্গে সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়। কাজের যে তীব্র নেশা আছে, জকিকে দেখে তা বুঝেছি। ওয়ে সাইড গ্রোভের সেই নিশীথ উৎসবে ওর যতখানি উৎসাহ দেখেছি, কাজের বেলায়ও ঠিক ততখানি, বরং বেশিই।

সে—রাত্রির পর মিমিকে আর আমার ঘরে দেখিনি। আমার ঘর মানে নিরিবিলি অবকাশে। কেননা, সুস্থ হয়ে ওঠার পর গ্রিনরুমের সেই অ্যাসবেস্টস—ঘেরা কুঠুরি আমি ছেড়ে দিয়েছি, আমার নতুন আস্তানা এখন সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটের ছোট একটা ঘরে। থিয়েটারের কাজ ছাড়াও খুচরো একটা কাজ জোগাড় করে নিতে হয়েছে, এক খাবারের দোকানে বাসন ধোয়ার কাজ। ভোর সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা অবধি তারপর আসি থিয়েটারে।

কিন্তু সে—রাত্রির পর মিমির সঙ্গে নিরালায় আর দেখা হয়নি, দেখা সে করেনি। মহলার সময় অবশ্য রোজই সকালে দেখা হয়, কিন্তু লক্ষ করেছি, ক’দিন থেকে আমায় সে এড়িয়ে চলেছে। এ তার সঙ্কোচ, না ঔদাসীন্য, বোঝা মুশকিল।

মিমির সম্বন্ধে ধীরে ধীরে আমার মনে একটি কৌতূহল জমে উঠেছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারি না। মহলার সময় যখন সে মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকায়, আমি সে—চাহনির গভীরতর অর্থ খুঁজে বের করবার চেষ্টা করি, যে—অর্থ মাদাম ফ্যানির চোখে সমস্ত প্যারিস খুঁজে পায়নি।

আগেই বলেছি, দিনের আলোয় মিমি অতি সাধারণ, সকালবেলায় রঙ্গালয়ের মতোই নির্মোহ, যে পানপাত্র নিঃশেষ হয়ে আসছে, অনেকটা তারই মতো। হ্যাঁ, দিনের আলোয় মিমির চেহারার পট পরিবর্তন হয়তো নারী—পুরুষের মনে কৌতূহল জাগতে পারে বইকি। লক্ষ করলে বোঝা যায়, অতি সাধারণ এই মেয়েটির মধ্যে কোথায় যেন প্রচ্ছন্ন একটি আকর্ষণ রয়েছে। তা রূপও নয়, যৌবনও নয়, অন্য কিছু। সে যে কি, তার যথার্থ সংজ্ঞা আমি দিতে পারব না।

‘প্যাশন—ফ্লাওয়ার’ নাটকের প্রথম অভিনয় রাত্রি। আটটায় প্লে আরম্ভ!

সকাল থেকে আর ফুরসৎ নেই। ব্যস্ততা, ছুটোছুটি, চাপা কলরব। গ্রিনরুমের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা কাজের চাকা যেন আজ সকাল থেকে অনবরত ঘুরে চলেছে। সমস্ত তোড়জোড় করে জকি যখন গ্রিনরুমের ওপরতলায় সুইচ—ঘরের সেই ছোট টুলটিতে গিয়ে বসল, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুরু হয়েছে। জকি আজ নিজেই স্টেজে আলোক—সম্পাতের ভার নিয়েছে।

আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট। কপালের ঘাম মুছে, এইবার অডিটোরিয়ামে গিয়ে বসব ভাবছি। প্যাশন ফ্লাওয়ার—এর প্রথম অভিনয় আমায় দেখতেই হবে। দরজার কাছে কল—বয়, রাস্তা আটকাল। বললে, আপনাকে খুঁজছিলাম।

আমাকে? কেন?

ছোকরাটি মুখে কোনো জবাব না দিয়ে, একটুকরো পাকানো কাগজ আমার হাতে দিল। কাগজটা খুলতেই বেরোল ছোট একটি ভায়োলেট ফুল—গাঢ় নীল চোখের সঙ্কেতের মতো, আর দ্রুতহাতে পেন্সিলে লেখা দুটি লাইন :

‘প্লে ভাঙলে আমার সঙ্গে দেখা কোরো—নিশ্চয়। থিয়েটারের ফটকে নয়, গ্রিনরুমের পেছনের দরজায় আমি অপেক্ষা করব।

.

বিস্মিত হওয়ার কথা বইকি! কল—বয়কে শুধোলুম, তোমার ভুল হয়নি তো?

ঘাড় নেড়ে সে বললে, না, ভুল আমার হয়নি। চিঠি আপনাকেই দিতে বলা হয়েছে।

অর্কেস্ট্রা তখনো বেজে চলেছে, যবনিকা উঠতে আর দেরি নেই। ফুল আর চিঠি ট্রাউজারের পকেটে পুরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লুম।

.

সমস্ত নিউইয়র্ক স্টেজের পানে তাকিয়ে যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। সেই বিশাল প্রেক্ষাগারের দূরতম কোণে কোনো রকমে ঠাঁই করে নিয়ে যখন বসলুম, তখন কালো ভেলভেটের যবনিকা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে।

নিউইয়র্ক থেকে অনেক—অনেক মাইল দূরে প্যারিসে এসে পড়েছি, এসে পড়েছি প্যারিসের সেই বহুনিন্দিত বহু প্রশংসিত Cafe de Lnxe-এর একাংশে, নিশীথ—নগরীর সেই পরম রমণীয় নরকে। ছোট ছোট টেবিল ঘিরে অভিজাত প্যারিসের ভিড়, আলাপ—গুঞ্জন, সিগারেটের ধোঁয়া, শ্যাম্পেনের ফেনা। এপাশে বড় বড় কাচের শার্সি দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্যারিসের রাজপথ—কুয়াশায় আবছায়া।

কিন্তু সে কই? এই মধুচক্রের মক্ষিরানি, নিশীথোৎসবের সেই দাহমতী দীপশিখা?

হঠাৎ গুঞ্জন গেল থেমে, শোনা গেল ম্যান্ডোলিন আর স্যাক্সোফোনের অস্পষ্ট সঙ্গত আর সরু গলার অস্ফুট সঙ্গীত:

 ওগো ও প্রেমিক প্রজাপতি, তুমি

 শুনেছ কি মোরে গান,

 জান কি নিরালা বনতলে কাঁপে

 নিশিগন্ধার প্রাণ?

ক্রমশ সঙ্গত হল স্পষ্টতর, সঙ্গীত হল ঊর্ধ্বায়িত বাতির শিখার মতো উজ্জ্বলতর, উচ্ছ্বলতর। দেখা গেল, দূরে প্রত্যেক টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে একটি নারীমূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতে একটা বেতের টুকরিতে একরাশ ভায়োলেট। পরনে ঝলমলে নীল গাউন পায়ের কাছে নীল ঢেউয়ের মতো লুটোচ্ছে, অনাবৃত কাঁধ আর অর্ধ—অনাবৃত বুক শাঁখের মতো সাদা, দেহে লীলা, চোখে সঙ্কেত, ঠোঁটে কামনা আর মুখে গান:

 এপ্রিল—রাতে জেগে আছে শুধু

 নিশিগন্ধার প্রাণ,

 ওগো ও প্রেমিক প্রজাপতি, তুমি

 শুনে যেও মোর গান।

এই তো সে! মাদাম ফ্যানি—হোটেলওয়ালি ফ্যানি।—প্যারিসের বহুবাঞ্ছিত মৃত্যু! কিন্তু একে আমি চিনি, একেই তো দেখেছিলুম ওয়ে—সাইড গ্রোভের সেই উৎসবে, নিশীথ—রাত্রির সেই আশ্চর্য মায়ালোকে। একে ফ্যানিই বলো, আর মিমিই বলো, এ শুধু সে—ই, পুরুষের কামনায় প্যারিস যার জন্যে চিরকাল উন্মত্ত হয়ে উঠেছে!

.

ফুলওয়ানি ফ্যানি গান গেয়ে আলাপ করছে আর ‘মনামি’দের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে তার তনুর স্তব, রাত্রির কণ্ঠে উঠছে সেই স্তবের প্রতিধ্বনি।

ব্যালকনিতে—যেখানে দুলছে কয়েকটি রঙিন চিনা লন্ঠন, আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি পতঙ্গ—সেখানে এসে দাঁড়াল ফ্যানি। শুরু হল সেখানে একটির পর একটি পুরুষের আনাগোনা—তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ। প্যারিসের মায়াবিনী তাদের পরিবেশন করে চলেছে চিরকালের সেই মধুর বিষ। কাউকে ক্ষণিক স্পর্শ, কাউকে একটি প্রেমের কথা, কাউকে বা চুম্বন। সমস্ত প্যারিসে যেন আগুন লেগে গেছে, আগুন লেগেছে দর্শকদের মনে—রক্তে—কামনায়—

মুহূর্তের পর মুহূর্ত যাচ্ছে মরে। সমস্ত চেতনা আমার চোখে আর কানে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

ধূসর—কেশ একটি পুরুষকে চুম্বন দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে, ফ্যানি তাকে প্রশ্ন করছে: প্যাশন ফ্লাওয়ার কোথায় পাওয়া যায় জানো? জানো তুমি?…আমায় বলে দেবে তার সন্ধান?

বাটন—হল থেকে গোলাপটি খুলে পুরুষটি হেসে, What sort of flower it is? I know the rose and those rosy lips! …kiss me…

পুরুষটি যখন চলে গেল, ফ্যানি তখন ব্যালকনিতে একা। মুখে ক্লান্তির রেখা, চোখে অদ্ভুত চাহনি।—না, গোলাপ সে চায়নি, সে চেয়েছে কামনার ফুল, পাপ আর পাঁকের ঊর্ধ্বে যে কামনা ফুল হয়ে ফোটে—সেই স্বপ্ন—কুসুম!

ভেতরের হলে তখনও মাদাম ফ্যানির নাম—গান। সবার অলক্ষ্যে ফ্যানি তখন চোরের মতো চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছে—পালিয়ে যাচ্ছে কামনার এই শ্মশানভূমি ছেড়ে। প্যারিসের রাজপথ কুয়াশা আর তুষারে একাকার, কাচের শার্সি দিয়ে দেখা গেল আবছায়া অন্ধকারে একা—একা ফ্যানি রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রেতিনীর মতো। প্যাশন ফ্লাওয়ার তাকে পেতেই হবে।

.

আড়াই ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল, জানতে পারিনি। হুঁস হল যখন, তখন অডিটোরিয়ামে আলো জ্বলে উঠেছে। সমগ্র নিউইয়র্কের মুখে নাটকের নায়িকার প্রশংসা।

ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই হাতে ঠেকল চিঠি আর ভায়োলেট। হ্যাঁ, সে অপেক্ষা করছে। আমারই জন্যে কি?

ঘুরে এসে গ্রিনরুমের পেছনের দরজায় দাঁড়াতেই দেখি কালো পুরুষালি ওভারকোটে পা ঢেকে মিমি অপেক্ষা করছে। নিঃশব্দে রাস্তায় নেমে এসে আমার কানে কানে বললে, একটা ব্যাচ নাও।

গাড়িতে যখন উঠছি, তখন চোখে পড়ল, প্রকাণ্ড একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আধাবয়সী একটি লোক গ্রিনরুমের দরজায় এসে পৌঁছেছে। তার বুকের ওপর ঘড়ির চেনের হীরের লকেটটা আবছায়া অন্ধকারেও সাপের চোখের মতো জ্বলছে।

বললুম, ডিউক, তোমায় অভিনন্দন জানাতে এসেছে মিমি!

মিমির মুখে অদ্ভুত একটু হাসি দেখা দিল। আমাদের গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন আজগুবি স্বপ্নের মতো লাগছিল। শুধোলুম, কোথায় যাচ্ছি আমরা?

সিটে হেলান দিয়ে গভীর শ্রান্তিতে মিমি চোখ বুজে ছিল। চোখ না মেলেই জবাব দিলে, আমার বাড়িতে।

ছাব্বিশ

ট্যাক্সিটা এসে থামল ৪০৪ হাই স্ট্রিটে। পাড়াটা নিরালা, বাস—ট্রাম—ট্যাক্সির চিৎকার আর জনতার কলরব থেকে অনেকটা দূরে। রাস্তার দু’ধারে দেওদার জাতীয় গাছের সারি, বাতাসে মেঠো—ফুলের নিশ্বাস। শহর এখানে এসে হঠাৎ যেন রাখালের ছদ্মবেশ ধরেছে।

ল্যাম্প পোস্টের সুমুখেই সাদা একখানা বাড়ি, ক্যাব এসে থামল তারই ফটকে। ভাড়া চুকিয়ে মিমি নেমে পড়ল। তারপর গাড়ির দরজায় একটা হাত রেখে শুধোলে, আসবে না তুমি?

আমি? না, আজকে থাক। আরেক দিন বরং—

কিন্তু আমায় পৌঁছে দেবে না বাড়ির ভেতরে? উঁচু সিঁড়িতে উঠতে যদি একটু সাহায্য করতে…

নিশ্চয়! —গাড়ি থেকে নেমে বললুম, চলো।

ফটকে ঢুকতেই একখানা বাগান, ম্যাগনোলিয়ার ঝাড়! বাগান পার হয়েই উঁচু র্সিড়ির ধাপ—প্রাচীন ফরাসি ‘শ্যাটো’ ধরনের। মাটি থেকে দশটা করে ধাপ, তারপর ছোট্ট একটু চাতাল, তারপর আবার সিঁড়ির সারি। ওপরের শেষ ধাপের মাথায় চৌকো একটি ঘষা কাচের বাতি, তারই অস্পষ্ট আলোয় বাগানের অন্ধকার ঘোলাটে হয়ে উঠেছে মাত্র।

সেই দীর্ঘ সোপানশ্রেণীর নিচে মিমি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোখ দুটি বুজে হঠাৎ বলে উঠল, আমায় জড়িয়ে ধরো তো ওজয়—খুব শক্ত করে? উঃ, কী ক্লান্ত লাগছে।

সেই মুহূর্তে আমি তাকে ধরে না ফেললে, মিমি বোধ করি টলে পড়ে যেত। শার্টের অস্তিন গুটিয়ে দুটি হাতে তাকে বুকের কাছে তুলে নিলুম—ছোট মেয়ের মতো, ছোট পাখির মতো। মিমির চোখ দুটি মুদিত, দু’হাত দিয়ে বেষ্টন করেছে আমার গলা। ম্যাগনোলিয়া ফুলেরা যেমন রাতের বাতাসে কানে কানে কথা কয়, তেমনি চুপি চুপি মিমি বললে, এমনি করে আমায় ধরে রাখো ওজয়, আমায় নিয়ে চলে ঘরে।

সেই আবছায়া অন্ধকারে কালো ওভারকোট—ঢাকা একটি নারীদেহ তুলে নিতেই মনে অদ্ভুত আবহাওয়া ঘনিয়ে এল: ভাবলুম, আমি যেন মধ্যযুগের দুঃসাহসী এক নাইট, দুই হাতে কোনো কাউন্টের মেয়েকে নিঃশব্দে হরণ করে নিয়ে পালাচ্ছি। মনে মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা নিয়ে সিঁড়িতে পা দিলুম।

প্রথম দশটা ধাপ পার হয়ে গেলুম। অনায়াসে। আলো—ছায়াময় সেই সোপানশ্রেণী, শহরতলীর সেই সুগভীর নির্জনতা, নারীদেহের ঘনতর সংস্পর্শ—সব মিলিয়ে একটি মায়া—জগৎ রচনা করেছে। এ যেন প্রত্যেকের জীবন পার হয়ে অপরিচিত এক রহস্যলোকে যাত্রা।

এক এক করে আরো দশটা ধাপ পার হয়ে গেলুম। হাতে আমার সামর্থ্য কম নেই, তবু দ্বিতীয় চাতালে পৌঁছে মনে হল, মিমির দেহটা যতটা লঘুভার ভেবেছিলুম, ততটা নয়। কয়েক মিনিট আগে নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, কণ্ঠলগ্না মুদিতাক্ষি এমনি একটি নারীদেহ নিয়ে পৃথিবীর পার থেকে সুদূর মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত চলে যেতে পারি অনায়াসেই, কিন্তু নিজের ওপর এখন আমার সন্দেহ এসেছে। তবু আরো দশটা ধাপ এখনো আমায় পার হতে হবে।

একে একে দশটা ধাপ পার হয়ে তৃতীয় চাতালে ঘরের সুমুখে যখন পৌঁছলুম, তখন হাতের পেশীগুলো আমার ফুলে ফুলে উঠছে, ঠান্ডা রাতেও কপালে দেখা দিয়েছে ঘাম। অদ্ভুত সেই রোমান্টিক আবহাওয়া গেছে মিলিয়ে। ননীর মতো নরম, ফেনার মতো নরম এই দেহটাকে এখন ক্লান্তিকর একটা বোঝা ছাড়া আর কি বলা যায়? এই মুহূর্তে যদি এই মাংসস্তূপ ছুড়ে ফেলে দিতে পারতুম!

কিন্তু কেন? কেন সেই মধুর উত্তেজনা, সেই মদির উন্মাদনার বদলে এল বিরক্তি—তিক্ত এই ক্লান্তি? পরম রমণীয় নারীদেহও হঠাৎ অসহ্য ভার বোধ হয় কেন?

এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছিলুম সেই রাতেই—

.

আস্তে আস্তে ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলুম। নিচু ছাদওয়ালা একটা হল—সিলিং থেকে মেঝে অবধি দুধের মতো ধবধবে। মিমিকে নিয়ে এরপর কোনদিকে যাব, তাই ভাবছি, এমনি সময়ে পাশের কামরা থেকে বেরিয়ে এল আধাবয়সী মোটাসোটা একটি স্ত্রীলোক। মাথায় নার্সদের মতো সাদা একটা রুমাল বাঁধা। তার বিস্ফারিত দুই চোখে যে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছিল, তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। বললুম, একে কোথায় শুইয়ে দেব? বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

কাঁদো কাঁদো গলায় স্ত্রীলোকটি রীতিমতো হইচই বাধিয়ে তুলল: কি বললে? মিমি অজ্ঞান হয়ে গেছে? কি করে ওমন হল? …হায়, হায়, কি হবে এখন? হায় প্রভু, এ কী সর্বনাশ করলে…

বলতে বলতে তার গাল বেয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। বললুম, ব্যস্ত হয়ো না, ভয়ের কিছু নেই—

গোলমাল শুনে মিমি চোখ মেলেছিল। আস্তে আস্তে আমার গলা থেকে হাত খুলে দিয়ে বললে, আমায় নামিয়ে দাও।

স্ত্রীলোকটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, উঁহু, এখানে নয়, এখানে নয়, ঘরে চলো।

হল পার হয়ে যে ঘরে এলুম, সে ঘর ভরে ফিকে নীল আলো। সমুদ্রপারের আকাশে যেন জ্যোৎস্না উঠেছে! এককোণে অগ্নিকুণ্ড, মাঝখানে মুখোমুখি দুটি সোফা, ওপাশে নিচু একখানা খাট, দেওয়ালে কয়েকখানা ছবি। সোফা দুটোর মাঝে একটা টেবিলের ওপর ড্রাগন আঁকা ব্রোঞ্জের একটা ফুলদানি। তাতে ফুল নেই, শুধু সুগন্ধ কয়েকটি চিনে ধূপ পুড়ছে। একটা সোফার ওপর মিমিকে ধীরে ধীরে বসিয়ে দিলুম। গা থেকে ওভারকোট খুলতে খুলতে স্ত্রীলোকটিকে মিমি বললে, ড্রিঙ্ক, নাটাশা।

তারপর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললে, দাঁড়িয়ে কেন? বোসো। কিছু মনে কোরো না, নাটাশা অমনিই। অনেক দিনের পুরোনো চাকরানি কিনা, বলতে গেলে, ও—ই আমার অভিভাবক। ভারি ভালোবাসে আমায়…আচ্ছা ওজয়, বড় কষ্ট দিলুম তোমায়, না?

বললুম, ও কিছু না। কষ্ট আর কি! এবার তুমি অনেকটা সুস্থ হয়েছ বোধ করি?

সোফাতে শরীর এলিয়ে দিয়ে মিমি বললে, হ্যাঁ, আমি এখন বেশ সুস্থ। অনেকদিন পরে আজ নতুন নাটকে প্লে করলুম, শরীরের চেয়ে মনটাই আজ বেশি ক্লান্ত।…কী আশ্চর্য ওজয়, ফ্যানির কথা ভাবতে গেলেই আমার নিজের কথাই মনে পড়ে যায়!

এ হচ্ছে বড় অভিনেত্রীর লক্ষণ।—হেসে বললুম: নাটকের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একেবারে মিশিয়ে দিতে না পারলে, ভালো অভিনয় করা যায় না।—আচ্ছা, এখন আমি যেতে পারি বোধ হয়? গুড নাইট মিমি।

কি যেন বলতে গিয়ে মিমি হঠাৎ থেমে গেল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এল আমার কাছে, সমুদ্রপারের আকাশের মতো গাঢ়—নীল দুটি চোখ আমার মুখের পানে তুলে ধরে বললে, তোমায় অনেক কথা বলবার আছে ওজয়। আজকের রাতটা—শুধু আজকের রাতটা এখানে থাকতে পারবে না?…আজ একা একা থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যাব আমি!

কিন্তু তোমার কথা শোনবার জন্যে তো অনেক লোক আছে মিমি। সমস্ত নিউইয়র্ক আজ তোমার জন্যে ফুল আর অভিনন্দন নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমায় তুমি ডাকলে কেন?

মিমি টেবিল ঘেঁষে আমার আরেকটু কাছে সরে এল, যে কথা আমি বলতে চাই, সেকথা যে শুধু তোমাকেই বলা যায়, তা তুমি বিশ্বাস করতে পারো না?

গ্রীবায় একটি রমণীয় ভঙ্গিমা এনে মিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার পানে তুলে ধরেছে তার মুখ—ম্যাগনোলিয়া ফুল যেমন করে আকাশের দিকে আত্মনিবেদন করে। মিমির শরীর ঘিরে লতিয়ে লতিয়ে উঠছে ধূপের ধূসর একটি ধূমরেখা—পুরুষের দগ্ধ কামনার মতো।

‘সেকথা শুধু তোমাকেই বলা যায়’—হয়তো বহুপুরুষের কানে কানে মিমি ঠিক এই কথাই শুনিয়েছে এমনিতর বহুরাতে। কিন্তু জ্যোৎস্নার মতো নীলাভ, জ্যোৎস্নার মতো নরম এই নীল আলোর তলায় দাঁড়িয়ে নাই—বা স্মরণ করলুম! মনে মনে যদি বিশ্বাসই করি, সেই কথাটি মিমি শুধু আমাকে বলতে চেয়েছে, ক্ষতি কি?…হ্যাঁ, এমন রাতে চিরকালের সেই মধুর মিথ্যা আমি আরেকবার বিশ্বাস করবার চেষ্টা করব।

বললুম, বেশ, তোমার কথা শোনবার জন্যে আমি আজ রইলুম মিমি।

মিমির চোখের তারায় হাসি উঠল ঝিকমিকিয়ে। হাত ধরে টেনে আমায় সোফায় বসিয়ে বললে, Naughty Darling ! আমি জানতুম, তুমি আজ চলে যেতে পারো না।

সাতাশ

একখানা ট্রে’তে ড্রিঙ্ক সাজিয়ে নাটাশা ঘরে ঢুকল। মিমি নিজেই দুটি পানপাত্র পূর্ণ করে একটি আমার দিকে এগিয়ে দিলে, তারপর নিজের পাত্রটি তুলে ধরে বললে, কাকে স্মরণ করে আমরা পান করব?

বললুম, সমস্ত নিউইয়র্ক আজ তোমায় যে জয়মাল্য দিয়েছে, সেই মালা—

না,—গেলাসটি টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে মিমি বলে উঠল: না, মাদাম ফ্যানির সেই নিষ্ঠুর মৃত্যু স্মরণ করে।

মৃত্যু! আজ রাতে মৃত্যুকে নাই—বা স্মরণ করলে মিমি!

জানো, মৃত্যুও কোনো কোনো জীবনের পরম সুন্দর উৎসব হয়ে উঠতে পারে? ফ্যানির সমস্ত জীবনের চেয়ে তার মৃত্যু ঢের উজ্জ্বল! আজই তো সেই মৃত্যুকে স্মরণ করে পান করবার রাত!—মিমি পানপাত্রে চুমুক দিলে: কিন্তু সেই মৃত্যুর মানে কি জানো?

মানে, আত্মার মুক্তি, এই তো বলবে? কিন্তু ধোঁয়াটে আধ্যাত্মিকতায় আমার বিশ্বাস নেই মিমি, এই জীবনই আমার কাছে সবচেয়ে সত্য—অনেক রঙে বিচিত্র এই জীবন।

জীবনকে কে না সবচেয়ে ভালোবাসে ওজয়? কিন্তু আমি তা বলতে চাইনি, আমি বলতে চেয়েছিলুম, ফ্যানির মৃত্যুর মানে শরীরের কামনার মৃত্যু—এই সাদা, সুন্দর শরীরের কামনা? ধূপগুলো দেখেছ ওজয়? এই ধূপ হল ফ্যানির প্যাশন, আর এই প্যাশন পুড়ে পুড়ে যে সুগন্ধ উঠছে তা হল ফ্যানির মৃত্যু!…তোমার ড্রিঙ্ক যে পড়ে রইল ডার্লিং!

গেলাসটা নিঃশেষ করে বললুম, রূপক হিসেবে তোমার কথাটা চমৎকার মিমি, কিন্তু যে স্বপ্নের জন্যে ফ্যানি নিবেদন করেছিল, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সে—স্বপ্ন প্রতিমুহূর্তে চুরমার হয়ে যায়, সে—কথা ফ্যানিও জানত বইকি। কোথায় খুঁজে পাবে সেই প্যাশন—ফ্লাওয়ার?

কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না? এত বড় পৃথিবীর কোথাও না? কিন্তু স্বপ্ন যদি বারবার ভেঙে যায়, লোকে তাহলে কি করে বাঁচে বলো তো?

বলতে বলতে ওর কণ্ঠ কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠল। সারা দেহে ওর অস্থিরতা জেগেছে। সোফা থেকে হঠাৎ উঠে ও জানলার শার্সির দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল।

বাইরে অন্ধকার রাত্রি কান পেতে আছে জানলার পাশে, বাগানে ম্যাগনোলিয়া ফুলেরা হয়তো আত্মনিবেদনের ভাষা খুঁজছে। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিমি, নীল আলো পড়েছে ওর ধবধবে দুধালি নিরাবরণ পিঠে আর কাঁধে। দাঁড়িয়ে আছে যেন নিঃশব্দ কথাপুঞ্জ, অনুচ্চচারিত একটি ‘লিরিক’ যেন। এখনো কি ও ফ্যানির মৃত্যুর কথাই ভাবছে?

না, মৃত্যু নয়, আজ জীবনকে স্মরণ করে পান করবার রাত। এমন রাত জীবনে বহুবার আসে না মিমি। তোমার এই উষ্ণ ঘরের ধূপ সুরভিত নীলাভ—আবহাওয়ায় তুমি আজ সেই কথাই বলো, যে—কথা শুনে চিরকাল পুরুষের রক্তে জাগে নতুন জীবনের স্পন্দন!

মুহূর্তের পর মুহূর্ত যাচ্ছে পালিয়ে। বললুম, এতক্ষণ ফ্যানির কথাই তুমি বললে মিমি, কিন্তু তোমার কথাই আমি শুনতে এসেছিলুম আজ।

জানলার কাছে মিমি ফিরে এল, শুধোলে সিগারেট?

সিগারেট বের করে ওকে একটা দিয়ে নিজেও একটা নিলুম। তারপর নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে ওর দিকে লাইটার দিলুম এগিয়ে। মিমি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে, তারপর হেঁট হয়ে আমার সিগারেটে ওর সিগারেট ঠেকিয়ে ধরিয়ে নিলে।

একে কি বলে জানো?—মিমি শুধোলে।

কি?

মিমির চোখ দুটি হেসে উঠল, একে বলে, Touch of love !

ওর একখানা হাত ধরে ফেলেছিলুম, মিমি হয়তো বুঝেছিল আমার হাতের সঙ্কেত। বুঝেছিল বলেই কি ঠিক সেই মুহূর্তে তার মুখে নেমে এসেছিল একটি পাণ্ডুর ছায়া? না, সে আমার চোখের ভুল? আমার মুঠি শিথিল হয়ে আসছিল, মিমি সে—হাতখানা তুলে ধরে তার ঠোঁটে একবার ছোঁয়াল। তারপর দরজার কাছে দৌড়ে গিয়ে ছোট মেয়ের মতো চিৎকার করে ডাকলে, নাটাশা, আজ আমাদের খেতে দেবে না বুঝি—

ব্যস্ত হয়ে নাটাশা ছুটে এল: সেই কখন থেকে আমি খাবার সাজিয়ে বসে আছি, তোমাদেরই তো গল্প ফুরোয় না।

খাবার ঘরে যেতে হল। মুখোমুখি খেতে বসে, হাসতে হাসতে মিমি বললে, রান্নায় নাটাশার যা চমৎকার হাত! সেই জন্যেই তো ওই মোটা শশা—ওই বুড়ি ভল্লুকটাকে তাড়াতে পারি নে।

নাটাশশ চটেই আগুন! ছোট ছোট চোখ দুটো পিটপিটে করতে করতে বললে, বেশ, বেশ, আমি মোটা শশা, আমি বুড়ি ভল্লুক, তাতে কার কি আসে যায়? ঈশ্বর তো আর সবাইকে তোমার এত এঞ্জেল সৃষ্টি করেননি!…হুঁ, কালিলিনের চোখ যদি তোমাদের থাকত…

হাসি চেপে মিমি শুধোলে, কালিলিন তোমাকে ভয়ানক ভালোবাসত নাটাশা, না?

নাটাশার কুঁচকানো লাল মুখে এবার খুশির একটি আভা ছড়িয়ে পড়ল। দু’—চারবার ঢোক গিলে বুড়ি বললে, সে আমায় কি বলে ডাকত, জানো? সে বলত—নাঃ, সে কথা আমি কিছুতেই বলতে পারব না—যাই, তোমাদের জন্যে খরগোশের রোস্ট নিয়ে আসি গে—

বোঝা গেল, নাটাশার লজ্জা হয়েছে। এই লজ্জা ওর ভীরু প্রেম। বুড়ি নাটাশার মধ্যে বিগত দিনের একটি গ্রাম্য কিশোরী আজো রয়েছে আত্মগোপন করে।

আঠাশ

এক চামচ সুপ মুখে দিয়ে মিমি তেমনি তরল কণ্ঠে শুধোলে, কালিলিন নাটাশাকে কি বলে ডাকত জানো?

কি বলে?

সরে এসো বলছি—

মুখটা সামনের দিকে খানিক এগিয়ে নিয়ে যেতেই, মিমি আমার কানে কানে রাত্রির বন—মর্মরের মতো চুপি চুপি উচ্চচারণ করলে, My harvest moon !

চমৎকার সম্বোধন! ‘ম্যুজিক’ কালিলিনের কাছে এর চেয়ে মধুরতর ডাক আর কি হতে পারে? জীবনে যখন আসে চৈত্রমাস, মনের নির্জন শূন্যতায় যখন জাগে ফুল—ফসলের সময়, তখন আকাশে আলো করে যে চাঁদ ওঠে, সে চাঁদ কি জানো? সেই চাঁদই তো প্রেম? আমাদের দেহসীমার বাইরে সুদূর স্পর্শাতীত যে প্রেম, তারই উজ্জ্বলতম প্রতীক! আসলে, সে চাঁদ আমাদের মানসিক যৌবনের রূপালি স্বপ্ন।

আমার মুখের কাছে মুখ এনে মিমি তেমনি নরম গলায় ফের বললে, My harvest moon !

ও কি কালিলিনের ডাকের প্রতিধ্বনি, না এ ডাক আমারই উদ্দেশে? মিমির উষ্ণ নিশ্বাস লাগছে আমার গালে, ওর হাতখানা ভীরু পাখির মতো এগিয়ে আসছে আমার হাতের কুলায়। ওর মাথার চুলে, ওর নিশ্বাসে, ওর সর্বাঙ্গে কি যেন অদ্ভুত সুগন্ধ, আশ্চর্য নেশা।

আমার হাতের মধ্যে মিমির সাদা হাত দুখানা সাদা পায়রার মতো থরথর করে কাঁপছে। ওর কি হল কে জানে? আমার কাঁধে মুখ গুঁজে তেমনি মৃদু মর্মরিত কণ্ঠে বারংবার ডাকছে: My harvest moon ! My harvest moon !

রাত্রির বনানীর মতো মিমির সর্বাঙ্গে আশ্চর্য সুগন্ধ, ওর ডাকে অদ্ভুত নেশা! দু—হাত দিয়ে ওর মুখখানা তুলে ধরে এগিয়ে আনলুম আমার মুখের কাছে—

ঠিক সেই সময়! ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে নাটাশার গলা শুনতে পাওয়া গেল: রোস্ট এনেছি মিমি, তোমাদের দিয়ে আসব কি?

স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো দুজনে দুদিকে সরে বসলুম। নাটাশা আমাদের টেবিলের ওপর মাংসের ডিশ দুটো নামিয়ে রেখে, ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে পা দিয়ে শুধু বললে, আজ আর রাত জেগো না মিমি, উপরি উপরি ক’রাত জেগে যদি অসুখে পড়, আমি তাহলে ভুগতে পারব না কিন্তু—

মিনিট কয়েক চুপচাপ। নিঃশব্দে টেবিলের দিকে তাকিয়েছিলুম, মুখ তুলতেই মিমির চোখে চোখ পড়ে গেল। ওর মুখখানা হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে উঠে, দেখতে দেখতে ফের কাগজের মতো বিবর্ণ হয়ে গেল।

আস্তে আস্তে মিমি বললে, আমি…আমি ভারি দুঃখিত।

বললুম, দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, এ হচ্ছে মুহূর্তের ষড়যন্ত্র।

চামচে দিয়ে প্লেটের সুপ নাড়াচাড়া করতে করতে মিমি বললে, নাটাশাকে আমার হিংসে হয়।

নাটাশাকে! কেন?

এত বয়সে অবধি জীবনে ওর ক্লান্তি এল না। ছোট আশা আর ছোট আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কী সহজভাবেই না দিন কাটিয়ে যাচ্ছে। জীবনে নাটাশা বোধ করি কখনো স্বপ্ন দেখেনি, তাই ওর সমস্ত জীবন হয়ে উঠেছে স্বপ্নের মতো সুন্দর!…ওকি, তুমি যে কিছুই খাচ্ছ না ওজয়?

.

খাওয়া শেষ করে ফের শোবার ঘরে এসে বসলুম। সেই নীল আলো আর ধূপ—সৌরভ। নিশীথ—রাত্রির সেই অবাস্তব আবহাওয়া।

সামনে দুটি পানপাত্র—পরিপূর্ণ। ধবধবে টেবিল—ক্লথের ওপর গাঢ় সবুজ সাঁৎরুজের বোতলের একটুকরো আভা পড়েছে নিটোল একটি পান্নার মতো। একটি গেলাস তুলে নিয়ে বললুম, কই, তোমার কথা তো কিছুই বললে না মিমি!

সিগারেটের নীল সর্পিল ধূম—রেখার পানে তাকিয়ে মিমি চুপ করে বসেছিল। অন্যমনস্কের মতো বলল, হ্যাঁ, এইবার বলব।

বুঝতে পারলুম, কথাটা মিমি সহজভাবে শুরু করতে পারছে না। সোফায় হেলান দিয়ে, নিঃশব্দে ও শুধু সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে বললে, থিয়েটার আমি ছেড়ে দিচ্ছি জানো?

সে কী!

হ্যাঁ, থিয়েটার আমি ছেড়েই দেব ঠিক করেছি।

এমন গম্ভীরভাবে তুমি তামাশা করছ মিমি, যে, কথাটা সত্যি বলে ভুল হতে পারে।

সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে মিমি বললে, কিন্তু তামাশা আমি করিনি ওজয়, থিয়েটার আমি সত্যিই ছেড়ে দেব। কাল থেকেই।

কথাটা এবার নিছক তামাশা বলে মনে হল না, মিমির চিবুকের ভঙ্গিমায় আর ঠোঁটের বঙ্কিমায় দৃঢ়তার আভাস দেখতে পেলুম।

বললুম, পাগল হয়েছ মিমি! আজই রাতে নতুন নাটকের প্রথম অভিনয় হল, আর কাল থেকে তুমি দেবে থিয়েটার ছেড়ে। তোমার এই খেয়াল—খুশির জন্যে জকিকে কতখানি বিপন্ন হতে হবে, ভেবে দেখেছ? আর, তুমি ছেড়ে দিলেও নিউইয়র্ক তোমায় ছাড়বে কেন? আজকের মতো কাল রাত্রেও সমস্ত নিউইয়র্ক এসে ভিড় করবে লাইম লাইট থিয়েটারের দরজায়—রাশি রাশি ফুল নিয়ে আর প্রশংসা নিয়ে—

সোফা ছেড়ে মিমি হঠাৎ ঘরে পায়চারি শুরু করলে। অতর্কিতে ওর শরীরে যেন কাঁটা ফুটছে। ওর শরীরের রেখায় রেখায় নির্বাক অস্থিরতা। আমার কথাকে চাপা দিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল, উপায় নেই! উপায় নেই! কাল সকালেই!…তুমি জানো না ওজয়, আমি কত অসহায় হয়ে পড়েছি—ভয়ানক অসহায়! নিজেকে নিয়ে আমি আর পারি নে…

শেষ দিকে মিমির স্বর কাঁপতে কাঁপতে অতল হতাশায় ডুবে গেল। কি হয়েছে ওর আজ, কে জানে! উষ্ণ আগুনের তাপে ছোট এই ঘরটিতে যখন ঘনিয়ে এসেছে নিভৃত একটি অবসর, নীল বাতি আর ধূপ মিলে যখন রচনা করেছে রঙের আর গন্ধের অপূর্ব একটি কবিতা, তখন ওই মেয়েটির কি হল? গোড়া থেকেই লক্ষ করেছি, থেকে থেকে মিমির আজ ছন্দ যাচ্ছে কেটে, থেকে থেকে অভাব ঘটছে সঙ্গতির। নিজের সঙ্গে ওর কোথায় যেন বিরোধ বেঁধেছে।

এ সময় কি বলা যায়, ভাবছিলুম। আমার সুমুখ থেকে, মিমি কণ্ঠে প্রগাঢ় মিনতি ঢেলে বললে, কিছু মনে কোরো না ওজয়, আমায় তুমি ক্ষমা করো। সন্ধে থেকে আমি সহজ হওয়ার চেষ্টা করছি, তবু পারছি না কিছুতেই। আমি কি করব, বলতে পার? এমন করে পারি নে—আর পারি নে—

সোফায় ফের বসে পড়ে মিমি দু’হাতে মুখ ঢাকলে। অস্ফুট চিৎকারের মতো ওর শেষ কথাগুলো কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে গেল।

ঘরের আহাওয়াটা পাথরের মতো ভারি হয়ে এসেছে, মনটাও। আস্তে আস্তে মিমির মাথায় একখানি হাত রেখে বললুম, তোমার কি হল আজ মিমি? এমন অস্থিরতা তো আগে কখনো দেখিনি! আমায় বন্ধু বলে ভাবতে পারো না?

মুখ তুলে মিমি একটু শুকনো হাসলে: বন্ধু বলে না ভাবলে কি তোমায় আজ ডেকে আনতুম? ফিরিয়ে দিতুম ডিউককে, সমস্ত নিউইয়র্ককে?…আমার কিছু হয়নি বন্ধু, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিনা—

ওর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললুম, তোমায় আমি কোনো প্রশ্নই করব না মিমি, কিন্তু মনে হচ্ছে, আমার কাছ থেকে তুমি যেন কিছু লুকোবার চেষ্টা করছ?

সাঁৎরুজের অপর পাত্রটি নিঃশেষ করে মিমি আরেকটা সিগারেট ধরালে, তারপর সহজ ভাবে বললে, একটা গল্প শোনো ডার্লিং—

উনত্রিশ

আটাশ বছর আগে সানফ্রান্সিসকোয় একটি মেয়ে জন্মেছিল। গরিব ঘরের মেয়ে, তার নাম ধরো…, মিমি এক মুহূর্ত ভাবলে, তারপর ফের বলতে শুরু করলে: মেয়েটির নাম ধরো মিমি। এমনি কত মিমিই তো আছে পৃথিবীতে। তার বাপ ছিল মিস্ত্রি, প্যাকিং বাক্সের কারখানায় কাজ করত। রোজগার সামান্য, শহরের বস্তি—অঞ্চলে দোতলায় দু’খানা ঘর নিয়ে থাকত সেই গরিব পরিবারটি—মিমি, তার বাপ—মা, আর ছোট দুই ভাই। মিমির সমস্ত শৈশব কেটেছে সংসারের বাজার করে, আর মাটির নিচে মদ রাখবার কুঠুরির মতো অন্ধকার সেই ছোট দুটো ঘরের মেঝে ঘষে ঘষে সাফ করে। ঋতুতে ঋতুতে আমাদের যে রং বদলায়, মাঠে মাঠে ফোটে ডেজি আর ড্যাফোডিল, সে মেয়েটি তা জানত না, জানত না বাইরের জীবন কত বড়, কত বিচিত্র!…আশ্চর্য হচ্ছ? কিন্তু সত্যিই মিমি ছিল এমনিতর! অন্ধকার গুহার মতো ছোট ছোট দুটি ঘরে তার নিজস্ব একটি সম্পূর্ণ জগৎ গড়ে উঠেছিল। আর সে ছিল ঘরেরই আসবাবপত্রের শামিল! আসলে, মিমি নিজেকে তখন চিনত না, চিনতে শেখেনি। শুধু রবিবার দিনগুলো ছিল তার জীবনের বখশিস! রবিবারের সকালবেলায় মিমি ফর্সা পোশাক পরত, মাথা আঁচড়ে চুলে বাঁধত রিবন, গির্জে যাবার রাস্তায় সেই বোকা মেয়েটি দু’চোখে বিস্ময়ভরে বড়লোকদের মেয়েদের পানে তাকিয়ে থাকত—রং—বেরঙের ঝলমলে পোশাকের বাহার, গা বেয়ে আনন্দ পড়ছে উপচে, তারা যেন পরি—রাজ্যের মেয়ে! বাড়ি ফিরে মিমি ভাবত, চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখে এল। স্বপ্নই তো! নইলে, পৃথিবী কি এত ভালো, এত সুন্দর হতে পারে কখনো! কিন্তু কেন হতে পারে না? নিজেদের সেই ঘুপসি নোংরা ঘরের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে মিমির দম আটকে আসত! তুমি শুনছ ওজয়?

শুনছি বইকি! বলে যাও।

সিগারেটের অর্ধেকটা মিমির আঙুলের ফাঁকেই পুড়ে গিয়েছিল, ফেলে দিয়ে আবার সে শুরু করলে: এক—একদিন মিমির বাপ আসত মদ খেয়ে, হল্লা করত, কুৎসিত গালাগালি দিত, আর তার মা পাড়ার ছোকরাদের সঙ্গে সস্তা খেলো রসিকতা করত, আর কারণে অকারণে মিমির চুলের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিত। মার খেয়ে যে কাঁদতে হয়, বিদ্রোহ করতে হয়, তাও সেই বোকা মেয়ে জানত না। সতেরোটা বছর এমনি করে কেটে গিয়েছিল সেই বিশ্রী আবহাওয়ার মধ্যে, প্রতিদিন নিজেকে অপমান করে করে। সতেরো বছর পরে মেয়েটি বিদ্রোহ করতে শিখল। কেমন করে তা বলি। ক্রিসমাস ইভ, সন্ধে হয়ে এসেছে, অনেক দিনের পুরোনো সেই ফর্সা পোশাক পরে আর চুলে রিবন বেঁধে মিমি বাইরে বেরোবার জন্যে তৈরি, লাল একটি মোমবাতি সে সংগ্রহ করেছে, গির্জেয় গিয়ে আলো জ্বালাবে। ঘরের বাইরে পা দিতে গিয়ে মিমি থমকে দাঁড়াল—দরজার ওপারে তার বাপ দাঁড়িয়ে টলছে, পুরু পুরু ঠোঁট দু’খানা লালায় মাখামাখি চোখ দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো টকটকে, বিশ্রী বীভৎস মুখ! মিমির সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল। জড়ানো গলায় তার বাপ শুধোলে, ‘তোর মা কোথায়? কোথায় সেই শুয়োরের মাসি?’ ভয়ে ভয়ে মিমি জবাব দিলে, ‘ফ্রাঙ্কের ঘরে।’ বিড়বিড় করে বকতে বকতে তার মাতাল বাপ পাশের কামরার দিকে এগোল, কিন্তু যেতে পারলে না, দু’পা এগিয়েই আছাড় খেয়ে পড়ল, কাঠের বারান্দার ভাঙা রেলিঙের খোঁচায় কপালের খানিকটা গেল চিরে। কাঁচা রক্ত দেখে, মিমি কয়েক মিনিট আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হুঁস ফিরে আসতেই দ্রুতপায়ে নিচে দৌড়ল—ডাক্তার চাই! কাঠের সিঁড়ি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে মিমি নিচে নামছিল, সিঁড়ির মুখে একটা ল্যাম্পের ফ্যাকাশে আলো এসে পড়েছে। তাড়াতাড়িতে হঠাৎ আরেকটি দেহের সঙ্গে মিমির ধাক্কা লেগে গেল—সঙ্গে অনেক ফুলের গন্ধে মিমির চেতনা এল ঝিমিয়ে—

দম নেওয়ার জন্য মিমি এবার থামলে, ওর চোখ দুটি বুজে এসেছে, ক্লান্ত একটি নিশ্বাসে বুক উঠছে কেঁপে কেঁপে। অনেক বছর আগেকার সেই ক্রিসমাস ইভ—এর কথা হয়তো মনে মনে ও আরেকবার স্মরণ করে নিচ্ছে!

জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম, তারপর? তার আগেই মিমি চোখ মেলে বলতে লাগল, হ্যাঁ, সেই গুমোট আবছায়া সিঁড়িতে মাতালের গোঙানির মাঝখানে হঠাৎ অনেক ফুলের গন্ধ কয়েক মুহূর্তের জন্য মিমিকে যেন ঘুম পাড়িয়ে দিল! সেই মধুর ঘুম থেকে মিমি যখন জেগে উঠল, তখন দেখলে, তার সুমুখে এক ধাপ নিচে দাঁড়িয়ে একটি পুরুষমূর্তি! আবছা আলোতেও সে চিনতে পারলে—ডন! লম্বা—চওড়া চেহারা, ছোকরাটি লরি চালায়। যাকে একতলার ঘরে, বাজার করতে যাবার সময় কখনো কখনো দেখা হত, দোতলা থেকেও মিমি মাঝে মাঝে শুনতে পেত দমকা হাওয়ার মতো তার হাসির আওয়াজ। ডনের হাতে লিল্যাক ফুলের মস্তবড় একটি তোড়া। তোড়াটি নিবেদনের ভঙ্গিতে মাথা তুলে ধরে ডন বললে, ‘তোমায় দেব বলেই তোড়াটা নিয়ে যাচ্ছিলুম মিমি। নেবে?’

ভীরু হাত বাড়িয়ে মিমি লিল্যাক ফুলের সেই তোড়াটা আস্তে আস্তে বুকের কাছে তুলে নিল।

হেসে ডন বললে, ‘ঠিক মে—কুইন’—এর মতো দেখাচ্ছে তোমায়! বেড়াতে যাবে মিমি? চলো না, এমন চমৎকার সন্ধ্যা, আর বাইরে—’

কথা ফুরোবার আগেই সিঁড়ির ওপর থেকে গোঙানি শোনা গেল। তাড়াতাড়ি মিমি বলে উঠল, না, না, আমি এখন ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। আমার বাবা মদ খেয়ে—পড়ে গিয়ে কপাল কেটে ফেলেছে—’

ডন কিন্তু নড়ল না, পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছ? কিন্তু আধো—জানোয়ার একটা মাতালকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি শুনি? কপালের ঘা শুকোবার আগেই তো সে ফের মদ খাবে, হল্লা করবে? বাপকে বাঁচাতে গিয়ে, নিজেকেই তুমি যে মেরে ফেলতে বসেছ মিমি! তুমি কি বাঁচতে চাও না? এত বড় পৃথিবীতে তুমি নাই—বা মরলে মিমি? চলে এসো, বেরিয়ে এসো এই অন্ধকার কবর থেকে—বাইরে অনেক আলো, অনেক ফুল—’

ডনের বাদামি রঙের চোখে আলো পড়ে চকচক করছিল। মিমির মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গেল। এতদিন তো একথা সে ভাবেনি! সতেরো বছরের এই নোংরা গুমোট আবহাওয়ায় সত্যিই তার দম আটকে এসেছে! কিন্তু কেন—কেন সে মরবে? সে বাঁচতে চায়! থাক পড়ে রক্তাক্ত কপাল নিয়ে মাতাল বাপ, প্রতিবেশী ফ্রাঙ্কের ঘরে বিগত যৌবনা মা মরুক সস্তা রসিকতা করে, কী আসে যায় তার? সে বাঁচতে চায়! বাইরে অনেক আলো, অনেক ফুল—বাইরে ক্রিসমাস সন্ধ্যা!

রুদ্ধশ্বাসে মিমি ডনকে বললে, ‘চলো যাই—এক্ষুণি—’