নিশির জন্যে ভালবাসা

নিশির জন্যে ভালবাসা

বাল্টিমোরের কনভেনশন সেন্টারে এইমাত্র আলবার্তো গার্সিয়া তার পেপারটি উপস্থাপন শেষ করেছেন। ওভারহেড প্রজেক্টরের সুইচটি অফ বর তিনি হলভর্তি দর্শকদের দিকে তাকালেন। বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সে বক্তব্য শেষ হবার পর সাধারণত ছোট একটি সৌজন্যমূলক করতালি দেওয়া হয় কিন্তু এবারে একটি বিস্ময়কর নীরবতা বিরাজ করল। এই সেশনটির সভাপতি সেন্ট জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃদ্ধ অধ্যাপক বব রিকার্ডো প্রথমে করতালি দিতে শুরু করলেন এবং গ্যালারির প্রায় দুই হাজার শ্রোতা হঠাৎ করে চেতনা ফিরে পেয়ে করতালিতে যোগ দিল। দেখতে দেখতে করতালির প্রচণ্ড শব্দে হলঘরটি ফেটে যাবার উপক্রম হল কিন্তু তবুও সেটি থেমে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, বরং একজন–দুজন করে সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে উরুগুয়ের একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত বিজ্ঞানীকে সম্মান দেখাতে শুরু করলেন। বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সে সাধারণত সাংবাদিকরা থাকেন না কিন্তু জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের এই বার্ষিক কনফারেন্সে আলবার্তো গার্সিয়া যে পেপারটি। উপস্থাপন করবেন তার কথা কীভাবে কীভাবে জানি বাইরে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল, কাজেই আজ এখানে হলভর্তি সাংবাদিক। ফটো তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে শুরু করল। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্যে শ্রোতাদের অনেকে তাদের ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলেন।

বৃদ্ধ অধ্যাপক বব রিকার্ডো শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালেন, তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে সেশনটি শেষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি এখনই তিন নিয়ন্ত্রণটুকু হাতে না নিয়ে নেন সেটি সম্ভব হবার কথা নয়। বব রিকার্ডোকে উঠে দাঁড়াতে দেখে শ্রোতারা তাদের করতালি থামিয়ে একজন একজন করে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন, সাংবাদিকদের দলটি ঠেলাঠেলি করে আরো সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। বব রিকার্ডো কী বলেন সোনার জন্যে সবাই নীরব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

বব রিকার্ডো উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটি নিশ্বাস ফেলে কোমল গলায় বললেন, আলবার্তো গার্সিয়ার নাম আমাদের মতো কয়েকজন ছাড়া কেউ জানত না। কিন্তু আজ থেকে পৃথিবীর সব মানুষ আলবার্তোর কথা জানবে। আজকের কনফারেন্সে সে যে পেপারটি উপস্থাপন করেছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সেটি অত্যন্ত সাদামাটা একটি টেকনিক্যাল পেপার, কোষ–বিভাজনের সময় মানব–ক্রমোজমের টেলোমিয়ারকে অক্ষত। রাখার প্রক্রিয়া। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সে শুধু টেলোমিয়ারকে অক্ষত রাখে নি, টেলোমারেজ প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করেছে এবং সফলভাবে মানবকোষে ব্যবহার করেছে। আমরা তার তথ্য থেকে জানতে পেরেছি আলবার্তোর সাদাসিধে একটি ল্যাবরেটরিতে একটি পেটরি–ডিশে মানবদেহের ত্বকের কয়েকটি কোষ বিভাজন করছে যাদের থেমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বব রিকার্ডো বার্ধক্যে শীর্ণ হয়ে যাওয়া তার হাতটি সামনে তুলে ধরে বললেন, আমাকে বার্ধক্য এবং জরা আক্রান্ত করেছে, কারণ প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমার দেহের কোষগুলো তাদের হিসাবমতো এক শ থেকে দু শ বারের মতো বিভাজন করে থেমে পড়ছে। মঞ্চে দাঁড়ানো আলবার্তো বলছে থেমে পড়ার প্রয়োজন নেই। আলবার্তো গার্সিয়া মানবজাতির পক্ষ থেকে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি খুঁজে বের করেছে। সে আজ আপনাদের সামনে ঘোষণা করেছে মানুষকে বার্ধক্য স্পর্শ করবে না। বব রিকার্ডো হঠাৎ থেমে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন, প্রকৃতপক্ষে আলবার্তো মানুষকে অমরত্ব দান করেছে।

হলঘরটিতে হঠাৎ একধরনের চাঞ্চল্য দেখা গেল, একসাথে অনেকে কথা বলতে শুরু করল, অনেকে প্রশ্ন করার জন্যে উঠে দাঁড়াল। বব রিকার্ডো হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি জানি আপনাদের সবার ভিতরে অসংখ্য প্রশ্ন জমা হয়েছে, আমার নিজের ভিতরেও আছে। কিন্তু আজকে আমাদের হাতে সময় নেই, আমি এখানে মাত্র অল্প দু–একটি প্রশ্ন গ্রহণ করতে পারব। কে প্রশ্ন করতে চান?

উপস্থিত বিজ্ঞানীদের অনেকেই হাত তুলে প্রায় দাঁড়িয়ে গেলেন। বব রিকার্ডো তাদের। একজনকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে ইঙ্গিত করছিলেন কিন্তু তার আগেই কমবয়সী একজন তরুণী হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল; অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলল, প্রফেসর রিকার্ডো–আমরা সংবাদপত্র থেকে এসেছি, আপনাদের বৈজ্ঞানিক আলোচনা আমরা কিছুই বুঝব না। সেটি কি করে করা যায় না? আপাতত আমাদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে কি একটি-দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না?

বব রিকার্ডো একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, কী প্রশ্ন?

তরুণীটি আরো একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি ডক্টর গার্সিয়ার কাছে জানতে চাই। তিনি কেন এই আবিষ্কারটি করেছেন?

আলবার্তো গার্সিয়াকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, তিনি প্রশ্ন দৃষ্টিতে তরুণী সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন?

হ্যাঁ, কেন?

আলবার্তো গার্সিয়া একটু বিপন্ন মুখে বললেন, টেলোমারেজ নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতূহল। আমাদের ল্যাবরেটরিতে সেরকম সুযোগ–সুবিধে নেই, তাই যেটুকু পেরেছি সেটুকুই করেছি। মানবকোষকে কীভাবে অনির্দিষ্ট সময় বিভাজন করতে দেওয়া যায় সেটি বিজ্ঞানীমহলে দীর্ঘদিনের কৌতূহল। আমি সেই কৌতূহল থেকে কাজ করেছি

কিন্তু মানুষ যদি অমর হয়ে যায়–তাদের যদি মৃত্যু না হয়।

আলবার্তো গার্সিয়া হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি একজন বিজ্ঞানী, আমি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের কৌতূহল নিয়ে কাজ করেছি। এই তথ্যের কারণে মানবসমাজে কী প্রভাব পড়বে সে–সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

তরুণী সাংবাদিক উৎকণ্ঠিত মুখে বলল, কিন্তু এখন আমরা সেটাই শুনতে চাই। মানুষ যদি অমর হয়ে যায়, এই পৃথিবীর কী হবে? সমাজের কী হবে?

আলবার্তো গার্সিয়া মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি জানি না। একমুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি বব রিকার্ডোর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, হয়তো প্রফেসর রিকার্ডো এ ব্যাপারে আপনাদের কিছু একটা বলতে পারবেন।

সাংবাদিকরা সাথে সাথে বব রিকার্ডোর দিকে ঘুরে গেল, প্রফেসর রিকার্ডো, আপনি কি কিছু বলবেন?

বব রিকার্ডো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভবিষ্যৎ অনুমান করা খুব কঠিন, কিন্তু তোমরা যদি আমাকে চাপ দাও আমি চেষ্টা করতে পারি।

আমরা চাপ দিচ্ছি প্রফেসর রিকার্ডো।

বব রিকার্ডো একটু হেসে কথা বলতে শুরু করলেন, কথা শুরু করার সাথে সাথে তার মুখের হাসি মিলিয়ে সেখানে একটি থমথমে গাম্ভীর্য চলে এল। প্রায় নিচুগলায় বললেন, মানুষের অমরত্বের জন্যে মোহ দীর্ঘদিনের। এই অমরত্বের লোভে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অনেক অন্যায় অনেক পাপ করা হয়েছে। দেবদেবী বা ঈশ্বর মানুষকে যে অমরত্ব দিতে পারে নি, আমাদের বিজ্ঞানীরা মানুষকে সেই অমরত্ব দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। এখনো সেই কাজ পূর্ণ হয় নি কিন্তু আমার হিসেবে আগামী শতাব্দী থেকে মানুষ আর বাধক্যের কারণে মৃত্যুবরণ করবে না।

বব রিকার্ডোকে বাধা দিয়ে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, তাহলে কিসে তাদের মৃত্যু হবে?

রোগ, শোক, একসিডেন্ট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পৃথিবীর হিসেবে সেটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। মানুষের যদি মৃত্যু না হয়, দেখতে দেখতে এই পৃথিবীতে জনসংখ্যার এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে। এই পৃথিবীতে থাকবে শুধু মানুষ আর মানুষ। আজ থেকে হাজার। বছর পর এই পৃথিবীতে পদচারণা করবে সহস্র বছরের যুবা, তাদের চোখে কী থাকবে–স্বপ্ন হতাশা আমি জানি না, তাদের বুকে কী থাকবে, ভালবাসা না ঘৃণা সেটাও আমি জানি না। আমার বয়স সত্তর, আমি এখনো আমার শৈশবকে স্মরণ করতে পারি, সহস্র বছরের মানুষ কি তার শৈশবকে স্মরণ করতে পারবে? আমার মনে হয় পারবে না। তাদের স্মৃতিতে কোনো আনন্দ নেই, তাদের সামনে ভবিষ্যৎ নেই, কোনো স্বপ্ন নেই। বেঁচে থাকার কোনো তাড়না নেই। তাদের সমাজে কোনো শিশু নেই, কোনো ভালবাসা নেই তাদের কথা চিন্তা করে আমি শিউরে উঠছি।

একজন প্রৌঢ় সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আপনি কি মনে করেন ড. আলবার্তো গার্সিয়াকে পৃথিবীর ইতিহাস ভালোভাবে স্মরণ করবে না?

বব রিকার্ডো বিষণ্ণমুখে মাথা নেড়ে আলবার্তো গার্সিয়ার দিকে তাকালেন, বললেন, আমি দুঃখিত আলবার্তো। কিন্তু আমার ধারণা মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্যে পৃথিবীর ইতিহাস এককভাবে তোমাকে দায়ী করবে। তুমি হবে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিশপ্ত বিজ্ঞানী।

আলবার্তো গার্সিয়া ফ্যাকাসে মুখে বব রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

***

দুই হাজার বছর পরের কথা।

.

নিশি রনের গলা জড়িয়ে বলল, তুমি এরকম মুখ ভার করে আছ কেন?

রন অন্যমনস্কভাবে নিশির হাত সরিয়ে বলল, কে বলেছে আমি মুখ ভার করে আছি?

এই তো আমি দেখছি, তুমি নিজ থেকে কোনো কথা বলছ না, আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছ। তাও ছাড়া ছাড়াভাবে, কাটা কাটাভাবে।

রন নিশিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, আমি দুঃখিত নিশি। কয়দিন থেকে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।

কেন? কী হয়েছে?

জানি না কেন। আমার বয়স প্রায় দুই হাজার বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মনে হয় নিজেকে বুঝতে পারি না।

নিশি রনের গলা জড়িয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, তোমার বয়স দশ হাজার বছর হলেও তুমি নিজেকে বুঝতে পারবে না। কিছু কিছু মানুষ নিজেকে বুঝতে পারে না।

রন কোমল চোখে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি নিজেকে বুঝতে পার?

নিশি মাথা নাড়ল, বলল, পারি। এই যেমন মনে কর তোমার পাশে বসলেই আমার মনে হয় আমার বয়স এক হাজার বছর কমে গিয়েছে?

সত্যি?

সত্যি।

রন মাথা নাড়ল, বলল, আমি বিশ্বাস করি না। এক হাজার বছর আগে তোমার কেমন লাগত সেটি তোমার মনে নেই। তোমার মনে থাকার কথা নয়।

নিশি হাসি হাসি মুখে বলল, মনে না থাকলে নেই–সবকিছু মনে রাখতে হবে তোমাকে কে বলেছে?

আমার মাঝে মাঝে খুব মনে করার ইচ্ছে করে। রন এক ধরনের উদাস–চোখে বলল, আমার কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মনে করার ইচ্ছে করে জান?

কোন জিনিসটি?

আমার শৈশবের কথা। আমি শৈশবে কী করেছি খুব জানার ইচ্ছে করে।

সেটি তুমি কেমন করে জানবে? গত দুই হাজার বছরে তুমি নিশ্চয়ই তোমার স্মৃতি খুব কম করে হলে পাঁচবার মুছে দিয়েছ।

নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই দিয়েছি।

তুমি যতবার তোমার নতুন জীবন শুরু করেছ ততবার তুমি তোমার স্মৃতি মুছে দিয়েছ।

রন মাথা নাড়ল, আমার নতুন জীবনটি কতটুকু নতুন কে জানে!

নিশি খিলখিল করে হেসে বলল, অ্যাডভেঞ্চারের দিকে তোমার যত ঝোঁক আমি নিশ্চিত তুমি এক দুইবার ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছ, মেয়ে থেকে ছেলে হয়েছ! দুই হাজার বছরে তো কত কী করা যায়!

রন কোনো কথা না বলে একটু হাসল। নিশি হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল, আমার কী ইচ্ছে করে জান?

কী?

আমার খুব সন্তানের মা হতে ইচ্ছে করে। এরকম ছোট একটা বাচ্চা হবে, আঁকুপাকু করে নড়বে, আমি বুকে চেপে ধরে রাখব, ভাবলেই আমার বুকের ভিতর কেমন জানি করতে থাকে।

রন নিশিকে স্নেহভরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করে জান সেটি হবার নয়। পৃথিবীতে নতুন শিশুর জন্ম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার বছর আগে।

জানি। তবুও ইচ্ছে করে।

পৃথিবী যত মানুষকে বাচিয়ে রাখতে পারে এখানে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ। আমার শুধু কী মনে হয় জান?

কী? পৃথিবীতে জনসংখ্যা আবার বুঝি আশঙ্কা–সীমা পার হয়ে গেছে।

নিশি চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি!

হ্যাঁ। মনে নেই গত কয়েক মাস থেকে খাবার পরিবহনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, পানীয়ের সরবরাহ কম।

হ্যাঁ।

আমার ধারণা এগুলো পরিবহনের বা সরবরাহের ক্রটি নয়।

নিশি ভয়–পাওয়া গলায় বলল, তাহলে এগুলো কী?

এগুলো অভাব। শুধু যে খাবারের অভাব তাই নয়, জ্বালানির অভাব, জায়গার অভাব। তুমি লক্ষ করেছ আমাদের এই দুই হাজার তলা দালানে একটি এপার্টমেন্ট খালি নেই? দেখেছ?

হ্যাঁ। দেখেছি।

মনে আছে পোশাকের মূল্য শতকরা বিশভাগ বাড়ানো হল। মনে আছে?

নিশি মাথা নাড়ল, তার মনে আছে। রন গম্ভীরমুখে বলল, আমার এইসব দেখে মনে হয় কী জান?

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

হ্যাঁ।

নিশির বুক কেঁপে ওঠে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে গত দুই হাজার বছরে বেশ কয়েকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই স্মৃতি তাদের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তবু তারা সেগুলো জানে। পৃথিবীর মানুষ এখন এই ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকে, কখন পৃথিবীর প্রয়োজনে তাকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করিয়ে দেওয়া হয়।

নিশির ভয়–পাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রন গভীর ভালবাসায় তাকে বুকের মাঝে টেনে নেয়। অপূর্ব রূপসী এই রমণীটিকে সে মাত্র তিনশত বছর আগে থেকে চেনে। ছেলেমানুষ সরল এই মেয়েটিকে তার বড় ভালো লাগে।

***

গভীর রাতে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দে নিশি চমকে জেগে উঠল। বিছানায় তার পাশে শূন্য জায়গা, রন আগেই উঠে গেছে। নিশি ভয়–পাওয়া গলায় ডাকল, রন। কোথায় তুমি?

জানালার কাছে ছায়ামূর্তির মতো রন দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, এই যে, আমি এখানে।

কী হয়েছে রন? সাইরেন বাজছে কেন?

পৃথিবীর মানুষের এখন খুব বড় বিপদ নিশি।

কী হয়েছে? কেন বিপদ?

পৃথিবীর জনসংখ্যা আশঙ্কা–সীমা পার হয়ে গেছে।

পার হয়ে গেছে? নিশি আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, পার হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। শুনছ না বিপদের সাইরেন?

এখন কী হবে?

জনসংখ্যা কমাতে হবে।

কীভাবে কমাবে? কাকে কমাবে?

জানি না। যোগাযোগ মডিউল খুলে দেখি।

রন যোগাযোগ মডিউলের নিয়ন্ত্রণ স্পর্শ করতেই ঘরের ভেতরে একজন মানুষের হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ভেসে এল। মধ্যবয়স্ক কঠোর চেহারার মানুষ, বুকের উপর চারটি লাল রঙের তারা দেখে বোঝা যায় সে নিয়ন্ত্ৰণবাহিনীর অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মানুষটি কঠোর গলায় বলল, পৃথিবী আবার ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি। মানুষের একটি বিশেষ সংখ্যায় পৌঁছে গেলে পৃথিবী তাকে বহন করতে পারে না, একটি অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় দিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমে আসে। আমরা সেই অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যেতে চাই না। সেই বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণহীন এবং তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।

পৃথিবীর মানুষের গড় বয়স দুই হাজার বছর। গত দুই সহস্রাব্দ পৃথিবীতে নতুন কোনো শিশুর জন্ম হয় নি। বিবর্তনের ভেতর দিয়ে কার্যকর প্রজাতির উঠে আসার ব্যাপারটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। মানবজাতি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার উপযোগী নয়। মানুষ এখন দুর্বল এবং অথর্ব। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

অতীতে জনসংখ্যা যখনই আশঙ্কার সীমা অতিক্রম করেছে তখনই মানুষের সংখ্যা কমিয়ে নতুন শিশুর জন্ম দেওয়া হয়েছে। যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছুক তাদের তালিকা করে পৃথিবী থেকে অপসারণ করা হয়েছে। সেই সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করে মানুষকে হত্যা করতে হয়েছে। মানুষকে অত্যন্ত দ্রুত হত্যা করতে পারে এরকম ভাইরাস তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে একবার এক তৃতীয়াংশ মানুষ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে, এখন এক তৃতীয়াংশ মানুষকে হত্যা করেও পৃথিবীকে রক্ষা করা যাবে না। এখন পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে কমিয়ে আনতে হবে। যেভাবেই থোক।

পৃথিবীর জনসংখ্যা কমানোর জন্যে এবার সম্পূর্ণ নতুন এবং কার্যকর একটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই পদ্ধতি অবলম্বন না করা হলে মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ। আজ রাতের জন্যে মানুষ হত্যাসংক্রান্ত বিধিনিষেধটি পৃথিবী থেকে তুলে নেওয়া হল। পৃথিবীর প্রত্যেকটি জীবিত মানুষ অন্য একজন মানুষকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করবে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, বরং সে পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ পাবে। তাকে যেন হত্যাকারে অপরাধবোধে ভুগতে না হয় সেজন্যে কাল ভোরের আগেই তার পুরো স্মৃতিকে অপসারিত করে দেওয়া হবে।

মানুষ হত্যা করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এর কার্যকর কয়েকটি পদ্ধতি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পদ্ধতিগুলি হচ্ছে–

নিশি চিৎকার করে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে দিতেই ঘরের মাঝামাঝি বসে থাকা কঠোর চেহারার মানুষের হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিশি উদভ্রান্তের মতো রনের দিকে তাকাল, বলল, এটা হতে পারে না। এটা কিছুতেই হতে পারে না।

রন বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু এটা হয়ে গেছে।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারে না।

প্রয়োজনের খাতিরে মানুষ অনেকবার অন্য মানুষকে হত্যা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস। যুদ্ধের অর্থ হচ্ছে হত্যাকাণ্ড। পরিকল্পিত সুসংবদ্ধ হত্যাকাণ্ড!

নিশি ব্যাকুল হয়ে বলল, কিন্তু এটি তো যুদ্ধ নয়।

কে বলেছে যুদ্ধ নয়? মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্যে এটিও এক ধরনের যুদ্ধ। এখানে মানুষ নিজেরা নিজেদের শত্রু। তাই এখন একে অন্যকে হত্যা করবে। মানুষকে যেন সেই হত্যাকাণ্ডের অপরাধবোধ বহন করতে না হয় সেজন্যে তার স্মৃতিকে পুরোপুরি অপসারণ করে দেওয়া হবে। সে জানতেও পারবে না সে একটি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে।

নিশি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো মাথা নেড়ে বলল, না–না–না। এটা হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। একজন মানুষ অন্যকে খুন করতে পারে না।

রন বিষণ্ণ গলায় বলল, এটি সেরকম খুন নয়। এর মাঝে কোনো ক্রোধ, জিঘাংসা, স্বার্থ বা লোভ নেই। এটি একটি প্রক্রিয়া, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার একটি প্রক্রিয়া। মানুষকে বাচিয়ে রাখার একটি প্রক্রিয়া। এর সিদ্ধান্ত কোনো মানুষ নেয় নি, তারা শুধুমাত্র নিয়মটি পালন করছে। 

নিশি এবারে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কেঁদে ফেলল, কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিন্তু আমি কেমন করে একজন মানুষকে খুন করব? কাকে খুন করব? কেমন করে খুন করব?

রন কিছু বলল না, গভীর মমতায় নিশির দিকে তাকিয়ে রইল। নিশি ব্যাকুল হয়ে রনের দিকে তাকাল, রন তাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, নিশি, তোমার কাউকে খুন করতে হবে না। আমি তোমাকে রক্ষা করব নিশি।

কেমন করে তুমি আমাকে রক্ষা করবে?

রন কোনো কথা বলল না, গভীর মমতায় সে নিশির মুখে হাত বুলিয়ে বলল, এই যে। এইভাবে।

নিশি অনুভব করল রনের শক্ত দুটি হাত তার গলায় চেপে বসেছে, নিশি নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। একবিন্দু বাতাসের জন্যে তার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে কিন্তু রনের হাত এতটুকু শিথিল হল না। নিশি বিস্ফারিত চোখে রনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, সেই মুখে কোনো ক্রোধ নেই, কোনো জিঘাংসা নেই, কোনো প্রতিহিংসা নেই। সেই মুখে গভীর বেদনা এবং ভালবাসা।

নিশির জন্যে ভালবাসা এবং পৃথিবীর জন্যে ভালবাসা।