পাঁচ
গ্রীনফিল্ড ডাইনার-এ জ্যাক নানার সঙ্গে ডিনারে যোগ দিল ছেলেরা। খদ্দেরে ঠাসাঠাসি জায়গাটা। বাতাসে কথাবার্তার গুঞ্জন, চামচ-কাঁটাচামচের টুং-টাং আর হরেক রকমের সুস্বাদু খাবারের সুঘ্রাণ।
প্রিয় বুথে বসে, ছেলেরা জ্যাক নানাকে ওদের সর্বশেষ রহস্যটির খুঁটিনাটি বর্ণনা দিল। খাবারে মন নেই কারও। জ্যাক হিগিন্স বুঝলেন ওরা কেসটা নিয়ে এতটাই চিন্তিত যে খাওয়ায় আগ্রহ পাচ্ছে না। মুসা এমনকী ডেজার্টও অর্ডার দেয়নি!
‘মিস্টার প্রাইসের সেল ফোন নম্বরটা পর্যন্ত নেই আমাদের কাছে,’ বলল কিশোর। ‘উনি নিশ্চয়ই সঙ্গে রাখেন ওটা।
‘মিসেস কোনরকে আমাদের সব কথা জানাতে হবে,’ বলল রবিন। ‘তাঁকে আপডেট দিয়ে বাড়ি ফিরব আমরা।’
‘তারপর?’ মুসার প্রশ্ন।
এর জবাব জানা নেই কারও। সবাই চুপ করে রইল।
ডন নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল, চিকেন স্ট্রিপ চিবোচ্ছে আর দুধের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎই কামরার ওপ্রান্তে কিছু একটা দৃষ্টি কাড়ল ওর।
‘অ্যাই,’ ফিসফিস করে বলল। ‘ওদিকে দেখো!’
ছোট্ট এক বুথে একাকী বসে এক লোক, কফি পান করছে। সেদিকে ভ্রূ দেখাল ডন।
‘কী দেখব?’ কিশোর জবাব চাইল। ‘লোকটাকে?’
‘না, ব্যাগটা!’
অপর সিটে চামড়ার বাদামি এক ব্যাগ। সুদৃশ্য আর দামি। ‘ওটা দেখার কী আছে?’
‘ইনিশিয়ালগুলো দেখো, ওপরদিকে!’
হ্যাঁ, যিপারের ঠিক নিচে, চামড়ায় এমব্রয়ডার করা আদ্যক্ষর-’ডব্লিউ এক্স পি’। মুহূর্তে ছেলেদের মনে পড়ল মি. প্রাইসের পুরো নাম: উইলার্ড জেভিয়ার প্রাইস!
‘ইয়াল্লা!’ শ্বাস চাপল মুসা। ‘এটা কি তবে…?’
‘ক’জনেরই বা অমন আদ্যক্ষর আছে বলো?’ বলল রবিন ‘মাঝের নাম এক্স দিয়ে?’
ছেলেরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটিকে জরিপ করল। ফুল হাতা নেভি ব্লু টি-শার্ট, নীল জিন্স আর বহু ব্যবহৃত ওয়র্ক বুট পরে রয়েছে সে। রুপোলী পাক ধরা এক মাথা কালো চুল তার, গালে ক’দিনের না কামানো দাড়ি।
কফিতে আরেক চুমুক দিতেই, ওয়েট্রেস জানতে এল তার আর কিছু লাগবে কিনা। মাথা নেড়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল লোকটা। ওয়েট্রেস টেবিলে বিল দিলে, ওটার ওপর পাঁচ ডলারের এক নোট রাখল খদ্দের। এবার সটান উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল।
‘এসো, বলল কিশোর
ছেলেরা সার বেঁধে বুথ ত্যাগ করল, জ্যাক নানা ওদেরকে অনুসরণ করলেন।
লোকটা বাইরে বেরিয়ে চশমা পরার জন্য মুহূর্তের জন্য থামল।
‘একটু শুনুন, স্যর,’ ডাকল রবিন।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা, ওদেরকে দেখে চমকে গেছে।
‘আমাকে বলছ?’
‘হ্যাঁ, বলল কিশোর। ‘জানি প্রশ্নটা একটু উদ্ভট শোনাবে। কিন্তু ব্যাগটা কি আপনার?’ মুখে হাসি ধরে রেখেছে ও।
লোকটি এবার পাল্টা হাসল।
‘না, আমার নয়… জানলে কীভাবে?’
‘এটা সম্ভবত আমাদের পরিচিত এক ভদ্রলোকের,’ বলল মুসা। ‘ব্যাগটা কি আপনি ট্রেইনে পেয়েছেন?
লোকটিকে আরও হতভম্ব দেখাল। সে খানিকটা মুগ্ধ হয়েছে মনে হলো।
‘হ্যাঁ, ট্রেইনে।
‘ষোলো নম্বর ট্রেইনে?’ এবার প্রশ্ন করল নথি।
এবার হেসে উঠল লোকটা।
‘একদম ঠিক। আমি আসলে ট্রেইনের ইঞ্জিনিয়ার!
ছেলেরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল। এবার তল পাওয়া যাচ্ছে!
‘আর ব্যাগটা কি….চার নম্বর বগিতে ছিল?’ প্রশ্ন করল কিশোর। যেটা বন্ধ থাকার কথা?’
মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক।
‘হ্যাঁ, ইয়াং ম্যান।’
‘খাইছে, তারমানে উইলার্ড প্রাইস ওখানে ছিলেন,’ বলল মুসা। ‘তিনিই নিশ্চয়ই লাফিয়ে পড়েছিলেন ট্রেইন থেকে!’
বাকি কাহিনী ব্যাখ্যা করল কিশোর
‘এবং আমরা আগে থেকেই ভাবছিলাম মি. প্রাইস হয়তো চতুর্থ বগিটায় ছিলেন।’
‘আমার ধারণা ছিলেন,’ মন্তব্য করলেন ইঞ্জিনিয়ার। কাঁধ থেকে হড়কে নামিয়ে ব্যাগটা ধরিয়ে দিলেন কিশোরের হাতে। ‘চতুর্থ বগির ওভারহেড লাগেজ র্যাকে পাই এটা। দামি কোন কিছু যখন পাই আর মালিককে পাই না তখন আমার রিপোর্ট করতে হয়। এর মানে ফর্ম ফিলাপ কর, এটা কর, ওটা কর-বিরক্তিকর কাজ।’ চোখ ঘোরালেন তিনি। ‘কাজেই তোমরা মিস্টার প্রাইসকে এটা ফিরিয়ে দিতে পারলে আমি বেঁচে যাই।’
‘দেব,’ বলল রবিন। ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
লাইব্রেরিতে ফিরে, ছেলেরা মিসেস কোনরকে সব খুলে বলল। তারপর পেছনের এক কামরায় ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে এক টেবিলের ওপর রেখে চেইন খুলল।
‘খাইছে, কেমন অস্বস্তি লাগছে,’ বলল মুসা। এর ভেতরে নিশ্চয়ই ওঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আছে।’
‘কিন্তু এর মধ্যে হয়তো এমন কিছু রয়েছে যেটা ওঁর হদিস দিতে পারে,’ বলল রবিন।
ওপরদিকে, ছেলেরা ওঁর লেখা কয়েকটি বই পেল, বেশির ভাগই নতুনটার কপি। ওগুলোর তলায় এক সেল ফোন চার্জার, কটা কাপড়চোপড় আর এক চামড়ার ব্যাগে টুথব্রাশ, শ্যাম্পু আর অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসপত্র। আর তার নিচে ছোট এক নোটপ্যাড।
রবিন নোটপ্যাডটা খুলে পড়তে লাগল।
‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে?’ কিশোর প্রশ্ন করল। ‘কোন কু?’
‘উম-বৃহস্পতিবার মাসের বাজার…শুক্রবার লঙ্গি… জুনের পাঁচ তারিখে ক্লিয়ারওয়াটারে বইতে অটোগ্রাফ দেয়া… তিন তলার ভাঙা জানালাটা মেরামত…’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। ‘নাহ, কাজের কিছু নেই।’
‘ব্যস, এটুকুই?’ মুসার প্রশ্ন।
‘আরেকটা পাতা আছে,’ বলে পাতাটা ওল্টাল রবিন। ‘ডাইনিং রুমে নতুন টেবিল দরকার হতে পারে…. কাউকে দিয়ে পেছনের লনের ঘাস কাটাতে হবে… আমি কী করব…
‘মানে?’ কিশোর জবাব চাইল। ‘পুরোটা পড়ো।’
‘এটা কু হতে পারে-এখানে লেখা, আমি কী করব ওয়েসলি হলের ব্যাপারে?’
‘খাইছে, আবার সেই ওয়েসলি হল,’ বলল মুসা।
‘এক কাজ করি এসো,’ প্রস্তাব করল কিশোর।
‘লাইব্রেরির ক্যাটালগ ঘেঁটে দেখি মিস্টার হল আর মিস্টার প্রাইস সম্পর্কে কোন তথ্য পাই কিনা। মানে খবরের কাগজ কিংবা ম্যাগাজিনের আর্টিক্, হয়তো ইন্টারনেটেও কিছু পেতে পারি। এই অদ্ভুত যোগাযোগটার ব্যাপারে আরও জানতে হবে আমাদের।’
‘ভাল আইডিয়া,’ সায় জানাল রবিন। এতে আমরা হয়তো জানতে পারব বারবার কেন মিস্টার ওয়েসলি হলের নাম ঘুরেফিরে আসছে।’
ছেলেরা লাইব্রেরিতে তথ্যসন্ধান চালাল। ঘণ্টা খানেক পরে, খবরের কাগজ আর বিনোদন ম্যাগাজিনের ছোটখাট এক পাহাড় জমল। প্রত্যেকে কটা করে নিয়ে পাতা উল্টে চলল।
‘এই আর্টিক্টা বলছে,’ বলল মুসা, ‘মিস্টার প্রাইস জন্তু- জানোয়ার ভালবাসেন। তিনি বিভিন্ন অ্যানিমেল চ্যারিটিতে অনেক টাকা আর সময় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উনি নিজেও বহু বছর ধরে প্রাণী পোষেন। কোন ধরনের মাংস খান না, শুধু ফল, সবজি, আর-শোনো-গ্র্যানোলা বার!’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘চার নম্বর কামরায় নিঃসন্দেহে উনিই ছিলেন।’
‘এই ম্যাগাজিনে লিখেছে,’ ওদেরকে বলল কিশোর, ‘তিনি এক নিভৃত গাঁয়ের কোন এক গোপন আস্তানায় বসে কখনও সখনও লেখালেখি করেন। তবে জায়গাটার নাম বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘…ওটা ছিল পুরানো, বিশাল এক লালরঙের বার্ন। এখন সাদা রঙ করা হয়েছে, কালো শাটার নিয়ে চমৎকার দেখায় ওটাকে। আমি প্রায়ই একান্তে, নিরিবিলি সময় কাটাতে যাই ওখানে।’
‘মিস্টার হলের সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন?’ মুসার প্রশ্ন। ‘ও ব্যাপারে কিছু পেলে?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রবিন, ‘আমি খানিকটা পেয়েছি। এই আর্টিকল্টায় মিস্টার প্রাইস বলেছেন, ‘আমার বই পাঠকদের ভাল লাগে এতে আমি রোমাঞ্চিত। আমার বই ওয়েসলি হল-এর বইয়ের চাইতে বেশি বিক্রি হলেই আমি সন্তুষ্ট।’
‘এই সাক্ষাৎকারে,’ বলল কিশোর, ইন্টারনেট খুঁজে পাওয়া এক আর্টিকলের প্রিন্ট আউট তুলে নিল গোয়েন্দাপ্রধান, ‘মিস্টার ওয়েসলি হল বলেছেন, ‘আমার পাঠকরা যে আমার লেখা ভালবাসে এটাই আমার সার্থকতা। উইলার্ড প্রাইসের ছেলেমানুষী কাহিনী যে তারা পড়ে না এরচেয়ে আনন্দের আর কী আছে?’
‘এখানে লিখেছে,’ মুসা বলল, ‘মিস্টার প্রাইস বলেছেন, ছোটরা দু’ধরনের বই পড়তে পারে ভাল বই, আর নয়তো ওয়েসলি হল-এর বই।
‘ওঁরা একজন আরেকজনকে দু’চোখে দেখতে পারেন না, তাই না?’ বলল ডন।
‘তা-ই তো মনে হচ্ছে,’ বলল রবিন। এবার খেয়াল হলো ওর প্রায় আটটা বাজে। ‘যাই চলো,’ বলল ওদেরকে। ‘নানা বসে থাকবেন আমাদের জন্যে।
ছেলেরা বাসায় ফিরে দেখল ওদের জন্য চমক অপেক্ষা করছে।
‘বাসায় ফিরে দেখি বাতিটা মিটমিট করছে,’ কিচেনে রাখা অ্যান্সারিং মেশিনটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন জ্যাক নানা, ব্যাখ্যা দিলেন ওদেরকে। ‘প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের মেসেজ বুঝি। তবে শীঘ্রিই ভুল ভাঙে। শোনো-
প্লে বাটন টিপলেন তিনি, এবং শোনা গেল অদ্ভূত, রহস্যময় এক বার্তা। প্রবল শোঁ-শোঁ আওয়াজের কারণে কিশোর পুরো ভলিউম দেয়ার পরও কেবল অল্প কটা শব্দ উদ্ধার করা গেল।
‘জানাচ্ছি তোমাদেরকে… আর কোন উপায় ছিল না… ও লাফিয়ে পড়ে…অ্যালার্টনে নিখোঁজ… সাঙ্ঘাতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা… মিস্টার কিনের কাছে যাচ্ছি… যত দ্রুত সম্ভব…’
এবং বার্তাটার এখানেই সমাপ্তি।
‘এটা তো মিস্টার প্রাইসের মেসেজ!’ ডন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল।
অ্যান্সারিং মেশিনের ছোট্ট পর্দাটা খুঁটিয়ে নিরীখ করল রবিন।
‘কলটা এসেছে ১০:৩২-এ ছ’ঘণ্টারও আগে!’ বলে উঠল ও।
‘এবং আমরা সারাদিন বাইরে ছিলাম, বলল কিশোর। ‘সেজন্যে জানতে পারিনি।’
‘ইয়াল্লা, আশা করি উনি ভাল আছেন!’ বলল মুসা।
‘ওঁর সেল ফোনে কল করলে কেমন হয়?’ বাতলে দিল কিশোর।
নম্বর তো নেই,’ মনে করাল রবিন
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘অ্যান্সারিং মেশিনে নিশ্চয়ই থাকবে, কলার আইডিতে।’ রবিন চোখ নামাতেই দেখল ওটা।
‘তাই তো!’
নম্বরটি টিপে অপেক্ষা করতে লাগল ও। আর সবাই শ্বাস চেপে উদ্গ্রীব হয়ে দেখছে ওকে।
ক’মুহূর্ত পরে, কিশোর বলল, ‘সাড়া দিচ্ছেন উনি?’
মাথা নাড়ল রবিন।
‘না, এটা সোজা ওঁর ভয়েস মেইলে গেছে।’
‘খাইছে, রিঙও বাজছে না?’ মুসা শুধাল।
‘না।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নথি। ‘মনে হচ্ছে রহস্যটা ক্রমেই আরও জটিল হচ্ছে।’
‘উনি বলেছিলেন ‘মিস্টার কিন’-এর কাছে যাচ্ছেন, তাই না?’ জবাব চাইল রবিন।
‘তা-ই তো শুনলাম মনে হলো,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু কে এই মিস্টার কিন?’
কেউ জানে না।
‘আর তিনি যেন কোন্ শহরের নাম বলেছিলেন?’ বলল কিশোর। ‘অ্যালার্টন না? উনি নিশ্চয়ই ওখানেই লাফিয়ে পড়েন ট্রেইন থেকে। শহরটার নাম আগে কখনও শুনিনি।’
‘ওটা এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল উত্তরে,’ জানালেন জ্যাক নানা। ‘ছিমছাম ছোট্ট এক শহর। বেশ ক’বার গেছি। একদম শান্ত, নিরিবিলি।’
মুখের চেহারা উজ্জ্বল হলো মুসার।
‘খাইছে! অ্যালার্টন! নামটা আগে দেখেছি!’
‘তাই? কোথায়?’
মুহূর্তের বিরতি নিয়ে আরেকবার ভাবল মুসা এবং নিশ্চিত হয়ে নিল। এবার চাইল অন্যদের দিকে।
‘লাইব্রেরিতে আমরা যে আর্টিকলগুলো ঘাঁটছিলাম, সেখানে, জানাল ও। ওখানেই থাকেন ওয়েসলি হল!’