নিকষছায়া – ১০

১০

হি ইজ আ মনস্টার।

ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে কথাগুলো বলে ফাইলটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল অমিয়।

কৌতূহলী চোখে তাকাল পল্লব আর সঞ্জয়। দীপক পালের চোখ দু’টো টকটকে লাল। অনেকখানি জল চোখের কোলে এসে থমকে থাকলে তবেই এমন রক্তাভা জন্ম নেয়। সেই লাল চোখ তুলে দীপক পাল জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখলেন স্যার?

মাথা নেড়ে বিষণ্ণ গলায় অমিয় বলল, গতিক সুবিধের ঠেকছে না পালদা। মিতুলের ভারী বিপদ।

এক বার যেন কেঁপে উঠলেন দীপক পাল। চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরে নিজেকে সামলে বললেন, একটু খুলে বলুন স্যার।

সঞ্জয় বলল, হ্যাঁ অমিয়। কী দেখলি প্লিজ সবটা বল। আমি যতদূর জানি মামার চোদ্দো বছরের মেয়াদ হয়েছিল। কিন্তু হিসেব মতো সে মেয়াদ তো আজ থেকে বছর সাতেক আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তা এত দিন পরেই যদি উদয় হল তা হলে মাঝের সাত বছর লোকটা ছিল কোথায়?

জেলে।

এক সাথে চমকে উঠল পল্লব আর সঞ্জয়। সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, জেলে? তবে কি আবার কোনও ক্রাইম?

অমিয় মাথা নাড়ল, খুন। প্রথম বার সাজা পাওয়ার মেয়াদ শেষ হতে যখন আর দু’বছর বাকি তখন আর একটা খুন করে পাষণ্ডটা আর সেটা জেল প্রেমিসেসের মধ্যেই। তাতে সাজার মেয়াদ আরও চোদ্দো বছর বেড়ে যায়।

সঞ্জয় বলল, তা হলে তো লোকটার এখন জেলে থাকার কথা।

হ্যাঁ। কিন্তু মাস দুয়েক আগে লোকটা জেলের দু’জন গার্ডকে আহত করে পালানোর চেষ্টা করে এবং পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী এনকাউন্টারে তার মৃত্যু হয়।

কিন্তু সেটা তো ভুল রিপোর্ট, উত্তেজিত হয়ে উঠল সঞ্জয়।

অমিয় বলল, হ্যাঁ ভুল তো। কিন্তু অমন একটা নটোরিয়াস ক্রিমিনাল নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেল এটা জানাজানি হওয়া কি পুলিশের পক্ষে খুব সম্মানের? তার চেয়ে এনকাউন্টার শব্দটা অনেক বেশি বীরত্বব্যঞ্জক নয় কি?

কথাটা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমিয়। পল্লব বলে উঠল, কিন্তু লোকটা পরের খুনটা করেছিল কেন? যাকে মেরেছিল তার সাথে কোনও রাইভালরি ছিল?

না রে। ও সব কিছু না।

তবে?

উত্তর না দিয়ে দীপক পালের দিকে তাকাল অমিয়। দীপক পালও একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অমিয়র দিকে। তার পর বললেন, আমার সামনে কথাটা বলতে অস্বস্তি বোধ করছেন তাই না স্যার? ভাববেন না, বলুন। মিতুলের হারিয়ে যাওয়াটা যখন মেনে নিতে পেরেছি তখন এটাও মানতে পারব। মিতুলকে তো খুঁজে পেতে হবে। হয়তো এর মধ্যেই কোনও সূত্র লুকিয়ে আছে।

বলেছিলেন বটে, কিন্তু মেনে নেওয়াটা সহজ হল না দীপক পালের পক্ষে। অমিয়র কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন তিনি। তার পর এই প্রথম বার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। পাগলের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বলতে থাকলেন, এ হতে পারে না স্যার। মিতুলের দেহের ওপর বসে কেউ শবসাধনা করবে এ হতে পারে না। একটা রাত পার হয়ে গেল স্যার। ওই লোকটা এতক্ষণে মিতুলকে কথাটা শেষ করতে পারলেন না দীপক পাল। তাঁর হেঁচকি উঠতে শুরু করল। কিন্তু দীপক পাল তখনও জানতেন না তাঁর আদরের মিতুলের সাথে যা হতে চলেছে তার থেকে মৃত্যু অনেক কম যন্ত্রণাদায়ক, অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য!

তিন বন্ধু মিলে যখন দীপক পালকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তখনই দরজায় এসে দাঁড়াল এক কনস্টেবল। দরজায় দু’টো টোকা দিয়ে বলল, স্যার পালবাবুর মেয়ের কলেজের বাইরে যে ফলওয়ালা বসে সে দেখা করতে চায়। বলছে, পালবাবুর মেয়ের ব্যাপারে কিছু জানে।

কথাটা শুনেই সোজা হয়ে বসলেন দীপক পাল। হেঁচকি তুলতে তুলতেই অমিয়কে বললেন, স্যার, যিনি ফল বিক্রি করেন তাঁকে আমি যাতায়াতের পথে অনেক বার দেখেছি। ভদ্রলোককে ডাকব ভিতরে?

চরম বিপদেও ডেকোরাম ভোলেননি পুলিশ কর্মচারীটি। তিনি জানেন, মিতুলের অন্তর্ধান কেসের চার্জে আছেন তাঁর বস এস আই অমিয় বোস। বসের অনুমতি ছাড়া কারও জবানবন্দি তিনি নিতে পারেন না। দীপক পালের কথার উত্তর না দিয়ে অমিয় সোজা কনস্টেবলটিকে বলল, ভিতরে পাঠিয়ে দিন।

মন্থর পদক্ষেপে যিনি ভেতরে ঢুকে এলেন তাঁকে ফলওয়ালা কম, পুরোহিত বেশি মনে হয়। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। শান্ত সৌম্য দোহারা চেহারা। সাদা চুল। এক মুখ সাদা দাড়ি। পরনে সাদা ধুতি আর সাদা ফতুয়া। তাঁকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন দীপক পাল, বসুন।

চেয়ারে বসে হাত জোড় করে ভদ্রলোক বললেন, নমস্কার। আমার নাম বলরাম চট্টোপাধ্যায়। আমি দিনের বেলা গভর্নমেন্ট কলেজের গেটে ফল বিক্রি করি আর সন্ধেবেলায় বারো হাত কালীমন্দিরে পুজো করি। আমি মায়ের নিত্যসেবক।

পল্লব আর সঞ্জয়ের চোখাচোখি হল। পল্লবের জানতে ইচ্ছে করছিল, জীবিকার এমন অদ্ভুত কম্বিনেশনের কারণ কী? কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করার আর সুযোগ পেল না। তার আগেই অমিয় মূল প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ল, কখন জানতেন পারলেন মিতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না?

বলরাম বললেন, আজ কলেজে এসে। তবে শ্যামশ্রী দিদিভাইয়েরর ডাকনাম যে মিতুল তা আমি জানতাম না। আমি শুনেছিলাম, ওর বাবা বারাসাত থানায় পোস্টেড। তাই ছুটে এসেছি। ওর বাবার সাথে একটি বার দেখা করা যায়?

দীপক পাল কিছু বলার আগেই চোখের ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দিয়ে অমিয় বললেন, আমি এ কেসের চার্জে আছি। আপনি যা বলার আমাকে বলুন।

ম্লান হেসে বলরাম বললেন, আপনাকে বলতেও আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমি যা বলব তা হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।

আমি বিশ্বাস করব না অথচ মিতুলের বাবা করবেন?

আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, অসুখ যখন খুব বাড়াবাড়ি হয় তখন ঘোর নাস্তিকও চরণামৃত নিতে আসে। তাবিজ, কবজ পরে নিরাময়ের চেষ্টা করে। উনি তো বাবা, যে কোনও উপায়ে মেয়েকে ফিরে পেতে চাইবেন। তাই আমার কথা বিশ্বাস করবেন।

বেশ। আপনি বলুন কী বলতে চান। তার পর ভেবে দেখা যাবে আপনার কথা বিশ্বাসযোগ্য কি না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলরাম বললেন, গুরুর আশীর্বাদে আমি সামান্য কিছু ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলাম। কিন্তু চর্চার অভাবে সে সব ধরে রাখতে পারিনি। তবু মাঝে মাঝে পুরনো বিদ্যা চলকে ওঠে। গতকালও তাই হয়েছিল। শ্যামশ্রী যখন কলেজ থেকে বেরচ্ছিল তখন ওকে অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাশে লাগছিল। মনে হচ্ছিল কিছু যেন ওকে টানছে। যেন একটা অশুভ ছায়া ওর শরীরের ওপর লেপটে ছিল সূক্ষ্ম রেশমি কাপড়ের মতো। আমি বার দুয়েক ওকে ডেকেওছিলাম কিন্তু ও শুনতে পায়নি। তার পর ভেবেছিলাম, হয়তো আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু আজ যখন এসে শুনলাম, ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তখনই বুঝলাম আমি ভুল দেখিনি। বড় আফসোস হচ্ছে আমার। কেন যে চর্চা ছেড়ে দিলাম? যদি চর্চা থাকত তা হলে হয়তো আমি মনের ভুল ভেবে ঘটনাটাকে উড়িয়ে দিতাম না। বিপদটা আটকাতে পারতাম। বড় লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে শ্যামশ্রী।

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না দীপক পাল। হাত জোড় করে বলে উঠলেন, ঠাকুরমশাই, আমি শ্যামশ্রীর বাবা। একটা কথা বলবেন শুধু? আমার মেয়েটা বেঁচে আছে তো?

চমকে উঠলেন বলরাম। উঠে দাঁড়িয়ে দীপক পালের হাত ধরে বললেন, ছি ছি। এমন অলুক্ষুণে কথা বলছেন কেন? মায়ের ওপর বিশ্বাস রাখুন। কিচ্ছু হবে না শ্যামশ্রীর।

ধরা গলায় দীপক পাল বললেন, বিশ্বাস রাখতেই চাই ঠাকুরমশাই। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাই আমার মেয়েটার কিচ্ছু হয়নি। ও সুস্থ আছে, ভাল আছে। আমি বিশ্বাস করতে চাইছি ও আবার ফিরে আসবে। আমায় বাবা বলে ডাকবে কিন্তু মন মানছে না। আমরা জানতে পেরেছি, যে লোকটা ওকে ধরে নিয়ে গেছে সে একজন তান্ত্রিক। শবসাধনা করে। একটা গোটা রাত কেটে গেছে ঠাকুরমশাই। আমার মেয়েটাকে এতক্ষণে সে মেরে ফেলেনি তো?

আর্ত কণ্ঠে বলরাম বলে উঠলেন, না না। এ সম্ভব নয়। এ অসম্ভব।

অমিয় এতক্ষণ চুপ ছিল। এ বার একটু ইতস্তত করে বলে উঠল, আপনি এত কনফিডেন্টলি কী করে বলছেন?

দৃঢ় কণ্ঠে বলরাম বললেন, বলছি, তার কারণ আমি জানি এত তাড়াতাড়ি শ্যামশ্রীর মৃত্যু নেই।

যেন মাঝসমুদ্রে একখানি কুটো দেখতে পেয়েছেন দীপক পাল। ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবে ঠাকুরমশাই? কী ভাবে জানলেন আপনি?

ম্লান হাসলেন বলরাম, এ আমার অভ্যেস বলতে পারেন। আমার কাছে যারা ফল কিনতে আসে নেহাতই কৌতূহলের বশে আমি তাদের হাতের রেখাগুলি লক্ষ্য করি। তাদের কিছু বলি না, এমনিই দেখি। আমি শ্যামশ্রীর হাতও দেখেছি। ওর আয়ুরেখা তো এত ক্ষুদ্র নয়!

পল্লব বলে উঠল, আপনি হাত দেখতে পারেন?

মৃদু ঘাড় নাড়লেন বলরাম। তার পর দীপক পালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মেয়ে যে বিপদের মধ্যে আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, আপনার মেয়ে বেঁচে আছে।

বৃদ্ধের দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন দীপক পাল, আপনার কথা যেন সত্যি হয় ঠাকুরমশাই। একটাই অনুরোধ, এতটা যখন উপকার করলেন আর একটু করুন। আমার মেয়েটাকে কী ভাবে খুঁজে পাব একটু বলে দিন। আমরা গোটা এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু কিচ্ছু পাইনি। এমনকী কোনও সূত্র অবধি পাইনি। ধনা বলে এক পাতাখোরের সাথে ওই তান্ত্রিকের খানিক জানাশোনা ছিল কিন্তু ওই ধনা ছেলেটিও যেন কাল রাত থেকে উবে গেছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করুন ঠাকুরমশাই।

মাথা নাড়লেন বলরাম। অসহায় গলায় বলে উঠলেন, আমার যদি সে ক্ষমতা থাকত আপনাকে বলতে হতো না। কিন্তু আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। এ পথের অন্ধিসন্ধি আমি জানি না। আর যে শ্যামশ্রীকে লুকিয়ে রেখেছে সে কোনও সাধারণ তান্ত্রিক নয় বলেই মনে হচ্ছে। আমার সাধ্য নেই তার অবস্থান নির্ণয় করি। তবে অমিয়রা চার জন একসাথে বলে উঠল, তবে?

তাদের চিন্তিত মুখের ওপর এক বার দৃষ্টি বুলিয়ে বলরাম বললেন, এক জন আছেন। যিনি চাইলেই আপনাদের সাহায্য করতে পারেন। তবে চাইবেন কি না আমি জানি না।

অমিয় বলল, কে তিনি?

আমার গুরু নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। তিনি এই গভর্নমেন্ট কলেজেরই সংস্কৃতর অধ্যাপক ছিলেন। পঁচিশ বছর হল রিটায়ার করেছেন। সমস্ত প্রাচীন শাস্ত্র তাঁর নখদর্পণে। নিজেও তন্ত্রসিদ্ধ। বহু গোপন ও জটিল তন্ত্রসাধনা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান তাঁর। আমি যেটুকু যা ক্ষমতা পেয়েছিলাম তাঁরই কৃপায়। কিন্তু আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে রাতারাতি এ সমস্ত চর্চা বন্ধ করে দেন তিনি। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে মারতে উঠতেন। অনেক সাধ্যসাধনা করেও তাঁকে টলাতে পারিনি। তার পর আরও গুরু ধরেছিলাম কিন্তু মন বসাতে পারিনি। মন থেকে একবার যে গুরুর কাছে নাড়া বাঁধা হয় তিনি ছাড়া অন্য কারও কাছে মন্ত্রদীক্ষা হয় না। ধীরে ধীরে আমারও চর্চা কমে গেল। সব ভুলে গেলাম।

ব্যাকুল গলায় দীপক পাল বললেন, মিতুলের এমন বিপদ শুনলেও কি তিনি সাহায্য করবেন না?

মাথা নাড়লেন বলরাম, জানি না। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই অনেক সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে যেত কিন্তু সবাইকেই ফিরিয়ে দিতেন, বলতেন, ও আমি ছেড়ে দিয়েছি।

দীপক পাল বললেন, আচ্ছা, আপনি যদি অনুরোধ করেন তাতেও রাজি হবেন না?

আঁতকে উঠলেন বলরাম, আমি? না না। আমার কথা ভুলেও বলবেন না। যদি জানতে পারেন আমি আপনাদের এ সব বলেছি আমাকে জুতোপেটা করবেন। আর হয়তো মুখই দেখবেন না কোনও দিন।

অশীতিপর এক বৃদ্ধ মধ্য ষাটের আর এক বৃদ্ধকে জুতোপেটা করছেন, দৃশ্যটা ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল পল্লবের। হাসি এক অদ্ভুত চিত্তবৃত্তি। খুব গম্ভীর সময়েও সোডার মতো ভুসভুসিয়ে উঠে আসে। হয়তো হেসেই ফেলত পল্লব কিন্তু সঞ্জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। কলেজের এই বন্ধুটিকে হাতের তালুর মতো চেনে সঞ্জয়। কোন কথায় পল্লব কী করতে পারে সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা আছে। তাই জুতোপেটা শব্দটা শুনেই সে কঠিন চোখে তাকিয়েছিল পল্লবের দিকে।

সামান্য নীরবতার পর দীপক পাল বলে উঠলেন, তা হলে এখন উপায় ঠাকুরমশাই?

বলরাম বললেন, মায়ের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনারা ভাদুড়ি স্যারের সঙ্গে দেখা করুন। দক্ষিণপাড়ায় ঢুকে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই ওনার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। সবটা খুলে বলুন ওনাকে। অনুরোধ করুন। হতেও তো পারে উনি রাজি হয়ে গেলেন। এখন এই একমাত্র উপায়।

টেবিল থেকে টুপিটা তুলে নিল অমিয়। বলল, ঠিক বলেছেন। উই হ্যাভ নো আদার অপশন। উই হ্যাভ টু কনভিন্স দ্যাট ওল্ড ফেলো। পালদা চলুন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বলরামবাবু।

হাত জোড় করে বলরাম বললেন, কী হল আমাকে জানাবেন দয়া করে। শ্যামশ্রীর জন্য আমিও বড় চিন্তায় আছি।

থানার জিপে করেই ওরা চার জনে রওনা দিল নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ির বাড়ির উদ্দেশে। গাড়িটা চালাচ্ছে অমিয়। পল্লব তার পাশে। পেছনের সিটে সঞ্জয় আর দীপক পাল। কেউ কোনও কথা বলছে না। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে চার জনকেই। এ যেন এক অনিশ্চিত বিষণ্ণ ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা। নীরবতা ভেঙে প্রথম কথাটা বলে উঠল সঞ্জয়, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না বুঝলি অমিয়?

রাস্তার দিকে চোখ রেখেই অমিয় বলল, কী?

মামা তো থাকত বর্ধমানের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা বর্ধমান স্টেশনে নেমেছিলাম। তার পর আমাকে কাঁধে নিয়ে মামা টানা দেড় দিন হেঁটেছিল। শ্মশানের পাশে মাটির বাড়িটার কথাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। তা হলে মামা বারাসাতে কী করছে? এত জায়গা থাকতে বারাসাত কেন?

ঘুরে তাকাল পল্লব, সত্যিই তো। এটা তো একটা ভাবার মতো কথা। গেনু এসে একটার পর একটা ডেডবডি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তার পর মিতুলকে ধরে নিয়ে গেল লোকটা। কিছু তো একটা মতলব আছেই কিন্তু সেটার সাথে বারাসাতের কী লিঙ্ক?

মাথা নাড়ল সঞ্জয়, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তবে কিছু না কিছু একটা যোগসূত্র তো আছেই। লোকনাথ চক্রবর্তী এমনি এমনি কিছু করার লোক না।

আচমকাই ধক করে জ্বলে উঠল দীপক পালের চোখ দু’টো। সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, ভাই যদি এ লোকটার সাথে আমার দেখা হয় আর তখন আপনি যদি আমার সাথে থাকেন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবেন কেমন? আমি এই লোকটার কলজেটা উপড়ে নেব। যতই হোক আপনার মামা। এ দৃশ্যটা দেখা আপনার উচিত হবে না।

রিয়ার ভিউ মিররে অবাক হয়ে দীপক পালের দিকে তাকিয়ে রইল অমিয়।

. . .

সাদা রঙের তিন তলা বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে বাগান। মরশুমি ফুল লাগানো হয়েছে। জবা, শিউলি, গন্ধরাজ ইত্যাদি গুল্মজাতীয় গাছও আছে কয়েকটা। গোলাপি আর বেগনি রঙের বোগেনভিলিয়ার ঝাড় উঠে গেছে গেটের দু’পাশ দিয়ে। সেই ফুলেই ঢাকা পড়েছে গেটের খানিকটা অংশ। তার ফাঁক দিয়ে ভাল করে নজর চালালে চোখে পড়ে বাড়ির নাম, শ্রীরঞ্জনী।

গেটে তালা দেওয়া নেই। মোরাম বিছানো পথ ধরে ওরা চার জনে এগিয়ে এল মূল বাড়ির দিকে। কলিং বেল বাজাতেই বছর ত্রিশের একটি মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। অমিয় আর দীপক পালের পোশাক দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কাকে চান?

অমিয় হাত জোড় করে বলল, নমস্কার। নীরেন্দ্রনাথ স্যার আছেন?

মেয়েটি একটু অবাক হল, হ্যাঁ। দাদু আছেন কিন্তু আপনাদের কি আসার কথা ছিল?

অমিয় বলল, না। আসলে খুব দরকারে আচমকাই আসতে হয়েছে আমাদের।

কিন্তু দাদু তো এ ভাবে কারও সঙ্গে দেখা করেন না।

দীপক পাল দু’পা এগিয়ে বলে উঠলেন, আমরা জানি। বিশ্বাস করুন, ওনাকে এভাবে বিরক্ত করতেও চাইনি। কিন্তু আমাদের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। আমার মেয়েকে কাল রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা জানতে পেরেছি এটা কোনও তান্ত্রিকের কাজ। লোকটা খুব খারাপ। আমার মেয়েটা বড় বিপদে আছে। আপনি প্লিজ ওনার সাথে একটু দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।

দীপক পালের আকুলতা মেয়েটিকে স্পর্শ করল বোধ হয়। কোল্যাপসিবল গেটটা খুলে দিয়ে বলল, ভিতরে এসে বসুন। আমি দাদুকে বলে দেখছি।

মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। মিনিট তিনেক পর ফিরে এসে বলল, আসুন। দাদু স্টাডিতে আছেন।

স্টাডি রুমের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে ফের ভিতরে চলে গেল মেয়েটি। কপালে হাত ঠেকিয়ে দীপক পাল চাপা গলায় অমিয়কে বললেন, দেখা করতে যখন রাজি হয়েছেন তখন আশা করি খালি হাতে ফিরতে হবে না। তাই না স্যার?

অমিয় বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। চলুন দেখা যাক।

ঘরটায় ঢুকেই থমকে গেল পল্লব। নিজের লাইব্রেরিটা নিয়ে তার মনে এত দিন বেশ একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। কিন্তু এই ঘরটায় ঢুকেই তা নিমেষে ধূলিসাত হয়ে গেল। কোনও ব্যক্তি মানুষের সংগ্রহে যে এত বই থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কুড়ি বাই কুড়ি ফুটের চৌকোনা ঘরটা জুড়ে সিলিং পর্যন্ত উঁচু প্রচুর আলমারি। তাদের প্রতিটা তাক বইয়ে ঠাসা। আলমারিতে জায়গা হয়নি বলে মেঝেতে কাঠের পাটাতন পেতে তার ওপরেও স্তূপীকৃত বই রাখা। প্রেসিডেন্সি কলেজের আর্টস লাইব্রেরির সামনের ঘরেও বুঝি এত বই নেই! একটাই জানলা খোলা। সেই জানলা দিয়ে আলো আসছে আর তাতেই দেখা যাচ্ছে, এই বইয়ের সমুদ্রের মাঝে ইজিচেয়ারে বসে আছেন অশীতিপর মানুষটি। তাঁর হাতেও একটি বই।

কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সামনে এলে নিজে থেকেই মাথা নত হয়ে আসে। ইনিও তেমনই। পঁচাশি বছর বয়স কিন্তু এখনও যেন ঋজু শালবৃক্ষটি। ভারী পাওয়ারের চশমার আড়ালে উজ্জ্বল চোখ দু’টি তাঁর গভীর প্রজ্ঞার সাক্ষ্য বহন করছে। তবে ইজিচেয়ারের পাশে দাঁড় করানো দু’টি ক্রাচ দেখে বোঝা যায়, বাকি শরীরে কেরামতি দেখাতে না পেরে বার্ধক্য পা দুটিকে জখম করে দিয়ে গেছে। অমিয়দের দেখে গম্ভীর গলায় তিনি বলে উঠলেন, কী ব্যাপার? সকাল সকাল পুলিশের লোক আমার বাড়িতে কেন?

চার জনে চোখাচোখি হল। ওরা বুঝতে পারল মেয়েটি দাদুকে সবটা বলেনি। দীপক পাল হাত জোড় করে বললেন, স্যার, বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।

ভুরু কুঁচকে গেল নীরেন্দ্রনাথের। বললেন, সে কী কথা! মানুষ বিপদে পড়লে ডাক্তার, উকিল আর পুলিশের কাছে যায়। আমি সামান্য মাস্টার। পুলিশ বিপদে পড়ে আমার কাছে আসবে কেন?

কেউ কিছু বলার আগেই পল্লব ফস করে বলে বসল, সামান্য মাস্টার হতে যাবেন কেন স্যার? আপনি তো একজন তন্ত্রসিদ্ধ সাধক।

দুম করে হাতের বইটা বন্ধ করে ইজি চেয়ারের ওপরেই সোজা হয়ে বসলেন নীরেন্দ্রনাথ। সঞ্জয় বুঝতে পারল, যে তীর বেরিয়ে গেছে তাকে আর ফেরানো যাবে না। তবু সে একটা চেষ্টা করতে গেল। দ্রুত বলে উঠল, তা না স্যার। আসলে…

থামুন, রীতিমতো গর্জন করে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। বিরক্তি ঝরে পড়ছে তাঁর সমস্ত শরীর দিয়ে। সেই বিরক্তিই যেন কতগুলো কথা হয়ে তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, কে বলেছে আপনাদের আমি তন্ত্রসিদ্ধ? মারণ, উচাটন আর বশীকরণ এই তিনটে শব্দ ছাড়া আর কী জানেন তন্ত্র সম্পর্কে? কী ভেবেছেন, তন্ত্র মানে ভূতের রোজা? আপনারা বিপদে পড়বেন আর আমি এখানে বসে ঘটি চেলে তার সমাধান বার করে দেব? তন্ত্র ছেলের হাতের মোয়া নয়। খোলামকুচি নয়। কঠিনতম সাধনা ও অভ্যাসে এ বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়। আমার সাধনাও নেই। অভ্যাসও নেই। আমি কিচ্ছু জানি না তন্ত্রের। চলে যান আপনারা।

কেঁদে উঠে বৃদ্ধের পায়ের কাছে আছড়ে পড়লেন দীপক পাল, আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না স্যার। আপনি ছাড়া এ বিপদ থেকে আমাদের আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। দয়া করুন স্যার। দয়া করুন।

দীপক পালের বুকফাটা কান্নায় বুঝি পাথরও গলে যেত কিন্তু বৃদ্ধের মন গলল না। বাঁ হাত তুলে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে ক্রুদ্ধ দুর্বাসার মতো বলে উঠলেন, আর একটাও কথা না। এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে না গেলে আমি সর্বান্তকরণে আপনাদের অকল্যাণ কামনা করব। তন্ত্র না জানি, আমি আনখশির সাত্ত্বিক মানুষ। জীবনে সজ্ঞানে কোনও অন্যায় করিনি। আমার শান্তি বিঘ্নিত হলে আমার অভিশাপ তীব্রতর হবে।

স্তম্ভিত হয়ে গেল ওরা চার জন। ব্রহ্মতেজ বোধ হয় একেই বলে। বৃদ্ধের সাথে আর একটিও কথা বলার সাহস হল না কারও। দীপক পালের জামার হাতায় টান দিয়ে অমিয় চাপা গলায় বলে উঠল, চলে আসুন পালদা। এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না।

১১

স্বভাবগম্ভীর কোনও মানুষকে যখন শিশুসুলভ অস্থিরতা আচ্ছন্ন করে তখন তা দেখতে ভারী মজাদার লাগে। যদিও পরিস্থিতি একেবারে মজার নয় তবু পল্লবের একটি ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা আছে। সে খুব জটিল অবস্থার মধ্যেও হাসি ও মজার উপাদান খুঁজে নিতে পারে এবং আশেপাশের লোকজন যখন টেনশনে পাগল তখন সে একা একা ফিকফিক করে হাসতে পারে। এই জন্য সে ছেলেবেলা থেকে ঝাড় খেয়ে আসছে কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শোধরাতে পারেনি। অবশ্য শোধরানোর চেষ্টা করেছে বলে মনেও হয় না। সঞ্জয় একবার বলেছিল, সবকিছু নিয়ে এত ক্যাজুয়াল কেন তুই পল্লব? সিরিয়াসনেস বলে কি কোনও বস্তু নেই তোর মধ্যে? সবসময় খিল্লি করতেই হবে?

উত্তরে গম্ভীর হয়ে পল্লব বলেছিল, তুই ওই গানটা শুনেছিস?

কোন গানটা?

ওই যে, ‘তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন/সত্যম, শিবম, সুন্দরম/দুঃখের পৃথিবীটা তাদের কাছে এক আনন্দআশ্রম।’

তুই বলতে চাইছিস সত্য, শিব আর সুন্দর তোর জীবনের মূলমন্ত্র?

একেবারেই না। আমার জীবনের তিনটে অন্য মন্ত্র আছে। হাজি, হাট্টা আর হামাজম। তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন/হাজি, হাট্টা আর হামাজম/দুঃখের পৃথিবীটা তাদের কাছে এক ফানন্দআশ্রম।

সঞ্জয় আকাশ থেকে পড়েছিল, মানে? মানে কী এ সবের?

রীতিমতো দার্শনিকের মতো ভঙ্গিতে পল্লব বলেছিল, দেখ আনন্দ খুব মানডেন। তার থেকে ফান ইজ ফার বেটার। তাই ফানন্দআশ্রম। আর হাজি, হাট্টা, হামাজম মানে হাসি, ঠাট্টা আর তামাশা।

ভেবলে গিয়ে সঞ্জয় বলেছিল, তা নরমালি বললেই হয়। অমন বিকৃত করার কী আছে?

ফিক করে হেসে পল্লব বলেছিল, এমনি। জাস্ট ফর ফান।

সেই দিনের পর থেকে সঞ্জয়ও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এখন পল্লব হাসছে নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়িকে দেখে। ভাদুড়ি মশায় বসে আছেন বারাসাত হাসপাতালে তিতাসের চেম্বারে আর অস্থির বাচ্চাদের মতো একবার কলম তুলে প্যাডে দাগ কাটছেন, পরক্ষণেই সেটা রেখে দিয়ে পেপারওয়েটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। তার পরেই আবার সেটা মুঠোয় নিয়ে আকুল হয়ে তাকাচ্ছেন দরজার দিকে। পল্লব বুঝতে পারছে, বৃদ্ধের মনের মধ্যে অসম্ভব এক টেনশন কাজ করছে। এই চঞ্চলতা তারই বহিঃপ্রকাশ। তবু, হাসিটাকে বাগে আনতে পারছে না সে।

অবশ্য টেনশন হওয়াই স্বাভাবিক। আচমকা যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। পল্লবরা তো রীতিমতো ঘাবড়েই গেছিল। সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছিলেন ভাদুড়ি মশায় নিজে। সে অবস্থায় হাল ধরেছিলেন দীপক পাল।

ভাদুড়ি মশায়ের তিরস্কার শুনে, ফিরে যাবে বলে ওরা তখন সবে স্টাডির দরজার কাছে এসেছে তখনই ভিতরের একটা ঘর থেকে হুড়মুড় করে কিছু পড়ার জোর শব্দ হল। চমকে উঠল সবাই। শব্দটা ভাদুড়ি মশায়ও পেয়েছেন। চিন্তিত স্বরে তিনি জোর গলায় ডেকে উঠলেন, দিদিভাই? দিদিভাই?

কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। পল্লবদের তখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে না ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখবে কী হল, বুঝতে পারছে না। সাধারণ বুদ্ধি বলছে, গিয়ে দেখা উচিত কিন্তু পরক্ষণেই একটু আগে দেখা ভাদুড়ি মশায়ের ক্রুদ্ধ মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

ভাদুড়ি মশায় আরও দু’বার ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে উঠতে গেলেন ইজিচেয়ার থেকে। তাড়াহুড়োয় একটা ক্রাচ পড়ে গেল মাটিতে। এ বার ছুটে গেল অমিয়। ক্রাচটা তুলে দিল বৃদ্ধের হাতে। ক্রাচ নিয়ে যতটা দ্রুত হাঁটা সম্ভব ততটাই দ্রুত ভিতরের ঘরের দিকে চললেন ভাদুড়ি মশায়। চোখাচোখি করে ওরা চার জনও পিছু নিল তাঁর। ভিতরের ঘরের দরজার সামনে পৌঁছেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। গলা চিরে বেরিয়ে এল করুণ আর্তনাদ, দিদিভাই!

বৃদ্ধের ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে যা দেখল তাতে তাতে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল ওরা চার জন। একটু আগেই যে মেয়েটি ওদের ভিতরে আসতে দিয়েছিল সে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি সম্পূর্ণ অচেতন। পাশেই মাটিতে ভেঙে ছড়িয়ে আছে একটি চিনেমাটির ফ্লাওয়ার ভাস। বোঝা যাচ্ছে, ছুটে আসতে গিয়ে ওই ফ্লাওয়ার ভাসেই ধাক্কা খেয়ে মেয়েটি পড়ে গেছে। সে জন্যই অমন বিকট শব্দ হয়েছিল। অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বৃদ্ধ। বুঝি বা মনে মনে অকেজো পা দু’টিকে অভিসম্পাত করছিলেন। তখনই এগিয়ে এসেছিলেন দীপক পাল, স্যার, একটু সরে দাঁড়ান প্লিজ। আমাকে ভিতরে যেতে দিন।

কথা না বাড়িয়ে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটেছিল। তৎপর হাতে মেয়েটিকে সোজা করে শুইয়ে নাড়ি টিপে ধরেছিলেন দীপক পাল। কয়েক সেকেন্ড পরে বলে উঠেছিলেন, নাড়ি পাচ্ছি না। হসপিটালাইজড করতে হবে।

ভাদুড়ি মশায়ের কথা থেকে জানা গেছিল, এই মুহূর্তে বাড়িতে তিনি আর তাঁর নাতনি ছাড়া আর কেউ নেই। কাজের লোকটিও অসুস্থ বলে আসেনি। ফোন করলে ড্রাইভার চলে আসবে তবে তাতে অনেকটা সময় লাগবে। সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় তিনি বলেছিলেন, আমার লাইব্রেরিতে টেবিলের ওপর একটা ডায়েরি আছে। ওতে ফোন নম্বর লেখা থাকে। ওখান থেকে নম্বর নিয়ে একটু অ্যাম্বুল্যান্সে ফোন করবেন? পাড়ার ক্লাবেই একটা অ্যাম্বুল্যান্স আছে।

ফোন করা হয়েছিল এবং জানা গেছিল, কিছুক্ষণ আগেই অ্যাম্বুল্যান্সটি অন্য এক জন রোগী নিয়ে রওনা দিয়ে দিয়েছে। অসহায় বৃদ্ধ বলেছিলেন, ওর চোখেমুখে একটু জল দেবেন কেউ?

মেয়েটির হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দীপক পাল বলেছিলেন, জল দিয়ে লাভ হবে না স্যার। যদি অনুমতি করেন একটা কথা বলব?

চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়েছিলেন ভাদুড়ি মশায়। দীপক পাল বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আমরা কি ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি?

আশার আলো ফুটে উঠেছিল এই মুহূর্তে চিন্তিত কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে তীক্ষ্ন দুটি চোখে। বৃদ্ধ বলেছিলেন, চলুন। কিন্তু আমাকেও আপনাদের সঙ্গে নিন।

অমিয়র দিকে তাকিয়ে দীপক পাল বলেছিলেন, স্যার, আপনি তিতাস ম্যাডামকে ফোন করে ব্যাপারটা বলে দিন। আপাতত আমি আর আপনি, স্যার আর ওনার নাতনিকে নিয়ে হাসপাতাল চলে যাচ্ছি। সঞ্জয়বাবু আর পল্লববাবু একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আসুন।

তিতাস নামটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছিল পল্লব। এই নামটা শুনেই না সে দিন সে অমিয়র ফোন কেটে দেয়নি। মনের গোপনে একটা আশা নিয়েই তো সে বারাসাত এসেছিল। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় আর তিতাস প্রসঙ্গে কথা হয়ে ওঠেনি। পল্লব বুঝতে পারল, তিতাস এখন বারাসাত হাসপাতালে পোস্টেড।

সঞ্জয়ের ডাকে ঘোর কেটেছিল পল্লবের। ছুটে গিয়েছিল মেয়েটিকে তুলতে। অমিয় ততক্ষণে তিতাসকে ফোন করে দিয়েছে।

বৃদ্ধের কোলে মাথা আর অমিয়র কোলে পা রেখে পেছনের সিটে শুয়েছিল মেয়েটি আর দীপক পাল হু হু করে জিপ ছুটিয়েছিলেন বারাসাত হাসপাতালের দিকে।

আসতে না আসতেই মেয়েটিকে আইসিইউ-তে ভর্তি করে দিয়েছে তিতাস। এখন তিতাস মেয়েটিকে পরীক্ষা করছে আর ওরা অপেক্ষা করছে তিতাসের চেম্বারে। এখানে আসার পর ভাদুড়ি মশায়ের কাছ থেকেই জানা গিয়েছে তাঁর নাতনির নাম অপালা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানশিয়েন্ট ইন্ডিয়ান লিটারেচর নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল করছে। রিসার্চের কাজেই আট মাসের জন্য দেশে এসেছে। অপালার দাদা সৌমেন্দ্রনাথ অর্থাৎ ভাদুড়ি মশায়ের নাতি আবার থাকেন জাপানে। সেখানে তিনি জাপানি ছেলেমেয়েদের ‘নো’, ‘কাবুকি’ ইত্যাদি নানা ধরনের জাপানি নাটকের ফর্ম পড়ান। সম্প্রতি ভাদুড়ি মশায়ের পুত্র ও পুত্রবধূ ছেলের সাথে দেখা করতে জাপান গেছেন তাই আপাতত বাড়িতে দাদু আর নাতনি।

তা তিতাসের চেম্বারে বসে ভাদুড়ি মশায় বাচ্চাদের মতো চঞ্চল হয়ে পড়েছিলেন আর তাই দেখে পল্লব ফিকফিক করে হাসছিল, এমন সময় দৌড়ে এল তিতাস। ভাদুড়ি মশায়ের কাছে গিয়ে বলল, আর ভয় নেই স্যার। আপনার নাতনি রেসপন্স করেছে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। তবে একটু ট্রমার মধ্যে আছে। কিছুটা সময় দিন, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।

এতক্ষণ পর স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধের গলা দিয়ে। ক্রাচ দু’টোর সাহায্যে খানিকটা সময় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তার পর তিতাসের মাথায় হাত রেখে স্মিত হেসে বললেন, রাজরাজেশ্বরী হও।

তিতাসও তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল আর উঠতেই দেখতে পেল, একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে পল্লব। পল্লব এখানে কী করছে! যদিও তিন বছর পর এই প্রথম দেখা তবু তিতাসের চোখ এড়াল না, এই তিন বছরে বেশ খানিকটা মোটা হয়েছে পল্লব। চশমার ফ্রেমটা বদলেছে আর বরাবরের মতো জামাটায় ইস্ত্রি নেই। পকেটের কাছটা বিশ্রি ভাবে কুঁচকে আছে। বিস্ময় কাটতে না কাটতেই কে যেন এসে কাঁধে হাত রাখল। ঘুরে তাকিয়ে তিতাস দেখল, সঞ্জয় দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক তার পেছনে। বাক্যস্ফূর্তি হতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল তিতাসের। তার পরই সে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলল, আমাকে মাপ করবেন স্যার।

বলেই, সঞ্জঅঅঅঅয় বলে একটা চিৎকার দিয়ে সঞ্জয়ের গলা ধরে ঝুলে পড়ল প্রায়। আলিঙ্গন শেষ হতে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলে উঠল, ওহ মাই গড! এত বছর পর তোরা সবাই এক সাথে এখানে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। কখন এসেছিস তোরা?

সঞ্জয় বলল, কাল বিকেলে।

কাল বিকেলে এসেছিস আর এই শয়তান, সরি স্যার, বদমাইশ অমিয়টা আমায় কিচ্ছু বলেনি!

অমিয় এগিয়ে এল, বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না তিতাস। আমরা সবাই খুব বিপদের মধ্যে আছি।

থমকে গেল তিতাস, বিপদ? কী হয়েছে?

অমিয় বলল, শান্ত হয়ে বোস। সব বলছি।

যৌবনের এই উচ্ছ্বলতা দেখে মৃদু মৃদু হাসছিলেন ভাদুড়ি মশায়। কিন্তু বিপদের কথা শুনে তাঁর কপালেও ভাঁজ পড়ল আবার। হয়তো মনে পড়ে গেল, একটু আগে এদেরই তিনি বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ এরা না থাকলে অপালার অনেক বড় ক্ষতি হতে পারত। গম্ভীর গলায় তিনি বলে উঠলেন, যদি আপত্তি না থাকে বিষয়টা আমার সামনে বলা যায়?

অমিয় বলল, পালদা, আমি বলি?

তিতাসের চেম্বারেই টেবিল ঘিরে বসে আছে ওরা ছ’ জন। মাথা নাড়লেন দীপক পাল, হ্যাঁ স্যার। আমি এমনিও গুছিয়ে সবটা বলে উঠতে পারব না।

ঘাড় নেড়ে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে দীপক পালকে দেখিয়ে অমিয় বলল, স্যার, ইনি বারাসাত থানার এ এস আই দীপক পাল। গত কাল দুপুর থেকে পালদা’র মেয়ে মিতুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেড়টা পৌনে দু’টো নাগাদ কলেজ থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি।

সে কী! চমকে উঠল তিতাস, তার পর?

তার পর আমরা আমাদের সাধ্য মতো ইনভেস্টিগেট করেছি। সম্ভাব্য সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু মিতুলকে পাইনি। রাতের দিকে ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জেরা করে আমরা একটা অদ্ভুত ইনফরমেশন পাই আর সেটা থেকেই শিওর হই যে এটা আর পাঁচটা কিডন্যাপিং-এর কেস থেকে আলাদা।

ভাদুড়ি মশায় বললেন, কী ইনফরমেশন?

অমিয় বলল, বলছি স্যার। তবে তার আগে আপনাকে অন্য কয়েকটা ঘটনার কথাও বলতে হবে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি ওই ঘটনাগুলোর সাথে মিতুলের হারিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট যোগাযোগ আছে।

তোমরা এত কিছু প্রমাণ পেয়েছ অথচ মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছ না?

এই প্রথম ভাদুড়ি মশায় আপনি ছেড়ে তুমি বলে উঠলেন। পল্লবের সাথে চোখাচোখি করতে গিয়ে সঞ্জয় দেখল, পল্লবের এ সব দিকে মন নেই। সে হাঁ করে তিতাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করে কোণা চেপে বসেছে, যাতে তিতাস দেখতে না পায়। অমিয় বলল, না স্যার। সেই জন্যই তো আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। একমাত্র আপনিই পারেন এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।

এ কথার উত্তর না দিয়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, বলে যাও।

নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল অমিয়। যেমন ভাবে কলেজে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার আগে গুছিয়ে নিত, অনেকটা সে ভাবেই। অনেক দিন পর আজ আবার কোনও অধ্যাপকের মুখোমুখি পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। আর এ যে সে পরীক্ষা নয়। পাশ করার ওপর নির্ভর করছে মিতুলের ভাগ্য। অমিয় বলতে শুরু করল, স্যার গত কয়েক দিন ধরেই বারাসাত ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। মৃতদেহ উধাও হয়ে যাচ্ছে।

যেন সামান্য একটু নড়েচড়ে বসলেন ভাদুড়ি মশায়। উত্তেজিত গলায় তিতাস বলে উঠল, রাইট, আমাদের হাসপাতালের মর্গ থেকেও একটা বডি উধাও হয়েছে। তার পর এই সমীরের কেসটাও তো সেম।

অমিয় বলল, হ্যাঁ। ও দু’টো বটেই ওর পরে আরও দু’টো বডি জাস্ট ভ্যানিস হয়ে গেছে। এই নিয়ে চারটে। এক জন ডোমের বয়ান অনুসারে একটা বডি তো জ্বলন্ত চুল্লির মধ্যে থেকেও উধাও হয়েছে।

গলা ঝাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, ডোমের বয়ান কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

অমিয় বলল, বিশ্বাসযোগ্য একটা কারণেই স্যার, যারা যারা এই বডি ভ্যানিশের সময় কাছাকাছি ছিল তারা প্রত্যেকেই একটা কমন ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। সেটা হল তীব্র পচা গন্ধ।

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল অমিয়। তাকে থামিয়ে দিয়ে সঞ্জয় স্বভাববিরুদ্ধা ভাবে বলে উঠল, এত ঘুরিয়ে না বলে আসল কথাটা বল না। স্যার, এই প্রত্যেকটি মৃতদেহ উধাও হয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একটি পিশাচ আর এই পিশাচটি যার হুকুমে চলে সেই তান্ত্রিকই মিতুলকে কিডন্যাপ করেছে। আপনার সামনে বলতে আমার বাধোবাধো ঠেকছে তবু না বললে তো উপায় নেই তাই বলছি, এই তান্ত্রিকের এমন একটি মেয়ের দরকার ছিল যার এ মাসের পিরিয়ডস সদ্য শুরু হয়েছে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে সেই মেয়েটি মিতুল।

চাপা টেনশন ধ্বনিত হল ভাদুড়ি মশায়ের গলায়, ঠিক বলছ তুমি? এত নিশ্চিত কী করে হচ্ছ যে

কথা কেটে সঞ্জয় ক্লান্ত হতাশ গলায় বলল, হচ্ছি, কারণ যে লোকটা এই সব করছে সে আমার নিজের মামা। তার নাম লোকনাথ চক্রবর্তী।

পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কাউকে গুলি করলে যেমন বিস্ময় আর যন্ত্রণা একসাথে অনুভূত হয়, অবিকল তেমন ভাবে বিস্মিত ও যন্ত্রণাকাতর হয়ে উঠল ভাদুড়ি মশায়ের মুখখানি। ব্যথিত কণ্ঠে অস্ফুটে তিনি বলে উঠলেন, সর্বনাশ!

ভাদুড়ি মশায়ের এই অসহায়তা মুহূর্তে চারিয়ে গেল বাকি পাঁচ জনের মধ্যে। ভয়ার্ত কণ্ঠে দীপক পাল বলে উঠলেন, এমন ভাবে সর্বনাশ বললেন কেন স্যার? আমায় মেয়েটা কি তবে

বুজে এল দীপক পালের গলা। অস্থির মাথা নেড়ে বৃদ্ধ বলে উঠলেন, জানি না। আমি জানি না। যা সন্দেহ করছি তা যদি সত্যি হয় তা হলে বরং তোমার মেয়ের মৃত্যুকামনা করো। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, লোকনাথের সাধনা সম্পন্ন হওয়ার আগেই যেন তোমার মেয়ের মৃত্যু হয়। নয়তো এ অত্যাচার সে সইতে পারবে না।

অসম্ভব এই কথায় কাঁদতেও ভুলে যান দীপক পাল। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বাকিরাও। শুধু বৃদ্ধের চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামে এক ফোঁটা জল। কঠিন হয়ে ওঠে চোয়াল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠেন, পাষণ্ড!

নীরবতা ভেঙে সঞ্জয় বলে ওঠে, আপনি আমার মামাকে চেনেন?

ভাদুড়ি মশায় কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দরজায় এসে দাঁড়ায় একটি জুনিয়র ডাক্তার। তিতাসের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ম্যাম। পেশেন্ট এখন স্টেবল। ওনার দাদুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

বৃদ্ধকে হাত ধরে দাঁড় করায় তিতাস। বলে, আসুন স্যার। আগে নাতনির সাথে দেখা করে নিন।

ক্রাচ ঠুকে ঠুকে তিতাসের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যান ভাদুড়ি মশায়। তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে পরাজিত মানুষের মতো দীপক পাল বলে ওঠেন, উনি মিতুলের মৃত্যুকামনা কেন করতে বললেন স্যার? কী সন্দেহ করছেন উনি? কীসের অত্যাচার? ওই লোকটা কী করতে চায় মিতুলকে নিয়ে?

এ উত্তর জানা নেই কারও। শুধু অজানা এক আশঙ্কা বুকের মধ্যে জাল বুনে চলেছে মাকড়সার মতো। যেন ধীরে ধীরে সে শিকারের দিকে এগোচ্ছে। শিকারটি সব দেখতে পাচ্ছে কিন্তু লালারসে বন্দী অবস্থায় আসন্ন যন্ত্রণার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী বা করার থাকে! চুপ করে রইল ওরা তিন জন।

ও দিকে নাতনির সঙ্গে দেখা করে ভুরুটা যেন আরও বেশি কুঁচকে গেল ভাদুড়ি মশায়ের। এমনিতেই লোকনাথের নাম শোনার পর থেকে তীব্র এক অস্বস্তি কাজ করছে তাঁর মধ্যে। এই লোকনাথের জন্যই আজ থেকে তিরিশ বছর আগে তিনি তন্ত্র চর্চা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই লোকনাথ আবার ফিরে এসেছে এবং সে যা করতে চলেছে তা ভয়াবহ। যদিও মেয়েটির বাবার সামনে তিনি সন্দেহ শব্দটা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু আসলে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি সবটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি জানেন লোকনাথ কী করতে চলেছে। এই ভূ-ভারতে ওই বিশেষ এবং ভয়ানক সাধনার কৌশলটি জানতেন শুধু তিনি আর জানে লোকনাথ। এমনিতেই মিতুল নামে মেয়েটিকে কী ভাবে রক্ষা করবেন তার কোনও উপায়ই খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি, তার মধ্যে অপালা যা বলল তা তাঁকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। অপালার বয়ান অনুসারে, সে ঘরে বসে ল্যাপটপ খুলে পড়ছিল আর একটা খাতায় নোটস নিচ্ছিল। হঠাৎ একটা বছর পাঁচ-ছয়েকের বাচ্চা মেয়ে তার কলমটা তুলে নিয়ে দৌড় দেয়। প্রথমটা সে খুব অবাক হয়েছিল, তাদের বাড়িতে তো অমন কোনও মেয়ে নেই! তবে কি বাইরে থেকে কেউ ঢুকে পড়েছে! তার পরই সে মেয়েটাকে ধরতে ছুটে যায় এবং ফ্লাওয়ার ভাসে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে সে দেখতে পায় মেয়েটি তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি বলে ওঠে, রাগ কোরো না দিদি। ব্যাস, এর পর আর কিছু মনে নেই তার।

ভাদুড়ি মশাই নিশ্চিত, তাঁর বাড়িতে অমন কোনও মেয়ে ঢোকেনি। কারণ গেটের তালা খুলেই অচেতন অপালাকে জিপে তোলা হয়েছিল। তবে কোথা থেকে এল মেয়েটি? ভাবতে ভাবতেই শিউরে ওঠেন তিনি, এ কি তবে লোকনাথেরই কোনও ছল? এত বছর পর সে ফিরে এসেছে গুরুর ওপর প্রতিশোধ নিতে?

১২

দু’হাতে কপালের রগ ধরে বসেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। ওরা সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়েছিল তাঁর দিকে কিন্তু কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। অপেক্ষা করছিল কখন বৃদ্ধ নিজে থেকে কিছু বলে ওঠেন। নাতনিকে দেখে এসে তিতাসের চেম্বারে ফিরে সেই যে কপাল ধরে বসেছেন তার পর দশ মিনিট কেটে গেছে এক বারও মুখ তোলেননি। পল্লব দু’এক বার কথা বলে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সঞ্জয়ের চিমটি খেয়ে চুপ করে যেতে বাধ্য হয়েছে। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর মুখ তুলে বললেন, আপনাদের কারও কাছে একটা সিগারেট হবে?

হকচকিয়ে গেল সবাই। বৃদ্ধের কাছ থেকে এ কথাটা কেউই আশা করেনি। সঞ্জয় ছাড়া এখানে সকলেই স্মোকার কিন্তু ভাদুড়ি মশায়ের ব্যক্তিত্বের সামনে সবার মনেই যেন সেই প্রথম প্রথম সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা পড়ার লজ্জা ঘনিয়ে উঠল। ওদের অস্বস্তি বুঝে বৃদ্ধ বললেন, লজ্জার কিছু নেই। থাকলে দাও। বিশ বছর হল ধূমপান ছেড়েছি কিন্তু আজ মনটা একেবারে বশে নেই। স্নায়ুগুলো চঞ্চল। সবটা গুছিয়ে বলতে গেলে একটু ধাতস্থ হতে হবে।

উঠে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে এগিয়ে দিল পল্লব। সিগারেটটা ঠোঁটের ফাঁকে রাখলেন তিনি। কিন্তু লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিতে যেতেই বাধা পেল পল্লব। হাত তুলে থামিয়ে তিনি বললেন, আমাকে দাও। মুখাগ্নি একেবারে শেষ দিনে হওয়াই অভিপ্রেত।

অপ্রতিভ হয়ে লাইটারটা ভাদুড়ি মশায়ের হাতে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল পল্লব। সঞ্জয় চাপা গলায় বলল, সব জায়গায় পাঁয়তারা মারলে চলে না।

চাপা গলায় উত্তর দিল পল্লব, হু। বুড়োটি বাস্তুঘুঘু।

সঞ্জয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ভাদুড়ি মশাই বলে উঠলেন, আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা, লোকনাথ আমার কাছে এসেছিল।

টানটান হয়ে বসল ওরা পাঁচ জন। ওদের মুখের দিকে এক বার চোখ বুলিয়ে ভাদুড়ি মশায় বলতে শুরু করলেন, লোকনাথ তখন যুবক। কত বয়স হবে ওর, বড়জোড় পঁচিশ কি ছাব্বিশ। কোথা থেকে যে ও আমার সন্ধান পেয়েছিল আমি জানি না, এক দিন সকালে কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরচ্ছি, এসে সটান পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। বলল, চরণে আশ্রয় দিন গুরুদেব।

সে সময় অনেকেই নানা বিপদে আপদে আমার কাছে আসত। আমি ভেবেছিলাম, তেমনই কেউ হবে। বললাম, এখন না। বিকেলে এসে দেখা কোরো।

কথা না বাড়িয়ে ও চলে গেল। সারাদিনে নানা কাজে আমি ভুলেও গেছিলাম কিন্তু বিকেলে যখন বাড়ি ফিরছি দেখি গেটের এক পাশে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে গেল, ওকে বিকেলে দেখা করতে বলেছিলাম। বাড়ি ঢুকে জামাকাপড় বদলে ওকে ডেকে পাঠালাম লাইব্রেরি ঘরে। কিছুতেই চেয়ারে বসাতে পারলাম না ওকে। হাত জোড় করে মাটিতে পায়ের কাছে বসল। নিজের পরিচয় দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা কী সমস্যা তোমার?

লোকনাথ বলল, সমস্যা নাই গুরুদেব। আমি আপনার শিষ্য হতে চাই। আপনার কাছে মন্ত্র নিতে চাই।

শুনেই আমি বিরক্ত হলাম। এমন অনেকেই আমার কাছে আসত তখন। এসে, দীক্ষা দিন, বলে ঝোলাঝুলি করত। এদের সকলেরই ধারণা তন্ত্র একটি অত্যন্ত সোজা ব্যাপার। দু’-চার দিন অভ্যেস করলেই না কি মস্ত তান্ত্রিক হওয়া যায়! লোকনাথকেও তাদের দলেই ফেলেছিলাম আমি এবং যথারীতি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু লোকনাথ হাল ছাড়ার পাত্র ছিল না। সে দিনের পর থেকে ও রোজ সকালে আমার কলেজ যাওয়ার সময় এবং বিকেলে ফেরার সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। প্রথম প্রথম আমার মজাই লেগেছিল। এটা নতুন কিছু না। কমবেশি সবার মনেই ধারণা থাকে যে গুরু প্রথম বারেই কাউকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না। শিষ্যের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চান। আমিও আট মাস অপেক্ষা করার পর আমার গুরু আমার প্রতি সদয় হয়েছিলেন। তা আমি ভেবেছিলাম, লোকনাথও বাকিদের মতো এই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে দিতে মাসখানেকের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দেবে। কিন্তু লোকনাথ যে আমাকে এতটা ভুল প্রমাণ করবে আমি তখনও ভাবতে পারিনি। গুরুকৃপা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি বলে আমার মনে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। সে গর্ব ভেঙে দিয়েছিল লোকনাথ। এক মাস নয়, দু’মাস নয়, টানা এক বছর ধরে প্রতিদিন লোকনাথ দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার ধারে। শেষমেশ রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম আমি। এক দিন রিক্সা থামিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এসো।

সেই আমার কাছে লোকনাথের শিক্ষা শুরু হল। দীক্ষা আমি আগেও কয়েক জনকে দিয়েছি কিন্তু লোকনাথের মতো তুখোড় ছাত্র আমি আমার সমগ্র শিক্ষকজীবনে আর একটিও পাইনি। লোকনাথ আমার দেখা উজ্জ্বলতম ছাত্র।

এই অবধি বলে চুপ করলেন ভাদুড়ি মশায়। সঞ্জয়ের নিজের কলেজ বেলার কথা মনে পড়ে গেল। তার চরম বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষকেরাই। আদর্শ শিক্ষকেরা বুঝি বা এমনই হন। ছাত্র যতই খারাপ হোক না কেন, সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমন ভাবেই স্নেহসিক্ত হয়ে আসে তাঁদের কণ্ঠ। তিতাস বলে উঠল, তার পর?

গলা ঝেড়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, লোকনাথের মতো শিষ্য পেয়ে আমিও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলাম। যা জানতাম সবটা হাতে ধরে শিখিয়েছিলাম। লোকনাথের নিষ্ঠা ছিল দেখার মতো। ও আমার বাড়িতেই থাকত। আর পাঁচ জন যারা তন্ত্র নিয়ে চর্চা করতে চাইত তাদের সঙ্গে লোকনাথের একটা মূলগত পার্থক্য ছিল। তোমাদের একটা প্রশ্ন করি। তন্ত্র কী বলো তো?

আচমকা এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ওরা। পুরনো কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ যে আচমকা প্রশ্ন করে বসবেন তা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। ওদের বাঁচিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিলেন। বললেন, পদার্থ বিদ্যার প্রায়োগিক দিক যেমন অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স তেমনই তন্ত্র হল মন্ত্রের প্রায়োগিক দিক। তা এই প্রয়োগের দু’টি দিকই রয়েছে। শুভ এবং অশুভ। যে কোনও শক্তিকেই ভাল এবং খারাপ দু’ভাবেই ব্যবহার করা সম্ভব। সাধারণ নিম্নমেধার তান্ত্রিকেরা শক্তির অশুভ দিকটা নিয়েই মাতামাতি করে। আর তাতে ষটকর্ম অর্থাৎ মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি সামান্য কিছু শক্তি আয়ত্ত করে। উচ্চমার্গের সাধনার কিছুই জানে না তারা। লোকনাথের কিন্তু ঝোঁক ছিল উচ্চমার্গের সাধনার দিকে। ও কখনও তাড়াহুড়ো করত না। থিয়োরি না বুঝলে যে ভাল প্র্যাকটিক্যাল করা যায় না, লোকনাথ সেটা জানত। কিন্তু তখনও আমি বুঝিনি এ সবই ছিল লোকনাথের ছল। এগুলো ও করত আমাকে খুশি করার জন্য। আমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য। আর মূর্খ আমি ওকে বিশ্বাসও করেছিলাম। ওকে নিরাপদ ভেবে ওর সামনে খুলে দিয়েছিলাম গোপনতম এবং ভয়াবহ এক জগতের দরজা। আমি জানতাম না, লোকনাথ এটারই অপেক্ষায় ছিল এত দিন।

বড় করুণ শোনাল ভাদুড়ি মশায়ের গলা। যেন মিতুলের এই ঘটনার জন্য পরোক্ষে নিজেকেই দায়ী করলেন বৃদ্ধ। ইতস্তত করে তিতাস বলল, একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার?

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। ক্লান্ত স্বরে বললেন, বলতে তো হবেই মা। যে বিষবৃক্ষের বীজ আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে রোপণ করেছিলাম, আজ তাতে ফল ধরেছে। এ দায় আমি অস্বীকার করব কেমন করে?

কিছু বলতে যাচ্ছিল অমিয়। হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশায়, সান্ত্বনা দিও না আমাকে। গত তিরিশ বছর ধরে এই ভয় আমি গোপনে পুষে রেখেছিলাম। আমি জানতাম এক দিন না একদিন এ অনিষ্ঠ হবেই। শুধু আশা করেছিলাম, তা ঘটবে আমার অগোচরে। কিন্তু নিয়তি কেন বধ্যতে। সেই জড়িয়ে গেলাম আমি। লোকনাথকে বিশ্বাস করে যে ভুল আমি করেছিলাম, তার মাশুল তো আমায় দিতেই হতো। যাক গে, যা বলছিলাম, দেখো আমি কোনও দিনই তন্ত্র সাধক হতে চাইনি। আমি সর্বান্তকরণে একজন শিক্ষক। পড়াশোনা করতে গিয়ে আমার তন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায় এবং আমি বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম। কপালগুণে গুরু আমার ওপর কৃপা করেছিলেন। তা ভারতীয় তন্ত্র সম্পর্কে জানতে জানতেই আমার অন্যান্য দেশের তন্ত্র সম্পর্কেও কৌতূহল জন্মায় এবং আমি খুঁজতে শুরু করি। খুঁজতে খুঁজতে অবাক হয়ে দেখি, পৃথিবীর নানা দেশে তন্ত্রের নানা রকমফের। সে সব আমি সংগ্রহ করতে শুরু করি। দু’টি জাবদা খাতা তৈরি করি। তার একটিতে আমি সেই সব বিদেশি তন্ত্র চর্চার শুভ প্রয়োগগুলি লিখে রাখতে শুরু করি এবং আর একটি খাতায় লিখতে থাকি অশুভ প্রয়োগগুলির কথা। বড় ভয়ানক সেই সব পদ্ধতি এবং তার চেয়েও ভয়ানক তার ফল। এই দু’টি খাতাই আমি লোকনাথকে পড়তে দিয়েছিলাম। আমি নেহাতই অ্যাকাডেমিক কৌতূহল থেকে সেই সব লিখে রাখতাম কিন্তু লোকনাথের ছিল বিপরীত বুদ্ধি। ও আমাকে লুকিয়ে সেই সব গোপন এবং ভয়াবহ পদ্ধতিগুলি অভ্যাস করতে শুরু করে। এক দিন ধরা পড়ে যায়। ওর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি ও মানুষ বলি দিয়েছে। সেই দিন লোকনাথকে চড় মেরেছিলাম আমি। পুলিশ ডেকে ওকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। মানুষ চিনি না বলে নিজের ওপর ভয়ানক ঘেন্না হয়েছিল আমার। কিন্তু সে বার বিচারে কিছু প্রমাণ হয়নি বলে লোকনাথ ছাড়া পেয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। গেট থেকেই ওকে দূর করে দিয়েছিলাম আমি। বলেছিলাম, তোর মতো নরাধমের মুখ দেখতে চাই না।

যাওয়ার আগে লোকনাথ আমায় শাসিয়ে গেছিল। বলেছিল, আমি যা করেছিলাম তা যদি আপনার অন্যায় মনে হতো তা হলে নিজে হাতে জুতোপেটা করতেন আমায়। পুলিশে দিলেন কেন? এ কাজটা আপনি ঠিক করেননি গুরুদেব। বিরাট ভুল করেছেন। আপনারে এর মাশুল দিতে হবে।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি সে দিন বলেছিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর যা করার আছে করে নিস। নিম্ন মার্গের পাঁচপেঁচি তান্ত্রিক ভয় দেখাচ্ছে কি না নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়িকে!

তখনও জানতাম না, লোকনাথ ফাঁকা আওয়াজ করেনি। প্রমাণ পেলাম দিন কয়েক পর। লিখতে বসে দেখলাম, যে খাতায় বিদেশি তন্ত্রের অশুভ প্রয়োগগুলি লিখে রাখতাম তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক সাধনাগুলি যে সব পাতায় লেখা ছিল, পাতাগুলি কেউ নিপুণ হাতে কেটে নিয়েছে খাতা থেকে! আমার এত দিনের পরিশ্রম চুরি হয়েছে। বলা ভাল, আমি যে মারণাস্ত্র বানিয়েছি স্নেহান্ধ হয়ে তাই তুলে দিয়েছি হিংস্র, দুর্দমনীয় এক যুদ্ধবাজের হাতে। সেই দিনের পর থেকে আমি সব ছেড়ে দিই। আবার কে কবে এসে নিষ্ঠা দেখাবে, মন গলে যাবে আমার! হাতে করে আর কোনও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করতে পারব না আমি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন ভাদুড়ি মশায়। অস্বাভাবিক এক নিস্তব্ধতা গোটা ঘর জুড়ে। বুঝি বা পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। নীরবতা ভেঙে কথা বলে উঠল সঞ্জয়, এত জায়গা থাকতে মামা কেন বারাসাতে এসে এ সব শুরু করল এতক্ষণে তার উত্তর পাওয়া গেল।

ঘাড় নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, ঠিক বলেছ। লোকনাথ অসীম ক্ষমতা পেতে চায় এবং সেটা পেতে চায় আমারই নাকের ডগায় বসে। আমাকে দেখিয়ে দিতে চায়, আমি ওকে তাড়িয়ে দিলেও ওর সাধনায় কোনও বাধা পড়েনি। এবং আমার বিশ্বাস কি জানো, লোকনাথ যে ভয়ানক সাধনাটি করছে তাতে সিদ্ধি লাভ করলে ও সবার আগে আমার ওপরেই প্রতিশোধ নেবে।

পল্লব বলল, কিন্তু স্যার, একটা কথা বলুন, আপনার ওপর যদি প্রতিশোধ নেওয়ারই থাকত তা হলে এত দিন কি লোকটা চুপ করে বসে থাকত? ওর তো একটা পিশাচ আছেই যে ওর কথায় ওঠে বসে। তাকে দিয়ে কি

উঁহু, পারত না, বলে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, ওর পিশাচটি নিম্ন শ্রেণির। গুরুবাক্য থেকে আমি আজ অবধি বিচ্যুত হইনি। গুরুকৃপায় এ আধারেও তো কিছু শক্তি আছে। ওই পিশাচ আমার কিছু করতে পারবে না কিন্তু লোকনাথ যে সাধনা করছে তাতে যদি ও সফল হয় আমিও আর নিজেকে বাঁচাতে পারব না। মহাশক্তিধর হয়ে উঠবে ও। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রলয় আসবে।

মামির কথাগুলো যেন সঞ্জয়ের কানে বাজতে থাকে। মামিও ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল। বলেছিল, ‘আমাকে টানছে। আমি আর লড়াই করতে পারছি না। সে যা চাইছে তা যদি হয় সর্বনাশ হবে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রলয় আসবে।’ তার মানে মামাই মামিকে বন্দি করেছে! সেই জন্যই মামি সে দিন ওই কথাগুলো বলেছিল! কিন্তু কীসের সাধনা করছে মামা? তার জন্য মিতুলকে কেন দরকার তার?

প্রশ্নগুলো ভাদুড়ি মশায়কেই করল সঞ্জয়। একটু চুপ থেকে ভাদুড়ি মশায় বললেন, তোমাদের মধ্যে কারও ওই পিশাচটিকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে?

সঞ্জয় ঘাড় নাড়ল, আমার হয়েছে স্যার।

ভাদুড়ি মশায় বললেন, কেমন দেখতে তাকে? খুব বেঁটে আর মোটা? মাথায় টাক? মেয়েদের মতো গলায় কথা বলে?

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ওরা। অস্ফুটে সঞ্জয় বলল, আপনি গেনুকে জানেন?

ম্লান হাসলেন বৃদ্ধ, ও! লোকনাথ বুঝি তার নাম রেখেছে গেনু?

আবারও অবাক হওয়ার পালা। সঞ্জয় বলল, ওর নাম গেনু নয়?

বৃদ্ধ বললেন, দেখো, ভূত, প্রেত, পিশাচ, হাঁকিনী, ডাকিনী এরা সবই এক এক ধরনের শক্তি যা আমাদের অনুভবযোগ্য এই চতুর্মাত্রিক জগতের বাইরে অবস্থান করে। বিশেষ সাধনার বলে এবং কখনও কখনও বিশেষ কার্যকারণ সম্পর্কে এরা আমাদের জগতে আসে। এরা প্রত্যেকেই এক একটা স্পিসিজ। লোকে ভালবেসে যেমন পোষা কুকুরের নাম দেয়, ঠিক তেমনই লোকনাথ তার পোষা পিশাচের নাম দিয়েছে। নিজের ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করতে শিখিয়েছে। তবে এই পিশাচটির উল্লেখ কোনও ভারতীয় তন্ত্রে নেই কারণ লোকনাথ যে সাধনায় প্রথমে এই পিশাচটিকে বশ করেছিল তা কঙ্গোর এক আদিম উপজাতির তন্ত্র এবং ওই উপজাতিটি বামন, ডোয়ার্ফ। সে জন্যই গেনুকে অমন দেখতে।

বিস্ময়াভূত হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল ওরা। পল্লব বলে উঠল, কঙ্গো? আফ্রিকা? ওই লোকটা আফ্রিকার তন্ত্র সাধনা করছে?

ঘাড় নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, এখন সে ওই বিশেষ সাধনাটির শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর দু’টি পদ্ধতি। দু’টিই মর্মান্তিক। প্রথম পদ্ধতির সাধনায় লোকনাথ কোনও কারণবশতঃ ব্যর্থ হয়েছে তাই এই চরম পন্থা। যা বলতে চলেছি সহ্য করতে পারবে তো?

দীপক পালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন ভাদুড়ি মশায়। ফ্যাকাশে মুখে ঘাড় নাড়লেন দীপক পাল, সহ্য করা ছাড়া আর কি কোনও উপায় আছে স্যার? আপনি বলুন। আমি জানতে চাই ওই লোকটা মিতুলকে নিয়ে কী করতে চায়?

দীপক পালের মনের কথা যেন পড়তে পারলেন বৃদ্ধ। মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যা ভাবছ তা নয়। লোকনাথ তোমার মেয়ের দিকে মোটেই কামনার দৃষ্টিতে তাকাবে না। ওকে অশালীন ভাবে স্পর্শও করবে না কারণ ও তোমার মেয়েকে এখন কন্যারূপে দেখছে।

তা হলে ওই লোকটার থেকে মিতুলের কীসের ভয়? তা হলে কেন আপনি বলছেন, মিতুলের সাথে যা হতে চলেছে তার থেকে মৃত্যুও শ্রেয়! তার মানে ও তো মিতুলকে মারবে না! তবে? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না স্যার, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, কেঁদে ফেললেন দীপক পাল।

হতাশ গলায় বৃদ্ধ বললেন, বুঝতে পারছ না তার কারণ ওই বীভৎসতা কল্পনা করার শক্তি ঈশ্বর মানুষকে দেননি। তার জন্য লোকনাথের মতো দানব হতে হয়। এ সাধনা সাত দিন ধরে চলে। সপ্তম দিনটি হতেই হবে বিশেষ কোনও তিথি। আজ যদি মৃতদেহ উধাও হতে শুরু হওয়ার পঞ্চম দিন হয় তা হলে আর দু’দিন পরেই সেই বিশেষ তিথিটি আসবে এবং তোমরা জানো কি না জানি না, আর দু’দিন পরেই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।

চমকে উঠল ওরা, তাই তো। এ কথাটা তো আগে মাথায় আসেনি। সত্যিই দু’দিন পর সূর্যগ্রহণ এবং খবরে বলছে, এমন সূর্যগ্রহণ না কি চব্বিশ বছর পর হচ্ছে। পরেরটি হবে আরও বত্রিশ বছর পর।

ভাদুড়ি মশায় বললেন, যে কোনও তন্ত্র সাধকের কাছে এমন তিথি লোভনীয়। কারণ এ মাহেন্দ্রক্ষণ কালেভদ্রে আসে। তাই জন্যই লোকনাথ সাধনার জন্য এই বিশেষ সময়টি বেছে নিয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রতি দিন একটি একটি করে শবের ওপর বসে সাধনা করতে হয়। সাধনার চতুর্থ দিন থেকে শেষ চার দিন ওই শবের মুখে মদের বদলে দিতে হয় কুমারী মেয়ের রজঃ এবং সপ্তম দিনে আসে সেই ভয়াবহ ক্ষণ যখন সাধক তার সমস্ত শক্তি পোষা পিশাচের মধ্যে সমর্পিত করে ও পিশাচটিকে পুত্ররূপে কল্পনা করে। অসহায় মেয়েটির সঙ্গে তার বিবাহ দেয়। রজঃস্বলা মেয়েটিকে বলপূর্বক রমণ করে সেই পিশাচ এবং তৎক্ষণাৎ মেয়েটির গর্ভসঞ্চার হয়। কয়েক দণ্ডের মধ্যে মেয়েটি জন্ম দেয় আর একটি পিশাচের যার শক্তির তুলনা হতে পারে শুধুমাত্র ঈশ্বরের সঙ্গে। এবং অবশ্যই সেই পিশাচটিও সাধকের আজ্ঞাবহ। তার পর, পিশাচ জন্ম দেওয়ার অভিশাপে ধীরে ধীরে মেয়েটির দেহ পচতে শুরু করে। অসহ্য যন্ত্রণায় মেয়েটি ছটফট করতে থাকে কিন্তু মৃত্যু আসে না। মৃত্যুও যেন মুখ ফিরিয়ে নেয় অভিশপ্ত মেয়েটির থেকে। এই যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং শেষপর্যন্ত তাকে এ নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় মাংসভোজী পরজীবী কীটের দল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন ভাদুড়ি মশায়। বজ্রাহত হয়ে বসে রইল ওরা পাঁচ জন। এমন অসম্ভব, অবাস্তব, হাড় হিম করা কথা ওরা কেউ কখনও শোনেনি। শুনবে বলে ভাবেওনি। ভাদুড়ি মশায়ের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন দীপক পাল।

ভাদুড়ি মশায়ের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলেন দীপক পাল আর অমিয় তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, কাঁদবেন না পালদা। আপনি তো বলেন এ জন্মের কর্মফল এ জন্মেই মিটিয়ে যেতে হয়। কখনও তো খারাপ কিছু করেননি আপনি। আপনার সঙ্গে এ হতে পারে না। এ হতে পারে না পালদা। আপনি শান্ত হোন।

কিন্তু শান্ত করা যাচ্ছিল না দীপক পালকে। এমন অসহায় ভাবে কখনও কাউকে কাঁদতে দেখেনি পল্লব। সেই কান্না চারিয়ে যাচ্ছিল সকলের মধ্যে। সবার চোখ দিয়েই কখন যে জল গড়াতে আরম্ভ করেছে কেউই খেয়াল করেনি। কাঁদছিল পল্লবও। চোখ মুছে সে বলল, কিন্তু এর তো নিশ্চয়ই কোনও প্রতিকার আছে স্যার। সেটা কী?

জোরে জোরে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, না নেই। একবার এ সাধনা শুরু হলে কোনও প্রতিকার নেই। প্রথমত লোকনাথ কোথায় সাধনা করছে একমাত্র সে বলে না দিলে জায়গাটা কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি খুঁজে পাওয়া যায়ও, সাধনা শুরু হয়ে যাওয়ার পর কোনও রজঃস্বলা নারী ছাড়া মেয়েটির কাছে আর কেউ যেতে পারবে না। তৃতীয়ত, পিশাচটি সর্বক্ষণ মেয়েটিকে পাহারা দিচ্ছে, তার নজর এড়িয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। তবে একমাত্র একটি ভাবেই এ সাধনা অসিদ্ধ হতে পারে যদি সময়ের আগেই মেয়েটির রজঃ বন্ধ হয়ে যায়। পিশাচটি যখন মেয়েটিকে রমণ করতে যাবে তখন যদি মেয়েটির রক্তপাত না হয় তা হলে সে মেয়েটিতে প্রবিষ্ট হতে পারবে না।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মিতুলের পিরিয়ডস তো সবে শুরু হয়ে হয়েছে। অন্তত ছ’দিন তা চলবে। তার আগে কথা শেষ করতে পারল না অমিয়, ভাদুড়ি মশায় বলে উঠলেন, সে জন্যই তো বললাম প্রতিকার নেই। এক মাত্র অলৌকিক কিছু না হলে মিতুলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমারই চোখের সামনে আমারই তৈরি করা দানব আমার নাতনির চেয়েও ছোট একটি অসহায় মেয়েকে এমন যন্ত্রণা দেবে অথচ আমি কিচ্ছু করতে পারব না! হা ঈশ্বর! এই লিখেছিলে তুমি আমার অদৃষ্টে!

অসহায় ভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন ভাদুড়ি মশায়। কান্নায় গলা বুজে এল তাঁর। কিন্তু তিতাস তাকিয়েছিল অন্য দিকে। তার মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরছিল, যদি জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যায়ও, সাধনা শুরু হয়ে যাওয়ার পর কোনও রজঃস্বলা নারী ছাড়া মেয়েটির কাছে আর কেউ যেতে পারবে না। যদিও ভাবনাটি অসম্ভব তবু ভাবছিল তিতাস। কিন্তু নাহ! হতাশ হল সে। মিতুলকে বাঁচানোর জন্য হাতে মাত্র দু’দিন সময় আছে। তার পিরিয়ডসের ডেট আসতে এখনও চার দিন দেরি।

১৩

হাসপাতালের একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে। ডেটল, ফিনাইল, ওষুধ, রক্ত, হাগা, মোতা সব মিলিয়ে একটা বিচ্ছিরি চিমসে গন্ধ। মাথাফাতা ধরে যায়। তাও কেবিনে আছে বলে জায়গাটা অনেক পরিষ্কার, যদি জেনারেলে ফেলে রাখত তা হলে আর দেখতে হতো না। আগে এ সবে প্রবলেম হতো না। কত রাত নেশা করে নিজের বমির ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু গত চার বছর ধরে গুরুর সাথে থাকতে থাকতে অভ্যেস বদলাচ্ছিল। গুরু হেবি সাফসুতরো মানুষ। সব সময় কাচা জামা প্যান্ট পরতো, সেন্ট মাখত। বলত, ভাল গন্ধ মন ভাল রাখে।

গুরুর কথা মনে পড়ে চোখটা ভিজে উঠল সমীরের। সমীরকে অনাথ করে দিয়ে অকালে চলে গেল মানুষটা। গুরু আর তিতাস দিদি, মোটে এই দু’টো মানুষই তো ছিল জীবনে। তাও এক জনকে নিয়ে নিল ওই দানবের বাচ্চাটা। ঝপ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল সমীরের। মনে মনে বলল, মা কসম, ওই দানব-এর বুকের রক্ত যদি না খেয়েছি তো আমার নাম সমীর দলুই না।

বলতে বলতে, পাশ ফিরে শুতে গিয়েই আরও বেশি করে ঝাঁট জ্বলে গেল সমীরের। এমন ধলতার ব্যান্ডেজ যে পাশ অবধি ফেরা যায় না। তিতাস দিদির বলিহারি। মোটে দুটো পাঁজরার হাড় ভেঙেছে আর মাথায় চোদ্দোটা সেলাই পড়েছে তার জন্য আটকে রেখে দিয়েছে! এই ভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে মেজাজ আরও বিগড়ে যাচ্ছে। একটু আগে তো একটা নার্সের সাথে হেবি ঝামেলা হয়ে গেল। ওয়ার্ড বয়টাকে ঘুষ দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট আনিয়েছিল। সবে ধরিয়ে দু’টো সুখটান দিয়েছে, নার্সটা এসে হুজ্জুতি বাধিয়ে দিল। আরে ভাল মুখে বললেই হতো। আরও গোটা চারেক টান দিয়ে সে ফেলেই দিত সিগারেটটা, তা না কী হম্বিতম্বি, এখুনি ফেলো। এটা হাসপাতাল, পাড়ার ক্লাব না।

আরে ব্যাটা, সে কী জানে না, এটা পাড়ার ক্লাব না? পাড়ার ক্লাব হলে কি তিতাস দিদি দু’বেলা ক্যারাম পিটতে আসে? যত আবোদা মার্কা কথা বার্তা! তাও বেশি কথা না বাড়িয়ে সমীর সিগারেটটা ফেলেই দিয়েছিল। কিন্তু সে মাল চুপ করলে তো! ভ্যাজর ভ্যাজর করেই যাচ্ছিল! লাস্টে যেতে যেতে বলেছিল, তিতাস ম্যাডামের সবেতে বেশিবেশি। এই সব নেশাখোরদের এত তোল্লাই দেওয়ার কী আছে কে জানে বাবা!

ব্যাস, সমীরের ‘আতা মাজি সটকলি!’ গুরুর মুখ চেয়ে এত কষ্ট করে নেশা ছেড়েছে সে আর সেই নেশা নিয়েই অপবাদ! মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল, হ্যাঁ, আমি নেশাখোর আর তুমি সাধু!

আর যায় কোথায়? সে মেয়েটা কেঁদেকেটে পুরো যাত্রাপালা বসিয়ে দিল। হেড নার্স এসে শাসিয়ে গেছে, তিতাস ম্যাডাম এসে সব বলে দেবে। সেই নিয়ে খানিক চাপে আছে সমীর। তিতাস দিদির মুড সে কিছুতেই ধরতে পারে না। এই হাসিখুশি তো এই গম্ভীর! আর যখন কাউকে ঝাড়ে একেবারে পাছায় বিছুটি পাতা ডলে দেয়! সমীর বুঝতে পারছে, খিস্তিটা মারা উচিত হয়নি কিন্তু গুলি তো বেরিয়ে গেছে বন্দুক থেকে। সবচেয়ে ভাল হতো যদি হাসপাতাল থেকে পালাতে পারত। তা হলে হপ্তাখানেক তিতাস দিদিকে মুখ দেখাতে হতো না। তদ্দিনে নিশ্চয়ই দিদি শান্ত হয়ে যেত। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না সমীর তখনই কে যেন দাদা, বলে ডেকে উঠল।

ঘাড় ঘুরিয়ে সমীর অবাক। বেডের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে আছে একটা রোগাপাতলা বাচ্চা ছেলে। সাত-আট বছর বয়স হবে। চোখ দু’টো বড় বড় আর মুখখানা হেবি মিষ্টি। অবাক হয়ে গেল সমীর! এই হাফটিকিটটা এখানে কোত্থেকে এল? সে তো দরজার দিকে মুখ করেই শুয়েছিল। ঢুকতে তো দেখেনি! তা হলে? অবশ্য অন্যমনস্ক ছিল, তাই হয়তো খেয়াল করেনি। নিশ্চয়ই কোনও পেশেন্ট পার্টির সাথে এসে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। সে হেসে বলল, কে তুই? নাম কী?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভারী অদ্ভুত একটা কথা বলল ছেলেটা। বলল, গেনুর ওপর তোমার খুব রাগ তাই না?

ভেবলে গেল সমীর, গেনু? গেনুটা কে? অনেকের ওপরেই তার রাগ আছে কিন্তু তার মধ্যে গেনু বলে তো কাউকে মনে পড়ছে না। শুয়ে শুয়েই সে বলল, কার কথা বলছিস তুই? কে গেনু?

ছেলেটা বলল, তুমি গেনুকে চেনো। নামটা জানতে না। ওই যে গো, যার জন্য মতিউর দাদা মরে গেল। ওই পিশাচটার নামই তো গেনু।

শরীরের সমস্ত রক্ত যেন এক মুহূর্তে সমীরের মুখে এসে জমা হল। উত্তেজনায় ফুলে উঠল কপালের শিরাগুলো। ছিটকে সোজা হয়ে বসল সে। খেয়ালও করল না এই ঝটকায় কপালের দু’টো কাঁচা সেলাই পট পট করে খুলে গেল। রক্ত গড়াতে শুরু করল কান ঘেঁষে। আবার মনে পড়ে গেল গুরুর মুখটা। হাসিখুশি চোখ দু’টোর একটা ভেদ ঢুকে আছে গাছের হারামি ডাল। শীতল চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সমীর বলল, তুই জানিস কোথায় থাকে ওই দানবটা?

ঘাড় নাড়ল ছেলেটা, জানি।

কেন জানি না, ছেলেটাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল সমীরের। মনে হল, একমাত্র এই ছেলেটাই তাকে ওই গেনু নামের জানোয়ারটা অবধি পৌঁছে দিতে পারবে। প্রতিশোধের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারবে। সে জিজ্ঞেস করল, আমাকে নিয়ে যেতে পারবি সেখানে?

পারব।

চল তবে।

টান মেরে হাত থেকে স্যালাইনের নলটা খুলে বেড থেকে উঠে দাঁড়াল সমীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল হাতের শিরা থেকে। জায়গাটা মুখ দিয়ে চেপে ধরল সে। রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই বুকের ডান দিকটা টনটনিয়ে উঠল ব্যথায়। অন্য কেউ হলে সে ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে যেত কিন্তু কইমাছ সমীর নাম তো তার এমনি এমনি হয়নি! এ দিক, ও দিক তাকিয়ে পা টেনে টেনে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল সে। কারও চোখে পড়ার আগেই বেরিয়ে আসতে পারল মেল ওয়ার্ড থেকে। আটটা-সাড়ে আটটা বাজে, তবু বেশ ভিড় হাসপাতালে। ভিড় আর অন্ধকার, এ দু’টোই গা ঢাকা দেওয়ার জন্য ভাল জিনিস। দিনের বেলা হলে এত সহজে সে বেরিয়ে আসতে পারত না। তবে একটা কথা সমীর ভাবছিল, খালি হাতে যাওয়াটা কতটা ঠিক হবে? আর যাই হোক দানবটা এলিতেলি না!

বেচারা সমীর! যদি রাগে আর ভালবাসায় অন্ধ না হতো, যদি তার সামান্যতম যুক্তিবোধও কাজ করত তা হলে বুঝতে পারত, অবাস্তব একটা লড়াই লড়তে যাচ্ছে সে। কারণ মতিউরের ভয়ানক মৃত্যু তো তার চোখের সামনেই ঘটেছিল। তবু কিছু কিছু মানুষ এমনই সৃষ্টিছাড়া হয়, আর হয় বলেই হয়তো তারা হারিয়ে গিয়েও থেকে যায় চিরকাল। মনে মনে।

আশপাশটা দেখছিল সমীর। তার চোখ এমন কিছু খুঁজছিল যা খুব ভারী নয়, সহজে বহনযোগ্য অথচ অস্ত্র হিসেবে মারাত্মক। ছেলেটা যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলল, একটা দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওইটা নাও না।

ঘাড় ঘুরিয়ে সমীর দেখল, একটা পুরনো লোহার ট্যাপ কল। বোঝা যাচ্ছে, বহুদিন ধরে এটার ব্যবহার হয় না। জং ধরে গেছে। কেউ দেখছে কি না দেখে নিয়ে এগিয়ে গেল সমীর। গায়ের জোর লাগিয়ে কয়েক বার ঝাঁকি দিতেই কলের মাথা সমেত রডটা গোড়া থেকে উপড়ে এল। খুশি হয়ে গেল সমীর। পুরনো দিনগুলো চলকে উঠল রক্তের মধ্যে। বাহ! এই তো দিব্যি হয়েছে অস্তরটা। জায়গামতো জমাতে পারলে দানব হোক আর পিচাশ হোক, খবর আছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, হেবি জিনিস দেখালি বাচ্চা। তোরও বুঝি গেনুর ওপর রাগ?

মাথা নাড়ল ছেলেটা, ওরা আমার মাকে আটকে রেখেছে।

থমকে গেল সমীর। তার পর বলল, কুছ পরোয়া নেহি। আগে নিয়ে তো চল আমায়। তার পর বাকিটা বুঝে নেব।

ছেলেটার পিছু পিছু হাসপাতালের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল সমীর। কিন্তু বেরতেই সতর্ক হয়ে গেল সে। সুট করে একটা চায়ের দোকানের আড়ালে ঢুকে গেল। দূর থেকে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটাকে চিনতে পেরেছে সমীর। তিতাস দিদির গাড়ি। এই সময় তিতাস দিদি হাসপাতালে আসছে কেন? গিয়ে নিশ্চয়ই এক বার না এক বার তাকে খুঁজবে আর সে পালিয়েছে শুনলে তুলকালাম করবে। খুঁজে আনতে লোকও পাঠিয়ে দিতে পারে। সময় নেই হাতে। ঝটপট এই চত্বর থেকে পাতলা হয়ে যেতে হবে। তিতাস দিদির গাড়িটা ভিতরে ঢুকে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল সমীর তার পর আড়াল থেকে বেরিয়েই বাচ্চাটাকে বলল, জলদি চল হাফটিকিট।

বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে বলতেই দ্রুত হাঁটছিল সমীর। শুধু রাস্তার কিছু লোক অবাক হয়ে দেখল, বুকে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা একটা চোয়াড়ে টাইপের ছেলে একা একা কথা বলতে বলতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হেঁটে চলেছে রাস্তা দিয়ে। এক জন মাঝবয়সি মহিলা তো তাঁর সঙ্গিনীকে বলেই ফেললেন, আহা রে! এতটুকু বয়েসেই পাগল হয়ে গেছে ছেলেটা!

. . .

মনটা ভাল নেই তিতাসের। ভাদুড়ি মশায়ের সাথে কথা হওয়ার পর একটা গোটা দিন কেটে গেছে। আজ রাত পোহালেই কাল সূর্যগ্রহণ। অনেক কিছু এক্সপেক্ট করেছিল তিতাস কিন্তু কিছুই হয়নি। ওরা যে তিমিরে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলকে উদ্ধার করার কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। দীপক পালের স্ত্রীর মধ্যে সামান্য পাগলামির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যদিও এ সব তন্ত্র সাধনার ব্যাপারে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি তবু মিতুলের জন্য অস্বাভাবিক দুঃশ্চিন্তা তাঁর মানসিক স্থিতি নষ্ট করে দিয়েছে খানিকটা। সকাল থেকে তিনি ভাত বেড়ে বসে আছেন এবং বারে বারে জিগ্যেস করছেন মিতুল কখন ফিরবে? দীপক পালের বোন এসে এখন রয়েছেন তাঁদের বাড়িতে। তিনিই ফোনে এ সব বলছিলেন দীপক পালকে। ওরা পাঁচ জন এতক্ষণ অমিয়র ফ্ল্যাটে বসে ছিল। একটু আগেই ওখান থেকে বেরিয়েছে তিতাস। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না তাই হাসপাতালে চলে এসেছে। ইমার্জেন্সিতে গিয়ে বসে থাকবে। কাজের মধ্যে থাকলে কষ্টটা কম হবে।

অনেক দিন পরে আজ পল্লবের সঙ্গে কথা হল। আজ অফ ডে, তাই সকাল থেকে বাড়িতেই ছিল তিতাস। দুপুরে অমিয় ফোন করে বলেছিল, বিকেলের দিকে এক বার আসতে পারবি? ওরা তো এখানেই আছে। আমি পালদাকেও ডেকে নিচ্ছি। যদি আলোচনা করে কোনও রাস্তা পাওয়া যায়!

বেরতে গিয়েও থমকে গেছিল তিতাস। ফিরে এসেছিল আয়নার কাছে। সাদামাটা জামাটা ছেড়ে একটা ভাল কুর্তি পরে নিয়েছিল। ঘন করে কাজল দিয়েছিল চোখে আর এত দিন পর আলমারি খুলে বার করে এনেছিল একটা বিশেষ পারফিউম। এটা তাকে পল্লবের দেওয়া শেষ উপহার। পল্লব শুধু এই পারফিউমটাই গিফট করত তাকে।

তিতাস বলত, এটা তো খুব কমন পারফিউম। বারবার এটাই দিস কেন বল তো আমায়?

পল্লব বলত, কমন বলেই তো দিই। এটা আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট।

এক্সপেরিমেন্ট?

হ্যাঁ। আমি লক্ষ্য করেছি, তুই গায়ে দিলেই এই পারফিউমটার গন্ধ অন্য রকমের হয়ে যায়। কেমন যেন নেশা ধরানো ঝিমিঝিমে একটা গন্ধ। অন্য কেউ মাখলে সেটা হয়ই না।

হাসত তিতাস, বলত, আমি তো খুব বড় বংশের মেয়ে। তাই আমার ফেরোমনে পারিজাত ফুলের সুবাস। দু’য়ে মিলেমিশে অমনটা হয়।

তার পরেই যথারীতি তাকে পেড়ে ফেলত পল্লব আর শুঁকতে শুরু করত। চুমু খেত না, আদর করত না, শুধু পাগলের মতো সারা শরীরে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিত। তিতাস মুখে বলত ঠিকই, আগের জন্মে তুই কুকুর ছিলি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অসহ্য রকমের উত্তেজিত হয়ে উঠত সে আর একটা সময় পর পল্লবকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চড়ে বসত তার ওপর। ক্যানাইন দু’টো দিয়ে কানের কাছটা কামড়ে ধরে বলত, বলেছি না, আমায় জাগাবি না? মর এ বার!

প্রথম দু’টো বছর রাগ আর অভিমানে দিব্যি কেটে গেছিল। কিন্তু ইদানীং বড় ফাঁকা লাগত তিতাসের। পল্লবের পরে সে যে আর পুরুষসঙ্গ করেনি তা নয়, কিন্তু সবাইকেই যেন বড্ড অগভীর লাগে। ওই শোয়াশুয়ি অবধিই ভাল কিন্তু তার পর ভীষণ ভীষণ একঘেয়ে। পল্লবের অনেক দোষ ছিল কিন্তু সে একঘেয়ে ছিল না। কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে পল্লবের কাছ থেকে কখনওই কোনও সলিউশন পাওয়া যেত না কিন্তু সে এমন উদ্ভট আইডিয়া দিত যে খুব টেনশনেও হাসি পেয়ে যেত। আর কিছু পারুক না পারুক পল্লব হাসতে পারত। হাসাতে পারত। রমণের একেবারে চরম মুহূর্তে নির্গত হতে হতে একমাত্র পল্লবই বলতে পারত, শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে/মুখের পরে, বুকের পরে।

শেষ দিকে কয়েক বার ভেবেওছিল পল্লবকে ফোন করবে কিন্তু করে উঠতে পারেনি। তাই এত দিন পর পল্লবকে দেখে সে যে অজান্তেই দুর্বল হয়ে পড়েছে, তিতাস সেটা বুঝতে পারল পারফিউমটা মাখার পর। লজ্জা পেয়েছিল খুব। এই ছেলেমানুষিটা না করলেই হতো। পল্লবের কুকুরের নাক। ঠিক গন্ধ পাবে। যদি ভাবে তিতাস সিগন্যাল দিচ্ছে? থমকে গিয়েই মনকে প্রবোধ দিয়েছিল তিতাস, ভাবলে ভাববে। এটা তো একধরনের সিগন্যাল বটেই।

কয়েক মুহূর্তের জন্য পল্লবের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনা হয়ে গেছিল তিতাস কিন্তু তার পরেই ফের বুকের ওপর চেপে বসেছিল মিতুলের জন্য ভয়। ভাদুড়ি মশায়ের কাছ থেকে সবটা জানার পর থেকেই তিতাসের মাথায় একটা অন্য অঙ্ক ঘুরছিল। ভাদুড়ি মশায় অনেকগুলি যুক্তি এবং তার প্রতিযুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন কেন মিতুলকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও কিছু অসম্ভব বলেই কি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে হবে? তিতাসের এক মাস্টারমশাই একটা কথা খুব বলতেন। তিনি বলতেন, ‘এই যে এত পড়ছ, এতে যে চাকরি পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু না পড়লে যে পাবে না সেটা নিশ্চিত।’ অর্থাৎ চেষ্টা করেও যে মিতুলকে উদ্ধার করা যাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই কিন্তু চেষ্টা না করলে মিতুল যে ওই পিশাচটির দ্বারা ধর্ষিত হবে এটা গ্যারান্টেড। তাই নিজের মতো করে কাউকে না জানিয়ে একটা চেষ্টা করেছিল তিতাস। ভালই হয়েছে কাউকে জানায়নি। কারণ, ডুমস ডে’র সময় এগিয়ে এসেছে অনেকটাই কিন্তু তার চেষ্টায় এখনও কোনও ফল হয়নি।

চেম্বারে ঢুকে ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে অনেকটা জল খেল তিতাস। বোতলের ঢাকনাটা আটকাচ্ছে, এক জন নার্স দরজায় উঁকি দিল, আসব ম্যাম?

আসুন। কী ব্যাপার?

আজ তো আপনার অফ ডে, তবু আপনি এসেছেন খুব ভাল হয়েছে।

কেন বলুন তো?

আসলে ম্যাম, সমীর দলুই আছে না, ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারই তো পেশেন্ট।

মানে? হোয়াট দ্য হেল! গলাটা দু’পর্দা চড়ে গেল তিতাসের, পেশেন্ট কেবিনের বাইরে যায় কী করে? আপনারা কী করছিলেন?

অধোবদন হয়ে নার্সটা বলল, আসলে ম্যাম ও তো আপনি ছাড়া কারও কথা শোনে না। আজকেই বিকেলে নমিতাদিকে গালাগালি দিয়েছে। আপনাকে জানিয়ে গেলাম, ও নিশ্চয়ই আশেপাশে আছে। ফিরে এলে একটু বলে দেবেন আমাদের সাথে যেন কোঅপারেট করে।

ঠিক আছে। আপনি যান। ও কেবিনে ফিরলে আমাকে খবর দেবেন।

ওকে ম্যাম, ঘাড় নাড়িয়ে নার্সটি চলে গেল। ধপ করে বসে পড়ল তিতাস, এই সমীরটা বড্ড অবাধ্য। আজ একটু ধমকাতে হবে ওকে। ভাবতে ভাবতে সবে একটু বেঁকে মোবাইলটা পকেট থেকে বার করতে যাবে অস্বস্তিটা টের পেল তিতাস আর তখনই একটা বাচ্চা মেয়ের গলা পেল সে, ও গো, শুনছ?

ঘাড় ঘুরিয়ে তিতাস অবাক। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। বছর পাঁচেক বয়স হবে। কী মিষ্টি গোল্লামতো দেখতে! মনটা ভাল হয়ে গেল তিতাসের। ইচ্ছে করল, গাল দু’টো চটকে মেখে খেয়ে নেয় এক্ষুনি। বোধ হয় কোনও সিনিয়র ডাক্তার বা নার্সের মেয়ে। বাবা বা মায়ের সাথে বেড়ুবেড়ু করতে এসেছে। নয়তো এই সময় তো এখানে কোনও বাচ্চার আসার কথা নয়। চেয়ার থেকে উঠে তিতাস এগিয়ে গেল মেয়েটার কাছে, হাত নেড়ে ছেলেমানুষি গলায় বলল, হ্যাঁ গো শুনছি। বলো। কী নাম তোমার?

উত্তর না দিয়ে মেয়েটা এমন একটা কথা বলল, স্তম্ভিত হয়ে গেল তিতাস। মেয়েটা বলল, তুমি মিতুলদিদির কাছে যেতে চাইছ তাই না?

বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে তিতাস বলল, কে তুমি? মিতুল কোথায় আছে তুমি জানো?

ঘাড় নাড়ল মেয়েটা। আধো গলায় বলল, জানি গো। তাই তো তোমায় বলছি, তুমি যাবে?

বিদ্যুচ্চমকের মতো তিতাসের মনে পড়ে গেল, ভাদুড়ি মশায়ের নাতনি অপালাও একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ের কথা বলেছিল। সে বলল, তুমিই কি তবে…

মেয়েটা যেন তিতাসের মনের কথা পড়তে পারল। কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠল, তা যদি না করতাম বুড়ো দাদু কি তোমাদের কিছু বলত? আর দেরি কোরো না গো চলো। যা ভাবছ করে ফেলো। আগে আমার সাথে গিয়ে জায়গাটা চিনে এসো তার পর বাকিদের নিয়ে যেও।

শিশুটির মুখের মধ্যে অপার্থিব একটা জ্যোতি। সে জ্যোতি যেন ভরসা দিচ্ছে তিতাসকে। কী হচ্ছে তিতাস ঠিক বুঝতে পারছে না কিন্তু এই মুহুর্তে মেয়েটাকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ভাদুড়ি মশায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, অলৌকিক কিছু না হলে মিতুলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তবে কি এ বার সেই অলৌকিক কিছুই ঘটতে চলেছে? চেষ্টায় ফল হবে তার মানে? সমীরের সাথে পরে কথা বললেও চলবে। দেরি না করে জলের বোতলটা ঢুকিয়ে ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল তিতাস। মেয়েটাকে বলল, চলো।

খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছে তিতাস। যদিও সে মেয়েটাকে আর দেখতে পাচ্ছে না তবু অনুভব করতে পারছে মেয়েটা তার সাথে সাথেই আছে। তার মাথার মধ্যে থেকেই সেই আধো আধো গলা তাকে রাস্তা বলে দিচ্ছে। হেলাবটতলা পেরিয়ে তিতাসের গাড়ি এখন ছুটেছে ময়নার দিকে। সামনেই একটা বাম্পার। মাথার মধ্যে সেই শিশুকণ্ঠ বলে উঠল, এখানে থামো।

গাড়ি থামাল তিতাস। হেড লাইট জ্বালিয়েই নেমে এল গাড়ি থেকে। রাস্তায় একটাও আলো জ্বলছে না। রাস্তার দু’দিকেই জঙ্গল। তার ওপর ঘন কুয়াশা। গা ছমছম করে উঠল তিতাসের। আবার মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। ডান দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওখানে একটা কারখানা আছে আর কারখানার গোডাউনের মধ্যেই আছে মিতুলদিদি।

অবাক হয়ে গেল তিতাস, কারখানা কোথায়? এ তো জঙ্গল! পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল ভাদুড়ি মশায়ের কথা, লোকনাথ যেখানে সাধনা করছে একমাত্র সে দেখিয়ে না দিলে কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই জায়গা খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। এই শিশুটি কে তা মিতুল জানে না কিন্তু সে যে অসাধারণ তা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। মেয়েটা বলল, সামনের আম গাছটা দেখতে পাচ্ছ? ওটাকে ঘিরে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে তিন বার পাক দিতে হবে তা হলেই তুমি কারখানাটা দেখতে পাবে। আমার সাথে এসো।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাচ্চাটার সাথে এগিয়ে গেল তিতাস। আমগাছটার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে পাক দিতে শুরু করল এবং তৃতীয় পাক শেষ হওয়া মাত্র তার চোখের সামনে থেকে কুয়াশার পর্দাটা সরে গিয়ে একটা কারখানার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। কারখানার গেটটা খোলা। লোকনাথ চক্রবর্তী মায়াজালের বেশি সিকিওরিটির কোনও ব্যবস্থা রাখেনি। কিন্তু এক পা এগিয়েই থমকে গেল তিতাস। এতক্ষণ ধরে যে সাহস সে দেখাচ্ছিল তা কর্পূরের মতো উবে গিয়ে তাকে জাপটে ধরল তীব্র শ্বাসরোধকারী এক ভয়। মনে পড়ে গেল ভাদুড়ি মশায়ের তৃতীয় সাবধানবাণীটি, মেয়েটিকে সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে ওই পিশাচ। তার নজর এড়িয়ে মেয়েটির কাছ পর্যন্ত যাওয়া কার্যত অসম্ভব। যদিও তিতাস কোনও দিন গেনুকে দেখেনি তবু শুনে শুনে তার মনে কঙ্গোর আদিম বামন উপজাতির পিশাচটির যে ছবি আঁকা আছে তা বীভৎস। হঠাতই একটা সম্ভাবনা তাকে আরও অসাড় করে তুলল। সে শুনেছে, গেনু বাচ্চা মেয়েদের মতো গলায় কথা বলে। তাকে এই অবধি নিয়ে আসা বাচ্চা মেয়েটাই গেনু নয় তো? চমকে মেয়েটার দিকে তাকাল তিতাস। পাকা বুড়িদের মতো মাথায় হাত দিয়ে সে বলে উঠল, ওহ হো! তুমি তো জ্বালালে দেখছি। গেনু রূপ বদলাতে পারে না গো। আমি গেনু নই।

বড় লজ্জিত হল তিতাস কিন্তু ভয়টা তাকে ছাড়ল না। সে ফ্যাকাশে গলায় বলল, কিন্তু গেনু তো পাহারা দিচ্ছে। মিতুলের কাছ অবধি যাব কী করে?

মেয়েটা বলল, গেনুকে আটকানোর ব্যবস্থা করছে আমার দাদা। সে এক জনকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারবে না। তার মধ্যেই দেখে নাও মিতুল দিদি কোথায় আছে। না দেখলে সবাইকে নিয়ে আসবে কেমন করে? সময় নেই গো, সময় নেই।

কাঁপা গলায় তিতাস বলল, আর লোকনাথ বলে লোকটা? সে কোথায়?

কেমন যেন কঠিন শোনাল সেই শিশুকণ্ঠ, সে তো সাধনা করেই গেল! সাধনায় বসেছে। এখন এ দিকে আসবে না।

মেয়েটা এগোতে লাগল কারখানার গেটের দিকে। এই মুহূর্তে তিতাসের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি। আর ভাবার মতো শক্তি নেই তার। যা হয় হবে। যন্ত্রের মতো মেয়েটার পিছুপিছু যেতে শুরু করল তিতাস। কারখানার ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরল মেয়েটা। চারপাশে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে লোহা লক্কড়ের জঙ্গল। দূরে দূরে একটা দু’টো সোডিয়ামের আলো জ্বলছে। সেই আবছা আলোয় হোঁচট খেতে খেতে এগোতে লাগল তিতাস। কিছুটা গিয়ে মেয়েটা থামল। অদূরেই একটা করোগেটেড টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বাটে গোছের ঘর দেখিয়ে বলল, ওখানেই আছে মিতুলদিদি। দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠে ভিতরে নেমে যাও।

চমকে তাকাল তিতাস, তুমি যাবে না?

করুণ মুখে মেয়েটা বলল, না গো। আমরা শুধু দেখিয়ে দিতে পারি। তার বেশি পারি না। আমাদের মাকে আটকে রেখেছে না? মা থাকলে এত কাণ্ড হতেই দিত না।

একটা রাতচরা পাখি ডাকতে ডাকতে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তিতাসকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটা ত্রস্ত গলায় বলে উঠল, যাও গো যাও। গেনু ক্ষেপে উঠেছে ওদিকে। আমি টের পাচ্ছি। তাড়াতাড়ি করো।

দ্রুত পায়ে গোডাউনের দিকে এগিয়ে গেল তিতাস। দেওয়ালের ইট বেরিয়ে আছে। সেগুলো বেয়ে উঠে যেতে খুব একটা অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কোমরে একটা ব্যথা হচ্ছে। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে দেওয়াল বাইতে শুরু করল তিতাস। তার পর ছাউনির ফাঁক গলে লাফ দিল ভিতরে। মোবাইলের টর্চ জ্বালাল। ওই তো… ওই তো মিতুল… তাকে দেখতে পেয়েছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। তিতাস বলে উঠল, ভয় নেই মিতুল। আমি তোমার বাবার বন্ধু।

তিতাস জানতেও পারল না, গোডাউন থেকে কিছুটা দূরেই এখন গেনুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে একটা অবাধ্য ছেলে। যার নাম কইমাছ সমীর।

. . .

কারখানাটা দেখেই চমকে উঠেছিল সমীর, আরে এ তো সেই কারখানাটা! যেখানে বছর চারেক আগে কাতান দিয়ে তার বুক পেট চিরে দিয়েছিল চারটে ছেলে। কেউ জানে না, এমনকী গুরুকেও সে কোনও দিন বলেনি, এই কারখানার মাটিতেই সে নিজে হাতে পুঁতে রেখেছে ওই চার জনের লাশ। সমীর জানে না, পিচাশের লাশ ফেলা যায় কি না! তবু সে চেষ্টা করবে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুই ঠিক জানিস তো গেনু এখানেই আছে?

ঘাড় নেড়ে ছেলেটা বলেছিল, সোজা হেঁটে যাও ভিতরের দিকে। গেনু নিজেই তোমাকে খুঁজে নেবে।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসেছিল সমীর, থ্যাঙ্ক ইউ হাফটিকিট। যদি ফিরে আসি তোকে দাদাবৌদির বিরিয়ানি খাওয়াব।

পা টেনে টেনে কারখানার গেটের দিকে এগিয়ে গেছিল সমীর। এ কারখানার অন্ধিসন্ধি তার হাতের তালুর মতো চেনা। সোজা এগিয়ে গেলে মেশিনঘর। ওখান থেকে বাঁ দিকে টার্ন নিলে গোডাউন। কল বসানো লোহার রডটা শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটছিল সে। অপেক্ষা করছিল সেই পচা গন্ধটার জন্য।

কিছুটা এগোতেই একটা রাতচরা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে আর তখনই গন্ধটা পেল সমীর। মনে মনে বলল, এসে গেছে গন্ধমারানির পুত।

দু’পায়ের ফাঁকে রডটা চেপে ধরে পকেট থেকে রুমালটা বার করে সমীর নাক মুখ ঢেকে নিল। গুরুর সাথে থেকে থেকে সেন্টের গন্ধের আদত হয়ে গেছে। এই ঝাঁটের গন্ধে প্রবলেম হবে। রুমালটা বেঁধে মুখ তুলতেই সমীর দেখতে পেল, কিছুটা দূরেই একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গেনু। রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকা না থাকলে গেনু দেখতে পেত, সমীরের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে মুচকি হাসি।

মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় গেনু বলল, কে তুই? ঢুকলি কী করে এখানে?

এর পর যা ঘটল তা গেনুর অভিজ্ঞতায় ছিল না। এত দিন পর্যন্ত সবাই তাকে দেখে ভয় পেয়েছে। হাড় হিম করা ভয়। এই প্রথম কেউ ভয় পেল না। উল্টে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠল, চিনলি না আমায়? তোর বাপ রে কুত্তার বাচ্চা।

তীব্র হিংসায় গেনুর গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। পাঁশুটে সবুজ রঙের মণি দু’টো জ্বলে উঠল ধ্বকধ্বক করে। তীব্র কণ্ঠে সে বলে উঠল, তোর মরণের ভয় নাই?

আবারও অবাক হল গেনু। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ছেলেটা বলল, না বে মাদারচোদ। আজ তোর হিসেব নিতে এসেছি।

বলেই, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, চিতা বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে উঠে কল সমেত রডটা সে আমূল বিঁধিয়ে দিল গেনুর দন্তহীন মুখগহবরে। রডটা মুখ দিয়ে ঢুকে গলা ফুঁড়ে পেছন দিক দিয়ে খানিকটা বেরিয়ে রইল। মুখের কাছে ঝুলে রইল কলটা। কোনও সাধারণ মানুষ তাকে আঘাত করতে পারে এটা বিশ্বাস করতে গেনুর যতটুকু সময় লাগল তার মধ্যেই সমীর বলে উঠল, গুরুর চোখ নিয়েছিলি, তোর মুখ নিলাম।

তার পর প্রচণ্ড এক চড় মারল গেনুর কানের জায়গাটায়। মট করে একটা শব্দ হল। একটা তীব্র বেদনা ছড়িয়ে পড়ল সমীরের সারা শরীর জুড়ে। সমীর বুঝতে পারল, তার হাতটা কনুইয়ের কাছ থেকে ভেঙে ঝুলছে একটা লতানে গাছের মতো। হাঁটু দিয়ে গেনুর পেটে লাথিটা মারতে চাইল সে। কিন্তু লাথিটা গেনুর গায়ে লাগল না। শূন্যে কেটে গেল। টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ল সমীর। বোধ হয় কটা দাঁত ভেঙে গেল। থু থু করে রক্তমাখা দাঁতগুলো বাইরে ফেলে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল সমীর। যদিও চোখের দৃষ্টি ঝাপসা তবু ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল, গেনু এখন তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে রডটা টেনে শরীরের বাইরে বার করে আনল গেনু। দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটা। ধাতব কিছুতে ধাক্কা খেয়ে টং করে একটা তীক্ষ্ন শব্দ হল আর শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বাঁকানো কালো নখ দিয়ে সমীরের শরীরটা দু’আধখানা করে চিরে ফেলল সে। দু’টো টুকরো আলাদা হয়ে পড়ে রইল দু’দিকে।

খিলখিল করে হেসে উঠল গেনু আর তার পর দীর্ঘ কালো খসখসে জিভটা দিয়ে চেটে নিল ছিটকে এসে মুখে লাগা সমীরের রক্ত।

১৪

সমীরের দু’টুকরো হয়ে যাওয়া দেহটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে লোকনাথ।

মাটিতে থইথই করছে রক্ত। সাপের মতো কিলবিলে হয়ে পড়ে রয়েছে সুদীর্ঘ অন্ত্র। বাঁকানো নখ দিয়ে টেনে টেনে সেগুলোকেই এক জায়গায় করছিল গেনু। কখনও নখে বিঁধিয়েই মুখে পুরে দিচ্ছিল তুলনামূলক ছোট টুকরোগুলিকে। আবেশে বুঝে আসছিল ক্ষুদ্র হিংস্র চোখ দু’টি। গম্ভীর গলায় লোকনাথ ডেকে উঠল, গেনু।

প্রভুর ডাকে মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠল পোষ্য পিশাচটি। টাটকা, তাজা মানুষের অন্ত্রের মতো সুস্বাদু খাদ্যের টান অগ্রাহ্য করেও উঠে এল। থপথপ করে এসে দাঁড়াল লোকনাথের পাশে, কত্তা।

সন্দিগ্ধ গলায় লোকনাথ বলল, এ কী করে এখানে ঢুকেছিল জানিস?

গেনু বলল, না কত্তা। আমি তো মেয়েটারে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম এ আগায়ে আসছে।

গম্ভীর গলায় শুধু একটা হুঁ, বলল লোকনাথ কিন্তু তার মনের মধ্যে ঘনিয়ে উঠতে লাগল সংশয়। মন্ত্র পড়ে এ জায়গাটার বাঁধন দিয়েছিল সে। কোনও মানুষের পক্ষে তো এমনি এমনি এ জায়গায় ঢুকে আসা সম্ভব না। এ রাস্তা জানত একমাত্র ধনা কিন্তু তাকেও তো মেরে ফেলেছে সে। তা হলে? এ অসম্ভব সম্ভব হল কী করে? অস্থির হয়ে উঠল লোকনাথ। ক্রুদ্ধ শার্দূলের মতো পায়চারি করতে লাগল হাত দু’টোকে পেছনে ভাঁজ করে। প্রভুর চঞ্চলতা দেখে একটু অবাক হল গেনু কিন্তু যেচে প্রশ্ন করার হুকুম নেই। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল প্রভুর পরবর্তী প্রশ্ন বা আদেশের অপেক্ষায়। যদিও বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে টাটকা অন্ত্রগুলির দিকে। তবু লোভ সংবরণ করল সে। এমন সময় লোকনাথ আবার বলে উঠল, শুধু এ একাই এসেছিল না সঙ্গে আর কেউ ছিল?

আহত হল গেনু। তার ওপর কি কত্তার ভরসা নাই? ঈষৎ অভিমানী গলায় সে বলল, যদি আর কেউ আসত তারেও তো এখানেই দেখতে পেতেন কত্তা। এ ভাবে রক্তে মাটি ভিজায়ে আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকত।

মাথা নাড়ল লোকনাথ, তা বটে। ছেলেটি কী ভাবে ঢুকেছে গেনু জানে না কিন্তু বিনা অনুমতিতে প্রভুর সাধনক্ষেত্রে প্রবেশ করার সমুচিত শাস্তি সে দিয়েছে এই মানবসন্তানটিকে। একটা গাছের নীচে ধপ করে বসে পড়ল লোকনাথ। মাথা নেড়ে বলল, মনটা বড্ড অস্থির করছে রে গেনু। রাত পোহালেই সূর্যগ্রহণ। সাধনার চরম ক্ষণ। যত বার এ সাধনা আমি করতে গেছি তত বার বাধা পেয়েছি। এ বারই সব ঠিক ঠিক হচ্ছিল কিন্তু শেষ বেলায় ফের এক ফোঁটা চোনা পড়ে গেল।

প্রভু তাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছেন। এ বার আর উত্তর দিতে বাধা নেই। গেনু বলল, এর হিসাব তো চুকায়ে দিছি কত্তা। তবে আর চিন্তা কী?

দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে লোকনাথ বলল, সব হিসেব কি আর এত সহজে চোকে রে? এ ছেলে নিজে থেকে এখানে ঢোকেনি। আমার মন বলছে, এর পেছনে অন্য কোনও ঘটনা কাজ করছে। আমার তো শত্তুরের অভাব নাই। এখানেই এক বুড়ো ভাম আছে। আমার গুরু। ঠিক করেছিলাম সাধনা শেষ হলে গুরুদক্ষিণাটা দিয়ে আসব। সে কোনও কলকাঠি নাড়ল না তো? কিন্তু নাহ! আমি তো খবর নিয়েই এসেছি, বহুদিন হল সে রক্তাম্বর পরা ছেড়ে দিয়েছে। এ সবের সাথে তার আর কোনও যোগাযোগ নাই। তবে? তবে আমার পেছুতে লাগল কোন আবাগির ব্যাটা?

কথাটা বলে ফেলেই স্তব্ধ হয়ে গেল লোকনাথ। চোখ দু’টো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন কোনও দিশা দেখতে পেয়েছে। তার পরেই আচমকা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই নিজের মাথায় চড় মেরে বলল, কী বোকা আমি, কী বোকা! এমন নিরেট মাথা যার তার মাথায় যেন কাক শালিকে হাগে। আবাগির ব্যাটার কথা ভাবতে ভাবতে আবাগিটার কথাই তো ভুলে গেছি। আমার সবচেয়ে বড় শত্তুর। আমার বউ। ধম্মপত্নী।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকনাথ। একটু আগের শিথিলতা মুছে গিয়ে তার শরীরী ভাষা এখন ইস্পাতকঠিন, শাণিত। প্রতিহিংসায় কম্পিত। গলায় এক রাশ ঘেন্না ঢেলে বলল, চিরকাল জ্বালিয়ে খেলে মাগি। ও হল জাত সাপ। ওরে ঢিল দেওয়া আমার উচিত হয়নি। সে বারও ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম। আমার যাত্রা ভঙ্গ করতে নিজের গলায় ফাঁস দিতে অবধি দু’বার ভাবেনি। এ বারও বন্ধ করেছি, তার মধ্যে থেকেই আমার বিরুদ্ধে কাঠি করতে শুরু করেছে। আজ ও মাগির এক দিন কী আমার এক দিন।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল লোকনাথ। টাটকা অন্ত্রগুলির দিকে এক বার মনমরা হয়ে তাকিয়ে শেষমেশ প্রভুকেই অনুসরণ করল পিশাচটি। একটা গুমটি মতো ঘরের সামনে এসে লোকনাথ থামল। এক লাথি মেরে খুলে দিল ঘরের দরজা। ঘরের মধ্যে থরে থরে সাজানো পুজোর নানা উপকরণ। একটা ছোট মাটির জালায় হাত ঢুকিয়ে তুলে নিল এক মুঠো কালো সর্ষে। তুলে নিল চারটি তির কাঠি। সুতোর আন্ডিল থেকে ছিঁড়ে নিল খানিকটা লাল সুতো। তার পর এগিয়ে গেল ঘরের কোণে রাখা একটা কাঠের বাক্সের দিকে। বাক্সের ডালা খুলে বার করে আনল লম্বা হলদেটে শুকনো লাঠির মতো একটা জিনিস। লম্বায় জিনিসটা বড় জোর এক হাত। ডাক্তারি ছাত্ররা দেখলে বুঝতে পারত ওটা কোনও লাঠি নয়, মানুষের পায়ের একটা হাড়। যার পোশাকি নাম ‘ফিবুলা’। খুব ভাল চোখ যাদের তারা হয়তো বলে দিতে পারত, এ হাড় কোনও পুরুষের নয়, নারীর। তবে এ হাড় দেখে কেউই যেটা বুঝতে পারত না সেটা হল, এ হাড়টি সংগ্রহ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কর্কট রাশিতে জন্ম, সাত মাসের গর্ভবতী মেয়েকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার পর অপেক্ষা করতে হয়েছে যত দিন না দেহটি কঙ্কালে পরিণত হয়। তার পর আষাঢ় মাসের অমাবস্যার রাতে গিয়ে কালো বেড়ালের থাবার সাহায্যে কবর খুঁড়ে তুলে আনতে হয়েছে কঙ্কালটি এবং বিশেষ পদ্ধতিতে শোধন করার পর তবেই এ হাড়টি খুলে নেওয়া হয়েছে। দেখতে নিরীহ এই হাড়টি আসলে অতীব শক্তিধর একটি আয়ুধ। কিন্তু এ জিনিস বড়ই দুর্লভ। প্রায় কেউ জানেই না এমন জিনিস হয় বলে। লোকনাথও কি জানত যদি না ভাদুড়ি বুড়ো বিশ্বাস করে তার খাতাগুলো লোকনাথের হাতে তুলে দিত! সুদূর পর্তুগালের একটি গোপন সঙ্ঘ শয়তানকে নিজেদের সন্তান রূপে কল্পনা করে। তাদেরই তন্ত্রে ব্যবহৃত হয় এই ‘বিশেষ’ ফিবুলা।

জিনিসগুলো নিয়ে ঘর থেকে বাইরেটায় বেরিয়ে এল লোকনাথ। প্রথমেই হাড়টি দিয়ে মাটিতে একটা বর্গক্ষেত্র আঁকল। তার চার কোণে পুতে দিল চারটি তির কাঠি। লাল সুতো বেঁধে দিল তাদের সাথে। যেন একটা ঘেরাটোপ তৈরি করল সে। বর্গক্ষেত্রের মাঝখানে ছিটিয়ে দিল মুঠো করে আনা কালো সর্ষে। তার পর বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল বিজাতীয় এক মন্ত্র। ঠিক তিন বার মন্ত্রটা আওড়াল লোকনাথ তার পর এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। সরু, ফাঁপা হাড়টির একটা দিক বাঁশির মতো করে ধরল মুখের সামনে। ফুঁ দিল তাতে। শিসের মতো অথচ অদ্ভুত সুরেলা এক আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল বায়ুমণ্ডলে। সে সুর জোরাল নয় কিন্তু তার মধ্যে যেন জমা হয়ে আছে শত সহস্র যুগের হাহাকার। সেই বুকফাটা আকুতিতে স্তব্ধ হয়ে যেতে লাগল সমস্ত চরাচর। হাড় বাজাতে বাজাতে সাপের ফনার মতো দুলতে লাগল লোকনাথ এবং এক সময় দেখা গেল বর্গক্ষেত্রের চার কোণের চারটি তির কাঠিতে কাঁপন ধরেছে। ছড়িয়ে থাকা সর্যেগুলো যেন সেই সুরের মোহে ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে আসছে পরস্পরের প্রতি। এক সময় সেগুলি এক জায়গায় এসে জড়ো হল আর তাতে দপ করে জ্বলে উঠল প্রোজ্জ্বল, দ্যুতিময় নীলাভ সবুজ এক শিখা। সুরের সাথে সাথে শিখাটিও যেন কাঁপছে। যন্ত্রণায় দীর্ণ হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই শিখাটিই একটি অবয়ব ধারণ করতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণ পর দেখা গেল বর্গক্ষেত্রটির মাঝে হাঁটু মুড়ে বসে আছে এক শীর্ণকায়া দীর্ঘাঙ্গী। খোলা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। জলে ভরা দুই চোখে তীব্র ঘৃণা নিয়ে সে তাকিয়ে আছে লোকনাথের দিকে। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে সে আর কান্নার কম্পনে ঠোঁট দু’টি ঈষৎ ফাঁক হলে দেখা যাচ্ছে, মাত্র কয়েকটি দাঁত অযত্নলালিত ভাঙা বেড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে এ দিক, ও দিক। তারা যেন মুখ গহ্বরের শূন্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুনে।