নিখোঁজ যাত্রী – ৮

আট

‘তুমিই বোধহয় ঠিক, কিশোর,’ বলল রবিন, এখনও একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ছবি দুটোর দিকে। ‘মিস্টার প্রাইস আর মিস্টার হলকে মোটেই একে অন্যের শত্রু মনে হচ্ছে না।’

‘খাইছে, আর আমি একটা কথা ভাবছিলাম,’ বলল মুসা।. ‘মিস্টার প্রাইসের প্রথম দিককার বই পাহাড়ে নিখোঁজ-এর কথা মনে আছে?’

‘বইটা দুর্দান্ত!’ প্রশংসা ঝরল ডনের কণ্ঠে।

‘নিঃসন্দেহে,’ সায় জানাল মুসা। ‘উৎসর্গ পাতায় মিস্টার প্রাইস লিখেছিলেন, ‘এ বইটা ওয়েস বাছাধনের জন্যে।’ ওয়েস বাছাধন যদি ওয়েসলি হল হন? নাম তো মিলে যাচ্ছে।

‘এবং উপন্যাসের এক চরিত্রের নাম ছিল ওয়ার্ডসলি টল, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘হ্যাঁ, তাই,’ জবাব দিল কিশোর। ‘মিস্টার প্রাইস নির্ঘাত ওয়েসলি হলের সম্মানেই তাঁর চরিত্রের নামটা রাখেন। দুটো নামই খুব কাছাকাছি।’

মাথা ঝাঁকাচ্ছিল রবিন।

‘আমাদের এখন কোথায় যেতে হবে সেটা পরিষ্কার।

‘যা বলেছ,’ জবাব দিল কিশোর। ‘একদম পানির মত।’

সুসান লাঞ্চ বিরতির সময় খুশি মনে ছেলেদেরকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিল ওয়েসলি হলের বাসায়। আঁকাবাঁকা মেটে গাড়িপথ ধরে এগোচ্ছে, বাড়িটা চোখে পড়তেই ছেলেরা থ বনে গেল।

‘আমি যা ভাবছি তোমরাও কি তা-ই ভাবছ?’ রবিন শুধাল।

‘সম্ভবত,’ বলল মুসা।

ওয়েসলি হলের বাসস্থানটি নিঃসন্দেহে পুরানো এক বার্ন। সাদা রঙের বাড়িটার কিনারাগুলো দিয়ে আদি লাল রং উঁকি মারছে। আর জানালাগুলোর দু’পাশের সবকটা খড়খড়ির রং কালো।

‘ঠিক যেমনটা আমরা আর্টিকটায় পড়েছিলাম,’ বলল কিশোর

হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল মুসা।

‘মিস্টার প্রাইস এখানেই মাঝেমধ্যে লেখালেখি করতে আসেন। এটাই তাঁর গোপন আস্তানা!’

‘যাকে বলে দোস্ত-দুশমন!’ ঠাট্টা করে বলল কিশোর। এক সময়ের সুপারহিট বাংলা ছায়াছবিটির নাম মনে পড়ে গেছে ওর।

সামনের ধাপে দাঁড়িয়ে, ঘণ্টি বাজিয়ে অপেক্ষায় রইল ওরা। মুহূর্ত পরে, মস্ত দরজাটা পেছনে সশব্দে খুলে গেল এবং কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল বিশালদেহী এক বয়স্কা মহিলাকে।

‘কী চাই?’

‘সরি,’ শুরু করল রবিন, ‘মিস্টার ওয়েসলি হল কি বাসায় আছেন?

‘না, কাল সকাল থেকে তিনি বাইরে। তোমরা কারা?’

নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর।

‘আমরা ওঁর এক বন্ধুর খোঁজ করছি। তাঁর নাম উইলার্ড প্রাইস।’

‘ও, হ্যাঁ, উইলার্ড। উনি খানিক আগেও এখানে ছিলেন। আমি লরা, মিস্টার ওয়েসলি হলের হাউসকিপার।’

‘ও, আচ্ছা, বলল কিশোর। ‘মিস্টার প্রাইসের সাথে আমরা দেখা করতে চাই। উনি এখানে ছিলেন বলছিলেন।’

‘হ্যাঁ, তবে কোন্ সময়টায় তা জানি না। গতকাল বিকেলে আমি বোনের বাসায় যাই। তবে উইলের কাছেও এক্সট্রা চাবি আছে, এবং তিনি আমার জন্যে জঞ্জালের স্তূপ রেখে গেছেন।’

‘খাইছে, কী ধরনের জঞ্জাল?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘ভেজা কাপড়চোপড়?’ অনুমান করল রবিন।

‘কাদামাখা জুতো?’ যোগ করল কিশোর।

‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা এতসব জানলে কীভাবে?’

‘আমরা গোয়েন্দা!’ সগর্বে বলল ডন, এবং কিশোর অল্প কথায় সব জানাল মহিলাকে।

ওর কথা শেষ হলে লরা বলল, ‘তাহলে তোমরা হয়তো বলতে পারবে এগুলো কী।’ চারপাশে ঝাড়ু বুলিয়ে কিছু মিহি, সাদা জট পাকানো পশম জড় করল। এবাড়িতে এজিনিস জীবনেও দেখিনি।’

রবিন এক মুঠো লোম নিয়ে নিরীখ করল। অন্যরাও। সন্দেহ নেই কারও মনে….

‘এগুলো কুকুরের লোম,’ বলে উঠল রবিন

‘এহ, কুকুরের লোম?’ গুঙিয়ে উঠে মাথা নাড়ল লরা। ‘মেঝেগুলো আবার সাফ করতে হবে আমার।’

কিশোর বলল, ‘আমরা কি সূত্র খোঁজার জন্যে ভেতরটা একটু ঘুরে দেখতে পারি? কুকুরের লোম পেলে পরিষ্কার করে দেব কথা দিচ্ছি।’

‘এসো, তবে কোন কিছু নোংরা কোরো না কিন্তু।

‘করব না,’ রবিন আশ্বস্ত করল মহিলাকে।

এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গেল ওরা, কোন কিছু স্পর্শ না করে শুধু দেখে গেল। পেছনদিকে ওয়াশার আর ড্রায়ার নিয়ে ছোট্ট এক লণ্ডি এরিয়া। ছেলেরা মেঝেতে ছোট-ছোট দুটো পাত্র দেখল। একটার তলায় এখনও কিছু বিস্কুটের গুঁড়ো লেগে রয়েছে, এবং অপরটিতে সামান্য পানি দেখা গেল। এবার ওরা সিঙ্কে প্রাইসের বৃষ্টিভেজা জামাকাপড় দেখল- চমৎকার এক হাউণ্ডথ ব্লেয়ার, ছেঁড়া সাদা এক শার্ট, এবং একজোড়া চামড়ার কালো জুতো, এক সময় ঝাঁ চকচকে থাকলেও এখন একদম বাতিল মাল। আর কাছেই এক ট্র্যাশ ক্যানে পড়ে রয়েছে এক সেল ফোন। ছেলেরা ওটা চালু করার চেষ্টা করল-অকেজো।

ওপরে উঠে দেখল, ওয়েসলি হলের গেস্ট রুমের এক কোণে একজোড়া তোয়ালে গাদা করে রাখা-একটা কাদামাটি মেখে নোংরা, অপরটায় লেগে রয়েছে আরও কয়েক গোছা মিহি সাদা লোম। ট্রেইনের চতুর্থ কামরাটিতে ওরা ডগ শ্যাম্পুর যে উৎকট দুর্গন্ধ পেয়েছিল সেটি ভক করে নাকে এসে লাগল ছেলেদের।

‘উনি নিশ্চয়ই নিজে একটা তোয়ালে ব্যবহার করেছেন আর অন্যটা দিয়ে কুকুরটার গা মুছেছেন,’ বলল কিশোর। ওরা এ-ও লক্ষ করল বিছানাটা অবিন্যস্ত, বোঝা যায় কেউ শুয়েছিল।

নাইটস্ট্যাণ্ড থেকে ফোন তুলে কানে ঠেকাল রবিন।

‘এখনও ডেড,’ বলল। ‘বোঝা যাচ্ছে কেন তিনি আমাদেরকে আর ফোন করেননি।’

রহস্যের টুকরোগুলো একে-একে জোড়া লাগছে দেখে অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

‘কিন্তু সমস্যাটা তো থেকেই গেল,’ বলল রবিন।

‘সেটা হচ্ছে তিনি এখন কোথায়?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘উনি এখনও নিখোঁজ!’ বলল ডন।

‘হুম,’ বলল কিশোর। ‘আমরা ঠিক পথেই আছি, তবে দিল্লী বহুত দূর।’

দেয়ালে ঝুলন্ত পেণ্ডুলাম ঘড়িটার দিকে চাইল মুসা।

‘খাইছে, এবং লাইব্রেরিতে রিডিং শুরু হতে আর অল্প সময় বাকি!’

এবার রবিন বলল, ‘ভাবছি… তুমি যদি আচমকা এখানে হাজির হও, ঠিক মিস্টার প্রাইসের মত, রাতে থাকো, কিছু কাপড় আর খাবার নাও, তারপর চলে যাও-এবং বাড়ির মালিক যদি তোমার পুরনো বন্ধু হন-তবে কি তুমি কোন ধরনের চিরকুট লিখে রেখে যাবে না? সেটাই স্বাভাবিক না?’

‘খাইছে, অবশ্যই,’ বলল মুসা।

আঙুল ফোটাল কিশোর।

‘জাপানের ফুল বইটার কথা মনে আছে? ছেলেটা যেখানে মা-র জন্যে কম্পিউটারে মেসেজ রেখে যায়?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ বলে উঠল রবিন। তারপর স্ক্রীন অফ করে দেয় শত্রুরা যেন না দেখে!’

কিন্তু ও জানত মা অন করলেই দেখতে পাবেন।

‘খাইছে, মিস্টার প্রাইসও কি তা-ই করেছেন?’ মুসার প্রশ্ন। ‘চেক করে দেখি, বলল কিশোর। ‘আমরা কোথাও কোন চিরকুট পাইনি, এবং ওয়েসলি হল রোজ নিশ্চয়ই কম্পিউটারে বসেন। মেসেজ রাখার নিখুঁত জায়গা ওটা।’

ছেলেরা হল ধরে শশব্যস্তে পা চালিয়ে মি. হলের অফিসে ফিরল। উষ্ণ, আরামদায়ক কামরাটি বই পড়ার জন্য আদর্শ-মেঝে থেকে প্রায় ছাদ অবধি দেয়ালগুলো বুককেস দিয়ে ঠাসা, আর কোন ধরনের বই নেই সেখানে! বিশাল তিনটি জানালা দিয়ে ওপারের পাহাড়-পর্বতের শ্বাসরুদ্ধকর নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে। কামরার ঠিক মাঝখানে ওয়েসলি হলের অতিকায় ওক কাঠের ডেস্কটি, ওপরে কাগজপত্র আর বইয়ের স্তূপ। ওঁর কম্পিউটার চালু রয়েছে, ছেলেরা টের পেল, কেননা হার্ড ড্রাইভের গুঞ্জন আর ফ্যানের শোঁ-শোঁ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মনিটর-প্রাইসের সেই কাহিনীর মতন-অফ।

‘দেখি তো,’ বলল কিশোর, বাটন দাবাল। মুহূর্তখানেক পরে আলোকিত হলো পর্দা, এবং ওরা বুঝল ওদের ধারণাই ঠিক। বার্তাটা ওদের চোখের সামনে। কিশোর জোরে জোরে পড়ে শোনাল:

ওয়েস বাছাধন,
ঘরদোর নোংরা করার জন্য দুঃখিত-

গতকাল থেকে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। দেখা হলে সব বলব। আমি কিছু পাঠকের সঙ্গে মিলিত হতে গ্রীনফিল্ড লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। যেহেতু ট্রেইন মিস করেছি, এবং আজ ট্রেইনের কোন শিডিউলও নেই, তাই আমি তোমার গাড়িটা নিচ্ছি, পুরানোটা। আশা করি কিছু মনে করবে না!

-উইল

বি: দ্র: ও, হ্যাঁ, তোমার নতুন বইটার কিছু অংশ পড়লাম—ওই যে, তোমার ডেস্কের ওপর যেটা পড়ে রয়েছে-এবং সত্যি বলতে কি লেখাটা একেবারে অখাদ্য, জঘন্য-যেমন ভাষা, তেমনি কাহিনী!

চাপা হাসল কিশোর।

‘যা ভেবেছিলাম—ওঁরা পরস্পরের শত্রু নন, স্রেফ প্রতিদ্বন্দ্বী।‘

‘তাই?’ ডনের প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ, মিস্টার ওয়েসলি হল চান তাঁর বই মিস্টার প্রাইসের চেয়ে বেশি চলুক। তবে তাঁরা নিঃসন্দেহে ভাল বন্ধু। আসলে দু’জন দু’জনকে খোঁচাতে ভালবাসেন। মিস্টার হল লাইব্রেরিতে মিস্টার প্রাইসের ডিসপ্লে নষ্ট করে ঠিক সে কাজটাই করছিলেন- এটাকে বড়দের দুষ্টুমি বলতে পার। হয়তো একে অন্যের সাথে এমনটা করে চলেছেন বহু বছর ধরে।’

‘কিন্তু অন্য গাড়িটার ব্যাপারটা কী?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘মিস্টার হলের কি সত্যিই একটা পুরনো গাড়ি আছে?’

ঠিক এমনিসময় ওদের পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এবং ওটা অবশ্যই লরার নয়।

‘হ্যাঁ, আছে,’ জবাব দিলেন ওয়েসলি হল, দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরজায়। ‘আমার দোস্ত প্রাইস বোধহয় নিয়েছে ওটা। তবে সমস্যা হচ্ছে, গাড়িটার যখন-তখন বিগড়ানোর স্বভাব আছে!’