নিশীথ নগরী – ১০

দশ

রাত ক্রমে বাড়ছে। কার্নিভ্যালের ভিড়ে ধরেছে ভাঙন, কলরব এসেছে স্তিমিত হয়ে। ‘মেরি—গো—রাউন্ড’—এর কন্সার্ট বাজনা গেছে থেমে, হেল্টার স্কেল্টারও ফাঁকা। অল্পবয়স্কা যে—সব মেয়ে বয়—ফ্রেন্ডদের সঙ্গে এসেছিল, এইবার তারা অভিভাবকদের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে বোধ করি। এখনও তবু ছোট ছোট দল এখানে—ওখানে ছড়ানো। একে একে আলো নিভেতে শুরু হয়েছে, গ্রিনউইচ ভিলেজের এই প্রকাণ্ড মাঠে অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসেছে মন্থর একটি আলস্য।

কিন্তু কবির দেখা পেলুম না এখনো। কথা ছিল, কার্নিভ্যাল ভাঙলে ফটকের কাছে ফের দুজনের দেখা হবে। কিন্তু কই, কোথায় সেই কাউবয়—এর মতো গোল টুপি আর হলদে কালো ডোরা—কাটা স্কার্ট? ফটক পার হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম। গোটাকতক ট্যাক্সিওয়ালা এখনো সোয়ারির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

Hel-lo guy ! একা একা দাঁড়িয়ে যে!

ফিরে দেখি, অচেনা একটা লোক। লোকটার বাঁ পা—টা হাঁটু অবধি কাটা, ‘ক্র্যাচে’ ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে খাকি মিলিটারি পোশাক, বহু পুরাতন, তালি লাগানো। কণ্টকিত মুখখানা ক্ষুরের সঙ্গে অসহযোগ করেছে।

বললুম, চিনতে পারছি নে তো তোমায়!

তা তো পারবেই না। শুধু তুমি কেন, তুমি তো সেদিনের ছেলে হে, সারা বেলজিয়ামই আজ আর আমায় চিনতে পারবে না! ফাঁকা টোটা ঘরে কে আর জমিয়ে রাখে বলো? ভাঙা পেয়ালা দেয় বাতিল করে।

হা হা করে লোকটা হেসে উঠল। সামনের দাঁত দুটো নেই। হাসলে মানুষকে এত কুৎসিত দেখায়, আগে ধারণাই ছিল না।

হঠাৎ হাসি থামিয়ে লোকটা আবার শুরু করলে : অথচ একসময়, হ্যাঁ, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে, খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইনে আমার নাম ছাপা হয়েছিল জানো? শত্রুসৈন্য তখন ব্রাসেলস শহর ঘেরাও করেছে, আশেপাশে ফাটছে বিষাক্ত গ্যাসের সেল, সেই সময় লুইস—গান হাতে নিয়ে যে এগিয়ে গিয়েছিল, সে হচ্ছে কার্পোরোল অগাস্টিন।…

বললুম, ও, তুমিই কার্পোরাল অগাস্টিন?

পাগল! সে কবে মরে গেছে! আমি তার প্রেতাত্মা, বুঝলে?—লোকটা একটা চোখ কুঁচকে বিশ্রী একটা ইঙ্গিত করলে: Any Pretty on naughty bridie?

কার কথা বলছ? অবাক হয়ে শুধোলুম।

সুন্দরী মেয়ে হে, সুন্দরী মেয়ে। জোয়ান বয়সে সব মেয়েই অবিশ্যি সুন্দরী। তা আজ আর সে আসেনি বুঝি? হুঁঃ, এই বয়েসে অনেকেরই আসবার কথা থাকে, কিন্তু আসে না। …তবে বলি শোন: মিলিটারি ব্যারাক থেকে পালিয়ে একদিন সমুদ্রতীরে বেড়াতে গেছি, সেইখানে তার সঙ্গে আলাপ। সেই হাঙ্গেরিয়ান মেয়েটি, নামটা আজ আর মনে নেই। কথা কইতে কইতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি চুমু দেওয়ার পর সে অন্ধকারে আমার কানে কানে বললে, আমার জীবনে পুরুষের এই প্রথম চুম্বন!…শুনে শিউরে উঠলুম। ভার্জিন! আসবার সময় মেয়েটি বললে, কাল আবার দেখা কোরো। দেখা ফের হয়েছিল বটে, তবে কাল নয়, হপ্তাখানেক বাদে, শহরের এক কাফেয়। দেখি, আরেকটি ছেলের মুখে মুখ রেখে সে তেমনি মিষ্টি গলায় বলছে: আমার জীবনে এই প্রথম চুম্বন।…ওই কথাটা বোধ হয় ওর মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।

শুকনো গলায় লোকটা আবার চিৎকার করে হেসে উঠল। তারপর বললে, দাঁড়িয়ে থেকে আর কি হবে? ঘরে যাও। কাল থেকে নগদ কারবার কোরো ভাই, ধার রেখে না, বুঝলে?

বললুম, তুমি ভুল করেছ অগাস্টিন, আমি অপেক্ষা করছি আমার এক কবি—বন্ধুর জন্য—কিন্তু আজ আর বোধ করি দেখা হবে না।

চলে আসছিলুম, পেছন থেকে অগাস্টিন ডাকলে, শোনো, শোনো।—

ফিরতে হল। একটা চোখ কুঁচকে ও হঠাৎ চাপা গলায় শুধোলে, কিছু আছে নাকি? দিতে পারো?

প্রথমে বুঝতে পারিনি, টুপিটা খুলে আমার সুমুখে ধরতেই বুঝলুম, অগাস্টিন কিছু ভিক্ষে চায়। বললুম, এই করেই তোমার চলে নাকি? কেন, স্টেট থেকে তো অক্ষম সৈন্যদের খোরপোশ দেওয়ার নিয়ম আছে শুনেছি।

রাস্তার ওপর খানিকটা থুথু ফেলে অগাস্টিন বলে উঠল, চুলোয় যাক স্টেট! উচ্ছন্নে যাক!

পকেটে যে ক’টা সেন্ট পড়েছিল, ওর টুপিতে ফেলে দিলুম।

অদ্ভুত লোক। টুপিটা ফের মাথায় দিয়ে বললে, ধন্যবাদ আমি কাউকে দিই না। কেড়ে নেবার ক্ষমতা নেই, নইলে—

ক্রাচের খটখট আওয়াজ করতে করতে ও চলে গেল। বহু সম্মানিত কার্পোরাল অগাস্টিনের প্রেতাত্মা!

এগারো

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। নিশীথ—হাওয়ায় তাঁবুর পর্দাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘরে কে এসেছিল না? এইমাত্র যেন কার অস্পষ্ট পদধ্বনি মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হয় না, পাশে বুড়ো পপ ঘুমের ঘোরে নাক ডাকাচ্ছে।

স্বপ্ন দেখছিলুম হয়তো! কিন্তু ঘুম আমার আর আসবে না। আস্তে আস্তে উঠে তাঁবুর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। মৃত্যুর মতো অন্ধকার স্তব্ধতা, মৃত্যু হয়েছে সেই উৎসব—সন্ধ্যার! প্রকাণ্ড ফাঁকা মাঠ নিঃসঙ্গ বার্ধক্য দিনের মতো পড়ে আছে। এই নির্জন কার্নিভ্যাল যেন বিগত যৌবনের ট্র্যাজেডির প্রতীক।

রহস্যময় এই নিশীথ—রাত্রি ভারি অদ্ভুত লাগছিল। তাঁবুর সামনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলুম। দিনের আলোয় নিজেদের আমরা চিনতে পারি না, নগর সভ্যতার একটা পালিশ থাকে আমাদের মুখে, কিন্তু রাত্রির এই অন্ধকার গভীরতায় নিজেদের সঙ্গে আমাদের হয় মুখোমুখি পরিচয়।

হঠাৎ পিঠে কে হাত রাখলে। ফিরে দেখি আরেকটি মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। ভালো করে মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু চিনতে পারলুম—বুড়ি মারিয়া। হাতে সেই মড়ার খুলি। শুধোলে, এত রাতে বাইরে যে?

বললুম, ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। স্বপ্ন দেখছিলুম বোধ করি। কিন্তু এই রাতে তুমি একা—একা ঘুরে বেড়াচ্ছ যে মারিয়া?

ঘুম আমার আসে না।—মারিয়া বলতে লাগল, আজ পঁচিশ বছর এমনি করেই কাটছে। স্বপ্ন আমিও দেখি, জানো? রোজ মাঝ—রাতে জেগে উঠি, মনে হয় কে যেন ডাকছে! আর ঘুম আসে না চোখে। যদি সে এসে ফিরে যায়…

মারিয়া নিজের মনে একবার হাসলে: ও আমারই মনের ভুল! সে আর আসবে না জানি, তবু—এখনও স্বপ্ন দেখি —

শুধোলুম, কার কথা বলছ মারিয়া? কে সে?

কে আবার! কেউ না!…আচ্ছা, বলি শোন। আলেক্সি ম্যাক্সিভিচ—এর নাম শোনোনি বোধ হয়? কেই বা জানে তার নাম! পের্ট্রোগার্ডের একজন ‘ম্যুজিক’ ছিল সে। লম্বা—চওড়া চমৎকার চেহারা। বড় বড় কালো চোখ মেলে তাকালে নেশা লাগত, রাশিয়ার মেয়েরা ভয় করত তাকে।

আলেক্সিকে তুমি ভালোবাসতে বুঝি?

ভালোবাসতুম বললে তোমরা—অল্পবয়সী ছেলেরা খুশি হবে, তা জানি। কিন্তু আলেক্সিকে দেখলে আমার বুকের ভেতর কাঁপত। কাস্তে হাতে ছেলেরা যেত মাঠে, আর আমরা যেতুম আঁটি—বাঁধা ফসল মাথায় করে গাড়ি বোঝাই করতে। খালি গায়ে চওড়া বুক ফুলিয়ে আলেক্সি ফসল কাটত আর গাইত—কি গান গাইত জানো?

ভাঙা ভাঙা গলায় মারিয়া গুনগুন করে গাইলে—

 ওগো ও চাঁদ? রূপালি চাঁদ!

 ফসলে ছেয়েছে ভলগা—কূল,

 ফুটেছে কি জানো বন্ধু গো

 কুমারী—মনের রূপালী ফুল!

মারিয়ার গলায় সুর নেই, তবু ওই লাইন ক’টা ও গুনগুন করে গাইলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত।

বললুম, আলেক্সি আজো কি তোমায় মনে করে রেখেছে?

মারিয়া জবাব দিলে, যত সহজে ও ভালোবাসে, ভুলে যায় তত সহজে। সত্যিকার পুরুষের ভালোবাসাই এমনি।

আলেক্সি তা হলে তোমায় ছেড়ে গেছে? তবে তুমি আজো তার জন্যে রাত জেগে অপেক্ষা কর কেন?

কেন জানো?—মারিয়া বলতে লাগল: পের্ট্রোগার্ডে তখন শুরু হয়েছে বিপ্লব, জার’কে খুন করবার জন্যে বলশেভিকদের ষড়যন্ত্র চলেছে। ধরা পড়ে আলেক্সি একদিন জেলে গেল। শুনলুম, তাকে সাইবেরিয়ায় পাঠানো হবে। সেই সময় অন্ধকার রাত্রে আমি চুপি চুপি যেতুম তার সঙ্গে দেখা করতে, দলের চিঠিপত্র, খাবার লুকিয়ে দিয়ে আসতুম তার হাতে।…জেলখানায় সেই সেল—এর মধ্যে আমার সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়। বললে, সাইবেরিয়া থেকে আমি ফিরে আসব নিশ্চয়—তোমার কাছেই ফিরে আসব মারিয়া!—তার চোখের পানে চেয়ে আমার চোখ বুজে এল, পালিয়ে এলুম তার সুমুখ থেকে।

আলেক্সি ফিরে এসেছিল?

তেমনি ভাঙা গলায় মারিয়া হেসে উঠল: বোকা ছেলে, যে যায়, সে কি আর ফেরে?

মনে পড়ল, খোঁড়া কার্পোরাল অগাস্টিনও এই কথাই বলেছিল। ফেরে না নদীর স্রোত, আর ফেরেনা প্রথম প্রেম! দার্শনিক মতে, এই হল জীবন। অন্য সময় এই নাটকীয় কথাটা নিয়ে একটা সস্তা ঠাট্টা করা যেত, কিন্তু মধ্যরাত্রির এই গভীরতায় মারিয়ার কণ্ঠে কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাল।

বললুম, পের্ট্রোগার্ড ছেড়ে তুমি চলে এলে কেন?

কারণ—, মারিয়া বলতে লাগল: আলেক্সি আর ফিরে আসেনি। পনেরো বছর বাদে পের্ট্রোগার্ড—এ আবার একদিন যে ফিরে এল, সে পাগল। মিছে দিন গুনে গুনে আমার তখন চুলে পাকা ধরেছে।

তুমি বিয়ে করনি মারিয়া?

করেছিলুম বইকি। চওড়া একটা বুকে মাথা রাখতে না পেলে মেয়েদের চলে না। তা স্বামীও গেল, একটা ছেলে ছিল—নাম রেখেছিলুম আলেক্সি—সেও গেল। দিন আমার তখন কি নিয়ে কাটে বলো? চলে এলুম তাই পের্ট্রোগার্ড ছেড়ে, ভিড়ে গেলুম বুড়ো পপ—এর কার্নিভ্যালের দলে, তারপর—

বললুম, দিন তোমার কাটে তো পরের হাতগুণে, কত লোককে বলে দাও সৌভাগ্যের সন্ধান, কিন্তু নিজের সৌভাগ্যকে আজো খুঁজে নিতে পারলে না। ভাগ্যের সঙ্গে তোমার এত রেষারেষি কেন বলো তো?

মারিয়া তার মুখখানা আমার কাছে এগিয়ে নিয়ে এল। বললে, অন্ধকার যে, নইলে দেখতে পেতে কপালে আমার কতগুলো রেখা পড়েছে, মুখের চামড়া গেছে কতখানি কুঁচকে। ভালো করে লক্ষ করলে আরো দেখতে পেতে, এটার সঙ্গে…, মারিয়া পড়ার খুলিটা দেখালে: আমার মুখের বিশেষ তফাত নেই।

মারিয়া তার ভাঙা গলায় এবার জোরে হেসে উঠল। তারপর ফের বললে, বয়েস যার ষাট পার হয়েছে, তাকে কেউ পছন্দ করে না—আলেক্সিও না, ভাগ্যও না!

আচ্ছা, হাত দেখা তুমি শিখলে কোথায়?

শিখেছিলুম, এক জিপসির কাছ থেকে।…কিন্তু সত্যিই কি কিছু জানি আমি? সব ফাঁকি, সব ভুয়ো!—রাত বুঝি ভোর হয়ে এল, যাই।

মড়ার খুলিটা হাতে নিয়ে মারিয়া আবার মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আমি বুঝেছি, আলেক্সি ম্যাক্সিভিচ ওর প্রণয়ী নয়, সে হচ্ছে বুড়ি মারিয়ার প্রথম যৌবন স্বপ্ন। আলেক্সি আর আসবে না তা ও জানে, কিন্তু যার সন্ধানে নিশীথ—রাত্রে ও ঘুরে বেড়ায়, সে তার পলাতক যৌবন।

আস্তে আস্তে তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলুম। পর্দা সরিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখি, একটা ছায়ামূর্তি—আমারই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে! তা হলে স্বপ্ন নয়, সত্যিই ঘরে কেউ এসেছে! গলা চড়িয়ে শুধোলুম, কে?

অন্ধকার যেন কথা কয়ে উঠল, আমি—লু।

কী আশ্চর্য! লু এত রাতে—এখানে?

বারো

কী আশ্চর্য, লু এত রাতে—এখানে—? নিশীথ—রাত্রির এই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে আর যাকেই আমার স্মরণ হোক না কেন, সে লু নয় নিশ্চয়ই। নিঃশব্দ অন্ধকারে গা ঢেকে চোরের মতো চুপি চুপি আমার এই তাঁবুর মধ্যে কি করতে এসেছে সে? কি চায়?

চেঁচিয়ে কি বলতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই লু আমার মুখে হাত চাপা দিলে। বুড়ো পপ মড়ার মতো ঘুমুচ্ছে, ঘুমুলে ওর নাকের মধ্য দিয়ে অদ্ভুত একরকম শব্দ হয়।

আমার কানের কাছে মুখ এনে লু চাপা গলায় বললে, আস্তে—বাইরে এসো—

কলের পুতুলের মতো ওর সঙ্গে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালুম। অন্ধকার আকাশের নিচে বুড়ি মারিয়া সেই মড়ার খুলিটা আগলে নিয়ে এখনো হয়তো নিশি—পাওয়ার মতো একা—একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিগতযৌবনা বিফল—স্বপ্ন মারিয়া! কিন্তু লু—ফেনিল—যৌবনা সুন্দরী নর্তকী লু—তার চোখে আজ ঘুম নেই কেন?

তেমনি ফিসফিস করে লু বললে, এসো, ওই বেঞ্চিটায় খানিক বসি।

মেরি—গো—রাউন্ড’—এর পাশে লোহার একটা বেঞ্চি, দুজনে সেখানে পাশাপাশি বসলুম। লু এতক্ষণে সহজ গলায় বললে, ভয়ানক অবাক হয়ে গেছ, না?

সত্যিই বিস্ময়ে আমার মুখের কথা গিয়েছিল হারিয়ে। এবার যেন জেগে উঠে বললুম, শুধু আমি নয়, এত রাতে তাঁবুর মধ্যে নর্তকী লু—কে দেখলে, যে কেউ অবাক হতে পারে। তোমার এই আসার মানে কি? কি চাও তুমি?

লু বললে, যদি বলি গল্প করতে এসেছি?

যদি বলতে, প্রেম নিবেদন করতে এসেছ, তা হলেও বিশ্বাস করতুম না।

অস্পষ্ট একটু হাসির আওয়াজ শোনা গেল। ক্ষীণ একটি জলধারা তটরেখা ছুঁয়ে গেল যেন।

হেসে লু বললে, তাই নাকি? কোনো মেয়ে তোমায় প্রেম নিবেদন করতে পারে, এ বিশ্বাসই বা তোমার হল কেন?

মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কারণ, আমি জানি প্রেম নিবেদন করাটা কোনো কোনো মেয়ের পেশা।

কণ্ঠে আমার কি শ্লেষ ছিল? লু চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বললে, তুমি তাহলে রাত জেগে ঝগড়া করতেই এসেছ?

বললুম, ভুল করছ লু, তুমিই আমায় ডেকে এনেছ। ব্যাপারটাকে কিন্তু বেশ নাটকীয় করে তুলেছ দেখছি! এখন যেতে পারি বোধ হয়?

এলেই বা কেন? পেশাদারী প্রেম নিবেদন শোনবার লোভটা সামলাতে পারলে না বুঝি?

আবছায়া অন্ধকারে কেবল লু’র মুখের সীমারেখা দেখা যাচ্ছিল—শিল্যুট—এর মতো। কিন্তু মনে হল, কথার শেষদিকে তার গলা কেঁপে উঠল যেন। হেসে বললুম, তুমি যে সেই মধ্যযুগের নায়িকাদের মতো অভিমান শুরু করলে দেখছি। এরপর নিশ্চয় আমার বলা উচিত: অপরূপ তোমার চোখের তারার রং!…যাকগে, ভোর হতে আর দেরি নেই, আসল কথাটা কি, বলে ফেলো তো?

কয়েক মিনিট চুপচাপ। তারপর লু বললে—যেন নিজের মনেই: আজ সন্ধেবেলার সেই বিশ্রী ব্যাপারটার জন্যে কিছু মনে কোরো না। আমি দুঃখিত।

এই কথা বলতেই তুমি এত রাতে এসেছ? তা কাল সকালে বললেও পারতে। আশা করি, কাল সকালে তোমার গালে আমার আঙুলের দাগ মিলিয়ে যাবে। …ও আমারই কলঙ্ক লু! তোমার শেষ কথাটা আমারই বলা উচিত…

তাকিয়ে দেখি, আমার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে কখন যে চলে গেছে, জানতে পারিনি। আশ্চর্য মেয়ে! রহস্যময় এই নিশীথাকাশের তলায় একাকিনী সে যে কথাটি বলতে এসেছিল, তা আর বলা হল না, কিন্তু কি যে তুমি বলতে চেয়েছিলে, আমি তা বুঝেছি লু! চিরকালের সেই পুরোনো কথাটিই তুমি নতুন করে বলতে এসেছিলে! কুরূপা মোটা ম্যাগিও একদিন সেই কথাই বলতে চেয়েছিল।

.

না, ঘুম আজ আর আমার চোখে আসবে না। তার চেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে এই অন্ধকার মাঠে একা একা পায়চারি করে বেড়ানো ভালো।

আজকের এই রাতটি অবাস্তব একটি রূপ নিয়ে এসেছে। একটু আগেকার ঘটনাটা ভুলতে পারছি না কিছুতেই, মাথার মধ্যে যেন শিকড় গেড়ে বসেছে! আগাগোড়া ব্যাপারটাই যেন রোমান্টিক নভেলের টুকরো একটা পৃষ্ঠা।…কিন্তু লু মনে মনে আহত হয়ে ফিরে গেছে? কি জানি! এত রাতে আমার সঙ্গে একলা দেখা করাটা আমার হয়তো সহজভাবেই নেওয়া উচিত ছিল।

রাতের শেষ—প্রহরও ফুরিয়ে এল, কোথায় দূরে একটা গ্রাম্য গির্জার পেটা ঘড়ি ঢং ঢং করে বাজছে। ক্লান্ত মন্থর শব্দ! অবাস্তব এই অপরূপ রাত্রির মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি যেন। সমস্ত মাঠে ভরে এখন ফিকে—নীল ঘন কুয়াশা।

বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ নজর পড়ল, খানিকটা দূরে ঘাসের ওপর কি যেন পড়ে! কাছে গিয়ে দেখি…কে, লু না? ভিজে ঘাসের ওপর লু অমন করে উপুড় হয়ে পড়ে আছে কেন—সাদা একমুঠো পপিফুলের মতো? ওর দেহের ভঙ্গিটা এমন অসহায় ও করুণ!

হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসে আস্তে আস্তে ডাকলুম, শুনছ লু—

সাড়া নেই। আবার ওর এলোমেলো চুলের ওপর আলগোছে একখানা হাত রেখে বললুম, এখনো তুমি শুতে যাওনি লু? এখানে এমনি করে পড়ে রয়েছ কেন?

তীরবেগে লু সোজা হয়ে উঠে বসল। চাপা উত্তেজনায় ওর সারাদেহ থরথর করে কাঁপছে। প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললে, কেন তুমি এখানে এসেছ শুনি? আমায় একটু একা থাকতে দেবে না! যাও—চলে যাও—

কি হল ওর আজ, কে জানে! বললুম, তা যাচ্ছি, কিন্তু তুমি তোমার তাঁবুতে যাও।

উঠে চলে যাচ্ছিলুম, লু আবার ডাকলে, শোনো—

আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, এসব কথা জো—কে বোলো না।

কিছু বলবার আগেই ও তাড়াতাড়ি চলে গেল।

.

আবার তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলুম। তিরিশ গজও এগিয়ে যাইনি, অস্ফুট একটা চিৎকার কানে এল। মেয়েলি গলার চিৎকার।

দৌড়লুম। যেখানে ভিজে ঘাসের ওপর লু উপুড় হয়ে পড়েছিল, সেখানে ফিরে এসে দেখি, দীর্ঘাকৃতি জোয়ান একটা পুরুষ দুই থাবা দিয়ে লু’র দুই কাঁধ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীলচে অন্ধকারে চোখদুটো তার প্যান্থারের চোখের মতো জ্বলছে। এই তো জো। ও কি নিঃশব্দে লু’র পেছনে পেছনে এসেছিল? আমার শরীর একতাল মাটির মতো ভারি হয়ে গেল।

জো গর্জন করে উঠছিল: কোথায় ছিলি এতক্ষণ বল—নোংরা ইঁদুরখানা কোথাকার—

শুকনো গলায় লু বললে, ওই তো ওকেই জিজ্ঞেস কর না।

এতক্ষণ জো বোধ করি আমায় লক্ষ করেনি, এবার আমাকে দেখে তার হাতদুটো লু’র কাঁধ থেকে খসে পড়ল। দেখলুম, প্যান্থারের মতো তার দপদপে চোখদুটো আস্তে আস্তে এল নিভে।

তুমি! ওজয়!

হ্যাঁ, আমি অজয়।—তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বললুম, লু এতক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করছিল। কিন্তু তুমি কোন অধিকারে কৈফিয়ত চাও?

অধিকার! হাঃ হাঃ!—কর্কশ গলায় জো হাসবার চেষ্টা করলে, তারপর আমার পিঠ চাপড়ে বলে উঠল: এখনো তুমি ছেলেমানুষ ওজয়, নিতান্ত ছেলেমানুষ। লু আমার স্ত্রী, জানো? হাঃ, হাঃ! এসো আমরা যাই…

জো তার তাঁবুর দিকে এগোল, পেছনে পেছনে লু।

তেরো

হার্লেম।

বুড়ো পপ—এর হুকুম জারি হয়ে গেছে: জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, যেতে হবে এবার হার্লেমের দিকে।

হার্লেম, শুনেছি, নিগ্রোদের ছোটখাটো একটা উপনিবেশ—আধা শহর, আধা গ্রাম, যেতে হবে আমাদের কাল ভোরের গাড়িতে। গ্রিনউইচ ভিলেজে কার্নিভ্যাল চলেছে এক হপ্তা, আর নয়, এবার নতুন ডেরা। কার্নিভ্যাল আজ বন্ধ। কাজ আমাদের অনেক, তাঁবু গুটানো, জিনিসপত্র বাঁধা, গাড়ি বোঝাই করা—অনেক কাজ।

নতুন ডেরার মোহ যাযাবর মনকে আবার টানছে, আবার পাখা মেলেছে চিরকালের সেই বন—হংস! বিচ্ছিন্ন কয়েকটি দিন—রাত্রি, ভাঙা স্বপ্ন, মুখের আর চোখের আলাপ, স্মৃতি আর বিস্মৃতি: জীবনকে বিশ্লেষণ করলে এছাড়া আর কি বা খুঁজে পাওয়া যায়?

সমস্ত মাঠ ভরে জিনিসপত্রগুলো এখানে—সেখানে ছড়ানো—ছিটানো, হাতুড়ির খটাখট আওয়াজ, গাড়োয়ানদের হল্লা। রংচঙে সাজানো স্টলগুলো এখন একেবারে ফাঁকা—বিধবার সিঁথির মতো। আজ সকালে মাঠের এই দৃশ্যটার সঙ্গে নষ্টনীড় জীবনের কোথায় যেন মিল আছে। নতুন পথযাত্রার কথা ভাবলেই কবিকে আমার মনে পড়ে যায়, পান্থশালার সেই কবি অ্যাডলফ! সময়ের স্রোতে ও পরমানন্দে গা—ভাসান দিয়েছে। কল্পনায় লঘু পাখায় ভর করে উড়ে উড়ে চলেছে সূর্যাস্ত থেকে নবসূর্যোদয়ের কূলে। সেই যে একত্রে এসেছিলুম এই কার্নিভ্যালে, তারপর আজ অবধি আর দেখা নেই। গ্রিনউইচ ছেড়ে ও যে আমার আগেই চলে যায়নি, তাই বা কে বলতে পারে? পথে যে বন্ধুকে পেয়েছিলুম, পথের জনতায় আবার সে হারিয়ে যাবে, এ আমি জানতুম বটে—কিন্তু জানতে পারলুম না, বার্থা আর ক্লডেট—এর পর কবির জীবনে এবার কোন নারীর প্রবেশ?

প্রকাণ্ড একটা প্যাকিং বাক্সের মধ্যে ডিক খুচরো মাল বোঝাই করছিল। আমায় ডেকে বললে, একটু হাত লাগাও তো, চটপট সেরে ফেলি কাজটা।

বাক্সের মধ্যে বিচালি বিছোতে বিছোতে ডিক শুধোলে, হ্যাঁ হে ছোকরা, কাল রাতে একটা গোলমাল শুনছিলুম যেন—কিসের বলো তো?

বললুম, কি জানি কে চেঁচামেচি করছিল।

ডিক এবার আমার মুখের পানে চেয়ে মুচকে হেসে বললে, লুকোচ্ছ কেন, বলেই ফেলো না। এই তো পাঁচ মিনিট আগে জো—র সঙ্গে দেখা হল। বললে, কাল রাতে তুমি নাকি লু’কে নিয়ে—

মিথ্যে কথা!

ডিক দুঃখিত হওয়ার ভান করে বললে, ও, ভুল হয়েছে! তুমি লু’কে ডেকে নিয়ে যাওনি বটে, লু’ই তোমার তাঁবুতে গিয়েছিল। তা কথা একই!

ডিক আবার হেঁট হয়ে বিচালি বিছোতে লাগল। বুঝলুম, কাল রাতের সেই অদ্ভুত ঘটনাটা সকাল না হতেই কানাকানি হয়ে পড়েছে। আরো বুঝলুম যে, অতিরঞ্জনের ফলে ব্যাপারটার চেহারাই গেছে বদলে! জো তাহলে সত্যিই কাল রাতে লু’র অনুসরণ করেছিল।

বললুম, কোনো ঘটনাকে তোমরা এমন বিশ্রীভাবে নাও কেন? লু যদি কাল আমার তাঁবুতে গিয়েই থাকে, তাতে হয়েছে কি?

কিছুই না—, ডিক কাঁচা তামাক পাতা চিবোচ্ছিল, খানিকটা থুথু ফেলে বলে উঠল, তোমার সৌভাগ্যকে হিংসে করতে ইচ্ছে হয় শুধু! Ah, the gal’s hot stuff!…কিন্তু একটু সাবধানে প্রেম কোরো হে ছোকরা!

কি যা—তা বকছ ডিক! জানো, লু জো’র স্ত্রী?

স্ত্রী! জো’র স্ত্রী হল লু!—ডিক সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল, প্রচণ্ড হাসির বেগে তার মুখের ফাঁক দিয়ে তামাক পাতা ছিটিয়ে পড়তে লাগল। হাসতে হাসতে মোটর—টায়ারের মতো ও ফেটে পড়ল যেন।

খামোখা ওর এই উচ্ছ্বসিত হাসির মানে বুঝতে পারলুম না। খানিকটা অপ্রস্তুত, খানিকটা বিরক্ত হয়ে শুধোলুম, হাসছ কেন?

ডিক তখন অনেকটা সামলে নিয়েছে, পেন্টুলুনের বেল্ট শক্ত করে আঁটতে আঁটতে বললে, হাসছি তোমার মজার কথা শুনে। লু হল জো’র বউ। কোন গির্জেয় বিয়ে হয়েছে শুনি!

কেন, লু কি জো’র স্ত্রী নয়?

আলবত একশোবার। শুধু জো কেন, লু আরো অনেকেরই স্ত্রী।

তার মানে? কি বলতে চাও তুমি?

তুমি দেখছি, নেহাত বোকা! এই সাদা কথাটা আর বুঝতে পারছ না? তার মানে, লু হচ্ছে ভাড়াটে স্ত্রী—একটা বেশ্যা, জো’র রক্ষিতা।

আশ্চর্য হলুম, কিন্তু অবিশ্বাস করা চলল না। ইয়াঙ্কি সভ্যতার মানে এতদিনে আমি কিছু কিছু শিখেছি বই কি। অভিধানের নতুন সংস্করণে এবার আশা করি দেখতে পাব, ডেমোক্র্যাসি মানে বহুচারিতা।

বাক্সের ডালার ওপর ডিক পেরেক দিয়ে টিনের পাত আঁটছিল। বললে, তাই বলছিলুম হে ছোকরা, একটু সাবধানে প্রেম কোরো। জো বড় সহজ নয়!

জিজ্ঞাসু চোখে তাকালুম।

ডিক বলতে লাগল, জো আগে ছিল গ্যাংস্টার—দুর্দান্ত গুন্ডা! এখন অবিশ্যি মন গেছে ভেঙে, কিন্তু গ্যাংস্টার জো এখনো মরেনি।…আড়াই বছর আগে, পপ—এর কার্নিভ্যালে তখন সবে কাজে লেগেছি, একটি মেয়ে একদিন আমার কাছে এল। বললে, তোমার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে, তাই এলুম। মেয়েটি সুন্দরী, নাম ধরো, লু মিসেস। গল্প করছিলুম দুজনে, লু’র মাথা আমার কাঁধে ঠেকেছে, আমার হাত ঘিরেছে ওর কোমর, হঠাৎ পেছন থেকে—

হাতুড়িটা আমার হাতে দিয়ে, ডিক শার্টের বোতাম খুলে ফেললে। বাঁ দিকের পাঁজরার কাছাকাছি গভীর একটা ক্ষতচিহ্ন। নিজেরই অজান্তে বলে উঠলুম, জো তোমায় খুন করতে চেয়েছিল!

তাই কি আমি বলেছি? —হাতুড়িটা নিয়ে শিস দিতে দিতে ডিক চলে গেল।

.

মালবোঝাই ওয়াগনগুলো ঢিকোতে ঢিকোতে চলেছে হার্লেমের রাস্তায়। আকাশের গায়ে আর উইলো—বনের ঝোপে ঝোপে এখনো নীলচে কুয়াশা জড়িয়ে আছে—ফিকে অন্ধকারের মতো। গ্রিনউইচের সেই মাঠ ছেড়ে এসেছি রাত থাকতেই, নইলে সন্ধ্যার আগে হার্লেমে পৌঁছনো যাবে না। একে উঁচু পাহাড়ি রাস্তা, তার ওপর চড়াইয়ের মুখে মাইল তিরিশের গাড়ি টেনে টেনে ঘোড়াগুলোর দম এসেছে ফুরিয়ে। আবছায়া নিরালা বন—পথে ঘোড়ার গলার মৃদুমন্থর ঘণ্টাধ্বনি ঘুমপাড়ানি গানের মতো শোনাচ্ছে।

যে ওয়াগনটায় দামি জিনিসপত্র বোঝাই করা হয়েছে, পপ—এর কথামতো সেটায় চেপেছি আমি। তাঁবু, কাঠ—কাটরা, লোহা—লক্কড়ে বোঝাই বড় বড় মালগাড়িগুলো অনেকটা এগিয়ে গেছে, তারপর চলেছে বুড়ো পপ—এর ছোট্ট টমটম, তার পিছনে আমার ওয়াগন, আর সব শেষে আসছে জো আর লুর গাড়ি।

গাড়ির দোলানিতে বোধ করি তন্দ্রা এসেছিল, খুট করে একটা আওয়াজ হতেই চমক ভাঙল, চোখ মেলবার আগেই নাকে এসে লাগল সস্তা জিন—এর উগ্র গন্ধ। বুঝলুম, জীবনে আরেকটি বিস্ময়ের মুহূর্ত এসেছে। কিন্তু চোখ না—মেলেও আমি বলে দিতে পারতুম, রাত্রি—শেষের এই নীল অন্ধকারে এসেছে কে? এসেছে—লু, সুন্দরী গণিকা লু, মোমের মতো নরম, মোমের মতো সাদা তার শরীর নিয়ে, মদের মতো মদির, মদের মতো মধুর তার কামনা নিয়ে। এসেছে ইভ—এসেছে যৌবনের অভিশাপ!

সাপের মতো দু’খানা হাত অন্ধকারে আমার গলা জড়িয়ে ধরল, আমার হৃদকম্পনের সঙ্গে সঙ্গে কাঁপছে আরেকটি নিরাবরণ বুক, ভ্রমর গুঞ্জনের মতো আমার কানের কাছে ধ্বনিত হচ্ছে: তোমায় আমি ভালোবাসি জয়—ভালোবাসি! আমায় বিশ্বাস করো—

রক্তে আমার লেগেছে নেশা, নিজের নিশ্বাসের তাপে নিজেরই ঠোঁট যাচ্ছে পুড়ে। ভুলে গেছি, লু গণিকা—ভুলে গেছি, লুকে আমি ঘৃণা করি! তবু একবার বাঁচবার চেষ্টা করলুম। রুদ্ধশ্বাসে বললুম, তুমি চলে যাও লু, চলে যাও—এখুনি জো জেগে উঠবে, এখুনি সে এসে পড়বে এখানে—

ফিসফিস করে লু বললে, জো আর নেই।

জো নেই! তার মানে?

সাপের হিসহিস শব্দের মতো লু বলে উঠল, জো নেই, আমার জীবনে জো আর আসবে না। আমি বেঁচেছি!….ঘুমিয়েছিল সে, আস্তে আস্তে আমি তার গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে দিয়ে চলে এসেছি। এতক্ষণে…

এতক্ষণে ঘুমন্ত জোকে নিয়ে গাড়িখানা ঢালু পথে গড়াতে গড়াতে নিশ্চয় অতল খাদের মধ্যে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে। সারাদেহ আমার বরফের স্তূপের মতো ঠান্ডা কঠিন হয়ে উঠল। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই পপির মতো নরম, তরল সীসের মতো উষ্ণ দু’খানা ঠোঁট আমার ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরল।

চোদ্দো

একটি মুহূর্ত! যে মুহূর্তে গ্রহে—গ্রহে লাগতে পারে সংঘাত, পৃথিবী হতে পারে কক্ষচ্যুত। যে মুহূর্তে অরণ্যে আসে ফুলের বন্যা, দেহ আর দেহের সংঘর্ষে জ্বলে ওঠে আশ্চর্য অগ্নিশিখা। নারী সম্বন্ধে মানুষের ধারণাই বদলে যায় যে মুহূর্তে! সেই মুহূর্ত—সেই সর্বনাশা লগ্ন এসেছে আমার জীবনে। পপির মতো নরম, তরল সীসের মতো উষ্ণ সেই দুখানা ঠোঁটের নিপীড়নে আমার সমস্ত চেতনা যেন এক মিনিটের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। লু’র চুম্বন—সুন্দরী নারীর চুম্বন!

একটি মুহূর্তের জন্য আমার আত্মার হল মৃত্যু!

কিন্তু ঘুমন্ত অসহায় জোকে নিয়ে সেই ওয়াগনখানা এতক্ষণ ঢালু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ক্রমশ গড়িয়ে চলেছে! হয়তো এখনো খাদের নিচে পৌঁছয়নি। এখনো কিন্তু চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো যেতে পারে!…পারে বাঁচানো যেতে? হঠাৎ জেগে উঠলুম যেন: শোনো অজয়, জোকে তুমি বাঁচাও। পরম নিশ্চিন্ত হয়ে এখনো হয়তো সে ঘুমুচ্ছে, জানতেও পারেনি যে, জীবনে তার মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠেছে!…কেন বাঁচাবে না শুনি? কোনো ক্ষতিই তো জো তোমার করেনি, ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতাই তো নেই তার সঙ্গে? চিরকালের সেই ইভ—এর জন্য একটা ঘুমন্ত জীবন এমনি করে তুমি নষ্ট হতে দেবে?…চেষ্টা করলে জো’কে এখনো বাঁচাতে পার কিন্তু!

সারাদেহ আমার কখন কঠিন হয়ে উঠেছে জানতে পারেনি। গা—ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই লু একপাশে ছিটকে পড়ল। তার আর্তনাদ শোনবার অবসর ছিল না, একলাফে ওয়াগন থেকে নেমে আবছায়া কুয়াশা ভেদ করে ছুটলুম সেই চালু পাহাড়ি রাস্তায়। একশো গজ যেতে না যেতেই দেখতে পাওয়া গেল, জো’র ওয়াগনখানা মাতালের মতো টলতে টলতে গড়িয়ে চলেছে—চলেছে অতল খাদের সেই অন্ধকার কবরের দিকে। চাকাগুলো একবার যদি পিছলে যায়, তবে—

কে থামাবে অনিবার্য সর্বনাশের মতো প্রকাণ্ড ওই ভারি ওয়াগনের গতি? আমি? অসম্ভব! কিন্তু জোকে বাঁচাতেই হবে। মাথার চুলগুলো মুঠি করে ধরে ভাবতে লাগলুম, কি করা যায়? কি করা যায়?

জো’র ওয়াগনখানাকে পেছনে ফেলে রেখে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলুম। রাস্তার ধারে পড়ে রয়েছে মস্ত একটুকরো পাথর, কোনোরকমে পাথরের টুকরোটাকে যদি হাতখানেক সরিয়ে রাস্তায় এনে ফেলা যায় তো জো এ—যাত্রা রক্ষা পেয়ে যেতে পারে। দু—হাত দিয়ে পাথরটাকে সরাবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু না, মৃত্যুর মতো নিষ্ঠুর, মৃত্যুর মতো অটল সেই ভারি পাথরখানা একচুলও টলল না। এদিকে ওয়াগনখানা আমার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে, ঢালুর মুখে গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে, গাড়িখানা এমন ভয়ানকভাবে দুলছে যে, যে—কোনো মুহূর্তে চাকা পিছলে যেতে পারে!

আরেকবার চেষ্টা করলুম পাথরখানাকে সরাতে, পেশীগুলো উঠল ফুলে, স্নায়ু—শিরা যেন এখুনি ছিঁড়ে পড়বে, সমস্ত শরীরের জোর দিয়ে প্রাণপণে দিলুম এক ধাক্কা। পাথরের টুকরোটা এবার আধ—হাতটাকে সরে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ওয়াগনের পেছনের একখানা চাকা এসে ঠেকল তাতে। প্রচণ্ড ঝাঁকানি দিয়ে গাড়িখানাকে কে যেন হঠাৎ ব্রেক কষে থামিয়ে দিলে। চিৎকার করে ডাকলুম: শিগগির উঠে পড়ো জো, শিগগির—ওয়াগন থেকে লাফিয়ে পড়ো এখুনি—

প্রচণ্ড ঝাঁকানি না লাগলে, আমার চিৎকার জো’র কানে পৌঁছত কিনা সন্দেহ। দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঘুমে জড়ানো ভারি গলায় বললে, আঃ, জ্বালালে দেখছি শুয়োরের ছানা! কেন, এত চিৎকার কিসের হে ছোকরা?

বললুম, নেমে এসে গালাগালি দিও’খন, আগে নিজের প্রাণটা তো বাঁচাও—নেমে পড়ো শিগগির—

হতচকিত হয়ে জো এবার একলাফে ওয়াগন থেকে নেমে এল। আমার দিকে বিমূঢ় চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে শুধোলে, কি ব্যাপার ওজয়? আমি কিছু বুঝতে পারছি না, জিন খেয়ে শেষ—রাতে মাতাল হয়ে পড়েছিলুম কিনা—হার্লেমে আমরা কি পৌঁছে গেছি?

বললুম, না, কিন্তু তার আগেই তুমি খাদের অন্ধকার ঠান্ডা কবরে পৌঁছে যেতে! তোমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও জো, ভয়ানক একটা অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে তুমি বেঁচে গেলে আজ!

অ্যাক্সিডেন্ট! কেমন করে?—বিস্মিত জো প্রশ্ন করল।

উত্তরে (মিথ্যে কথা বলা ছাড়া উপায় কি?) বললুম, তোমার ওয়াগনের ঘোড়াটা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে রাশ ছিঁড়ে ফেলে, তুমি তো ঘুমুচ্ছিলে, এদিকে ঢালু রাস্তায় তোমাকে নিয়ে গাড়িখানা পিছু হটে গড়াতে শুরু করেছিল। যে কোনো মুহূর্তে চাকা পিছলে গাড়িখানা খাদে পড়তে পারত—ভাগ্যিস এই পাথরখানা ঠেলে সরিয়ে চাকা আটকানো গেল—

আমরা গলা শুনে জো’র মগজ থেকে ঘুমের আর নেশার জড়িমা কেটে গিয়েছিল বোধ করি। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সে হাত দিয়ে বুকের ওপর নিঃশব্দে ক্রশ—চিহ্ন আঁকলে। তারপর হঠাৎ আবার ওয়াগনের মধ্যে উঠতে গেল, তার হাতখানা ধরে ফেলে শুধোলুম, কোথা যাচ্ছ?

লু এখনো ওর মধ্যে রয়েছে যে!

জোর কথায় আমার হেসে ওঠা উচিত ছিল, বলা উচিত ছিল: তোমার মৃত্যুর দাম দিয়ে লু আমার প্রেম কিনতে গিয়েছিল—কিনতে গিয়েছিল কামনা—কলঙ্কিত এই রাত্রির কয়েকটি মুহূর্ত।…কিন্তু আমার মুখ দিয়ে বেরোল: লু আগেই লাফিয়ে পড়েছিল গাড়ি থেকে—সেই তো আমায় এই অ্যাক্সিডেন্টের খবর দিলে!

কুয়াশার আড়াল থেকে তখন ভোরবেলাকার হলদে আলো দেখা দিয়েছে। সেই অস্পষ্ট আলোয় জো’র মুখখানা অত্যন্ত শুকনো ক্লান্ত মনে হল। আশ্চর্য, কবরের ধার থেকে ফিরে এসেও ওর মুখে আনন্দের এতটুকু চিহ্ন নেই! যেন নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়েই জো বলতে লাগল, বেঁচে আর লাভ নেই, বুঝলে ওজয়। ধরো যদি মরেই যেতুম আজকে, তাতে কার কি ক্ষতি হত? কার চোখেই বা জল আসত বলো? …সব ভুয়ো ওজয়, সব বাজে…

জীবন সম্বন্ধে এই সস্তা দার্শনিকতায় হাসি পাবার কথা, বিশেষত গ্যাংস্টার জো’র মুখে এমন নাটুকে কথা শুনে। কিন্তু কোনো অসতর্ক ক্ষণে মানুষের ভেতরকার চেহারা বদলে যায়, কে বলতে পারে? আজ এই বিমর্ষ ভোরবেলার জো’কে—নিজের প্রতি বিগতমোহ এই লোকটিকে কেই বা চিনত আগে?

প্রসঙ্গটাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললুম, নেশা বুঝি তোমার এখনো কাটেনি জো? ওসব দার্শনিকতা এখন থাক—আগে এই ওয়াগনখানার ব্যবস্থা করতে হবে, ওদিকে দুর্ভাবনায় লু একা একা নিশ্চয়ই ছটফট করছে!

হ্যাঁ, চলো যাই। পপকেও একটা খবর দিতে হবে।—বলে জো এগোল।

.

বুড়ো পপকে খবর দিয়ে, আগের মালগাড়ি থেকে জনকয়েক লোক সঙ্গে নিয়ে আমার ওয়াগনের কাছে ফের ফিরে আসতে খানিকটা দেরি হল। ঘোলাটে হলদে আলো তখন অনেকটা সাদা হয়ে এসেছে।

লু’কে ডাকলুম। দরজা খুলে নিচে আসতেই জো’র সঙ্গে ওর মুখোমুখি দেখা। স্পষ্ট দেখলুম, লু’র মুখ ‘মমি’র মুখের মতো বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো বুঝি ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়—ভূত দেখেছে যেন! জো মরেনি, লু’র জীবনে মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতো জো তাহলে আবার এল!

কিন্তু চোখের পলকে পট—পরিবর্তন! নিজেকে সামলে নিতে লু’র এক সেকেন্ডও লাগেনি। দুই হাত দিয়ে জো’র কণ্ঠ বেষ্টন করে সে যেন সমুদ্রের ফেনার মতো ভেঙে পড়ল, মুখের কাছে মুখ নিয়ে অপূর্ব কোমল গলায় বলতে লাগল : তুমি ফিরে এলে জো—আঃ বাঁচলুম—

আদরের বন্যায় জো নিজেও বোধ করি অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লুর এই অদ্ভুত অভিনয় দেখে আমি হাততালি দেব কিনা, ভাবছিলুম!

.

কোথায় যেন পড়েছিলুম: নারী হচ্ছে কাচের গ্লাসের জল, নিজস্ব কোনো সত্তা নেই, যখন যে রঙের গেলাসে রাখ, তখনকার মতো সেই রংই তার। ‘রাশিকৃত চুম্বনের ফেনা!’ কথাটা একটু অশ্লীল শোনায় বটে, কিন্তু আরো সহজ করে বলা যায়, মেয়েরা হচ্ছে ভাড়াটে ট্যাক্সি। অন্তত আজকের এই নাটকীয় মুহূর্তে জো’র কণ্ঠলগ্না লু’র দিকে তাকিয়ে একথা বললে ভুল হবে না নিশ্চয়। মোমের মতো সাদা, পপির মতো ধবধবে লু’র শরীর, লোভনীয় রমণীয় শরীর, কিন্তু লু’র সঙ্গে কার তুলনা দেব? বরফে ডোবানো আঙুর, ঠান্ডা, বিস্বাদ! কিংবা রংকরা কাগজের ফুল, বিংশ শতাব্দীর মতো মেকি।

যাই হোক, চমৎকার অভিনয় করেছে লু, আজকের এই নাটকীয় ব্যাপারটাকে আশ্চর্য কৌশলে ও মানিয়ে নিয়েছে। টমটম ফিরিয়ে বুড়ো পপ তখন এসে পড়েছে সেখানে। লু’র হাত দু’খানা গলা থেকে খুলে জো বললে, এসো ওজয়, ঘোড়াটাকে ওয়াগনে ফের জুড়ে দিই, নইলে হার্লেমে সময় মতো পেঁছনো যাবে না।

বুড়ো পপও আমাদের সঙ্গে এগোল, তার পেছনে আর সবাই। ঘোড়াটা যথাস্থানেই দাঁড়িয়েছিল, তাকে ধরে নিয়ে জো রাশটা পরীক্ষা করে দেখলে। তারপর অবাক হয়ে বললে, কই, রাশ তো ছিঁড়ে যায়নি?

বললুম, না, ঠিক ছিঁড়ে যায়নি বটে, তবে খুলে গিয়েছিল হঠাৎ।

জো একবার আমার পানে তাকালে: এত শক্ত বাঁধন আপনা থেকেই খুলে গেল?

হ্যাঁ, বাঁধন যখন খুলে যায়, তখন আপনা থেকেই—কেউ টের পায় না—

কথাগুলি বলবার সময় মুখে কি আমার সঙ্কেতের ভাষা ফুটে উঠছিল? কণ্ঠে ব্যঙ্গের আভাষ? লু একবার আমার পানে মুখ তুলে তাকাল সে—মুখে বিবর্ণ একটি ছায়া নেমে এসেছিল ক্ষণেকের জন্য।

কথাটা জো কিন্তু ধরতে পারেনি, বললে তুমি তো টের পেয়েছিলে, নইলে ওয়াগনটা থামাতে পারতে না, হার্লেম—এ পৌঁছবার আগে খাদের ওই অন্ধকার কবরে পৌঁছে যেতুম বটে।

পপ আমায় জড়িয়ে ধরল: মাই বয়, ঈশ্বর তোমার ভালো করবেন!…দেখছ জো, ছেলেটার কী দুরন্ত সাহস! হাজার হোক, ক্যাথির ছেলে—আমার ভাগ্নে তো। ছোটবেলায় আমিও অমন দুরন্ত ছিলুম কিনা।

আবেগ আনন্দে ঝাঁঝালো ভুরুর নিচে পপ—এর চোখের পাতা ঘনঘন কাঁপতে লাগল। তার চোখের পাতা বোধকরি ভিজে এসেছে।

অন্যান্য ওয়াগন থেকে ইতিমধ্যে আরো জনকয়েক নেমে এসে জড়ো হয়েছিল, ব্যাপারটা শুনে ভিড়ে চাঞ্চল্য জাগল, শোনা গেল নানা কণ্ঠের গঞ্জন, ‘শাবাশ, বাহাদুর ছেলে!’ ‘ওই তো আজ জোকে বাঁচালে।’ ‘হ্যাঁ, সাহস বটে, অতবড় পাথরটাকে একাই সরিয়ে দিলে!’ ‘ঈশ্বর ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন…ও যেন দেবদূত হয়ে নেমে এসেছিল পৃথিবীতে।’

ভারি অপ্রস্তুত বোধ করছিলুম, প্রশংসা ক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়ে চলেছে। হঠাৎ গভীর রাতে ট্রেনের হুইসল—এর মতো তীক্ষ্ন একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল ভিড়ের সেই মৃদু কলরব ছাপিয়ে: থামো, থামো, কেন মিথ্যে ওর প্রশংসা করছ শুনি?…জানো, ও কতবড় শয়তান! জানো তোমরা?

এক সেকেন্ডের জন্য সকলের কথা গেল হারিয়ে। লু’র চিৎকার কুয়াশার পর্দায় লেগে তখনো কাঁপছে। পপ এগিয়ে এল, চোখের পাতা পিটপিট করতে করতে শুধোলে, কি বলছ তুমি লু? শয়তান—শয়তান কে?

তেমনি স্পষ্ট গলায় লু উচ্চচারণ করলে, শয়তান তোমাদের ওই ওজয়—যাকে তোমরা বলছ এঞ্জেল! জানো, রাত্রে লুকিয়ে জোকে খুন করতে গিয়েছিল কে? ঘুমন্ত অবস্থায় আমায় কে অপমান করতে চেয়েছিল—শুনবে তোমরা?

বিস্ময়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল—লু’র কথা শুনে, লু’র দিকে তাকিয়ে। ওর মুখ হয়ে উঠেছে রাঙা, এলোমেলো চুলে একটা চোখ আর মুখের একটা পাশ ঢাকা, আরেকটা চোখ জ্বলছে পাহাড়ি সাপের চোখের মতো। সারা দেহ ওর কাঁপছে থরথর করে। ধারালো কণ্ঠে ভোরবেলাকার কুয়াশার পর্দা ছিন্নভিন্ন করে লু বলে চলেছে: চোরের মতো চুপি চুপি ও এসেছিল আমাদের ওয়াগনে, রাত তখন শেষ হয়ে এসেছে, আমরা ঘুমোচ্ছিলুম। অন্ধকারে ও আমাকে নিয়ে গেল নিজের গাড়িতে, যাবার সময় দিয়ে গেল ঘোড়ার রাশ খুলে—জো তখন ঘুমোচ্ছে, কিছুই টের পায়নি। চিৎকার করতে গেলুম, দেখি, মুখ বাঁধা! তারপর বুনো জানোয়ারের মতো ওর সে কি…জোর করে আমায় ও চুমু খেল, করতে চাইল অপমান! (কান্নায় লু’র গলা বুজে এল) ধস্তাধস্তি করতে করতে আমার মুখের বাঁধন গিয়েছিল খুলে, চিৎকার করে উঠতেই ও ভয় পেয়ে ছুটল জোকে বাঁচাতে! এতবড় শয়তান ও, আর ওকেই তোমরা বলছ দেবদূত—বাঃ, চমৎকার! তাড়িয়ে দাও, এখুনি তাড়িয়ে দাও ওকে—

লু বোধ করি এবার হাঁফিয়ে উঠেছিল, রাস্তায় বসে পড়ে ও দু’হাতে মুখ ঢাকলে।

.

হ্যাঁ, বিস্মিত সবাই হয়েছিল, বিস্মিত হওয়ার কথা বইকি! শুধু অভিনয় নয়, লু যে মুখে মুখে এত চমৎকার গল্প রচনা করতে পারে, আমিই কি তা জানতুম? এ যেন রোমাঞ্চকর সিরিয়াল ফিল্মের খানিকটা! ভিড়ে ফের চাঞ্চল্য জেগেছে, কানে আসছে নানা কণ্ঠের মন্তব্য, কিন্তু ভাষা এবার বদলে গেছে: ‘ছোঁড়াটা শয়তানই বটে।’ ‘শুয়োরের বাচ্চচা কোথাকার, পেটে পেটে ওর এত বদমাইসি!’ ‘জো তাহলে নেহাত বরাত জোরে বেঁচে গেছে বলো?’

হাসি পাচ্ছিল, প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা যেন গালাগালির ভাষাও মুখস্থ করে এসেছিল, নইলে এত তাড়াতাড়ি মুখে জোগাল কেমন করে? পপ আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার হাত দু’খানা ধরলে, তারপর একবার কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বললে, জয় তুমি একবার বলো, লু যা বললে সব মিথ্যে!—বলো, অমন আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না, বলো—

বলতে পারতুম, লু’কেই আরেকবার জিজ্ঞেস করে দেখো পপ, আরেকটা রোমাঞ্চকর গল্প শুনতে পাবে নিশ্চয়! কিন্তু আড়ষ্ট ঠোঁট দু’খানা আমার কে যেন আঁঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে।

আস্তে আস্তে পপ আমার হাতদুটো ছেড়ে দিলে, বললে, শেষটা তোমাকেও অবিশ্বাস—নাঃ, কার্নিভ্যাল আমি তুলেই দেব জয়…

কথাটা আর শেষ হল না, অতি পুরাতন সেই ওক কাঠের পাইপটায় বুড়ো ঘনঘন টান দিতে লাগল।

আর চুপ করে থাকা আমার চলল না, স্নেহ—দুর্বল সেই বুড়োর একখানা হাত টেনে নিয়ে বললুম, পাগল হয়েছে আঙ্কল পপ! কার্নিভ্যাল তুলে দিতে যাবে কেন? মানুষের মুখের কথা থেকে কি সত্যি—মিথ্যে চিনে নেওয়া যায়?…তার চেয়ে এক কাজ করো, আমায় ছেড়ে দাও। তাড়িয়ে দিতে হবে না, আমি নিজেই চলে যাচ্ছি…

বুড়ো খামোকা রেগে অস্থির! হাতখানা সজোরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল, অনায়াসে, অনায়াসে! যাও না চলে, কে তোমায় ধরে রাখছে? তোমার মতো বজ্জাত ছোকরাকে তাড়িয়ে দেওয়াই তো উচিত! কেবল ক্যাথির ছেলে বলেই না তোমায় থাকতে দিয়েছিলুম, নইলে—নইলে তুমি আমার কে?

ঘনঘন পাইপে টান দিয়ে পপ ধোঁয়ায় মুখখানা অন্ধকার করে ফেলল। এবার আমারই চোখের পাতা এল ভিজে। ভারি অভিমান করেছে বুড়ো। ভেবেছিলুম চলে যাবার আগে বলে যাব : সত্যিই আমি তোমার কেউ নই পপ, তোমাদের আদরের বোন ক্যাথরিনকে আমি চোখেও দেখিনি! এতদিন তোমার স্নেহ আমি চুরি করেছি। …কিন্তু না, থাক! রাতে ঘুমের ঘোরে হয়তো বুড়ো স্বপ্ন দেখবে, পলাতক জয় আবার ফিরে এসেছে, হয়তো ভুল করে পাশের কম্বলখানা টেনে দেবে—পাছে জয়ের ঠান্ডা লাগে!

টুপি খুলে সবাইকে অভিনন্দন জানালুম—জো’কেও। কিন্তু আশ্চর্য, যাকে কেন্দ্র করে আজকের এই নাটকীয় ব্যাপারের সূচনা, সেই জো এতক্ষণ একটি কথাও কয়নি, একবার আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ঘোড়ার পিঠে একখানা হাত রেখে নিঃশব্দ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে—গ্যাংস্টার জো! যার ছোরার চিহ্ন এখনো ডিক—এর পাঁজরে আঁকা! এতবড় অভাবনীয় ঘটনা যেন ও ধারণা করতে পারছে না, কিংবা ওর পক্ষে এ যেন নিতান্ত অসাধারণ ব্যাপার!

সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে পা বাড়ালুম, হঠাৎ পিঠে কে হাত রাখলে। চেয়ে দেখি, ডিক। কানের কাছে মুখ এনে বললে, এ আমি জানতুম—ব্যর্থ কামনার প্রতিশোধ এমনিই ভয়ানক হয়ে ওঠে। যাক, আর এমন বোকামি কোরো না, অবহেলা কোরো না সুন্দরী মেয়ের চুমুকে—বাই—বাই কিড?

আশ্চর্য লোক এই ডিক। ও কি সব জানতে পেরেছে?…ফিরে চললুম সেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে। আবার একলা। দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে, লু এখনো দু’হাতে মুখ ঢেকে পথের ধুলোয় বসে। মনে মনে বললুম: আমায় তুমি বাঁচিয়ে দিয়েছ লু! মনে মনে তোমায় এতখানি ঘৃণা করবার সুযোগ না দিলে, তোমার কামনা থেকে আমার মুক্তি ছিল না। কিন্তু আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেকে তুমি এত বড় শান্তি নাই—বা দিতে!