দশ
পেছনের রাস্তাটা হুবহু মি. হলের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়-নির্জন, কোলাহলমুক্ত, অপরূপ সুন্দর। পথটা গাছে ছাওয়া পাহাড়সারি ঘিরে রাখা এক উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে। পথটাকে প্রায় পুরোটা রাস্তা অনুসরণ করেছে আলসে এক নদী, মৃদু আলোড়ন তোলা পানির ওপরে চমকাচ্ছে সূর্যের আলো।
প্রথম আধ ঘণ্টা ওরা আর কোন গাড়িঘোড়া দেখল না। শেষবারের মত হাতঘড়িতে চোখ রাখল রবিন।
ছিটা। আর মাত্র এক ঘণ্টা। লাইব্রেরিতে পৌঁছতেই তো প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যাবে আমাদের!’
ধীরে-ধীরে মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘হ্যাঁ,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। ‘মনে হচ্ছে না উনি এখানে আছেন। আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
মি. ওয়েসলি হল বললেন, ‘তারমানে গ্রীনফিল্ডের কপালে আজ সন্ধ্যায় ওয়েসলি হল নাচছে!’
রাস্তার এক পাশে গিয়ে গাড়ি ঘোরাতে লাগলেন তিনি। হাইওয়েতে ফিরবেন, ফলে গ্রীনফিল্ডে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবেন।
এসময় পেছনের জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখল ডন।
‘এক মিনিট!’ বলে উঠল ও। ‘ওটা কী? ধোঁয়ার মত লাগছে!’
ওরা সবাই চাইল। সত্যিই, ওই দূরে, পরের পাহাড়টার পেছন থেকে ধোঁয়ার ক্ষীণ রেখা উঠছে।
রবিন বলল, ‘শীঘ্রি চলুন ওখানে, দেখা দরকার ঘটনাটা কী!’ ওয়েসলি হল হুইল ঘুরিয়ে গতি তুললেন গাড়িতে। পাহাড়চূড়ার কাছাকাছি হতেই, সবাই গলা উঁচু করল দেখার উদ্দেশ্যে। চূড়ায় পৌছতেই, হুডখোলা পুরানো, সবুজরঙের গাড়িটা দেখল ওরা, রেডিয়েটর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগলিয়ে।
ছেলেরা সমস্বরে আনন্দধ্বনি করে উঠল
এবার আঁতকে উঠল ওরা পুরানো গাড়িটার পাশে যখন গাড়ি থামালেন ওয়েসলি হল, কাউকে ভেতরে দেখা গেল না।
‘খাইছে, উনি এখানে নেই!’ মুসা রীতিমত হাহাকার করে উঠল।
‘আছেন,’ জবাব দিল রবিন, আঙুল তাক করল উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে। ‘ওই যে ওখানে!’
কয়েকশো ফিট সামনে এক লোককে দেখল সবাই, একাকী পায়ে হেঁটে চলেছেন জনমানবশূন্য রাস্তা দিয়ে, ছোট্ট সাদা এক কুকুর হাঁটছে তাঁর পাশে-পাশে। ফিতে নেই বলে টমির কলারে নিজের নেকটাইটা জুড়েছেন মি. প্রাইস।
উইলার্ড প্রাইস হাঁটা ধরেছেন গ্রীনফিল্ডের পথে।
ওয়েসলি হল তাঁর পাশে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘এই যে, ভদ্রলোক, চললেন কোথায়? লিফ্ট লাগবে নাকি?’
কী পরিশ্রান্তই না দেখাচ্ছে মি. প্রাইসকে! ঘেমেনেয়ে একাকার।
তারপরও স্মিত হাসলেন।
‘ওয়েস বাছাধন, তুমি! তোমার সাথে এখানে দেখা হবে ভাবিনি! এই… উম…..’
‘পাণ্ডববর্জিত এলাকায়?’ ওয়েসলি হল প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ, তাই।’
এবার ছেলেদেরকে লক্ষ করলেন মি. প্রাইস। মি. হলের উদ্দেশে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘তোমার ভাগ্নে-ভাতিজা বুঝি?’
হেসে ফেললেন মি. হল।
না, তবে আমার ধারণা তুমি ওদেরকে চেনো-ওরা তোমার ভক্ত-কিশোর, মুসা, রবিন আর ডন।’
‘তাই!’ জবর চমকেছেন মি. প্রাইস। এগিয়ে এসে জানালা দিয়ে মাথা গলালেন। তোমরা এখানে কী করছ? তোমাদের তো লাইব্রেরিতে আমার অপেক্ষায় থাকার কথা!
হাসতে হাসতে খুন হওয়ার জোগাড় হলো ছেলেদের।
‘উঠে পড়ো, ওরা পথে তোমাকে সবই বলবে,’ বললেন ওয়েসলি হল।
‘বেশ,’ বললেন মি. প্রাইস। দরজা খুলে টমিকে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকতে দিলেন। কুকুরটা হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পেছনে গিয়ে সোজা ডনের কোলে চড়ে বসল। মি. প্রাইস দরজা লাগিয়ে সিটবেল্ট বাঁধলেন।
‘হাতে যা সময় আছে তাতে এখনও শিডিউল রাখতে পারব- আমাদের বক্তৃতার,’ ওয়েসলি হল বললেন।
‘ভেরি গুড,’ জবাব দিয়ে, পরক্ষণে মি. প্রাইস ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলেন, ‘দাঁড়াও, আমাদের বক্তৃতা মানে? কী বলতে চাইছ? তুমি এর মধ্যে ঢুকলে কীভাবে?’
‘আ…ওটার ব্যাখ্যাও দেব তোমাকে,’ মি. হল মুচকি হেসে
বললেন।
মি. প্রাইস ছেলেদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চাইলেন। ওরা স্রেফ শ্রাগ করল।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই, কিশোর বলল, ‘দারুণ মজার এক ট্রিপ হতে যাচ্ছে এটা।’
দুই লেখক গ্রীনফিল্ডের পথে চলার সময় তুমুল তর্ক-বিতর্ক জুড়লেন।
‘আমার বইগুলো তোমারগুলোর চাইতে ঢের ভাল,’ বললেন মি. হল। ‘আমি মরার একশো বছর পরও টিকে থাকবে!’
‘তাই বুঝি? তোমার বইতে তো অজস্র বানান ভুল, ভাষার ঠিক নেই, দাঁড়ি-কমাও থাকে না,’ পাল্টা বললেন মি. প্রাইস। ‘ছোটরা কী শিখবে তোমার বই পড়ে?!’
‘এহ, আর তোমার তো কাহিনীই হয় না,’ বললেন মি. হল। ‘হাজারটা গোঁজামিল!’
এরকম আরও কত খুনসুটিই না করে চললেন দুই লেখক। তবে এর মাঝেও ছেলেদের বুঝতে কষ্ট হলো না প্রাইস আর হল পুরানো বন্ধু।
শহরে পৌঁছে কিশোর বলল, ‘মি. প্রাইস, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
মি. প্রাইস ঘাড় কাত করলেন, সিটের পেছনে বাহু রেখে ঝুঁকলেন।
‘নিশ্চয়ই, কিশোর।’
‘টমির ব্যাপারে,’ বলল ও, ভ্রূ দেখাল কুকুরটার উদ্দেশে। টমি পুরো সফরে ডনের কোল ছাড়েনি। ও খাঁচা থেকে বেরোল কীভাবে?’
‘ওহ, আমার দোষে। ঝড়-বৃষ্টির ভেতর ট্রেইন যখন ছুটছিল, টমি ভয়ে কুঁই-কুঁই করতে থাকে। আমি তখন খাঁচা খুলে ওকে বের করে আমার কোলে বসাই। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে নানা কথা বলে সান্ত্বনা দিলেও তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। তো ওকে আবার খাঁচায় পুরি, কিন্তু সম্ভবত ঠিকভাবে বন্ধ করিনি, কারণ ক’মুহূর্ত পরেই ট্রেইন থেকে লাফ দেয় ও!’
‘খাইছে, কিন্তু বগি থেকে ও পালাল কীভাবে?’ মুসার প্রশ্ন। ওরকম ভারী ধাতব দরজা তো ওর খুলতে পারার কথা নয়!’
‘ওটা আমি খুলেছি,’ মি. প্রাইস বললেন ওদেরকে। ‘বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ অসাধারণ লাগে আমার। টমিকে খাঁচায় পুরে, অ্যালার্টনে ট্রেইন থামলে দরজা খুলি বুক ভরে তাজা বাতাস নিতে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল, আর সে কী অপূর্ব ঘ্রাণ! আমি চোখ বুজে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেইন আস্তে-আস্তে স্টেশন ছেড়ে চলতে শুরু করেছে, অমনি টমি আমার পাশ দিয়ে এক ছুটে বাইরে লাফিয়ে পড়ে!’
‘এবং আপনার মনে হয় ওর পিছু নেয়া উচিত, বলল কিশোর।
‘হ্যাঁ, কারণ আমিই তো প্রথমে ওকে খাঁচা থেকে বের করি।’
‘এবার বুঝলাম,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কিশোর।
‘আপনি ট্রেইনে ব্যাগ রেখে গিয়েছিলেন কেন সে ব্যাখ্যাও মিলল,’ বলল রবিন। আপনি আসলে ওটা নেয়ার সময় পাননি।’
‘আমি এমনকী ওটার কথা ভাবিওনি,’ মি. প্রাইস বললেন ওদেরকে। ‘টমিকে বাঁচাতে হবে মাথায় শুধু সে চিন্তাই ছিল। যখন টের পেলাম ব্যাগটা ফেলে গেছি, ততক্ষণে খুদে বন্ধুটি আমার হাতে ধরা পড়েছে।’ এবার প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘তোমরা জানলে কীভাবে আমি ট্রেইনের চতুর্থ বগিটায় ছিলাম? কারও তো ওখানে থাকার কথা নয়।’
‘গ্র্যানোলা বারের মোড়ক,’ বলল রবিন। ‘ওখানে একটা মোড়ক পাই, আরেকটা পাই পার্কিং লটে, আর পাই আপনার ব্যাগে।’
‘খাইছে, আপনি টমিকে লাল ট্রাকটার তলা থেকে বের করে আনতে গ্র্যানোলা বারের লোভ দেখান, তাই না?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ।’
‘আর আপনার নোটপ্যাডের নোটটার কাহিনী কী?’ মুসা ফের প্রশ্ন করল। ‘যেটায় মিস্টার ওয়েসলি হলের কথা ছিল? আপনি লিখেছিলেন, ‘আমি কী করব ওয়েসলি হলের ব্যাপারে?’
মি. প্রাইস হেসে উঠে মি. হলের উদ্দেশে চাইলেন।
‘ওহ, গ্রীনফিল্ড থেকে ফেরার পথে ওর সাথে দেখা করব কিনা তখনও ঠিক করতে পারিনি, তাই টুকে রাখি যাতে মনে থাকে।’
‘ও নিয়ে আর ভাবতে হবে না,’ বললেন ওয়েসলি হল। ‘দেখা তো হয়েই গেল।’
‘হুম।’
‘আর আপনার সেল ফোন? ওটা কি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, একদম ভিজে-টিজে শেষ। পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাওয়ার আগে তোমাদের বাসায় কোনমতে শেষ কলটা করি 1 আমার সাথে কোন চার্জারও ছিল না, এবং অ্যালার্টনের অন্য কোন ফোনও কাজ করছিল না। শব্দ করে হেসে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। ‘বিশ্বাস করতে পার? এই মডার্ন টেকনোলজির যুগেও কিনা মাত্র কয়েকটা শহর পরে মেসেজ পাঠাতে কত বিড়ম্বনা!’
লাইব্রেরির পার্কিং লটে গাড়ি থামলে ওরা দেখল, বাইরে, লনে দাঁড়িয়ে রয়েছে উৎসুক জনতা, অপেক্ষারত। চলতি পথে মিসেস কোনরকে ফোন করে রবিন আদ্যোপান্ত জানায়। মিসেস কোনর তো মহাখুশি, ওরা একজন নয়, দু-দু’জন বিখ্যাত লেখককে একসঙ্গে হাজির করছে লাইব্রেরিতে। জ্যাক নানাও হাজির এখানে, তাঁর চোখে-মুখে খেলা করছে গর্বের আর তৃপ্তির ছায়া। মিসেস টিনা টার্নারও এসেছেন, মি. প্রাইসের সব কটা বই তাঁর হাতে-অটোগ্রাফ নেবেন।
ওয়ার্ন পরিবারকেও দেখা গেল। মি. প্রাইস মি. হলের গাড়ির দরজা খুলতেই, টমি এক লাফে নেমেই তীরবেগে ছটল, নিজের পরিবারের কাছে। বাচ্চা দুটোর খুশি ধরে না কুকুরটাকে ফিরে পেয়ে! টমি লাফিয়ে ওদের গায়ে উঠে মুখ চাটতে লাগল, প্রপেলারের মতন ঘুরছে ওর লেজটা।
সবাই গাড়ি থেকে নামলে, দর্শকরা করতালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। মি. প্রাইস আর ওয়েসলি হল তাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে স্মিত হাসলেন। ছেলেরা ঝটপট এক পাশে সরে দাঁড়াল। তাই দেখে মিসেস কোনর জানালেন জনতা ওদেরকেও অভিনন্দন জানাচ্ছে।
‘তোমরা না থাকলে আজকের এই চমৎকার সন্ধেটা পণ্ড হত!’ বললেন তিনি।
শুনে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল ছেলেদের। উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে ভক্তরা সবাই ভেতরে ঢুকতে লাগল।
মি. প্রাইস মি. হলের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কী বুঝলে, ওয়েস বাছাধন?’
‘কী?’
‘দারুণ এক গল্পের প্লট মাথায় খেলে গেল। চারটে বাচ্চা ছেলে এক পাগলা বুড়োকে খুঁজে বের করবে, ওদের সাথে দেখা করতে আসার পথে যে লোক বোকার মত হারিয়ে যায়।’
তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেদের উদ্দেশে মুচকি হাসলেন। ওরা এতটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মুখে কথা জোগাল না।
‘জমজমাট কাহিনী হবে নির্ঘাত,’ বলে পুরানো বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিলেন মি: হল। ‘এখন ওদের ভাল লাগলেই হয়!’
‘লাগবে! লাগবে!’ বলে উঠল ডন, একান-ওকান হাসি ওর মুখে।