বর্তমান দুনিয়ায় যেমন বহু জাতি বা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বাস করে, আদিকালেও তেমন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যাসভ্য বহু জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করিত এবং সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে উহাদের মতামতও ছিল বহুবিধ। প্রত্যেক দলের মানুষই তাহাদের আপন দলীয় মতকে মনে করিত সনাতন মত এবং উহা আজও করিয়া থাকে। অথচ উহাদের অনেকেই আপন দলীয় মতের বাহিরে অন্যদের মতবাদের কোনো খবর রাখিতে চাহেন না অথবা রাখিলেও তাহাতে গুরুত্ব দেন না। বলা বাহুল্য যে, সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে পৃথিবীতে যত রকম মতবাদ প্রচলিত আছে, নিশ্চয়ই তত রকম ভাবে কোনো কিছুর সৃষ্টি হয় নাই, সৃষ্টি হইয়াছে একই রকম ভাবে। কিন্তু কোন্ রকম? সাম্প্রদায়িক মনোভাব লইয়া কোনো ব্যক্তির পক্ষেই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নহে। পক্ষান্তরে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায় নিরপেক্ষ মানুষ পাওয়া কঠিন। এমতাবস্থায় বিভিন্ন মতবাদ সম্বন্ধে কিছু কিছু ওয়াকেফহাল হইয়া তত্ত্বানুসন্ধানী ব্যক্তিগণ যাহাতে একটি স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন, তজ্জন্য এই পুস্তকের প্রথম দিকে জগত ও জীবন সৃষ্টির বিষয়ে আদিম মানবদের সৃষ্টিতত্ত্ব, ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব, দার্শনিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্বের সারাংশ সন্নিবেশিত হইল।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধু যে জগত ও জীবন সৃষ্টির বিষয়েই মতভেদ আছে তাহাই নহে, মতভেদ মানব সমাজের আচার-অনুষ্ঠান, ধর্ম, রীতি-নীতি, সংস্কার-কুসংস্কার ইত্যাদিতেও। তাই মানব সমাজের কতিপয় সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির উৎপত্তি সম্বন্ধেও কিছু কিছু বিবরণ দেওয়া হইল এই পুস্তকখানির শেষের দিকে।
মানুষের জাতিগত জীবন ব্যক্তিজীবনেরই অনুরূপ। ব্যক্তিজীবনে যেমন শৈশব, বাল্য, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য আছে, জাতিগত জীবনেও তেমন শৈশব, বাল্য, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য আছে। তবে জাতিগত জীবনের এখন সবেমাত্র যৌবনকাল, বার্ধক্য বহুদূরে। শৈশব ও বাল্যে মানুষ থাকে অনুকরণশীল ও অনুসরণশীল এবং কতকটা কৈশোরেও। সরলমনা শিশুরা বিশ্বাস করে তাহাদের মাতা, পিতা বা গুরুজনের কথিত জ্বীন-পরী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব ইত্যাদি সম্বন্ধে কল্পিত কাহিনীগুলি এবং নানাবিধ রূপকথা, উপকথা ও অতিকথা। শিশুমনে ঐগুলি এমনই গভীরভাবে দাগ কাটে যে, বার্ধক্যেও অনেকের মন হইতে উহা বিলীন হইতে চাহে না। এই জাতীয় বিশ্বাস অর্থাৎ যে সমস্ত কাহিনীর বিষয়সমূহে ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো প্রমাণ নাই অথবা কার্যকারণ সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়াস নাই, এক কথায় যুক্তি যেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, এইরূপ কাহিনীতে বিশ্বাস রাখার নামই অন্ধবিশ্বাস। অনুরূপভাবে মানুষের জাতিগত জীবনের বাল্যকালে তৎকালীন মোড়ল বা সমাজপতিগণ নানাবিধ হিতোপদেশের সহিত বহু রূপকথা, উপকথা ও অতিকথা যুক্ত করিয়া পরিবেশন করিয়াছিলেন এবং সাধারণ মানুষ তাহা তৃপ্তিসহকারে গলাধঃকরণ করিয়াছিল এবং উহার ফলে মানুষের জীবন। হইয়াছিল অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত। আর উহা কৌলিক ব্যাধির ন্যায় বংশপরম্পরায় চলিয়া আসিতেছে হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া। এইরূপ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অন্ধবিশ্বাসকে বলা হয় কুসংস্কার। দুঃখের বিষয়, মানুষের জাতিগত জীবনের যৌবনে বিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানের যুগেও বহু লোক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের গভীর সমুদ্রে ডুবিয়া রহিয়াছে।
মানব সমাজে কুসংস্কারের বীজ উপ্ত হইয়াছিল হাজার হাজার বৎসর পূর্বে। এখন উহা প্রকাণ্ড মহীরূহের আকার ধারণপূর্বক অসংখ্য শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিয়া এবং ফুলে-ফলে সুশোভিত হইয়া বিস্তীর্ণ জনপদ আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে। আর তাহারই ছায়াতলে কালাতিপাত করিতেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
অতীতে বহু মনীষী কুসংস্কাররূপী মহীরূহের মূলে যুক্তিবাদের কুঠারাঘাত করিয়া গিয়াছেন, যাহার ফলে বহু মানুষ উহার ছায়াতল হইতে বাহির হইয়া দাঁড়াইয়াছে মুক্তমনের খোলা মাঠে আর তরুণ-তরুণীরা ভিড় জমাইতেছে দর্শন-বিজ্ঞানের পুস্পোদ্যানে।
এই পুস্তকখানির আদান্ত অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করিলে সুধী পাঠকবৃন্দ বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে মানবমনের ধারাবাহিক চিন্তা, গবেষণা ও সর্বশেষ যুক্তিসম্মত মতবাদের বিষয় জানিতে পারিবেন।
এই পুস্তকখানি প্রণয়নে প্রণেতা হিসাবে তত্ত্বমূলক অবদান আমার কিছুই নাই। তত্ত্ব যাহা পরিবেশিত হইয়াছে তাহা সমস্তই সংকলন, আমি উহার সংগ্রাহক মাত্র। ইহা প্রণয়নে আমি যে সমস্ত গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছি, তাহার গ্রন্থকারগণের নিকট আমি চিরঋণে আবদ্ধ।
এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপিখানা বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় কাজী গোলাম কাদির সাহেব ও মাননীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক সাহেব তাহাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করিয়া পরম ধৈর্যসহকারে পাঠ করিয়া উহা সংশোধনের প্রয়াস পাইয়াছেন এবং ইহার প্রুফ সংশোধনে সহায়তা করিয়াছেন মাননীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাহেব। বাংলা একডেমীর প্রাক্তন মহাপরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের চেয়ারম্যান মাননীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাহেব দয়াপরবশ হইয়া পাণ্ডুলিপিখানা পাঠ করিয়া কতিপয় ভ্রম সংশোধনের ইঙ্গিত দান করিয়াছেন। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ও আবুজর গিফারী কলেজ (ঢাকা)-এর অধ্যক্ষ জনাব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাহার নানারূপ অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই পুস্তকখানার ভূমিকা লিখিয়া ইহার মর্যাদাবৃদ্ধি করিয়াছেন। এই সমস্ত বিদগ্ধজনের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ।
এই পুস্তকখানার রচনাকাল ১৯. ৪. ১৩৭২ হইতে ২৫. ৪. ১৩৭৭, কিন্তু মুদ্রণকাল মাঘ, ১৩৮৪। এই সময়ের মধ্যে দেশ তথা সমাজে নানারূপ উত্থান-পতন ও ভাগা-গড়া ঘটিয়াছে আর বিজ্ঞান জগতে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটিয়াছে বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কারের ফলে। তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যক হইয়াছিল এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপিখানার কিছু কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের। আর সেই সংশোধনের বিরক্তিকর ঝামেলার বেশির ভাগই ভোগ করিতে হইয়াছে। প্রেস কর্তৃপক্ষকে। ইহাতে প্রেস কর্তৃপক্ষ মো. তাজুল ইসলাম সাহেব ও তাহার কর্মচারীবৃন্দের উদারতা ও সহিষ্ণুতা আমাকে বিমুগ্ধ করিয়াছে।
নানা কারণে এই পুস্তকখানিতে এমন কতগুলি ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকিয়া গেল, যাহা শুদ্ধিপত্র দ্বারাও দূর করা দুষ্কর। ইহার জন্য প্রিয় পাঠকবৃন্দের নিকট আমার ক্ষমা প্রার্থনা ভিন্ন আর কোনো উপায় নাই।
বিনীত
আরজ আলী মাতুব্বর
লামচরি
১১ আষাঢ় ১৩৮৪