নির্মোক নৃত্য
দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, তোমার মতলবটা কি উর্বশী? এই স্বর্গধামে তো পরম সুখে আছ, উত্তম বাসগৃহে সুন্দর প্রমোদকানন, মহার্ঘ বেশভূষা, প্রচুর বেতন, সবই তো ভোগ করছ। এসব ত্যাগ করে মর্ত্যলোকে যেতে চাও কেন? এখন রাজা পুরূরবা সেখানে নেই যে তোমাকে মাথায় করে রাখবেন। স্বর্গে তুমি চিরযৌবনা অনিন্দিতা সুরেন্দ্রবন্দিতা, কিন্তু মর্ত্যে গেলেই দু দিনে বুড়িয়ে যাবে, তখন যতই প্রসাধন লেপন কর তোমার দিকে কেউ ফিরে তাকাবে না।
উর্বশী নতমস্তকে বললেন, দেবরাজ, এখানে আমার অরুচি ধরেছে। সব পুরুষকেই আমি জয় করেছি, তাদের একঘেয়ে চাটুবাক্য আমার আর ভাল লাগে না। পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলে আমার অসংখ্য ভক্ত জুটবে, অর্থও প্রচুর পাব। জরার লক্ষণ দেখলে আবার না হয় এখানে চলে আসব।
—তোমার অত্যন্ত অহংকার হয়েছে দেখছি। এখানে তোমার আদরের অভাবটা কি?
—মানুষের কাছে ঢের বেশী আদর পাব। মর্ত্যের এক কবি লিখেছেন, ‘মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষপাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল।’ আমরাবতীর কোন কবি এমন লিখতে পারে?
—কবিরা বিস্তর মিছে কথা লেখে। যদি প্রমাণ করতে পার যে এখনাকার সব পুরুষকে তুমি জয় করেছ তবে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি। দেবর্ষি আর মহর্ষিদের কাবু করতে পার?
—তাঁরা তো সেই কবে কাবু হয়ে গেছেন।
—আচ্ছা, তোমাকে পরীক্ষা করব। দিব্য মানব জান? যাঁরা স্বর্গে মর্ত্যে অবাধে আনাগোনা করেন, যেমন সনৎকুমার সনাতন সনক সদানন্দ। এঁরা হলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। এঁদের ঘাঁটাতে চাই না, অত্যন্ত বদরাগী মুনি। তবে আরও তিন জন সম্প্রতি এখানে বেড়াতে এসেছেন, কুতুক, পর্বত আর কর্দম ঋষি। এঁরা বেশ শান্ত স্বভাব আর একেবারে নির্বিকার। এঁদের কাবু করতে পারবে?
—যদি পুরুষ হন তবে কাবু করতে পারব না কেন?
—শুধু পুরুষ নন, ওঁরা মহাপুরুষ।
—তবে ওঁদের মহাকাবু করব।
—উত্তম কথা। ওঁরা হলেন দেবর্ষি নারদের বন্ধু। নারদকে বলব তোমার নাচ দেখবার জন্যে আমার সভায় ওঁদের নিমন্ত্রণ করে আনবেন।
নারদের মুখে নিমন্ত্রণ পেয়ে তিন ঋষি প্রীত হলেন। বললেন, আমরা ময়ূরনৃত্য খঞ্জননৃত্য দেখেছি, বানর—ভল্লুকাদির নৃত্যও দেখেছি, কিন্তু নারীনৃত্য কখনও দেখি নি। দেখবার জন্য খুব কৌতূহল আছে। কিন্তু উর্বশী তো শুনেছি অপ্সরা, সে নারী বটে তো?
নারদ বললেন, এমন নারী যার জন্যে ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্তধারা।’ তার নৃত্য দেখলে তোমরা মুগ্ধ হবে। এখন ইন্দ্রসভায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।
পর্বত ঋষির দাড়ি গলা পর্যন্ত , কর্দমের বুক পর্যন্ত, আর কুতুক ঋষির হাঁটু পর্যন্ত। এঁরা যথাসাধ্য ভব্য বেশ ধারণ করে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলেন। পর্বত একটি বল্কল পরলেন, বল্কল না থাকায় কর্দম শুধু কৌপীন ধারণ করলেন। মহামুনি কুতুক একবারে সর্বত্যাগী নিষ্কিঞ্চন, তাঁর বল্কলও নেই কৌপীনও নেই, অগত্যা তিনি দিগম্বর হয়েই রইলেন। নারদ বললেন, ওহে কুতুক, অন্তত একটি তৃণগুচ্ছের মেখলা পরে নাও। কুতুক বললেন, কোনও প্রয়োজন নেই, আজানুলম্বিত শ্মশ্রুই আমার বসন।
নবাগত তিন ঋষিকে পাদ্য অর্ঘ্য আসন ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি সৎকার করে ইন্দ্র বললেন, হে মহাতেজা তপঃসিদ্ধ জিতেন্দ্রিয় মহর্ষিত্রয়, আমার মুখ্যা অপ্সরা উর্বশী আপনাদের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত একটি অভিনব নৃত্য দেখাবে—নির্মোক, নৃত্য, মর্ত্যলোকের প্রতীচ্যখণ্ডের ম্লেচ্ছগণ যাকে বলে স্ট্রিপ—টীজ। এখানে অগ্নি বায়ু বরুণ প্রভৃতি দেবগণ, নারদাদি দেবর্ষিগণ, অগস্ত্যতাদি মহর্ষিগণ সকলেই সমবেত হয়েছেন, মেনকা প্রভৃতি অপ্সরাও আছেন। আপনাদের আগমনে আমরা সকলেই কৃতার্থ হয়েছি। এখন অনুমতি দিন, উর্বশী নৃত্য আরম্ভ করুক।
আগন্তুক তিন ঋষির মুখপাত্র মহামুনি কুতুক বললেন, হাঁ হাঁ, বিলম্বে প্রয়োজন কি, আমরা নৃত্য দেখবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি।
লাস্যনৃত্যের উপযুক্ত বেশভূষার উপর একটি আলখাল্লা বা ঘেরাটোপ পরে উর্বশী ইন্দ্রসভায় প্রবেশ করলেন। সকলকে প্রণাম করে যুক্তকরে বললেন, হে মহাভাগ দেবগণ এবং অগ্নিকল্প ঋষিগণ, আমি যে নির্মোক নৃত্য দেখাব তাতে আমার দেহ ক্রমে ক্রমে অপাবৃত হবে। আপনাদের তাতে আপত্তি নেই তো?
কুতুক তাঁর মাথা আর বিপুল দাড়ি নেড়ে বললেন, আপত্তি কিসের? যাবতীয় জন্তুর ন্যায় তোমার দেহও পঞ্চভূতের সমষ্টি। তাঁর অভ্যন্তরে নারীসত্তা কোথায় আছে তাই আমরা দেখতে চাই।
উর্বশী পুনর্বার সবিনয়ে বললেন, আমার নৃত্যে যদি অসভ্য বা কুৎসিত কিছু দেখতে পান তো দয়া করে জানাবেন, তৎক্ষণাৎ আমি নৃত্য সংবরণ করব।
ঘেরাটোপ ফেলে দিয়ে উর্বশী তাঁর মণিমুক্তাস্বর্ণময় দৃষ্টি বিভ্রমকর উজ্জ্বল বেশ প্রকাশ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ নৃত্য করে তাঁর উত্তরীয় বা ওড়না খুলে ফেলে দিলেন।
পর্বত ঋষি হাত তুলে বললেন, উর্বশী, নিবৃত্ত হও, তোমার নৃত্যে শালীনতার অত্যন্ত অভাব দেখছি, এই চিত্তপীড়াকর নৃত্য আমরা দেখতে চাই না।
মহামুনি কুতুক ধমক দিয়ে বললেন, তোমার চিত্তপীড়া হয়েছে তো আমাদের কি? তুমি চক্ষু মুদ্রিত করে থাক, নৃত্য চলুক।
উর্বশী চুপি চুপি ইন্দ্রকে বললেন, দেবরাজ, পর্বত ঋষি কাবু হয়েছেন।
নৃত্য চলতে লাগল। পর্বত ঋষি দুই হাতে চোখ ঢাকলেন। কিন্তু কৌতূহল দমন করতে না পেরে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলেন।
ক্রমে ক্রমে উর্বশী তাঁর দেহের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত করলেন। তখন কর্দম ঋষি চোখ ঢেকে বললেন, উর্বশী, তোমার এই জুগুপ্সিত নৃত্য দেখলে আমাদের তপস্যা নষ্ট হবে, ক্ষান্ত হও।
কুতুক ভর্ৎসনা করে বললেন, কেন ক্ষান্ত হবে? তোমার সহ্য না হয় তো উঠে যাও এখান থেকে।
সহাস্য চক্ষুর ইঙ্গিতে উর্বশী ইন্দ্রকে জানালেন যে কর্দমও কাবু হয়েছেন।
তারপর উর্বশী ক্রমশ তাঁর সমস্ত আবরণ আর আভরণ খুলে ভূমিতে নিক্ষেপ করলেন এবং অবশেষে ‘কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি’ প্রকাশ করে পাষাণবিগ্রহবৎ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সভাস্থ দেবগণ দেবর্ষিগণ ও মহর্ষিগণ বললেন সাধু সাধু!
কুতুক বললেন, থামলে কেন উর্বশী, আরও নির্মোক ত্যাগ কর।
নারদ বললেন, আর নির্মোক কোথায়? উর্বশী তো সমস্তই মোচন করেছে।
কুতুক বললেন, ওই যে, ওর সর্বগাত্রে একটি পদ্মপলাশতুল্য শুভ্রারক্ত মসৃণ আবরণ রয়েছে।
—আরে ও তো ওর গায়ের চামড়া।
—ওটাও খুলে ফেলুক।
—পাগল হলে নাকি হে কুতুক? গায়ের চামড়া তো শরীরেরই অংশ, ও তো পরিচ্ছদ নয়।
—পরিচ্ছদ না হ’ক নির্মোক তো বটে। ওই খোলসটাও খুলে ফেলুক, নীচে কি আছে দেখব।
নারদ বললেন, কি আছে শোন। চর্মের নীচে আছে মেদ, আর নীচে মাংস, তার নীচে কংকাল।
—কিচ্ছু নেই।
—যার প্রভাবে ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্তধারা’ উর্বশীর সেই নারীত্ব কোথায় আছে?
—নারীত্ব আছে ওর বসনে, আভরণে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, ভাবভঙ্গীতে, আর অনুরাগী পুরুষের চিত্তে। তুমি তো বীতরাগ, চিত্ত পুড়িয়ে খেয়েছ, দেখবে কি করে?
মহামুনি কুতুক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমাকে প্রতারিত করবার জন্যে এখানে ডেকে এনেছ? এই উর্বশী একটা অন্তঃসারশূন্য জন্তু, ছাগদেহের সঙ্গে ওর দেহের প্রভেদ কি? ওহে পর্বত, ওহে কর্দম, চল আমরা যাই, এখানে দেখবার কিছু নেই।
উর্বশীর লাঞ্ছনা দেখে মেনকা ঘৃতাচী মিশ্রকেশী প্রভৃতি অপ্সরার দল আনন্দে করতালি দিলেন।
কুতুক পর্বত ও কর্দম সভা ত্যাগ করলে উর্বশী নতমুখে অশ্রুপাত করতে লাগলেন।
ইন্দ্র বললেন, উর্বশী শান্ত হও, নিরন্তর জয়লাভ কারও ভাগ্যে ঘটে না, আমিও বৃত্রাসুর কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলাম।
উর্বশী বললেন, একে কি পরাজয় বলে দেবরাজ? ওই কুতুক ঋষি একটা অপুরুষ অপদার্থ দগ্ধেন্দ্রিয় উন্মাদ, ওকে দিয়ে এই সভায় আমার এমন অপমান করিয়ে আপনার কি লাভ হল? আমি অমরাবতীতে থাকব না, মর্ত্যেও যাব না, তপশ্চর্যা করব।
অনন্তর উর্বশী মাথা মুড়োলেন, তুলসীমালা পরলেন, তিলকচর্চা করলেন, এবং নিত্যধাম গোলোকে গিয়ে হরিপাদপদ্মে আশ্রয় নিলেন।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)