নিশীথ নগরী – ২০

কুড়ি

গুচ্ছ গুচ্ছ চুলে ঢেউ তুলে, অত্যন্ত সহজ গলায় মিমি বললে, হ্যাঁ, মনে আছে বইকি। কিন্তু আমি বাজি রেখেছিলুম একটি চুমু—মাত্র একটি! কে নেবে বলো?

Surely me!

আশ্চর্য, অটোর আর আমার মুখ দিয়ে একসঙ্গে একই মুহূর্তে কথাটা বেরিয়ে এল। এই কথাটা বলবার জন্য দুজনেই যেন মনে মনে অপেক্ষা করছিলুম এতক্ষণ। কোথায় যেন জমে উঠেছিল কামনার উষ্ণ বাষ্প, এতক্ষণে একই মুহূর্তে গেল তা বিদীর্ণ হয়ে।

মিমি উঠল হেসে। সরু ইস্পাতের টুকরোয় ঘা দিলে যেমন তীক্ষ্ন ধাতব আওয়াজ বেরোয়, তেমনি সেই হাসি। হাসতে হাসতেই বললে, বাঃ, পুরুষ জাতটা তো ভারি উদার আর নিঃস্বার্থ।

অটো আর মিমির পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকালুম। মিনিট দুই দুজনের মুখের কথা গেল হারিয়ে। সেই এক পলকের দৃষ্টির ভেতর দিয়ে পরস্পরকে আমরা স্পষ্ট চিনে নিয়েছিলুম—চিনে নিয়েছিলুম বিংশ শতাব্দীর সমস্ত সভ্যতা আর সংস্কারের ছদ্মবেশের আড়াল থেকে নারীলোভী দুটি আদিম বর্বরকে।

ওদিকে ক্যাবারে—মেয়েদের নাচ—গান চলেছে সমানে, যৌবনের কামনার মতো শ্যাম্পেন উঠছে এখনো ফেনিয়ে। কিন্তু আমাদের চারপাশের এই আবহাওয়া হঠাৎ এমন গুমোট করে উঠল কেন? কিছু বলতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই অটো বললে, যাই বলো, বাজির পুরস্কারটা আমারই পাওনা—হ্যাঁ, আমারই তো পাওনা! Otto for–

কথাটা আমিই শেষ করে দিলুম: Otto for champagne and O’joy for champagne-colored lips.

দমকা হাসির হাওয়ায় মিমি এবার আইভিলতার মতো ভেঙে পড়বে যেন।

তারপর হাসি থামিয়ে, ফাঁকা বিয়ারের মগে পেন্সিলটা দিয়ে টুং—টাং আওয়াজ করতে করতে হালকা সুরে গেয়ে উঠল:

 Naughty boy and pretty boy,

 Otto Kruger and O’joy!

কথাটা আমি হঠাৎ রসিকতাচ্ছলেই বলেছিলুম, কিন্তু অটো কথাটা নিলে অন্যভাবে। বলে বসল, মেয়েদের ব্যাপারে অটো ক্রুগার লিমিটেড কারবার করে না।

কথাটা কানে বিশ্রী শোনাল। বললুম, অন্তত আজ রাতে আমি যে তোমার পার্টনার, তা ভুলে যেও না অটো!

Ugh!—অটোর মুখে সেই বিরক্তিসূচক শব্দটা আবার শোনা গেল : পার্টনার তো মিমিরও ছিল, তুমি লোনার কাছে চেষ্টা করে দেখলে না কেন? বাইবেলের দিব্যি দিয়ে কেউ তো তোমায় মানা করেনি!

আমি তোমারই কথার প্রতিধ্বনি করতে পারি, অটো, কি জবাব দেবে তখন বলো?—শুধোলুম।

জবাব এই যে, আমি আমার দাবি ছাড়ব না! অটো গর্জন করে উঠল।

দাবি! তুমি হাসালে অটো। সুন্দরী মেয়ের চুমু যদি দাবি করে নিতে হয়, তবে শ্বেত—পাথরের অনেক সুন্দরী নারী—মূর্তি তো আছে—আছে অনেক আড়ষ্ট কঠিন ঠান্ডা ঠোঁট!…আর দাবির কথাই যখন তুললে, তখন জেনে রেখো, তোমার চেয়ে দাবি আমারও কম নয় কিন্তু…

অটো একটা কিছু জবাব দিতে যাচ্ছিল, লাইটার জ্বেলে তাড়াতাড়ি তার নিভে যাওয়া চুরুটের সামনে ধরলুম। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললুম, কিন্তু বাজে তর্ক করে লাভ কি? আর কতক্ষণই বা ওই উৎসব রাত্রির পরমায়ু বন্ধু! তার চেয়ে মীমাংসার ভার দেওয়া যাক মিমির হাতেই, কি বলো?

অটোর জবাবের অপেক্ষা না করেই মিমির পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করলুম: তোমার বাজির পুরস্কার তুমি কাকে দিতে চাও, মিমি? যাকে ইচ্ছে দিতে পারো কিন্তু—আমরা আপত্তি করব না।

তাই নাকি!—দুই চোখে তরল কৌতুক ভরে মিমি আমার দিকে চেয়ে বলে উঠল: মনে মনে তোমার নিশ্চয় ধারণা যে, পুরস্কারটা তুমিই পাবে!

মিমির কণ্ঠে কি প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ ছিল? হয়তো আমারই মনের ভুল, তবু হঠাৎ সমস্ত মনটা গেল বিস্বাদ হয়ে! বললুম, ভুল করছ তুমি, দাবিও আমি করি না, দামও নিই না।…আচ্ছা, গুডবাই।

মাত্র আট দশ পা এগিয়েছি, হঠাৎ পেছন থেকে আমার ওভারকোটে টান পড়ল। ফিরে দেখি মিমি।

চলে যাচ্ছ যে বড়?

বললুম, কার্পোরাল অনেকক্ষণ একলা বসে আছে, তাই…

তুমি তো ছেলেমানুষ!—মিমি আমার বুকের কাছে ঘেঁষে এল, টলটলে চোখ দুটি আমার মুখের পানে তুলে ছোট খুকির মতো আবদারের সুরে বললে, না, তুমি যেতে পাবে না। এসো।

আশ্চর্য মেয়ে! কতক্ষণেরই বা আলাপ, অথচ পুরোনো বন্ধুর মতো জোর করতে ওর বাধল না একটুও!…ককেট? হয়তো তাই হবে। নারী হচ্ছে তোমারই ছায়া, তার পেছনে ছুটে চলো, সে পালাবে, কিন্তু সরে এসো তার কাছ থেকে, ছায়া তোমার অনুসরণ করবে। একটা শক্ত জবাব এসেছিল মুখে, কিন্তু মুখের কথা আমার গেল হারিয়ে—হারিয়ে গেল গাঢ়—নীল সেই চোখের আকাশে, চঞ্চল হাসির সেই মায়াকাননে।

তেমনি করেই হেসে মিমি চুপি চুপি বললে, দাম না হয় না—ই নিলে—যদি কেউ উপহার দেয়?

বললুম, তাহলে মনে করে রাখব অনেকদিন।—ফের ফিরে এসে বসতে হল চেয়ারে!

মিমি বললে, আচ্ছা, এক কাজ করা যাক, লটারি করে যার নাম উঠবে, সেই পাবে বাজির পুরস্কার, কেমন?

রাইট ও!—অটো উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে? কি বলো ওজয়? হা—হা—হা—

হল কাঁপিয়ে অটো হেসে উঠল। এক মুহূর্তে ওর গলার সুর পর্যন্ত বদলে গেছে দেখছি। টকটকে লাল রূঢ় মুখখানা এসেছে কোমল হয়ে। সুন্দরী মেয়ের সুমুখে এলে, গরিলার মতো বন্য বিশালকায় অটো ক্রুগার কখন যে সুন্দর, ভদ্র হয়ে ওঠে, তা কি ও নিজেই জানতে পারে?

স্কোর—শিট থেকে দু’টুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে মিমি একটাতে লিখলে: ‘অটো’ আরেকটাতে লিখলে: ‘ওজয়’। তারপর কাগজের টুকরো দুটো গোল গোল করে পাকিয়ে অটোর হাতে দিলে। পাকানো কাগজ দুটো অটো তার প্রকাণ্ড থাবার মধ্যে কয়েক সেকেন্ড নাড়াচাড়া করে জুয়ার ঘুঁটির মতো টেবিলে ছড়িয়ে ফেলে, মিমিকে বললে, একটা তুলে নাও।

একটা টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে মিমি কাগজটা খুলে দেখলে, তারপর তাকাল অটোর দিকে। ঠোঁটের কিনারে আর চোখের তারায় তার সেই দুষ্টু হাসি। অটোর চোখদুটো ঝকমক করে উঠল—আগ্রহে, আনন্দে, নেশায়। অটোর নামই উঠেছে নিশ্চয়। তা উঠুক, কিন্তু আমার মুখে কি অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল তখন?

রুদ্ধশ্বাসে অটো শুধোলে, কে—কার নাম উঠল?

নিঃশব্দে মিমি কাগজের টুকরোটা টেবিলের ওপর মেলে ধরলে। তাতে লেখা—আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলুম না। তাতে লেখা: ‘ওজয়’।

অটোর সারা দেহ পাথরের মূর্তির মতো আড়ষ্ট কঠিন হয়ে উঠেছে। চলন্ত একটা ডায়নামো যেন হঠাৎ গেছে থেমে।

একুশ

খানিকক্ষণ বিশ্রী গুমোট। তারপর অস্বাভাবিক শান্ত গলায় অটো বলে উঠল, আরেকবার লটারি করতে বললে, তুমি বোধ করি আপত্তি করবে না মিমি?

মিমি এতক্ষণ কাগজের টুকরোটার দিকে চুপ করে তাকিয়েছিল, মুখ তুলে বললে, কেন?

যদি বলি, আমার ধারণা, এর মধ্যে কোনো কারসাজি আছে!

এবার মিমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল, বললে, ভারি দুঃখিত আমি অটো।

মনে মনে কোথায় যেন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বললুম, আমি কিন্তু রাজি, আরেকবার লটারি হোক।

বেশ। বলে মিমি কাগজের টুকরো দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিলে। এবার নতুন কাগজে নতুন করে নাম লিখলে অটো নিজে, তারপর পাকানো টুকরো দুটো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে মিমিকে বললে, কুড়িয়ে নাও একটা।

কিন্তু হল না, এবারেও হল না। ভাগ্য এবারেও অটোকে ঠকিয়েছে। কাগজের টুকরোটার ওপর পেন্সিলে লেখা ‘Ojoy’ কথাটা ওর দিকে চেয়ে যেন মৃদু মৃদু হাসছে। এবার অটো কাগজ দুটো নিজেই ছিঁড়ে ফেললে। নিভে যাওয়া ফার্নেসের মতো ওর মুখ চোখ ঠান্ডা—ফ্যাকাশে।

বাজির পুরস্কারটা তাহলে আমারই পাওনা। মনে মনে তবু কেমন যেন অপ্রস্তুত আর অস্বস্তি বোধ করছিলুম। মিমির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে গেল। দেখি, মুখ থেকে ওর গলা অবধি একটি লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে…

.

কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, ভাবিনি। ভাবতে পারিনি যে, সভ্যতা আর সংস্কারের খোলস থেকে অতর্কিত ফণা তুলে দাঁড়াবে বর্বর বন্য কামনা। ভাবতে পারিনি যে, এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে ট্রয়!

মিমি এসে আমার বুকের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল, মস্ত একটা ক্রিসেন্থিমামের মতো মুখখানা তুলে ধরলে আমার দিকে, চোখের পাতা দুটি ধীরে ধীরে বুজে এল রাত্রিবেলার ফুলের মতো। মিমির মুখে ছড়িয়ে পড়েছে আলো—সোনালি আলোর সোনালি রেণু। রাঙা ঠোঁটে রাঙা নেশা টলমল করছে, ফ্রান্সের সমস্ত দ্রাক্ষাবনের চেয়ে মধুর, মৃত্যুর চেয়েও মোহময়।

ধীরে ধীরে আমার মুখ নুয়ে এল সোনালি সেই ক্রিসেন্থিমামের ওপর। পাতলা দু’খানি ভীরু ঠোঁট প্রজাপতির পাখার মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে।

হঠাৎ…এক সেকেন্ডের জন্য আমার দম আটকে এল, লোহার মতো শক্ত থাবায় কে যেন পেছন থেকে আমার ওভারকোটের কলার চেপে ধরেছে।

ফিরে দেখি, হ্যাঁ, অটোই বটে। কিন্তু এ অটোকে এতক্ষণ আমি চিনতুম না। বয়লারের মতো টকটকে লাল মুখের রেখাগুলি কেমন ক্রুর, কঠিন, একগোছা চুলে ডান দিকের চোখটা প্রায় ঢেকে গেছে, বাঁ—চোখে অন্ধকার রাত্রে মোটরের হেডলাইটের মতো সে কী তীব্রতা! উত্তেজনায় আর ঘন ঘন নিশ্বাস—প্রশ্বাসে ওর বুকখানা প্রচণ্ড হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠছে।

আমার পেছনে যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বন্য বর্বর একটা অতিকায় গরিলা! সুসভ্য পোশাকে দাঁড়িয়ে পুরাণ—বর্ণিত স্যামসন যেন। বিংশ শতাব্দীর মানুষের এই আদিম অরণ্য স্বাভাবিকতাকে আমি চিনতুম না—চিনতুম না অচরিতার্থ কামনার এই ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাকে।

শক্ত থাবার চাপে গলায় আমার লাগছিল, তবু শান্তস্বরে বললুম, ছেড়ে দাও, নেশার ঝোঁকে সহজ ভদ্রতাটুকু অন্তত ভুলে যেও না।

Ugh!—জড়িত স্বরে অটো গর্জন করে উঠল: তোর বুড়ো—ঠাকুরদার নেশা হোক, শুয়োরের নাতি! চুমু চোর!

প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে ফের বললুম, ছেড়ে দাও বলছি অটো, এটা মাতলামি করবার জায়গা নয়।

উত্তরে অটো আমার গলায় সজোরে একটা ঝাঁকানি দিলে, নিমেষের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে এল। তেমনি জড়িত কর্কশকণ্ঠে অটো বলে উঠল, থাম, থাম, ছেলে—মুখো মেয়ে কোথাকার! চুমু চোর!…বেশি কথা বলবি তো রাগবি বলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেব রাস্তায়…

মাথার চুল থেকে আমার পায়ের নখ পর্যন্ত আগুনের একটা হলকা নেমে গেল। ভাববার অবকাশ ছিল না, ছিল না স্থানকালপাত্র বিবেচনার সময়। দেহের সমস্ত শক্তি যেন আমার ডান হাতের মুঠিতে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

পলকের মধ্যে কি যে ঘটে গেল, বুঝতে পারিনি! শুধু দেখলুম, আমার ওভারকোটের কলার ছেড়ে দিয়ে, অটো দু’হাতে নাক—মুখ ঢেকে অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠল, তারপর সেই বিশাল দেহটা টলতে টলতে পেছনে ফাঁকা টেবিলটার ওপর হুড়মুড় করে গেল পড়ে।

অটো এতটা আশা করেনি নিশ্চয়। আমার প্রথম আক্রমণের জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু এখন সে নিজেকে নিয়েছে প্রস্তুত করে, টলমলে বিশাল দেহটাকে খাড়া করে আবার সে উঠে দাঁড়িয়েছে। আহত নাকের কাঁচা রক্তে ওর সাদা শার্ট যে কমিউনিস্টদের পতাকার মতো রাঙা হয়ে উঠেছে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। আমার দিকে লক্ষ্য রেখে, যন্ত্রণা—কাতর স্বরে বলতে বলতে ও এগিয়ে আসছে: এক ঘুসিতে তোকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিচ্ছি…দাঁড়া, ইঁদুর বাচ্চচা…

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, মিমি এতক্ষণ কাঠের মূর্তির মতো আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, চোখের সামনে যেন অবাস্তব একটা কিছু ঘটছে! আতঙ্কে তার মুখ ব্লটিং—কাগজের মতো সাদা! রক্তাক্ত বিকৃত মুখে অটোকে ফের এগিয়ে আসতে দেখে, হঠাৎ ও যেন শিউরে উঠল—আমার বুকের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিনতি করে বারংবার বলতে লাগল: এখান থেকে তুমি চলে যাও ওজয়, চলে যাও…লক্ষ্মীটি…

কিন্তু সংযমের বাঁধ তখন গেছে ভেসে, রক্তে ধরে গেছে আগুন। উগ্র উদ্ধত একটি মূঢ় স্পর্ধায় অপরিণামদর্শী যৌবন তখন হয়ে উঠেছে উন্মাদ!

ভীতিবিহ্বল মিমিকে টেনে সরিয়ে দিলুম, গা থেকে ওভারকোট খুলে ফেলে দিলুম ছুড়ে, হাতের আস্তিন গুটিয়ে দাঁড়ালুম সোজা হয়ে। লোহার মতো শক্ত, পাথরের মতো ভারি থাবা নিয়ে অটো তখন আমার প্রায় কাছে এসে পড়েছে। বুনো মহিষের মতো নাক মুখ দিয়ে তার অদ্ভুত একটা গর্জন বেরোচ্ছে: দাঁড়া! এক ঘুসিতে তোকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিচ্ছি।

কথাটা কিন্তু অতিরঞ্জিত নয় মোটেই। কলকাতার দুর্দান্ত ছোকরাদের মধ্যে শক্তিমান বলে আমার যতই সুনাম থাক, যতই জোর থাক আমার কবজিতে, সাড়ে ‘ছ’ ফিট লম্বা বিশাল এই ‘আয়রন—ম্যান’—এর তুলনায় আমি শিশু বইকি। মনে মনে জানতুম, চ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধা অটোর নিয়তির মতো অনিবার্য থাবার আঘাতে সত্যিই আমি সান্ডউইচ হয়ে যেতে পারি, কিন্তু দুরন্ত দুঃসাহস তখন আমার মতো মধ্যে মাথা তুলে রুখে দাঁড়িয়েছে আহত সাপের মতোই।

চকিতে আমার সামনে এক হাত দূরে হিংস্র একটা মুঠি উদ্যত হয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আমার গলার হাড় যেত চূর্ণ হয়ে…কিন্তু এ কী!

অরণ্যে যেন হঠাৎ আগুন লেগেছে! মারামারির অন্ধ উত্তেজনায় ওয়ে—সাইড গ্রোভ—এর এই মাতাল মজুরের দলকে তুলেছে খেপিয়ে! আমাদের এ দ্বন্দ্বযুদ্ধের কারণ কি, কেউ তা জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, দোষী কে! পৃথিবীতে নীতি নেই, ন্যায় নেই—নেই সভ্যতা আর সহজ বুদ্ধি। আছে শুধু বন্য বর্বর বীভৎস কতকগুলি পশু!

হ্যাঁ, আগুন লেগেছে এই জন—অরণ্যে। হই—চই চিৎকার, ভীত ক্যাবারে— মেয়েদের আর্তনাদ! টেবিল—চেয়ারগুলো টুকরো—টুকরো হয়ে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে পড়ছে, ঝমঝম শব্দে ভাঙছে কাচের বাসন। হঠাৎ বড় একটা প্লেট লেগে বাতির ঝাড়টা গেল গুঁড়িয়ে!

অন্ধকার! কালো পাথরের মতো জমাট, মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর! অন্ধকার এই উৎসব রাত্রি হঠাৎ যেন আতঙ্কে অস্থির, উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে। প্রকাণ্ড একটা যুদ্ধের জাহাজ যেন সমুদ্রের অন্ধকার অতলে যাচ্ছে তলিয়ে।

সেই অন্ধকারে অটোর মুষ্টি হল লক্ষ্যভ্রষ্ট। কিন্তু উন্মত্ত জনতার ঠেলাঠেলিতে শরীরের ভার আমি রাখতে পারলুম না, পড়ে গেলুম জনতার পায়ের তলায়। ভারি একটা বুট আমার বাঁ দিকের পাঁজরা চেপে ধরেছে, মনে হল ফুসফুস এখুনি ফেটে যাবে—কানে এল, মিমির তীক্ষ্ন ব্যাকুল চিৎকার: জকি, এদিকে. . . শিগগির. . .

তারপর আর কিছু মনে নেই।

বাইশ

চোখ মেলতেই মাথার ভেতর কেমন যেন গোলমাল বেধে গেল। চোখ মেলেছি বটে, কিন্তু আমার ধারণাশক্তি এখনো জাগেনি। অন্ধকার বিস্মৃতির কোলে ঘুমিয়েছিলুম এতক্ষণ—গাঢ় নিশ্চেতনার দেশে! রিপভ্যান উইঙ্কল—এর মতো হয়তো কত দীর্ঘ বছর পার হয়ে এসেছি, পার হয়ে এসেছি কত সমুদ্র, কত প্রান্তর, কে জানে! কে জানে, এ কোথায় এসে পড়লুম আমি?

চারিপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি অ্যাসবেস্টস দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা কুঠুরী—রেস্তোরাঁয় নিরিবিলি কামরার মতো। স্প্রিং—এর মতো একখানা খাটে আমি শুয়ে, পাশে একটা টেবিলের ওপর ওষুধের কয়েকটা শিশি আর কিছু ফুল। সবুজ ঘেরা—টোপ—ঢাকা স্তিমিত বাতি জ্বলছে।

বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়েছিলুম, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ফের শুয়ে পড়তে হল। তীক্ষ্ন নখ দিয়ে কে যেন আমার বাঁ দিকের ফুসফুসটা চেপে ধরেছে। যন্ত্রণায় আবার চোখ বুজে এল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই কে যেন আমার বুকে একখানি হাত রাখল—মোমের মতো নরম, পাথরের মতো ঠান্ডা একখানি হাত। মিষ্টি মেয়েলি গলায় কে যেন আমার কানে কানে বললে, চুপ করে শুয়ে থাকো লক্ষ্মীটি—নড়াচড়া কোরো না।

আবার চোখ মেলে তাকালুম। শিয়র থেকে একখানি মুখ নুয়ে পড়ছে আমার মুখের ওপর।

চিনতে পারছ আমায়?

চিনতে—কই না! তবে, ভারি চেনা—চেনা লাগছে কিন্তু ওই মুখ। হয়তো ভোরবেলাকার স্বপ্নে দেখেছি, হয়তো দেখেছি শহরের পথে আবছায়া কুয়াশায়। কোথায় যে দেখেছি, তা ঠিক স্মরণ করতে পারছিলুম না, তবু ফিকে সবুজ সেই কোমল আলোয় মুখখানি বড় চেনা—চেনা লাগছিল।…হ্যাঁ, চিনি বইকি, সেই গাঢ় নীল চোখ, ঠোঁটের কিনারে সেই তরল সঙ্কেত…

মিমি! তুমি মিমি!

হ্যাঁ, আমি। কেমন আছ ওজয়?

কেন, কি হয়েছে আমার?

কোনো জবাব না দিয়ে মিমি আস্তে আস্তে আমার বুকের ব্যান্ডেজের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্মৃতির কুয়াশা গেল কেটে, মনে পড়ল সেই ওয়ে—সাইড গ্রোভ, বর্বর কামনার সেই বন্য প্রতিযোগিতা, উন্মাদিনী সেই উৎসব রাত্রি, তারপর অন্ধকার—মৃত্যুর মতো গাঢ় সেই অন্ধকার!

আমি এখন কোথায় আছি মিমি?

নিউইয়র্কে।—মিমি বললে, নিউইয়র্কে লাইম লাইট থিয়েটারে। জকি তোমায় এখানে এনে রেখেছে।

সবই শুনলুম মিমির মুখে। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রে মাতালদের দাঙ্গা থামাবার জন্য শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। পুলিশ এসে যখন ফের আলো জ্বালল, তখন সেই ক্লাব হাউসটির চেহারা বিধ্বস্ত বিক্ষত জীবনের মতো ভয়াবহ। চতুর্দিকে ভাঙা টেবিল চেয়ার আর কাচের বাসনের টুকরো ছড়ানো, তারই মাঝে মাঝে আহত মাতাল মজুরের দল পড়ে পড়ে গোঙাচ্ছে। এমনি করেই চিরকাল ধ্বংস হয়ে যায় ট্রয়—সুন্দরী হেলেনের জন্য—হেলেনের সেই মধুরতর বিষাক্ত চুম্বনের জন্য। এমনি করেই বনমানুষের আদিম কামনার কাছে বিংশ শতাব্দীর সভ্যতা ও সংযম এক মুহূর্তে হয়ে যায় মিথ্যে।

হার্লেম—এর নাইট—ক্লাবে এরকম দাঙ্গা অবিশ্যি এই প্রথম নয়, পুলিশও যথারীতি দাঙ্গাকারীদের নাম লিখে নিল এবং কাউকে পাঠাল হাসপাতালে, কাউকে বা হাজতে। সেই রাত্রেই জকি আহত অবস্থায় আমায় নিয়ে চলে আসে নিউইয়র্কে; তারপর লাইম লাইট থিয়েটারের কুঠুরিতে এনে রেখেছে তার নিজের তদারকে। শুনলুম, প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি এখানে, সেই ভারি বুটের চাপে বাঁ দিকের পাঁজরা আমার দস্তুরমতো জখম হয়েছে।

বললুম, জকির কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলুম। জকি উদার, রাস্তার বিপন্ন লোককে আশ্রয় দেওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারে, কিন্তু মিমি, এত বড় নিউইয়র্ক শহরে এতগুলো বল—রুম আর থিয়েটার ছেড়ে এই সন্ধেবেলা তুমি রুগির পাশে বসে রয়েছ কেন?

আমার খুশি।—সারাদেহে একটা ঢেউ তুলে মিমি উঠে দাঁড়াল: যাই, জকিকে খবর দিয়ে আসি, তুমি জেগেছ।

খবর আর দিতে হল না, দরজা ঠেলে জকি নিজেই ঘরে ঢুকল।

হেল্লো বয়! কেমন আছ? বুকের ব্যথাটা কমেছে একটু? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে?

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্নের ভিড়ে জবাব দেওয়ার অবকাশ পাচ্ছিলুম না। জকি একটু থামতে হেসে বললুম, ফুটপাথে পড়ে থাকলেও আমার অসুবিধে হত না, তার চেয়ে এখানে অনেক আরামে আছি। বুকের ব্যথাটাও যেন একটু কম হচ্ছে।

জকি আমার পাশে বসে বললে, ক্রমে ক্রমে একেবারে সেরে যাবে, ডাক্তার বলেছে, ভরের বিশেষ কিছু নেই।

কোন মুহূর্তে কেমন করে মানুষের সত্যকার পরিচয় পাওয়া যায়, তাই ভাবছিলুম। পৃথিবীতে যেমন নীচতা আর বর্বরতা আছে, আছে হিংসা আর স্বার্থ, তেমনি স্নেহ আর সান্ত্বনাও তো আছে! আর আছে নিঃস্বার্থ বন্ধুতা! বললুম, তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ জকি—

জকি হো হো করে হেসে উঠল, থাক, থাক, এটা স্টেজ নয় হে সেন্টিমেন্টাল ছোকরা! জীবনটাকে সব সময় কতগুলো উচ্ছ্বাস দিয়ে স্যাম্পেনের ফেনার মতো ফুলিয়ে—ফাঁপিয়ে রাখ কেন বল দিকি? জীবনের আরেকটা দিক আছে জানো? গ্র্যানাইটের মতো শক্ত, কাজ দিয়ে ভরাট!…যাকগে, কাজের কথাই বলি শোনো: সেরে উঠে তুমি কি করবে ঠিক করেছ?

বললুম, আগামী কালের ভাবনা ভাবতে শিখিনি।

হ্যাঁ, আজকালকার ইয়ং—ম্যানদের মধ্যে একজন শৌখিন বোহিমিয়ান থাকে জানি! কিন্তু কাজ বাদ দিয়ে শুধু স্বপ্ন—বিলাসের কোনো মানে হয় না। শোনো, তোমার মতো একটি টাটকা তরুণ ছোকরা আমার দরকার, যাকে আমি নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চাই। তুমি বোধ হয় জানো, এই লাইম লাইট থিয়েটারের আমি একজন ম্যানেজার। এখানে হপ্তায় দু’দিন করে ক্লাস বসে অভিনয় আর প্রযোজনা সম্বন্ধে—তুমি সেই ক্লাসে ভর্তি হও, তাছাড়া খুচরো কাজও কিছু কিছু আমি জুটিয়ে দেব। কি বলো, রাজি?

জকির কথা শুনতে শুনতে আমার দুর্বল শরীরেও যেন রক্তের জোয়ার এসেছিল। পৃথিবী বিখ্যাত লাইম লাইট থিয়েটার, তারই ম্যানেজারের প্রিয় ছাত্র হয়ে কাজ শেখা—এ আমি কল্পনাও করতে পারিনি কোনোদিন। এক মুহূর্তে আমার সমস্ত অন্ধকার ভবিষ্যৎ যেন অনুরঞ্জিত হয়ে উঠল।

বললুম, নিশ্চয় রাজি। এত বড় সৌভাগ্যকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

বেশ।—আমার একখানা হাত ধরে মৃদু ঝাঁকানি দিয়ে জকি বললে, তাহলে তুমি সেরে উঠলেই তোমায় আমার সহকারী করে নেব।—তারপর হাতের ঘড়িটার পানে তাকিয়ে: সময় হয়ে এসেছে মিমি, তোমার মেকআপ এখনো বাকি, যাও তৈরি হও গে—

মিমি বেরিয়ে গেল। জকি উঠে বললে, আটটা বাজে, থিয়েটার এইবার শুরু হবে, আমিও যাই ওজয়। আর কাউকে পাঠিয়ে দেব?

বললুম, খানিকক্ষণ একলা থাকলেই আমি খুশি হব।

.

বাতিটা নিভিয়ে দিলুম। এখন চোখে আর ঘুম আসবে না। অন্তরঙ্গ এই অন্ধকার ভারি ভালো লাগছে! একা একা শুয়ে ভাবতে লাগলুম, কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছি!

আবার শুরু হল জীবনের নতুন একটি অধ্যায়!

অর্কেস্ট্রার শব্দ ক্ষীণ হয়ে কানে আসছে। প্লে বোধ করি শুরু হয়ে গেছে। শরীরে শক্তি থাকলে, উঠে গিয়ে সেই বিরাট প্রেক্ষাগারের অনেক দূরে একটি কোণে নিঃশব্দে বসতুম, দু’দিনের চেনা একটি মেয়েকে পাদপ্রদীপের আলোয় নতুন করে চেনবার চেষ্টা করতুম।

হঠাৎ রাশি রাশি পপি ফুলের সুগন্ধে অন্ধকার যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল—পোশাকের খসখস শব্দও শোনা যাচ্ছে না?…পরমুহূর্তেই হালকা নরম প্রজাপতির দু’খানি ডানা যেন চকিতে আমার ঠোঁট দু’খানা ছুঁয়ে গেল।

তেইশ

সকালের দিকে মিমি আজ এসেছিল। পরনে রূপালি—ধূসর সার্টিনের একটা চিনে ক্লোক শুধু, নিরাভরণ ও নিরাড়ম্বর চেহারা। দিনের বেলায় ওকে আজ অত্যন্ত কাছাকাছি স্পষ্ট করে দেখতে পেলুম। ওকে প্রথম দেখেছিলুম হার্লেমের সেই ক্লাব হাউসে, উৎসব রাত্রির আলোয়, নাচ গান হাসি হল্লা আর নারীদেহের সুগন্ধ দিয়ে তৈরি সেই স্বপ্ন—সুন্দর আবহাওয়ার মাঝখানে—দেখেছিলুম দুই চোখে শ্যাম্পেনের নকল মোহ নিয়ে! কিন্তু আমার এই ছোট্ট কুঠুরির জানলা দিয়ে তুষার—ভেজা দিনের যেটুকু ফ্যাকাশে আলো এসে পড়েছে, সেই আলোয় মিমিকে আজ নতুন করে দেখলুম। দেহে নেই সেই রমণীয় বঙ্কিমা, ঠোঁটের কিনারে আর গাঢ়—নীল চোখের তারায় নেই হাসির সঙ্কেত। যৌবনের কামনার মতো রাঙা সেই ঠোঁট এখন বাসি করবীর পাপড়ির মতো বিবর্ণ! মুখেও কয়েকটা রেখা পড়েছে না? ও কি বার্ধক্যের পদচিহ্ন? মিমির বয়স নির্ণয় করা এখন মুশকিল।

নিশীথ—রাত্রির আশ্চর্য একটা মায়া আছে জানো? রাতের মিমি সেই মায়া জানে। তা নইলে কে বিশ্বাস করবে বল যে, অতিসাধারণ এই মেয়েটির একটি চুম্বনের জন্যে সেদিনের সেই উৎসব—রাত্রি কতকগুলি মানুষের রক্তে ও হিংসায় কলঙ্কিত হয়ে উঠেছিল!

সুপ্রভাত ওজয়! কেমন আছ আজ?

বললুম, অনেকটা ভালো। ডাক্তার বলছে, আর দু’—তিনদিন বাদেই ব্যান্ডেজ খুলে দেবে।

তুমি এমন অসময়ে যে?

ঘরের কোণে ছোট একটা বেতের দোলা—চেয়ার ছিল, মিনি তাকে বসে পড়ে বললে, সকালের দিকে থিয়েটারে প্রায়ই আমায় আসতে হয়…মহলা দেবার জন্য। দুপুরে বসে ক্লাস, আইভানো পেত্রোভিচ—মস্কো থিয়েটারের আর্ট ডিরেক্টর ছিল—সে—ই পড়ায়। দুপুরেও মাঝে মাঝে আসি।…থিয়েটারে শিগগির একটা নতুন নাটক প্লে হবে জানো?

তাই নাকি?

প্যাশন—ফ্লাওয়ার।

প্যাশন—ফ্লাওয়ার! কামনার ফুল! পাঁক আর পাপের ঊর্ধ্বে মাটির যে কামনা সূর্যমুখীর মতো ফুটে ওঠে। কিন্তু কোথায় সে ফুল? ক্রমবিবর্তনের বহু স্তর পার হয়ে, সভ্যতার ধারাবাহিক ভাঙা—গড়ার পরেও চিরকালের বন—মানুষের সেই মজ্জাগত কলঙ্কিত কামনা সত্যিই কি ফুটেছে? প্যাশন—ফ্লাওয়ার ফোটে আমাদের কল্পনায়—নিশীথ স্বপ্নে—রঙ্গমঞ্চে! আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কোথায় পাবে সে—ফুল?

বললুম, চমৎকার নাম তো! গল্পটা বলো না, শুনি।

মিমি বললে, এই নাটকের নায়িকা হল মাদাম ফ্যানি, প্যারিসের এক হোটেলওয়ালি। শহরের সমস্ত অভিজাত সম্প্রদায়—বিশেষ করে আর্টিস্ট শ্রেণী এক সময় ফ্যানির নামে পাগল হয়ে উঠেছিল। অনেকের সঙ্গে সে প্রেমের ভান করেছে, তার সর্বনাশা রূপের মোহে অনেক ধনী লোক বসেছে পথে। তবু রাতের পর রাত হোটেলের সেই উন্মত্ত উৎসবের মাঝেও ফ্যানি মনে—মনে স্বপ্ন দেখত প্যাশনের নয়—প্যাশন—ফ্লাওয়ারের!

তারপর?

তারপর—, টেবিলের ওপর থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে মিমি ধরালে: তারপর হঠাৎ একদিন ফ্যানির জীবনে এল ক্লান্তি। তখন তার চোখের কোলে নেমেছে ছায়া, আর কালো চুলে লেগেছে ধূসর রং। একদিন গভীর রাতে হোটেলের সেই নাচ—গান আর উৎসবের মাঝে হঠাৎ তার মনে হল, কই, সে ফুল তো আজও ফোটেনি! পাগলের মতো ফ্যানি সেই প্যাশন—ফ্লাওয়ার খুঁজতে বেরোল। প্যারিসের রাস্তায় তখন তুষার পড়ছে, সমস্ত শহর শীতে আড়ষ্ট। আবছায়া অন্ধকারে সেই তুয়ারের মধ্যে ফ্যানি রাস্তায় রাস্তায় প্যাশন—ফ্লাওয়ার খুঁজে বেড়াতে লাগল। আর তাকে ফিরতে দেখা যায়নি।

অতি সাধারণ, মোহহীনা এই মেয়েটির মুখে সেই অতি সাধারণ ট্র্যাজেডির কাহিনি কেমন অদ্ভুত করুণ শোনাল। গল্প শেষ করে মিমি নিঃশব্দে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ বললে, তুমি কবে সেরে উঠবে ওজয়? আসছে হপ্তায় লাইম লাইট থিয়েটারের নতুন নাটকখানা খোলা হবে—প্রথম অভিনয় দেখতে আসবে তো?

বললুম, দেখব বইকি। ততদিনে আমি সেরে উঠব নিশ্চয়। ফ্যানির ভূমিকায় তোমাকেই দেখতে পাওয়া যাবে বোধ করি?

হ্যাঁ, ফ্যানি আমার খুব প্রিয়। অনেক দিন আগে ব্রডওয়ে স্টেজে ফ্যানির ভূমিকায় আমি প্রথম নেমেছিলুম। সেটা ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাস। তখন লোকে আমায় চিনত মাদাম ফ্যানি বলে—এখনো অনেক আলাপি লোক আমায় ডাকে ওই নামে।

হেসে বললুম, তোমায় কিন্তু অন্য নামে ডাকা উচিত। যে নামে অটো আমায় মিথ্যে করে ডেকেছিল।

অবাক হয়ে মিমি শুধোলে, কোন নামে?

চুমু—চোর!

মিমির মুখ থেকে গলা অবধি চকিতে একটি লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল—কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে অরুণোদয়ের মতো। অত্যন্ত বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করে শুধোলে, তার মানে?

মানে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমার অন্ধকার ঘরে চুপি চুপি যে এসেছিল, আমি জানি, সে কে! তুমিও জান মিমি। কিন্তু হঠাৎ কেন সে একটি চুমু দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তা এখনো জানি না।

অন্যদিকে তাকিয়ে মিমি চুপচাপ বসেছিল। একটু পরে বললে, তোমার পাওনা ছিল, সে রাতের লটারি তো তুমিই জিতেছিলে।

বাজে কথা! চুমু তো নোটের ভাঙানি নয় যে, তিনদিন বাদেও তা পাওনা থাকবে। পাওনা—চুমুর ওপর আমার কোনো লাভ নেই, তুমি সে—চুমু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলো।

এবার আমি যাই।—বাই বাই!

চেয়ার ছেড়ে মিমি উঠে দাঁড়াল।

বললুম, তুমি তাহলে বলে গেলে না, সেদিন আমার ঘরে সে এসেছিল কেন?

দরজার কাছে গিয়ে মিমি ফিরে তাকাল। আশ্চর্য, হঠাৎ তার ঠোঁটে আর চোখের তারায় ফিরে এসেছে সেই তরল হাসির সঙ্কেত। ফিরে এসেছে গ্রীবায় সেই রমণীয় বঙ্কিমা, মুখে সেই মায়া—লাবণ্য!

ফিরে তাকিয়ে মিমি শুধোলে, যে এসেছিল সেদিন সন্ধেবেলা, জানো সে কে?

কে?

ফ্যানি।

ফ্যানি! ফ্যানি এসেছিল! কেন?

মিমি তখন বাইরে চলে গেছে। দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেল: অন্ধকারে প্যাশন—ফ্লাওয়ার খুঁজতে।

চব্বিশ

পাঁজরার ব্যথাটা এখন অনেক কম। ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছে। আজ থেকেই চলা—ফেরা করতে পারতুম, কিন্তু জকি আপত্তি করছে। আরো দু’—তিনদিন বিশ্রাম না করলে আমায় সে কাজে লাগতে দেবে না—শরীর আমার এখনো দুর্বল।

প্রযোজনা সম্বন্ধে আইভানো পেত্রোভিচ—এর লেখা একখানা বই জকি আমায় পড়তে দিয়ে গেছে। গোটা দুই অধ্যায়ের পর আর এগোতে পারছি না। প্রায় দিন পনেরো হল এই ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে বন্দি হয়ে রয়েছি—আর পারা যাচ্ছে না। অতি সঙ্কীর্ণ এই ঘরখানা যেন আমার যাযাবর—মনের কবর! এই মুহূর্তে বাইরে জনতার সঙ্গে মিশে শহরের রাস্তায় রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরে এলে নতুন করে বেঁচে উঠতুম। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থিয়েটারের গ্রিনরুমের অ্যাসবেস্টস—ঘেরা এই অপরিসর অংশটুকুকে সত্যিই মনে হয় কবর—মৃত আত্মার অন্ধকার ঠান্ডা কবর! একা যখন থাকি, আলো জ্বালি না, অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হয়, জন—কলরব, ট্যাক্সির হর্ন, আর রাতের হোটেলের জাজ—ব্যান্ডের বিচিত্র ভাষায় সমস্ত নিউইয়র্ক আমায় ডাকছে—ডাকছে বর্তমান শতাব্দী!

কিন্তু রাত যখন গভীর হয়ে আসে, চোখে নামে অন্ধকারের মতো তন্দ্রা, তখন সেই স্তিমিত চেতনায় দেখতে পাই: ঘুমন্ত শহরের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় একা—একা একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে অপরূপ অবাস্তব সেই প্যাশন—ফ্লাওয়ার! তার চুলে, তার পোশাকে জমেছে তুষার, চোখে নেমেছে ক্লান্তি, কুয়াশায় আর তুষারে তার মুখের নকল প্রসাধন মুছে গিয়ে ফুটে উঠেছে প্রথম বার্ধক্যের নিষ্ঠুর সত্য। হ্যাঁ, সে মুখ ফ্যানির, কিন্তু আশ্চর্য, ফ্যানির মুখ মনে করতে গেলেই আমার কেবল মনে পড়ে মিমির মুখ! যে মিমি এসেছিল সেদিন সকালে, এসেছিল সেই সন্ধ্যার নিঃশব্দ অন্ধকারে প্যাশন—ফ্লাওয়ার খুঁজতে।

আসলে, আমরা সবাই খুঁজে বেড়াই সেই কামনার ফুল। খুঁজে বেড়াই নিশীথ রাত্রির জাগ্রত তন্দ্রায় আমাদের স্বপ্নাতুর অবচেতনায়!

পৃথিবীতে যেদিন কামনার জন্ম হল—জন্ম হল প্রথমতম মানুষের শরীরে, মজ্জায়, রক্তে, কামনার ফুলের সন্ধানও শুরু হয়েছে সেইদিন থেকেই। মাটির কামনা হল আমাদের মাটির ঘরের প্রদীপ, আর কামনার ফুল হল সুদূর নিশীথাকাশের তারা। বহু শতাব্দী, বহু যুগ পরেও মাটির প্রদীপ আজো সেই আকাশের তারার স্বপ্ন দেখছি।

সে স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি, ফ্যানিও দেখেছিল। সে স্বপ্ন নিয়ে যে মেয়েটি একদিন আমার অন্ধকার ঘরে এসেছিল, সেও হয়তো ফ্যানি, কিন্তু ফ্যানির কথা ভাবলেই মিমিকে আমার মনে পড়ে যায়। যে মিমির চোখে সেদিন মায়া ছিল না, ঠোঁটে ছিল না হাসির সঙ্কেত, সকালের রূঢ় আলোয় যার ক্লান্ত মুখে দেখেছিলুম বার্ধক্যের প্রথম পদচিহ্ন! সেই মিমিই তো ফ্যানি!

.

প্রযোজনা সম্বন্ধে সেই বইটা আজ শেষ করব বলে বসেছি। একটা খাতা আর একটা নীল পেন্সিল দিয়ে জকি বলেছে, দরকারি কথাগুলো নোট করে রাখতে। বইখানা কিন্তু রীতিমতো কৌতূহল জাগিয়ে রাখে, বিশেষত পেত্রোভিচের লেখবার ভঙ্গিটি চমৎকার—গল্পের মতো।

শিয়রে সবুজ শেড—ঢাকা বাতিটা জ্বালিয়ে, বুকের তলায় বালিশ রেখে খাতায় নোট লিখে চলেছি। রাত হয়েছে অনেক, বোধ করি বারোটা। শনিবার, আজকে থিয়েটারে প্লে আছে—অবশ্য সেই পুরোনো নাটকই। একাদিক্রমে প্রায় আড়াইশো রাত্রি ধরে এই নাটকই চলেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, নিউইয়ক কলকাতা নয়, এখানকার থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ পাঁচরাত্রি অভিনয়ের পর দর্শকদের জন্য হা—প্রত্যাশী হয়ে বসে থাকে না, নিউইয়র্কের যে—কোনো থিয়েটারে যে—কোনো নাটক একাদিক্রমে দুশো—তিনশো রাত্রি চলে যায়। লাইম লাইট থিয়েটারে তো দূরের কথা।

হ্যাঁ, রাত হয়েছে অনেক। প্লে বোধ করি শেষ হয়ে এল। দিনের অরণ্যের মতো গ্রিনরুম প্রায় স্তব্ধ হয়ে এসেছে। বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লুম, বইখানার বাকি অধ্যায় দুটো কাল সকালে শেষ করা যাবে।

কিন্তু অন্ধকার কি কথা কয়? মৃদু চাপা কণ্ঠে কে যেন কথা কইছে না? এ আমার নিদ্রাহীন নিঃসঙ্গ মনের স্বপ্ন—প্রলাপ নয়! চাপা মেয়েলি গলার আওয়াজে গ্রিনরুমের এই অন্ধকার যেন মর্মরিত হয়ে উঠেছে:

‘ফের আজকে এসেছ তুমি? কেন এলে?’

না, এ আমার জাগ্রত তন্দ্রার স্বপ্ন—প্রলাপ নয়। এ কণ্ঠস্বর আমি চিনি, হার্লেমের সেই উৎসব—রাত্রি যে কণ্ঠস্বরে গান হয়ে বেজে উঠেছিল।

‘হ্যাঁ, আজো আমি এলুম ফ্যানি, কিন্তু আজ আর আমি ফিরব না।’ মোটা ভরাট গলার আওয়াজ।

মিমি তাহলে ঘরে একা নয়! রাতের মিমি কখনো একা থাকে না, ফ্যানিও থাকত না। কিন্তু এই নিশীথ রাত্রে যে লোকটি মিমির দীপহীন সাজঘরে এসেছে, অভিনয়ের প্রশংসা ছাড়াও তার আরো কিছু বক্তব্য আছে নিশ্চয়! সমস্ত চেতনা আমার উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল:

‘তোমার কী দুঃসাহস ডিউক!’

‘তুমিই তো আমার দুঃসাহসী করেছ ফ্যানি! জানো, গত সাতদিন ধরে এই লাইম লাইট থিয়েটারে সেই একই বক্স আমি রিজার্ভ করে রেখেছি? কেন জানো? কেবল তোমাকে দেখবার জন্যে।’

‘১৯১৬ সালে ব্রডওয়েতে ঠিক এ কথাই তুমি আমায় বলেছিলে না ডিউক?’—দ্রুত জলতরঙ্গ বাজনার মতো সরু গলার তীক্ষ্ন হাসি শোনা গেল: ‘What about your new mistress–that platinum blonde?’

‘তুমি আমার প্রতি অবিচার করছ ফ্যানি, ওসব বাজে গুজব।…এখনো আমি তোমায় চাই, বিশ্বাস করো…সমস্ত নিউইয়র্ক আমি তোমার পায়ের তলায় লুটিয়ে দিতে পারি…’

‘ওসব কথা বড় পুরোনো হয়ে গেছে, নতুন কিছু বলবার থাকে তো বলো। নইলে, আমায় যেতে দাও, আমি ক্লান্ত!’

পাশের ঘরে আলো জ্বলে উঠল। অ্যাসবেস্টসের পার্টিশান পার হয়ে সে—আলো আমার ঘরের দেয়ালে এসে পড়েছে। খানিকক্ষণ চুপচাপ।

আবার সেই মোটা ভরাট গলার আওয়াজ, ‘আজো ফিরে যাচ্ছি ফ্যানি…কিন্তু এখনো আমি তোমায় চাই।’

মিমির স্বর, ‘গুড নাইট! শোনো, শোনো ডিউক, আমায় একটু সাহায্য করো না, জ্যাকেটের বোতামগুলো খুলে দেবে?’

ডিউক নিশ্চয় এই ডাকের অপেক্ষা করছিল। নির্জন নিশীথ রাত্রে যখন সেই অতিপুরাতন নাটকের অভিনয় শুরু হয়, তখন শেষ পর্যন্ত পুরুষের সাহায্য নারীর পক্ষে দরকার হবেই, ডিউক তা জানত বইকি।

‘Ah, how charming you are!’

ডিউকের কণ্ঠ গদগদ হয়ে এসেছে। চিরকালের পুরুষের সেই কামনা অতুর কণ্ঠ! অন্ধ প্রবৃত্তির সেই অর্থহীন ভাষা।

‘Don’t be silly darling ! You naughty !’ (আবার সেই চাপা হাসির কলরোল) ‘Oh, no, no…don’t don’t…’

হঠাৎ আলো নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার মদির করে উন্মত্ত চুম্বনের শব্দ! মিমির কণ্ঠস্বর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে নিঃশব্দতায় ডুবে গেছে।

.

নিশি—পাওয়া অনিদ্রাগ্রস্ত রোগী দেখেছ? তেমনি করে সেই অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে উঠে কখন যে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলুম, জানি না। আমার ঘরের পাশের বন্ধ দরজায় আঘাতও করেছিলুম বোধ হয়।

মিমি যখন দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়াল, তখন ফের আলো জ্বলেছে। ওর চুল এলোমেলো, গায়ে কালো রেশমের একটা চাদর জড়ানো, ঘন ঘন নিশ্বাস—প্রশ্বাসে ওর সর্বাঙ্গ তখন কাঁপছে।

ও, তুমি ওজয়! ঘুমোওনি এখনো?—মিমির মুখে শুকনো একটু হাসি দেখা দিল।

আমার মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল: অন্ধকারে তুমি প্যাশন—ফ্লাওয়ার খুঁজে পেয়েছ কিনা, দেখতে এসেছিলুম।