নিকষছায়া – ১৫

১৫

ধড়মড় করে উঠে বসল সঞ্জয়। সে দরদর করে ঘামছে। ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের জন্য চোখ লেগে এসেছিল তার। চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। চিৎকার করে উঠল সে, পল্লব। পল্লব।

পাশের ঘর থেকেই দুড়দাড় করে দৌড়ে এল পল্লব আর অমিয়। সঞ্জয়কে দেখে দু’জনেই ঘাবড়ে গেল ওরা। সঞ্জয়ের চোখ বিস্ফারিত। থরথর করে কাঁপছে সে। ছুটে এসে তাকে জাপটে ধরল পল্লব, কী হয়েছে? সঞ্জয়? এই সঞ্জয়।

কাঁপা গলায় সঞ্জয় বলল, আমি ওই শিসটা শুনলাম পল্লব। তোকে বলেছিলাম না, একটা শিসের শব্দ শুনছিলাম। সেইটা। মামির কান্নার আওয়াজও শুনেছি।

পল্লব বলল, কখন শুনলি?

এইমাত্র। তাতেই ঘুম ভেঙে গেল। ভয় পেয়ে তোকে ডেকে উঠলাম। মামি কি আমায় কিছু বলতে চায়? কিন্তু সেটা কী? তার সাথে কি মিতুলকে উদ্ধারের কোনও সম্পর্ক আছে? এ দিকে সময় তো ফুরিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই গ্রহণ লাগবে। কী হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না পল্লব।

দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল সঞ্জয়। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে অমিয়। চোখের ইশারায় তাকে জলের বোতলটা আনতে বলল পল্লব। অমিয় সবে দু’পা এগিয়েছে তখনই বেজে উঠল কলিং বেল। ভুরু কুঁচকে গেল অমিয়র, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। এখন আবার কে এল?

পল্লব বলল, আমি জল আনছি। তুই দরজাটা খোল।

দরজা খুলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অমিয়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তিতাস। উস্কোখুস্কো চুল। চুলে মাকড়সার জাল। হাতে পায়ে ধুলো। হাঁফাচ্ছে। হাপরের মতো ওঠা নামা করছে তার বুক। তীব্র বিস্ময়ে অমিয় বলে উঠল, এ তোর কী অবস্থা তিতাস?

অমিয়র গলা পেয়ে ততক্ষণে ছুটে এসেছে পল্লব আর সঞ্জয়। তিতাসের অবস্থা দেখে ওরাও একই রকম বিস্মিত। দরজাটা বন্ধ করে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াল তিতাস। কিছু না বলতেই ঢাকনা খুলে জলের বোতলটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরল পল্লব। এক নিঃশ্বাসে অনেকটা জল খেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতাস বলল, মিতুল কোথায় আছে আমি জানি। জায়গাটা দেখে এসেছি। সেখান থেকেই আসছি।

কিছু কথা থাকে খুবই সহজ। কিন্তু হজম করতে অনেক সময় লাগে। এ কথাটাও সে জাতের কথা। কেমন যেন ভেবলে গিয়ে তিতাসের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওরা।

হাতে দু’বার মৃদু তালি দিল তিতাস, হেই গাইজ!

সাড় ফিরে এল ওদের। পল্লব অনেক কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু যা বলতে চাইছিল তার কিছুই বলে উঠতে পারল না। তার বদলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, তুই… তুই একা কেন গেছিলি? তোর যদি কিছু হয়ে যেত!

এক মুহূর্তের জন্য পল্লবের চোখে চোখ রাখল তিতাস। তবে সে কিছু বলার আগেই সঞ্জয় বলে উঠল, কিন্তু তুই গেলি কী করে?

তিতাস বলল, একবারে বলছি। রেডি হ তোরা। আমাদের ভাদুড়ি স্যারের বাড়ি যেতে হবে। এক্ষুনি।

না চাইতেই পল্লব ককিয়ে উঠল, এখন? এত রাতে? বুড়ো হেবি টেটিয়া। এখন গেলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে।

অসভ্যের মতো কথা বলবি না পল্লব। আমরা ওনার বাড়িতে বুজ পার্টি করতে যাচ্ছি না। আর উনি মিতুলের ব্যাপারে যথেষ্ট কনসার্ন। পালদাকে ফোন কর অমিয়। সোজা স্যারের বাড়ি আসতে বল। জলদি কর। উই আর রানিং আউট অব টাইম।

পল্লব দেখল, তিন বছরে অভ্যেস খুব একটা বদলায় না। তিতাসের ধমক খেয়ে সে এত দিন পরেও নার্ভাস হয়ে গেল এবং রেডি হতে গিয়ে টি-শার্টটা উল্টো করে পরে ফেলল। এটাও হয়তো সে খেয়াল করত না যদি না গাড়িতে তিতাস ফিসফিস করে বলে উঠত, টি-শার্টটা উল্টো পরেছিস।

হেডলাইটে রাতের অন্ধকার চিরে হু হু করে ছুটতে লাগল গাড়িটা।

১৬

দাঁতে দাঁত চেপে লোকনাথ বলল, সত্যি করে বল তুই কী কল করেছিস? কী করে এ জায়গার সন্ধান পেল ছেলেটা?

ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না ছাপিয়ে ভেসে এল তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ। লোকনাথের চোখে চোখ রেখে সেই দীর্ঘাঙ্গী বলল, বলব না।

রাগে বিকৃত হয়ে এল লোকনাথের গলা, বলবি না তো? তুই হলি চিরকেলে নষ্টা মেয়েছেলে। তোর সাথে ভাল মুখে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে। এখনও তুই লোকনাথ চক্কোত্তিকে চিনিসনি। তুই বলবি না তোর বাপ বলবে।

বলেই সেই সরু হাড়টা দিয়ে বাতাসের ওপরেই সজোরে প্রহার করল লোকনাথ। আগুনরঙা হয়ে সেই প্রহার ফুটে উঠল দীর্ঘাঙ্গীর শরীরে। কাতর আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বাতাসের ওপর মুহুর্মুহু আঘাত করতে থাকল লোকনাথ আর চিৎকার করতে লাগল, বল। ওই ছেলেটাকে কে পথ দেখিয়েছে বল। তোরে বলতেই হবে আজ।

মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেল লোকনাথ তবু সেই দীর্ঘাঙ্গীর মুখ দিয়ে আর্তনাদ ছাড়া আর একটিও শব্দ বার করতে পারল না সে। হাড়টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে মাটির ওপরেই শুয়ে পড়ল লোকনাথ। হাঁ করে দম নিতে লাগল। শরীরময় অজস্র আগুনরঙা ক্ষত নিয়ে ধুঁকতে লাগল লোকনাথের মৃত স্ত্রী। সঞ্জয়ের মৃত মামি। আড় চোখে সে দিকে দিকে দেখল লোকনাথ তার পর শুয়ে শুয়েই হঠাৎ নরম গলায় বলে উঠল, তোমার বড় জেদ রমা। কোনও দিন আমার একটা কথা ঠিক মতো শুনলা না। আরে বাবা আমি তোমার পতি। কথায় বলে পতি পরমগুরু। তা আমারে সেই সম্মান তুমি কোনও দিন দিলা না। মরার আগে অবধি এ দুঃখ আমার যাবে না। আমি চিরকাল ভাল মুখে তোমায় বুঝায়েছি, তুমি শোনোনি। শেষকালে আমি কঠিন হতে বাধ্য হয়েছি। আজও সেই এক ঘটনা ঘটালে। কথায় আছে, স্বভাব যায় না মলে। তা তুমি দেখি সে কথা একেবারে সত্যি করে দিলে। মরেও তোমার স্বভাব বদলাল না, উঠে বসল লোকনাথ, দেখো রমা, ঠিক যখন করেছি তোমার পেট থেকে কথা বার করব তখন তো আমি করবই। আসলে কী বলো তো রমা, তুমি যতই নিজেরে চালাক ভাবো অতটা চালাক তুমি না। আরে বাবা, চিরকাল তো আমি তোমার ওপরে চড়েছি। তুমি তো আর আমার ওপরে চড়োনি। তোমার দুব্বল জায়গাগুলো আমি জানি। এই অন্তরটিপুনিটা দিতে চাইছিলাম না। সেই বাধ্য করলে। গেনু।

থপথপ করে এসে দাঁড়াল মূর্তিমান শয়তানটি। প্রভুর এই নরম গলাটা গেনু চেনে। সে জানে এর পরেই প্রভু এমন একটা কিছু বলবেন যা ভয়ানক। এই সব সময় ভারী ভাল লাগে তার। মিহি গলায় সে বলল, হুকুম করেন কত্তা।

উদাস গলায় লোকনাথ বলল, তোর কত্তামারে তো আমি কিছুই দিতে পারিনি তাই ভেবেছিলাম তার শেষ ইচ্ছেটা আমি রাখব। কিন্তু রাখতে পারলাম না।

চকিতে মুখ তুলে তাকাল দীর্ঘাঙ্গী। ঘৃণার পাশাপাশি সে দৃষ্টিতে এখন আশঙ্কা। কান এঁটো করা হাসি হাসল লোকনাথ, ঠিক ধরেছ রমা। ছেলেমেয়ে হারানোর পর ওরেই তো সবচেয়ে ভালবেসেছিলে তুমি।

কাতর আর্তনাদ করে উঠল রমা, না! না!

গর্জে উঠল লোকনাথ, চুপ শঅলী। যা গেনু, আমার ভাগ্নার মাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে আয়। কত্তামারে নৈবেদ্য দে। আমার জেদের ঠাকুর। কত জেদ ঠাকুরের। ঠাকুররে নৈবেদ্য দিতে হবে না? তবে হ্যাঁ, কলিজাটা তুই খেয়ে নিস।

১৭

বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল অপালা। অবাক হয়ে বলল, আপনারা! এত রাতে!

তিতাস বলল, স্যারের সাথে খুব দরকার। স্যার কি শুয়ে পড়েছেন?

জানি না। আসুন।

অপালার বলার ধরনে থমকে গেল ওরা। তিতাস বলল, জানি না মানে?

ভেতরে আসুন। বলছি।

বসার ঘরে উৎসুক হয়ে অপালার মুখের দিকে তাকিয়েছিল ওরা। অপালা বলল, দাদুর কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না। সেই যে আমাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরল তার পর থেকেই অসম্ভব রকমের অস্থির হয়ে গেছে। আমায় কিছু বলছে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে সারাক্ষণ যে একটা ছটফটানি চলছে আমি বুঝতে পারছি। এত বয়েস হয়েছে। এখন তো এই সব একসাইটমেন্ট ঠিক না। আজ ভোরবেলা মানে খুব ভোরবেলা, ধরুন চারটে নাগাদ আমাকে তুলে দিল। দেখি তখনই স্নান করা হয়ে গেছে। আমি বললাম, এত সকালে স্নান করেছ কেন তুমি? গিজার চালিয়েছিলে?

উত্তর দিল না। বলল, আমি লাইব্রেরি ঘরে যাচ্ছি। কিছু কাজ আছে। আমি নিজে থেকে না বেরনো অবধি আমায় ডাকবে না।

আমি বললাম, ডাকব না মানে? খেতেও ডাকব না?

দাদু বলল, আমি খাব না। আজ আমার উপোস। তোমার চিন্তা হতে পারে তাই বলে দিলাম, যখন বেরনোর আমি নিজে থেকে বেরব। তার আগে ডু নট ডিস্টার্ব। এই বলে ক্রাচ খটখটিয়ে চলে গেল। আমি পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। সেই সোয়া চারটে নাগাদ লাইব্রেরি ঘরে ঢুকেছে, এখন রাত সোয়া বারোটা। দেখতেই তো পাচ্ছেন বেরোয়নি। টোয়েন্টি আওয়ারস, নট আ ম্যাটার অব জোক। আমি ডাকতেও পারছি না। কথা না শুনলে বাচ্চাদের মতো রেগে যায়। কী যে হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মা বাবার সাথেও কনসাল্ট করতে পারছি না। অত দূরে আছে। ওখানে বসে টেনশন করবে। আপনারা এলেন, আপনাদের বলে একটু হালকা হলাম। বাট আপনারাই বা এমন টেন্সড কেন? কী হয়েছে আমাকে একটু বলবেন?

পরস্পরের সাথে চোখ চাওয়াচায়ি করল ওরা। তিতাস কিছু বলতে যাবে তখনই খুট করে একটা শব্দ হল। ছিটকিনি খুললে যেমন শব্দ হয় তেমন। শব্দটা এসেছে লাইব্রেরি ঘরের দিক থেকেই। এক সাথে সবার চোখ গিয়ে পড়ল সেই ঘরের দরজায়। ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজাটা আর তীব্র বিস্ময়ে উঠে দাঁড়াল ওরা সবাই। দরজায় এসে যিনি দাঁড়িয়েছেন তিনি নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়িই বটে কিন্তু এ কোন ভাদুড়ি মশায়? চিরাচরিত ধুতি পাঞ্জাবির বদলে পরনে রক্তাম্বর। মাথাতেও পাগড়ির মতো করে জড়ানো একটি লাল উত্তরীয়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এবং ভস্মাচ্ছাদিত কপালে রক্তিম ত্রিপুণ্ড্র। চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের জ্বলজ্বল করছে। সমস্ত দেহ থেকে যেন ফুটে বেরচ্ছে সাধনালব্ধ বিভূতি।

সবার আগে ছুটে গেল অপালা। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, এ সব কী দাদু? তুমি… তুমি ঠিক আছ তো?

স্নেহ ঝরে পড়ল যোগী পুরুষের কণ্ঠস্বর থেকে, হ্যাঁ দিদিভাই। আমায় নিয়ে চিন্তা কোরো না। এই ছেলেমেয়েগুলো বড় বিপদে পড়েছে। তাই ওদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি মাত্র। জানি না, পারব কি না, তবু ভাবলাম, এক বার চেষ্টা করেই দেখা যাক। অন্তর থেকে ডাক পেলাম জানো? গুরু যেন কানে কানে বলে উঠলেন, অলৌকিক হবে নীরেন। লেগে পড়ে থাক, অলৌকিক হবে।

এগিয়ে এসে ভাদুড়ি মশায়ের জীর্ণ পা দু’টি স্পর্শ করল ওরা পাঁচ জন। মাথায় হাত রাখলেন বৃদ্ধ। মুখ তুলে তিতাস বলল, অলৌকিক ঘটনা সত্যি ঘটতে শুরু করেছে স্যার। আমি দেখে এসেছি মিতুল কোথায় আছে।

চমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, সে কী করে সম্ভব?

তিতাস বলল, আমিও জানি না। কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিল। কারখানাটা ময়নার কাছে।

বিস্ময় বাড়ল ভাদুড়ি মশায়ের, বাচ্চা মেয়ে?

হ্যাঁ স্যার। অপালা যাকে দেখেছিল সেই। সে চাইছে মিতুলকে উদ্ধার করা হোক। তাই অপালাকে অজ্ঞান করে আমাদের আপনার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এবার সে আমাকে জায়গাটা চিনিয়ে দিয়েছে এবং সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার আমি গেনুকে দেখতে পাইনি। মেয়েটি বলছিল, কেউ একটা গেনুকে আটকে রাখবে এবং লোকনাথ বলে লোকটা সাধনায় ব্যস্ত। সে এখন এদিকে আসবে না। আমার মনে হয় স্যার, আমরা যদি এখনই ওখানে যেতে পারি তা হলে হয়তো মিতুলকে উদ্ধার করতে পারব।

চুপ করে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। সবচেয়ে অবাক হয়েছে অপালা। কী হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না, তবে এটুকু বুঝতে পারছে পরিস্থিতি ঘোরাল। হাত জোড় করে দীপক পাল বললেন, তিতাস ম্যডামের কাছে সব শোনার পর আপনাকে দেখেও অনেকটা বল ভরসা পেয়েছি। অমত করবেন না স্যার, যদি মেয়েটাকে বাঁচাতে পারি!

কী যেন ভাবলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর বলে উঠলেন, তাই চলো। যদিও আমার মন বলছে এত সহজ নয়, তবু তিতাস যখন মিতুল অবধি পৌঁছতে পেরেছে হয়তো পরের অসম্ভবগুলিও সম্ভব হবে। গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর।

অস্থির অপালাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন ভাদুড়ি মশায়। দরজা খুলে দিল তিতাস। ক্রাচ সামলে গাড়িতে ওঠা বড়ই কঠিন কাজ। তাঁকে উঠতে সাহায্য করছিল সঞ্জয়। হঠাৎই একটা তীব্র পচা গন্ধে আশঙ্কায় কুঁকড়ে গেল চারপাশের বাতাস। ভাদুড়ি মশায়ের হাত ছেড়ে মুখ তুলল বিস্মিত সঞ্জয়। এ গন্ধ তার চেনা। অস্ফুট আতঙ্কে সে বলে উঠল, গেনু!

১৮

একটা খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে লোকনাথ বলল, কী রমা? এই বার শান্তি?

দু’চোখ ভরা ঘেন্না নিয়ে লোকনাথের দিকে তাকিয়ে আছে সেই দীর্ঘাঙ্গী। তীব্র বিবমিষায় সে বলে উঠল তুমি কি মানুষ?

হেসে উঠল লোকনাথ, এত দিন পর তুমি আমারে এই প্রশ্ন করছ? মানুষ হলে কি আমি নিজের হাতে দুই ছেলেমেয়েরে বলি দিতে পারতাম? পারতাম না। আমি মানুষ নই রমা। আমি সাধক। সাধকের মায়া, দয়া, স্নেহ, প্রেম কিচ্ছু থাকতে নাই। তার পাখির চোখ হল তার সিদ্ধি। হতাশ গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় আমার কোনও দিন ভাল মানুষ হতে ইচ্ছে করেনি? ইচ্ছে করেনি ছেলেমেয়েরে কোলে কাঁখে করে রথের মেলায় নিয়ে যাই? পাঁপড় ভাজা আর জিলিপি কিনে দিই? অনেক বার ইচ্ছে করেছে। কিন্তু আমি পারিনি। আটকে গেছি। আমি যে পথভ্রষ্ট হতে পারব না রমা। আমি সত্যবদ্ধ। এই সিদ্ধিই আমার মোক্ষ, সিদ্ধিই আমার পিছুটান। এ যন্ত্রণা তুমি বুঝবা না।

জ্বলন্ত দৃষ্টি ক্রমে করুণ হয়ে এল দীর্ঘাঙ্গীর। কণ্ঠে ফুটে উঠল কাতরতা। সে হাত জোড় করে বলল, হয়তো আমি বুঝব না, কিন্তু দোহাই তোমার, তুমি আর কাউকে নতুন করে যন্ত্রণা দিও না। সঞ্জয়কে মেরো না। গেনুকে তুমি ফিরিয়ে নাও।

কাতরতা লোকনাথের কণ্ঠেও। জীবন মৃত্যুর দুই পারে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য এক দাম্পত্য সংলাপ রচিত হচ্ছে এই লোহালক্কড়ের জঙ্গলে। এই গোপন সাধনক্ষেত্রে। লোকনাথ বলল, ভাগ্নার তো কোনও ক্ষতি আমি করতে চাইনি। যদি চাইতাম, তা হলে শক্তি ফিরে পেয়ে যখন আমি গেনুরে ফের নিজের কাছে আনলাম তখনই তো তারে মারতে পারতাম। আমি শক্তিহীন ছিলাম বলে এত দিন তুমি ভাগ্নারে গেনুর হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছ। এ বার তো পারতে না। তাও কি আমি কিছু করেছিলাম বলো? সে তো দিব্যি ছিল। তোমার অধিক ভালবাসাই তার মরণের কারণ হল।

কেঁদে উঠল রমা, না না, এমন বোলো না তুমি। এত পাপ যে ধর্মে সইবে না।

ম্লান একটা হাসি ফুটে উঠল লোকনাথের ঠোঁটের কোণায়। ক্লান্ত গলায় বলল, পাপ? পাপের ভয় শুরুর দিকে খুব পেতাম জানো? কিন্তু পুণ্যের যেমন মোহ আছে, পাপেরও আছে। এক বার মন শক্ত করে পাপ কাজ করে ফেললে রক্তে নেশা লেগে যায়। ফের পাপ করতে ইচ্ছে করে। এ যেন এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে ছুটে যাওয়া। আর একের পর এক পাপ করতে করতে মানুষ এক সময় পাপী থাকে না। সে নিজেই একটা আস্ত পাপ হয়ে ওঠে। যাক গে, বেঁচে থাকতে আমি তোমারে সুখী করতে পারিনি। এখন মরার পরেও তোমায় দাগা দিতে আমার খারাপ লাগছে। এখনও সময় আছে রমা, তুমি কি বলবে কী করে ওই ছেলেটা এখানে ঢুকেছিল? যদি সত্যি সত্যি বলে দাও আমি গেনুরে ডেকে নেব। সে ভাগ্নারে কিছু করবে না। পরের মেয়ের কথা ভেবে নিজের জনের ক্ষতি কোরো না।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল রমার দুই চোখ। সে বলে উঠল, বলব। তার আগে তোমায় একটা কথা দিতে হবে। কথা দাও এই ফুটফুটে মেয়েটাকে তুমি বলি দেবে না।

কয়েক মুহূর্ত রমার দিকে তাকিয়ে রইল লোকনাথ। তার পর হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, হা রে কপাল! তুমি ভাবছ আমি এই মেয়েটারে বলি দেব? আর সেই জন্য তুমি মেয়েটারে বাঁচাতে আমার পেছুতে লেগেছ! ওহ রমা! এদ্দিন তান্ত্রিকের ঘর করেও তুমি মুখ্যুই রয়ে গেলে। ওরে বাবা ও সব বলি টলি দিতে লাগে নিম্নমার্গের সাধনায়। ও সাধনা আমি কবেই ত্যাগ করেছি। এ মেয়েটারে বলি দেব বলে আমি আনিনি গো। ওর থেকে আমার মাসিকের রক্ত দরকার ছিল, সে আমি পেয়েও গেছি। কাল আমার সাধনা শেষ। তার পর ও মেয়ের সাথে আমার আর কোনও সম্পক্ক নাই।

মিথ্যে কথা। মিথ্যে বলছ তুমি, চিৎকার করে উঠল রমা, আমি জানি তুমি ওই মেয়েটাকে বলি দেবে বলেই ধরে এনেছ। কিচ্ছু ভুলিনি আমি। অনেক দিন আগে তুমি আমায় বলেছিলে, তুমি এমন এক সাধনা করছ যাতে গেনুর থেকেও শক্তিশালী পিশাচ তোমার বশ হবে। তার জন্য তিনটে বলি দরকার ছিল। দুই ছেলেমেয়েকে বলি দেবার পর আর তুমি কাউকে বলি দিতে পারোনি। আমি তোমায় দিতে দিইনি। তুমি জানতে এ বারেও আমি তোমায় বাধা দেব তাই আগেভাগেই আমায় বন্দী করেছ তুমি। তুমি যাই বলো না কেন, আমি জানি, এই মেয়েই তোমার সেই তৃতীয় বলি। এই মেয়েকে বলি দিলেই তুমি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সে প্রলয় আমি আসতে দেব না। আর কাউকে বলি হতে দেব না আমি। কিছুতেই না।

তীব্র উত্তেজনায় হাফাতে লাগল রমা। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল লোকনাথ। তার পর ঈষৎ অভিমানী কণ্ঠে বলল, বিশ্বাস করছ না তো? আমার মনের মধ্যে ঢোকার শক্তি তোমার নাই। যদি থাকত তা হলে দেখতে পেতে, সত্যি ও মেয়েটারে বলি দেওয়ার কথা আমি ভাবছি না। সাধনার নানা পথ হয় রমা। যে সাধনা অত বছর আগে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে তা কি আর এখন সম্ভব? এ সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতি। আচ্ছা, একটা কথা বলো, যদি বলি দেবারই হতো তা হলে কি আমি ওরে অমন গুদামে ফেলে রাখলাম? বলির পাঁটাকে তো ফুল মালা দিয়ে সাজাতে হয়। তেমন কোনও সাজ তোমার চোখে পড়ছে কি? আরও অভিমানে ঘন হল লোকনাথের গলা, রমা, চিরটাকাল আমারে তুমি ভুল বুঝে এলে। চিরটাকাল।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রমা। স্বামীকে যদিও এতটুকু বিশ্বাস করে না তবু এই কথাটা ফেলে দিতে পারল না সে। এর আগে লোকনাথ যাদের যাদের বলি দিয়েছে বা দিতে চেয়েছে তাদের প্রত্যেকের প্রতি সে অসম্ভব যত্নবান ছিল। কিন্তু এই মেয়েটার প্রতি লোকনাথের অবহেলা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি রমার। দ্বন্দে জীর্ণ হতে লাগল সে, সত্যিই কি তবে সাধনার পথ বদলে ফেলেছে লোকনাথ? যে ভয় সে এত দিন পাচ্ছিল সে ভয় তবে অমূলক? তবে কি সে মিছিমিছিই সঞ্জয়ের মনের মধ্যে দুঃস্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে এল?

এত কী ভাবছ রমা? ভাবাভাবির সময় নাই। দেখো, সত্যি বলতে, ভাগ্নাকে যদি তুমি বাঁচাতে চাও এই মুহূর্তে আমার কথা শোনা ছাড়া তোমার সামনে কি আর কোনও রাস্তা আছে বলো? নাই তো? তা সত্ত্বেও কিন্তু আমি তোমারে সবটা বুঝায়ে বলেছি। এ বার চটপট আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দাও। গেনু হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। তারে না ফেরালে সব্বোনাশ কিন্তু হবেই।

শিউরে উঠল রমা। সত্যিই, সঞ্জয়কে বাঁচাতে গেলে এই লোকটার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। দোলাচলে ভুগতে ভুগতেই সে আরও একবার আশ্বস্ত হতে চাইল। বলল, সত্যি তুমি ফিরিয়ে নেবে তো গেনুকে?

নেব রে বাবা, নেব। এ বার চটপট বলো তো, ছেলেটা কী করে ঢুকেছিল এখানে? তুমি তো বন্দি। কোন ফিকিরে ওকে গোপন পথ দেখায়েছিলে?

আমি দেখাইনি।

তবে?

তোমার ছেলে দেখিয়েছিল।

বজ্রাঘাতে দগ্ধ তালগাছের মতো কেঁপে উঠল লোকনাথ। মৃতের মতো নিস্পন্দ হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার পর তার চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে নামল এক ফোঁটা জল। ধরা গলায় সে বলে উঠল, শেষমেশ বাপের বিরুদ্ধে ছেলেরে ওসকালে রমা! ছি ছি ছি! এক বারও এ দিকটা আমার মাথায় আসেনি! তাদের কথা আমি ভুলেই গেছিলাম! আমি ভাবতেও পারিনি ওই ছোট বাচ্চাটাকে দিয়ে তুমি এই ঘেন্নার কাজটা করাবে! ছেলেরে উসকেছ, এ বার মেয়েরেও হয়তো ওসকাবে!

চোখ মুছতে মুছতে লোকনাথ এগিয়ে চলল জায়গাটা ছেড়ে। হাহাকার করে উঠল রমা, কোথায় যাচ্ছ তুমি? গেনুকে কখন ফেরাবে? আমি তো সব বললাম তোমায়। এ বার গেনুকে ডাকো।

উত্তর না দিয়ে লোকনাথ ফের ঢুকে গেল গুমটি ঘরটার ভিতরে। যখন বেরিয়ে এল তখন তার হাতে তিরকাঠি, লাল সুতো আর কালো সর্ষে। একইরকম ভাবে মাটিতে আঁকল বর্গক্ষেত্র। তিরকাঠি পুঁতে, তাতে লাল সুতো বেঁধে তৈরি করল নতুন একটা ঘেরাটোপ। তার মধ্যে ছড়িয়ে দিল কালো সর্ষে। ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল রমা, কী করছ তুমি? কী করছ?

চকিতে ঘুরে হাতের সেই হাড় দিয়ে বাতাসের ওপর সজোরে প্রহার করল লোকনাথ। আগুনরঙা ক্ষত কেটে বসে গেল রমার ঠিক মুখের ওপর। আর্তনাদ করে সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। তার ব্যাকুল নিষেধ অগ্রাহ্য করেই লোকনাথ সেই মন্ত্রপাঠের পর হাড় বাজাতে শুরু করল। পুনরাবৃত্তি হল ঘটনার এবং দু’টি প্রোজ্জ্বল দ্যুতিময় নীলাভ সবুজ শিখার মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে অবয়ব ধারণ করল একটি একটি বালক এবং একটি বালিকা। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তারা।

উন্মাদিনীর মতো চিৎকার করতে লাগল রমা, কেন ধরে আনলে ওদের? ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি।

হিংস্র বাঘের মতো ঘুরে তাকাল লোকনাথ। বাতাসের ওপর ফের আঘাত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে বলে উঠল, কসবীর কসবী। ছেলেমেয়েরে বাপের বিরুদ্ধে ভড়কে আবার কথা! আর কোনও ছাড় নেই তোদের। এ বার এমন অবস্থা করব তোদের তিনটের উড়ে বেড়ানো জন্মের শোধ শেষ। সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করেছিস বলে খুব রস জমেছে না খাঁজে খাঁজে? স্থূল দেহে বাঁধব তোদের। দেখি কেমন করে আর কাউরে রাস্তা দেখাস।

কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাড়টা ফের মুখে তুলে নিল লোকনাথ। এ বার সেখান থেকে বেরিয়ে এল অন্য এক সুর। কান্না নয়, এ বার ক্রোধ। পুঞ্জীভূত সেই রোষ যেন কেটে বসে যেতে লাগল বাতাসের স্তরে স্তরে। ধীরে ধীরে কম্পন দেখা গেল ছেলেমেয়ে দু’টির শরীরে। ফের তারা পরিণত হল সেই নীলাভ সবুজ শিখায় এবং হাড়টা ফেলে দিয়ে লোকনাথ এগিয়ে গেল সে দিকে। আচমকাই দু’হাত দিয়ে খপ করে চেপে ধরল শিখা দু’টি। যখন হাত তুলে আনল দেখা গেল তার দু’হাতে দু’টি শালিক পাখি ছটফট করছে। সেই গুমটি ঘরে ঢুকে লোকনাথ দু’টি ফাঁকা মাটির জালার মধ্যে ভরে ফেলল পাখি দু’টিকে। বন্ধ করে দিল জালার মুখ। এর পর রমার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সে। হিসহিসে গলায় বলল, দেখলি তোর ছেলেমেয়েরে কী করলাম? এ বার তোর পালা। রাস্তা দেখানোর পথ চিরকালের মতো বন্ধ।

কেঁদে উঠল রমা, আমাকে যা খুশি করো কিন্তু এ বার তো গেনুকে ফেরাও।

প্রেতের মতো খলখল করে হেসে উঠল লোকনাথ, গেনু হল ধনুক থেকে ছিটকে বেরনো তির। গেনু যখন কাউরে মারতে যায় তখন তারে ফেরায় কার সাধ্যি!

প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে গেল রমা।

১৯

সাবধান! গেনু আমাদের আশেপাশেই আছে, চিৎকার করে উঠল সঞ্জয়।

তীব্র পচা গন্ধটা সবাই পেয়েছিল ওরা। আশঙ্কার মেঘ জমেছিল সবার মনেই। কিন্তু সঞ্জয়ের চিৎকার স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ঝড় এসে গেছে।

ভয়ে হিম হয়ে ইতস্তত দাঁড়িয়ে রইল কয়েকটা মানুষ। তারা বুঝতে পারছে, খুব কাছে এসে ওঁত পেতে বসে আছে মৃত্যু। এখন কোন দিক দিয়ে কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শুধু তারই অপেক্ষা। অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।

খুব বমি পাচ্ছে পল্লবের। পেটের ভিতর পাক দিয়ে উঠে আসছে গলার কাছে। কিন্তু ভয়ে বুঝি শিথিল হয়ে গেছে গোটা শরীরটাই। বমি হচ্ছে না। এমন সময় তার চোখ আটকে গেল কিছুটা দূরে। রাতের অন্ধকারে জ্বলছে দু’টো পাঁশুটে সবুজ রঙের মণি। ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলে উঠল, ওই… ওই যে।

চমকে তাকাল সবাই। রাস্তার ঠিক ও পারেই দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান বিভীষিকা। গেনু। কয়েক কদম এগিয়ে এল সে। পিশাচটির চলাফেরায় এখন আর সেই ঢিলেঢালা থপথপে ভাবটা নেই। সে এগিয়ে আসছে শিকারি শ্বাপদের নিস্তব্ধ হিংস্রতায়। মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় সে বলে উঠল, কেমন আছ ভাগ্না?

ইট চাপা দেওয়া ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল সঞ্জয়। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমি জানতাম ও আসবে। আমায় মারতে আসবে। মামি নেই, এই তো সুযোগ।

গেনু বলল, ভয় পাইছ বুঝি? ভয় নাই, ব্যথা লাগব না তোমার। মামায় তোমার মুন্ডু চায়। এক টানে ছিঁড়ে নেব। তুমি বুঝতেও পারবা না। বন্ধুদের বিদায় বলে চলে আসো ভাগ্না। এই বারে আর মামারে দুঃখ দিও না। আসো।

বাঁকানো নখের তিনটে আঙুলওয়ালা হাতটা বাড়িয়ে ধরল গেনু। ঠিক যে ভাবে প্রিয়জন হাত বাড়িয়ে দেয় আর এক প্রিয়জনের দিকে। মাথা ঘুরতে লাগল সঞ্জয়ের। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল হিমশীতল চাদরের মতো মৃত্যুভয় ঢেকে দিচ্ছে তার সমস্ত চেতনা। অজ্ঞান হয়ে যাবে সে, ঠিক তখনই তার কানে এল একটা বজ্রনির্ঘোষ, সবাই আমার পেছনে এসে দাঁড়াও।

ক্রাচ ঠুকে ঠুকে সামনে এগিয়ে এলেন ভাদুড়ি মশায়। ফের গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সবাই আমার পেছনে এসো।

শিশু যে ভাবে মায়ের কোলে আশ্রয় খোঁজে, ঠিক সে ভাবেই ওরা ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ভাদুড়ি মশায়ের পেছনে। অর্ধ অচেতন সঞ্জয়কে ধরে নিয়ে এল অমিয় আর দীপক পাল। গেনুর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালেন অশীতিপর যোগীপুরুষ। থমকে গেল গেনু। আজ তার সাথে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে যা আগে কখনও ঘটেনি। একটু আগেই একটা মানুষ তার হায়ে হাত তুলেছে। এখন আবার আর একটা মানুষ তার পথ আটকে দাঁড়াল। কী হচ্ছে এ সব! অন্ধ রাগে জ্বলে উঠল তার সর্বাঙ্গ। তীক্ষ্ন গলায় সে বলল, ভাল চাস তো পথ ছাড়। তোদের কারও সাথে আমার কিছু নাই। ভাগ্নারে নিতে আসছি। নিয়ে চলে যাব। আমায় বাধা দিলে সব ক’টা মরবি।

ব্যঙ্গ ঝিকিয়ে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠে, তাই না কি? নিম্নশ্রেণির পিশাচের এত ক্ষমতা যে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকি দেয়?

হুঙ্কার দিল গেনু, কে তুই? কে?

গমগম করে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠ, আমি? আমি তোর প্রভুর গুরু। আমার নাম শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। যদি আজ অবধি এক মুহূর্তের জন্য গুরুবাক্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে থাকি, যদি শাস্ত্রের গভীরে ঢুকে থাকি, যদি আমার সাধনায় ফাঁকি না থাকে তবে তিরিশ বছরের অনভ্যাসও আমি কুড়ি ঘণ্টায় জয় করতে পারি। তোর মতো পিশাচের সাধ্য নেই আমার ইচ্ছেকে অতিক্রম করে। আমি ইচ্ছা করছি, তুই ফিরে যা। ফিরে যা তোর প্রভুর কাছে আর গিয়ে বল, তার আস্তানার খোঁজ আমি জানি। আমি আসছি। এই অশুভ সাধনায় আমি কিছুতেই তাকে সিদ্ধ হতে দেব না।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল গেনু তার পরেই ঝড়ের মতো উড়ে এল ভাদুড়ি মশায়ের দিকে। এতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে এই কথোপকথন শুনছিল ওরা। এ বার প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আর্তনাদ করে উঠে চোখ বুজল।

কোথাও কোনও শব্দ নেই। নীরব নিস্পন্দ গোটা চরাচর। ঝিঁঝিঁ পোকারাও যেন আজ ডাকতে ভুলে গেছে। এই নীরবতা অসহনীয়। চোখ খুলল তিতাস আর চোখ খুলেই যা দেখল তাতে অবাক হতেও ভুলে গেল সে। ভাদুড়ি মশায়ের থেকে ঠিক ছ’ ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে আছে গেনু। প্রবল চেষ্টা করছে সে এই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে কিন্তু পারছে না। যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল রচিত হয়েছে তার আর ভাদুড়ি মশায়ের মাঝখানে। পরিশ্রমের প্রাবল্য ফুটে উঠেছে গেনুর কদাকার মুখে। তাতে আরও ভয়াবহ লাগছে তাকে। ভাদুড়ি মশায় কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু ক্রাচের হাতলে ধরা তাঁর মুঠো দু’টি দেখে বোঝা যাচ্ছে, পরিশ্রম তাঁরও নেহাত কম হচ্ছে না। টানটান হয়ে ফুলে উঠেছে শীর্ণ হাতের শিরাগুলি। ত্বক ভেদ করে যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে তারা। এই নিস্তব্ধ লড়াই আরও কিছুক্ষণ চলল, তার পর আচমকাই অদৃশ্য হয়ে গেল গেনু।

মুঠো দু’টো শিথিল হয়ে এল বৃদ্ধের। হাত থেকে খসে গেল ক্রাচ দু’টি। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই তাঁকে দু’দিক থেকে ধরে ফেলল তিতাস আর পল্লব।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। বলে উঠলেন, আমার শরীর নিয়ে ভেবো না। চলো। আর দেরি করে লাভ নেই। পিশাচের সাথে এই সম্মুখ সমরে মনে বল পেয়েছি আমি। তিতাস যখন জায়গাটা চেনেই, আজ রাতেই আমরা উদ্ধার করার চেষ্টা করব মিতুলকে। একের পর এক অসম্ভব আজ সম্ভব হচ্ছে যখন তখন হয়তো বিফল হব না আমরা।

দু’টো গাড়ি ছুটে চলল ময়নার দিকে।