নিকষছায়া – ২০

২০

কী নাম বললি তুই আবার বল, চিৎকার করে উঠল লোকনাথ।

অধোবদনে গেনু বলল, নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি।

সজোরে হাতের হাড়টা গেনুর কাঁধে বিঁধিয়ে দিল লোকনাথ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল গেনু। তার বুকের ওপর পা তুলে অন্ধ আক্রোশে লোকনাথ বলল, একটা লোক আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সাধনা ছেড়েছে আর তারে ভয় পেয়ে ফিরে এলি! তুই তো মেয়েছেলেরও অধম, রাগে গেনুর বুকে একটা লাথি বসিয়ে দিল লোকনাথ।

কিন্তু তাতেও সে শান্ত হতে পারল না। দু’হাতে চুলের মুঠি ধরে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগল এ দিক, ও দিক। গাছের গায়ে মাথা ঠুকতে লাগল, কেন আমি শেষ করিনি ওই বুড়োরে? কেন?

আচমকা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল লোকনাথ। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, সবাই আমার শত্তুর। নিজের বউ শত্তুর, ছেলেমেয়ে শত্তুর, গুরু শত্তুর। সবাই শত্তুর। গুখেগোর ব্যাটা আমি। আমি বেজন্মা, সজোরে চড় মারতে শুরু করল নিজের দুই গালে।

প্রভুর যন্ত্রণা দেখে বড় অসহায় হয়ে পড়ল গেনু। প্রভুর এই চেহারা আজ অবধি সে কখনও দেখেনি। নিয়ম ভেঙে অনুনয় করে উঠল, আমায় শেষ করে দ্যান কত্তা কিন্তু আপনি শান্ত হোন। শান্ত হোন, পায়ে পড়ি আপনার। আমি খালি হাতে ফিরতাম না কত্তা। আজ অবধি কি ফিরেছি? কিন্তু ওই বুড়ো ভয়ানক। সে যে আপনার শক্তিরেও টেক্কা দেয় পারলে। সে বলেছে, এই জায়গার খোঁজ জানে। সে আসছে এখানে। কিছুতেই আপনারে সিদ্ধি পেতে দেবে না।

গেনুর কথায় কান্না থেমে গেল লোকনাথের। চকিতে ঘুরে বসল গেনুর দিকে। বাঁ হাতের চেটোয় চোখের জল মুছে বলল, কী বলেছে? সে এই জায়গা চেনে? এখানে আসছে?

মাথা নাড়ল গেনু, হ্যাঁ কত্তা।

কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়াল লোকনাথ। ধুলো ঝাড়ল ধুতি থেকে। গেনুর কাঁধ থেকে খুলে নিল বিঁধিয়ে রাখা হাড়টা। তার পর ফিক করে হাসল গেনুর দিকে তাকিয়ে। তরল কণ্ঠে বলল, সিদ্ধি পেতে দেব না, বললেই হল? ও বুড়ো হয়েছে। ভীমরতি ধরেছে। তাই এ সব আলফাল বকছে। ও সব নিয়ে ভাবিস না গেনু। আসতে চাইছে তো? আসুক। আমার নামও লোকনাথ চক্কোত্তি। নে ওঠ।

যারপরনাই অবাক হল গেনু। প্রভুর এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণটা সে কিছুতেই অনুধাবন করতে পারল না।

. . .

তিতাস বলে উঠল, সামনে একটা বাম্পার আছে। ওখানেই দাঁড়াতে হবে আমাদের।

পর পর দুটো গাড়ি চলেছে। সামনের গাড়িতে তিতাস। সে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িটা অনুসরণ করছে সামনের গাড়িটাকে।

বাম্পারের সামনে এসে থেমে গেল দুটো গাড়ি। একে একে সবাই নেমে এল গাড়ি থেকে। সবার মধ্যেই কাজ করছে একটা মিশ্র অনুভূতি। আশঙ্কা এবং উত্তেজনা মিলেমিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক মানসিক দোলাচল। শুধু ভাদুড়ি মশায়কে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তাঁর মনের মধ্যে কী চলছে। ব্যগ্র হয়ে তিতাসের দিকে এগিয়ে এলেন দীপক পাল, জায়গাটা কোথায় ম্যাডাম? এখানে তো দু’দিকেই জঙ্গল! মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় তিনি অস্থির।

ওই যে আমগাছটা, ওই গাছটাকে ঘিরে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে তিন বার পাক দিলেই আসল জায়গাটা দেখা যাবে। লোকনাথ মায়া করে রেখে বলে দেখা যাচ্ছে না। আসুন পালদা। স্যার আসুন, গাছটার দিকে এগিয়ে গেল তিতাস।

তিন বার পাক দিতেই ওদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল কুয়াশার পর্দা। দৃশ্যমান হল কারখানার গেট। তিতাস বলল, ওর মধ্যেই একটা গোডাউন মতো জায়গায় মিতুল আছে। ঢুকে বাঁ দিক দিয়ে যেতে হবে।

দুম করে ভিতরে ঢুকে যাওয়া উচিত হবে কি হবে না, আর গেলেও লোকনাথ এবং গেনুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য কতখানি সাবধানতা নেওয়ার প্রয়োজন সে সব নিয়ে কোনও কথা হওয়ার আগেই তিরের মতো কারখানার গেটের দিকে ছুটে গেলেন দীপক পাল।

প্রাথমিক হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে অমিয় চিৎকার করে উঠল, পালদা!

কিন্তু দীপক পাল ততক্ষণে ঢুকে গেছেন কারখানার ভিতরে। তাঁকে আর দেখা যাচ্ছে না। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে চোখাচোখি হল পল্লব আর অমিয়র। ওরা দু’জনেও ছুটল গেটের দিকে। যেতে যেতে চিৎকার করে অমিয় বলল, তিতাস, তুই আর সঞ্জয় স্যারকে নিয়ে আয়।

. . .

গুদাম ঘরের সামনে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা সবাই। শুধু গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন দীপক পাল। গোটা কারখানা জুড়েই এ দিক ও দিক ছড়িয়ে রয়েছে মনুষ্য বসবাসের ছাপ। পড়ে রয়েছে পুজোর নানা উপকরণ এবং যজ্ঞভস্ম। কিন্তু মিতুল, লোকনাথ বা গেনুর চিহ্নমাত্র নেই। হতাশ কণ্ঠে ভাদুড়ি মশায় বলে উঠলেন, বলেছিলাম না, এত সহজ হবে না। লোকনাথ আমাদের বোকা বানিয়েছে। সাধনার জন্য যেটুকু দরকার ঠিক সেটুকু নিয়ে পালিয়েছে। নতুন আস্তানায় নির্বিঘ্নে সাধনা সম্পন্ন করবে কাল সূর্যগ্রহণের অন্তিম লগ্নে।

দীর্ঘশ্বাস যেন হাহাকার হয়ে বেরিয়ে এল বৃদ্ধের কণ্ঠ থেকে। নিজেকে শক্ত করে পরাজয়ের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল তিতাস। বলল, চিন্তা করবেন না স্যার। লোকনাথ পালাতে পারবে না। আমার বিশ্বাস, সেই বাচ্চা মেয়েটি আবার আসবে। সে আমাদের পৌঁছে দেবে লোকনাথ অবধি।

বেচারা তিতাস! সে জানে না, ওই বাচ্চা মেয়েটির আসার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে লোকনাথ। চরম কৌতুকে সে এখন দুলে দুলে হাসছে তার নতুন সাধনক্ষেত্রে বসে।

২১

ঘুম এক অদ্ভুত জিনিস। প্রচণ্ড রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানুষের ঘুম পায়। আসলে মানুষ তো ঘুমায় না, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শরীরের কলকব্জাগুলো। তখন অজান্তেই বুজে আসে চোখের পাতা। মিতুলেরও তাই হয়েছিল। বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। চোখ মেলে মিতুল দেখল, বাইরে ভোরের আলো। ঘরের দরজাটা খোলা। সে দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল মিতুল। যত দূরে চোখ যায় থইথই করছে কাকচক্ষু জল। থেকে থেকে ভেসে আসছে ভেজা বাতাস। এক ঝলকের জন্য হলেও মনটা ভাল হয়ে গেল তার। সে বুঝতে পারল না কোথায় এনে ফেলা হয়েছে তাকে।

গত রাতে পিশাচটা যখন আচমকা এসে কাঁধে তুলে নিয়েছিল, ভয় পেয়েছিল মিতুল, কিন্তু জ্ঞান হারায়নি। শেষ কয়েকটা দিন তাকে অনেক শক্ত করে দিয়েছে ভিতর থেকে। আসলে ঠিক শক্ত না। মানুষ কখন ভয় পায়? যখন সে বোঝে বর্তমান পরিস্থিতি তার অনাগত ভবিষ্যৎকে তছনছ করে দিতে পারে, তখন। কিন্তু মিতুল তো এখন সবটাই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সে বুঝে গেছে, এই ফাঁদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। ওই লোকনাথ নামে লোকটা যদি তাকে ছাড়ে তবেই সে মুক্তি পাবে। তার আগে নয়। যদিও ওই লোকটার কথা অনুযায়ী আজই তার ছুটি কিন্তু যতক্ষণ না সে এখান থেকে বেরতে পাচ্ছে ততক্ষণ কিছুই বিশ্বাস নেই। তবে একটাই আশার কথা, এই ক’ দিনে প্রথম দিনের মারধোরের পর লোকটা তাকে আর কোনও অত্যাচার করেনি। এক বার করে এসে শুধু ঘটি বাড়িয়ে দিয়েছে, মিতুলও দ্বিরুক্তি না করে দিয়ে দিয়েছে সে যা চায়। হয়তো মরতেই হবে, তার আগে কী লাভ শুধুশুধু মার খেয়ে? তবে কাল রাতে পিশাচটা যে কেন তড়িঘড়ি তাকে কাঁধে তুলে কারখানা থেকে সরিয়ে নিয়ে এল মিতুল বুঝতে পারেনি। অবশ্য বুঝেই বা সে কী করত! তাকে এই ঘরের ভিতর ফেলে রেখে পিশাচটা বেরিয়ে গেছিল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসেছিল কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় বলেছিল, এই সব কত্তার দরকারি জিনিস। হাত দিবা না। কেমন?

উত্তর দেয়নি মিতুল। শুধু এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল আর বসে থাকতে থাকতেই কখন যে ঘুম নেমেছে টের পায়নি। হঠাৎ খুব কাছেই যেন শালিক পাখি ডেকে উঠল। কিন্তু ডাক শুনে পাখিটা যে শালিকই কী করে বুঝল মিতুল? কারণ, বাবা। ছোটবেলা থেকেই এই খেলাটা বড্ড প্রিয় মিতুলের। যখন তখন সে বাবার গলা ধরে ঝুলে পড়ত আর বলত, ও বাবা, বাবা। শালিক পাখির ডাক ডাকো।

মিতুলের বাবা মোটেই হরবোলা নন। তিনি জীবনে একটি মাত্র পাখির ডাকই নকল করতে শিখেছেন আর তা হল শালিক পাখি। ছোটবেলায় তাঁর একটা পোষা শালিক ছিল। মিতুলের আবদারে তিনিও সুর করে ডেকে উঠতেন, ভ্রুচি পাপিয়া, ভ্রুচি পাপিয়া, ড্রড়.. ড্রড়.. ড্রড়.. ড্রড।

তাই শুনে হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত মিতুল। বাবার কথা মনে পড়ে খুব কান্না পেল মিতুলের। আর হয়তো বাড়ি ফেরা হবে না। বাবা মায়ের সাথে আর কোনও দিন দেখা হবে না। ওরা এখন কী করছে কে জানে! নিশ্চয়ই ওরাও মিতুলের কথা ভেবে কাঁদছে।

আবারও কাছেই কোথাও একটা শালিক ডেকে উঠল। কিন্তু কান্নার দমকে আর সে দিকে নজর দিতে পারল না মিতুল।

কাঁদছ কেন? বাপ মায়ের জন্য মন কেমন করছে বুঝি?

গলাটা পেয়েই চমকে তাকাল মিতুল। দেখল, দরজায় দাঁড়িয়ে লোকনাথ। সে হেসে বলল, কেঁদো না। বলেছি তো, আজ তোমার ছুটি। একটু পরেই গ্রহণ লাগবে। আমি সাধনায় বসব। সাধনা শেষ, গল্পও শেষ। নাও, মিতুলের দিকে একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি ছুঁড়ে দিল সে, দেখতেই পাচ্ছ সামনে কত জল। যাও চান করে ওই নোংরা জামাকাপড়গুলো খুলে শাড়িটা পরে নাও।

চান, এই শব্দটাই যেন মিতুলকে আরাম দিল ভিতর থেকে। কত দিন হয়ে গেল স্নান করেনি সে। লোকনাথ বলল, আর হ্যাঁ, রক্ত আটকানোর জন্য পট্টি বাঁধার দরকার নেই বুঝেছ? ওটা খুলে রেখো।

চান করতে পারবে ভেবে যেটুকু স্বস্তি পেয়েছিল মিতুল, লোকটার এ কথায় আবার ফিরে এল ঘিনঘিনে ভাবটা। চরম বিপদের মধ্যেও মেয়েলি পরিচ্ছন্নতার অভ্যেস থেকে বেরতে পারেনি সে। ব্যাগটাকে কাছ ছাড়া করেনি কিছুতেই। ওর মধ্যেই তো ছিল স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটটা। যত বার সে ন্যাপকিন বদলাত তত বার নিজের যৌবনকে ধিক্কার দিত। এই পিরিয়ডসটাই তো কাল। এর জন্যই তো লোকটা তাকে ধরে এনেছে।

তাড়া দিল লোকনাথ, আর বসে থেকো না। ওঠো। বেশি সময় নাই। চান করে পাড়েই শাড়িটা বদলে নেবে। ওখান থেকে গেনু তোমারে সোজা সাধনার জায়গায় নিয়ে আসবে।

চলে গেল লোকনাথ। লোকটার কথা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল যে সাধনা শেষ হলেই ছুটি পাবে কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতায় সে ভরসা পেল না। যে লোক কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ‘মা’ সম্বোধনকে ‘নটী মাগি’-তে নামিয়ে আনতে পারে তাকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায় না। শাড়িটা বুকের কাছে জড়ো করে উঠে দাঁড়াল মিতুল। ঘর থেকে বেরতে যাবে আবার শালিক পাখির ডাক। থমকে গেল মিতুল। তার মনে হল, আওয়াজটা ঘরের মধ্যে থেকেই আসছে। আওয়াজটা খুব জোরাল নয়, কিন্তু স্পষ্ট। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হল মিতুল। কোনও শালিক তো নেই! তা হলে? তবে কি সে ভুল শুনল?

তখনই আবার ডেকে উঠল শালিক। এ বার আর একটা নয়। বেশ কয়েকটা একসঙ্গে। শব্দের উৎস অনুসরণ করে মিতুলের চোখ আটকে গেল ঘরের এক কোণায়। সেখানে কিছু খড় গাদা করে রাখা আর তার ওপরেই রয়েছে কিছু পুজোর উপকরণ, জবার মালা, একটা কাঠের বাক্স আর কয়েকটা মাটির জালা। মনে হচ্ছে যেন ওই জালাগুলোর ভিতর থেকেই আওয়াজটা আসছে! কাল রাতে পিশাচটা ওখানেই জিনিসপত্রগুলো রেখে মিতুলকে হাত দিতে বারণ করে গিয়েছিল। অন্ধকার ছিল বলে পিশাচটা কী রেখে গেছে মিতুল তখন দেখতে পায়নি।

অদ্ভুত মানবচরিত্র। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ তার চিরকালীন। তাই পিশাচের সাবধানবাণী মাথায় থাকা সত্ত্বেও মিতুল কিছুতেই কৌতূহল দমন করতে পারল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল জালাগুলোর কাছে। এক বার দরজার দিকে তাকিয়েই সে দ্রুত হাতে খুলে ফেলল একটা জালার মুখ। কিন্তু না, এ জালায় তো তেল রয়েছে। পরের জালাটার ঢাকনা খুলল সে। হতাশ হল। এটার মধ্যে কালো সর্ষে। আবার ডেকে উঠল শালিক। এ বার আর জালা চিনতে ভুল হল না মিতুলের। সে বুঝতে পারল লোকটা এই জালাগুলোর মধ্যেই পাখি ধরে রেখেছে। একটা না, অন্তত গোটা দু’-তিনেক পাখি তো আছেই। জালাগুলোর মধ্যে থেকে এক ধরনের স্পন্দন অনুভব করছে সে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল মিতুলের। আচমকাই পাখিগুলোর জন্য যে বিবশ হয়ে পড়ল। নিজের সাথে বড় মিল খুঁজে পেল পাখিগুলোর। সেও বন্দী, এই পাখিগুলোও বন্দী। তাকে হয়তো কেউ উদ্ধার করতে আসবে না, হয়তো সে মুক্তি পাবে না কিন্তু চাইলেই তো সে এই পাখিগুলিকে মুক্তি দিতে পারে। দ্রুত হাতে জালার ঢাকনা খুলতে গেল মিতুল আর তখনই তীব্র পচা গন্ধটা পেল। যে মুহূর্তে সে ছিটকে দরজার সামনে এল সেই মুহূর্তেই দরজায় এসে দাঁড়াল কদাকার পিশাচটি। রিনরিনে গলায় বলল, এখনও চানে যাও নাই? এবার কিন্তু কত্তায় কুপিত হবেন। যাও যাও।

নিরাশ দৃষ্টিতে জালাগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিতুল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মুক্তি দেব বললেই দেওয়া যায় না। মুক্তি বড় সহজ জিনিস নয়। শুধু একটা ব্যাপার কেউ খেয়াল করল না, মিতুলের হাতের টানে একটি জালা সামান্য কাত হয়ে গেছে। একটুখানি সরে গেছে মুখ ঢাকা দেওয়ার সরাটা।

স্নান হয়ে গেছে মিতুলের। ভেজা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। ক্লান্তিতে, দুঃশ্চিন্তায় চোখ দু’টো একটু কোটরাগত হয়েছে বটে কিন্তু তাতে মালিন্য আসেনি এতটুকু। মুখখানা টলটল করছে সদ্য ফোটা শিউলি ফুলের মতো। লাল পাড় সাদা শাড়িতে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। গেনুর যদি প্রেমিকের চোখ থাকত, তা হলে হয়তো সেও বাহবা দিত এই চিন্ময়ীকে। গেনুর সাথে হেঁটে আসছিল মিতুল। যে দিকে তাকাও সে দিকেই জল। শুধু এক দিকে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে রাস্তার সীমানা। মিতুল বুঝতে পারল, এটা কোনও ভেড়ি এলাকা। দেখতে পেল, দূরে একটা গাছের তলায় লোকনাথ দাঁড়িয়ে আছে। নানা কিছু ছড়ানো ছেটানো আছে গাছের তলায়। এত দূর থেকে সে সব কী বুঝতে পারল না মিতুল। তবে হঠাৎ দেখতে পেল আগুন জ্বলছে। দিনের আলোয় এত দূর থেকে আগুনের শিখা অমন স্পষ্ট হল কী করে! তখনই মিতুল খেয়াল করল, দিনের আলো মরে আসছে। তার দখল নিচ্ছে অকাল আঁধার। পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে ত্রস্ত হয়ে। গ্রহণ লেগেছে সূর্যে। হঠাৎ যেন পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল। কয়েক মূহর্ত সময় লাগল ধাতস্থ হতে, তার পরেই মিতুল বুঝতে পারল মৃদু এক কম্পন জেগেছে পৃথিবীর বুকে। ভূমিকম্প হচ্ছে। আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল লোকনাথ। গলা ছেড়ে বলে উঠল, গেনু রে, একে গ্রহণ তায় ভূমিকম্প। সব লক্ষণ মিলে যাচ্ছে। আজ তো আমারই দিন। সিদ্ধি হবে, সিদ্ধি। আমার কত বছরের পরিশ্রম আজ সফল হবে। অবশেষে আমি কথা রাখতে পারব। আয় আয়, পা চালিয়ে আয় তোরা। আর দেরি করিস না।

ওই কয়েক মুহূর্তই। তার পরেই থেমে গেল কম্পন। পিশাচটির সাথে সাথে দ্রুত এগোল মিতুলও। কিন্তু গাছতলার কাছাকাছি যেতেই ভয়ে শিউরে উঠল সে। কাঠকুটো দিয়ে একটা যজ্ঞবেদী বানানো হয়েছে। তার পাশে ছড়িয়ে আছে সাধনার নানা উপকরণ। কিন্তু যজ্ঞবেদীর পাশে ওটা কী শোয়ানো? কীসের ওপর এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লোকনাথ? কী ওটা? দু’হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠল মিতুল। তার দিকেই মুখ ফিরিয়ে রয়েছে একটি সদ্যোজাত শিশুর শব। চোখ, নাক, ঠোঁট এখনও কিছুই স্পষ্ট হয়নি, তার আগেই মৃত্যু এসেছে অতর্কিতে। হয়তো মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত সে অনুভব করতে পেরেছিল তার কাছে নতুন এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ। তার পরেই তাকে ফিরে যেতে হয়েছে অন্য এক অন্ধকারে। মাতৃজঠরের মতো এ অন্ধকারে মঙ্গলময় আশ্বাসবাণী নেই, রয়েছে কেবল শীতল নৈরাশ্য।

লোকনাথ বলে উঠল, ভয় পেলে না কি মা? কী করব বলো? বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই তো কারবার তাই এ সাধনায় শেষ দিন একটা কচি বাচ্চার মড়া লাগে। না না আমি মারিনি। খামোখা মারতে যাব কেন? এ দেশে এত এত মানুষ। পোকামাকড়ের মতো জন্মায় আবার পোকামাকড়ের মতো মরে। এ দেশে একটা মরা বাচ্চা জোগাড় করা খুব কি কঠিন বলো তো? তবে বাচ্চার মড়ার ওপর বসা খুব ঝকমারি। যুৎ করে বসা যায় না। আর এই গেঁড়াটার ওপর বেশি চাপ দিলে তো প্যাটা গেলে যাবে। তাই একখান হাঁটু তুলে বসব আর কী!

খল খল করে হাসতে লাগল লোকনাথ। মিতুলের মনে হল, হয়তো পিশাচটির মধ্যেও এই লোকটির চেয়ে বেশি মনুষ্যত্ব আছে। অসহায় হয়ে যজ্ঞবেদীর এক পাশে বসে পড়ল সে। এক বার মিতুলের দিকে তাকিয়ে মৃত শিশুটির গায়ে হাঁটু চাপিয়ে বসে পড়ল লোকনাথ। দু’হাতের এক বিশেষ মুদ্রা করে চোখ বুজল। পিশাচটি দাঁড়িয়ে রইল অনুগত পোষ্যের মতো।

বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল লোকনাথ আর থেকে থেকে কীসের যেন শুকনো গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে লাগল আগুনে। বিশ্রি কটু গন্ধে ভরে গেল চারপাশ। মিতুল চোখ তুলে দেখল, ধীরে ধীরে সূর্যের শেষ বলয়টুকুও মুছে গেল আকাশের বুক থেকে। ঘনাল গাঢ় কৃষ্ণরঙ। পূর্ণগ্রাস। অজানা এক আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠল মিতুল আর তখনই চোখ খুলল লোকনাথ। টকটকে লাল দুই চোখ। গম্ভীর গলায় বলে উঠল, আমার বাক্স থেকে হাড়ের কাঁকই নিয়ে আয় গেনু। মেয়ের খোপা বেঁধে দে। গলায় মালা পরা। সব নিজে হাতে করবি হতভাগা।

আজ্ঞে কত্তা, থপথপ করে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেল পিশাচটি যেখানে মিতুল এতক্ষণ ছিল।

ভয়টা ফিরে আসছিল। আবার ভয় পাচ্ছিল মিতুল। কী করতে চাইছে লোকটা? কেন ওই কদাকার পিশাচ তার চুল বেঁধে দেবে? কেন তার গলায় মালা পরাবে? এ কাজগুলি তো লোকটা নিজেও করতে পারত। তা হলে ওই ‘সব নিজে করবি হতভাগা’ কথাটার মানে কী? তার এই প্রসাধনের সঙ্গে কি পিশাচটির কোনও সম্পর্ক আছে? কাঁপা গলায় সে বলে উঠল, এ সব করতে বলছেন কেন? কী করবেন আমায় নিয়ে?

লোকনাথ উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঝড়ের মতো এসে উপস্থিত হল পিশাচটি। হাতে তার কাঁকই এবং জবা ফুলের মালা কিন্তু উত্তেজনায় সে থরথর করে কাঁপছে। তার অবস্থা দেখে চমকে উঠল লোকনাথ। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পিশাচটি কাতরে উঠল, সব্বোনাশ হয়েছে কত্তা। একটা পাখি উড়ে গেছে।

ছিটকে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল লোকনাথ। শবের গায়ে পা ঠেকিয়ে রাখল। কিন্তু এই প্রশমিত উত্তেজনা ক্রোধ হয়ে ফুটে বেরল তার সর্বাঙ্গ দিয়ে। যজ্ঞের একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে সে ছুঁড়ে মারল গেনুর দিকে। হুঙ্কার দিয়ে উঠল, কী করে উড়ে যায়? তোরে সাবধানে রাখতে বলেছিলাম তো।

ভয়ে কাঁপছে পিশাচটি, সে হাত জোড় করে বলল, রেখেছিলাম কত্তা। মুখ চাপা দিয়ে খড়ের ওপর চাপায়ে রেখেছিলাম। আমার দোষ নাই। ভূমিকম্পে একটা জালা উল্টে গেছে কোনও ভাবে। আপনি পাখিটারে ধরেন কত্তা, নয়তো সে আবার ওই বুড়োটারে পথ দেখায়ে নিয়ে আসবে।

চুপ গুয়োর ব্যাটা, ফের একটা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারল লোকনাথ, তুই আমায় বলে দিবি আমি কী করব? এখন আমি আসন ছেড়ে উঠে পাখি ধরতে যাব? সাধনাটা মাটি করে দেব? জানিস না একবার আসনে বসলে সাধনা শেষ না হওয়া অবধি ওঠা যায় না? ও পাখিরে এখন আর ধরা যাবে না। ওদের আসতে সময় লাগবে। তার মধ্যে আমারে যা করার করে ফেলতে হবে। ভোদার মতো মুখ না বানিয়ে কাজে লেগে পড়। খোঁপা বাঁধ। আরে বাঁধ না হারামজাদা।

ভয়ে ভয়ে গেনু হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মিতুলের পেছনে। কাঁকই দিয়ে আঁচড়ে দিতে শুরু করল তার ভেজা চুল। চোখ বন্ধ করে ফেলল মিতুল। প্রাণপণে চেষ্টা করল কোনও ভাল দৃশ্যের কথা ভাবতে। একটা পাহাড়, একটা নদী, অন্ততপক্ষে সুন্দর একটা ফুল! একটি পিশাচ তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। তার কাঁধে, গালে এসে পড়ছে পিশাচের দুর্গন্ধময় শ্বাসরোধকারী নিঃশ্বাস! এমন অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা যে তার সাথে ঘটছে মিতুল যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল না। অসহ্য এই বাস্তব থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিল অনেক দূরে, যতটা দূরে গেলে একে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। কিন্তু মিতুল পারল না। তার মাথার মধ্যে ঘনিয়ে উঠল অন্য একটা চিন্তা, সে বুঝতে পারল না, পাখি উড়ে গেছে বলে এত রেগে গেল কেন লোকটা?

. . .

নজর রাখবার জন্য মোবাইল ফোনের টাওয়ার খুব ভাল জায়গা। এতটা উঁচুতে বসলে অনেকটা দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। ডাকবাংলো মোড়ের কাছাকাছি এমনই একটি মোবাইল ফোনের টাওয়ারের শীর্ষে বসেছিল পেচকটি। একই দিনে দু’বার রাত্রি সচরাচর আসে না। আজ দিনটি শিকারের জন্য প্রশস্ত। সে অপেক্ষা করছিল কখন একটি শিকার তার আওতার মধ্যে আসবে এবং ঘাতক নখে তাকে বিঁধে ফেলবে সে। ফিরে যাবে বাসায়। বুভুক্ষু সন্তানেরা তার পথ চেয়ে বসে আছে। আচমকা সে দেখতে পেল, বেশ কিছুটা নীচ দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো উড়ে আসছে একটি বাচ্চা শালিক পাখি। যেন তার বড্ড তাড়া। যেন এক্ষুনি গন্তব্যে পৌঁছতে না পারলে ভারী বিপদ হয়ে যাবে। মনে মনে হাসল পক্ষীচূড়ামণি, আজ আর গন্তব্যে পৌঁছনো হল না শালিক শিশুটির। দুই ডানা প্রসারিত করে দিল সে। অন্ধকারে ঝিকিয়ে উঠল তার স্ফটিকস্বচ্ছ দুই চোখ। মাথাটা সে একবার ঘুরিয়ে বৃত্তাকারে। তার পর আকাশে একটি পাক খেয়ে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মতো নেমে আসতে লাগল নীচের দিকে।

২২

লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলির মতো শালিক পাখিটা আছড়ে পড়ল পল্লবের গাড়ির জানলায় তার পর খসে পড়ল মাটিতে। হতাশায় দিগ্বিদিক মুখরিত করে ডেকে উঠল একটা ধূসর পেঁচা আর উড়ে গিয়ে বসল উঁচু একটি গাছের ডালে।

ওরা ছড়িয়েছিটিয়ে বসেছিল বারাসাত থানার বাইরেই। নিরাশা গ্রাস করেছিল সবাইকেই। শুধু তিতাস প্রাণপণে বিশ্বাস করে যাচ্ছিল সেই মেয়েটি আসবে। তিতাস বিশ্বাস করছিল সেই প্রবাদটায়, মর্নিং শোজ দ্য ডে। প্রথম অসম্ভবকে সম্ভব করে সে তো মিতুলের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল। এই গোটা লড়াইকে যদি একটা দিন হিসেবে কল্পনা করা হয় তা হলে দিনের শুরুটা তো যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। তা হলে কেন দিনের শেষে প্রত্যাশা পূরণ হবে না?

কেউই কারও সাথে কোনও কথা বলছিল না। শুধু দীপক পাল মাঝে মাঝেই ছুটে আসছিলেন ভাদুড়ি মশায়ের কাছে আর ঘড়ি দেখিয়ে জিগ্যেস করছিলেন, স্যার গ্রহণ আরও ঘণ্টা দুয়েক চলবে বলুন? দু’ঘণ্টা মানে তো অনেকটাই সময়। তার মধ্যে কোনও একটা ব্যবস্থা হবে না?

উত্তর দিতে পারছিলেন না ভাদুড়ি মশায়। শুধু শেষ বার প্রশ্নের সময় দীপক পালের হাত ধরে বলেছিলেন, এসো, আমার কাছে এসে বোসো।

বাইরের বড় বেঞ্চটায় ভাদুড়ি মশায়ের পাশে বসে পড়েছিলেন দীপক পাল। দু’হাতে মুখ ঢেকে নীরবে কাঁদছিলেন আর তাঁর পিঠে স্নেহশীল পিতার মতো আদরহাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন বৃদ্ধ। অস্ফুটে বলছিলেন, নিয়তি কেন বধ্যতে! তবু একটাই সান্ত্বনা, নিয়তির সাথে এই অসম লড়াইয়ে তুমি পালিয়ে আসোনি। লড়াই করেছ। কেঁদো না দীপক। কন্যাকে নিয়ে সুখস্মৃতি রোমন্থন করো। তোমার অন্তরের পরিপূর্ণতা স্পর্শ করুক তোমার কন্যাকেও। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করো, তার শেষ মুহূর্তটি যেন…

কথা শেষ করতে পারলেন না বৃদ্ধ, তার আগেই জলে ভরা দুই চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকালেন দীপক পাল। সে দৃষ্টির একটাই অর্থ হয়, মিথ্যে স্তোক দেবেন না দয়া করে। থমকালেন ভাদুড়ি মশায়। তিনিও জানেন, যতই প্রার্থনা করুন মিতুলের শেষ মুহূর্তটি কিছুতেই আনন্দময় হতে পারে না।

ঠিক এই সময় শালিক পাখিটি আছড়ে পড়ল পল্লবের গাড়ির কাচে। ঘটনাটা সবার আগে লক্ষ্য করেছিল পল্লব। সে চেঁচিয়ে উঠল, যাহ! পাখিটা বোধহয় গেল।

পল্লবের দৃষ্টি অনুসরণ করে তিতাস ছুটে গেল গাড়ির কাছে আর দেখল, মাটিতে পড়ে ছটফট করছে একটা শালিক পাখি। পাখিটা প্রাণপণে চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বারে বারে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাটিতে। মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল তিতাসের। দু’হাতের পাতায় পাখিটাকে মাটি থেকে তুলে নিতে গিয়ে সে বুঝতে পারল, পাখিটার একটা ডানা ভেঙে গেছে। পাখিটাকে বুকের কাছে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে বলল, অমিয়, একটু তুলো পাওয়া যাবে রে? খুব চোট পেয়েছে পাখিটা।

তুলো ভিজিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে পাখিটাকে জল খাওয়াচ্ছিল তিতাস। এতক্ষণে যেন সামান্য ধাতস্থ হয়েছে পাখিটা। আচমকা সে এমন একটা কাণ্ড করল, সবাই থতোমতো খেয়ে গেল। তিতাসের কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল সে আর ভাঙা ডানায় শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে গোঁত্তা খেতে খেতে একেবারে সঞ্জয়ের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল।

এ কী! এ কী! বলে একটু সরেই বসেছিল সঞ্জয় কিন্তু তার পরেই অবাক হয়ে দেখল, পাখিটা ছোট্ট ঠোঁট দিয়ে তার প্যান্টের একটা কোণা ধরে টানছে। সেই টান স্বাভাবিক নয়। তার মধ্যে যেন একটা কাতরতা রয়েছে। রয়েছে এক ব্যাকুল আহ্বান। সবাই অবাক হয়ে পাখিটাকে দেখছিল। অমিয় বলল, পাখিটার মধ্যে কেমন একটা ছটফটানি কাজ করছে দেখেছিস তিতাস? যেন কিছু একটা বলতে চাইছে তাই না?

কিছু কিছু মানুষের আক্কেল দাঁত ওঠে নব্বই বছর বয়েসে। পল্লবও সেই জাতের মানুষ। স্থান কাল বিবেচনা না করেই বেফাঁস বলে ফেলল, লাভ নেই। কত মেয়ে এমন টানাটানি করে সঞ্জয়কে ওর জায়গা থেকে নড়াতে পারেনি, সেখানে এ তো একটা শালিক পাখি।

তিতাস জানে, পল্লবকে বলে কোনও লাভ নেই। পল্লবের কিডনিতে এক বার টিউমার হয়ে সেটা ফেটে গেছিল। মরমর অবস্থা। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ট্রলির ওপর আচ্ছন্নের মতো শুয়েছিল পল্লব। এক জন নার্স তার পাশে স্যালাইনের বোতল ধরে ধরে হাঁটছিলেন। সঙ্গে তিতাস, সঞ্জয়রাও ছিল। হঠাৎ তিতাস দেখেছিল, সেই আচ্ছন্ন অবস্থাতেও নার্সের দিকে তাকিয়ে পল্লব মিটিমিটি হাসছে। সুস্থ হয়ে ফেরার পর সে পল্লবকে জিজ্ঞেস করেছিল, অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে তুই হাসছিলি কেন? যা বলেছিল, শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল তিতাস। ফিক করে হেসে পল্লব বলেছিল, আরে ওই নার্স দিদিটার কত বড় গোঁফ। চাইলে তা দেওয়া যাবে। তুই খেয়াল করিসনি?

রেগে উঠে তিতাস বলেছিল, প্রথমত, তখন তুই মরে যাচ্ছিলি। এ সব দেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের কথা যেন আর না কোনও দিন না শুনি। এ কী ধরনের অসভ্যতা!

এমন অনেক ভর্ৎসনা তিতাস করেছে পল্লবকে। লাভ হবে না জেনেও করেছে। আজও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ধমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, চুপ করো। এটা ইয়ার্কির সময় নয়।

বেচারা ভাদুড়ি মশায়! উনি তো আর পল্লবকে তেমন ভাল করে চেনেন না। যদি চিনতেন, এ কথাটা বলার জন্য ভারী লজ্জা পেতেন। তবে পল্লব কিন্তু বেশ চুপসে গেল বৃদ্ধের ধমক খেয়ে। বেঞ্চ থেকে উঠে ক্রাচ ঠুকে ভাদুড়ি মশায় এগিয়ে এলেন সঞ্জয়ের দিকে। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন পাখিটার দিকে। পাখিটার কাণ্ড দেখে পল্লব তো হকচকিয়ে গেছিলই। এ বার বৃদ্ধের কাণ্ড দেখে আরও চমকে গেল। বৃদ্ধ বললেন, তিতাস, পাখিটাকে তুলে ধরো তো আমার চোখের কাছে।

বিনা বাক্যব্যয়ে পাখিটাকে দু’হাতে তুলে নিল তিতাস। এক দৃষ্টে তিতাসের করতলে তিরতির করে কাঁপতে থাকা পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। ততক্ষণে সবাই ঘিরে ধরেছে বৃদ্ধকে। কিন্তু একটা সাধারণ পাখির মধ্যে বৃদ্ধ এত মন দিয়ে কী দেখছেন কেউই বুঝতে পারছে না আর প্রশ্ন করার সাহসও পাচ্ছে না। অস্বস্তিকর নীরবতা, শুধু বিনবিনে এক আশঙ্কা যেন মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাছোড়বান্দা মশার মতো।

গলা ঝাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। চোখ তুলে বললেন, ঠিক বলেছ অমিয়। পাখিটা কিছু বলতে চায় কিন্তু ওকে মেরে ফেলতে হবে।

বৃদ্ধের এই অদ্ভুত কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেল ওরা সকলে। তিতাস আঁতকে উঠল, কী বলছেন স্যার? মেরে ফেলতে হবে মানে?

পাখিটার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, আমি অনুভব করছি, এ কোনও সাধারণ পাখি নয়। পাখির স্থূল শরীরে বন্দী হয়ে আছে কোনও আত্মা যে আমাদের কিছু বলতে চাইছে।

মিতুলের খোঁজ দিতে চাইছে কি? চমকে উঠে বলল তিতাস।

হতে পারে। হতেই পারে। এ হয়তো সেই মেয়েটিই, তুমি যার প্রত্যাশা করছিলে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওদের চোখ। ভাদুড়ি মশাই বললেন, কিন্তু এ অবস্থায় ও তো কিছুই বলতে পারবে না। যদি পথ দেখাতেও চায়, ভাঙা ডানা নিয়ে সেও অসম্ভব। তাই ওকে মুক্তি দিতে হবে এই স্থূল শরীর থেকে। ক্ষতিকারক পোকামাকড় ছাড়া আমি আজ অবধি কিছু মারিনি। এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তোমাদের মধ্যেই কাউকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।

ওরা যে সকলেই মিতুলকে বাঁচাতে চায় এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই কিন্তু পাখিটাকে মারার কথায় অদ্ভুত এক দ্বিধা এসে ঘিরে ধরল ওদের। হয়তো যা করতে বলা হচ্ছে তা মঙ্গলের জন্যই তবু সজ্ঞানে, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে একটা ডানা ভাঙা শালিক পাখিকে মেরে ফেলাটা খুব সহজ কাজ বলে মনে হল না এই পাঁচটি মানব সন্তানের। আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন দীপক পাল। হাত বাড়িয়ে তিতাসকে বললেন, আমাকে দিন।

এই বোধ হয় ঠিক হল। নিজের কন্যাকে বাঁচানোর জন্য অন্য কাউকে প্রাণী হত্যার পাপ থেকে মুক্তি দিলেন দীপক পাল। ছোট্ট নরম তুলতুলে একটা শরীর। বুকের পালকে লেগে আছে জীবনের ওম। ইতিমধ্যেই একটি ডানা ভেঙে সে যন্ত্রণাকাতর। দু’আঙুলে শক্ত করে গলার কাছটা চেপে ধরলেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগার কথা নয়। তবু মিনিটের পর মিনিট কাটিয়ে দিচ্ছিলেন দীপক পাল। প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন পাখিটার গলা টিপে ধরতে কিন্তু পারছিলেন না। থরথর করে কাঁপছিল তাঁর সমস্ত শরীর। অসহায় দু’টি চোখ যেন ফেটে পড়ছিল যন্ত্রণায়। বাকিরা দমবন্ধ করে তাকিয়ে তাঁর দিকে। কিন্তু পারলেন না দীপক পাল। কেঁদে ফেললেন। হাহাকার করে বলে উঠলেন, যতই যাই হোক। এ তো খুন স্যার। আমি পারব না খুন করতে। তাতে আমার মিতুলের আরও ক্ষতি হবে। ও আরও কষ্ট পাবে।

বেঞ্চের ওপর পাখিটাকে নামিয়ে রেখে ছুটে চলে গেলেন কিছুটা দূরে। তার পর ভেঙে পড়লেন কান্নায়। তাঁর অবরুদ্ধ কণ্ঠ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে আসতে লাগল বারে বারে, মিতুল! মিতুল!

অসহায় পিতাকে কী ভাষায় সান্ত্বনা দিতে হয় তা ওদের কারোরই জানা নেই। তবু ওরা ঘিরে ধরল দীপক পালকে। হতাশ হয়ে এক বার পাখিটার দিকে তাকিয়ে ভাদুড়ি মশায়ও এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য অরক্ষিত হয়ে পড়ল পাখিটি। আর ওই এক মুহূর্তেই দূরবর্তী গাছের ডাল থেকে ধেয়ে এল একটি ধূসর বিদ্যুৎ এবং তীক্ষ্ন নখে শালিক শিশুটিকে বিঁধিয়ে উড়ে গেল দূরে।

. . .

সঞ্জয় বলল, সামনে থেকে বাঁ দিকে। মধ্যমগ্রাম চৌমাথার সিগন্যাল ভেঙে পুলিশের জিপটা ঢুকে পড়ল বাদু রোডে। গাড়িটা রয়েছে ফোর্থ গিয়ারে। হর্ন থেকে হাত সরাচ্ছেন না দীপক পাল। গিয়ারও নামাচ্ছেন না। ভৈরব গতিতে ছুটে আসা জিপটা দেখে ভয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছে অন্য গাড়িগুলো। রাস্তার ধারে নেমে যেতে যেতে কেউ কেউ গালাগালও দিয়ে উঠছে জিপটাকে। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই দীপক পালের। তিনি একবগগার মতো চালাচ্ছেন। কারণ মিতুলকে বাঁচানোর জন্য হাতে আর মাত্র আধ ঘণ্টা সময় আছে। আধ ঘণ্টা পরেই ছেড়ে যাবে গ্রহণ। তাঁকে টানা রাস্তার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে সঞ্জয়। আসলে সঞ্জয় বলছে না, সঞ্জয়ের মাথার মধ্যে বসে রাস্তা বলে দিচ্ছে একটা সাত আট বছরের মিষ্টিমতো ছেলে। যাকে সঞ্জয় প্রথম দেখেছিল, বারাসাত স্টেডিয়ামে। এতক্ষণে ছেলেটি আর মেয়েটির যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছে সে।

২৩

দাউদাউ করে জ্বলছিল যজ্ঞের আগুন আর সে দিকে তাকিয়ে জড়ভরতের মতো বসেছিল মিতুল। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরে গেছে, এই লোকনাথ বলে লোকটা তাকে মিথ্যে বলেছিল। না, হয়তো মিথ্যে বলেনি, কিন্তু তার বলার মধ্যে যে ব্যঞ্জনা ছিল তাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছিল মিতুল। লোকটা বলেছিল, আজ মিতুলের ছুটি। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় মিতুল বুঝতে পেরেছে, এ ছুটি সে ছুটি নয়। তাকে নিয়ে অন্য কোনও পরিকল্পনা আছে লোকটার আর সেটা এই ভয়াবহ পিশাচটার সাথে জড়িত। নয়তো এতক্ষণ ধরে পিশাচটা কেন তার পাশে বসে হাত ধরে থাকবে!

চুল আঁচড়ে, খোঁপা বেঁধে তার গলায় একটা জবার মালা পরিয়ে দিয়েছিল পিশাচটা। তার পরই লোকনাথ তাকে কাছে ডেকে নিচু গলায় কী যেন বলেছিল। জবার মালা পরিয়ে দিয়েছিল গলায়। খুব আনন্দিত হয়ে পিশাচটা থপথপ করতে করতে এসে এসে বসে পড়েছিল মিতুলের ঠিক পাশে। রিনরিনে গলায় বলেছিল, হাতখান দাও খুকি।

সম্মতির অপেক্ষা না করে তার ভয়ালদর্শন তিন আঙুলওয়ালা খসখসে হাতের মধ্যে তুলে নিয়েছিল মিতুলের ছোট্ট করতল। সেই থেকে এক বারের জন্যেও মিতুলের হাত ছাড়েনি পিশাচটা। মাঝেমাঝেই সে মিতুলের দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে মুচকি হেসে উঠছে আর কালো বাঁকানো নখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মিতুলের হাতের পাতায়। আর পারছে না মিতুল। সে প্রাণপণে চেতনা হারাতে চাইছে। একমাত্র চেতনা হারালেই হয়তো এই অদ্ভুত গা ঘিনঘিনে ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যেত, কিন্তু ওই যে, মুক্তি অত সোজা ব্যাপার নয়। জ্ঞান হারাচ্ছে না মিতুল তবে সে বুঝতে পারছে সময়ের সাথে সাথে নিষ্ঠুর এক জড়তা গ্রাস করছে তাকে। চাইলেও সে আর হাত পা নাড়াতে পারছে না। যেন একটা অদৃশ্য বাঁধন পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলছে তাকে কিলবিলে সরীসৃপের মতো।

সামনেই মৃত শিশুটির গায়ে হাঁটু তুলে দিয়ে এক মনে মন্ত্র পড়ে চলেছে লোকনাথ আর মাঝে মাঝেই ঘটি থেকে গাঢ় কালচে লাল তরল ঢেলে দিচ্ছে শবের মুখে। শবের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সেই ঈষৎ আঠালো পদার্থটি। মিতুল জানে সেটা কী! সে ভাবছে, এই ঘেন্নার দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল ছিল কিন্তু মুহূর্তেই হাতের পাতায় পিশাচের নখের স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারছে, জীবন বা মৃত্যু কোনওটাই আর তার হাতে নেই। সে ওই লোকনাথ নামের লোকটার পুতুল মাত্র। সে যেমন নাচাবে তেমনই নাচতে হবে মিতুলকে।

আচমকা মন্ত্রপাঠ বন্ধ করে দিল লোকনাথ। দপ করে খুলে ফেলল বন্ধ দুই চোখ। শিউরে উঠল মিতুল। পৃথিবীর যাবতীয় হিংসা যেন এসে পুঞ্জীভূত হয়েছে ওই দুই চোখের মণিতে। ভেড়ির জোলো হাওয়ায় আগুনের লাল আভা মদ্যপ নর্তকীর মতো ছন্দভ্রষ্ট হচ্ছে লোকনাথের শরীর জুড়ে। মূর্তিমান শয়তানের মতো দেখাচ্ছে তাকে। উঠে দাঁড়াল সে। চিমটে দিয়ে ঘটিটা বাড়িয়ে ধরল আগুনের ওপর। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। ক্রমে ধোঁয়া বেরতে আরম্ভ করল ঘটির মুখ থেকে। ঘটির ভিতর টগবগ করে ফুটতে লাগল মিতুলের রক্তধৌত অনিষিক্ত ডিম্বাণুরা। লোহিততপ্ত হয়ে উঠল পেতলের ঘটিটা। উজ্জ্বল লাল আভা বিকিরণ করতে শুরু করল পেতলের স্বাভাবিক সোনাটে রং। ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল লোকনাথের ঠোঁটের কোণে। নরম গলায় সে বলল, গেনু, গলার মালাটা এ বার মেয়ের সাথে বদলাবদলি কর।

জড়তা শরীরকে গ্রাস করলেও চেতনাকে গ্রাস করতে পারেনি। অন্তর থেকে কেঁপে উঠল মিতুল, মালা বদলের তো একটাই অর্থ হয়।

কিছুই করতে হল না মিতুলকে। পিশাচটি নিজেই মালা দু’টো বদলাবদলি করে নিল।

লোকনাথের মধ্যে একটা অস্থির উত্তেজনা। সে বলল, বাহ! একটা কাজ হয়ে গেল। ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলাম। কাছে আয় গেনু। কাছে আয়।

প্রভুর ডাকে উঠে পড়ল অনুগত পিশাচটি। থপথপ করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল প্রভুর সামনে। ঘটিটাকে সেই আগুনের মধ্যে ধরে রেখেই লোকনাথ বলল, সাধনার ঠিক শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এই বার আমি আমার সমস্ত শক্তি তোর মধ্যে সমর্পণ করে ক্ষীণশক্তি হয়ে যাব। তুই আমার ছেলে। তোর মধ্যে দিয়েই আমার শক্তি জন্ম দেবে ভবিষ্যতের। শুধু তার আসার অপেক্ষা। সে এলেই আবার আমি ফিরে পাব আমার শক্তি আর তখন আমি, তুই আর সে মিলে হয়ে উঠব ভগবানের সমান। বাকি কাজটা কিন্তু তোকেই করতে হবে গেনু। মনে আছে তো যা বলেছি? পারবি তো?

আবেগে যেন গলা বুজে এল পিশাচটির। প্রভু তার ওপর এত বড় কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে ধন্য। অস্ফুটে বলে উঠল, পারব কত্তা। পারব।

গর্জন করে উঠল লোকনাথ, পারতে তোকে হবেই, আর তার পরেই বাঁ হাত সোজা করে আকাশের দিকে তুলে দিল সে। তর্জনী, অনামিকা আর কনিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করল বিচিত্র এক মুদ্রা। অত্যন্ত দ্রুত এক বিজাতীয় মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল।

সেই মন্ত্রোচ্চারণ যেন যেন ছুটে গেল দিকচক্রবাল পার হয়ে। দূর দূরান্ত থেকে ডেকে আনতে লাগল বজ্রগর্ভ মেঘেদের। যজ্ঞকুণ্ডের ওপর কালো আকাশে ষড়যন্ত্রকারীর মতো জমা হতে লাগল তারা। শুরু হল ঘনঘন বজ্রপাত। দিগন্ত মথিত করে ধেয়ে এল তীব্র ঝোড়ো হাওয়া। ফুঁসে উঠল জল, দুলে উঠল মাটি, প্রাণভয়ে আর্তনাদ করতে লাগল পক্ষীকুল। আসন্ন প্রলয়ের সঙ্কেত জাগল দিকে দিকে। বিচিত্র সেই মুদ্রা ত্যাগ করে বাঁ হাতের পাঁচটি আঙুল খুলে দিল লোকনাথ। যেন মুঠো করে আকাশ থেকে পেড়ে আনতে চাইছে কিছু। একটা সময় তীব্র বেগে সেই হাত সে নামিয়ে আনল যজ্ঞবেদীর দিকে। সেই হাতের টানেই যেন মেঘের পেট থেকে বিদ্যুতের একটা শিখা আছড়ে পড়ল যজ্ঞের আগুনে আর তখনই… তখনই ডান হাতের সেই লোহিততপ্ত ঘটি থেকে ফুটন্ত রক্ত লোকনাথ ঢেলে দিল গেনুর মাথায়।

গলা চিরে তীক্ষ্ন জান্তব এক আর্তনাদ করে উঠল গেনু। এমনই সেই আর্তনাদ যা ভয়ের বীজ বুনে দেয় মজ্জায় মজ্জায়। শিরা ধমনী জুড়ে বইতে শুরু করে ভয়ের স্রোত। সারা শরীর জুড়ে বসন্তের দাগের মতো দগদগে হয়ে ফুটে বেরয় ভয়। ঝাপসা চোখে মিতুল দেখল, গেনুর শরীরটা গলে যাচ্ছে একটু একটু করে আর সেই জায়গায় ঘনিয়ে উঠছে ঘন কালো এক নিকষছায়া। গলিত পিচের মতো গাঢ় চটচটে এক অন্ধকার চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে গেনুকে। আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে প্রেতের মতো হাসছে লোকনাথ। একটা সময় সেই অন্ধকারের বৃত্ত রচনা সমাপ্ত হল। যজ্ঞবেদীর ঠিক পাশে শূন্যে দুলতে লাগল অতিকায় পিউপার মতো তরঙ্গিত এক অন্ধকার। ধীর পায়ে সেই অন্ধকারের পিণ্ডের দিকে এগিয়ে এল লোকনাথ। একঘেয়ে সুর করে ডাকতে লাগল, গেনু আয়। গেনু আয়। গেনু আয়।

সেই ডাকের সাথে সাথে কম্পন বাড়তে লাগল পিণ্ডটিতে। কী যেন এক মহামারী ছটফট করছে পিণ্ডের অভ্যন্তরে। আচমকা সেই পিণ্ড চিরে বেরিয়ে এল একটা সুদীর্ঘ বাঁকানো কালো নখ। আর তার পরেই আরও কয়েকটি নখ ভিতর থেকে ফালা ফালা করে দিল সেই অন্ধকার এবং তার মধ্যে থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে আতঙ্কে পাথর গেল মিতুল। এ যে গেনু তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই কিন্তু প্রভুর সমস্ত শক্তি আত্মস্থ করে সে হয়ে উঠেছে আরও ভয়াবহ। আকারে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ এবং পরনের ধুতির মতো কাপড়টি আর নেই। সে এখন সম্পূর্ণ নগ্ন। বিশাল বিকৃত লিঙ্গটি প্রাণঘাতী মারণাস্ত্রের মতো উত্থিত হয়ে রয়েছে ঠিক মিতুলের দিকে।

নতুন খেলনা পেলে শিশুরা যেমন খুশি হয়ে ওঠে ঠিক তেমন খুশি হয়ে উঠেছে লোকনাথ। উত্তেজনায় অস্থির সে। যেন আর তর সইছে না। এক ঝলক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, যা গেনু যা। আর সময় নাই।

রিনরিনে স্বরে এক জান্তব শব্দ করে আগুনের সিল্যুয়েটে অতিকায় এক ভল্লুকের মতো পিশাচটি এগিয়ে আসতে থাকল মিতুলের দিকে। পূর্বতন গেনু কদাকার হলেও তার আচরণের মধ্যে সামান্য সরসতা ছিল কিন্তু এই গেনু যেন শুধুই রিরংসার প্রতিমূর্তি। অন্য সময় হলে হয়তো মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই ভয়ঙ্করের সামনে থেকে মিতুল পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু এখন যে তার সে ক্ষমতাও নেই। তার শরীরের দখল নিয়েছে লোকনাথের বশীকরণ। মিতুলের সামনে এসে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াল গেনু। একটিও কথা খরচ না করে এক টানে সরিয়ে দিল মিতুলের বুকের কাপড়। উন্মুক্ত হয়ে গেল শুভ্র শঙ্খের মতো মিতুলের দু’টি স্তন। পর মুহূর্তেই নখে বিঁধিয়ে ফড়ফড় করে সে ছিঁড়ে ফেলল মিতুলের পরনের কাপড়টি। দমকা বাতাসে দূরে উড়ে গেল অসহায় মেয়ের সমস্ত আব্রু। সে দিকে তাকিয়ে গেনুর পাঁশুটে সবুজ রঙের ঘাতক চোখে হিংসা ছাপিয়ে ফুটে বেরল কাম। পিচ্ছিল হয়ে উঠল বিশাল বিকৃত লিঙ্গাগ্রটি। মিতুলের সমস্ত চৈতন্যকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে লাগল এই কদর্য দৃশ্যটি। চোখ বুজতে চাইল মিতুল। কিন্তু হায়, চোখের পাতাও তার বশে নেই। তাকে চেয়ে দেখতেই হবে সব কিছু। সাক্ষী থাকতে হবে অকল্পনীয় এক ধর্ষণের, যেখানে ধর্ষিতা হবে সে নিজে।

চিৎকার করে উঠল লোকনাথ, নে গেনু। মেয়েটারে নে। গ্রহণ ছেড়ে আসছে। গ্রহণ থাকতে থাকতে তোরে ওর গর্ভসঞ্চার করতে হবে।

লোকনাথের দিকে একবার ঘুরে তাকাল গেনু। তার পর সামনে ফিরে নখের ধাক্কায় মিতুলকে শুইয়ে দিল। ঝুঁকে ফাঁক করে দিল তার দুই পা। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল দুই পায়ের মাঝখানে। আসন্ন এক অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিটি পল অনুপল অপেক্ষা করতে লাগল মিতুল। সে অনুভব করতে পারল বিশাল বিকৃত লিঙ্গটি এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু গেনুর লিঙ্গ মিতুলকে স্পর্শ করা মাত্রই আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। অদৃশ্য কোনও এক শক্তির ধাক্কায় গেনু ছিটকে পড়ল লোকনাথের পায়ের কাছে! যেন কেউ ঘেটি ধরে দূরে ছুঁড়ে দিল কুকুরছানাকে।

গেনু যতটা না বিস্মিত হল তার থেকেও বেশি বিস্মিত হল লোকনাথ। এমন তো হওয়ার কথা নয়! যদি ওই শালিক পাখি নীরেন ভাদুড়িকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে চলেও আসে তারও ক্ষমতা নেই এই গেনুকে আটকানোর। তবে কি তার সাধনায় কোনও ত্রুটি রয়ে গেল? কিন্তু না, সব কিছু তো সে নিয়ম মতো করেছে। তার শক্তি সঞ্চারিত করেছে গেনুর মধ্যে। তাতে তো কোনও বাধা আসেনি। তা হলে এখন কী হল? কেন মেয়েটিতে প্রবিষ্ট হতে পারল না গেনু? উন্মাদের মতো সে ছুটে গেল মিতুলের দিকে আর একটু নজর করেই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। যে দিক থেকে বিপদের কোনও কল্পনাই করেনি সে, বিপদ এসেছে ঠিক সেই দিক থেকেই। অন্তত ঘণ্টাখানেক আগেই মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে মেয়েটির। বিন্দুমাত্র রক্তপাত হচ্ছে না। আর রক্তপাত না হলে গেনুর ক্ষমতাই নেই সে মেয়েটিতে প্রবিষ্ট হয়। সাধনার শেষ ধাপের না মেলা হিসেবটিই অদৃশ্য শক্তি হয়ে গেনুকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে দূরে। পণ্ড হয়ে গেছে লোকনাথের সাধনা।

দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরল লোকনাথ। তার পর মিতুলের বুকে বসিয়ে দিল একটা লাথি। চিৎকার করে উঠল, চার দিনের মাথায় মাসিক বন্ধ হয়ে যায় কোন কসবীর? কোন রক্ষুসী তুই? কোন ডাইনি? কেন আমার সব আশায় জল ঢেলে দিলি? কেন পণ্ড করে দিলি আমার এত বছরের পরিশ্রম?

চুলের মুঠি ধরে মিতুলকে একটার পর একটা চড় মারতে শুরু করল লোকনাথ। একটা করে চড় মারছে আর কেঁদে উঠছে। অবিশ্রান্ত গালিগালাজ করছে। মিতুলের তুলতুলে গাল দু’টো লাল টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সেখানে বসে গেছে পাঁচ আঙুলের ছাপ। ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। আচমকা তাকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকনাথ। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, গেনুরে দিয়ে না, তোরে মারব আমি। কুকুরের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে মারব। শেষ করে দিল, আমার সব শেষ করে দিল বেবুশ্যে মাগি।

বলতে বলতেই ছুটে গিয়ে যজ্ঞকুণ্ড থেকে তুলে নিল একটা বেশ মোটা জ্বলন্ত কাঠ। সেটা হাতে নিয়ে ঘুরে তাকাল মিতুলের দিকে। হঠাতই মিতুল অনুভব করল, তার হাতে পায়ে সাড় ফিরে আসছে আবার। কোনওক্রমে দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল সে। তাকে নড়াচড়া করতে দেখেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠল বিশাল পিশাচটি। হুকুমের প্রত্যশায় রিনরিনে গলায় বলে উঠল, কত্তা?

সে দিকে না তাকিয়েই লোকনাথ বলল, তুই না। আমি। আমি মারব মেয়েটাকে। আর বাকি সব কটারে শেষ করবি তুই। কী ভেবেছে এরা? আমি হেরে যাব? হেরে যাওয়ার পাত্তর নয় লোকনাথ চক্কোত্তি। আবার সাধনা করব আমি। আরও কঠিন সাধনা। আমার কথা না রেখে আমি মরব না।

খুনী চোখে তাকিয়ে কাঠ হাতে সে এগিয়ে যেতে লাগল মিতুলের দিকে। ঠিক তখনই হেড লাইটের তীব্র আলোয় ধাঁধিয়ে গেল লোকনাথের চোখ। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করতে করতে সে বুঝতে পারল তীব্র গতিতে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে তার দিকে। নড়ার অবকাশ পেল না লোকনাথ, তার আগেই সর্বশক্তিতে অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরলেন দীপক পাল। একটা জোর ঝাঁকুনি অনুভূত হল গাড়ির ভিতর। ঝড়ের মুখে কুটোর মতো উড়ে গেল লোকনাথের দেহটা। ছিটকে প্রায় বিশ ফুট দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। এক বার কেঁপে উঠে তার পর স্থির হয়ে গেল।

মিতুল, বলে ডেকে উঠল একটা চেনা গলা। এতক্ষণ পর নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারাল মিতুল। ছুটে গিয়ে দু’হাতে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল তিতাস। রাহুর পূর্ণগ্রাস থেকে সামান্য মুক্তি পেয়ে ঝিকিয়ে উঠল সূর্যের বলয়টি। কিন্তু হঠাতই তীক্ষ্ন জান্তব এক চিৎকারে কেঁপে উঠল চারপাশ। ওরা দেখল কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে বিভীষিকা। আতঙ্কে বাক্যস্ফূর্তি হল না কারও। গেনুর এই বীভৎস রূপ ওদের কাছেও নতুন। ওরা জানতেও পারল না, গেনুর মাথার মধ্যে তখন ঘুরে চলেছে একটাই কথা। প্রভুর শেষ আদেশ, ‘আমি মারব মেয়েটারে। আর বাকি সব কটারে শেষ করবি তুই।’

গেনুর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। সে শুধু হুকুম তামিল করতে জানে। প্রভু হয়তো নেই কিন্তু তাঁর আদেশ তো আছে। আদেশের ততক্ষণ মৃত্যু হয় না, যতক্ষণ না তা পালন করা হয়। অনিবার্য মৃত্যুর মতো সে এগিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। সেই মুহূর্তে এক জনের কথাই মনে পড়ল ওদের। কাতর গলায় তিতাস বলে উঠল, স্যার, বাঁচান।

কিন্তু কোনও সাড়া এল না ভাদুড়ি মশায়ের দিক থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকিরা জিপ থেকে নেমে এলেও বৃদ্ধকে নামানো হয়নি। জিপের কাছে ছুটে গিয়েও থমকে গেল পল্লব আর অমিয়। পেছনের সিটে চোখ বুজে নিস্পন্দ হয়ে বসে আছেন ভাদুড়ি মশায়। এতটাই নিস্পন্দ সেই বসার ভঙ্গি যে তাতে প্রাণ আছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। অমিয় ব্যাকুল হয়ে ডাকল, স্যার, চোখ খুলুন স্যার।

চোখ খুললেন না ভাদুড়ি মশায়। ওদের ব্যাকুল আহ্বান বিন্দুমাত্র কাঁপন ধরাতে পারল না বৃদ্ধের নিস্পন্দতায়। ও দিকে তীব্র শ্বাসরোধকারী পূতিগন্ধময় পিশাচটি ক্রমেই এগিয়ে আসছে। তার চলাফেরায় কোনও দ্রুততা নেই। সাফল্যের সম্ভাবনায় সে নিশ্চিত। তার এই গতিপথে সবার আগে রয়েছে তিতাস। মিতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রয়েছে সে। তার পর একে একে সঞ্জয়, দীপক পাল, অমিয়, পল্লব এবং সবশেষে ভাদুড়ি মশায়। মিতুলকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তিতাস। অচেতন কিশোরীটির থেকেই যেন সাহস পেতে চাইছে সে। গেনু এসে দাঁড়াল তার সামনে। রাহুগ্রাস থেকে আর একটু মুক্তি পেয়েছে সূর্য। সেই সামান্য আলোতেও চকচক করে উঠল গেনুর বাঁকানো করাল নখর আর তখনই গন্ধটা পেল তিতাস। তীব্র পচা গন্ধের মধ্যেও এক ঝলক জীবনের মতো তার নাকে ঝাপটা মারল কোনও পারফিউমের সুবাস। কিন্তু সেই গন্ধেই যেন বিপদের ইঙ্গিত পেল গেনু। তিতাসকে ছেড়ে শিকারী শ্বাপদের দ্রুততায় ঘুরে গেল পেছন দিকে। ওরা দেখল, বেশ কিছুটা দূর থেকে গেনুর দিকে হেঁটে আসছে একটা ছায়ামূর্তি। গন্ধটা যেন তার কাছ থেকেই আসছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না তবু সেই ছায়ামূর্তিকে যেন খুব চেনা লাগল দীপক পালের। অস্ফুটে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই খেয়াল করলেন, চার পাশ থেকেই গেনুর দিকে এগিয়ে আসছে আরও কয়েকটি ছায়ামূর্তি। বিস্মিত হল বাকিরাও। একটু আগেই তো জনমানবহীন ছিল ছিল জায়গাটা। তা হলে, কোত্থেকে এল এরা? এরা কারা? আরও অবাক হল গেনুর অস্থিরতা দেখে। গেনু যেন ভয় পেয়েছে। অপ্রত্যাশিত কিছুর আশঙ্কায় সে যেন দিশেহারা। ধীরে ধীরে সেই দশ-বারোটি ছায়ামূর্তি গেনুর নিকটবর্তী হল। এ দৃশ্য সম্পূর্ণ বিবশ করে ফেলেছে অমিয়দের। তারা নিথর হয়ে দেখল, গেনু যেন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এক পা পিছোল গেনু। কিন্তু আর এক পা পিছনোর আগেই সেই ছায়াদের দল থেকে তিরের মতো ছুটে এল একটি ছায়া এবং আছড়ে পড়ল গেনুর ওপর। তার দেখাদেখি বাকি ছায়াগুলিও তীব্র গতিতে এসে ঘিরে নিল গেনুকে। ছায়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল গেনুর সমস্ত অবয়ব। কয়েক মুহূর্তের একটা আন্দোলন তার পরেই গেনুর গলা থেকে নির্গত তীব্র এক আর্তনাদ কানে তালা ধরিয়ে দিল ওদের। বিহ্বল হয়ে, সেই ছায়া শরীরের ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যাচ্ছিল, তাতেই ওরা দেখল, গেনুর শরীরটা ক্রমে বেঁকে দুমড়ে মুচড়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আর ততই বেড়ে চলেছে সেই তীব্র তীক্ষ্ন যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ। এক সময় সেই আর্তনাদের রেশ ফেলে রেখে ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল গেনুর অবয়ব আর স্পষ্ট হতে শুরু করল ছায়া শরীরগুলি। শোনা যেতে লাগল তাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ। সন্ধে হলে চায়ের দোকানে যেমন গুঞ্জনের জন্ম হয় তেমন একটা গুঞ্জন উঠে এল সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে। যেন নিজেদের মধ্যে কোনও কথা বলছে তারা। কী বলছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে বলছে। তার মধ্যেই সেই গুঞ্জন ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি কণ্ঠ, মায়ের কসম খেয়েছিলাম গুরু। এই দানবের খুন না চুষলে আমার ঘুম হবে না। দিয়েছি স্যাটা ভেঙে।

চমকে উঠল তিতাস। এ কণ্ঠস্বর যে তার খুব চেনা। কিন্তু সে এখানে এল কী করে? চিৎকার করে উঠল তিতাস, সমীর, সমীর।

উত্তর দিল না কেউ। স্পষ্ট হয়ে ওঠা সেই ছায়ার দল তখন আবার একযোগে হাঁটতে শুরু করেছে দিগন্তের দিকে। ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের স্পষ্টতা। যেতে যেতে এক জন শুধু ফিরে তাকাল। ঠোঁটের কোণে তার মৃদু হাসি। সেই অস্পষ্টতাতেও এ হাসি চিনতে ভুল হল না কারও। প্রিয় বন্ধুর স্মৃতি সততই সমুজ্জ্বল। কিশোরবেলার মনখারাপের মতো টাটকা ক্ষত আর কী আছে পৃথিবীতে? তার মতো করে কাঁদাতে আর কে পারে! অজান্তেই চোখ ভিজে উঠল অমিয়র। অস্ফুটে বলে উঠল সে, প্রতিম!

পল্লব, সঞ্জয় আর তিতাস ঝাপসা চোখে দেখল, ঘোর লাগা মানুষের মতো অমিয় এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তম বন্ধুর দিকে। ছায়া হয়ে মিলিয়ে যেতে যেতে সুপ্রতিম বলে উঠল, আসিস না অমিয়। এখানে আসিস না।

রাহুগ্রাস থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেল সূর্য। আলোয় ধুয়ে গেল চরাচর। পাখিরা ফের ডেকে উঠল। এ ডাকে আর আশঙ্কা নেই, রয়েছে মুক্তির আনন্দ। শুধু চোখের জলে ভাসতে ভাসতে অমিয়, সঞ্জয়, পল্লব আর তিতাস তাকিয়ে রইল দিগন্তের দিকে। একটু আগেই যেখানে মিলিয়ে গেছে ফেলে আসা প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু হস্টেল, কলেজ স্ট্রিট আর যৌবনের সমস্ত উদ্যাপন।

এতক্ষণে চোখ মেলে তাকালেন ভাদুড়ি মশায়। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলেন সিটের ওপর। এক দিন যারা গেনুর শিকার হয়েছিল, আজ তারাই গেনুর অন্তিম দশার কারণ হল। মৃত আত্মাকে জাগানো এবং তাকে দিয়ে কোনও বিশেষ কাজ করানো বড় সহজ ব্যাপার নয়। এ অতি উচ্চমার্গের সাধনা। অখণ্ড মনঃসংযোগ প্রয়োজন হয়। আত্মাদের আহ্বান কালে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয় পৃথিবী থেকে। জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসে তাতে। মিতুলের মুখখানা একবার দেখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আর পেরে উঠলেন না ভাদুড়ি মশায়। ঘুম নামল তাঁর দু’চোখ জুড়ে আর ঘুমনোর ঠিক আগে তিনি দেখতে পেলেন, কিছুটা দূরেই এক কৃশকায়া দীর্ঘাঙ্গী রমণীর দুই হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে। খুশিতে ঝলমল করছে তাদের চোখগুলো।

মিতুলের মাথাটা কোলে নিয়ে গাড়িতে বসেছিল তিতাস। মিতুলের জ্ঞান ফিরে এসেছে কিন্তু এখনও সে আছন্ন অবস্থায় রয়েছে। অনেকক্ষণ আগেই কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে তাকে। মেয়ের পা দু’টো কোলে নিয়ে শক্ত করে ধরে বসেছিলেন দীপক পাল। কোনও কথা বলছিলেন না। শুধু নীরবে কাঁদছিলেন, আর তিতাস ভাবছিল সেই বাচ্চা মেয়ের কথাটা। সে বলেছিল, গেনুকে কেউ একটা আটকানোর ব্যবস্থা করছে। সে রাতে তা হলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে সমীর ওই কারখানাতেই গেছিল! নিজেকে ধিক্কার দিল তিতাস, কেন তখন মাথায় আসেনি সমীরের নামটা? তার তো ভাবা উচিত ছিল, হেরে যাব জেনেও মৃত্যুর সঙ্গে যারা পাঞ্জা লড়তে পারে তাদের প্রত্যেকের একটাই নাম হয়, আর সেটা, কইমাছ সমীর!

২৪

ভাদুড়ি মশায়ের লাইব্রেরি ঘরে বসে ছিল ওরা। ওরা বলতে অমিয়, সঞ্জয়, পল্লব, তিতাস আর দীপক পাল। মিতুল এখন আগের থেকে ভাল আছে। যদিও ট্রমাটা পুরোপুরি কাটেনি তবে আশা করা যাচ্ছে আর কিছু দিনের মধ্যেই সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। বারো হাত কালী মন্দিরের পূজারী এবং কলেজ গেটের ফলওয়ালা বলরাম চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, মিতুলের এখনই মৃত্যু নেই, তার আয়ুরেখা দীর্ঘ, সে কথা মিলে গেছে। মিতুল ফিরে আসার আনন্দে প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে বেশ খানিকটা টাকা তুলে পঞ্চাশটা অনাথ বাচ্চার পড়াশোনার জন্য একটা ট্রাস্টে দান করেছেন দীপক পাল। পল্লব চোখ কপালে তুলে বলেছিল, এতগুলো টাকা দিয়ে দিলেন পালদা? এত অশিক্ষিত এ দেশে, আর দু’টো বাচ্চা বেশি অশিক্ষিত থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো?

পল্লবের কথায় হা হা করে হেসে উঠেছিলেন দীপক পাল। বলেছিলেন, সবটাই দিয়ে দিতাম বুঝলেন? কিন্তু মিতুলের বিয়ের কথা ভেবে আটকে গেলাম।

এই সব কিছু নিয়েই কথা হচ্ছিল, চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল অপালা, ভাদুড়ি মশায়ের স্কলার নাতনি। বসে পড়ে বলল, প্লিজ হেল্প ইয়োরসেলফ। এ বার আমার একটা প্রশ্ন আছে।

সবাই ঘুরে তাকাল অপালার দিকে। অপালা বলল, দেখুন, দাদুর কাছে আমি সবটাই শুনেছি। আপনাদের এই টিমওয়ার্কটাকে আমার লাল সেলাম। কিন্তু তার পরেও আমার একটা খটকা থেকে গেছে। দাদু বলছেন বটে অলৌকিক কিন্তু অলৌকিকেরও তো একটা লজিক্যাল ব্যাখ্যা থাকতে হবে। আমি অ্যাকাডেমিশিয়ন, তাই স্বভাব দোষে সেই ব্যাখ্যাটাই খুঁজে চলেছি।

সঞ্জয় বলল, কোন লজিকটা মিলছে না বলুন?

চায়ে চুমুক দিয়ে অপালা বলল, সবচেয়ে বড় লজিকটাই তো মিলছে না। মিতুল যখন ওই লোকনাথ বলে লোকটার কবলে ছিল এবং মায়া করে লোকটা জায়গাটা সবার চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছিল তখন মিতুলের কাছে পৌঁছনোর প্রথম শর্তটা কী ছিল? দাদুই বলেছেন আমায়, কোনও রজঃস্বলা নারী, যার পিরিয়ডস চলছে একমাত্র তিনিই যেতে পারবেন মিতুলের কাছাকাছি। আমরা সবাই জানি, তিতাস ওই বাচ্চা মেয়েটির দেখানো পথে মিতুলের কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু…

তাকে থামিয়ে দিয়ে অমিয় বলে উঠল, এতে কিন্তুর কী আছে? তখন হয়তো তিতাসের…

এ বার অমিয়কে থামিয়ে দিল অপালা, পিরিয়ডস চলছিল না।

থমকে গেল সবাই। একমাত্র তিতাসের মুখ অভিব্যক্তিহীন। অপালা বলে চলল, এত লোক থাকতে বাচ্চা মেয়েটি কেন শুধু তিতাসকেই পথ দেখিয়েছিল? কারণ সে জানত, একমাত্র তিতাসই মিতুলের কাছে যেতে পারবে। কিন্তু তার জন্য তো সবার আগে তিতাসের পিরিয়ডসটা স্টার্ট হতে হবে। যে রাতে তিতাস মিতুলের কাছে গেছিলেন, তখনও তো তাঁর পিরিয়ডস শুরু হতে তিন দিন দেরি। কী তিতাস? আমি কী ভুল বলছি?

এ বার অপার বিস্ময় জেগে উঠল তিতাসের চোখে। সেই বিস্ময় ধরা পড়ল তার কণ্ঠেও। সে বলে উঠল, ইয়েস। ইউ আর রাইট। বাট হাউ ডু ইউ নো?

অপালা বলল, আপনার মনে আছে, আমায় ডিসচার্জ দেওয়ার আগে আমি আপনার চেম্বারে গেছিলাম। আপনি আমায় কয়েকটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিলেন?

হ্যাঁ মনে আছে।

সে দিনই আপনার টেবিলে একটা ক্যালেন্ডার দেখেছিলাম যেখানে প্রতিটা মাসে একটা করে ডেট গোল দাগ দেওয়া আছে। সেপ্টেম্বর অবধি দেওয়া ছিল। অক্টোবর থেকে ফাঁকা। এটা সেপ্টেম্বর মাস। একটু মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, আগের মাসের ডেটের থেকে পরের ডেটটা ঠিক আঠাশ দিন পরে। কোনও মাসে যদি সেই ডেটটা একটু এগিয়ে বা পিছিয়ে এসেছে, পরের মাসের ডেটটাও কিন্তু সেই হিসেবেই আঠাশ দিন এগিয়ে বা পিছিয়ে এসেছে, বাকিদের দিকে তাকিয়ে অপালা বলল, ফলে আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি কেন ডেটগুলোয় গোল করে রেখেছেন তিতাস। আমরা যারা ওয়ার্কিং উওম্যান, অনেক সময় কাজের চাপে এই ডেটটা মিস করে যাই। তখন অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই চোখের সামনে ডেটটা লিখে রাখলে সুবিধে।

প্রশংসার গলায় তিতাস বলে উঠল, আপনার তো মারাত্মক চোখ!

নাতনির প্রশংসায় গর্বিত হলেন বৃদ্ধ। বলে উঠলেন, ও ছোট থেকেই ও রকম। সব কিছু একেবারে খুঁটিয়ে দেখে।

অপালা বলল, বাদ দাও এ সব। আমরা পয়েন্ট থেকে সরে যাচ্ছি। আমার প্রশ্ন হল, যদি তিন দিন পরেই পিরিয়ডস হবে তা হলে সে রাতে তিতাস কী করে মিতুলের কাছে গেলেন? আমি এটাকে কিছুতেই অলৌকিক বলে মানতে পারছি না।

সবাই এক সাথে কৌতূহলী চোখে ঘুরে তাকাল তিতাসের দিকে। সত্যিই তো, এ ভাবিয়ে তোলার মতোই প্রশ্ন! ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে তিতাস বলল, আপনি ঠিক বলছেন অপালা। নরমাল পিরিয়ডসের ডেট আমার সে দিন থেকে তিন দিন পরেই ছিল বটে কিন্তু স্যারের কাছ থেকে সবটা জানবার পরে আমি সে দিনই দু’টো ওষুধ খাই যাতে আমার পিরিয়ডসটা এগিয়ে আনা যায়। অলৌকিকেরও ব্যাখ্যা হয়। আমার পিরিয়ডস স্টার্ট হওয়া মাত্রই আমি বাচ্চা মেয়েটির দেখা পেয়েছিলাম। তার আগে অবধি কোনও অলৌকিক ঘটেনি।

অবাক হয়ে তিতাসের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল সবাই। তিতাস ফের বলল, আসলে আমি চাইছিলাম যাতে অলৌকিক কিছু হয়। অলৌকিক ঘটাবার ক্ষমতা তো আমার হাতে নেই তাই যেটুকু হাতে ছিল ট্রাই করেছিলাম।

অপালা বলে উঠল, মাই গুডনেস! ইউ আর সাচ আ ওয়ান্ডারফুল উওম্যান বাট পিরিয়ডস এগিয়ে আনার ওষুধ হয়? আমি তো জানতাম বিফোর টাইম পিরিয়ডস স্টপ করানোর ওষুধ আছে।

হাসল তিতাস, দুটোই আছে। পরেরটা আমি সে রাত্রেই মিতুলকে খাইয়ে দিয়ে এসেছিলাম। অনেক সময় এগুলো মিসও হয় বাট আই হ্যাড নো আদার অপশন। মিতুলকে নিয়ে আমি একা ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না।

কয়েক মুহূর্ত তিতাসের দিকে তাকিয়ে রইল অপালা। তার পর উঠে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, কোনও অলৌকিক না। কিচ্ছু না। মিতুলকে বাঁচিয়েছেন আপনি। ইউ সেভড দ্যাট পুওর গার্ল। আই লাভ ইউ তিতাস। আমি ছেলে হলে আই উড লাভ টু ম্যারি ইউ।

লজ্জায় মাথা নিচু করল তিতাস। মুগ্ধ হয়ে সে দিকে তাকিয়ে রইল পল্লব। লজ্জা পেলে এমনিতেই মেয়েদের পরীর মতো দেখায়, সেখানে তো সুন্দরী বলে তিতাসের নামডাক আছেই। পল্লব ঠিক করে ফেলল, আজ সে একেবারে হাঁটু ভেঙে বসে তিতাসের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এমন রমণীরত্ন মাঝে মাঝে যে চিড়বিড়িয়ে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। না না, তিন বছর আগে রাগ করাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। এখনই কিছু একটা বলবে ভাবছিল সে কিন্তু তার আগেই অপালা বলে উঠল, তা হলে দাদু, এ বার মানলে তো সবটাই অলৌকিক নয়?

না, মানলাম না। মাথা নেড়ে বলে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়।

এখনও মানলে না? হতাশ শোনাল অপালার গলা।

হাসলেন বৃদ্ধ। বললেন, দিদিভাই, এ জগতের সবচেয়ে বড় অলৌকিক হল মানুষের ইনটেলিজেন্স। বুদ্ধিমত্তা। সেটা ছিল বলেই না বিজ্ঞানকে ধরা গেল হাতের মুঠোয় আর এ ভাবে তার প্রয়োগ সম্ভব হল। অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছ তুমি তিতাস। আর এ জিনিস একদিনে তৈরি হয় না। তার জন্যেও লাগে নিবিড় সাধনা আর অভ্যাস। কী বলেছিলাম মনে আছে তো? মন্ত্রের প্রায়োগিক দিকই হল তন্ত্র। তুমি যে মহাতান্ত্রিক। এসো মা, আশীর্বাদ করি, সুখী হও। সৌভাগ্যবতী হও।

তিতাসের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, সংস্কৃত বিভাগ, বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ।

. . .

ভাদুড়ি মশায়ের বাড়ি থেকে বেরতে বেরতে দীপক পাল ওদের বললেন, এক বার আমার বাড়ি থেকে ঘুরে যাবেন না কি আপনারা? মিতুল খুশি হবে আপনাদের দেখলে।

পল্লবের মনে হল, অমিয় যেন একটু আগ বাড়িয়েই বলে উঠল, যাব তো। আপনারা এগোন, আমি আসছি।

এ নিয়ে বেশ কয়েক বার দীপক পালদের বাড়ি গেছে ওরা। পল্লব খেয়াল করেছে, ও বাড়িতে গেলেই অমিয় তার বুলেটটা নিয়ে যায়। মিতুলও বেশ ঘন চোখে তাকায় অমিয়র দিকে। সে আলতো গলায় অমিয়কে বলল, অমিয়, ব্যাপারটা বাল্য বিবাহ হয়ে যাবে না তো রে?

কড়া চোখে পল্লবের দিকে তাকাল অমিয়। তার পর হেসে ফেলল। নিচু গলায় বলল, ম্যাচিওর মেয়েরা কবিতা পছন্দ করে আর বাচ্চা মেয়েরা বাইক এবং ফিগার। কোনদিন শক্তি, সুনীল, ভাস্কর চক্রবর্তী পড়তে শুরু করবে তার আগে বাবা ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি। পরে না হয় আমিও কবিতা পড়ে নেব।

ফিক করে হেসে ফেলল পল্লব। সে ভাবছে, মিতুলের সাথে অমিয়র বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও কি দীপক পাল অমিয়কে স্যার বা আপনি করে বলবেন? শ্বশুর জামাইকে আপনি আজ্ঞে করলে মোটেই সেটা ভাল দেখাবে না।