নিধিরামের নির্বন্ধ
নিধিরাম সরকার ভেবে ভেবেই মারা গেলেন। তাঁর শারীরিক ব্যাধি বা আর্থিক অভাব ছিল না, সাংসারিক শোক তাপও তিনি পান নি, তবু দুর্ভাবনায় তাঁর জীবনান্ত হল।
নিধিরাম সচ্চরিত্র বুদ্ধিমান দেশহিতৈষী লোক, কিন্তু অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। তাঁর মনে নিরন্তর সংশয় উঠত—সুরেন বাঁড়ুজ্যে না বিপিন পাল, বেঙ্গলী না ইংলিশম্যান—কার উপদেশ ভাল? গান্ধীজী না দেশবন্ধু, নেতাজী না পণ্ডিতজী—কার মতে চলা উচিত? কংগ্রেস, হিন্দুমহাসভা, কমিউনিস্ট আর সমাজতন্ত্রী দল কোনওটাই তাঁর পছন্দ হয় নি। দেশের হিতার্থে তিনি বক্তৃতা দেন নি, ছেলে খেপান নি, ডাকাতি করেন নি, সুতো কাটেন নি, জেলে যান নি, শুধু মনে মনে মঙ্গলের পথ খুঁজেছেন। অবশেষে নৈরাশ্য আর চিন্তাবিষে জর্জর হয়ে দেহত্যাগ করলেন। তাঁর এক শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু বললেন, মরবেই তো, সংশয়াত্মা বিনশ্যতি। আর এক ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু বললেন, কেয়ার কিলড এ ক্যাট।
নিধিরাম পরলোকে এলে বিধাতা তাঁকে বললেন, বৎস, তুমি সন্দেহাকুল কর্মবিমুখ হলেও তোমার চরিত্রটি প্রায় নিষ্পাপ ছিল, তাই এই আনন্দলোকে এসেছ। কি আনন্দ ভোগ করতে চাও তা বল।
নিধিরাম উত্তর দিলেন, ভগবান, আনন্দ চাই না। পৃথিবী অধঃপাতে যাচ্ছে, যাতে রক্ষা পায় তাই করুন।
বিধাতা বললেন, তুমি দেখছি মরে গিয়েও ভববন্ধনে জড়িয়ে আছ। ওহে নিধিরাম, পৃথিবী নেই, তোমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়েছে। শুধু আমি আছি, এবং আমিই তুমি।
—প্রভু, সলিপসিজম আর অদ্বৈতবাদ আমার বুদ্ধির অগম্য। আমি মরে গেলেও জগৎ থাকবে না কেন? সমস্ত পৃথিবীর ভাল যদি নাও করেন তবে অন্তত ভারতের যাতে ভাল হয় তাই করুন।
—ভালই তো চিরকাল করে আসছি।
—তার লক্ষণ তো কিছুই দেখছি না, যা করে থাকেন তা শুধু লীলাখেলা।
—ও, আমার লীলাখেলা তোমার পছন্দ নয়, তোমার ফরমাশী খেলা চাও? ‘নিত্য তুমি খেল যাহা, নিত্য ভাল নহে তাহা, আমি যে খেলিতে কহি সে খেলা খেলাও হে।’—এই তোমার আবদার? বেশ, তোমার দেশের কিরকম ভাল চাও তাই বল।
—মানুষ ভাল না হলে দেশের ভাল হবে না। আপনি দেশের অন্তত সিকি লোককে ভাল করে দিন, তারাই বাকী সবাইকে শোধরাতে পারবে।
—আচ্ছা, চৈতন্য মহাপ্রভু আর রামকৃষ্ণ পরমহংসকে ভাল লোক মনে কর তো?
কপালে যুক্তকর ঠেকিয়ে নিধিরাম বললেন, ওঁরা অবতার কি না জানি না, তবে মহাপুরুষ তাতে সন্দেহ নেই।
—ভারতের সিকি লোক মানে ন কোটি। যদি ন কোটি ভারতবাসী শ্রীচৈতন্য বা শ্রীরামকৃষ্ণের তুল্য হয়ে যায়, তা হলে তোমার মনস্কাম পূর্ণ হবে তো?
মাথা চুলকে নিধিরাম বললেন, ভগবান, ওঁরা যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। দেশের চার আনা লোক যদি বিরাগী ভক্ত হয়ে যায় আর বাকী বারো আনা তাদের অনুসরণ করে তবে সংসার যে ছারখারে যাবে। আমাদের দরকার কর্মী বুদ্ধিমান জনহিতৈষী সংসারী সৎপুরুষ। ত্যাগী ভক্ত সন্ন্যাসী গুটিকতক হলেই চলবে।
—উত্তম কথা। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি ছিলেন না, তুমি যে সব গুণ চাচ্ছ তাও তাঁর প্রচুর ছিল। যদি ভারতের ন কোটি লোক রবীন্দ্রনাথের তুল্য হয়ে যায় তা হলে খুশী হবে তো?
নিধিরাম আবার নমস্কার করে বললেন, প্রভু, পাঁচ শ বৎসরে যদি একটি রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব হয় তাতেই দেশ ধন্য হবে। কিন্তু যদি বিস্তর আসেন তবে আদি রবীন্দ্রনাথের মাহাত্ম্য যে খর্ব হবে, তাঁকে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
—আচ্ছা, যদি ন কোটি মহাত্মা গান্ধীর মতন কর্মী জনহিতৈষীর আগমন হয়?
—একই আপত্তি প্রভু। মহাত্মা গান্ধীকেও সস্তা করতে চাই না। আমাদের দেশ অসাধু অকর্মণ্য চোর ঘুষখোর বজ্জাত লোকে ভরে গেছে, তাদের পরিবর্তে দরকার সচ্চরিত্র সাধারণ কাজের মানুষ। লোকোত্তর পুরুষ খুব কম হলেই চলবে।
—বুঝেছি, লোকোত্তর পুরুষের ইনফ্লেশন চাও না। আচ্ছা, যদি দেশের সিকি লোক জওহরলালের মতন হয়ে যায় তা হলে চলবে তো?
একটু ভেবে নিধিরাম বললেন, নেহেরুজী জ্ঞানী কর্মী দূরদর্শী জনহিতৈষী সৎপুরুষ তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের সমস্ত মন্ত্রী আর সরকারি অফিসের কর্তারা যদি তাঁর মতন হয়ে যায় তা হলে দেশের অশেষ মঙ্গল হবে। কিন্তু সে রকম ন কোটি লোকের কাজই দেশে নেই, তাঁদের দিয়ে তো মোটা কাজ করানো চলবে না।
—আচ্ছা যদি ন কোটি উদযোগী কর্মবীর ধনপতির আবির্ভাব হয় তা হলেতোমার আশা মিটবে?
—আপনি পরিহাস করছেন প্রভু। ন কোটি ব্যবসাদার কর্মবীরের স্থান কোথায়? কার ধন নিয়ে তাঁরা ধনপতি হবেন? অরণ্যের চার আনা পশু যদি বাঘ হয় আর বাকী বারো আনা যদি হরিণ হয়, তবে আগে হরিণরা লোপ পাবে তার পর বাঘরা না খেয়ে মরবে। আমার নিবেদনটি শুনুন। ন কোটি মুক্তাত্মা সন্ন্যাসী, বা ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, বা রাজনীতিজ্ঞ সুশাসক হলে চলবে না। আর ন কোটি ব্যবসায়ী তো উপদ্রব স্বরূপ। নানারকম সাধারণ সচ্চরিত্র কর্মীরই দরকার—চাষী কারিগর শিল্পী বাস্তুকার যন্ত্রী বিজ্ঞানী শিক্ষক বিচারক পরিচালক কেরানী ইত্যাদি। তা ছাড়া অল্প গুটিকতক কলাবিৎ অর্থাৎ লিখিয়ে আঁকিয়ে গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়েও চাই। লোকোত্তর পুরুষ কোটিতে এক—আধটি হলেই ঢের।
—তুমি যে রকম চাচ্ছ সেরকম কাজের লোক তো দেশে আছেই।
—কিন্তু তাদের মধ্যে যে বিস্তর মূর্খ আর দুর্বৃত্ত লোক আছে, তারাই মঙ্গল হতে দিচ্ছে না।
—ওহে নিধিরাম, ব্যস্ত হয়ো না। তোমার দেশে যত মূর্খ আর দুর্বৃত্ত আছে তারা খেয়োখেয়ি মারামারি করে আপনিই ধ্বংস হয়ে যাবে, তার পর কালক্রমে সুবুদ্ধি সৎপুরুষের আবির্ভাব হবে।
—তবেই হয়েছে। আপনি অনন্তকাল এক্সপেরিমেণ্ট করতে পারেন, কিন্তু দেশের লোকের অত ধৈর্য নেই, তারা নানা দলে বিভক্ত হয়ে ছিন্ন ভিন্ন ভাল মন্দ উপায় খুঁজছে। আপনি ইচ্ছা করলেই তাদের সুপথে চালাতে পারেন।
—আমার ইচ্ছা—অনিচ্ছা নেই। সৃষ্টি স্থিতি আর লয় ঘড়ির কাঁটার মতন যথানিয়মে হচ্ছে, জাগতিক ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করি না।
—ভগবান, বেশী কিছু তো চাচ্ছি না, লোকে যাতে অংসযমী উচ্ছৃঙ্খল আর সমাজদ্রোহী না হয় সেই ব্যবস্থা করুন।
—দেখ নিধিরাম, সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার উদ্দেশ্যে তোমার দেশে চাতুর্বর্ণ্য স্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু এখন তার পরিণাম কি হয়েছে দেখছ তো? তুমি যে রকম চাচ্ছ তা পাবে ইতর প্রাণীর মধ্যে, তারা কখনও স্বজাতির ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয় না। কিন্তু মানুষ চিরকালই মতলবে চলে।
—প্রভু, যদি একজন জবরদস্ত অবতার পাঠিয়ে দেন তবে তিনি তো অবলীলাক্রমে সাধুদের পরিত্রাণ দুষ্কৃতদের বিনাশ আর ধর্মসংস্থাপন করতে পারবেন।
—তুমি কি মনে কর সিভিলিয়ানদের মতন একদল অবতার আমি পুষে রেখেছি আর তোমাদের দরকার হলেই পাঠাব? মানুষ মাত্রেই অবতার, কেউ কম কেউ বেশী। জনসমাজের অল্পাধিক মঙ্গল যে করতে পারে সেই অবতার। তোমারও সেই শক্তি আছে। যদি ইচ্ছা কর তুমি আবার জন্মগ্রহণ করে তোমার জাতভাইদের উদ্ধারের চেষ্টা করতে পার।
—আমার কতটুকু ক্ষমতা প্রভু? আমার কথা শুনবেই বা কে?
—বুড়োরা না শুনুক, তারা আর কদিনই বা বাঁচবে। ছেলেরা শুনতে পারে, তারা এখনও ঝানু হয়ে যায় নি।
—হা ভগবান, আপনি দেখছি কোনও খবরই রাখেন না।
—শোনো নিধিরাম। ছেলেরা বুড়োদের কথা না শুনুক, সমবয়সীদের কথা শুনতে পারে। তুমি পৃথিবীতে ফিরে যাও, জাতিস্মর না হলেও তোমার সদিচ্ছার সংস্কার থাকবে। বালক কিশোর আর যুবকদের তুমি সুমন্ত্রণা দিও।
—আমি একটি মন্ত্রণাই জানি— আগে বিনয় ও শিক্ষা তারপর কর্মপথ।
—বেশ তো, ওই মন্ত্রণাই দিও।
—আমার কথায় কেউ যদি কান না দেয়?
—তোমার চাইতে যাঁরা ঢের বড় অবতার তাঁদের কথাও সকলে শোনে নি। তুমি যথাসাধ্য চেষ্টা ক’রো, তাতেই তোমার জন্ম সার্থক হবে। এক বারে কিছু করতে না পারলে বার বার অবতরণ ক’রো। যদি অনন্তকালেও কিছু করতে না পার তা হলেও বিশ্ব—ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষতি হবে না।
১৩৬২ (১৯৫৫)