নিশীথ নগরী – ১৫

পনেরো

উডস্টক।

ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে পড়েছি, সে—জায়গাটার নাম উডস্টক। নিউইয়র্ক শহর থেকে শ’খানেক মাইলের মধ্যে। শহরতলীর এই জায়গাটাকে আর্টিস্টদের উপনিবেশ বলা যেতে পারে। উইলো বনের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা ক্লাব হাউস, রেস্তোরাঁ আর দোকানপাট—এই নিয়েই উডস্টক। মস্ত একটা মেলা যেন।

হার্লেমের সেই পাহাড়ি রাস্তাকে অনেক দূরে ফেলে এসেছি, ফেলে এসেছি সেই রোমাঞ্চিত রাত্রিকে, সুন্দরী লু’র চুম্বনকে। জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু হল। কূল থেকে কূলে ভেসে—চলা এছাড়া জীবনের আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে? প্রথমতর মানুষ যেদিন সৃষ্টি হল, সেই দিনই তার পায়ের তলায় রচনা করা হল পথ। অনন্ত এই পথযাত্রার ইতিহাস দিন—রাত্রির পৃষ্ঠায় কেবলই লেখা আর মোছা চলেছে। নারী হল সেই পথের বিপদ, আর বিশ্রাম, আর প্রেম যেন পথের ধারের পান্থাশালায় এক—একটি উৎসব সন্ধ্যা। আসলে, মনে মনে আমরা সবাই একা; উৎসবের বাতি যখন নিভে আসে, যখন ফুরিয়ে যায় প্যাশনের পানপাত্র, তখন চিরকালের সেই পথ দেয় ডাক। পেছনে পড়ে থাকে শুধু নিভে—যাওয়া বাতির ধূমশিখা, ছিন্নফুলের টুকরো, আর অস্পষ্ট কতগুলি পদচিহ্ন! সঞ্চয়? কিছুই না? আত্মার গহন নির্জনতায় নিজেদের আমরা ফিরে পাই শুধু।

পকেটে যখন পয়সা থাকে না, থাকে না আশ্রয়, তখন দার্শনিক হওয়া ছাড়া উপায় কি? এ—কথাটা ইতিপূর্বে বুঝেছিলুম একটিবার, আজো বুঝেছি। কিন্তু সারারাত পার্কের বেঞ্চে শুয়েই কাটাতে দেবে, আমেরিকার পুলিশ এতখানি উদার নয়। অতএব আজকের রাতটার মতো আস্তানা একটা চাই এবং তার সঙ্গে কিছু টাটকা খাবার। কেননা, আমার পাকস্থলী পকেটের মতোই খালি। অতি আধুনিক সাহিত্যিকরা আর যাই হোক, মিথ্যাবাদী নয়—মনের ক্ষুধার চেয়ে দেহের দুক্ষা যে ঢের বড়, চোদ্দ ঘণ্টা প্রায়োপবশনের পর তাতে আর সন্দেহ থাকে না।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, কুয়াশা আর অন্ধকার পথ—ঘাট মাখামাখি। যাওয়াই বা যায় কোথায়? ক্লাব—হাউস আর রেস্তোরাঁ থেকে তীব্র আলো ছিটিয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর, কানে আসছে অর্কেস্ট্রার সুর। কিন্তু ওদিকে তাকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই, পার্কের বেঞ্চে বসে আরো খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া ভালো। পকেট খালি হলেও সিগারেটের প্যাকেটটা এখনো খালি হয়নি। কবি এখন থাকলে, অন্তত মুখরোচক একটা প্রেমের গল্প শুনে সময় কেটে যেত বেশ।

ঠান্ডা হাওয়ায় তন্দ্রা এসেছিল, ভারি বুটের আওয়াজ কানে যেতেই ওভারকোটের কলার উলটে কান ঢেকে বসলুম, সিগারেটটা দিলুম নিভিয়ে, হ্যাঁ, কনস্টেবলটা এই দিকেই আসছে। কিন্তু না, বরাতটা আমার ভালো বলতে হবে, অন্ধকারে আমার কালো ওভারকোট তার নজরে পড়েনি নিশ্চয়, ভারি বুটের শব্দ করতে করতে পুলিশম্যান আমায় পার হয়ে গেল।

নতুন করে সিগারেটটা ধরালুম। রাত ক’টা বাজল, কে জানে। হিমে কখন যে ওভারকোটটা ভিজে উঠেছে টের পাইনি, ঠান্ডা এই বুনো হাওয়ায় এবার নাক—চোখ জ্বালা করতে শুরু হয়েছে। বিগতযৌবনা স্ত্রীর মতো ঠান্ডা হাওয়া! কিন্তু যাওয়াই বা যায় কোথায়?

Hey–who’s that guy?

নাঃ, জ্বালালে দেখছি! আবার সেই খটখট আওয়াজ! বললুম, এসো, থানায় যাবার জন্য আমি তৈরি হয়ে আছি। এই ফাঁকা পার্কের চেয়ে হাজতঘর গরম নিশ্চয়?

হাজত—ঘর সম্বন্ধে বেশ অভিজ্ঞতা আছে দেখছি যে!

মোটা কর্কশ গলায় হেসে উঠে লোকটা আমার সামনে এগিয়ে এল। বুট নয়, খটখট আওয়াজ ক্রাচের। সেই ঝলমলে মিলিটারি কোট—দাড়ি কণ্টকিত মুখ! আরে, এ যে খোঁড়া কার্পোরাল অগাস্টিন, গ্রিনউইচের মাঠে কানিভ্যালের ফটকের সুমুখে টুপি পেতে আমার কাছে একদিন যে ভিক্ষে চেয়েছিল। অন্ধকারে আমায় ঠাহর করে দেখে কার্পোরাল অবাক হয়ে গেছে: কিহে ছোকরা, চিনতে পারছ?

বললুম, তুমি এই রাতে এখানে যে?

আমার আবার এখানে—ওখানে কি?—অগাস্টিন বলতে লাগল: পৃথিবী জুড়ে রয়েছি আমরা যেখানে পাপ আর অত্যেচার, নগর যেখানে হয়ে গেল গোরস্থান, মানুষ হল জানোয়ার, সেইখানেই আমরা—শয়তানের দূত! যাক, তুমি এখানে একা—একা বসে কেন, তাই আগে বল শুনি? স্মাগলিং শুরু করেছ নাকি আজকাল?

বললুম, সুযোগ পাইনি, নইলে বেকার বসে থাকতুম না।

কেন, তুমি তো পপ—এর কার্নিভ্যালে ছিলে?

হ্যাঁ, ছিলুম বটে, তবে এখন আর নেই। হার্লেম থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি এই উডস্টকে। দেখা যাক, আবার কোথায় গেলে আস্তানা মেলে!

হুঁ, রাতটা কাটাবে কোথায়?

ভেবেছিলুম, পার্কের এই বেঞ্চেই কাটিয়ে দেব—কিন্তু আমেরিকান পুলিশরা এমন অতিথি—বিমুখ কেন বলো তো?

পার্কে রাত কাটাবে? (অগাস্টিন এবার বেঞ্চে আমার পাশে বসে পড়ল) খাওয়া—দাওয়াও হয়নি তাহলে বলো? তোমরা—আজকালকার ছেলেরা—জীবন সম্বন্ধে এমন উদাসীন কেন? নিজেকে ঠকিয়ে এই যে সস্তা দার্শনিকতা—এর কোনো মানে হয়? Life immense with pulse and passion! সেই তো জীবন!…এসো, আমার সঙ্গে এসো…

অগাস্টিন আমার হাত ধরে টানলে। শুধোলুম, যাব কোথায়? তুমি তো আমার চেয়ে ভ্যাগাবন্ড!

এসো না, দেখি দু’টুকরো কালো রুটি আর এক মগ মদ জোটে কিনা—

হাতখানা টেনে নিয়ে বললুম, ভিক্ষে—

আঃ…, অগাস্টিন প্রায় ধমক দিয়ে উঠল: ওই তো তোমাদের ভ্যানিটি—মিথ্যে অহঙ্কার! যার বেশি আছে, সে আমাদের দেখে—এ ভিক্ষে নয়, দাবি। এসো, উঠে এসো।

উঠলুম। পার্কে চুপচাপ বসে হিমে ভেজার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় খানিকটা ঘুরে বেড়ানো বরং ভালো।

.

ওয়ে—সাইড গ্রোভ, উডস্টকের সবচেয়ে গরিব ক্লাব হাউস যেটা, আমায় নিয়ে অগাস্টিন সেইখানেই ঢুকল। বাংলো প্যাটার্নের নিচু একতলা বাড়ি, বাইরে তেমন আলোর বাহার নেই। শোনা গেল, নিউ ইয়র্কের যত ফ্যাক্টরি—ম্যানদের আড্ডা এখানে। ফি শনিবার রাত্রে তারা এই ক্লাবে জড়ো হয়, মদ খায়, হল্লা করে, তারপর সোমবার ভোরে আবার ক্লাব হয়ে যায় ফাঁকা। সস্তা মদ আর সস্তা খাবারের জন্য ওয়ে—সাইড গ্রোভ ফ্যাক্টরিম্যানদের ভারি প্রিয়।

বাইরে একটি মাত্র বাতি জ্বলছে—কুয়াশায় ঝাপসা চোখের মতো। গরিব এই ক্লাব—হাউসটা গরিব ঘরের মেয়ের মতো কেমন যেন বিষণ্ণ—উৎসবের এতটুকু স্পন্দন নেই। শ্রমিকের আড্ডা অথচ শোনা যাচ্ছে না গান, না হল্লা। কিন্তু বাইরে থেকে ভুল করেছিলুম, ভারি কাঠের দরজা ঠেলতেই ভেতর থেকে এক আলোর বন্যা, সুরের ঝড়, আর হাসির হল্লা! এক সেকেন্ডে যেন আশ্চর্য—দ্বীপের একটা গুহায় পৌঁছে গেছি।

মাঝারিগোছের একটা হল, তারই একধারে চলেছে নাচ—গান। তিনজন নিগ্রো জাইলোকন, শেলো আর কেটসড্রাম নিয়ে অদ্ভুত সুরতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে, আর জন দশ—পনেরো সুন্দরী মেয়ে ধরেছে গান। মাঝখানে একটি পুরুষ আর একটি মেয়ে শুরু করেছে নাচ—আমেরিকার সবচেয়ে প্রিয় নাচ বোলেরো। সিগারেটের নীল ধোঁয়া, নারীদেহের প্রসাধন সুগন্ধ, অর্কেস্ট্রার সুর, রঙিন প্রজাপতির মতো সুন্দরী মেয়েদের লীলা—বিলাস—সব মিলিয়ে হলটার মধ্যে এক আশ্চর্য মায়া—জগৎ রচনা হয়েছে! ফেনিল সুরা আর ফেনিল যৌবনের উৎসব, অগাস্টিনের ভাষায়: Life immense with pulse and passion!

এধারে নিরিবিলি একটা টেবিল বেছে নিয়ে আমরা বসে পড়লুম। কার্পোরাল তার ঠেঙ্গোদুটো টেবিলের ধারে ঠেকিয়ে রেখে বললে, আজ আবার জকি এসেছে দেখছি!

শুধোলুম, জকি কে?

ওই যে লোকটি নাচছে—ওর ভালো নাম কেউ জানে না, সবাই চেনে জকি বলে—নিউইয়র্ক শহরের এক বিখ্যাত থিয়েটারের অ্যাসিস্টেন্ট—স্টেজ—ডিরেক্টর। মাঝে মাঝে জকিকে উডস্টকে দেখা যায় বটে, কিন্তু অদ্ভুত ওর খেয়াল, কখনো ও বড় বড় ক্লাব হাউসের দরজা মাড়ায় না, এখানে এসে ওঠে এই ওয়ে—সাইড গ্রোভে। হঠাৎ এসে শনি, রবি এই দুটো দিন হই—হই করে কাটিয়ে চলে যায়, তারপর হয়তো দু’মাস আর পাত্তা নেই! কিন্তু লোক ভালো…, অগাস্টিন পাইপ ধরিয়ে বলতে লাগল: বুকের ছাতি যেমন চওড়া, মনটাও তেমনি। এত মিশুকে আর এত আমুদে—ফুর্তি যখন করে, তখন চেনা—অচেনা সবাইকে নেয় দলে জুটিয়ে। জকি যেদিন আসে, ওয়েসাইড গ্রোফ—এর চেহারাই সেদিন যায় বদলে।

তখনো অর্কেস্ট্রা বেজে চলেছে, নাচে এবার সবাই যোগ দিয়েছে। মেয়েরা গাইছিল:

 বনে—বনে আর মনে—মনে আজ ফুটছে গো

 গানের ফুল,

 চোখে—চোখে আর রাঙা ঠোঁটে—ঠোঁটে ঘটছে গো

 মধুর ভুল!

চেয়ে দেখি, অগাস্টিনের ঘোলাটে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, গানের ছন্দের সঙ্গে সেও একপায়ে তাল দিয়ে চলেছে। টেবিলের ওপর খাবার আর বিয়ার এসে পৌঁছেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই।

ষোলো

শ্যাম্পেন?

ফিরে তাকালুম। দেখি, অপরিচিত একটি পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স বছর চল্লিশের কম হবে না, দীর্ঘ সুগঠন দেহ, পরিষ্কার করে কামানো মুখে লাল আভা, পরনে সাদা ট্রাউজারের ওপর মাখন—রঙের সিল্কের হাতকাটা শার্ট। বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে লোকটি বলছে, শ্যাম্পেন? একটু শ্যাম্পেন দিই তোমাদের?

এই তো জকি—ওয়ে—সাইড গ্রোভ—এর এই উৎসব রাত্রির হৃৎপিণ্ড! অগাস্টিন মুখ ফিরিয়ে তাকাতে জকি এবার উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠল, হেল্লো! কার্পোরাল কতক্ষণ এসেছ?

কার্পোরাল বললে, এই কিছুক্ষণ। আমার এই ভ্যাগাবন্ড বন্ধু, নামটা কি হে?

বললুম, অজয়। অথবা শুধু জয় বলতে পার।

হাঁ, এই ভ্যাগাবন্ড বন্ধু জয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পার্কের একটা বেঞ্চে, পুলিশের তাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে এই ক্লাব—হাউসে।

ও, তোমার বন্ধু? Quite a bright kid!

জকি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে। গাঢ় আন্তরিকতায় ওর হাতের আঙুলগুলি যেন কথা কয়ে উঠল।

কার্পোরাল বলতে লাগল, যুদ্ধের সেই ট্রেঞ্চ থেকে ফিরে তোমার সঙ্গে বোধ করি এই প্রথম দেখা হল জকি, কিন্তু আজকে তোমার এই উৎসব দেখে আমার আবার সেই আগেকার অগাস্টিন হতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিউইয়র্কের সমস্ত সুন্দরী ইভদের জুটিয়ে এনেছ দেখছি, বেশ, বেশ।

তেমনি মোটা কর্কশ গলায় কার্পোরাল হেসে উঠল। কিন্তু হাসলে যে কুৎসিত মুখও সুন্দর দেখায়, তা এই প্রথম জানলুম। জকিও হাসলে। হেসে বললে, কি জানো কার্পোরাল, বয়স যত বাড়ছে, আমার বিশ্বাস, আমার যৌবনও তত বেড়ে যাচ্ছে! তাই তো সুন্দর মুখের আয়নার নিজের সুন্দর যৌবনকে মাঝে মাঝে দেখে নিই।

বিয়ারের মগটা নাড়াচাড়া করতে করতে কার্পোরাল শুধোলে, হ্যাঁ, শ্যাম্পেনের কথা কি বলছিলে?

জকি বললে, তোমরা আজ আমার অতিথি। কি খাবে বলো—শ্যাম্পেন না পিচ ব্যান্ডি?

There’s nothin like champagne in champagne-colored lips! কার্পোরাল হেসে জবাব দিলে।

জকি এবার ব্যস্ত হয়ে ডাক দিলে: মিমি শ্যাম্পেন!

সুন্দর একটি মেয়ে মদের ট্রে হাতে নিয়ে এতক্ষণ এ—টেবিল ও—টেবিলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল—প্রাচীন ইরানের পানশালায় সাকির মতো। জকির ডাক শুনে মেয়েটি এদিকে এগিয়ে এল। পরনে অদ্ভুত পোশাক—সাদায়—কালোয় লালে— নীলে মেশানো আলখাল্লা। মাথায় রূপালি ধূসর চুলের ওপর কালো রঙের হালকা ক্রমশ—সরু টুপি—অনেকটা গাধার টুপির মতো। গাঢ়—নীল চঞ্চল চোখের তারার হাসির প্রদীপ—আলোর সঙ্কেত! মেয়েটি যেন একটি কৌতুক কবিতা!

অর্কেস্ট্রা তখন থেমেছে। শ্যাম্পেনের ট্রে হাতে নিয়ে মিমি এগিয়ে আসছে—হালকা নাচের ছন্দে। লীলায়িত শরীর থেকে লাবণ্যের বন্যা ঝরে ঝরে পড়ছে। বনচারিণী ভ্রমরীর মতো ও গুনগুনিয়ে গাইছে:

 রাতের গানের মতো লাজুক কথার মতো

 সুর বাজে দূর বেহালায়,

 মধুর প্রেমের মতো মদির চুমার মতো

 রাঙা নেশা মোর পেয়ালায়!

কার্পোরালের দিকে তাকিয়ে দেখি, মিলিটারি কোটের আস্তিন থেকে রুমাল বের করে মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিচ্ছে। প্রথম যৌবনের এই অপরূপ সমারোহে ওর মৃত যৌবন হঠাৎ আবার বেঁচে উঠল নাকি?

জকি বললে, শ্যাম্পেন পরিবেশন করো মিমি, এরা আমার অতিথি।

নীলাভ কাচের দুটি গেলাস এগিয়ে এল আমাদের হাতের কাছে। টলটলে আঙুরের রস—মিমির যৌবনের মতো, যৌবনের কামনার মতো। জকি নিজেই তুলে নিলে তৃতীয় গেলাসটি, তারপর বাঁ হাতখানা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে ডান হাতে গেলাসটি উঁচু করে ধরে বললে, আজ কাকে স্মরণ করে আমরা পান করব বন্ধু?

মিমি তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। অপূর্ব ওর হাসি! অপরূপ ওর ঠোঁট! ইতালির আঙুরের মতো নরম, শ্যাম্পেনের মতো রাঙা! আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কার্পোরালের কথার প্রতিধ্বনি: Nothin like champagne in champagne-colored lips!

ঠিক এই সময় আবার বেজে উঠল অর্কেস্ট্রা, এবার মৃদু প্রথম দক্ষিণ হাওয়ায় বনমর্মের মতো, প্রেমিকের প্রথম কথার মতো মৃদু সুরে। আনন্দে জকি প্রায় চিৎকার করে উঠল, হুররে—

প্রথম গেলাস আমাদের নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। মিমি এল আরেকটুকু এগিয়ে, ওর চোখে তেমনি আলোর সঙ্কেত, ঠোঁটে রাঙা হাসির মদিরা! আমার গেলাস দ্বিতীয়বার পূর্ণ করবার সময় যেন কানে কানে বললে, There are no stars like those in those dark eyes!

তারপর ট্রেখানা তুলে নিয়ে গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে চলে গেল :

 মধুর প্রেমের মতো মদির চুমার মতো

 রাঙা নেশা মোর পেয়ালায়!

চমৎকার মেয়েটি, না? কার্পোরাল শুধোলে।

কে, মিমির কথা বলছ? হ্যাঁ, মেয়েটি মন্দ নয়, তবে সব সুন্দরী মেয়েই তো এক! সেই একঘেয়ে পুরোনো কাব্য, রকমফের শুধু রঙচঙে মলাটের! বললুম।

কার্পোরাল এবার চট করে চটে উঠল, বললে, মেয়েদের সম্বন্ধে লিনিক হওয়া দেখছি আজকালকার ছোকরাদের মুদ্রাদোষ। কিন্তু জানো, পুরুষের জীবনে এমন এক একটি মুহূর্ত আসে, যখন নারী সুন্দরী কি কুৎসিত, সে কথা মনেই ওঠে না, জীবনে একটি মেয়ে এল, এই কথাটিই সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।—বিয়ারের মগটাও প্রায় খালি হয়ে এসেছিল, শেষ চুমুক দিয়ে অগাস্টিন ফের শুরু করলে: বলি শোনো, আমার জীবনের সেরা দশটা বছর, লোকে যাকে বলে ফসল কাটার সময়—আমি অপব্যয় করেছি সুন্দরী মেয়েদের জন্যে। হ্যাঁ, বাজে খরচই বলতে হবে! ভালোবেসেছি, ভালোবাসার ভান করেছি, নিজেও ঠকেছি। মনে মনে আজ মেয়েদের আমার চেয়ে কেউ বেশি ঘৃণা করে কিনা জানিনে, তবু আজও সুন্দরী মেয়েরা সামনে এসে দাঁড়ালে—আচ্ছা, আমার এই কোটটা খুব পুরোনো হয়ে গেছে, না?

অদ্ভুত এই খাপছাড়া প্রশ্ন শুনে কার্পোরালের দিকে তাকিয়ে দেখি, অতিজীর্ণ সেই মিলিটারি কোটের আস্তিনের লম্বা লম্বা সুতোগুলো সে লুকোবার চেষ্টা করছে। বুঝলুম, বহুদিন বাদে তার হতশ্রী চেহারাটা হঠাৎ তাকে লজ্জা দিয়েছে।

সে কথায় কান না দিয়ে কার্পোরাল বললে, তোমায় কিন্তু মিমির ভালো লেগেছে হে ছোকরা।

তাই নাকি? কি করে বুঝলে?

শুনলে না, কানে কানে বলে গেল, তোমার কালো চোখে যে তারা জ্বলছে, সে তারা আকাশে নেই!—তারপর খামোকা বিশ্রী মোটা গলায় হেসে উঠে কার্পোরাল ফের বললে, কী মুশকিল, বুড়ো বয়সে তোমায় কি শেষে হিংসে করতে বসলুম নাকি।…তোমার মগে আর বীয়ার আছে?

কার্পোরালের আজ নেশা ধরেছে—পুরোনো দিনের নেশা, পুরোনো যৌবনের নেশা— পুরোনো মদের চেয়ে যা গাঢ়, তীব্র!

সতেরো

রাত কত হয়েছে, বোঝবার উপায় নেই। বাইরে এখন রাত্রি হয়তো গরিব মেয়ের মতো শীতে কাঁপছে, কিন্তু এই ক্লাব—ঘরের ভেতর উৎসব এখনো ফেনিয়ে উঠছে শ্যাম্পেনের ফেণার মতো। উষ্ণ স্পর্শ, উষ্ণ নিশ্বাস আর উষ্ণ নেশা! অর্কেস্ট্রা আবার থেমেছে, টুকরো টুকরো কথা, হাসি আর আলাপে প্রকাণ্ড হলটা গুঞ্জরিত হচ্ছে মস্ত একটা মৌচাকের মতো। এদিকে—ওদিকে ছড়ানো টেবিলগুলি ঘিরে ছোটদল। নানা কণ্ঠ থেকে নানা মন্তব্য ছিটকে ছিটকে পড়ছে।

ডান দিকের টেবিলে মজুরশ্রেণীর একজন আধাবয়সী লোক নাচওয়ালি একটি মেয়েকে কোলে বসিয়ে তারস্বরে প্রেম নিবেদন করছে। তার বক্তব্য মোটের ওপর এই: ‘রুথ হচ্ছে তার সপ্তদশ প্রিয়তমা, সুন্দরী রুথকে সে তার সাঁইত্রিশ বছরের পুরোনো ওয়ার্কশপ—এর চেয়ে ভালোবাসে। রুথ—এর অত্যন্ত সৌভাগ্য বলতে হবে যে, আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ওয়ার্কম্যান টমাস কুক তার চুমু চাইছে। কিন্তু রুথ যদি চুমু দিতে রাজি না হয়, তবে টমাস তাকে স্যান্ডউইচ করে খেয়ে ফেলতে পারে অনায়াসেই।

দুঃসাহসিকা রুথ প্রেমের সেই মহাক্ষুধাকে উপেক্ষা করে মাঝে মাঝে মাতাল টমাসের কান মুলে দিচ্ছে, আর দমকা হাসিতে ফেটে পড়ছে তুবড়ির মতো। ওপাশ থেকে কে একটা লোক জড়িত স্বরে গাইছে:

 Green grass mows well,

 A lovely girl loves well.

জীবনে বোধকরি ও এই দুটি লাইনই শিখেছে, কেননা দেড় ঘণ্টা পরেও গানের তৃতীয় লাইনে পৌঁছতে পারল না।

কার্পোরাল এতক্ষণ ঝিমিয়ে পড়েছে নেশার ঝোঁকে। চোখ বুজে টেবিলের ওপর মাথা রেখে পড়ে আছে। হয়তো ঘুমুচ্ছে, হয়তো বা স্বপ্ন দেখছে এমনই এক বিগত উৎসব—রাত্রির। যাক, ওকে আর নাই জাগালুম।

বসে বসে ভাবছি, কোথা থেকে কোথায় এসে পড়লুম! অন্ধকারে সেই পার্কের বেঞ্চে বসে আত্মসংযমের চেষ্টা করছিলুম—চেষ্টা করছিলুম খেলো কমিউনিস্ট—এর মতো জেলে গিয়ে ‘মার্টার’ হওয়ার, কিন্তু এক মিনিটে পট—পরিবর্তন। অন্ধকারে হঠাৎ আরব্যোপন্যাসের ছেঁড়া একটা পৃষ্ঠা উড়ে এল যেন। যাই বলো, ভাগ্য কিন্তু আমেরিকান পুলিশের চেয়ে ঢের ভদ্র আর অতিথি পরায়ণ।

কিন্তু যেখানেই যাই না কেন, নারী আছেই। নারী আছে সেই সেদিন থেকে, যেদিন প্রথমতম পুরুষের বুকের পাঁজরা থেকে হল ইভ—এর সৃষ্টি। আসলে, মেয়েরা হল পুরুষেরই কামনার প্রতিবিম্ব, যে কামনা চলে এসেছে পিতামহ থেকে পিতায়, পিতা থেকে সন্তানে—বংশানুক্রমে—শরীরের রক্ত—ধারায়, প্রতি অণু— পরমাণুতে।

.

একা—একা বসে কেন?

মুখ তুলে দেখি, সেই সাদা—কালোয়—লাল—নীলে মেশানো আলখাল্লা আর চুড়োর মতো হালকা টুপি! মিমি—এই পান্থশালার সাকি।

হেসে বললুম, বসো। দোসর কোথা পাবি?

মিমি বললে, দোসর খুঁজে নিতে হয়।

বললুম, খুঁজলেই কি সব কিছু পাওয়া যায়? আর যা পাওয়া যাবে, তা যদি আমার পছন্দ না হয়?

বলি শোনো: সোনালি চুল—আঙুরলতার মতো, গাঢ় নীল চোখ, জুন মাসের আকাশ যেন।

চামচে দিয়ে শ্যাম্পেনের ফাঁকা গেলাসে টুং—টাং আওয়াজ করতে করতে মিমি শুধোলে, আর? আমার দিকে না তাকিয়ে বলে যাও।

আর দু’খানি ঠোঁট—Champagne-colored lips!

চেয়ে দেখি, মিমির চোখে—মুখে চাপা হাসি উছলে পড়ছে।

আর?

হ্যাঁ, একে—একে বলছি। শ্বেত—হংসের মতো গলা—ধবধবে নিটোল, মসৃণ! আর…

থামো, বন্ধু থামো!—হঠাৎ দেখি কার্পোরাল চোখ মেলে উঠে বসেছে। আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে সে বলে উঠল, তোমার বর্ণনাটা চমৎকার, কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই, গলা থেকে আর নিচে নেমো না…

মোটা গলায় কার্পেরোল হা—হা করে হাসতে লাগল।

You drunken fool !

চট করে কার্পোরোলের মাথায় গাধার টুপিটা পরিয়ে দিয়ে, সারা শরীরে একটা ঘূর্ণী তুলে মিমি ছুটে পালাল।

খানিকবাদে মিমি ফের ফিরে এল, সঙ্গে ফ্যাকাশে রঙের রোগাটে আরেকটি মেয়ে। আমার দিকে চেয়ে শুধোলে, তাস খেলতে জানো?

জানি বইকি একটু—আধটু। কি খেলা?

যা হয়! নাচতে আমার ভালো লাগছে না, তার চেয়ে তাস খেলি এসো।

হাত ধরে মিমি একটা টান দিলে।

বললুম, কিন্তু কার্পোরাল যে একলা থাকবে!

কিছু না, কিছু না, একলা থাকা আমার অভ্যেস আছে।—তারপর মিমির দিকে চেয়ে কার্পোরাল বললে, এক মগ বিয়ার আমার জন্যে পাঠিয়ে দিতে পারবে কি ডার্লিং?

নিশ্চয় মিস্টার গুড ডঙ্কি! বলে সে এগোল।

পেছন থেকে শুনতে পেলুম, হাসতে হাসতে কার্পোরাল বলছে: It is better to be sneered at than yawned at!

মিমি হলের একেবারে ওপ্রান্তে নিয়ে এল আমাদের। বললে, কি খেলা যায়? স্ট্রিপ পোকার? ব্রিজ?…ব্রিজই ভালো, কি বলো? আমি আর লোনা পার্টনার, তোমার পার্টনার বেছে নাও।

এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখি, চেনা মুখ একটিও নেই। কাকেই বা পার্টনার করা যায়? কিছুদূরে একটা টেবিলের সামনে একা—একা বসে একটি ছোকরা জড়িত গলায় তখনো চিৎকার করছিল:

 Green grass mows well

 A lovely girl loves well

ছোকরাটির চেহারাখানা দেখবার মতো বটে! লম্বায় সাড়ে সাত ফুটের কম হবে না, গলা—খোলা শার্টের ফাঁকে লোহার কপাটের মতো শক্ত চওড়া বুক দেখা যাচ্ছে, ওর কব্জির বেড় বোধ করি আমার উরুর সমান। মদ খেয়ে মুখখানা টকটকে লাল। লোকটি যেন লিলিপুট—রাজ্যে গালিভার।

উঠে গিয়ে ওকেই ডাকলুম, হেল্লো! তাস খেলবে?

ছোকরাটি গর্জন করে উঠল: ugh! রেখে দাও তোমার তাস, আমি এখন গান গাইছি—বিরক্ত কোরো না।

তারপর আবার জড়িত কণ্ঠে শুরু করলে: Green grass…

এবার ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললুম, শুনছ, ওই যে মেয়েটি—তোমায় ও ডাকছে, তোমার সঙ্গে ভাব করতে চায়।

আশ্চর্য, তৎক্ষণাৎ ওর গান গেল থেমে। মিমির পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল, মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। অত্যন্ত মোলায়েম গলায় শুধোলে, সত্যি? সত্যি বলছ?

আঠারো

সত্যি বলছ? সত্যি?—খুশিতে ছোকরাটির সারা মুখখানা ঝলমল করে উঠল। সোজা হয়ে বসে সে বলতে লাগল, ওই মেয়েটির কথা বলছ না—রামধনু রঙের পোশাক—পরা ওই সুন্দরী মেয়েটি? Ah, adorable, she’s my May-Oueen!

বললুম, হ্যাঁ, ওই তো! তোমার সঙ্গে ভাব করতে চায়, দেখছ না বারবার তাকাচ্ছে তোমার দিকে। এসো না, তাস খেলবার ছল করে ওর সঙ্গে আলাপ করা যাক। ব্রিজ জানো তো?

ব্রিজ! ফুঃ!—নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে ছোকরাটির ঠোঁটের প্রান্ত কুঁচকে গেল: ও—খেলা পাঁচ বছরের ছেলেও জানে! তার চেয়ে বক্সিং লড়তে বলো, লোহার রড বেঁকাতে বলো—আচ্ছা, আতলান্তিক পার হতে বলো না, হাসতে হাসতে দেখিয়ে দিচ্ছি পারি কিনা। অটো ক্রুগার—ক্যালিফোর্নিয়ার বেস্ট স্পোর্টসম্যান—পারে না, এমন কাজ দুনিয়ায় নেই, বুঝলে?

প্রচণ্ড উৎসাহে অটো ক্রুগার টেবিলের ওপর তার বক্সি—এর নমুনা দেখালে। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ারের মগটা মেঝেয় পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ওর পেশীতে পেশীতে জেগেছে শক্তির জোয়ার, দ্রুত নিশ্বাসে চওড়া বুক উঠছে ফুলে ফুলে। ভারি মজা লাগছিল অটোর কথা শুনতে, কিন্তু কথাগুলো সত্যি বইকি। বাস্তবিক, সুন্দরী নারীর জন্য পুরুষ কী না করতে পারে? কী না করেছে? পৃথিবী জয় করতে পারে, যুদ্ধে প্রাণ দিতে পারে—পারে হেলেনের জন্য ট্রয় ধ্বংস করে ফেলতে।

অটোর কাঁধে একখানা হাত রেখে বললুম, সে তো বটেই! অটো ক্রুগারকে আমি কি চিনি নে? কিন্তু মিমি যে ব্রিজ খেলতে ভারি ভালোবাসে, তাই তোমায় বলছিলুম…

নিশ্চয়, নিশ্চয়! ব্রিজের মতো ইন্টারেস্টিং খেলা কি আর আছে? চলো, খেলি গে—

মেঝের ওপর ওর নাইট—ক্যাপ পড়েছিল, সেটা কুড়িয়ে নিয়ে অটো উঠে দাঁড়াল।

পরিচয় করিয়ে দিলুম, অটো ক্রুগার—ক্যালিফোর্নিয়ার সেরা খেলোয়াড়, আর মিমি—Miss New york 1931! And–and beauty-Queen of Way Side Grove.

মিমির দক্ষিণ হাতখানি নিয়ে, অটো সেই মধ্যযুগের নাইটদের অনুকরণে চুম্বন করলে। আশ্চর্য, ওর টকটকে লাল রূঢ় মুখে কেমন যেন লাবণ্য দেখা দিয়েছে, বিশাল একটা এঞ্জিনের মতো সমস্ত শরীর ওর খরতর প্রাণধারায় স্পন্দিত হচ্ছে। ওর কথা হয়েছে সংযত, গলার স্বর হয়েছে নরম।

লোনা—সেই রোগাটে ফ্যাকাশে মেয়েটি বলে উঠল, খোসামোদ পুরুষদের মুদ্রাদোষ।

অটো হয়তো মনে মনে জবাব খুঁজছিল, তার আগেই বললুম, হ্যাঁ, বিনয় প্রকাশ করা যেমন মেয়েদের স্বভাব। আসল কথা কি জানো, নিজের সম্বন্ধে মেয়েদের ধারণা এত অল্প যে, পুরুষদের প্রশংসার আয়নায় নিজেদের না দেখলে তারা খুশি হয় না, সত্যি কিনা বলো তো?

সত্যি বইকি! মেয়েদের ছায়া বুকে ধরে থাকা ছাড়া পুরুষদের আর কী—ই বা কাজ আছে?—মিমির ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি উঁকি দিল।

বললুম, ভেবে দেখো তাহলে, মেয়েদের নিজস্ব কোনো সত্তা নেই! আমি তোমায় সুন্দর করে দেখেছি বলেই তুমি হয়েছ সুন্দর, নইলে তোমার দাম কতটুকু?…ভুলে যেও না, ঈশ্বর ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের বুকের পাঁজরা থেকে!

মিমি এবার ফরাসি কায়দায় কাঁধ দুটো একবার নেড়ে বললে, তাই নাকি, অহঙ্কারী পুরুষ!

Simply charming! —হঠাৎ অটো প্রায় চিৎকার করে উঠল, সুন্দরী মেয়েরা রাগ করলে কী লোভনীয় হয়ে ওঠে! ঠিক—ঠিক যেন ভিনিগার দেওয়া চাটনির মতো লোভনীয়।

সবাই উঠল হেসে, অটো কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল। হেসে বললুম, তোমার উপমা বাস্তবিক মৌলিক, অটো—সুন্দরী মেয়েদের অনুরাগের চেয়ে রাগটাই বেশি বিপজ্জনক! আর, সেই জন্যই তো হেরে গেলে ওরা পুরুষের ওপর রাগ করে বসে।

চুলের গুচ্ছ দুলিয়ে মিমি বলে উঠল, কক্ষণো না, আমেরিকান মেয়েরা পুরুষদের কাছে হারে না কখনো। এ—যুগে মেয়েদেরই জিৎ সব বিষয়ে—তর্কে, খেলায়, অভিনয়ে, মোটর রেসে—

প্রেমে?—শুধোলুম।

প্রেমে তো চিরকালই আমরা জিতে এসেছি!—মিমির দুষ্টু চোখের তারায় হাসির আলো ঝিকমিকিয়ে উঠছে।

আর, তাস খেলায়?

তাসের গোছা ভাঁজতে ভাঁজতে মিমি জবাব দিলে, এখুনি প্রমাণ হয়ে যাবে।

চ্যালেঞ্জ?

নিশ্চয়।—মিমি তাস দিতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে অটো মোটা একটা চুরুট ধরিয়েছিল। দাঁতে চেপে প্রশ্ন করে বসল, What do ye stake my little buttercup?

তাই তো, কি দিয়ে বাজি ধরা যায়? নিচেকার ঠোঁট কামড়ে মিমি ভাবতে লাগল। চিনে মাটির পুতুলের মতো তুলি দিয়ে আঁকা গাঢ় লাল পরিপুষ্ট ঠোঁট! কামনার মতো কমনীয়, মৃত্যুর মতো মোহময়!

মিমি বলল, আচ্ছা ধরো, এক গেলাস শ্যাম্পেন বাজি। Not those champagne-colored lips?

কথাটার মানে বুঝতে অটোর বোধ করি মিনিট দুই—তিন সময় লেগেছিল। তারপর হঠাৎ আমার ডান হাতখানা ওর প্রকাণ্ড থাবার মধ্যে প্রায় পিষে ফেলতে ফেলতে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, The idea! The idea!

স্থির চোখে আমার পানে তাকিয়ে মিমি স্পষ্ট গলায় বললে, বেশ, তাই। I stake my kiss.

খেলা শুরু হয়ে গেল।

মিমি ডেকেছে একটা হার্ট। যদিচ আমার হাতে হরতনেরই অভাব, তবু ওকে ঘাবড়ে দেবার জন্যই গলা চড়িয়ে ডাক দিলুম: টু হার্টস! —চেয়ে দেখি, চাপা হাসিতে মিমির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ও কি আমার ডাকের কোনো মধুর অর্থ খুঁজে পেয়েছে—ধরতে পেরেছে অস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত?

লোনা দিলে পাশ। এবার অটোর পালা, একবার সে আমার আর মিমির পানে তাকাল, তারপর যেন আমার ডাকের প্রতিবাদ করেই বলে উঠল থ্রি হার্টস!

সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলুম, লাইটার না জ্বেলে লোনাকে বললুম, এবার কিন্তু তোমার ফোর হার্টস ডাকা উচিত।

উত্তরে লোনা দিলে ডবল এবং মৃদু হেসে বললে, It’s Heart’s game and not a game of hearts!

প্রথম দানে আমাদের দেড়শো’ ডাউন গেল,—যেতই। অন্য রঙের ডাক দেবার উপায়ও আমার ছিল না। মিমির চোখের তারায় সেই দুষ্টু হাসি! এবার কিন্তু সাবধান হতে হবে, মিমি আমায় চ্যালেঞ্জ করেছে, বাজি রেখেছে তার চুম্বন—ফ্রান্সের সবচেয়ে দামি শ্যাম্পেনের চেয়ে মধুরতর মদিরতর! অটোকে বললুম, হুঁশিয়ার!

এবারে ওদের খেলা—চারটে স্পেডের ডাক।

উনিশ

এবারে ওদের খেলা—চারটে স্পেডের ডাক। বঙ্কিমচন্দ্রের কথাটা পুরোনো হলেও সত্যি: সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র! শুধু পুরুষ জাত নয়—সুন্দরী নারীর প্রতি ভাগ্যেরও স্বাভাবিক পক্ষপাত আছে দেখছি! তা নইলে বেছে বেছে অনার্স কার্ডগুলি মিমির হাতেই বা পৌঁছবে কেন? যে অরণ্যে আসে চৈত্রমাস, সেইখানেই দক্ষিণ হাওয়ার পক্ষপাত, ফুলের প্রাচুর্যও সেইখানেই। নারীর যৌবন হল সেই চৈত্রমাস।

চারটের বদলে ওদের খেলা হল পাঁচটা স্পেডের। গেম ওদের হতই, সেজন্য মাথা খাটাবার কোনো দরকার ছিল না। স্কোর—সিটটা মিমির দুষ্টু চোখের মতোই ঠাট্টা করছে। একটা পার্ট গেম পর্যন্ত আমাদের হয়নি এখনো,‘They’ লেখা ঘরটা একেবারে ফাঁকা, কুমারীর মতো নিষ্কলঙ্ক! তবু দেখা যাক, আমাদের ধূসর প্রান্তরে একটিবারও জাগে কিনা বসন্তশ্রী। ভাগ্যেরও তো ভুল হতে পারে! কবি থাকলে হয়তো হাসত,—আমি কিন্তু অদৃষ্টবাদী লোক।

আবার তাস দেওয়া শুরু হয়েছে। ওদিকে আবার শুরু হয়েছে জাইলোফোনের টুংটাং—এর সঙ্গে মেয়েদের গান:

সাদা চেরি আর নীল ভায়োলেট ফুটছে গো,

জানো কোথায়?

চেরিফুল ফোটে সাদা গালে, আর ভায়োলেট ফোটে ওই চোখের

নীল তারায়!

আর জানি এক গোলাপ ফুটেছে চুপি চুপি আজ নিশীথে গো

তুলনা নেই;

জানি প্রিয়, জানি অনুরাগ—রাঙা তোমার মন—

গোলাপ সে—ই!

বাইরে অন্ধকার রাত্রির চোখে নেমেছে, কুয়াশার তন্দ্র, কিন্তু ওয়েসাইড গ্রোভ—এর চোখে আজ ঘুম নেই। গানে এদের নেই বিরাম, নাচে এল না ক্লান্তি। লীলায়, লাস্যে, উজ্জ্বলতায়, উচ্ছলতায় ক্লাব—হাউসের এই রাত্রি এখনো যেন কিশোরী! আর আশ্চর্য লোক ওই জকি। দু’দণ্ড স্থির হয়ে কোথাও বসতে দেখলুম না ওকে। এইমাত্র দেখা গেল রূপালি জরির পাড়ওয়ালা কালো ভেলভেটের একটা টুকরো কোমরে জড়িয়ে, ‘বোলেরো’ নাচে ও মেতে উঠেছে, পাঁচ মিনিট বাদে দেখো, ওই কোণে গিয়ে কাউকে ডেকে বলছে: ‘শ্যাম্পেন? শ্যাম্পেন দিই আরেকটু?’…আবার খানিক পরেই হয়তো শুনতে পাবে হলের ও—কোণ থেকে জকির হাসি আর হল্লা। অগ্নিকুণ্ডের মতো উষ্ণতায় আর উল্লাসে ঘরের সবাইকে ও বাঁচিয়ে রেখেছে, ও মাতিয়ে রেখেছে।

মনে মনে মিমিকে বললুম, আজকের খেলায় শেষ পর্যন্ত যদি হার মানতেই হয়, তবু আজকের এই উৎসব—রাত্রি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তোমার কপালে আজ যে সাদা চেরিফুল ফুটেছে আর চোখের তারায় ফুটেছে যে নীল ভায়োলেট, অনেক দিন পরে হঠাৎ কোনো এক ঘুম ভাঙা রাতে তারই অস্পষ্ট সুগন্ধ আমায় করে তুলবে উন্মনা! আর মনে মনে যদি ভাবি, সেই গোলাপ—তোমার অনুরাগী হৃদয়ের মতো রাঙা সেই গোলাপ আমারই জন্য আজ ফুটল, তবে তুমি না—ই বা আপত্তি করলে মিমি।—Ugh! এমন রাবিশ বরাত দেখেছ কখনো?

অটো একটি একটি করে তাস তুলে নিয়ে দেখছিল। বেছে বেছে দুরি থেকে নওলা পর্যন্ত তাসগুলোই বোধ করি ওর কাছে পৌঁছেছে। এবারেও নিশ্চয় ভাগ্যের ভুল হয়নি। নিজেরই ওপর রাগে ওর স্বাভাবিক লাল মুখ আরো লাল হয়ে উঠেছে, প্রকাণ্ড এঞ্জিনের মতো ওর বিশাল দেহটা উঠেছে অধৈর্য চঞ্চল হয়ে। বারবার এঞ্জিনের মতো ওর বিশাল দেহটা উঠেছে অধৈর্য চঞ্চল হয়ে। বারবার ও মিমির পানে তাকাচ্ছে, আর অসহিষ্ণু হাতে নাড়াচাড়া করছে তাসগুলো নিয়ে।

অটোকে বললুম, আমি যে তোমার পার্টনার, তা ভুলে যাচ্ছ কেন? চেহারার দিক থেকে না হোক, বরাতের দিক থেকে দুজনের চমৎকার মিল।

এখন যদি ভাগ্যের সঙ্গে দেখা হত মুখোমুখি, তাহলে—তাহলে…(অটোর মুঠি আবার কঠিন হয়ে উঠেছে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলুম) অটো ক্রুগারকে ঠাট্টা করার মজা সে হাতে হাতে টের পেত! …এই যে ওয়েটার…

ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই সে ট্রে থেকে বিয়ারের ভর্তি মগটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেললে।

কল দেওয়া শুরু হল। মিমি গোড়ায় দিলে পাশ, আমার তাস আমি দেখিনি—না দেখেও অবশ্য বলে দিতে পারি, হাতে কি এসেছে। তবু ডাকলুম, নো—ট্রাম্প। লোনা ডাক দিলে—টু ডায়মন্ডস। অটোর বিরক্ত মুখ থেকে বেরোল: নো বিড।

ঘুরে এল মিমির পালা, গলা চড়িয়ে এবার ডাকলে, গেম ইন ডায়মন্ডস! ওর ঠোঁটে আর চোখের তারায় সেই তরল দুষ্টু হাসি উপচে পড়ছে! এবারে ‘রাবার’ নিশ্চয়!

চেয়ে দেখি, মুখের চুরুটটা অটো দাঁত দিয়ে অস্থিরভাবে চিবোচ্ছে। সত্যিই তাহলে হেরে যেতে হল। মাথার মধ্যে কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। ক্যাবারে—মেয়েদের নাচ গান এখনো চলছে।

সমস্তই মনে হল নিরর্থক—এই গান, নাচ, এই উৎসব রাত্রি, ফেনোচ্ছল এই সুরের পেয়ালা! ফ্রান্সের সমস্ত দ্রাক্ষাবনের চেয়ে—পৃথিবীর সমস্ত দ্রাক্ষাবনের চেয়ে দু’খানি ওষ্ঠাধর ঢের বেশি মদিরতর, মধুরতর। গ্রীষ্মের রাত্রির নিশ্বাসের মতো উষ্ণ উজ্জ্বল সেই স্পর্শের তাপে রোমাঞ্চকর যে—মুহূর্তটির মৃত্যু হয়, তার কাছে চঞ্চল ঝলমল এই উৎসব রাত্রির দাম আর কতটুকু? আমি তো চেয়েছিলুম সেই মুহূর্তের মৃত্যু। যে—মৃত্যু সুন্দরতর জীবনের রূপ ধরে ফুটে ওঠে সূর্য—চুম্বিত ফুলের মতো।

কিন্তু হল না—এবারকার মতো তোমার চুম্বন নিয়ে তুমি ফিরেই যেও মিমি।

শুনেছ, আমি ডেকেছি পাঁচটা ডায়মন্ডস। এবার আমাদের রাবার!—মিমি আমায় ডেকে বললে।

পাশ দেওয়া ছাড়া উপায় কি। কিন্তু পাশ দেওয়ার আগে হাতের তাসগুলো একবার দেখে নেওয়া দরকার। তবু যদি…এ কী অদ্ভুত তাস এসেছে আমার হাতে, রুইতন পাঁচখানা অথচ ইস্কাবন নেই একখানাও। এই তো সুযোগ, এইবার ডবল দেওয়ার পালা আমার।

তাই হল, স্পেডের পিঠ তুরুপের ফলে ওদের বেশ কিছু ডাউন গেল—তিনশো। যাক, আমাদের দেড়শোর দেনা শোধ হয়ে কিছু সঞ্চয় রইল। এবারকার মতো রাবার ঠেকানো গেছে। একটা সিগারেট ধরানো যেতে পারে এখন। লাইটার জ্বালবার আগে মিমিকে বললুম, তোমার বাজির কথা আরেকবার স্মরণ করবার সময় এসেছে মিমি!

মিমি তাস ভাঁজছিল, আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলে, Yea, still I stake a kiss.

ওর কণ্ঠের সেই তরলতা আর নেই, কেমন যেন কঠিন। আবার তাস দেওয়া হল, কিন্তু কার্ড—লাক আমাদের ঘুরে গেছে। ডাক দিয়েছিলুম আমরাই, তিনটে নো—ট্রাম্পের খেলা—কিন্তু ‘লিটল—শ্লাম’ হবে ভাবিনি। অটোর কটা রঙের চোখ খুশিতে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, গুনগুন করে আবার ধরেছে সেই পুরোনো গানের লাইন:

‘Green grass mows well…’

আশ্চর্য, মিমির মুখে কিন্তু এতটুকু ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। ঠোঁটে তেমনি হাসির ইসারা, চোখে তেমনি দুষ্টুমির ঝিকিমিকি! সবচেয়ে আশ্চর্য যে, তাস দিতে দিতে হঠাৎ সে আমার দিকে ঝুঁকে, চাপা গলায় বললে, am happy naughty boy, that you win!

পঞ্চমবারের খেলা শুরু হল। ভাগ্য এতক্ষণ আমাদের চিনতে ভুল করেছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ দেখা পুরোনো বন্ধুর মতো এবার সে আমাদের ওপর সত্যিই খুশি হয়ে উঠেছে দেখছি। এবারেও আমাদের গেম এবং ‘রাব’। খুশিতে অটোর কণ্ঠস্বরের পর্দা হঠাৎ অনেকখানি চড়ে গেছে।

খেলা শেষ হতেই লোনা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলে। মিমি বসে বসে স্কোর—সিট—এর পাতায় পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি দাগ কাটছিল। অটো খামোকা গান থামিয়ে শুধোলে, And now my little buttercup?

চুলের গুচ্ছ দুলিয়ে মিমি মুখ তুললে, তারপর একবার আমার দিকে, আরেকবার অটোর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় বললে, কিন্তু আমি বাজি রেখেছিলুম একটি চুমু, মাত্র একটি—কে নেবে বলো?