তৃতীয় পরিচ্ছেদ — নির্মোকমুক্ত নিশাচর
অন্ধকার মেঠো পথে লম্বা লম্বা পা ফেলে যে-মানুষটা এগিয়ে চলেছে, তার মুখ দেখতে না-পেলেও চেনা মানুষের ভুল হওয়ার কথা নয়–
পথিকের পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র কণ্ঠস্বর। নীলে-এ এ, এই নীলে-এ-এ-এ!
আঃ, কী ঝামেলা, পথিক থমকে দাঁড়াল, এত চেঁচাচ্ছিস কেন বাঘা?
অন্ধকার পথের উপর এগিয়ে এল একটি ছায়ামূর্তি অর্থাৎ বাঘা
কর্তামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিস?
করেছি।
বেশ, বেশ। তা চাদর মুড়ি দিয়ে চলেছিস কোথায়?… আরে! তোর হাতে একটা থলে রয়েছে না! দেখি তো কীসের থলে?
বাঘা, নিজের চরকায় তেল দে। এদিকে হাত বাড়াবি না।
কী এত বড়ো কথা! বাঘা এগিয়ে এসে নীলকণ্ঠের থলি সমেত ডান হাত সজোরে চেপে ধরল, দেখি, তোর থলেতে কী আছে?
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল নীলকণ্ঠ। তার বাঁ-হাত তলোয়ারের মতো কোপ মারল বাঘার ঘাড়ে। অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ল বাঘা। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে সে বসেই রইল, তারপর সন্তর্পণে ঘাড়টা মালিশ করতে লাগল…
থলিটা মাটিতে নামিয়ে কঠিন স্বরে নীলকণ্ঠ বলল, উঠে আয় বাঘা। আজ দেখব তুই কেমন মায়ের দুধ খেয়েছিস।
বাঘা ওঠার চেষ্টা করল না, শুধু মাথা নাড়ল, ক্ষ্যামা দে নীলে। উরে বাপ–আমার মাথা ঘুরছে, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
খুব লেগেছে? নীলকণ্ঠের গলায় ক্রোধের আভাস ছিল না, মালিশ করে দিচ্ছি, এখনই ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ মালিশ করার পর বাঘা বলল, ছেড়ে দে নীলে। এখন ভালো লাগছে। আর মালিশের দরকার নেই।
বড় জোরে লেগে গেছে। রাগ একবার উঠলে আমার জ্ঞান থাকে না বাঘা। কিছু মনে করিস না রে।
আরে দুৎ, মরদের ইজ্জত মরদেই বোঝে। আজ বুঝলাম তুই বাপের বেটা। তাই তো বলি বদন সর্দারের বেটা এমন মেয়েমানুযের অধম হয় কেমন করে!
ওরে বাঘা গান গাইলে, বাঁশি বাজালে মানুষ না-মরদ হয় না; এ-কথাটা তোরা বুঝবি না, কিন্তু তোদের চেয়ে অনেক বড়ো মরদ আমার বাপ বুঝেছিল, একটু থেমে নীলকণ্ঠ আবার বলল, আজ থেকে দশ বছর আগেকার কথা হয়তো তোর মনে আছে
বাধা দিয়ে বাঘা বলল, মনে আছে, তোর বাপ বদন সর্দার নিজে দাঁড়িয়ে তোকে তালিম দিত। তবে মাঝে মাঝে
হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমার মাথায় খুন চড়ে যেত। একদিন বাবা ভীষণ চটে গেল। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, ছোরা খেলতে খেলতে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম খেলুড়ের পেটের দিকে অস্ত্রটাকে চালিয়ে দিলাম। সেটা লাগলে বেচারা গণেশের সেইদিনই জান নিয়ে টানাটানি পড়ত–কিন্তু বাবা হঠাৎ লাফিয়ে এসে আমার হাতে মারল এক দারুণ রদ্দা। ছোরাটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল না বটে, কিন্তু আমার হাত হয়ে গেল অসাড়। এক ধমক দিয়ে বাপ বলল, নীলে, এটা কি কাজিয়া হচ্ছে? তুই কি মানুষ খুন করতে চাস? এর আগে চারটে জোয়ান তোর হাতে চোট হয়েছে। এবার থেকে তুই আমার সাথে খেলবি। তারপর থেকে সবার চোখের আড়ালে বাব আমায় তালিম দিতে লাগল–কখনো ছোরাছুরি, কখনো লাঠি-সড়কি, কখনো-বা হাতাহাতি। লড়াই।
বাধা দিয়ে বাঘা বলল, তোকে তালিম দিয়েছিল বটে বদন সর্দার। আমার ঘাড়টা এখনও টনটন করছে। যাকগে–তারপর?
নীলকণ্ঠ আবার বলতে শুরু। করল, লাঠি ছোরা চালালেও আমার গান-বাজনার দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল। বাপের ভয়ে লুকিয়ে গান গাইতাম। যাত্রা শুনতে গিয়ে গানগুলো মনে মনে তুলে নিতাম। তার পর আড়ালে-আবডালে সেগুলোর সুর ভঁজতাম। একদিন নির্জন বনের ধারে গান ধরেছি আর কোথা থেকে হঠাৎ সামনে এসে পড়েছে বাবা! আমি তো চমকে গান থামিয়ে দিয়েছি আর ভাবছি এই বুঝি পড়ল এক থাপ্পড় আমার গালে–কিন্তু না, বাপ কিছুই বলল না, চুপ করে চলে গেল সেখান থেকে। আর একদিন সন্ধের সময় বনের ধারে বাঁশি বাজাচ্ছি, এমন সময় সেদিনও হঠাৎ গাছের ফাঁকে ফাঁকে লম্বা পা, ফেলে বাপ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। আগের দিন বলেনি দেখে আমার ভয় ভেঙে গিয়েছিল, বললাম, আমি ইয়ে-মানে-এখনই যাচ্ছি বাবা। বাবা কোনো কথা না-বলে পিছন ফিরে হাঁটা দিল, চলতে চলতেই বলল, তোকে আজ লাঠি নিয়ে রেয়াজ করতে হবে না, তুই যা করছিস তা-ইকর।এবার আমার সাহস বেড়ে গেল, সবার চোখের সামনেই গোঁসাইজির কাছে গান-বাজনা শিখতে শুরু করলাম। একদিন দুপুরে গোঁসাইজির ঘরে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি, হঠাৎ গোয়ালাদের গোবিন্দ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ওরে নীলে, তুই এখানে বাঁশি বাজাচ্ছিস? আমি সারাপাড়া তোকে গোরু-খোঁজা খুঁজছি–শেষে বামুনদিদিবললে তুই এখানে আছিস, তাই ছুট্টে এনু। ছেলেটা তখনও হাঁপাচ্ছিল। গোসাইজি বললেন, কী হয়েছে গোবিন্দ? গোবিন্দ বলল, সর্বনাশ হয়েছে। নীলের বাপ বদন সর্দারকে কে যেন চোট করেছে। সর্দারকে দেখে এলাম ভিন-গাঁয়ের পথে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে রয়েছে। আমায় দেখে বলল, ছুট্টে যা গোবিন, নীলুকে খবর দে। আমি আর । বাঁচব না, ছেলেটাকে একবার দেখে যেতে চাই। চ নীলু, পা চালিয়ে চল। প্রথমে ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পারিনি, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল–তারপর লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে ছুটলাম গোবিন্দর সঙ্গে। ভিন-গাঁয়ের পথে একটা ঝোপের ধারে পেলাম বাবাকে; রক্তে মাখামাখি অবস্থা। আমায় দেখে বাবা বলল, কে যেন ঝোপের ভিতর থেকে সড়কি ছুঁড়েছে। কোনোমতে সেটাকে পাঁজর থেকে টানাটানি করে বার করলাম বটে, কিন্তু তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেলাম! জ্ঞান ফিরে আসতে ওঠার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। চোখের সামনে সব কিছু তখন অন্ধকার হয়ে আসছে, বুঝলাম বাঁচব না…হঠাৎ দেখলাম গোবিন্দকে পাশের পুকুর থেকেই বোধ হয় জল এনে আমার মুখে মাথায় ঝাঁপটা দিচ্ছে আর ডাকাডাকি করছে। বললাম, ছুটে যা, নীলেকে খবর দে, মরার আগে তাকে একবার দেখতে চাই।
আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। বাপ বলল, কাদিস না নীলে। জন্মালে মরতেই হবে, দুঃখ করিস না। তবে সারাজীবন শুধু খুনখারাপি করে গেলাম এই কথাটাই মরণকালে মনে হচ্ছে। শোন বাবা, তোর গলায় সুর আছে, হাতের বাঁশিতে আছে জাদুর ছোঁয়া–এই খুনোখুনি আর রক্তারক্তির নেশায় তুই আর হাত লাল করিস না আর, আর আমাদের কত্তামশা রইলেন, ওঁকে আমার মতোই মানবি…।
বাপের শেষ কথা মেনে নিয়েছিলাম, তোদের টিটকারি, গালাগালি সব সহ্য করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্তামশাই আমার হাতে টাকার থলি ধরিয়ে দিলেন, হুকুম হল দেবী চৌধুরানির হাতে ওই টাকা তুলে দিতে হবে। তাই যাচ্ছি ঠ্যাঙাড়ের মাঠে লুঠেরার হাতে টাকা তুলে দিতে।
বলিস কী রে? বাঘার মস্ত গোঁফজোড়ার তলায় দাঁতগুলো একবার অন্ধকারেও ঝিকমিক করে উঠল, বদন সর্দার মারা গেছে, তা বলে ভুবনডাঙা গাঁয়ে কি আর মরদ নেই? নীলে, তুই বর্দন সর্দারের বেটা, আমি তার শাগরেদ চল, দুজনে একবার লাঠি ধরি, দেখি দেবী চৌধুরানির দলে কয়টা জোয়ান আছে?
না রে বাঘা। বাপের মরণকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কর্তামশাইকে কোনোদিন অমান্য করব না। সে-কথা আমায় রাখতেই হবে। তার হুকুমমতো টাকা তুলে দিতে হবে লুঠেরার হাতে। বাঘা রে, এমন না-মরদের কাজ করতে তোকে সঙ্গে নেব না, আমি একাই যাব।
টাকার থলিটা মাটি থেকে তুলে নিল নীলকণ্ঠ, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে… কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে…
তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে বাঘা আপনমনেই বলল, বাপের কথায় রামচন্দ্র রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়েছিল বলে লোক তাকে বাহবা দেয়। সেটা এমন কী কঠিন কাজ? মরদের কাছে তার ইজ্জতের দাম রাজত্বের চাইতে অনেক বেশি। কথায় বলে জান দোব তো মান দোবনি। নীলু রে! সেই মান, সেই ইজ্জত তুই বিকিয়ে দিচ্ছিস বাপের কথায়, কিন্তু সেইজন্য কেউ তোকে বাহবা দেবে না। তবে আমিও সাচ্চা মরদ, তোর ব্যথা আমি বুঝি। আমি বুঝতে পারছি তোর বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমারও তো কিছু করার নেই…