নিকষছায়া – ৫

একটু আগেই বড়সাহেবের কাছে ধাতানি খেয়েছেন। মেজাজটা খিচড়ে আছে অমিয়র। বড়সাহেব আবার তাঁর বড়সাহেবের কাছে ধাতানি খেয়েছেন। আসলে ধাতানি ব্যাপারটাই ওপর থেকে নীচের দিকে নামে এবং যত নীচে নামে তার তেজ তত বাড়তে থাকে। অমিয়র উচিত ছিল তাঁর অধস্তন দীপক পালকে ধাতানি দেওয়া। কিন্তু অমিয় সেটা করেননি। কারণ কবে গভীর রাতে কার বডি কোথা থেকে হাপিস হয়ে যাবে সেটা কারও পক্ষেই আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। যদিও এটাই এখন বারসাত থানার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলা হাসপাতাল থেকে যে বডি হাপিস হয়েছিল তা নিয়ে খুব একটা জলঘোলা হয়নি। কিন্তু পরের বডিটা ছিল এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তির। আর প্রভাবশালীরা কখনওই লোকাল থানাকে ভরসা করতে পারেন না। তাঁরা সরাসরি ওপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে গতকাল রাতেই ওসি সাহেব এস পি সাহেবের ফোন পেয়েছেন এবং সকাল হতে না হতেই অমিয়কে ছুটে আসতে হয়েছে জেলা হাসপাতালে। স্বর্গরথের হেল্পার সমীর দলুই এখন এখানেই ভর্তি। পরশু রাতে যখন ছেলেটাকে এখানে নিয়ে আসা হয় তখন তার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। অমিয় জানেন, ছেলেটি এখন কোনও মতেই এজাহার দিতে পারবে না তবু কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। অবশ্য অমিয় যে এই বডি উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটাকে হালকা ভাবে দেখছেন তা নয়। বরং বিশে ডোমের মুখে যা শুনেছিলেন তাতে তিনি রীতিমতো চিন্তিত। কারণ বিশের সাক্ষ্য তাঁর একটি পুরনো স্মৃতি এবং একই সঙ্গে একটি গোপন ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলেছে। কপালের রগদুটো চেপে ধরে তাই চুপ করে বসেছিলেন অমিয়। একটি মহিলা কণ্ঠ কানে এল, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনি আসতে পারেন।

মুখ তুলে তাকাতেই যেন হাজার ভোল্টের শক খেলেন অমিয়। দরজার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা ডাক্তার। তিনিই এইমাত্র পেশেন্টের জ্ঞান ফেরার খবর দিয়েছেন। ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন অমিয়, বিস্ময়ে বলে উঠলেন, তিতাস তুই!

একই রকম বিস্মিত হয়েছিলেন মহিলা ডাক্তারটি। ধীরে ধীরে সে বিস্ময় কেটে তাঁর মুখে ফুটে উঠল পরিচিত হাসি, ইয়েস। দিস ইজ ডক্টর তিতাস সেন। আই হোপ আই অ্যাম স্পিকিং উইথ মিস্টার অমিয় বোস, এস আই, বারাসাত থানা? অবশ্য আমার কাছে অন্য একটা পরিচয় বেশি গ্রহণযোগ্য। অমিয় বোস, ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্স, প্রেসিডেন্সি কলেজ?

অমিয় এক গাল হেসে ঘাড় নাড়লেন আর সেই মুহূর্তে ওখানে উপস্থিত দু’চারটি পেশেন্ট পার্টি, দু’জন নার্স, এক জন ওয়ার্ড বয় অবাক হয়ে দেখল, তুখোড় শল্য চিকিৎসক তিতাস ম্যাডাম প্রায় উড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন পুলিশ অফিসারটিকে এবং দীপক পাল পাল অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর বস এই আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর কোনও চেষ্টাই করছেন না।

আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে প্রথম কথাটা অমিয়ই বলল, আমি আগেই দেখেছি পেশেন্ট ডক্টর তিতাস সেনের আন্ডারে আছে কিন্তু বিশ্বাস কর, সেই তিতাস যে এই তিতাস আমি ভাবতেও পারিনি।

তিতাস বলল, আমাকেও বলা হয়েছিল বারাসাত থানার এস আই অমিয় বোস পেশেন্টের এজাহার নিতে আসবেন। শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেছিল জানিস? ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের পেশেন্ট তার আবার এজাহার কি? কিন্তু সেই অমিয় যে এই অমিয় আমিও তো ভাবতে পারিনি।

অমিয় চিন্তিত হয়ে পড়ল, পেশেন্টের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। এই যে বললি জ্ঞান ফিরেছে?

তিতাস হাসল, ওমনি জেরা শুরু করে দিলি তো? হ্যাঁ, জ্ঞান ফিরেছে। তুই এজাহার নিতে পারবি। অবশ্য যা অবস্থায় এসেছিল অন্য কেউ হলে কবে রেসপন্স করত বলা মুশকিল কিন্তু এই পেশেন্টের সাথে আর পাঁচ জনের ফারাক আছে। পেশেন্টের নাম কইমাছ সমীর। মৃত্যুকে পাঞ্জায় হারিয়ে দেওয়াতে ওর খুব হাতযশ।

অবাক হয়ে অমিয় বলল, মানে?

মানে তোকে পরে বোঝাব। আগে ক্যাফেটেরিয়ায় চল। এক কাপ কফি খাব একসাথে। তার পর অন্য কথা।

এখন কফি খাব? আগে কাজের কথাটা সেরে নিলে হতো না?

আমায় কাজ দেখাস না। ছেলেটাকে আর একটু রেস্ট নিতে দে, ধমকে উঠল তিতাস।

এ বারও অবাক হয়ে দীপক পাল দেখলেন, মহিলা ডাক্তারটির কথায় বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় নাড়লেন তাঁর বস এবং বললেন, আসুন পালদা। তবে এক কাপ কফিই খাওয়া যাক।

কফি খাওয়া সেরে বিল মিটিয়ে তিতাস বলল, তোরা আয়। আমি সমীরকে রেডি করছি।

করিডোর দিয়ে হাঁটছিলেন অমিয় আর দীপক পাল। দীপক পাল বললেন, একটা কথা বলব স্যার?

না তাকিয়েই অমিয় উত্তর দিলেন, যা ভাবছেন তা নয়। ইনি আমার এক বন্ধুর প্রেমিকা। তাও প্রাক্তন।

ওই যে পল্লব বলে একবার যার কথা উঠল তিনিই কি?

হ্যাঁ।

ওহ! উনি তো বললেনই তিন বছর পল্লববাবুর সাথে যোগাযোগ নেই।

হুম।

আর একটা কথা বলব স্যার?

ঘুরে তাকালেন অমিয়। দীপক পাল একটু ইতস্তত করে বললেন, ছাত্রাবস্থায় এই ম্যাডামের প্রতি আপনার একটু দুর্বলতা ছিল তাই না স্যার?

মুহূর্তে লজ্জিত হলেন অমিয়। এত বছর পরেও অধস্তন সহকর্মীর অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে গেছে তিতাসের প্রতি তার প্রচ্ছন্ন অনুরাগ। হ্যাঁ, অস্বীকার করবে কী করে অমিয়, তিতাসকে তার ভাল লাগত না? বরং একটু বেশি রকমই ভাল লাগত। কলেজ ফেস্টে আলাপ হয়েছিল তাদের।

সে বার প্রেসিডেন্সির ফেস্ট মিলিউয়ের দায়িত্বে ছিল অমিয়দের ব্যাচ। অমিয়, সুপ্রতিম, পল্লব একে বারে জান প্রাণ দিয়ে খাটছে তখন। এ বারের মিলিউকে গত দশ বছরের সেরা মিলিউ করে তুলতেই হবে। চার দিন ধরে মিলিউ চলে। চার দিনের শো স্টপার ফাইনাল হয়ে গেছে। প্রীতি পটেলের মণিপুরি ফায়ার ড্যান্স, চন্দ্রবিন্দু, কবীর সুমন আর ইন্ডিয়ান ওশান। এ ছাড়াও রয়েছে আরও নানাবিধ ইভেন্ট। এরই মধ্যে একটা ইভেন্ট ছিল ‘ব্যান্ডম্যানিয়া’ নামে যেখানে বাইরের কলেজের ব্যান্ডরা পারফর্ম করত। সেই ইভেন্টে মেডিক্যাল কলেজের একটা ব্যান্ড নিজেদের নাম এন্ট্রি করিয়েছিল সে বার। ব্যান্ডের নাম ‘লোকায়ত’। মেডিক্যাল কলেজ এবং ‘লোকায়ত’ নাম শুনেই ফ্যাক করে হেসে উঠেছিল পল্লব। বলেছিল, ডাক্তার এবং ফোক গান! ভারী অদ্ভুত কম্বিনেশন তো। এরা কী গান গাইবে আমি এখনই বলে দিতে পারি।

সুপ্রতিম বলেছিল, বল কী গাইবে?

চেনা গানের সুর ধার করে করে পল্লব প্যারোডি গেয়ে উঠেছিল, ‘আগে জানলে… আগে জানলে তোর ডাক্তারখানায় আসতাম না।’

হেসে উঠেছিল সবাই। এমনকী সদাগম্ভীর সঞ্জয়ের ঠোঁটের কোণেও দেখা দিয়েছিল হাসির রেখা। কিন্তু এই হাসাহাসি হাশহাশ ফিসফিসে পরিণত হয়েছিল ‘লোকায়ত’ স্টেজে ওঠার পর। ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান ব্যান্ডানা পরা একটা ছিপছিপে সুন্দর শ্যামলা মেয়ে দরাজ গলায় গান ধরেছিল, ‘কী ঘর বান্ধিমু আমি শূন্যের মাঝার/লোকে বলে/ও বলে রে/ঘরবাড়ি ভালা না আমার…’

বাংলার মাটির সুরের তালে তালে সে দিন প্রেসিডেন্সিকে নাচিয়ে ছেড়েছিল ‘লোকায়ত’। যথারীতি প্রথম পুরস্কার তারাই জিতেছিল। আর একই সাথে ব্যান্ডানা পরা মেয়েটি জিতে নিয়েছিল অনেকের হৃদয়। সেই তালিকায় অমিয় এবং পল্লবও ছিল। তার পর থেকে অনেকেই বিকেলবেলা ভিড় করত মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনে। নানারকম ভাবে তিতাসের চোখে পুরুষশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা করত। কিন্তু কী জানি কী করে শুধু মাত্র গোটা চারেক কবিতা লিখেই তিতাসকে একেবারে বধ করে ফেলেছিল পল্লব। তার পর থেকে বহু প্রেমিকের হৃদয় মাড়িয়ে পল্লবের হাত ধরে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় লঘু মরালীর মতো ভেসে বেড়াত তিতাস সেন।

না এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল না অমিয়র। সে জানত, সুন্দরী শিক্ষিত মেয়েরা কবিতায় বশীভূত হয়। সংবিধানের ধারা মুখস্থ বলে তাদের মন জয় করা যায় না। কিন্তু আশ্চর্য পরিচ্ছন্ন মনের মেয়ে তিতাস। অমিয় তাকে পছন্দ করে এবং পল্লব-অমিয় অভিন্নহৃদয় বন্ধু জানার পরেও সে কখনও কোনও গ্লানিবোধ করায়নি অমিয়কে বরং বন্ধুত্বের নিবিড় মর্যাদা দিয়েছিল। সুপ্রতিমের ঘটনাটা ঘটার পরে অমিয় যখন সঞ্জয় আর পল্লবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তখন থেকে তিতাসের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পল্লব আর তিতাসের প্রেমটা ওদের বন্ধুমহলে দারুণভাবে সেলিব্রেটেড ছিল তাই যোগাযোগ না থাকলেও অমিয় কানাঘুষোয় জানতে পেরেছিল তিতাস আর পল্লবের ব্রেক আপ হয়ে গেছে। আজ এতদিন পর তিতাসের মুখোমুখি হয়ে তার সেই পুরনো অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। ভারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু বুদ্ধিমতী তিতাস একবারও সুপ্রতিম কিংবা সঞ্জয়ের প্রসঙ্গই উত্থাপন করেনি।

প্রাথমিক লজ্জার ভাবটা কাটিয়ে অমিয় দীপক পালকে বললেন, বাব্বা! আপনার তো দারুণ নজর পালদা। এইটুকুতেই বুঝে ফেললেন যে ছাত্রাবস্থায় ম্যাডামের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল?

মৃদু হাসলেন দীপক পাল, মুর্শিদেরা কী বলেন জানেন স্যার? প্রেমের লক্ষণ হচ্ছে প্রকাশ। প্রেমের একটা অদ্ভুত জ্যোতি আছে। একটা উত্তাপ আছে। আপনি যতই ঢেকে চেপে রাখুন ও ঠিক বোঝা যাবেই যাবে। তবে আজ আমার একটা ভুল ভাঙল। আপনাকে এদ্দিন মনে হতো নীরস। আজ দেখছি, নাহ, ঠিকই আছে।

হেসে ফেললেন অমিয়। কথা বলতে বলতে তাঁরা আইসিইউ-এর কাছে চলে এসেছেন। এক জন নার্স ডাকল, স্যার, আপনারা আসুন। ম্যাডাম ডাকছেন।

কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন অমিয়রা। সমীর দলুইয়ের বেডটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা আছে। তিতাস চাপা গলায় বলল, ওকে বেশি একসাইটেড করিস না কেমন?

মাথা নাড়ল অমিয়। চাপা গলাতেই জিগ্যেস করল, ইনজুরিটা কী?

কী নয়? কত? পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে আর মাথায় চোট পেয়েছে। ১৪টা সেলাই পড়েছে। অদ্ভুত জীবনীশক্তি এই ছেলের। তোরা কথা বলে নে। আমি একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।

সমীরের গল্পটা কফি খেতে খেতেই শুনেছিলেন অমিয়। তাই ওঁদের দেখে শুয়ে শুয়েই সমীর যখন বাঁ হাত তুলে কপালে ঠেকাল অমিয় অবাক হলেন না। একটা টুল টেনে পাশে বসে বললেন, এখন কি একটু ভাল আছ?

সমীর বলল, তিতাস ম্যাডাম ছুঁয়ে দিয়েছেন। আমার আর কিচ্ছু হবে না। তা ছাড়া আমাকে জলদি ফিটও হতে হবে স্যার। ওই মালটা ম্যাজিশিয়ান হোক, ভূত হোক, পিচাশ হোক আমি কেয়ার করি না। ওর জন্য গুরুর এই হাল হয়েছে, ওর পুটকি জ্যাম না করে তো আমি ঘুমোতে পারব না। ওর স্যাটা যদি আমি না ভেঙেছি আমার নাম সমীর দলুই না। আমি এক বাপের বাচ্চা না। আমার মা তবে খুচরো নিত স্যার।

সমীর আরও কিছু বলত হয়তো কিন্তু তার আগেই দীপক পাল ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন, থাক থাক আর বলতে হবে না। বুঝেছি। তা কী হয়েছিল একটু খুলে বলো তো।

আইসিইউ থেকে যখন বেরিয়ে এলেন অমিয়র মুখ থমথম করছে। দীপক পালের কপালেও ভ্রুকুটি। দীপক পাল বললেন, দুটো কেসেই এই মোটা আর বেঁটে লোকটার কথা শুনলাম। আর দুজনের বয়ানই অবিশ্বাস্য। ধরে নিলাম, বিশে ডোম মদের ঘোরে ভুলভাল দেখেছে কিন্তু সমীর তো মদ খায়নি সে দিন। রিপোর্টেও দেখা গেছে ব্লাডে অ্যালকোহল নেই। তা হলে?

উত্তর দিলেন না অমিয়। তিনি এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছেন, তিনি যা সন্দেহ করছিলেন তাই। বিশে বা সমীর কেউই ভুল দেখেনি। যদিও ভুল দেখলেই ভাল হতো।

. . .

গম্ভীর মুখে থানায় ঢুকতেই একটা রোগা মতো লোক ছুটে এসে পা জড়িয়ে ধরল, স্যার আপনি মাইবাপ। একবার আমার কথাটা শোনেন।

ছুটে এসে কনস্টেবলরা ছাড়িয়ে নিল তাকে। একজন সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিল লোকটার গালে, ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলি যে! স্যার কী তোর শ্বশুর?

হাঁ হাঁ করে উঠলেন অমিয়, আহা মারছেন কেন? ওনাকে আমার ঘরে নিয়ে আসুন। পালদা আপনিও আসুন।

লোকটা কিছুতেই চেয়ারে বসতে রাজি নয়। সে অমিয়দের পায়ের কাছেই উবু হয়ে বসল হাত জোড় করে। নাম তার চরণ। সে বিশে ডোমের আপন পিসতুতো দাদা। জীবিকায় সেও ডোম। শ্মশানে মড়া পোড়ায়। সে শুনেছে, এই সারের জন্যই বিশের জেল হতে হতে হয়নি তাই সে আজ ছুটে এসেছে। ভোরবেলায় এমন একটা কান্ড হয়েছে যা সারকে না বললেই নয়। ঘটনাটা হল, গতকাল শেষ রাতের দিকে একটা বডি আসে শ্মশানে। আজকাল ইলেকট্রিক চুল্লি হয়ে গেছে তাই ঝামেলা অনেক কম। চুল্লি গরম হলে বডি ঢুকিয়ে দাও ব্যাস। চল্লিশ মিনিট পর কাম তামাম। পার্টির হাতে নাইকুণ্ডলী তুলে দিয়ে বকশিস নিয়ে ছুটি। তা আজ বডি ঢোকানোর পরে পরেই খুব পচা একটা গন্ধ উঠেছিল আচমকা। তার পর আবার গন্ধটা মিলিয়েও যায়। তা যাই হোক, তখন সেই নিয়ে মাথা ঘামায়নি চরণ। কিন্তু চমকে উঠেছিল চুল্লি থেকে ছাই বার করার সময়। নাইকুণ্ডলী নেই!

অবাক হলেন অমিয়, মানে?

চরণ বলল, আজ্ঞে স্যার চুল্লির ভিতর বডি ছিল না। যা ছাই হয়েছিল তা ওই কাঠের চাটাই পোড়া ছাই।

দীপক পাল ধমকে উঠলেন, ছাই দেখে তুমি বুঝে গেলে ওটা মানুষ পোড়া না চাটাই পোড়া?

চোখ কপালে তুলে চরণ বলল, কী বলেন সার? বুঝব না? চল্লিশ বচ্ছর ধরে এই কাজ করছি। ছাই দেখে বলে দেব মানুষ পুড়েছে না বেড়াল।

দীপক পাল বললেন, কিন্তু তা কী করে সম্ভব? চুল্লি তো তুমি নিজে বন্ধ করেছিলে।

হ্যাঁ সার। নিজে হাতে বন্ধ করেছি।

তা হলে?

সেটাই তো প্রশ্ন সার। ওই চুল্লির মধ্যে থেকেই বডি গায়েব হয়ে গেছে। বিশে ওই পচা গন্ধের কথা বলেছিল। তাই সকাল হতেই আমি ছুটে এসেছি সার। এমন আজব ঘটনা আমি আমার বাপের কালে দেখিনি।

চরণ হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই গম্ভীর মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অমিয়। পিছু পিছু বেরিয়ে এলেন দীপক পালও। অমিয় ততক্ষণে ফোনে কথা বলতে শুরু করেছেন, হ্যালো তিতাস, অমিয় বলছি… আসলে জরুরি কাজ ছিল তাই দেখা না করেই চলে এলাম… না না, আমি আবার যাব… বলছি শোন না, একটা দরকার ছিল। বলছি, পল্লবের নম্বর আছে তোর কাছে… আচ্ছা মেসেজ করে দিস… থ্যাঙ্ক ইউ। রাখছি এখন।

দীপক পাল অবাক হয়ে বললেন, পল্লববাবুর নম্বর কী হবে স্যার? এই কেসের সাথে ওনার যোগাযোগ আছে না কি?

অমিয় বললেন, না, তবে যার সাথে যোগাযোগ আছে তার সাথে একমাত্র পল্লবেরই যোগাযোগ আছে।

দীপক পাল চিন্তিত গলায় বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো স্যার, আপনাকে অতিরিক্ত চিন্তিত লাগছে। কেসটার ব্যাপারে কিছু ধরতে পারলেন? এমন আজগুবি কেস তো আমি আর কেরিয়ারে দেখিনি।

ক্লান্ত শোনাল অমিয়র কণ্ঠস্বর। বললেন, পেরেছি পালদা আর সেই জন্যই চিন্তিত। ভয়ানক অসম একটা লড়াইতে নামতে চলেছি আমরা।

পল্লব বলল, নিউটাউনের রাস্তাটা ধরে নিচ্ছি। ১২ কিলোমিটার বেশি ঘোরা হয় তবে এই বিকেলবেলা জ্যাম কম থাকবে আর রাস্তাটাও সুন্দর।

সঞ্জয় বলল, যেটা ভাল হয় কর। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে না তো? অমিয় যে বলেছিল দেরি না করতে।

পল্লব একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে তার পর বলল, আমি মানুষটা ভাল। কিন্তু তুই আমার চেয়েও ভাল।

সেটা কথা না পল্লব। আমি তো তোকে শুরু থেকেই বলছি, বিপদটা আমার একার নয়। এ বিপদ অনেকের। বাই চান্স অমিয় সেটায় জড়িয়ে পড়েছে। আর আমি তো কোনও ইঙ্গিতই পাচ্ছিলাম না যে বিপদটা কোন দিক দিয়ে আসতে পারে। সেটার যখন একটা সূত্র পাওয়া গেছে তখন আর পুরনো কথা মনে রেখে সেটাকে অগ্রাহ্য করা মূর্খামি হতো। তা ছাড়া অমিয় তো আমাদের বন্ধু। আমি আজও ওকে ভালবাসি। যতই রাগ করিস না কেন, আমি জানি তুইও বাসিস।

উত্তর দিল না পল্লব। গাড়িটাকে ঠেলে দিল ফিফথ গিয়ারে। নিউটাউনের প্রশস্ত রাস্তায় হু হু করে ছুটতে লাগল পল্লবের নতুন স্যান্ট্রোটা।

অমিয়র ফোনটা এসেছিল এগারোটা নাগাদ। গত রাতে সঞ্জয়ের ঘুমোতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। অনেক কষ্টে ঘুম এসেছিল ভোরের দিকে। পল্লবও জেগে ছিল সঞ্জয় না ঘুমনো অবধি। ফলে আজ উঠতে একটু বেলা হয়েছিল। বেলা করেই তাই ব্রেকফাস্ট করছিল দু’জনে। তখনই বেজে উঠেছিল পল্লবের ফোনটা। আননোন নম্বর দেখে প্রথম বার ধরেনি পল্লব। মিনিট পাঁচেক বাদে সেই একই নম্বর থেকে আবার ফোন। এ বার ফোনটা রিসিভ করেছিল পল্লব, হ্যালো, কে বলছেন?

উল্টোদিক থেকে উত্তর এসেছিল, পল্লব, আমি অমিয় বলছি।

প্রায় তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে থেকেছিল পল্লব। তার পর কঠিন গলায় বলে উঠেছিল, সরি রং নাম্বার।

ফোনটা কেটে দিতে যাবে, ও পার থেকে ভেসে এসেছিল অমিয়র আর্তি, পল্লব প্লিজ, ফোনটা কেটে দিস না। পল্লব। আমি জানি এটাই তোর নম্বর। আমি তিতাসের কাছ থেকে তোর নম্বরটা জোগাড় করেছি।

তিতাস নামটা শুনে থমকে গেছিল পল্লব। মানুষের মনস্তত্ব বড়ই জটিল। একই সাথে একাধিক অনুভূতির খেলা চলে তার অবচেতনে। অমিয়র গলা শুনে যেমন অতীত থেকে একরাশ অভিমান আর রাগ উঠে এসে ফোন কেটে দিতে চেয়েছিল তেমনই তিতাস নামটা শুনে অন্য এক সম্ভাবনায় পুলকিত হয়ে উঠেছিল পল্লবের হৃদয়। অমিয় তিতাসের থেকে তার নম্বর পেয়েছে! তার মানে তিতাসের সঙ্গে অমিয়র যোগাযোগ আছে। অমিয়র সূত্র ধরে তবে কি এক বার হলেও তিতাসের দেখা পাওয়া যাবে? তিন বছর বড় কম সময় নয় কিন্তু একটা মানুষকে ভুলে যাওয়ার পক্ষে খুবই কম। আসলে মনে রাখা যত সোজা, ভুলে যাওয়া তত সোজা নয়। পল্লবের সমস্ত সত্তা জুড়ে আজও তিতাস অমলিন। এখনও বিকেলবেলা পশ্চিমের জানলাটার কাছে দাঁড়ালেই পল্লবের মনে হয়, তিতাস তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। এখুনি পেলব করতলে চেপে ধরবে তার চোখ। তিতাসের চুলের সুবাসে মেদুর হয়ে উঠবে হলুদ বিকেল। চোখ থেকে হাত সরিয়ে পল্লব ঘুরে তাকাবে তিতাসের দিকে। কনে দেখা আলোয় তিতাসকে মনে হবে যেন বিকাশবাবুর অয়েল পেইন্টিং। ঘোর লেগে যাবে পল্লবের চোখে। তিতাস বলবে, কী দেখিস অমন করে?

পল্লব ফিসফিস করে বলবে, দিস ইজ নট রিয়ালিটি। এই কনে দেখা আলোয় তুই আমার সামনে এলেই আমার সব গুলিয়ে যায়। তখন আর তুই আমার ডাইমেনশনে বিলং করিস না। রিয়াল আর সাবরিয়ালের মধ্যে কেমন যেন ভেসে বেড়াস তুই।

উপমাতীত এক আশ্চর্য সুন্দর হাসি ফুটে উঠবে তিতাসের দু’চোখে। লঘু কণ্ঠে সে বলবে, তাই বুঝি?

তার পরই সে এগিয়ে আসবে পল্লবের দিকে। দু’হাতে খুলে দেবে পল্লবের শার্টের প্রথম চারটি বোতাম। উন্মুক্ত করে দেবে পল্লবের বুক। তার ডান হাত পল্লবের নাভি ছুঁয়ে ক্রমশ নেমে যাবে গভীরে আর অসহায় পল্লবের বাম স্তনবৃন্তটি কামড়ে ধরে সে বলে উঠবে, দিস ইজ রিয়ালিটি।

এর পরে যদি পল্লব মরে গিয়ে থাকে তবে কি তাকে দোষ দেওয়া যায়!

এই সমস্ত মৃত্যুগুলোই একত্রিত হয়ে পল্লবকে ফোনটা কাটতে দিল না। পল্লব বলে উঠল, ফোন করেছিস কেন?

জেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্বর্গরথের অ্যাক্সিডেন্ট এবং চরণ ডোমের মুখে শোনা চুল্লির ভিতর থেকে বডি উধাও হয়ে যাওয়া অবধি সবটাই পল্লবকে খুলে বলেছিল অমিয়। তিতাসের সঙ্গে তার কী ভাবে দেখা হয়ে গেছে তাও বলেছিল এবং সব কিছুর পর বলেছিল, আমার মন বলছে, এগুলো সব গেনুর কীর্তি। সঞ্জয়ের সঙ্গে একটু যোগাযোগ করিয়ে দিবি?

গলাটা ফের কঠিন হয়ে গেছিল পল্লবের, কেন? তোর কী ধারণা সঞ্জয় গেনুকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছে?

ফোনটা আসার পরেই পল্লবের অভিব্যক্তির বদল দেখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল সঞ্জয় কিন্তু কোনও প্রশ্ন করেনি। এ বার একই সঙ্গে তার আর গেনুর নাম উচ্চারিত হতে দেখে বিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলেছিল পল্লব। ততক্ষণে ওপার থেকে অমিয় কাতর গলায় বলে উঠেছিল, না না। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস পল্লব। আমি কি পাগল যে ভাবব সঞ্জয় এগুলো করাচ্ছে?

সে বার যখন ভাবতে পেরেছিলি, এ বার না ভাবার কী আছে? নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ ঝরে পড়েছিল পল্লবের গলায়।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর অমিয় বলেছিল, ভুল করেছিলাম পল্লব। সে অপরাধবোধ আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। হয়তো এটাই সঞ্জয়ের কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ।

একটু ভেবে পল্লব বলেছিল, তোর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে অমিয় বাট ক্যান আই ট্রাস্ট ইউ? তুই তো পুলিশ, এই কেসগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে তুই সেই পুরনো কেস খুঁচিয়ে তুলবি না তার কী গ্যারান্টি আছে?

আবার খানিকটা সময় নিয়েছিল অমিয়। পুরনো বন্ধুর কশাঘাতে রক্তক্ষরণ সামলাতে যতটা সময় নেওয়া উচিত, ততটা সময় নিয়েই বলেছিল, প্রথমত ওই কেসে সঞ্জয় বেকসুর খালাস পেয়ে গেছিল। আদালতে প্রমাণিত হয়েছিল ওটা দুর্ঘটনা। দ্বিতীয়ত

কথা কেটে পল্লব বলেছিল, না না, ও সব আমায় শোনাতে আসিস না। পুলিশ সব পারে। আমি স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি অমিয়, সঞ্জয়কে নিয়ে কোনও রকম টানাটানি কিন্তু আমি বরদাস্ত করব না।

বড় করুণ শোনাচ্ছিল অমিয়র গলাটা। সে বলেছিল, আমাকে একটা চান্স দিয়েই দেখ না।

বেশ। আমি সঞ্জয়ের সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।

ফোন রেখে সঞ্জয়ের দিকে ঘুরে বসেছিল পল্লব। অবিশ্বাসের গলায় সঞ্জয় বলেছিল, এত দিন পরে অমিয়? কেন? আর সেই সব পুরনো কথা এখন তা ছাড়া গেনু এর মধ্যে কোথা থেকে এল? গেনু কী করেছে?

অমিয়র থেকে যা শুনেছিল তার সবটাই সঞ্জয়কে খুলে বলেছিল পল্লব। তার পর বলেছিল, এবার তোর ডিসিশন। তুই কি এ সবের মধ্যে জড়াতে চাস?

এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি সঞ্জয়। পুরোটা মন দিয়ে শুনছিল। এ বার উত্তেজিত গলায় বলে উঠেছিল, জড়াতে চাই মানে? আমি অলরেডি জড়িয়ে গেছি পল্লব। আমার মন বলছে, গেনুর না আসা, মামির কান্না, ওই শিস, মেয়েটির চিৎকার এবং এই একের পর এক মৃতদেহ উধাও হয়ে যাওয়া এগুলোর মধ্যে একটা না একটা যোগসূত্র আছে। মামি বলেছিল না ভয়ানক বিপদ আসতে চলেছে। ওই যোগসূত্রটা খুঁজে পাওয়া গেলে হয়তো এই বিপদ আটকানো যাবে। তুই অমিয়কে ফোন কর। বল, আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে সবটা আরও ডিটেলে জানতে হবে।

সঞ্জয় এখানেই আছে শুনে অমিয় বলেছিল, আজ সন্ধে ছ’টা নাগাদ তোরা বারাসাতে আসতে পারবি? আমি তার মধ্যে সব কাজ সেরে রাখব। রাতে আমার এখানেই থেকে যাস।

পল্লব বলেছিল, থাকতে পারব কি না জানি না, তবে আসব। দেখা হচ্ছে।

বেশ। দেরি করিস না কেমন?

আজকাল এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেটের কাছে বেশ জ্যাম হয়। ভিআইপি রোড এখানে যশোর রোডের সঙ্গে মিশেছে তাই গাড়িঘোড়ার চাপটা সব সময়ই বেশি থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় বলল, অন টাইম আছি তাই না?

পল্লব বলল, হ্যাঁ। এখন তো পাঁচটা কুড়ি। জ্যামে না পড়লে ছ’টার আগেই বারাসাত থানায় ঢুকে যাব। যশোর রোড ধরে তো বেশিক্ষণ না।

জ্যামটা সবে ছেড়েছে। টুকটুক করে এগোচ্ছে গাড়িগুলো। এমন সময় বেজে উঠল পল্লবের ফোন। এতক্ষণে অমিয়র নম্বরটা সেভ করে নিয়েছে পল্লব। গাড়ির ব্লুটুথে ফোন কানেক্ট করাই ছিল। স্পিকার অন করে বলল, বল। আমরা এয়ারপোর্ট ক্রস করলাম।

অমিয় বলল, শোন না, আমি একটু ফেঁসে গেছি। এখুনি ওসি সাহেব বললেন ডিএম-এর সঙ্গে একটা মিটিং আছে। আমায় সেটা অ্যাটেন্ড করতে হবে।

মানে? আমরা কি তবে ফিরে যাব?

আরে না না। ঘণ্টাখানেকের মিটিং। আমি বাই সাতটা ফিরে আসব। ততক্ষণ প্লিজ একটু ওয়েট করিস। আমি এ এস আই দীপক পালকে বলে যাচ্ছি। উনি তোদের রিসিভ করবেন। চিন্তা করিস না, পালদা খুবই ভাল মানুষ। ওনাকে বলেছি, তোরা আমার বন্ধু। তোদের কোনও অসুবিধে হবে না। আমি অ্যাসাপ চলে আসব। প্লিজ কিছু মনে করিস না।

না না ঠিক আছে। তুই আয়। আমরা থাকব।

সোজা থানাতেই আসিস কিন্তু। পালদা তোদের জন্য ওয়েট করছেন।

ওকে।

প্রথম দর্শনেই দীপক পালকে ভারী পছন্দ হয়ে গেল ওদের দু’জনের। দীপক পাল বললেন, থানার মধ্যে ওয়েট করে লাভ নেই। থানা হল চোর ছ্যাঁচোড়দের জায়গা। ওখানে ভদ্রলোকেদের মানায় না। তার চেয়ে চলুন, পাশেই বারাসাত স্টেডিয়াম। ফুরফুর করে হাওয়া দেবে। ওখানেই চা খেতে খেতে স্যারের জন্য অপেক্ষা করা যাবে। আর হ্যাঁ শুনুন, আপনাদের বন্ধু আমাকে পালদা বলে ডাকেন। আপনারাও তাই ডাকবেন। কেমন?

পল্লব হেসে বলল, বেশ। তবে তাই হোক।

গাড়িটা থানার মধ্যে পার্ক করে রেখে ওরা তিন জন মিলে এগিয়ে চলল স্টেডিয়ামের দিকে। দীপক পাল বলতেই দারোয়ান গেট খুলে দিল। লম্বা সেলাম ঠুকল। পল্লবদের দেখিয়ে দীপক পাল দায়োয়ানকে বললেন, মেজোবাবুর কলেজের বন্ধু। কলকাতা থেকে এসেছেন। সামনের চায়ের দোকানে বলে এসো তো ভাল করে তিনটে স্পেশাল চা বানাতে।

দারোয়ান ছুটল চায়ের কথা বলতে। পায়ের নীচে সবুজ গালিচার মতো ঘাস। সে দিকে দেখিয়ে দীপক পাল বললেন, ঘাসে বসতে আপত্তি নেই তো?

চোখাচোখি হল পল্লব আর সঞ্জয়ের। মৃদু হেসে পল্লব বলল, একটা সময় দিনের বেশির ভাগটাই এই ঘাসের ওপর বসে কেটে যেত। বিশেষ করে শীতকালগুলো। দশটা নাগাদ কলেজে ঢুকে সেই যে প্রেসিডেন্সির মাঠে রোদে পিঠ পেতে বসতাম, শিকড় গজিয়ে যেত। শেষমেশ রাত আটটা নাগাদ পাপ্পুদার তাড়া খেয়ে হস্টেল ফিরতাম।

ঘাসের ওপর বসতে বসতে দীপক পাল বললেন, স্যারের কাছে আপনাদের কলেজের অনেক গল্প শুনেছি। এক বার কলেজের কথা শুরু হলে স্যার আর থামতেই চান না। আপনাদের চার জনের কথাও অনেক শুনেছি। তা সুপ্রতিমবাবু এলেন না?

চমকে উঠল পল্লব আর সঞ্জয়। তার পর দীপক পালের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে পল্লব বলল, না। ও আসতে পারেনি।

অমিয় যে গল্পগুলো দীপক পালকে বলেছে সেই গল্পের সময়কাল আজ থেকে দশ বারো বছর আগের। দীপক পালের কাছে তাই প্রেসিডেন্সি কলেজ সেই সময়েই থমকে আছে। তখনও তো হিন্দু হস্টেলের ছাদে পল্লব, অমিয়, সঞ্জয় আর সুপ্রতিম নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছে। কোয়াডে জমে উঠছে তর্ক, ক্যান্টিন ভেসে যাচ্ছে সুমনের গানে। কত আঙুল জড়িয়ে যাচ্ছে কত আঙুলের সাথে। কত না বলা বাণীর ব্যাকুলতা নিয়ে বেজে উঠছে গিটার আর হারমোনিকা। সুপ্রতিম তখন মেন বিল্ডিং এন্ড থেকে ছয় মেরে পার করে দিচ্ছে ডিরোজিও হলের ছাদ।

অমিয় হয়তো ইচ্ছে করেই সবটা বলেনি দীপক পালকে। ওরাও ভুলটা ভাঙাল না। কিছু কিছু ভুল না ভাঙানোই থাক।

চা নিয়ে এল একটা বাচ্চা ছেলে। ছেলেটা খুবই ছোট। বয়স খুব জোর সাত কি আট। খুব রোগা কিন্তু ভারী সুন্দর মুখখানা। মায়াভরা বড়বড় দু’টো চোখ। ছেলেটাকে দেখেই রেগে গেলেন দীপক পাল। বললেন, এরা আবার বাচ্চাদের দিয়ে খাটাচ্ছে! দাঁড়ান তো, গেলাস ফেরত দেওয়ার সময় আচ্ছা করে ঝাড়ব। যা তুই চলে যা। বলবি, আমরা গেলাস ফেরত দিয়ে দেব। তখনই দাম দিয়ে দেব।

কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাটা চলে গেল। বাচ্চাটার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আনমনা গলায় সঞ্জয় বলে উঠল, এই চাইল্ড লেবার ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে।

দীপক পাল বললেন, সত্যিই তাই। বাচ্চাটার কপাল খারাপ। গরিব দেশে জন্মেছে, তাই ইশকুলে না গিয়ে আমাদের চা দিতে হচ্ছে। মালিকের সাথে কথা বলব। দেখি যদি বাচ্চাটার কিছু একটা গতি করতে পারি।

পল্লব অবাক হল, কী গতি করবেন?

দীপক পাল হাসলেন, ওই আর কী? ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দেব। এখানে যা টাকা পায় সেটা ওর মা বাপের হাতে দিয়ে দেব মাসে মাসে। তা হলেই আর পড়াতে আপত্তি করবে না।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পল্লব আর সঞ্জয়। পল্লব বলল, অদ্ভুত মানুষ তো আপনি! কিন্তু এমন করে ক’ জনের জন্য করবেন?

একটু হাসলেন দীপক পাল, যতটুকু আমার সামর্থ্য। একটা পয়েন্টের পরে তো আর পেরে উঠব না, তখন হাত জোড় করে বলব, মাপ কর বাপ। তোরটায় এসে আটকে গেছি। আসলে কী বলুন তো, আমার খালি মনে হয় আমার মেয়ে মিতুল সেও যদি এমন গরিব ঘরে জন্মাত তারও তো এই অবস্থা হতো। তাই না?

সঞ্জয় বলল, অনেকটা শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আপনার ওপর। আজকালকার দিনে ক’জন ভাবে এমন করে?

উৎকণ্ঠিত হলেন দীপক পাল, আরে না না। ও সব কিছু না, তার পর হেসে বললেন, আমি খুব কর্মফলে বিশ্বাস করি জানেন তো? আমি বিশ্বাস করি, এ জন্মের কর্মফল এ জন্মেই চুকিয়ে যেতে হয়। তাই ভাল কিছু করার চেষ্টা করি যাতে কেস না খাই।

পল্লব কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই দীপক পালের ফোন বেজে উঠল। দীপক পাল বললেন, মনে হয়ে স্যারের হয়ে গেছে। বুঝলেন?

কিন্তু ফোনটা বার করেই নেতিবাচক মাথা নাড়লেন তিনি, স্যার নয়। হোম মিনিস্টার।

থানার এ এস আই-এর কাছে হোম মিনিস্টারের ফোন! ব্যাপারটা বুঝতে দু’সেকেন্ড সময় লাগল ওদের। তার পর হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণায়। ফোন ধরে দীপক পাল বললেন, বলো গিন্নি।

একতরফা কথা শুনতে পাচ্ছিল ওরা। দীপক পাল বলছিলেন, আরে ফেরেনি তো কী? ফিরে আসবে। এত চিন্তা করো কেন? উঠতি বয়েসের মেয়ে একটু এদিক ওদিক যাবে না। ঠিক আছে রাখো তুমি। আমি দেখছি।

পল্লব বলল, কী ব্যাপার পালদা? এনিথিং রং?

দীপক পাল বললেন, আরে না না। আমার গিন্নি অতিরিক্ত টেনশন করে। ছ’টা বেজে গেছে, মেয়ে কেন এখনও ফেরেনি তাই নিয়ে চিন্তিত। পাঁচটায় কলেজ ছুটি হয়। হয়তো একটু গল্পগুজব করছে। আসলে ফোনটা বন্ধ দেখে ভড়কে গেছে। চলুন তো, একবার কলেজ থেকে ঢুঁ মেরে আসি। এই তো সামনেই। বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ।

চায়ের ফাঁকা গেলাসগুলো হাতে নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল স্টেডিয়াম থেকে। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকেই চায়ের দোকানটা। ওদেরকে খালি গেলাস হাতে আসতে দেখে মালিক একেবারে হাঁ হাঁ করে এগিয়ে এল, আপনারা কেন খালি গ্লাস নিয়ে এলেন স্যার? ওখানেই রেখে দিতেন।

হ্যাঁ, বাচ্চাটাকে আবার খাটাতিস, কথা শেষ করতে দিলেন না দীপক পাল।

দোকানের মালিক যেন আকাশ থেকে পড়ল, বাচ্চা! বাচ্চা কোথায় পেলেন স্যার?

ধমকে উঠলেন দীপক পাল, ন্যাকা সাজছিস না কি? কার হাত দিয়ে চা পাঠিয়েছিলি তুই?

কেন স্যার? আমার হেল্পার ভানুর হাতে। ওই তো চা দিয়ে আসে। কিন্তু ভানু তো বাচ্চা নয়। দামড়া মাল।

খুবই অবাক হল ওরা। দীপক পাল চোখ সরু করে বললেন, তোর দোকানে একটা সাত আট বছরের মিষ্টি মতো ছেলে কাজ করে না?

দু’হাতে কান ধরল দোকানের মালিক, মায়ের দিব্যি স্যার। থানার উল্টোদিকে দোকান করে বাচ্চা লেবার রাখব? আমার কি মাথাফাতা খারাপ?

একটু থমকে গেলেন দীপক পাল। তার পর বললেন, তা হলে তোর ওই হেল্পারটাই গুপি করেছে। সে আবার হেল্পার রেখেছে। হেল্পারের হেল্পার। লুঙ্গির বুকপকেট। ডাক ব্যাটাকে।

মালিক বলল, স্যার, ওকে তো একটু আগে ছুটি দিয়ে দিলাম। মায়ের অসুখ বলছিল। কাল তো আসবে স্যার। আমি নিজে কান ধরে ওকে আপনার সামনে হাজির করব। যদি ও এ কাজ করে থাকে ওকে দিয়ে আপনার জুতো চাটাব স্যার।

ঠিক আছে। কাল ওকে নিয়ে আসবি। আসুন। এ দিকে কলেজ।

পথ দেখিয়ে ওদের কলেজের সামনে নিয়ে এলেন দীপক পাল কিন্তু এসেই চমকে উঠল ওরা। কলেজ একেবারে শুনশান। গেট বন্ধ ভিতর থেকে। বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কোনও ছাত্রছাত্রী নেই।

আপন মনেই বলে উঠলেন দীপক পাল, কী হল ব্যাপারটা? তার পর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন গেটের কাছে। মোটা লোহার শেকলের সঙ্গে তালা আটকানো। সেটা ধরে ঝাঁকিয়ে ডাক দিলেন, সিকিওরিটি। সিকিওরিটি।

সিকিওরিটি এজেন্সির পোশাক পরা একজন মাঝবয়সি গার্ড তড়িঘড়ি এগিয়ে এল ভেতর থেকে, কী ব্যাপার স্যার?

এখনই কলেজ এমন শুনশান কেন? পাঁচটায় তো ছুটি হয়। ছেলেপুলে কই?

গার্ড বলল, কলেজের একজন প্রাক্তন প্রিন্সিপাল মারা গেছেন স্যার। কলেজ তো আজ দেড়টায় ছুটি হয়ে গেছে।

পল্লব আর সঞ্জয় দেখল, মুহূর্তের মধ্যে একরাশ টেনশন এসে ভর করল দীপক পালের সদাহাস্যময় মুখটায়। রীতিমতো বিপন্ন গলায় তিনি বলে উঠলেন, সে কী! তা হলে মিতুল কোথায় গেল!

সুদেবকে লোকটার সন্ধান দিয়েছিল ধনা। ধনা পাতাখোর। নেশার ঝোঁকে ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ফুঁকে দিয়েছে। এখন নেশা করার জন্য ধনাকে তাই চুরি করতে হয়। চুরি করতে করতে সে অনেক অন্ধিসন্ধি জেনে ফেলেছে। শ্মশানে, কবরে ঘুরে ঘুরে অনেক তান্ত্রিকমান্ত্রিকের সাথেও তার হেভি জান-পহেচান হয়ে গেছে। সে জন্যই ধনার শরণ নিয়েছিল সুদেব। কারণ সে জানত, গায়ের জোরে তন্ময়ের সাথে পারবে না। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত তন্ময়ের কোনও ক্ষতি করতে পারছে ততক্ষণ ঘুম হবে না সুদেবের।

সুদেব তোতলা। একটু না, ভয়ানক রকমের তোতলা। নিজের নামটা অবধি একবারে পুরোটা বলতে পারে না। কখনও সু-তে তার জিভ আটকে যায়, কখনও বা দে-তে। আর এমন জেদি নাছোড়বান্দা জিভ যে কিছুতেই তাকে টাকরা থেকে টেনে নামানো যায় না। এ নিয়ে সবাই তাকে খেপায়। সুদেব ভেবেছিল, স্কুলের পরে তাকে আর এই অপমান সহ্য করতে হবে না, কিন্তু কলেজে উঠেও অবস্থার কিছু হেরফের হল না। বরং এই অপমান আর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কলেজের সহপাঠীরা তো একটা মক ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করেছিল যেখানে সুদেবের জন্য দোভাষী নিয়োগ করা হচ্ছিল। আসলে সুদেবকে নকল করে কে কতটা তোতলাতে পারে এ তারই একটা কদর্য খেলা। তাও মানিয়ে নিয়েছিল সুদেব কিন্তু গত শুক্রবার যে ঘটনাটা ঘটল তার পর থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এর শেষ দেখে তবে ছাড়বে।

সুদেব বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজে হিস্টরি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাদের ক্লাসের মৌপিয়াকে তার বরাবর ভাল লাগে। তা ক’ দিন ধরেই ফিলজফি ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলে তন্ময়, মৌপিয়ার সঙ্গে খুব ঘুরঘুর করছে দেখে সুদেব আর সময় নষ্ট করতে চায়নি। তার ওপর এই তন্ময় আবার ইউনিয়নের পান্ডা। বুলেট চালিয়ে কলেজ আসে। তাই মৌপিয়া একেবারে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আগে সে এক বার নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। শুক্রবার টিফিনের সময় এক তোড়া লাল গোলাপ হাতে হাজির হয়েছিল মৌপিয়ার সামনে। মৌপিয়া প্রথমে একটু থমকে গেছিল তার পর হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল তার ঠোঁটের কোণে। সে বলেছিল, তুই আমাকে ভালবাসিস সুদেব?

মৌপিয়া তার উপহার প্রত্যাখ্যান করেনি, উল্টে নিজে থেকে ভালবাসার কথা বলেছে! কৃতার্থ হয়ে গেছিল সুদেব। জোরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। মৌপিয়া বলেছিল তরল গলায়, তা হলে আমাকে এক বার আই লাভ ইউ বল।

সুদেব বলতেই চেয়েছিল। বুকের ভেতর থেকে আই লাভ ইউ বলতে চেয়েছিল, কিন্তু মোক্ষম সময়ে বিট্রে করল তার চিরকালের শত্রু জিভটা। আই-টা সে চমৎকার ভাবে বলে ফেলল। কিন্তু সেই যে লা-তে জিভ টাকরায় আটকাল আর নীচে নামল না। মৌপিয়ার বন্ধুরা তখন খিলখিলিয়ে হাসছে।

চোখে জল এসে গেছিল সুদেবের, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কেন? সে তোতলা বলে কি তার ভালবাসার অধিকার নেই! মাথা নিচু করে সেখান থেকে সরে এসেছিল। চুপচাপ গিয়ে বসেছিল মাঠের এক কোণে। মনে মনে ভাবছিল, এমন জিভ রাখার চেয়ে কেটে ফেলা ভাল। তখনই দলবল নিয়ে হাজির হয়েছিল তন্ময়। কলার ধরে এক ঝটকায় সুদেবকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তন্ময় বলেছিল, আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে নজর দিচ্ছিস কুত্তার বাচ্চা?

সুদেব কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার আগেই তন্ময়ের ঘুষি খেয়ে উল্টে পড়েছিল কাদার মধ্যে। সেই অবস্থাতেই তার পিঠের ওপর পা চাপিয়ে তন্ময় বলেছিল, ফের যদি কোনও দিন আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিস তোর চোখ আমি গেলে দেব শালা হাফটিকিট তোতলা। ফোট শালা।

পাঁজরার ওপর কষিয়ে একটা লাথি মেরে দলবল নিয়ে চলে গেছিল তন্ময়। কাদার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থেকেই সুদেব অনুভব করেছিল, মুখের ভিতরটা নোনতা লাগছে। চিরকালের শত্রু জিভটা দিয়ে সেই রক্ত চেটে নিতে নিতে সুদেব প্রতিজ্ঞা করেছিল, এর শোধ সে নেবেই। তাই ধনাকে গিয়ে বলেছিল, আমাকে এমন কারও একটা সন্ধান দে যে মারণ, উচাটন, বশীকরণ এই সব জানে।

ধনা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, খেয়েছে! তাই দিয়ে তুই কী করবি?

সুদেব বলেছিল, তোর তাতে কী? তুই জানিস কি না বল।

এই বলে ধনার হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিয়েছিল সুদেব। ধনার চোখটা চকচক করে উঠেছিল। টাকাটার গন্ধ শুঁকে বলেছিল, বারাসাত স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মের একদম শেষে জঙ্গল মতো একটা জায়গা আছে না? ওখানে মাঝেমাঝে একটা বুড়োমতো ভিখিরি বসে থাকে দেখবি…

আমার ভিখিরি চাই না। তান্ত্রিক চাই, ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল সুদেব।

আরও বেশি ঝাঁঝিয়ে উঠে ধনা বলেছিল, আগে সবটা শোন ভাই। তার পর তো তো করবি।

চুপ করে গেছিল সুদেব। পাতাখোর ধনা অবধি তাকে তোতলা বলে অপমান করছে! কিন্তু এখন দরকারটা তার। চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অন্য সময় হলে ঠাটিয়ে চড়িয়ে দিত ধনাকে। টাকাটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ধনা বলেছিল, ওই বুড়োটা আসলে ভিখিরি নয়। তান্ত্রিক। হেবি পাওয়ার।

তুই কী করে জানলি? সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করেছিল সুদেব।

ভক্তি বিগলিত চোখে ধনা বলেছিল, সে যা দৃশ্য দেখেছিলাম ভাই! জিন্দেগিতে ভুলব না। হপ্তা দু’য়েক আগের কথা। বেশ রাত তখন। আমি স্টেশনের বাথরুমের দুটো কল খুলে পাঁচ নম্বর দিয়ে বেরিয়ে আসছি হঠাৎ কানে এল কুত্তার চিৎকার। একটু এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, একটা বুড়ো মতো ভিখিরি টাইপের লোক দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনে তিন খানা সড়ালে কুত্তা হেবি ভোক মারছে। পারলে বুড়োটাকে এই খেয়ে নেয়। ভাই বিশ্বাস করবি না, বুড়োটা কিচ্ছু করল না, ছুটল না, ঢিল মারল না, শুধু এক নজরে কুত্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে কুত্তাগুলো চিল্লানো বন্ধ করে দিল। একটা কুত্তা এগিয়ে এসে পোষা বেড়ালের মতো মাথা ঘষতে লাগল বুড়োটার পায়ে।

ফের ধনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল সুদেব, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? যারা কুকুর ভালবাসে তাদের সামনে এমনিতেই কুকুরেরা শান্ত হয়ে যায়। পোষ মেনে যায়। কুকুররা খুব বোঝে কে ভাল আর কে খারাপ।

তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত বার করে হেসে উঠেছিল ধনা, সে কথা আমিও জানি রে বোকাচোদা। কিন্তু তাই যদি হতো এতক্ষণ ধরে গল্পটা তোকে বলতাম না। প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম, কুত্তাটা পোষ মেনে বুড়োটার পায়ের কাছে এগিয়ে এসেছে। বুঝেছে, বুড়োটা খারাপ নয়। কিন্তু তার পর বুড়োটা কী করেছিল জানিস? কুকুরটার পাশে উবু হয়ে বসে পড়েছিল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলছিল, চিল্লাফাল্লা আমার ভাল লাগে না, আর বলতে বলতে কুত্তাটার মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এক টানে ছিঁড়ে বার করে এনেছিল জিভটা। বাকি কুত্তা দু’টো তখন লেজ গুটিয়ে কী দৌড়!

ধনা হাসছিল কিন্তু ভয়ে শিউরে উঠেছিল সুদেব, এ তো পুরো সাইকো!

ধনা বলেছিল, না রে পাগলা। সাইকো না। হেবি বড় তান্ত্রিক। অমন ভিখিরি সেজে থাকে। আমি তো কাণ্ডটা দেখে সোজা পায়ে পড়ে গেছিলাম। কুত্তাদের ওপর আমার হেভি রাগ। রাতের বেলা যখন তখন পোঁদের গোড়ায় এসে ভৌ ভৌ করে। আমার কাছে গাঁজা ছিল, বাবাকে সেজে দিলাম। বাবা বলল, একটা দরকারে ক’দিন এখানে থাকবে। কাউকে বলতে বারণ করেছিল। কিন্তু তুই আমার বন্ধু। তার ওপর মাল্লু দিলি। বাবার কাছে হত্যে দে। লাক ভাল থাকলে বাবার ফেভার পেয়ে যাবি। ওই সব বশীকরণ না হাতের ময়লা।

প্রথমটায় একটু ভয়ই পেয়েছিল সুদেব কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিল, তারও জিভে প্রবলেম এটা ঠিক কিন্তু সে তো মোটেই চেঁচায় না। বরং সে ভাল করে কথা বলতেই পারে না। আশা করা যায় তার জিভটা অক্ষতই থাকবে। সাইকেল নিয়ে গুটিগুটি স্টেশনের দিকে রওনা দিয়েছিল সে।

পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মের শেষের দিকটা বড় বড় গাছে ঝুপসি হয়ে আছে। রেল কারখানার বাতিল যন্ত্রপাতি এখানেই ডাই করে রাখা হয়। জায়গাটা একটেরে। বেশি কেউ একটা আসে না এখানে। ওখানেই লোকটাকে দেখতে পেয়েছিল সুদেব। ধনা যেমন বুড়ো বলেছিল মোটেই ততটা বুড়ো নয়। মাথার চুলগুলো সাদা হয়েছে বটে কিন্তু শরীরে ভাঙন ধরেনি। শক্তপোক্ত গাঁটওয়ালা হাত পা। মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। মাথা নিচু করে বসে কী যেন বিড়বিড় করছিল। এই লোকটা যে অত বড় তান্ত্রিক এ কথা বিশ্বাস হয়নি সুদেবের। পাতাখোর ধনা নির্ঘাত উল্টোপাল্টা বলে টাকাটা গাপ করেছে। কিন্তু সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে রেখে দু’পা এগোতেই চকিতে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়েছিল লোকটা আর তাতেই অন্তরাত্মা অবধি শুকিয়ে গেছিল সুদেবের। মানুষের চোখে যে অমন ঘেন্না থাকতে পারে সুদেব তা কল্পনাই করতে পারে না। ওই হিমশীতল দৃষ্টি যেন সারা দুনিয়ার প্রতি উগরে দিচ্ছিল একরাশ বমি। থতোমতো খেয়ে পিছিয়ে এসেছিল সুদেব। তার বেশ ভয় ভয় করছিল। ফিরে যাবে কি না ভাবছে এমন সময় লোকটা বলে উঠেছিল, কী? ছেলেটাকে একেবারে মেরে ফেলতে চাস?

এত আশ্চর্য বহুকাল হয়নি সুদেব। লোকটা তার মনের গোপন কথা পড়ে ফেলেছে! ছুটে গিয়ে লোকটার সামনে হাতজোড় করে বসে বলেছিল, বাবা আপনি সিদ্ধপুরুষ। আমাকে দয়া করুন।

এ ক’টা কথা বলতে যথারীতি অনেকটা কসরত করতে হয়েছিল সুদেবকে। তার অবস্থা দেখে লোকটা ফ্যাক করে হেসে ফেলেছিল, তোতলাবি তো কথাটা বলবি কখন? তার পরেই আচমকা চুলের মুঠি ধরেছিল সুদেবের। ভয়ে কেঁপে উঠেছিল সুদেব। তার মনে পড়ে গেছিল কুকুরের জিভ ছেঁড়ার ঘটনাটা। সে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন আমায়। আমি কিছু করিনি। আমি বাড়ি যাব।

কিন্তু চেঁচাতে চেঁচাতেই সুদেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিল, সে আর একটুও তোতলাচ্ছে না। বেয়াড়া জিভটা আটকায়নি এক বারও। স্তব্ধ বিস্ময়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল সুদেব। হেসে বলেছিল লোকটা, এখন আর আটকাবে না।

লোকটার পায়ে মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে সুদেব বলেছিল, আপনি আমায় ঠিক করে দিলেন বাবা? আমায় সারিয়ে দিলেন?

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে লোকটা বলেছিল, এখনও দিইনি। যতক্ষণ আমার সাথে কথা বলবি তোর কথা আটকাবে না। এখান থেকে চলে গেলে আবার শুরু হবে তোতলামি। তবে হ্যাঁ, আমার একটা কাজ করে দিলে তোকে পুরোপুরি সারিয়ে দেব আর তোর প্রতিশোধ নেবারও ব্যবস্থা করে দেব।

উঠে বসেছিল সুদেব, বলুন বাবা। যা করতে বলবেন আমি করব।

চোখ সরু করে লোকটা বলেছিল, তোর বয়েস কত?

আজ্ঞে বাবা কুড়ি।

হুম। তোর বয়সি একটা মেয়ের সন্ধান এনে দে আমায়, যার এ বারের মাসিকটা সদ্য শুরু হয়েছে।

এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শোনেনি সুদেব। এর থেকে তো চাঁদ এনে দেওয়া সহজ ছিল। কোন মেয়ের সদ্য পিরিয়ডস শুরু হয়েছে সে জানবে কী করে? এমনিতেই মেয়েরা তাকে পাত্তা দেয় না। সাধারণ কথাই বলে না। সেখানে পিরিয়ডস! হাঁ করে তাকিয়েছিল সে লোকটার দিকে।

সুদেবের চোখে চোখ রেখে লোকটা বলেছিল, পারবা না পারবা না?

অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে সুদেব বলেছিল, বাবা আপনি সিদ্ধপুরুষ। এ সামান্য কাজের জন্য আমায় কেন বলছেন?

গম্ভীর হয়ে লোকটা বলেছিল, মেয়েদের যখন মাসিক চলে তখন তারা আদ্যাশক্তি মহামায়ার আশীব্বাদ লাভ করে। তাদের কাছে আমি যেতে পারব না। কারণ আমার বিপরীত শক্তি। কিন্তু তুই শক্তিহীন, তুই যেতে পারবি। আর গিয়ে মেয়েটার শরীরে এটা বেঁধে দিবি।

ঝোলা থেকে লাল সুতো জড়ানো একটা কালো শুকনো শিকড়ের টুকরো বের করেছিল লোকটা। সেটা সুদেবের হাতে দিয়ে বলেছিল, আর তাতেই মেয়েটা অশুচি হয়ে যাবে। মহামায়ার আশীব্বাদ কাজ করবে না। এটুকুই তোর কাজ। বাকিটা আমি বুঝে নেব।

সুদেবের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। একে তো জানতে হবে কোন মেয়ের সদ্য পিরিয়ডস শুরু হয়েছে, তার ওপর তার শরীরে এই শিকড় বেঁধে দিতে হবে। সুদেব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল খবরের কাগজের হেডিং, ‘গণপিটুনিতে মৃত কলেজ ছাত্র’। প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনা ত্যাগ করে শিকড়টা ফিরিয়ে দিয়ে চলে আসবে বলে সবে মনস্থির করেছে সুদেব, তখনই ভয়ঙ্কর কথাটা বলেছিল লোকটা। বলেছিল, তোর হাতে দুই দিন সময় আছে। যদি আমার এ কাজটা করে দিস তোর সব মনোবাসনা পূর্ণ করব। আর যদি কাজটা না করতে পারিস বা কাউরে এ নিয়ে কিছু বলিস তোর জিভটা ছিঁড়ে ফেলব। চিরকালের মতো বোবা হয়ে যাবি।

ভূতগ্রস্তের মতো স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল সুদেব। সে বুঝতে পারছিল, খুব বড় একটা ফাঁদে পড়ে গেছে কিন্তু এই জাল কেটে বেরবার সাধ্য তার নেই। পাশাপাশি আর একটা সম্ভাবনাও তাকে লোভী করে তুলছিল, এই কাজের বিনিময়ে যদি সারাজীবনের মতো তার তোতলামি সেরে যায় তা হলে এটুকু রিস্ক তাকে নিতেই হবে। এতে সে সুস্থও হবে এবং এই লোকটার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে। শেষমেশ লোভটাই জয়ী হল। সুদেব ঠিক করে ফেলল, যে করে হোক এমন একটা মেয়ের খোঁজ পেতেই হবে। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে লোকটা? যা খুশি করুকগে। সেটা সুদেবের মাথা ব্যথা নয়। আগে তো নিজের প্রাণটা। পরে অন্য কিছু।

এই সব ভাবতে ভাবতেই সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল সুদেব। পাড়ার মুখেই বাবার সাথে দেখা। হাতে দুশো টাকা ধরিয়ে বাবা বলল, তোর মায়ের প্রেশারের ওষুধটা ফুরিয়েছে। আমি তাস খেলতে যাচ্ছি। ভেবেছিলাম ফেরার পথে নিয়ে যাব। কিন্তু যদি দোকান বন্ধ হয়ে যায়! তুই তো বাড়ি ফিরছিস, ওষুধটা নিয়ে যা তো।

ওষুধ কিনে টাকা মেটাচ্ছে সুদেব তখনই পাশের কাউন্টারে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। শ্যামশ্রী, ডাকনাম মিতুল। এ পাড়াতেই থাকে। সুদেবদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। বাবা পুলিশ বলে হেবি ঘ্যাম। এক পাড়ায় থাকে অথচ কোনও দিন সুদেবের সাথে কথা বলেনি। সে দিন যখন মৌপিয়া তাকে হেনস্থা করছিল, এ মেয়েটাও দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসেছিল। সব দেখেছে সুদেব। কিছুই তার নজর এড়ায়নি।

খুচরো ফেরত নিয়ে সবে পেছন ফিরেছে সুদেব তখনই মিতুলের কথাটা কানে এল। মিতুল চাপা গলাতেই বলেছে, তবু কান এড়ায়নি তার। মিতুল প্যাড কিনতে এসেছে। এক মুহূর্তের মধ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে ফেলেছিল সুদেব।

আজ কলেজে গিয়েই নিচু হয়ে পেন কুড়োনোর অছিলায় মিতুলের ব্যাগের একটা খোপে ভরে দিয়েছিল লাল সুতো বাঁধা শিকড়ের টুকরোটা। তার পর আর সে কিছু জানে না। কলেজ হাফ ছুটি হওয়ার পর সে স্টেশনে গেছিল কিন্তু গিয়ে লোকটাকে আর খুঁজে পায়নি। সে জানেও না, এই শিকড়ের সাথে মিতুলের বাড়ি না ফেরার কোনও সম্পর্ক আছে কি না!

থানায় বসে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিল সুদেব। এ বার চোখ মুছে বলল, একটু জল দেবেন স্যার?

ইন্টারোগেশন রুমে একটা চেয়ারে বসেছিল সুদেব। তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছিল অমিয়। পেছনে দাঁড়িয়েছিল পল্লব আর সঞ্জয়। একটু দূরে অন্য একটা চেয়ারে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসেছিলেন দীপক পাল। সুদেবের কথাটা শুনে অমিয় উঠে দাঁড়াল। পুলিশি গাম্ভীর্যে বলে উঠল, নষ্ট করার মতো সময় নেই পালদা। গেট আপ। পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফোর্স পাঠিয়ে দেখুন ওই লোকটাকে পান কি না। যদিও পাওয়া যাবে না বলেই মনে হচ্ছে তবু এই মুহূর্তে আমি কোনও লুপহোল ছেড়ে যেতে চাই না। আর ওই ধনাকে আমার চাই। বাই ওয়ান আওয়ার। ক্লিয়ার?

দীপক পাল উঠে দাঁড়ালেন। টুপিটা ঠিক করে স্যালুট ঠুকে বললেন, ইয়েস স্যার, আর ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বিপন্ন বাবা থেকে এই মুহূর্তে তিনি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পুলিশ অফিসারে রূপান্তরিত হয়েছেন। তখনই আবার কাঁদতে কাঁদতে সুদেব বলল, আমাকে বাঁচান স্যার। ওই লোকটা আমার জিভ ছিঁড়ে নেবে বলেছে।

অমিয় ঘুরে তাকাল সুদেবের দিকে। তার পরেই প্রচণ্ড এক চড়ে তাকে উল্টে ফেলে দিল চেয়ার থেকে।

রাত ন’টা বেজে যেতেও মিতুল যখন ফিরল না তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল অমিয়। এর আগেই মিতুলের ফোনের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে দেখা গেছিল সেটা দুপুর তিনটে নাগাদ কাজিপাড়ার কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই ছুটেছিল সেখানে। একটা বড় আমবাগান। তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিতুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অসহায় হয়ে পড়েছিলেন দীপক পাল। তাকে সামলাচ্ছিল পল্লব আর সঞ্জয়। তখনই অমিয় বলেছিল, এক্ষুনি মিতুলের সব ক্লাসমেটকে থানায় নিয়ে আসুন পালদা। মহিলা পুলিশ নিয়ে যাবেন। আমার মেয়েদেরও চাই। কাউকে বাদ দেবেন না আর কারও বাবা-মাকে আসতে দেবেন না। বলবেন, কথা বলা হয়ে গেলে আমরাই ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে এস পি সাহেবের থেকে স্পেশাল অর্ডার পাস করাচ্ছি। আপনি রেডি হোন।

থানার বাইরে ভিড় করেছিল পঞ্চাশ জন উদ্বিগ্ন ছেলেমেয়ে। তাদের এক এক করে জেরা করা শুরু করেছিল অমিয়। জেরা বলা ভুল, সোজা থ্রেট করছিল তাদের। পদ্ধতিটায় কাজ হল সে তো দেখাই যাচ্ছে। এখনও জনা পনেরো ছেলেমেয়ে বাকি, তার আগেই ভয় পেয়ে সুদেব সবটা বলে দিয়েছে।

অমিয়র ঘরে বসে ছিল ওরা তিন জন। দীপক পাল ফোর্স নিয়ে ধনার খোঁজে বেরিয়েছেন। ইতিমধ্যেই বারাসাত থানায় আরও একটা মৃতদেহ উধাওয়ের অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বারে বডিটা গায়েব হয়েছে একটা বেসরকারি নার্সিং হোম থেকে। ওসি সাহেব নিজেই গেছেন সেখানে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে অমিয় বলল, মনে হচ্ছে এ বার পাগল হয়ে যাব। এক দিকে এই বডি উধাও। তার মধ্যে আবার মিতুলের হারিয়ে যাওয়া! কে ওই লোকটা? সে কি মিতুলকেই টার্গেট করেছিল?

পল্লব বলল, কিন্তু এই সুদেব বলে ছেলেটা যদি সব সত্যি বলে থাকে তা হলে তো মিতুল লোকটার টার্গেট নয়। যে কোনও মেয়ে হলেই চলত, যার সদ্য পিরিয়ডস শুরু হয়েছে।

টেবিলের ওপর ঘুষি মেরে অমিয় বলল, শালা পিরিয়ডসের সাথে কিডন্যাপের কী সম্পর্ক? আর যদি কেউ কিডন্যাপই করে থাকবে এতক্ষণেও একটা ফোন টোন এল না? না রে! আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।

এতক্ষণ আনমনা হয়ে সঞ্জয় কী যেন ভাবছিল। আচমকা বলে উঠল, এক বার সুদেবের কাছে চল তো। ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।

অবাক হল পল্লব, কী কথা?

চল না। তাড়াতাড়ি কর।

সুদেবকে একটা আলাদা সেলে রাখা হয়েছে। অমিয়দের দেখেই আঁতকে উঠল সে। ভয়ে দেওয়ালের কোণে সেঁটে গেল। থরথর করে কাঁপছে ছেলেটা। অমিয় বলল, ভয় নেই। আর মারব না, সঞ্জয়কে দেখিয়ে বলল, ইনি যা জানতে চাইছেন উত্তর দাও।

সঞ্জয়ের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। সে এগিয়ে গিয়ে সুদেবকে বলল, ভাল করে মনে করে দেখো তো, লোকটা যখন কথা বলছিল তখন করবে, খাবে, যাবে এই শব্দগুলোকে কি করবা, খাবা, যাবা এমন করে বলছিল? তা ছাড়া আমরা যখন ‘করবে’ শব্দটা উচ্চারণ করি তখন উচ্চারণটা হয় ‘কোরবে’। কিন্তু এই লোকটা কি ‘করবে’ উচ্চারণ করছিল?

একটু ভেবেই সুদেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ স্যার। কথায় একটা টান আছে লোকটার।

অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল অমিয় আর পল্লব। সঞ্জয়ের অস্থিরতাটা যেন আরও বেড়েছে। সে আবার বলল, তুমি তো লোকটাকে কাছ থেকে ভাল করে দেখেছিলে?

সুদেব মাথা নাড়ল, হ্যাঁ স্যার।

লোকটার একটা হাতের দুটো আঙুল কি ন্যাকড়া দিয়ে জড়ানো ছিল?

বিস্ফারিত চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল সুদেব। তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সঞ্জয় পেছন ফিরল। অমিয়কে বলল, যা বোঝার বুঝে গেছি। আজ থেকে একুশ বছর আগে নিজের দুই ছেলেমেয়েকে খুনের দায়ে লোকনাথ চক্রবর্তী নামে একটা লোকের চোদ্দো বছরের জেল হয়। খোঁজ নিতে পারবি লোকটা জেল থেকে বেরিয়ে কী কী করেছে? কোথায় গেছে? মৃতদেহ উধাও আর মিতুলের হারিয়ে যাওয়া কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ দুইয়ের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ আছে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, গেনু নিজে থেকে কিছু করতে পারে না। সে হুকুমের চাকর মাত্র।

তীব্র বিস্ময়ে পল্লব বলল, লোকনাথ চক্রবর্তী?

ঘাড় নাড়ল সঞ্জয়, ঠিক ধরেছিস। আমার সেই মামা। যে আমায় বলি দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল।

মানুষ অজ্ঞান হয় হঠাৎ করে কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার প্রক্রিয়াটির মধ্যে একটা মন্দ মন্দ ছন্দ আছে। নিঝুম বোধহীনতা থেকে অনুভূতিমালার দিকে যাত্রাটি মন্থর। যে ভাবে সন্ধে হলে পাহাড়ের ঢালে একটি দু’টি করে আলো জ্বলে ওঠে ঠিক সে ভাবেই একটু একটু করে জ্ঞান ফিরে আসছিল মিতুলের। প্রথমেই তার ভয়ানক তৃষ্ণাবোধ হল। গলাটা যেন মরুভূমির মতো খটখট করছে। তার পর সে অনুভব করল তার পায়ের আঙুলে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। সে পা নাড়াতে চাইছে কিন্তু পারছে না। তার পরেই এই বর্ণময় জগতকে দেখবার প্রবল বাসনা হল তার। খুলে গেল বন্ধ হয়ে থাকা আঁখিপল্লব দু’টি আর আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় এক তীব্র ঝাঁকুনি খেল সে। আলোর প্রত্যাশা করেছিল মিতুল। কিন্তু সে দেখল তার সামনে এখন নিঃসীম, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এই অন্ধকারটাই মিতুলকে চুলের মুঠি ধরে আধো অচেতনতা থেকে চেতন করে তুলল আর সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে আসতেই যে অনুভূতিটি মিতুলের সমস্ত চৈতন্য গ্রাস করল, তার নাম ভয়। এক লহমায় মনে পড়ে গেল জ্ঞান হারাবার আগেই মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি ঘটনাক্রম। এখনও মিতুলের মনে হতে লাগল, তার সঙ্গে যা ঘটেছে তা সত্যি নয়। এ আসলে দুঃস্বপ্ন। এখুনি ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে নিজের বিছানায় উঠে বসবে সে আর দরজা ঠেলে উঁকি দেবে একটা হাসিমুখ। সদ্য নাইট ডিউটি শেষ করে ফিরে আসা একটা পুলিশ তাকে বলবে, তোর মা এখনও ওঠেনি। এক কাপ করে চা হয়ে যাক না কি মিতুলবাবা?

দিনটা কিন্তু ভালই শুরু হয়েছিল মিতুলের। ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস টেস্টের খাতা বেরল, তাতে সে টপ করেছে। বন্ধুরা তাই নিয়ে খাওয়া, খাওয়া করে খুব লাফালাফি করছিল। তাই ক্লাস শেষ হতেই ক্যান্টিনে গিয়ে বন্ধুদের ফিস চপ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খাইয়েছিল মিতুল। ক্লাসে ফিরেই খেয়াল করেছিল তার ঠিক পেছনের বেঞ্চটাতেই বসে আছে সুদেব। বড় মায়া হয়েছিল মিতুলের, আহা রে! সে দিন ছেলেটা বড়ই হেনস্থা হয়েছে। মৌপিয়া একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। অবশ্য সেও হেসে ফেলেছিল কাণ্ডটা দেখে কিন্তু এখন হঠাৎ করেই সুদেবের জন্য কষ্ট হতে লাগল তার। সে ঠিক করে ফেলেছিল, ছুটির পরেই সুদেবের কাছে ক্ষমা চাইবে। তারা একই পাড়ায় থাকে, একই সাবজেক্টে অনার্স তবু কোনও দিন কথা হয়নি। ক্ষমা চাইতে গিয়ে কথা বলাও হয়ে যাবে।

সেই পিরিয়ডেই ঘোষণা হল প্রাক্তন প্রিন্সিপাল মারা গেছেন বলে কলেজ হাফ ছুটি হয়ে যাবে। অপ্রত্যাশিত ছুটি পেলে কে না খুশি হয়? মিতুলও হয়েছিল। ভেবেছিল, ফেরার পথে থানায় বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবে। অসময়ে মিতুলকে দেখে নিশ্চয়ই চমকে উঠবে বাবা। কিন্তু তার পরেই আচমকা মাথাটা ধরে গেল। কোথাও কিছু নেই, মাথার মধ্যে একটা চাপ ধরা ভাব। কাল রাত থেকে পিরিয়ডস শুরু হয়েছে। পেটে ব্যথাটাও যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল মিতুলের। ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট এইড বক্স থেকে একটা স্যারিডনও খেল কিন্তু মাথা ব্যথাটা কিছুতেই ছাড়ল না।

দু’আঙুলে কপালের রগ ধরে চুপ করে বসে ছিল মিতুল, তখনই কে যেন বলে উঠেছিল, আয়। আয়।

চমকে উঠেছিল মিতুল। কে ডাকল এমন করে? আশে পাশে সবাই তো যে যার মতো ব্যস্ত! তখনই আবার ডাকটা শুনতে পেয়েছিল মিতুল এবং বুঝতে পেরেছিল, আশপাশ থেকে নয়। ডাকটা আসছে তার মাথার মধ্যে থেকেই। মাথার মধ্যে থেকেই কে যেন তাকে ডাকছে। অদ্ভুত সুরেলা গলায় আকুল হয়ে বলছে, আয়। আয়।

এমন ভাবে যদি কেউ ডাকে তার কাছে কি না গিয়ে পারা যায়? ঘোরগ্রস্তের মতো কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিল মিতুল। ভুলে গেছিল, সুদেবের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা। ভুলে গেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা। মিতুল খেয়ালও করেনি তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠেছিল এক জনের। বলরাম দাদু। তাদের কলেজের গেটের বাইরে সে ফল বিক্রি করে। বলরাম দাদু দু’বার শ্যামশ্রী বলে ডেকেওছিল। কিন্তু শুনতে পায়নি মিতুল। পাবে কি করে? তখন যে তার মাথার মধ্যে একটানা বেজে চলেছে, আয়। আয়।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছিল মিতুল। সে যদি নিজের মধ্যে থাকত তা হলে বুঝতে পারত কাজিপাড়া ছাড়িয়ে আরও ভিতরে চলে এসেছে সে। এখানকার পথঘাট কিছুই তার চেনা নয়। কিন্তু মিতুল তো কিছুই দেখছিল না। অমোঘ সেই ডাক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তার নিয়তির দিকে।

ঘোর কেটেছিল পেছন থেকে জামায় টান পড়ায়। চমকে তাকিয়ে দেখেছিল, তার জামা ধরে টানছে একটা বছর সাত আটেকের বাচ্চা ছেলে। বড় বড় সুন্দর দু’টি চোখে একরাশ আকুতি নিয়ে ছেলেটা বলে উঠেছিল, যেও না দিদি। যেও না। বাড়ি যাও। ফিরে যাও।

কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের মধ্যে ফিরে এসেছিল মিতুল, তাই তো! বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় চলে এসেছে সে? কেন এসেছে? কোন জায়গা এটা? নিঝুম দুপুরে চারপাশ জনমানবহীন। মাঝে মাঝে শুধু একটা কুবো পাখি ডেকে উঠছে। খুব ভয় পেয়ে প্রথমেই বাবার কথা মনে পড়েছিল মিতুলের। দ্রুত হাতে ব্যাগ খুলেছিল সে। বাবাকে ফোন করতে হবে এখুনি। তার সাথে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু ফোন বার করতে গিয়েই হাত উঠে এসেছিল অদ্ভুত জিনিসটা। একটা শুকনো মতো কালো শিকড়ের টুকরো। তাতে লাল সুতো বাঁধা। আর সেটা হাতে নিতেই মাথার ভিতর ফিরে এসেছিল ডাকটা এবং আগের থেকে সহস্রগুণ তীব্র হয়ে। ফের আত্মবিস্মৃত হয়েছিল মিতুল এবং শিকড়টা মুঠো করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছিল সামনের আমবাগানটার দিকে। শুধু যেতে যেতে এক বার পেছন ফিরে দেখেছিল, বড় করুণ মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মিষ্টি মতো ছেলেটা।

বড় বড় গাছ চারিপাশে। দিনের বেলাতেও প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা। শুকনো পাতায় ঢেকে আছে মাটি। ইতিউতি দু’একটা সাপের খোলস। সেই সব মাড়িয়েই আরও ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল মিতুল। মিতুল যাচ্ছিল বলা ভুল, ডাকটা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা তীব্র পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল মিতুলের আর তখনই একটা কমবয়সি মেয়েগলা তাকে ডেকে উঠেছিল, খুকি, এ দিকে।

ঘুরে তাকিয়েই বজ্রাহত হয়ে গেছিল মিতুল। এমন ভয়ানক কদাকার জীব সে আগে কখনও দেখেনি। মানুষের মতো অথচ সেই না মানুষটা ফোকলা মুখে খলখল করে হেসে উঠে বাচ্চা মেয়ের মতো রিনরিনে গলায় বলেছিল, ডরাও না কি খুকি? ডর কীসের? আমি গেনু। কত্তার হুকুমের চাকর। কত্তায় তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। আসো। এই দিকে।

কালো, বাজপাখির নখের মতো বাঁকানো নখওয়ালা আঙুল তুলে সে নির্দেশ করেছিল একটা দিকে। মিতুল অবাক হয়ে দেখেছিল, সে হাতে মাত্র তিনটে আঙুল। এর পর আর কিছু মনে নেই তার।

প্রাথমিক ভয়টা কাটিয়ে উঠে মিতুল বোঝার চেষ্টা করছিল সে এখন কোথায় আছে! এমন কালিগোলা অন্ধকার যে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তবু সময়ের সাথে সাথে সবই সয়ে আসে। অন্ধকারও। একটু পরেই মিতুল বুঝতে পারল, একটা টানা লম্বা ঘরের এক কোণায় পড়ে আছে সে। ঘরটায় কিছু বড় বড় মেশিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ দিক, সে দিক। মিতুলের মনে হল, এটা কোনও পরিত্যক্ত কারখানা। তবে একটা ব্যাপারে মিতুল ভারী অবাক হল, যেই তাকে এখানে ধরে আনুক বেঁধে রাখেনি! এমনকী ব্যাগটাও তার পাশেই পড়ে আছে!

খুব বিপদের সময় মানুষের মাথা আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা হয়ে যায়। মিতুল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, যে করে হোক তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। যে বা যারা তাকে তাকে এখানে ধরে এনেছে তারা কনফিডেন্ট যে মিতুল এখান থেকে পালাতে পারবে না, তাই তাকে বেঁধে রাখেনি। কিন্তু এই চান্সটাই নিতে হবে মিতুলকে। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। এ দিক ও দিক দেখে সবে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে মিতুল তখনই ঘড়ঘড় শব্দ করে খুলে গেল ঘরের একটা প্রান্তের শাটার। সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে একটা লোক। আলো তার পেছনে, ফলে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু লম্বা ছায়াটা এসে পড়েছে মিতুলের পায়ের কাছে। তীব্র ভয়ে জবুথবু হয়ে গেলেও এটা দেখে মিতুল আশ্বস্ত হল যে এই লোকটা আর যাই হোক ওই কদাকার জীবটি নয়। কারণ সে ছিল যেমন বেঁটে আর তেমন মোটা।

সুইচ টিপে ঘরের ভিতরের একটা আলো জ্বালিয়ে দিল লোকটা। ধোঁয়াটে বাল্বের আবছা আলোয় মিতুল দেখল, সে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। এটা একটা পরিত্যক্ত কারখানাই বটে। মাকড়সার জালের পরিমাণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, বহুদিন এখানে মানুষের আনাগোনা নেই। একই সাথে মিতুল লোকটাকেও দেখতে পেল। দোহারা চেহারার একটা বয়স্ক লোক। দু’হাতে তার দু’খানা ঘটি। লোকটাকে দেখে মোটেই খুব একটা ভয়ঙ্কর কিছু মনে হল না মিতুলের। সবটা সাহস একত্রিত করে সে চেঁচিয়ে উঠল, কেন ধরে এনেছেন আমায়? কী চান আপনারা?

অদ্ভুত ব্যাপার, খুব নরম গলায় লোকটা বলল, সব বলব মা। বলব বলেই তো এলাম। তোমার ভয় নাই। জল আনছি। জল খেয়ে শান্ত হয়ে বোসো।

লোকটার বলার ধরণে একটু আশ্বস্ত হল মিতুল। মা বলে যে ডাকে সে কি কখনও ক্ষতি করতে পারে! তবু লোকটার আনা জলটা নিতে মিতুল ঠিক সাহস পেল না। তাকে ইতস্তত করতে দেখে লোকটা হেসে বলল, ভাবছ কিছু মিশানো আছে কি না? তাই তো? না মা, কিচ্ছু মিশানো নাই। অবশ্য আমার মুখের কথায় তুমি প্রত্যয় যাবা কেন? আমি তো অচেনা মানুষ। অচেনা মানুষের কথায় বিশ্বাস কী? কিন্তু সত্যি এ জল ভাল। এই দেখো, আমি খাচ্ছি, বলে ঘটি থেকে খানিকটা জল খেল লোকটা। তার পর ঘটিটা এগিয়ে ধরল মিতুলের দিকে।

প্রবল তেষ্টায় মিতুলের বুক ফেটে যাচ্ছিল এতক্ষণ। বুভুক্ষুর মতো সবটা জল খেয়ে ফেলল সে। লোকটা সুন্দর করে হাসল, এতক্ষণে একটু শান্তি পেলে না গো মা? নাও, এই বার একটু সুস্থির হয়ে বোসো। তোমায় ক’টা কথা বলার আছে বলে নিই। আবারও বলছি, ভয় পাবা না। আমি তোমার বাপের মতো।

লোকটার কথা শুনতে শুনতে যেন একটু স্বস্তি বোধ করছিল মিতুল। মনে হচ্ছিল, যতটা ভয় সে পাচ্ছিল ততটা ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এ লোকটা নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করবে।

বেশ ভারী পেতলের ঘটি। ঘটিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল মিতুল। লোকটার হাতে অন্য যে ঘটিটা ছিল সেটা লাল শালু জড়ানো। সেটা কোলে নিয়েই মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ল লোকটা। বলল, মা গো, আমি তন্ত্র সাধনা করি। যারে বলে তান্ত্রিক। না না, বলি দেব বলে তোমারে ধরে আনিনি। তান্ত্রিক মাত্রই বলি দেয় এ ভুল কথা। লোকের বদ রটনা। তোমার সাথে আমার অন্য একটা দরকার আছে। সবটা খুলে বললেই তুমি বুঝবা। তুমি শুনছ তো আমার কথা?

মিতুল ঘাড় নাড়ল। লোকটা বলল, বেশ। মন দিয়ে শোনো। অনেক বছর আগে আমার সাধনায় এক বার বাধা পড়ে। কে বাধা দিয়েছিল জানো? আমার নিজের ইস্ত্রি আর আমার আপন ভাগ্না। কথায় বলে, যম-জামাই-ভাগ্না/তিন নয় আপনা… এক্কেবারে খাঁটি কথা মা। তারে আমি কত ভালবাসতাম। নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম, কিন্তু সে আমারে ঠকিয়েছিল। আর ইস্ত্রির কথা তো বাদই দাও। সে না কি ছিল আমার ধর্মপত্নী! আমারে ঠকাতে তার একটুও বাধেনি। তাদের জন্য আমার জেল হয়ে যায়। চোদ্দো বছরের জেল। আমি যখন সমাধিতে ছিলাম পুলিশ আমারে ধরে। সমাধিতে থাকার সময় কী হয় জানো মা, তখন সব শক্তি ত্যাগ করে আধার শূন্য করতে হয়। আধারের আকার বাড়িয়ে নতুন করে বেশি শক্তি আহরণ করতে হয়। মানে ধরো একটা কৌটায় মুড়ি আছে। মুড়িগুলা বাইরে রেখে তুমি কৌটাটাকে আর একটু বড় করে বানিয়ে নিলে। এ বার তাতে বেশি মুড়ি ধরবে তাই না মা? বাজে উদাহরণ দিলাম, রাগ কোরো না। আমি তো অত লেখাপড়া করিনি। ভাল কথা বলতে পারি না। তা যাই হোক, আধার শূন্য ছিল বলে পুলিশ আমারে ধরতে পেরেছিল, নয়তো আমারে ধরা মানুষের কম্ম না। কিন্তু ওই আমার খারাপ দিন শুরু হল। সমাধিস্থ অবস্থায় তুলে এনেছিল বলে আমি শক্তিহীন হয়ে গেলাম। নতুন করে শক্তি পেতে সাধনা করার দরকার। কিন্তু জেলের মধ্যে বসে তো আর সাধনা করা যায় না। সাধনা করতে উপকরণ লাগে। এদিকে আমার মন হাঁসফাঁস করে। বাদক কি তার বাজনা ছাড়া থাকতে পারে বলো? এই করে করে বারো বছর সাজা ভোগ করে ফেললাম। কিন্তু আর পারছিলাম না গো মা। তার মধ্যে চন্দ্রগ্রহণের দিন এগিয়ে আসছিল। সাধনার জন্য বড় উপযুক্ত সেই দিন। নিজেরে আর সামলাতে পারলাম না। একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম। আরও চোদ্দো বছর সাজার মেয়াদ বেড়ে গেল বিচারে। তা সারাজীবন কী জেলে পচে মরব? সাধনা করব না? তাই মাসখানেক আগে আমি জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছি। এসেই খানিক সাধনা করে কিছুটা শক্তি ফিরে পেলাম। গেনুরে আবার নিজের কাছে টেনে আনলাম। এত দিন বেচারা পুরনো হুকুম তামিল করার জন্য ঘুরে ঘুরে মরছিল।

এই অবধি বলে একটু দম নিল লোকটা। বিস্ফারিত চোখে মিতুল বলে উঠল, গেনু! গেনু মানে সেই…

কথা কেটে লোকটা বলল, ঠিক ধরেছ। যে তোমারে নিয়ে আসছে এখানে।

ভয়ে কেঁদে ফেলল মিতুল, আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আমি বাড়ি যাব।

ব্যস্ত হয়ে উঠল লোকটা, আরে ওই দেখো! আবার কাঁদে! কেঁদো না মা। কেঁদো না। গেনুরে ভয় পাইছ তাই না? আসলে ও তো পিচাশ। তাই অমন বদসুরত দেখতে। কিন্তু ও তোমার কোনও ক্ষতি করবে না। আমার হুকুম ছাড়া গেনু এক পা নড়ে না। আমি যতক্ষণ আছি তোমার ভয় নাই গো মা। এই বুড়ো বাপটার ওপর একটু ভরসা রাখো।

নরম হাতে মিতুলের চোখের জল মুছিয়ে দিল লোকটা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মিতুল একই কথা বলে উঠল আবার, আমায় ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব। আমার মা বাবা খুব চিন্তা করছে আমার জন্য। কাঁদছে।

একটু হেসে লোকটা বলল, সে তো বটেই মা। সন্তান যে কী জিনিস সে বাপ মায়েই বোঝে। তোমারও সন্তান হবে। তুমিও বুঝবে। ছেড়ে দেব মা। তোমারে আমি ধরে রাখব না। তিনটা দিন। মাত্র তিনটা দিন তুমি এখানে থাকো। তার পর তোমার ছুটি। দেখো মা, জেলে থেকে থেকে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আমার হাতে বেশি সময় নাই। তাই শক্তিলাভের জন্য আমারে এক কঠিন সাধনা করতে হচ্ছে। আর চার দিন পরে আমার সাধনা শেষ। তোমারও ছুটি। এই চারটা দিন তুমি এই বুড়ো বাপটারে একটু সাহায্য করো মা।

ভয়ের সাথে যুঝতে যুঝতে এবং ভিতর থেকে উঠে আসা কান্নাটাকে সামলাতে সামলাতে মিতুল কোনও মতে বলল, কিন্তু আমি কী ভাবে সাহায্য করব আপনাকে?

পরম তৃপ্তিতে হেসে উঠল লোকটা, এই তো লক্ষ্মী মা আমার। কেমন সুন্দর কথা শুনলে তুমি। নাও এই ঘটিটা ধরো।

মিতুলের হাতে লাল শালু জড়ানো ঘটিটা ধরিয়ে দিয়ে এর পর লোকটা যা বলল তাতে লজ্জায়, ঘেন্নায়, ভয়ে, বিবমিষায় কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল মিতুল। লোকটা বলল, তোমার তো মাসিক চলছে মা, এই ঘটিতে খানিকটা মাসিকের রক্ত দাও।

এমন অসম্ভব, অবাস্তব, ঘৃণ্য কথা যে কেউ বলতে পারে মিতুল কল্পনাও করতে পারে না। বিশেষ করে যে লোকটা এতক্ষণ তাকে মা বলে সম্বোধন করেছে, নিজেকে বাবার মতো বলেছে সে কেমন করে বলতে পারে এমন কদর্য কথা! এই অপমানে তীব্র রাগে জ্বলে উঠল মিতুলের অন্তরের শাশ্বত নারীসত্তাটি। সেই রাগেই প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে মিতুল যেন কতকটা রিফ্লেক্সেই চিৎকার করে উঠল, না!

আচমকা দপ করে জ্বলে উঠল লোকটার চোখ দু’টো। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, কী বললি? তুই আমায় না বললি? লোকনাথ চক্কোত্তির মুখের ওপর না? গোঁড়াল দিয়ে আজ তোর গুমোর ভাঙব বেবুশ্যে মাগি।

এ কী ভয়ানক রূপান্তর! যে এতক্ষণ মা বলছিল তার মুখে এখন এই অশ্লীল সম্বোধন! মিতুলের ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে সাবধান করে দিল, বিপদ আসতে চলেছে। যতটা বিপদ সে কল্পনা করেছিল তার চেয়েও বেশি। পায়ে পায়ে পিছিয়ে যেতে লাগল মিতুল।

জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে লোকটা আবার বলল, ভালয় ভালয় দিবি না গেনুকে ডাকব? সে এসে তোরে ন্যাংটো করলে তোর ভাল লাগবে?

প্রচণ্ড ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল মিতুল, না না, এমনটি করবেন না। আমায় ছেড়ে দিন। প্লিজ। প্লিজ আমি হাতজোড় করছি।

ধ্যাত্তেরি নটী মাগি। বলছি সময় কম। এ কেঁদেকেটে যাত্রা করছে, বলেই মিতুলের গালে সজোরে একটা চড় মারল লোকটা। টাল সামলাতে না পেরে মিতুল ছিটকে পড়ল। মাথাটা ঠকাস করে ঠুকে গেল দেওয়ালে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে চারপাশটা ঝাপসা হয়ে গেল মিতুলের। সে এলিয়ে পড়ল মাটিতে।

মেয়েদের মাথার মধ্যে একটা বিশেষ সাইরেন আছে। শরীরের আশেপাশে কোনও পুরুষের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি টের পেলেই সাইরেনটা বাজতে শুরু করে। সেই সাইরেনটাই ঘন ঘন বাজতে থেকে মিতুলকে আবার খানিকটা সজাগ করে তুলল। আচ্ছন্ন হয়ে থেকেও মিতুল বুঝতে পারল, লোকটা উবু হয়ে বসে তার জামা তুলে প্যান্টটা খোলার চেষ্টা করছে। ভাগ্যিস এ প্যান্টের বোতামগুলো কোমরের পাশের দিকে। নয়তো এতক্ষণে…

আচমকা দেখতে পেল মিতুল, জল খাওয়ার ফাঁকা ঘটিটা রয়েছে তার ডান হাতের একেবারে নাগালের মধ্যে। এক মুহূর্ত দেরি না করে গায়ের সবটা শক্তি এক জায়গায় এনে মিতুল ভারী ঘটিটা সজোরে লোকটার মাথায় বসিয়ে দিল।

ঢং করে একটা ভোঁতা শব্দ হল আর অস্ফুট আর্তনাদ করে লোকটা লুটিয়ে পড়ল মিতুলেরই গায়ের ওপর। দু’হাতে ভারী শরীরটা ঠেলে সরিয়ে মিতুল উঠে পড়ল। মাথা আর ডান দিকের কান বরাবর একটা অসহ্য ব্যথা। কিন্তু সেটাকে অগ্রাহ্য করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে শাটার তোলা জায়গাটা দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল সে। চার দিকে ভাঙাচোরা লোহা লক্কড় আর বড় বড় গাছ। দূরে দূরে এক একটা সোডিয়ামের আলো জ্বলছে, তাতে যেন আরও বেশি করে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে। মিতুল জানে না, সে কোন দিকে যাবে, তবু আলো লক্ষ্য করে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। তার মন বলতে লাগল, আলোর কাছে গেলেই মুক্তি। ছুটতে ছুটতে বড় কোনও গাড়ির হর্ন শুনতে পেল মিতুল। তার মানে, কাছেই বড় রাস্তা। পা আর চলছিল না, তবু এই ভাবনাটাই যেন মিতুলের শরীরে নতুন উদ্যম এনে দিল। আরও জোরে ছুটতে লাগল সে।

সামনের রাস্তাটা দু’দিকে বেঁকে গেছে। এক মুহূর্ত থমকে ডান দিকের রাস্তাটা ধরল মিতুল আর একটু গিয়েই বুঝল, সে ভুল করেনি। ওই তো, কারখানার গেট দেখা যাচ্ছে। ছোট গেটটা আবার খোলা। মুক্তির আনন্দ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মিতুলকে। কিন্তু গেটের কাছে যেতে না যেতেই চেতনা অসাড় করে দেওয়া পচা গন্ধটা ঝাপটা মারল তার নাকে। এ গন্ধ মিতুল চেনে। পাথরের মতো ভারী হয়ে গেল তার পা দুটো। নিদারুণ অনিবার্যতায় সে যন্ত্রের মতো পেছন ফিরে তাকাল আর দেখল একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেনু। মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় সে বলল, সবাই কত্তারে ধোঁকা দেয়। তোমরা সবাই এত নিমকহারাম কেন খুকি?

রাত শেষ হতে আর বড়জোর ঘণ্টা তিনেক। বারাসাত বাস টার্মিনাসে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে বাসগুলো। সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই তাদের ঠেলেঠুলে তুলে দেবে ড্রাইভাররা। চোখ কচলে কোনও মতে ফের রাস্তায় নামতে হবে তাদের। পেটের খোলে যাত্রী তুলে ছুটতে হবে দিগ্বিদিক।

বাসগুলোর পাশ দিয়েই বেড়ালের মতো চুপিসাড়ে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিল ধনা। তার ডান হাতে একটা বড় আধলা ইট। বাঁ হাতে একটা চাকা খোলার জ্যাক। জ্যাকটা সলিড লোহার। বেশ ভারী। জ্যাকটা বাসের গায়ে লেগে টং শব্দ হল। মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠল ধনা। বাঁ হাতটা সামলে নিল। সে কিছুতেই নিজের উপস্থিতি টের পেতে দিতে চায় না। অতর্কিতে হামলা করতে চায় সে।

কুকুর দু’টোকে দেখার পর থেকেই মাথায় রক্ত উঠে গেছিল তার। এক বছরের কাছাকাছি হয়ে গেল তার কপালে কোনও মেয়ে জোটেনি আর হারামির বাচ্চারা তার চোখের সামনেই যাতা করছে! এখন মানুষ হয়ে গেছে শালারা।

নিজের একটা মেয়েছেলের আশা ধনা করে না। পয়সা দিয়ে যে সোনাগাছি যাবে সে অওকাতও তার নেই। কারণ যেটুকু যা রোজগার নেশার পেছনেই চলে যায়। কিন্তু রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ভিখিরি বা পাগলিগুলোকেও তো সে পেতে পারত! তাও তার কপালে নেই। আসলে এই মার্কেটে সবার ভাতার সেট করা আছে। এই তো দিন সাতেক আগের কথা। চাঁপাডালির কাছে একটা বাচ্চা মতো পাগলিকে হেবি চোখে লেগেছিল। তাকে তাকে থেকে একদিন রাতের বেলা সবে মুখটা চেপে ধরেছে কোত্থেকে তিনটে ছেলে এসে হাজির! তার পর সে কী মার ধনাকে। কেলিয়েকুলিয়ে ছেলেগুলো পাগলিটাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে কাট্টি মারল! নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছিল ধনার। একে তো তার কপাল ফাটা, তার মধ্যে ছেলেগুলো পেছনটাও ফাটিয়ে দিয়ে গেল!

তাই আজ সবটা রাগ কুত্তা দু’টোর ওপরেই উগরে দিল ধনা। বাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সজোরে আধলাটা ছুঁড়ে দিল। ধনার হাতের টিপ ভাল। কুত্তা দু’টোর পাছা যেখানে এক জায়গায় হয়ে আছে সেখানে গিয়ে জমে গেল আধলাটা। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল সারমেয় দু’টির। জিভ আটকে গেল দাঁতের ফাঁকে। তার পরেই মরণ আর্তনাদ করে উঠল তারা। জৈব তাড়নায় তারা পালিয়ে যেতে চাইল কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এই মুহূর্তে তারা পরস্পরের সাথে সংলগ্ন। এই বন্ধন ছিন্ন হতে সময় লাগবে। আর সেই সময়টুকুরই পূর্ণ সদব্যবহার করল ধনা। জ্যাকটা ডান হাতে নিয়ে সর্ব শক্তিতে একে একে বসিয়ে দিল কুত্তা দু’টোর মাজায়। সংলগ্ন অবস্থাতেই সারমেয় দু’টি নেতিয়ে পড়ল। নারীটি একেবারে চুপ করে গেল। পুরুষটি তখনও বাঁচার জন্য কাতর আর্তনাদ করছে।

মনটা ভারী খুশি হয়ে গেল ধনার। এতক্ষণে একটা কাজের কাজ হয়েছে। মাটিতে থুতু ফেলে সে সারমেয় দু’টির উদ্দেশ্যে বলল, পথেঘাটে নষ্টামি তো? জন্মের শোধ ঘুচিয়ে দেব।

এই বলে সবে সে জ্যাকটা তুলেছে ছেলে কুত্তাটার মাথায় বসাবে বলে তখনই পেছন থেকে চাপা গলায় কে যেন বলে উঠল, ধনা পালা।

চমকে পেছন ফিরতেই ধনা দেখল পল্টন দাঁড়িয়ে আছে। পল্টন নেশার দোস্ত। ধনা কিছু বলার আগেই পল্টন হুড়মুড় করে বলে উঠল, তোকে পুলিশ খুঁজছে। ফোর্স নিয়ে বেরিয়েছে। কলোনি মোড় আর হরিতলা পুরো ছানবিন করে ফেলেছে। যাকে পাচ্ছে র‍্যাম্পার্ট ক্যালাচ্ছে। এখন এ দিকেই আসছে।

অবাক হয়ে গেছিল ধনা, পুলিশ কেন খুঁজতে যাবে তাকে? সে তো তেমন কিছু করেনি!

পাছায় একটা লাথি মেরে পল্টন বলল, আবে ভাবছিস কি? ধরতে পারলে কিন্তু পেছন ফাটিয়ে দেবে। ডুব দে জলদি।

জ্যাকটা ছুঁড়ে ফেলে দৌড় লাগাল ধনা। কোনও ভাবেই পুলিশের হাতে ধরা দেওয়া যাবে না। পুলিশ কোনও কথা শোনার আগেই পেছনে রুল গুঁজে দেয়। দিন সাতেক আগেই ধোলাই হয়েছে। এখনও গায়ের ব্যথা ভাল ভাল করে মরেনি। তার ওপর আর পুলিশের ডান্ডা খেলে দেখতে হবে না। কিন্তু কোথায় যাবে ধনা? পল্টন যা বলল, তাতে সব কটা ঠেকেই মামারা আজ ঢুঁ মারবে। অন্য কোথাও লুকোতে হবে। ভাবতে ভাবতেই বিদ্যুচ্চমকের মতো মাথায় এসে গেছিল জায়গাটার কথা। বাবার আস্তানায় যেতে হবে। দিন কয়েক আগেই বাবাকে গাঁজা দিতে গেছিল। তখনই বাবা বলেছিল, জায়গাটা না কি মন্ত্রপড়া আছে। চোখের সামনেই অথচ কোনও মানুষ দেখতে পাবে না। বাবা ধনাকে ভালবাসে তাই কী ভাবে আসতে হবে বলে দিয়েছিল। লুকনোর জন্য এর থেকে ভাল জায়গা আর কী হতে পারে? ধনা তাই একেবারে দম ছাড়ল কারখানার গেটে গিয়ে। এ বারে নিশ্চিন্ত।

আগে এ কারখানাটায় ধনারা খুব আসত। সন্ধের পর থেকেই হেবি হাওয়া দেয়। ধুনকিটা জমে ভাল। বছর চারেক আগে এখানেই একটা ঝাম হয়ে গেছিল। সমীর দলুই বলে একটা ছেলেকে চুপিয়ে দিয়েছিল নেশার দোস্তরা। মালটা মরেনি। তার পরেই পুলিশ এসে ঠেক ফেক ভেঙে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে এদিকে আর খুব একটা আসা হতো না।

হাঁটতে হাঁটতে মেশিন রুমের দিকে এগোচ্ছিল ধনা। এখানেই বাবার সাধনার জায়গা। বাবার সব ভাল কিন্তু গায়ে হেবি বাদুড়পচা গ্যাস। চান ফান করে না বোধ হয়। আর বাবা আস্তানা গাড়ার পর থেকে এই জায়গাটাতেও সারাক্ষণ কেমন একটা চিমসে পচা গন্ধ চাপ বেঁধে থাকে। সে থাকুক গে, ধনা তো আর এখানে সংসার পাততে যাচ্ছে না। দিন দু’য়েক ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে আবার পাতলা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার সামনে গিয়েই চমকে উঠল ধনা। বাবার মাথা ফেটে গেছে। উবু হয়ে বসে সেখানেই গাঁদা গাছের পাতা লাগাচ্ছে বাবা। পাশে একটা লাল শালু জড়ানো ঘটি। তার মধ্যে কালো জলের মতো কী যেন একটা রয়েছে, ধনা ঠিক ঠাহর করতে পারল না। সে ডেকে উঠল, বাবা!

চোখ তুলে তাকাল লোকনাথ চক্রবর্তী। এতক্ষণ সে ধনাকে খেয়াল করেনি। ভুরু কুঁচকে বলল, তুই এখানে?

হাত জোড় করে ধনা বলল, বাবা, আপনার জন্য মনটা টানছিল। ভাবলাম একটা ছিলিম সেজে দিয়ে আসি। আমিও প্রসাদ পাব। তাই চলে এলাম। কিন্তু মাথা ফাটল কী করে বাবা?

গাঁজার কথা শুনে খুশি হল লোকনাথ। খিক খিক করে হেসে বলল, ঢ্যামনাপোকায় হুল দিয়েছে।

ভক হয়ে গেল ধনা। এমন পোকার নাম সে বাপের জন্মে শোনেনি। অবাক হয়ে বলল, সে কেমন পোকা বাবা?

লোকনাথ বলল, ও আছে। বাদ দে। ভাল করে সাজ দেখি।

বাবার পায়ের কাছেই বসে পড়ল ধনা। তবে পোকার ব্যাপারটা একেবারে বাদও দিতে পারল না। যে পোকার হুলে অমন মাথা ফাটে সে পোকা এলিতেলি নয়। বিরাট তালেবর।

কলকেটায় আগুন দিয়ে প্রণাম করে বাবার মুখের কাছে এগিয়ে ধরল ধনা। বুক ভরে দম নিল লোকনাথ। তার পর চিমনির মতো গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, নাহ, তেজ থাকা ভাল। মা তেজি হলে বাচ্চাও তেজি হয়।

ফের অবাক হল ধনা। বাবা যে আজ কী বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বেশি প্রশ্ন করলে যদি আবার রেগে গিয়ে তাড়িয়ে দেয়, তা হলেই কেলো। তাই চুপ করেই রইল।

মাত্র চার টানে অত বড় ছিলিমটা প্রায় শেষ করে ধনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে লোকনাথ বলল, এ বার সামনে থেকে যা। আমায় একা থাকতে দে। আমি সাধনায় বসব। আজ এমনিতেই বড় দেরি হয়ে গেছে।

কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে এল ধনা। এ কারখানার সবটা তার চেনা। কোথাও একটা গ্যারেজ হয়ে গেলেই হবে। আনমনে কারখানার আরও ভিতরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। পুলিশকে বোকা বানাতে পেরে মনটা খুশ হয়ে গেছে। গুনগুন করে একটা গানও ধরে ফেলল, রাত আকেলি হ্যায়…

হঠাৎ কাছেপিঠেই কে যেন গুঙিয়ে উঠল চাপা গলায়। চমকে গান বন্ধ করে দিল ধনা। মানুষের গলা মনে হল! কিন্তু এখানে আর মানুষ আসবে কোত্থেকে? আওয়াজটা এলই বা কোন দিক থেকে? অন্ধকারে একটা গাছের সাথে মিশে কান খাড়া করে রইল ধনা। মিনিট খানেক সব চুপচাপ। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। হয়তো ভুল শুনেছে ভেবে সবে এগোতে যাবে তখনই আবার মানুষের গলা পেল ধনা। একটা মেয়ে গুঙিয়ে উঠল, আহ! মা গো!

গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল ধনার। এত রাতে এই বিরান জায়গায় মেয়েছেলের গলা! তবে কি বাবা কোনও মেয়ে এনে রেখেছে এখানে? আগের দিন যখন এল তখন তো কোনও মেয়ের চিহ্ন দেখেনি! অবশ্য আগের দিন সে এ দিকটায় আসেওনি। প্রথমটা সে ভাবল, ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই। চুপচাপ সরে পড়াই ভাল। কিন্তু অদম্য কৌতূহল তাকে সরে পড়তে দিল না বরং সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল গোডাউনের দিকে। শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। দেওয়ালে কান পাতল সে। নাহ কোনও ভুল নেই। সত্যিই ভেতরে একটা মেয়ে থেকে থেকে কাতরে উঠছে। আসপাশটা দেখে নিয়ে সুট করে গোডাউনের পেছন দিকে চলে গেল ধনা। তার পর দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে উঠে গেল ওপরে। ছাউনি আর দেওয়ালের মাঝে অনেকটা ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়ে শরীরটা গলিয়ে দিল ভিতরে। তার পর ফের দেওয়াল বেয়ে নেমে এল গোডাউনের মেঝেতে।

ভিতরটা অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না যদিও, তবু একটা জ্যান্ত মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল ধনা। এক কোণে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখটা সইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল সে। ততক্ষণে মেয়েটা আরও দু’বার মা গো বলে উঠেছে। ধীরে ধীরে ধনা বুঝতে পারল, ঘরের এক কোণে মেয়েটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে না, শুধু মাঝে মাঝে আওয়াজ করছে। আরও কিছুক্ষণ অন্ধকারে সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল ধনা। দেখতে চাইল, মেয়েটা উঠে বসে কি না! কিন্তু উঠে বসা তো দূর, মেয়েটা পাশও ফিরল না। ওই একই ভাবে পড়ে রইল। হাজারখানা প্রশ্ন ধনার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল, কে এই মেয়েটা? এ ভাবে পড়ে আছে কেন এখানে? বাবা যদি মেয়েটাকে নিয়ে আসবে তবে মেয়েটা বাবার কাছে নেই কেন?

আচমকাই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল ধনার কাছে। বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘ঢ্যামনাপোকায় হুল দিয়েছে।’ আচ্ছা! তার মানে এই মেয়েটার সাথে ধস্তাধস্তি করতে গিয়েই বাবার মাথা ফেটেছে। আপন মনেই হেসে উঠল ধনা, বাবার সব শুকিয়ে কিসমিস হয়ে গেল তবু রস মরল না! উল্টে গাতন দিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। তার পর বোধ হয় বাবা কেলিয়েছে তাই এমন লাতন হয়ে পড়ে আছে। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে আলো জ্বালিয়ে দিল ধনা আর আলো আসতেই সে যেন হাজার ভোল্টের শক খেয়ে ছিটকে গেল! এ কী দেখছে সে! নিজের চোখ দু’টোকে বিশ্বাস করতে পারল না ধনা। এক বার ভাল করে চোখ কচলে নিল। নাহ, ঠিকই দেখছে। মেয়েটার গায়ে জামা আছে কিন্তু কোমর থেকে পুরো উদোম। বাল্বের আবছা আলোতেও শরীরটা চকচক করছে। এ তো কোনও এলিতেলি মেয়ে না! এ যে ভদ্দঘরের ডাঁসা পেয়ারা! এ মাল বাবা কোথায় পেল? শব্দ না করে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল ধনা কিন্তু আর একটু কাছে যেতেই থমকে গেল সে। মেয়েটার পায়ের ফাঁক দিয়ে রক্তের একটা লাইন গড়িয়ে চলে গেছে ঘরের অন্য দিকটায়। তবে কি বাবা এর মধ্যেই যা করার করে দিয়েছে? মরুকগে যাক। বাবার প্রসাদ পেতে তার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু অন্য একটা দ্বিধায় পড়ে গেল ধনা। এই নিয়ে কোনও ঝাম হবে না তো? বাবার পারমিশন ছাড়া খেলে বাবা আবার শাপটাপ দিয়ে দেয় যদি? ধনা যে একটু ভয় পাচ্ছিল না তা নয় কিন্তু মাখনের মতো চকচকে দাবনা দু’টো তাকে টানছিল।

নিজের সাথেই খানিকক্ষণ যুঝল ধনা তার পর সটান প্যান্ট খুলে ফেলে এক টানে মেয়েটাকে সোজা করে দিল। উফ! মাগিটার মুখখানাও তো হেবি মিষ্টি। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল সে। ভাগ্যিস আজ পুলিশ তাকে খুঁজছিল। চিরকাল ভদ্রঘরের মেয়েদের ওপর ধনার লোভ, কিন্তু ওপরওলা যে এ ভাবে ছপ্পর ফুঁড়ে দেবে সে ভাবতেও পারেনি।

ধনা যে উল্টে দিয়েছে তাতেও মেয়েটার কোনও সাড় নেই। সেই মাঝে মাঝে শুধু আহ, উহ, মা গো… এই সব করে চলেছে। সাড় না আসাই ভাল। চুপচাপ কাজ সেজে নেওয়া যাবে। দেরি না করে মেয়েটার জামা খুলতে শুরু করল ধনা। চোলি কে পিছে যে কী মাল ছুপিয়ে আছে ভাবতেই সে আরও গরম খেয়ে গেল। কিন্তু ধ্যাত্তেরি! এ জামাটা তো খোলাই যাচ্ছে না! কী ভাবে আটকেছে কে জানে! নষ্ট করার মতো সময় নেই ধনার হাতে। জামা ছেড়ে মেয়েটার দু’পায়ের মাঝে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সে। যেটা খোলা আছে আগে সেটার হিসেব নেওয়া যাক। পরেরটা পরে হবে।

মেয়েটার পা দু’টো তুলে সবে কাঁধের ওপর সেট করেছে ধনা, তখনই গন্ধটা পেল। একশোটা মড়া একসাথে পচলেও বুঝি এত বিকট গন্ধ হয় না! পেটের ভিতর থেকে পাক দিয়ে উঠল ধনার। মেয়েটাকে ছেড়ে এক লাফে একটু সরে গিয়ে ওয়াক তুলে খানিকটা বমি করে দিল! কোত্থেকে এল এই বিকট গন্ধটা? ভাবতে ভাবতে বাঁ হাতের চেটোয় মুখটা মুছে ঘুরে দাঁড়াতেই ভয়ে অবশ হয়ে গেল ধনা। তার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মানুষের মতো চেহারার এক অদ্ভুত ভয়াবহ কদাকার জীব। ধকধক করে জ্বলছে তার পাঁশুটে সবুজ রঙের মণি দু’টো। তার কাছ থেকেই আসছে এই দম বন্ধ করা পচা গন্ধটা। বাঁকানো নখওয়ালা আঙুল তুলে তীক্ষ্ন নারীকণ্ঠে সে বলে উঠল, পুজো না হতেই ভোগে হাত দিস তুই? কত্তায় তোরে স্নেহ করে আর তার এই দাম দিলি? কুত্তার মতো মরবি তুই। যন্ত্রণার মরণ হবে তোর।

ভয়ে চিৎকারটুকুও করতে পারল না ধনা। শুধু অনুভব করল তার পা বেয়ে গড়িয়ে নামছে প্রস্রাব।

. . .

ধনার গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকনাথ। গলার ওপর পায়ের চাপ বাড়াচ্ছে ক্রমাগত আর মরে যেতে যেতে ধনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে যন্ত্রণাকাতর দু’টি কুকুরের মুখ। কিছুক্ষণ আগে জ্যাক দিয়ে মেরে সে যাদের মাজা ভেঙে দিয়ে এসেছে।

গজরাচ্ছিল লোকনাথ, পথের কুকুর, কৃমিকীট। এত সাহস তোর! এত সাহস!

গেনু ডাকল, ছাড়ি দেন কত্তা। মরে গেছে।

ধনার নিথর দেহটার দিকে তীব্র ঘৃণার চোখে তাকিয়ে এক দলা থুতু ফেলল লোকনাথ। তার পর গাছতলায় বসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছে বলল, কাল তোর খাটনি কমল গেনু। কাল আর মরা খুঁজতে যেতে হবে না। এই মরাটাই কাজে লাগিয়ে দেব। একটু জল দে তো।

থপথপ করে একটা ঘটি হাতে লোকনাথের সামনে এসে দাঁড়াল গেনু। এক নিঃশ্বাসে সবটা জল খেয়ে লোকনাথ বলল, মানুষের ওপর ঘেন্না ধরে গেল বুঝলি গেনু? এরা বড্ড নিমকহারাম। তুমি যতই এদের ভাল করতে যাবা এরা তোমায় পেছন থেকে ছুরি মারবে। না রে, তার চেয়ে তুই অনেক ভাল। অনেক ভাল। তুই কোনও দিন আমার বিশ্বাস ভাঙিসনি। আমি যত দিন জেলে ছিলাম আমার শেষ হুকুম তামিল করার জন্য ঘুরে বেরিয়েছিস। আমার বউ তোরে খুব জ্বালিয়েছে আমি জানি। সেই জন্যই তো শক্তি ফিরে পেয়ে ও শালীকে সবার আগে বন্দি করেছি। আর তোরে কেউ জ্বালাবে না। অনেক করেছিস তুই আমার জন্য।

ফোকলা মুখে মিহি গলায় গেনু বলল, আপনি আমার মালিক। আমি আপনার হুকুমের চাকর। আপনার জন্য আমার তো করা লাগবই কত্তা।

লোকনাথ স্নেহের হাসি হাসল, কিন্তু তোরেও তো এর একটা প্রতিদান দিতে হয়। কখনও তো তোরে কিছু দিই নাই। তবে এ বার দেব।

গেনু অবাক হল, কী দেবেন কত্তা?

বাচ্চাদের মতো মাথা নেড়ে হাততালি দিয়ে খুশিয়াল গলায় লোকনাথ বলে উঠল, মিতুল নামে পুতুলটি। মিতুল নামে পুতুলটি।