নিশানা নির্ভুল
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও আরিজোনার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে বর্তমান কাহিনির শুরু এবং পাত্র ও অপাত্রদের মধ্যে প্রথমেই যে ব্যক্তি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, সে হচ্ছে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট এক বলিষ্ঠ পুরুষ।
অশ্বারোহী যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে কিছুদূরে মাঠের ওপর ঘাস খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল গোরু। গোরুর পালের আশেপাশে ঘোড়ার পিঠে চেপে যে লোকগুলো টহল দিচ্ছে, তাদের মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় তারা কেউ নিরীহ ভদ্রলোক নয়। ওরা হল আমেরিকার দুর্ধর্ষ কাউবয় বা গো-পালক।
প্রথমেই যে বলিষ্ঠ অশ্বারোহীর উল্লেখ করেছি, সেই মানুষ ওই গোরুর পালের মালিক এবং কাউবয়দের প্রভু। অশ্বারোহীর নাম জন চেসাম। ওই অঞ্চলের মানুষজনকে ভয় করত, এড়িয়ে চলত। ভয়টা অহেতুক নয়–জন অত্যন্ত ভয়ানক চরিত্রের লোক, সামান্য কারণেই নরহত্যা করতে সে অভ্যস্ত। তার লক্ষ্মীছাড়া চ্যালাচামুণ্ডারা ছিল তারই মতো, রাইফেল ও রিভলভারে সিদ্ধহস্ত, প্রভুর আদেশে গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করতে তারা একটুও ইতস্তত করত না।
আইন? হ্যাঁ, আইন একটা ছিল বটে তবে যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে সরকারের আইন নিয়ে আমেরিকাতে কেউ মাথা ঘামাত না। শক্ত মুঠিতে নির্ভুল নিশানায় যে গুলি চালাতে পারত, আইনের প্রতিনিধিরা তাকে স্পর্শও করতে চাইত না। গৃহযুদ্ধের পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার এই ছিল চেহারা।
সেদিন জন চেসামের মেজাজটা বেশ ভালো ছিল। কারণ, কয়েকদিন আগেই তার পোষা গুন্ডার দল পঞ্চাশটা গোরু চুরি করে এনেছে। মাঠের ওপর চেসামের নিজস্ব গোরুর পালের মধ্যে সেই চুরি করা গোরুগুলিও ছিল। পশুপালক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিজস্ব গোরুর গায়ে লোহা পুড়িয়ে নিজের দলের প্রতীক চিহ্ন এঁকে দিত। চুরি করা গোরুদের গায়েও অন্য প্রতিষ্ঠান র্যাঞ্চ-এর প্রতীক চিহ্ন ছিল। কিন্তু চেসাম খুব ভালোভাবেই জানত যে, সেই চিহ্ন দেখে তার গোরুর পালের ভিতর থেকে নিজস্ব গোরু শনাক্ত করে নিয়ে যেতে পারে এমন দুঃসাহসী মানুষ ওই অঞ্চলে নেই। অতএব, রাতারাতি পঞ্চাশটা গোরুর মালিকানা লাভ করে জন চেসাম খুব খুশি হয়ে উঠেছিল।
আচম্বিতে তৃণাবৃত প্রান্তরের বুকে জাগল অশ্বখুরধ্বনি, চেসামের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা।
মাঠের ওপর ঘোড়ার খুরে বাজনা বাজাতে বাজাতে ধুলোর ঝড় তুলে এগিয়ে আসছে একদল অশ্বারোহী!
তীক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চেসাম বুঝতে পারল, এরা কেউ আরিজোনার মানুষ নয়, সকলেই টেক্সাসের অধিবাসী। নবাগত ঘোড়সওয়ারদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল একটি ছোটোখাটো নিরীহ চেহারার মানুষ।
গোরুর পালের দিকে এক নজরে তাকিয়েই ছোটোখাটো মানুষটি আদেশ দিল, আমাদের গোরুগুলির চিহ্ন দেখে ওদের আলাদা করে নাও।
টেক্সানরা বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোরাই গোরুগুলিকে তারা দল থেকে তাড়িয়ে আলাদা করে ফেলল।
জন চেসাম এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখছিল, এইবার সে সগর্জনে প্রতিবাদ জানাল।
চেসামের দলের লোকগুলি প্রস্তুত হল লড়াইয়ের জন্য। প্রত্যেকেরই কোমরে ঝুলছে রিভলভার, মালিকের আদেশ পেলেই তারা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
নবাগতদের আচরণে বোঝা গেল, বিনা যুদ্ধে দাবি ত্যাগ করতে তারাও রাজি নয়। তারাও সশস্ত্র। দুই দলের দুই নেতা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল।
জন চেসাম তার প্রতিপক্ষের মুখের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তার লম্বা-চওড়া মস্ত শরীরের তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বীর ছোটোখাটো চেহারাটা নিতান্তই নগণ্য। সেই নগণ্য মানুষটি গম্ভীর স্বরে বলল, চেসাম! গোরুগুলি আমার, অতএব ওগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি অনেকদিন এখানে আছ, আইন তোমার অজানা নয়।
নবাগত অশ্বারোহীর দল তাদের নিজস্ব গোরুগুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে প্রস্থান করার উদ্যোগ, করল। জন চেসাম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না। প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী দেখেছিল সেই জানে, কিন্তু কোমরের রিভলভারে হাত না-দিয়ে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল পিছন দিকে এবং দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অকুস্থল থেকে। চুরি যাওয়া গোরুগুলিকে নিয়ে নবাগতরা প্রস্থান করল নির্বিবাদে।
জন চেসামের মতো দুর্দান্ত মানুষও যার কাছে বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করল তার নামও জন, তবে চেসাম নয়, স্লটার।
আরিজোনার মানুষ একটি নতুন নাম শুনল–জন স্লটার।
জন স্লটার নামক মানুষটি টেক্সাস অঞ্চল থেকে আরিজোনার টম্বস্টোন শহরের দিকে যাত্রা করেছিল। ওই জায়গাটা ছিল পশুপালকদের পক্ষে আদর্শ স্থান। টেক্সাস থেকে স্লটার এসেছিল ওইখানে পশুর ব্যাবসা করতে। তার দলে ছিল অনেকগুলি গোরু। আরিজোনার বিস্তৃত অঞ্চলে যারা পশুমাংসের ব্যাবসা করতে র্যাঞ্চ বা গোশালা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল অসাধু প্রকৃতির মানুষ। গোরু চুরি করে সম্পত্তি বৃদ্ধি করার নিয়মটা ছিল সেখানে নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। প্রতিবাদ করলে আসল মালিকের মৃত্যু ছিল অবধারিত, কাজেই কেউ প্রতিবাদ জানাতে সাহস পেত না। জন স্লটার নামে মানুষটি, যে তার নিজস্ব গোরু দাবি করার সাহস রাখে, এই খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জন চেসামের পরে আরও কয়েকটি গুন্ডা প্রকৃতির লোক স্লটারের গোরু চুরি করার চেষ্টা করল। প্রত্যেকবারই হল এক ঘটনা পুনরাবৃত্তি হারানো গোরুগুলিকে আবিষ্কার করে স্লটার সেগুলোকে আবার নিজের দলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। একদিন স্লটারের দলের লোকরা অন্য প্রতিষ্ঠানের গোরুর পালের ভিতর থেকে এক-শোটা চুরি করা জন্তু উদ্ধার করেছিল।
ওই অঞ্চলের গুন্ডাদের কাছে স্লটার হল মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ!
অবশেষে একদিন গোলমাল বাধল। গ্যালাঘার নামে এক ভয়ংকর দুবৃত্ত ঘোষণা করল স্লটারকে সে হত্যা করবে। কথাটা যথাসময়ে স্লটারের কানে এল। সে কোনো মন্তব্য করল না, কিন্তু সাবধান হল।
একদিন ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতে স্লটার লক্ষ করল, গন্তব্যপথের মাঝখানে এমন একটা জায়গা আছে, যেখানে একটা মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। সে সন্দেহজনক জায়গাটা পরিহার করে অন্য পথে ঘোড়া চালিয়ে দিল। একটু পরেই বোঝা গেল তার আশঙ্কা অমূলক নয়। পূর্বোক্ত স্থান থেকে খোলা পথের ওপর আত্মপ্রকাশ করল এক অশ্বারোহী।
গ্যালাঘার!
গ্যালাঘারের হাতে ছিল একটা শটগান এবং কোমরের দুই দিকে ঝুলছিল দুটি রিভলভার। শটগান উঁচিয়ে ধরে গ্যালাঘার সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল স্লটারের দিকে। স্লটার রাইফেল ছুড়ল। গ্যালাঘারের ঘোড়া আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, গ্যালাঘার নিজেও ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটির ওপর। কয়েক মুহূর্ত পরেই গ্যালাঘার উঠে পড়ে শটগান তুলে গুলি চালাল। আবার গর্জে উঠল স্লটারের রাইফেল, পেটে গুলি খেয়ে ধরাশায়ী হল গ্যালাঘার। মাত্র কয়েটি মুহূর্ত–আহত বাঘের মতোই লাফিয়ে উঠল গ্যালাঘার এবং দু-হাতে দুটি রিভলভার তুলে ঘনঘন অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল শত্রুর দিকে। স্লটার রাইফেল তুলল, অব্যর্থ লক্ষ্যে রাইফেলের বুলেট গ্যালাঘারের বক্ষ ভেদ করে তাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। রাইফেল নামিয়ে জন স্লটার তার নির্দিষ্ট পথের দিকে অশ্বকে চালনা করল।
এইসবই হল পথের ঘটনা। যথাসময়ে জন স্লটার এবং তার স্ত্রী গন্তব্যস্থান টম্বস্টোন শহরে এসে উপস্থিত হল। স্লটারের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল, অতএব শহরের অনেক গুন্ডা বদমাইশের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার দিকে।
একদিন স্লটার স্ত্রীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এক জায়গায় গোরু কিনতে গিয়েছিল। হঠাৎ স্লটারের চোখে পড়ল দুটি লোক ঘোড়া ছুটিয়ে পথের মাঝখানে একটা উচ্চভূমির অন্তরালে আত্মগোপন করল। স্লটার তৎক্ষণাৎ অন্যদিকের একটা ঢালু জমির ওপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে দিল এবং একটু পরেই এসে পড়ল খোলা রাস্তার মাঝখানে। অশ্বারোহী দুজন অন্তরালেই থেকে গেল, সামনে এসে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ তাদের হল না।
কিছুদিন পরেই স্লটার আবার নিজের আস্তানায় ফিরে এল। ফিরে আসার সঙ্গেসঙ্গে একটা গুজব শুনে তার মেজাজ গরম হয়ে উঠল–এডলিল আর ক্যাপ স্টিলওয়েল নামে দুই গুন্ডা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে স্লটারের টাকাপয়সা তারা লুঠ করবে।
কোমরে গুলিভরা রিভলভার ঝুলিয়ে জন স্লটার পূর্বোক্ত দুই গুন্ডার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিল, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারা যদি শহর ত্যাগ না-করে তাহলে স্লটার তাদের হত্যা করবে। এডলিল বিনা প্রতিবাদে স্লটারের বক্তব্য শুনল, কিন্তু স্টিলওয়েল হাত বাড়াল কোমরের রিভলভারটার দিকে।
স্টিলওয়েলের হাত রিভলভারের বাঁট স্পর্শ করার আগেই স্লটারের কোমরের রিভলভার বিদ্যুদবেগে খাপের আশ্রয় ছেড়ে শত্রুর ললাট লক্ষ করে উদ্যত হল! স্টিলওয়েল ভাবতেই পারেনি, এত দ্রুতবেগে কোনো মানুষ খাপ থেকে রিভলভার টানতে পারে।
নিজের কোমর থেকে চটপট হাত সরিয়ে এনে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্লটারের মুখের দিকে!
পরের দিনই দুই স্যাঙাত শহর ছেড়ে সরে পড়ল। টম্বস্টোন শহরে আর কোনোদিনই কেউ তাদের দেখতে পায়নি।
এইবার আমরা জন স্লটারের পূর্ব ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করব। ছোটোবেলায় স্লটার ছিল অত্যন্ত রুণ। শক্তির অভাব পূরণ করার জন্য সে রিভলভার ও রাইফেল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র অভ্যাস করতে শুরু করল এবং খুব অল্প বয়সেই সে এমন নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল যে, পাকা পিস্তলবাজ মানুষও তাকে ঘাঁটাতে সাহস করত না।
পরিণত বয়সে জন স্লটার যখন কনফেডারেট আর্মিতে যোগ দিল, তখন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এক বছর পরেই সৈন্যবাহিনী থেকে স্নটারকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল, কারণ সে হয়েছিল যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত। ওই অবস্থায় সে ফিরে এসে যোগ দিল টেক্সাস রেঞ্জার্স নামক বেসরকারি বাহিনীতে। ওই দুর্ধর্ষ বাহিনী এক মাসের মধ্যে যতগুলি লড়াইয়ের সম্মুখীন হত, সরকারি সৈন্যদল সারাবছরের মধ্যেও ততগুলি যুদ্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত না।
এমন ভয়ানক দলের মধ্যে ছয় বৎসর কাটিয়ে জন স্লটারের স্নায়ু হয়ে উঠল ইস্পাতের মতো কঠিন। তারপরই সে টেক্সাস ত্যাগ করে আরিজোনার টম্বস্টোন শহরের দিকে সস্ত্রীক যাত্রা করেছিল এবং পরবর্তীকালে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, পূর্বেই আমরা তা সবিস্তারে আলোচনা করেছি।
জন স্লটারের র্যাঞ্চ বা গোশালা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। তার টাকাপয়সা দেখে গুন্ডারা লুব্ধ হয়ে উঠত বটে, কিন্তু স্লটারের রিভলভার ও আঙুলের যোগাযোগে যে অত্যন্ত অশুভ ঘটনার উৎপত্তি হয়, বারংবার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে ওই অঞ্চলের দুবৃত্তেরা বুঝতে শিখেছিল, জন স্লটার নামক মানুষটির সঙ্গে যথাসম্ভব দূরত্ব বজাই রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। গুন্ডাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্লটারের পরিচিত, তবে স্লটার তাদের সঙ্গে কথা বলত না, বা কোনো দলীয় কলহের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইত না। সরকারের সেনাবাহিনীতে, রেল কোম্পানির মজুরদের মধ্যে এবং টম্বস্টোন শহরের ১৫০০০ শহরবাসীর কাছে মাংস বিক্রয় করে সে আদর্শ ব্যবসায়ীর জীবনযাপন করত, তাকে না-ঘাঁটালে সে কোনো গোলমালে নাক গলাত না।
কিন্তু গুন্ডাদের সঙ্গে সংঘর্ষ না হলেও দীর্ঘদিন নিরুপদ্রব শান্তি উপভোগ করার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি জন স্লটার। জেরোনিমো নামে এক দুঃসাহসী নায়কের নেতৃত্বে অ্যাপাচি জাতীয় রেডইন্ডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। মেক্সিকো থেকে অ্যাপাচিরা টম্বস্টোন শহরের উপর হানা দিতে লাগল, বহু মানুষের সম্পত্তি ও গোরু-ভেড়া লুণ্ঠিত হল–শান্তিপ্রিয় নাগরিক তো দূরের কথা, পিস্তলবাজ দুর্ধর্ষ গুন্ডারাও ক্ষিপ্ত অ্যাপাচিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল না। আগেই বলেছি কিশোর বয়সে জন স্লটার টেক্সাস রেঞ্জার্স নামক বাহিনীতে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, ওই সময়ে রেড ইন্ডিয়ানদের কম্যানচো জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে সে রেড ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধ পদ্ধতি শিখে গিয়েছিল। এইবার জেরোনিমোর বাহিনীর বিরুদ্ধে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগল।
কয়েকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে জেরোনিমো বুঝল, জন স্লটার অতিশয় বিপজ্জনক ব্যক্তি। স্লটারের নেতৃত্বে তার দলবল অ্যাপাচিদের মেক্সিকো পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল একাধিকবার। ওই লড়াই চলেছিল প্রায় এক বৎসরেরও বেশি। অবশেষে জেরোনিমোর আদেশে অ্যাপাচিরা স্লটারের এলাকা থেকে হাত গুটিয়ে নিল। বার বার মার খেয়ে জেরোনিমো বুঝেছিল, এ বড়ো কঠিন ঠাই!
জেরোনিমোর বিরুদ্ধে এমন সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল স্লটার যে, তার দিকে সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে জেরোনিমো যখন আত্মসমর্পণ করে, সেই সময় জন স্লটার ছিল জেনারেল মাইলের সঙ্গী।
স্লটারের কৃতিত্ব এইবার বহু মানুষের ঈর্ষার উদ্রেক করল। অব্যর্থ নিশানার জন্য যারা খ্যাতিলাভ করেছিল, সেই বন্ধুকবাজ মানুষগুলি এইবার স্লটারের উপর খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল। ডা. হলিডে নামে এক দন্ত চিকিৎসক সদম্ভে ঘোষণা করল, স্লটারকে সে শীঘ্রই হত্যা করবে। টম্বস্টোন শহরের মানুষ ওই ডাক্তারকে যমের মতোই ভয় করত–রিভলভার চালাতে সে ছিল অতিশয় দক্ষ এবং তার মতো ভয়ংকর খুনি সেই অরাজক যুগেও ছিল দুর্লভ।
স্লটার ও তার পত্নীর কানে এল ডা. হলিডের ভয়াবহ ঘোষণা। তা সত্ত্বেও একরাত্রে স্ত্রী ভায়োলোকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে স্লটার রওনা হল একটি নৃত্যঅনুষ্ঠানে যোগ দিতে। টম্বস্টোন শহরের খুব কাছেই ছিল ভায়োলার পিতার র্যাঞ্চ। অনুষ্ঠানের শেষে স্লটার তার শ্বশুরবাড়ির দিকে গাড়ি চালাল।
মেঘমুক্ত রাতের আকাশে ভাসছে পূর্ণচন্দ্র। পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল প্রতিফলনে জ্বলছে চাঁদের হাসি, তরল রজতধারার মতো। একটু আগেই শেষ-হয়ে-যাওয়া নাচের স্মৃতি, চাঁদনি রাত, স্বামীর সান্নিধ্য এবং পিতৃগৃহে সাদর অভ্যর্থনার সম্ভাবনা–সব কিছু মিলে ভায়োলার মনটা আজ ভারি খুশি, আর স্লটারের প্রাণেও লেগেছে সেই খুশির ছোঁয়া।
কিন্তু যতই আনন্দ হোক, সদা সতর্ক স্লটার এক মুহূর্তের জন্যও অসাবধান হয় না।
বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সে কোমরের রিভলভার হস্তগত করল, কারণ, তার কানে এসেছে ধাবমান অশ্বের খুরধ্বনি!
তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে একটা ঝোপের ভিতর থেকে মুক্ত প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করল ডা. হলিডে! ভায়োলা সভয়ে দেখল, ডাক্তারের ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে একটা রিভলভার!
ডাক্তারের ঘোড়া কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্লটারের অশ্বচালিত শকটের পাশে এসে পড়ল। মনে হল, ডাক্তার বুঝি এখনই গুলি ছুড়বে কিন্তু না, ঘোড়া আরোহীকে বহন করে সামনে এগিয়ে গেল, আরোহীর হাতের রিভলভার তবু অগ্নিবর্ষণ করল না।
ভায়োলা চেঁচিয়ে উঠল, জন! ওর হাতে রিভলভার!
শান্তস্বরে স্লটার বলল, জানি। আমার হাতেও একটা আছে।
ভায়োলা দেখল, তার স্বামীর হাতেও একটা রিভলভার রয়েছে বটে!
ডা. হলিডেও স্লটারের হাতের রিভলভার দেখেছে, আর দেখামাত্রই তার সংকল্পের পরিবর্তন ঘটেছে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে সে স্থানত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
টম্বস্টোন শহরের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। চারদিকে গুন্ডাদের অবাধ রাজত্ব। খুন, রাহাজানি, ডাকাতি লেগেই আছে। রাত্রিবেলা তো দূরের কথা, প্রকাশ্য দিবালোকেও ভদ্রলোকের ধনপ্রাণ নিরাপদ নয়। শেরিফ বেনহাম প্রাণপণ চেষ্টা করেও শহরের শান্তিরক্ষার কার্যে সফল হয়নি।
শহরের মানুষ তখন স্লটারকে শেরিফের পদে নির্বাচিত করল। নূতন শেরিফের কার্যকলাপে নাগরিকরা প্রথম প্রথম বিশেষ উৎসাহ বোধ করেনি। সত্যি কথা বলতে কী, তারা একটু হতাশ হয়েই পড়েছিল। কারণ, স্লটার অন্যান্য শেরিফের মতো চিৎকার করে শপথবাক্য উচ্চারণ করত না, অথবা বিরাট রক্ষীবাহিনী নিয়ে খুনির পিছনে তাড়া করার চেষ্টাও তার ছিল না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই টম্বস্টোমের মানুষ বুঝল, এই অরাজক শহরের শান্তিরক্ষা করতে হলে যে ধরনের মানুষ দরকার, ঠিক সেই ধরনের মানুষ হচ্ছে জন স্লটার। তাদের নির্বাচনে ভুল হয়নি কিছুমাত্র!
ঘোড়াচুরি বা ডাকাতির খবর পেলেই নিঃশব্দে ঘোড়ার পিঠে চেপে উধাও হয়ে যেত শেরিফ স্লটার। শহরের আশেপাশে পর্বতসংকুল অরণ্য ছিল সমাজবিরোধীদের প্রিয় বাসভূমি। কখনো কখনো সেই পর্বতবেষ্টিত বনভূমির ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত স্লটার… কয়েকদিন পরেই আবার শহরের রাজপথের ওপর শহরবাসীর চোখের সামনে ভেসে উঠত অশ্বারোহী স্লটারের ক্ষীণদেহ, তার সঙ্গে থাকত একটি বা দুটি জিন-লাগানো ঘোড়া, কিন্তু ওই ঘোড়াগুলির পিঠে কখনোই আরোহীর অস্তিত্ব থাকত না! শহরবাসী বুঝত, ঘোড়ার মালিকরা আর কোনোদিনই শহরের রাজপথ কলঙ্কিত করবে না–এক বা একাধিক দুবৃত্ত গুলি খেয়ে অরণ্যের ভিতরই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে, তাদের ঘোড়াগুলিকে নিয়ে এসেছে শেরিফ জন স্লটার!
অনেক সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত চালিয়ে অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করত শেরিফ স্লটার। উপযুক্ত প্রমাণ হাতে এলেই সে অপরাধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে দশ দিনের মধ্যে শহর ত্যাগ করার আদেশ দিত। অপরাধী জানত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শহর ছাড়তে রাজি না হলে তাকে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবে–অতএব সুবোধ বালকের মতোই সে শেরিফের আদেশ পালন করত নির্বিবাদে!
কোনো কোনো চিন্তাশীল নাগরিক কিন্তু স্লটারের কার্যকলাপ সমর্থন করতেন না। তারা বলতেন, স্লটারকে শেরিফের পদে নির্বাচিত করা হয়েছে, কিন্তু সে অবতীর্ণ হয়েছে একাধারে বিচারক, জুরি এবং ঘাতকের ভূমিকায়!
যে যাই বলুক, টম্বস্টোন শহরে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্লটারের চেষ্টায়। ১৯২২ সালে যখন জন স্লটারের মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স প্রায় বিরাশি।
[১৩৮৭]