নিখোঁজ যাত্রী – ৪

চার

‘কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড!’ ছেলেরা দুঃসংবাদটা দিলে বলে উঠলেন মিসেস কোনর। ‘এমন অলক্ষুণে কথা তো জন্মেও শুনিনি, বাপু! জলজ্যান্ত একজন মানুষ স্রেফ গায়েব হয়ে গেলেন! ঈশ্বর ওনার ভাল করুন।’

‘চিন্তা করবেন না, আমরা ঠিক বের করে ফেলব ওঁর কী হয়েছে,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রবিন।

‘তোমরা না পারলে, মিস্টার ওয়েসলি হলকে আমার ফোন করতে হবে,’ মিসেস কোনর বললেন।

‘খাইছে, যিনি এখানে এসে হম্বিতম্বি করছিলেন?’ মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস কোনর।

‘হ্যাঁ। ভদ্রলোক অনেক চেঁচামেচি করে গেছেন। উইলার্ড প্রাইসকে দু’চোখে দেখতে পারেন না তিনি, তাঁর বইগুলোও ভদ্রলোকের ঘোর অপছন্দ।

কিশোর বলল, ‘গতকাল আমরা মিস্টার প্রাইসের বইগুলোর যে ডিসপ্লে সাজিয়েছিলাম উনি ওটার বারোটা বাজিয়েছেন।’ মিসেস কোনরকে ঘটনাটা জানাল।

‘উনি অমন কাজ কেন করলেন?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

শ্রাগ করলেন মিসেস কোনর।

‘আমার কোন ধারণা নেই, ডন।’

‘খাইছে, আমি মিস্টার ওয়েসলি হলের কোন বইয়ের নাম শুনিনি,’ বলল মুসা।

‘উনি নিঃসন্দেহে ভাল লেখক,’ মিসেস কোনর স্বীকার করলেন। ‘তবে তাঁর বইগুলো একটু বড় পাঠকদের জন্যে।’

‘মিস্টার প্রাইসের উধাও হওয়ার পেছনে তাঁর হাত থাকতে পারে,’ বলল রবিন।

‘ওঁকে সন্দেহের আওতায় রাখতে হবে,’ বলল মুসা।

আবারও হাতঘড়ি দেখে নিল নথি।

‘চলো খেয়ে নিয়ে এই রহস্যটার পেছনে লাগা যাক।’

‘হ্যাঁ,’ বলল কিশোর। হাতে সময় কম আমাদের।’

‘তোমরা খুঁজে দেখো মিস্টার প্রাইসকে পাও কিনা, মিসেস কোনর বললেন। ‘কিন্তু মিস্টার প্রাইস কাল সকালের মধ্যে এখানে হাজির না হলে, আমাকে অগত্যা তাঁর বদলে মিস্টার হলকেই আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

‘মিস্টার প্রাইস না এলে অনেক মানুষ হতাশ হবে,’ বলল রবিন, ওরা তখন রোদ ঝলমলে এক সাইডওয়ক দিয়ে হাঁটছে। রাস্তার দু’পাশে বড়-বড়, দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর। ‘আর মিস্টার হলের জন্যে বেশি মানুষ আসবেও না। যা তিরিক্ষে মেজাজ ভদ্রলোকের!

ছেলেরা মিসেস টার্নারের বাসায় থামল, মিশর-রহস্য বইটি যিনি ভুলে ফেলে এসেছিলেন ট্রেইনে। বারান্দায় দু’জন মানুষ বসার মত এক দোলনা, এবং সদর দরজায় লেখা এক সাইন বলছে: বন্ধুদের সবাইকে স্বাগতম।

ছেলেরা দোরঘণ্টি বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে, দরজা খুলে গেল। ফুলের ছাপওয়ালা পোশাক পরা এক বয়স্কা মহিলা সাড়া দিলেন। ওদেরকে হাসতে দেখে, পাল্টা হাসলেন মিসেস টার্নার।

‘আরে, তোমরা এসেছ? একাই না সাথে তোমাদের নানাও আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘আমরা একাই, ম্যাম,’ জানাল রবিন।

‘উনি হয়তো এখন ইজি চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন, চোখের তারা নাচিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা। ‘যে সময়টায় তাঁর লনের ঘাস কাটার কথা।’

হেসে ফেলল ছেলেরা। জ্যাক নানাকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসেন মিসেস টার্নার।

রবিন পেছনের পকেট থেকে প্রাইসের বইটা বের করল। ‘মিসেস টার্নার, আজ সকালে আপনি সম্ভবত এটা ট্রেইনে ফেলে এসেছেন।’

বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটল মিসেস টার্নারের হাসিমাখা মুখের চেহারায়।

‘হ্যাঁ, তাই তো। ভেবে পাচ্ছিলাম না বইটা গেল কোথায়!’ স্ক্রিন ডোর খুলে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলেন ছেলেদেরকে। ভেতরে পা রেখে তাঁর হাতে বইটা তুলে দিল রবিন। ‘সফরের সময় পড়ছিলাম এটা, ভেবেছি ব্যাগে গুঁজে রেখেছি। বাসায় ফিরে টের পেলাম খোয়া গেছে ওটা।’ বইটার দিকে ভালবাসার দৃষ্টিতে চাইলেন। ‘ওহ, অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।’

‘ওঁর লেখা সত্যি আপনার ভাল লাগে?’ ডন জানতে চাইল।

‘সে আর বলতে!’ জবাবে বললেন তিনি। ‘শুধু বাচ্চাদের কেন, ওঁর বই বড়দেরও ভাল লাগে! তাঁর সাথে কাল রাতে লাইব্রেরিতে দেখা করতে যাব, ওহ, তর সইছে না আমার!’

‘একটু সমস্যা আছে যে,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল রবিন। ‘মিস্টার প্রাইসকে তো পাওয়া যাচ্ছে না।

হতভম্ব দেখাল মিসেস টার্নারকে।

‘তারমানে?’

‘জি,’ যতটুকু ওরা জেনেছে খুলে বলল কিশোর-মি. প্রাইস যে ক্লেয়ারমন্টে নিশ্চিতভাবেই ট্রেইনে উঠেছিলেন, কিন্তু ট্রেইন যখন গ্রীনফিল্ডে পৌঁছল তখন তিনি লাপাত্তা।

‘হায়, ঈশ্বর!’ বলে উঠলেন মিসেস টার্নার।

‘সেজন্যেই আমাদের আসা,’ রবিন বলল তাঁকে। ‘বইটাও ফেরত দেব আর জানতে চাইব আপনি তাঁকে ট্রেইনে দেখেছিলেন কিনা।’

‘না, দেখিনি,’ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দিলেন মিসেস টার্নার। ‘দেখলে ঠিকই চিনতাম।’

‘আমরাও তা-ই ভেবেছিলাম,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল মুসা।

‘অস্বাভাবিক কোন কিছু কি চোখে পড়েছিল আপনার?’ কিশোর প্রশ্ন করল। ‘যেটাকে কু ভাবা যায়?’

মুহূর্তখানেক ভাবলেন তিনি।

‘না, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না… আরেকটু ভেবে দেখি। ব্রায়ারউডে ট্রেইনে উঠি আমি। সময় কাটানোর জন্যে তাঁর বইটা পড়ব ঠিক করি। ওখানকার ছোট এক দোকান থেকে কিনি ওটা। ট্রেইনে বসে পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু শোরগোলের জন্যে পারছিলাম না। একটা কুকুর খুব ঘেউ-ঘেউ করছিল কোথায় যেন। বিশ্বাস করতে পার? ট্রেইনে কিনা কুকুর? তো আমি একদম পেছনদিকে চলে যাই, ওখানটা নিরিবিলি ছিল।’

‘তিন নম্বর বগি, বলল নথি।

‘হ্যাঁ, তিন নম্বর, ওখানে বসে পড়তে আরম্ভ করি-’ একটু বিরতি নিলেন তিনি, চোখজোড়া বিস্ফারিত। ‘শান্তিমত একটুখানি পড়তেই…বুঝলে? অস্বাভাবিক ঘটনাটা ঘটল।’

‘খাইছে, কী সেটা?’ মুসা উদ্‌গ্রীব।

‘খুব বাজে ধরনের ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ি আমরা…

‘জানি,’ বলল রবিন। কণ্ডাকটরদের ভেজা উর্দির কথা ভোলেনি ছেলেরা।

‘এক স্টেশনে থামি আমরা,’ কথার খেই ধরলেন মিসেস টার্নার। ‘ওসময় আমার পেছন থেকে কে যেন ‘অ্যাই!’ বলে ডাক ছাড়ে। চমকে যাই আমি, কারণ শব্দটা শুনে মনে হয় একদম শেষ বগিটা থেকে এসেছে, এবং কারও ওখানে থাকার কথা নয়।’

‘কারণ ওটা বন্ধ ছিল,’ জুগিয়ে দিল মুসা।

‘ঠিক, মিসেস টার্নার বললেন। ‘যাত্রী কম ছিল যে। চিৎকারটা শুনে উঠে দাঁড়াই কে চেঁচাল দেখার জন্যে। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখি ট্রেইন ছাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন লাফিয়ে পড়ল!’

‘ওয়াও, হীরে-রহস্য বইতে ঠিক এমনটাই করেছিল সেই গোয়েন্দা পুলিস, বলল ডন।

‘হুম,’ সায় জানালেন মিসেস টার্নার। ‘আমারও ঠিক তা-ই মনে হয়েছিল।’

‘ওটা কোন্ স্টপ ছিল, মিসেস টার্নার?’ কিশোরের প্রশ্ন। ‘কোন্ শহর?’

‘আমি শিয়োর নই,’ বললেন তিনি। ‘গ্রীনফিল্ডের দু’এক স্টপ আগে হবে।’

‘মানুষটা দেখতে কেমন ছিল?’ রবিন শুধাল। ভালভাবে দেখতে পেয়েছিলেন?’

‘না, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। তবে ওটা যে-ই হোক, সে চতুর্থ বগিটায় ছিল।

‘খাইছে, তারমানে ওখানে কেউ একজন ছিল!’ বলল মুসা। ‘তাই তো মনে হচ্ছে, বলল কিশোর।

কিন্তু ওটা যদি প্রাইস হন, তবে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে চলন্ত ট্রেইন থেকে লাফ দিতে যাবেন কেন তিনি?