নিকষছায়া – ১

খাবারের প্লেটটা এক ঝটকায় খানিকটা ঠেলে সরিয়ে বারাসাত থানার এস আই অমিয় বোস বললেন, এগুলো রুটি না গন্ডারের চামড়া? ছিঁড়তে গিয়ে আঙুল খুলে যাচ্ছে।

এ এস আই দীপক পাল হেসে বললেন, এ কথা শুনলে তারক কিন্তু লজ্জায় গলায় দড়ি দেবে স্যার। ওর এমন বদনাম আজ অবধি কেউ করেনি। দোষটা রুটির নয়। সময়ের। ঘড়ি দেখেছেন? দেড়টা বাজে। ন’টার সময় খাবার দিয়ে গেছে। এতক্ষণ সময় পেলে তো বাখরখানিও শক্ত হয়ে যাবে স্যার।

বিরক্তির ভাবটা কেটে গেল অমিয়র। সত্যিই তো, বেচারা তারকের আর দোষ কী? রাত দেড়টায় কোন ভদ্রলোকের ছেলে ডিনার করে! অবশ্য পুলিশের চাকরিতে সবই সম্ভব। একটা ফালতু পারিবারিক ঝগড়ার কেস মেটাতে এত রাত হয়ে গেল।

থানার উল্টো ফুটে তারকের রুটি তড়কার দোকান। খাবার ভালই বানায় ছেলেটা। নাইট ডিউটি থাকলে এখান থেকেই রুটি, তড়কা, ওমলেট আনিয়ে নেন অমিয়। কোনও কোনও দিন হরিতলার মোড়ের একটা দোকান থেকে বিরিয়ানি। তবে রাতে ভাত খেলে চোখ জড়িয়ে আসে তাই অমিয় রুটিটাই প্রেফার করেন। তাঁর মতে নাইট হোক বা ডে, ডিউটিটা ডিউটির মতোই করা উচিত। তাই গভীর রাতে যখন থানার অফিস ঘরের নানা প্রান্ত থেকে মৃদু ও জোরাল নাসিকাধ্বনি শোনা যায় তখনও সটান বসে থাকেন অমিয়। কখনও কানে ইয়ারফোন গুঁজে বই পড়েন। কখনও বা পুরনো কেসের ফাইলপত্তর খুলে নোটস নিতে থাকেন। নাইট ডিউটিতেও ঠায় জেগে থাকেন বলে সহকর্মীদের মধ্যে খানিক অসন্তোষ আছে অমিয়কে নিয়ে। অমিয় সেটা জানেন আর মনে মনে হাসেন। ল্যাজকাটা শেয়ালের দল ল্যাজওয়ালা শেয়াল দেখলেই ভড়কায়। এ দুনিয়ার নিয়ম। অমিয় ও সবে পাত্তা দেন না। তবে হ্যাঁ, আরও একজন আছেন যাঁকে নাইট ডিউটিতে আজ অবধি দু’চোখের পাতা এক করতে দেখেননি অমিয়। এ এস আই দীপক পাল। অমিয়ই বরং দু’একবার বলেছেন, শুয়ে পড়ুন না পালদা। দরকার হলে আমি তুলে দেব।

উত্তরে এক হাত জিভ কেটে দীপক পাল বলেছেন, ছি ছি স্যার! ডিউটি করতে এসে শোবো কী? অস্থানে কুস্থানে শুতে গেলে পয়সা খরচ করতে হয়। সরকার বাহাদুর নিশ্চয়ই আমায় সে জন্য পয়সা দেন না। বদ রসিকতা করলাম, কিছু মনে করলেন না তো? আসলে আমরা বাঙাল তো স্যার, যতটা নিই ততটা উসুল করে দেওয়ার চেষ্টা করি।

দীপক পাল মানুষটিকে ভারী ভাল লাগে অমিয়র। সোজাসাপটা লোক, কোনও প্যাঁচঘোঁচ নেই। সারাক্ষণ হাসিমুখে ঘুরে বেড়ান এবং সততার জন্য ডিপার্টমেন্টে রীতিমতো বদনাম আছে। অত্যন্ত সচেতনভাবে দীপক পাল দুটি জিনিস খান না। মদ এবং ঘুষ। হাসতে হাসতেই বলেন, ঘুষ খাই না বলে অনেকের অনেক অসুবিধে হয় আমি বুঝি। কিন্তু কী জানেন তো স্যার, ঘুষের পয়সা ফুস।

অমিয় জিগ্যেস করেছিলেন, কোনও দিন ঘুষ নেননি?

দীপক পাল বলেছিলেন, আপনাকে আমি ভালবাসি। আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আপনাকে মিথ্যে বলব না। এক বার খেয়েছিলাম জানেন। তা ধরুন আজ থেকে বছর পনেরো আগের কথা।

এত আগের কথা মনে আছে এখনও?

থাকবে না? যা কাণ্ড হয়েছিল! আমার মেয়ে মিতুল তখন ছোট। সামনেই পাঁচ বছরের জন্মদিন। খুব ইচ্ছে ছিল ঘটা করে ওর জন্মদিন করব। অত দিন আগে কেমন মাইনে পেতাম বুঝতেই তো পারছেন স্যার। টাকা পয়সার টানাটানি লেগেই থাকত। তা সে সময় হেলাবটতলার কাছে একটা গাঁজা ভর্তি লরি ধরলাম। নগদ তিরিশ হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিল হেল্পার ছেলেটা। লোভ সামলাতে পারলাম না।

অমিয় হাসে, তার পর? হল মেয়ের জন্মদিন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দীপক পাল, আর জন্মদিন! জন্মদিনের দিন দুয়েক আগে মিতুলের গালে একটা ফুসকুড়ি হল। বাচ্চা মেয়ে, না বুঝে গেলে দিল ফুসকুড়িটা। বিশ্বাস করবেন না স্যার, সেই যে মুখ থেকে ফোলা শুরু হল এই ডান দিকের বগল অবধি ফুলে ঢোল। সেই সঙ্গে তাড়সে জ্বর। মেয়ে আমার মর মর। হাসপাতালে ভর্তি করতে হল শেষমেশ। বারো দিন পর মেয়ে সুস্থ হল কিন্তু আমার ষাট হাজার টাকা খসে গেল। সেই থেকে ভয় পেয়ে গেছি স্যার। আমি কর্মফলে খুব বিশ্বাস করি। এ জন্মের পাপ এ জন্মেই চুকিয়ে যেতে হয়। তাই ও সব থেকে দূরে থাকি।

মনটা ভাল হয়ে গেছিল অমিয়র। বারাসাত থানায় বদলি হয়ে এসে যদি কিছু প্রাপ্তি হয়ে থাকে তা হলে এই মানুষটা। বলেছিলেন, আপনাকে কত বার বলেছি আমাকে স্যার স্যার করবেন না? নাম ধরে ডাকবেন।

ফের জিভ কেটেছিলেন দীপক পাল, ছি ছি। তা কী করে হয়? আপনি যে আমার বস।

তা হলে এই যে বললেন, ছোট ভাইয়ের মতো ভালবাসি।

সে তো বাসিই। আপনি আমার থেকে অন্তত বিশ বছরের ছোট।

ভাইকে কেউ স্যার বলে?

একটু হেসে দীপক পাল বলেছিলেন, স্যার, আমার বাবা আমার মাকে মিঠু বলে ডাকতেন। আমিও তাই শুনে শুনে চিরকাল মাকে মিঠু ডেকে এসেছি। আমার মুখে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য হয়নি আমার মায়ের। কিন্তু তা বলে কি মাকে আমি কম ভালবেসেছি? ও সব ডাকে কিছু এসে যায় না স্যার। তা ছাড়া ডেকোরাম মেনটেইন করাই ভাল। আমি আপনাকে নাম ধরে ডাকতেই পারি কিন্তু তাতে অনেকের চোখ টাটাবে। ২৮ বছর ধরে এই থানায় আছি, সবচেয়ে নিচু পোস্টে ঢুকেছিলাম। সেখান থেকে আজ এ এস আই। ওরা আমার একটাও ঘাস ছিঁড়তে পারবে না। কিন্তু আপনার পেছনে কাঠি দেবে।

গম্ভীর হয়ে অমিয় বলেছিলেন, বেশ। যেটা আপনার ইচ্ছে। তবে একটা কথা আপনাকে স্পষ্ট বলে দিতে চাই।

অমিয়র বলার ধরনে একটু থতিয়ে গেছিলেন দীপক পাল। বুঝতে পারছিলেন না অমিয় বিরক্ত হয়েছেন কি না। ইতস্তত করে বলেছিলেন, কী কথা স্যার?

আমাকে নাম ধরে ডাকতে না পারেন অসুবিধে নেই কিন্তু আমার সামনে বাল আর পোঁদকে নাম ধরেই ডাকুন। ঘাস আর পেছন বলে ম্যানেজ দিতে হবে না।

হো হো করে হেসে উঠেছিলেন দীপক পাল। বলেছিলেন, ষোড়ষ বর্ষ প্রাপ্তেষু পুত্র মিত্র বদাচরেত। সেখানে আপনি তো ছোট ভাই। চলুন আপনাকে সিগারেট খাওয়াই।

সেই থেকে দীপক পাল হয়ে গেছিলেন অমিয়র পালদা। অমিয়র সরিয়ে দেওয়া প্লেটটা তুলে টেবিলের নীচে রাখতে রাখতে দীপক পাল বললেন, উঠুন স্যার।

অমিয় হাঁ হাঁ করে উঠলেন, আরে! আপনি আমার এঁটো প্লেটে হাত দিলেন কেন?

ধুর। ছাড়ুন ও সব। উঠুন। টুপি পরুন।

অমিয় অবাক, কেন? বেরবেন না কি?

দীপক পাল বললেন, আপনার তো খাওয়া হল না। আমারও খিদে খিদে পাচ্ছে। চলুন, জেলা হাসপাতালের সামনে থেকে ঘুরে আসি। ওখানে গরম গরম ডিম টোস্ট আর ঘুগনি পাওয়া যাবে। ফাঁকতলে একটা টহলও দেওয়া হয়ে যাবে।

চলুন তবে।

থানার বাইরে বেরিয়ে এলেন অমিয় আর দীপক পাল। সেপ্টেম্বরের শেষ দিক। রাতের দিকে বাতাসে হিম পড়ে। দীপক পাল পাতলা একটা উইন্ডচিটার গায়ে দিয়েছেন। অমিয়কে বললেন, গায়ে হালকা কিছু একটা দিলে পারতেন।

নাহ। ঠিক আছে। আমি চালাই?

চালান।

দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসেন অমিয়। জিপ চালাতে ভারী ভাল লাগে তাঁর। ছোট থেকেই জিপের প্রতি তাঁর অদ্ভুত কৌতূহল ছিল। মনে হতো, আর সব গাড়ির থেকে এই গাড়িটা আলাদা। কী যেন একটা টান আছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় দেখেছিলেন, মেইন বিল্ডিং-এর শেষ দিকে হেয়ার স্কুলের মাঠের লোহার বেড়ার গায়ে একটা পুরনো জিপ দাঁড় করানো থাকত। শুনেছিলেন, ওটা জিওলজি ডিপার্টমেন্টের জিপ। বহুদিন অব্যবহারে নষ্ট হয়ে গেছে। এক বার সেই পুরনো জিপে উঠতে গিয়েই বোলতার কামড় খেয়েছিলেন। ভেতরে বোলতার চাক হয়েছিল। আজ স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়েই সে কথা মনে পড়ে হাসি পেয়ে গেল অমিয়র।

দীপক পাল বলে উঠলেন, পুরনো কথা মনে পড়ছে বুঝি?

ক্লাচ ছেড়ে এক্সিলারেটর দাবিয়ে গাড়িটা খানিকটা এগিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকালেন অমিয়, কী করে বুঝলেন?

মৃদু হাসলেন দীপক পাল, ও বোঝা যায় স্যার। পুরনো কথা মনে পড়ে ঠোঁটের কোণে যে আলতো হাসি জাগে তা থেকে সুন্দর গন্ধ বেরোয়। নস্টালজিয়ার মায়াবী একটা গন্ধ আছে, পুরনো বইয়ের মতো। সিন্দুকে রাখা ঠাকমার শাড়ির মতো।

ভারী সুন্দর বললেন তো পালদা। ঠিক বলেছেন, নস্টালজিয়ার একটা মায়াবী গন্ধ আছে।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যান অমিয়। বারাসাতের রাস্তাগুলি সুন্দর। সোডিয়ামের হলুদ আলোয় প্রোজ্বল। তাঁর মনে পড়ে যায় প্রেসিডেন্সি কলেজের কথা। কলেজেও সন্ধেবেলাগুলো ছিল এমন হলুদ আলোয় ধোওয়া। ছিল কোয়াড্র্যোঙ্গেলে আড্ডা, ছিল হিন্দু হস্টেলের ছাদে রাত জেগে গান, গল্প। সঞ্জয়, পল্লব আর সুপ্রতিমের সাথে ভাগ করে বেঁচে থাকা। কোথায় হারিয়ে গেল সে সব দিন! একটা বিচ্ছিরি ভুল বোঝাবুঝি এতটাই দূরত্ব তৈরি করে দিল যে আজ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অবধি নেই।

স্যার, সামনে থেকে ডান দিকে।

চমক ভাঙল দীপক পালের কথায়। দীপক পাল বললেন, অলরেডি দু’টো রাস্তা ছেড়ে দিয়েছেন। এ বার ডান দিক না নিলে অনেকটা ঘুরে আসতে হবে।

একটু লজ্জা পেলেন অমিয়। পুরোনো দিনের কথা ভাবতে গিয়ে রাস্তা গুলিয়ে ফেলা মোটেই কাজের কথা নয়। ফিফথ গিয়ারে ফেলে গাড়ির স্পিড তুলে দেন সত্তরে। হু হু করে জিপটা ছুটতে থাকে রাতের ফাঁকা রাস্তা ধরে।

কিন্তু কিছুটা গিয়েই স্পিড কমাতে বাধ্য হলেন অমিয়। জেলা হাসপাতালের গেটের কাছে জটলাটা এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। ভুরু কুঁচকে গেল অমিয়র, কী ব্যাপার বলুন তো পালদা? এত ভিড় কীসের?

দীপক পাল বললেন, আজকাল তো পেশেন্ট মরলেই ডাক্তারদের ধরে প্যাঁদায়। সে রকম কিছু না তো? চলুন গিয়ে দেখি। ওহ হো! হাঙ্গামা করার আর সময় পেলি না বাপ!

পুলিশের উর্দি দেখেই ভিড়টা একটু পাতলা হয়ে এল। সরুন, সরুন বলে হাঁক পেড়ে ভিড়ের নিউক্লিয়াসে ঢুকে পড়লেন অমিয় আর দীপক পাল। ভিড়ের মাঝখানে মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে একটা লোক। ভয়ে সে থরথর করে কাঁপছে। চোখ দুটো করমচার মতো লাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রীতিমতো নেশা করেছে। জামাটা কাঁধের কাছে ছেঁড়া দেখে এটাও বোঝা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে পাবলিকের চড় থাপ্পড় খেয়েছে। হাসপাতালের দু’চার জন গার্ডও ছিল ভিড়ের মধ্যে। দীপক পাল তাদেরই জিগ্যেস করলেন, ব্যাপারটা কী?

তারা কিছু বলার আগেই ছিটকে এগিয়ে এল একটা রোগা মতো লোক। কান্না আর রাগ একসাথে গলায় আটকে গেলে যেমন আওয়াজ বেরনোর কথা তেমন গলায় লোকটা হাঁউমাউ করে বলে উঠল, আমার বোনের বডি সরিয়েছে এই জানোয়ারটা।

অনেক হইহল্লা চেঁচামেচির পর যা বোঝা গেল তাতে বেশ একটু অবাক হলেন অমিয়। যে লোকটিকে পাবলিক চড় থাপ্পড় দিয়েছে তার নাম বিশে। সে হাসপাতাল মর্গের ডোম। অভিযোগটা তার বিরুদ্ধেই। ঘটনাটা হল, আজ রাত আটটা নাগাদ নমিতা বিশ্বাস নামে একটি বছর চব্বিশের মেয়ে এক্সপায়ার করে। মেয়েটি গতকাল বিষ খেয়েছিল। চার ঘণ্টা পর তার বডি পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালের মর্গেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন পোস্টমর্টেমের জন্য এই একটিই বডি এসেছিল মর্গে। সে বডি টেবিলে রেখেছিল এই বিশে ডোম। কিন্তু ডাক্তার গিয়ে দেখেন, টেবিলে বডি নেই আর বিশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরচ্ছে। অনেক খুঁজেও বডিটা পাওয়া যায়নি এবং বিশে অসংলগ্ন কথা বলছে। বাড়ির লোকের সন্দেহ, বিশেই বডিটা পাচার করেছে। তাই তাকে ধরে থানাতেই নিয়ে যাচ্ছিল তারা।

বিশের সামনে গিয়ে ধমকে ওঠেন দীপক পাল, এই বিশে, বডিটা কোথায় সত্যি করে বল।

কেঁদে উঠে মাটিতে আছড়ে পড়ে বিশে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, আজ বারো বচ্ছর আমি এই লাইনে স্যার। জীবনে কোনও দিন বডি নিয়ে ধুনচুন করিনি। বিশ্বাস না হয় স্যার, ম্যাডামদের জিগ্যেস করে দেখবেন। আমি কিছু করিনি স্যার। ও বডি পিচাশে নিয়ে গেছে।

চমকে ওঠেন অমিয়। এক ধমক দেন দীপক পাল, মদের ঘোরে কী আলফাল বকছিস?

ফের কাঁদে বিশে, মদের ঘোরে আমি ভুল দেখব না স্যার। আমি পাঁচ বছর বয়েস থেকে মদ খাই। সত্যি ও বডি পিচাশে নিয়ে গেছে। আমি আর এই মর্গে কাজ করব না স্যার। আমাকে বাঁচান।

আবার একটা ধমক দিতে যাচ্ছিলেন দীপক পাল। হাতের চাপে তাঁকে নিরস্ত করে বিশের সামনে মাটিতে উবু হয়ে বসেন অমিয়। শান্ত গলায় বলেন, না কেঁদে ঠিক করে বলো তো কী হয়েছে?

পুলিশের শান্ত গলায় ভাল কাজ হয়। চোখ মুছে উঠে বসে বিশে। হাত বাড়িয়ে বলে, একটু জল দেবেন স্যার?

জল খেয়ে ধাতস্থ হয়ে বিশে বলল, বডি কাটার কথা ছিল দেড়টা নাগাদ। আমি তার একটু আগেই ঢুকি। গিয়ে দেখি ভিতরটা অন্ধকার। আমার ধন্দ লেগেছিল স্যার। বাইরে তো আলো জ্বলছে। তা হলে? দেশলাই জ্বালাতেই আমি চমকে উঠলাম। আবছা আলোয় দেখলাম, একটা খুব মোটা আর খুব বেঁটে লোক বডিটা কাঁধে করে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, এই হারামির বাচ্চা! তখনই লোকটা আমার দিকে ঘুরে তাকাল স্যার, এই অবধি বলেই যেন ভয়ে শিউরে উঠল বিশে।

অমিয় বলেন, কী হল? থামলে কেন? বলো।

বিশে বলল, লোকটা আমার দিকে তাকাতেই আমি দেখলাম লোকটা টেকো। নাক আর কান বলতে কিছু নেই। চোখদুটো এত ছোট যে দেখাই যায় না। আর লোকটা পুরো ফোকলা। একটাও দাঁত নেই স্যার। অনেকক্ষণ থেকেই একটা পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি আজ বিশ বচ্ছর পচা মড়া ঘাঁটছি। পচা গন্ধ আমার গা সওয়া। কিন্তু এই গন্ধটা যেন জাহান্নাম থেকে উঠে আসছিল বিশ্বাস করুন। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম আর তখনই মেয়েছেলের মতো রিনরিনে গলায় লোকটা আমায় বলল, বিরক্ত করিস না। দেহখান আমার লাগবে।

এইটুকু বলেই ফের জ্ঞান হারাল বিশে। ধড়াস করে উল্টে পড়ল রাস্তার ওপর।

ভোর চারটের সময় ফোন বেজে উঠলে কার না মাথা গরম হয়! চোখ না খুলেই হাতড়ে হাতড়ে ফোনটাকে সাইলেন্ট করে দিল পল্লব। রাত আড়াইটে অবধি লেখালিখি করে সবে শুতে গেছে সে। সদর দরজা পেরিয়ে ঘুম এখন এসে বসেছে বৈঠকখানায়। পাখার হাওয়ায় শুকিয়ে নিচ্ছে ঘাম। তৃপ্তির চুমুক দিচ্ছে আমপান্নার সরবতে। এর পর স্নান সেরে খেতে বসবে। এ অবস্থায় ফোন বাজা মানে ঘুমের হাত থেকে আমপান্নার সরবত কেড়ে নেওয়া। কিন্তু যে বেরসিক ভোর চারটেয় ফোন করতে পারে তার কোনও ভরসা নেই। আর একবার ফোন করলেই দফা শেষ। ঘুম অপমানিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। তাই পল্লব সিদ্ধান্ত নিল, ফোনটা সুইচড অফ করে দিতে হবে। কোনও মতে চোখ খুলে সবে পাওয়ার বাটনটায় হাত রেখেছে ঠিক তখনই দ্বিতীয় বার বেজে উঠল ফোন আর স্ক্রিনে নামটা দেখে অবাক হয়ে গেল পল্লব। সঞ্জয় এই অসময়ে! আগের বারের ফোনটাও কি তবে সঞ্জয়ই করেছিল? কিন্তু কেন? সঞ্জয় আজ পর্যন্ত পল্লবের দেখা সবচেয়ে রেসপনসিবল মানুষ। সে তো জানে, পল্লব গভীর রাত অবধি লেখালিখি করে। তবে কি সঞ্জয়ের কোনও বিপদ হল? ঘুম উড়ে গেল চোখ থেকে। চিন্তিত গলায় পল্লব ফোন ধরল, হ্যালো, কী হয়েছে? এনিথিং রং?

সঞ্জয় বরাবরের ধীরস্থির মানুষ। কম কথা বলত বলে হিন্দু হস্টেলের বোর্ডাররা তাকে মৌনীবাবা বলে ক্ষ্যাপাত। সেই সঞ্জয়ের গলাতেই আজ খানিক ছটফটানি। সে বলল, তুই কোথায়?

পল্লব অবাক হল, কোথায় মানে? বাড়িতে। এত ভোরে তো আর শুটিং শুরু হয় না।

সঞ্জয় যেন একটু নিশ্চিন্ত হল, যাক। আমি আবার ভাবছিলাম যদি তুই আউটডোরে গিয়ে থাকিস মুশকিল হবে।

আমার আউটডোরে যাওয়ার সাথে তোর কী?

অনেক কিছু। আমি এখন দমদম এয়ারপোর্টে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তোর বাড়ি আসছি।

চমকে উঠল পল্লব, দমদম এয়ারপোর্টে মানে? হপ্তাখানেক আগেও যখন কথা হল তুই তো আসার ব্যাপারে কিছু বলিসনি। কী ব্যাপার বল তো?

তুই উঠে ফ্রেশ হ। এসে সব বলছি, ফোন রেখে দিল সঞ্জয়।

এ বার যেন আরও বেশি করে চিন্তায় পড়ে গেল পল্লব। সঞ্জয় মুম্বইতে থাকে। মুম্বই আইআইটি-তে ফিজিক্স পড়ায়। একাবোকা মানুষ। কলেজের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শুধু পল্লবের সাথেই তার যোগাযোগ আছে। পল্লব বহু বার বলেছে, ছুটিছাটায় আমার এখান থেকে ঘুরে যা। কিছু না হোক অন্তত পুজোর সময় ক’ দিন এসে থাক। সঞ্জয় রাজি হয়নি। গত চার বছরে পল্লবই বরং বার ছয়েক ঘুরে এসেছে সঞ্জয়ের কাছ থেকে। আরও দু’বার শুটিং-এর কাজে মুম্বই যেতে হয়েছিল সেই দু’বারও প্রোডাকশন হাউজের দেওয়া হোটেলে না থেকে সঞ্জয়ের কাছে উঠেছিল পল্লব। কিন্তু হাজার উপরোধেও এম.এস.সি শেষ করার পর আর কলকাতায় আসেনি সঞ্জয়। তাই হঠাৎ করে কিছু না জানিয়ে সঞ্জয়ের কলকাতায় আসা ব্যাপারটা যতটা বিস্ময়কর তার চেয়েও বেশি চমকপ্রদ।

সঞ্জয়কে দেখেই চমকে উঠল পল্লব। গত সপ্তাহেই ভিডিও কলে কথা হয়েছিল। সেই সঞ্জয়ের সাথে এই সঞ্জয়ের আকাশপাতাল পার্থক্য। মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো। চোখ দু’টোয় রাত জাগার গভীর ক্লান্তি। ঠোঁট ফেটে গেছে কিন্তু তাতে ক্রিম লাগানো হয়নি আর মুখখানা অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাশে। কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে মুখের সমস্ত লাবণ্য শুষে নিয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শেষ কয়েকটা দিন এমন কোনও বিষয় সঞ্জয়কে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে যা মোটেই অভিপ্রেত নয়। পল্লব কিছু বলার আগেই সঞ্জয় বলল, অনেক কথা আছে। সব বলব বলেই এসেছি। কিন্তু তার আগে একটু ঘুমোব। আমি তিন রাত ঘুমোইনি। আর শোন, আমি যখন ঘুমোব তুই আমার কাছে কাছে থাকিস তো। বেশি দূরে যাবি না। আমাকে চোখের আড়াল করবি না, কেমন?

সঞ্জয়ের কথায় পল্লবের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এক একটা কথা শুনতে খুব সাধারণ কিন্তু তার অভিঘাত অনেকখানি। সে কাঁপা গলায় বলল, এ ভাবে বলছিস কেন তুই? কী হয়েছে সত্যি করে বল তো।

সঞ্জয় বলল, একা থাকতে আমার ভয় করে। তাও যতক্ষণ জেগে আছি ঠিক আছে কিন্তু চোখ বুজলেই ভয়টা আমার শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ে পল্লব। সমস্ত শিরা উপশিরা জুড়ে একটা বিশাল কালো ভল্লুকের মতো থপথপ করে ঘুরে বেড়ায় সেই ভয়। আমি তার পদধ্বনি শুনি বুকের ভেতর। যেন সে আমার হৃৎপিণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমাগত। এ ভাবে ঘুম হয় বল? তাই তোর চোখের সামনে আমি একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই।

বড় অসহায় লাগে সঞ্জয়ের গলাটা। পল্লব অস্থির হয়ে পড়ে মনে মনে। সঞ্জয় শক্ত ধাতের ছেলে। জীবনে অনেক ওঠাপড়া দেখেছে। সাধারণ মানুষের জীবনে যে ধরনের অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার থেকে অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা রয়েছে সঞ্জয়ের। তা হলে কীসে এমন ভয় পেল সে যা তাকে চোখ বুজতে দিচ্ছে না! তবু অস্থিরতা চেপে পল্লব বলল, বেশ। হাত পা ধুয়ে আয়। আমি চা বসাচ্ছি। চা খেয়ে ঘুমোবি। আমি তো আছি। তোর কোনও চিন্তা নেই।

চা খেতে খেতেই ঢুলে পড়ছিল সঞ্জয়। পল্লব বলল, ঘরে গিয়ে শুবি চল।

বিছানায় শুয়ে পল্লবের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে সঞ্জয় বলল, তিন দিন পর মনে হচ্ছে আজ ঘুমটা হবে বুঝলি? আমি ঘুমোচ্ছি দেখে উঠে চলে যাবি না তো ভাই? না তোকে বিশ্বাস নেই। আমার হাত ধরে রাখ।

শিশু যে ভাবে মায়ের হাত আঁকড়ে ঘুমোয় ঠিক সে ভাবে পল্লবের হাতটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে চোখ বুজল সঞ্জয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিশ্বাস পড়তে শুরু করল তার। আর ঠায় বসে থেকে একটাই কথা ভাবতে লাগল পল্লব, এ কোন আদিম নিকষছায়া যার শীতলতায় এমন কুৎসিত ভাবে শুকিয়ে মরে আত্মবিশ্বাস!

কষের দাঁত বরাবর গালের ফাঁকে খৈনিটা গুঁজে দিয়ে সমীর বলল, যাই বলো গুরু, বড়লোকেরা কিন্তু আসলে হেবি গরীব। মাথাফাতা হেবি ঝাক মেরে ঢেকে রেখেছে কিন্তু পোঁদে কাপড় নেই। যার পোঁদ উদলা তার আর কী আছে বলো?

টাকি রোড ধরে মাঝারি গতিতে ছুটছে গাড়িটা। এ গাড়ির পোশাকি নাম স্বর্গরথ। মৃতদেহকে শ্মশান অবধি পৌঁছে দেওয়াই এ গাড়ির কাজ। গাড়িটা আজ খুব করে সাজানো হয়েছে। মোটা মোটা রজঃনীগন্ধার মালা। এত্ত রজঃনীগন্ধার স্টিক। গাদা খানেক ধূপকাঠি জ্বলছে। উল্টোদিকে হাওয়া তবু সে সুবাস নাকে এসে লাগছে মতিউরের। প্রথম প্রথম এই সব ফুল, অগুরু, সেন্ট আর ধূপকাঠির মিশ্র গন্ধে মতিউরের গা গুলোত। কিন্তু এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। বরং আজকাল এ গন্ধটা ভালই লাগে তার। কোনও কোনও পার্টি থাকে বিরাট চিন্দি। ধূপকাঠিতেও পয়সা বাঁচাতে চায়। এক প্যাকেট ধূপকাঠিতে কাজ সারে। মতিউর তখন নিজেই আরও দু’প্যাকেট ধূপ এনে জ্বালিয়ে দেয়। আহা রে, শেষবেলায় যাচ্ছে, একটু ভাল করে যাক। বাবার একটা কথা খুব মনে পড়ে মতিউরের। বাবা হাসপাতালের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ ছিল। রোগীদের গু, মুত, কফ, রক্ত, পুঁজ পরিষ্কার করত। কিন্তু কোনও দিন মানুষটার মধ্যে কোনও গ্লানি দেখেনি মতিউর। বাবা মনে করত, রোগীর সেবা করা পুণ্যের কাজ। বলত, জিন্দেগি হ্যায় তো গন্দগি হ্যায়। যতক্ষণ বেঁচে আছ ততক্ষণই তো মল-মূত্র, কফ, ক্যাথিটার, বেডপ্যান। মরে গেলে আর কিচ্ছু নেই। মুর্দার সব কিছুই সাফসুতরা। মৃতদেহের জন্য আছে শুধু কাফন আর সুগন্ধী।

তাই মতিউর চায় না, কারও শেষ যাত্রায় সুগন্ধীর অভাব হোক। গত সাত বছর ধরে সে স্বর্গরথই চালাচ্ছে। নিজেকে সে ড্রাইভার বলে না। বলে, সারথি। সমীর আজ বছর তিনেক তার সাথে। মতিউর একদিন বলেছিল, হ্যাঁ রে, সমীর, ড্রাইভারের তো হেল্পার থাকে কিন্তু আমি তো ড্রাইভার নই। রথের সারথি। তা হলে তুই আমার কী?

মাথা চুলকে সমীর বলেছিল, কী বলি বলো তো গুরু? একটা নাম মাথায় আসছে বটে কিন্তু প্রবলেম আছে।

কী প্রবলেম?

আমার তো আর বুকটুক নেই, থাকলে আমি হতাম তোমার ডরোথি। আমাদের পাড়ায় এই নামে একটা খ্রিষ্টান মেয়েছেলে আছে গুরু। হেবি ডবকা। কাতলা মাছের মতো চেহারা। তুমি সারথি, আমি তোমার ডরোথি।

নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠেছিল সমীর। চোখ পাকিয়েছিল মতিউর, বাজে কথা বলতে মানা করেছি না তোকে?

জিভ কেটে সমীর বলেছিল, চেষ্টা করি গুরু। মাইরি বলছি। কিন্তু মুখ থেকে আপসেই বেরিয়ে যায়। আসলে জন্মের পর থেকে খিস্তি শুনছি তো। ওটাই আমার মাতৃভাষা।

মানুষের উচিত তার মাতৃভাষা নিয়ে গর্বিত হওয়া। কিন্তু সমীরের সে সুবিধে নেই। এ ভাষাটি বড়ই শ্রুতিকটু। অনেক বলেও মতিউর শোধরাতে পারেনি সমীরকে। তবে হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে, এই ক’ বছরে সমীর আগের থেকে অনেক পাল্টে গেছে।

বছর চারেক আগে খুব অদ্ভুত ভাবে সমীরের সাথে দেখা হয়েছিল মতিউরের। এ রকমই একটা রাতে শ্মশানে বডি নামিয়ে একাই ফিরছিল মতিউর। হেল্পার ছেলেটা তখন ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। ময়না ক্রস করার পরই রাস্তার ওপর একটা বাম্পার। গাড়ি স্লো করতেই বেশ ভারী কিছু একটা আছড়ে পড়ল গাড়ির পেছন দিকে আর তখনই পাশের পরিত্যক্ত কারখানাটার ভেতর থেকে হইহই করে ছুটে বেরল কয়েকটা ছেলে। চেঁচাতে লাগল, ধর, ধর। ছেলেগুলোর হাবভাব ভাল ঠেকল না মতিউরের। স্পিড বাড়িয়ে হু হু করে পেরিয়ে এল জায়গাটা। থামল এসে একেবারে কলোনি মোড়ে। খুব ভারী কিছু ছুঁড়েছে গাড়িটায় লুচ্চাগুলো। ভেঙেচুরে গেছে নির্ঘাৎ। নেমে গাড়ির পেছনটা দেখতে গিয়ে চমকে উঠল মতিউর। এত অবাক সে বহুকাল হয়নি। হাতে পায়ে ধরে গাড়ির পেছন দিকের রড আঁকড়ে ঝুলছে একটা ছেলে। খালি গা, পরনে ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট। ডান দিকে বগলের নীচ থেকে কোমরের ওপর অবধি একটা টানা লম্বা গভীর ক্ষত। সেখান থেকে এত রক্ত বেরিয়েছে যে ছেলেটার সারা গা প্রায় লাল হয়ে আছে। এখনও রক্তপাত হয়ে চলেছে। অমন অদ্ভুত ভাবে ঝুলতে দেখে মতিউর প্রথমটা ভেবেছিল ছেলেটা বুঝি মরে গেছে। কিন্তু কাছে যেতেই চোখ খুলল ছেলেটা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে যা বলল তাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মতিউর। ছেলেটা বলল, দেখছিস কী শুওরের নাতি? হাসপাতালে নিয়ে চল।

‘কই মাছের প্রাণ’ কথাটা বইতে পড়েছিল মতিউর। সমীরকে দেখে সম্যক অর্থটা বুঝতে পারল সে। সমীরের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন বারাসাত জেলা হাসপাতালের এমার্জেন্সির ডাক্তাররা। যে ধারাল অস্ত্রটা দিয়ে সমীরকে আঘাত করা হয়েছে তার ফলাটা প্রায় দু’ইঞ্চি ভেতর অবধি গেছে এবং সেই টানে সমীরের অন্ত্রের ডানদিকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। গভীর আঘাত লেগেছে কিডনিতেও। মতিউরের সাথে সাথে ডাক্তাররাও অবাক হয়েছিলেন, এই পেশেন্ট এখনও বেঁচে আছে আছে কী করে! শুধু তাই নয়, পেশেন্টের সেন্স আছে। ডাক্তাররা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সমীরের সামনে। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তাঁদের সম্বিত ফিরেছিল সমীরেরই মাতৃভাষায়, দেখছিস কী? নতুন বউয়ের থোবড়া না কি বে! অপারেশন কর!

হাসপাতালে নিয়ে আসা থেকে অপারেশন, সবকটা পদক্ষেপই সমীর বলে দিয়েছিল পর পর। তার ভাষা শুনে ওই অবস্থাতেও হেসে ফেলেছিলেন এক ডাক্তার। বলেছিলেন, কই মাছের প্রাণ! এ ব্যাটা বেঁচে যাবে।

বেঁচে গেছিল সমীর। বারো দিন যমে মানুষে টানাটানির পর এবং চার মাস বিছানায় শুয়ে থাকার পর এক দিন উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। খুঁজে খুঁজে মতিউরের বাড়ি চলে এসেছিল এবং মতিউরের হাত ধরে বলেছিল, আমি তোমার কেনা গোলাম গুরু। শুধু তুমি না, আরও একজন আছে। যে ম্যাডাম আমার অপারেশন করেছিল, তুমি তো জানো, তিতাস ম্যাডাম। তোমরা দুজনে আমায় নতুন জন্ম দিয়েছ শালা। তোমরা আমার বাপ মা।

সেই থেকেই মতিউরের সাথে থেকে গেল সমীর। প্রচণ্ড রগচটা, অকুতোভয়, মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ… এর আড়ালে সমীরের আর একটা চেহারা লুকিয়েছিল। সেই মানুষটা অকাতরে প্রাণ দিতে পারে ভালবাসার মানুষের জন্য। কৃতজ্ঞতা শব্দটা হয়তো বানান করতে পারবে না সমীর কিন্তু তার প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে এর অর্থ অনুধাবন করেছে সে। লুকিয়ে থাকা এই সমীরকে আবিষ্কার করেছিল মতিউর এবং বাজে অভ্যেসগুলো সংশোধনের চেষ্টা করেছিল। হ্যাঁ, ফল হয়েছে। সমীর আগে রোজ দেড় লিটার মদ খেত। এখন হপ্তায় দু’এক দিন। তাও মতিউরের অনুমতি নিয়ে। আগে কথায় কথায় হাত চালাত সমীর। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে। তবে ওই যে, মাতৃভাষা-মাতৃদুগ্ধ। সেটা ত্যাগ করতে পারেনি।

তা আজও সমীরের মুখে পোঁদ উদলা কথাটা শুনে হাসি পেয়ে গেল মতিউরের। হাসি চেপে সে বলল, হঠাৎ এ কথা বললি কেন? কী দেখে মনে হল তোর বড়লোকেরা হেবি গরিব?

সমীর বলল, আরে বুঝতে পারলে না? এই যে লোকটা মরেছে সে যে হেবি বড়লোক তা নিয়ে তোমার সন্দেহ আছে? কেমন আলিশান বাড়ি! বাড়ির লোকেরা যে দু’টো গাড়িতে করে যাচ্ছে সে দু’টোও তো ঘ্যামা। কিন্তু দেখো, বডির সাথে একটাও বাড়ির লোক উঠল না। আমরা মড়া পোড়াতে যাই তাসাফাসা বাজিয়ে। যত চেনাশোনা সবাই চলে আসে। সবাই কাঁদে। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু কেউ মরে গেলে তাকে এ ভাবে একা ছেড়ে দিই না। সে জন্যই বলছি, বড়লোকেরা আসলে গরিব-এর অধম। ওদের কাছে সম্পক্কের ভ্যালু নেই। কারও সাথে কারও আঠা নেই।

চুপ করে থাকে মতিউর। এ কথার উত্তর নেই। সমীর যা বলছে তা সে সমর্থন করে না কিন্তু এটাও সত্যি বড়লোকেদের সবটাই কেমন চাপা চাপা। কান্না বা ভালবাসা কি অত মেপেজুপে হয়! সত্যিই এটা ঠিক না, বাড়ির একটা লোক অন্তত গাড়িতে উঠতে পারত। খইয়ের প্যাকেটটা অবধি সমীরের হাতে ধরিয়ে দিল। সমীর বলল, কী হল গুরু? চুপ করে গেলে যে! কথাটা ভুল বললাম?

মতিউর কিছু বলতে যাবে তার আগেই গন্ধটা পেয়ে গা গুলিয়ে উঠল তার। কোথা থেকে যেন একটা তীব্র পচা গন্ধ আসছে! মুখটা ঘেন্নায় কুঁচকে সমীর বলল, পাচ্ছ গুরু?

মতিউর মাথা নাড়ল, আশেপাশে কিছু পচেছে।

ধ্যাত। বিশটা মড়া একসাথে পচলে এমন গন্ধ বেরোয়। মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ছিঃ। কাচ তুলে দিচ্ছি।

রাস্তাটা সোজা গিয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। রাস্তার আলো জ্বলছে না। যেটুকু দেখা যাচ্ছে সে হেডলাইটের আলোয়। বাঁক নিয়েই চমকে উঠল মতিউর। আলো যত দূরে গেলে তার পৌরুষ হারিয়ে যায় ঠিক ততটা দূরেই রাস্তার ওপর কী যেন একটা পড়ে রয়েছে। আবছা আলোয় দেখে মনে হচ্ছে একটা বড় বস্তা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে গাড়ি থামিয়ে দিল মতিউর, ওটা কী বল তো সমীর?

নাকে হাত চেপে সমীর বলল, বুঝতে পারছি না। বস্তাফস্তা হবে। গন্ধটা মনে হচ্ছে ওটা থেকেই আসছে। দাঁড়াও তো দেখি।

দরজা খুলে নামতে যেতেই খপ করে সমীরের হাত চেপে ধরল মতিউর, খবরদার নামবি না।

হেসে উঠল সমীর, এত ভয় পাও কেন বলো তো? কিচ্ছু হবে না।

সমীরের অভয়বাণীতে কাজ হল না। ভুরু কুঁচকেই রইল মতিউরের। বলল, ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না রে। হঠাৎ করে কেউ মাঝরাস্তায় এমন বস্তা বসিয়ে রেখে যাবে কেন!

আরে বাবা, হয়তো কোনও লরিফরি থেকে মাল পড়ে গেছে। যাদের বাড়ির বডি তাদের দু’টো গাড়ি তো আমাদের আগে আগেই ছিল। তারাও বেরিয়ে গেছে। তেমন কিছু হলে জ্যাম হয়ে যেত। যাক গে, বলছ যখন নামছি না, তুমি সাইড কাটিয়ে বেরিয়ে যাও।

ফের স্টার্ট দিল মতিউর। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল গাড়িটাকে। যত এগোচ্ছে গন্ধটা বাড়ছে। নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না ভাল করে। গন্ধটা যেন বাতাসের গলা টিপে ধরেছে। কিছুটা এগোতেই নড়ে উঠল বস্তাটা এবং হেডলাইটের আলোয় মতিউর আর সমীর এমন কিছু দেখল যা তারা আগে কখনও দেখেনি। ওরা বুঝতে পারল, যেটাকে এতক্ষণ ওরা বস্তা ভেবে ভুল করছিল সেটা একটা লোক। যেমন বেঁটে, তেমনই মোটা। লোকটার পরনে ধুতির মতো কী একটা জড়ানো। মাথায় একটাও চুল নেই। বেশ অনেকটা কাছে চলে এসেছিল গাড়িটা। আচমকাই হেডলাইটটা দপদপ করতে লাগল। সেই বিক্ষিপ্ত আলোর মধ্যে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল ওদের দিকে। তীব্র পচা গন্ধটা একশোগুণ হয়ে ঝাপটা মারল ওদের নাকে আর ওরা দেখল, লোকটার নাক, কান বলতে কিচ্ছু নেই। আর এত ছোট চোখ যে চোখ আছে বলে বোঝাই যেত না যদি না তার মধ্যে স্থির হয়ে জ্বলে থাকত পাঁশুটে সবুজ রঙের মণি দু’টো। এমন অদ্ভুত ভয়ানক কদাকার মানুষ জীবনে দেখেনি সমীর। সে বলেই ফেলল, এই শালা দানবটা কি মানুষ!

লোকটা ততক্ষণে থপথপ করে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে গাড়ির দিকে। বহু কাল এমন ভয় পায়নি মতিউর। ভয়টা যেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছিল। সে চাইছিল ভয় না পেতে। একটা অদ্ভুত দর্শন লোক দেখে এত ভয় পাবারই বা কী আছে! কিন্তু সে বাধ্য হচ্ছিল ভয় পেতে। ভয় পাওয়া ছাড়া যেন দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। যেন এই মুহূর্তে একমাত্র সত্য দমবন্ধ করে দেওয়া ভয়। সমীরের মতো অকুতোভয় মানুষও কেমন যেন চুপ করে গেছে। ইতিমধ্যে লোকটা এগিয়ে এসেছে গাড়ির আরও কাছে। হঠাৎ অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল মতিউর। প্রাণপণে চেপে ধরল অ্যাক্সিলারেটর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটা সশব্দে আছড়ে পড়ল লোকটার ওপর। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোনও সংঘর্ষ হল না! লোকটা যেন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

থরথর করে কাঁপতে লাগল মতিউর। অস্ফুটে বলতে লাগল, গেল কোথায় লোকটা? গেল কোথায়? মানুষ কখনও মিলিয়ে যায় না কি!

তখনই একটা রিনরিনে মেয়ে গলা বলে উঠল, মিলাইনি। আছি তো।

এক সাথে চমকে উঠল মতিউর আর সমীর। গাড়ির মধ্যে মেয়ে এল কোথা থেকে! কয়েক মুহূর্তের জন্য পচা গন্ধটা উধাও হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সেটা ফিরে এসেছে তীব্রতম ভাবে। প্রচণ্ড ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল মতিউর, কে? কে কথা বলল?

ঠিক তার কানের কাছে সেই মেয়ে গলাটা বলে উঠল, আমি। আমি গেনু।

চমকে উঠে পেছন ফিরতেই ভয়ে জমে গেল মতিউর। সেই কদাকার লোকটা বসে আছে সিটের পেছনে। মেয়েদের মতো গলায় খিলখিল করে হাসছে আর… আর একটাও দাঁত নেই লোকটার। মুখগহ্বরের মধ্যে অসীম অনন্ত অন্ধকার। সেখান থেকেই উঠে আসছে নরকের দুর্গন্ধ। কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল মতিউর। ঘটনার অভিঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল সমীরও। সে অনেক কিছু দেখেছে এই জীবনে কিন্তু এমন অবিশ্বাস্য কিছু দেখেনি। লোকটা আবার মেয়েদের মতো গলায় বলল, গেনুরে চাপা দিবার পারবা না। গেনুর মরণ নাই।

মতিউরের শিথিল হাত থেকে স্টিয়ারিং খসে গেছে কখন তার খেয়ালও নেই। সাড় ফিরল যখন গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল রাস্তার ধারের একটা গাছে। কয়েক মুহূর্তের তীব্র যন্ত্রণা। তার পর সব অন্ধকার। সমীর বুঝতে পারল, গাড়ির ড্যাশবোর্ডটা তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। পাঁজরের হাড়গুলো মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে। সে শব্দ পাচ্ছে সমীর। কিন্তু বেদনাবোধকে অগ্রাহ্য করে একটাই কথা তার মাথায় ঘুরতে লাগল, মরে গেলে চলবে না। কিছুতেই না।

. . .

থানার বাথরুম থেকেই ফোনের রিং শুনতে পেয়েছিলেন অমিয়। পুরনো দিনের ল্যান্ডফোন। পাড়া জাগিয়ে বাজে। যখন বেরিয়ে এলেন, ফোনের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দীপক পাল। অমিয় বললেন, কী ব্যাপার পালদা?

গলা ঝেড়ে দীপক পাল বললেন, টাকি রোডে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে স্যার। আপনাকে যেতে হবে আমার সাথে।

অবাক হলেন অমিয়, সাধারণ এক্সিডেন্ট কেস দীপক পাল একাই সামলে নেন। অমিয়কে ইন্টারফেয়ার করতে হয় না। তা হলে আজ কী বড় কিছু! প্রশ্নসূচক চোখে তাকাতেই দীপক পাল বললেন, পাতি এক্সিডেন্ট হল আপনাকে বলতাম না স্যার। ডেডবডি নিয়ে যাওয়ার গাড়ি, গাছে ধাক্কা মেরেছে। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। গাছের একটা ডাল চোখ ফুঁড়ে মাথার ঘিলু নিয়ে বেরিয়ে গেছে। হেল্পারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে হয় না বাঁচবে। তবে…

থেমে গেলেন দীপক পাল। অমিয় বললেন, তবে?

ডেডবডিটা মিসিং স্যার।

টানা আঠেরো ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সঞ্জয়। সকাল ছটা নাগাদ ঘুমিয়েছিল, উঠল রাত বারোটায়। উঠেই বলল, খুব খিদে পেয়েছে। খেতে দে পল্লব।

ঘুম থেকে ওঠার পর সঞ্জয়কে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। পল্লব বলল, খাবার রেডি আছে। বসে পড়।

খেতে খেতেই সঞ্জয় বলল, খুব জ্বালাচ্ছি, না রে?

বাজে বকিস না। মাছের ঝোলটা আমি রেঁধেছি। ভাল হয়েছে?

খুউব। কত দিন পর তোর হাতের রান্না খেলাম। মনে আছে হোস্টেলে থাকতে তুই রান্না করতিস?

মনে থাকবে না? ওই তো আমার রান্নায় হাতেখড়ি।

ওহ সেই ঝিঙে আলুর ঝোলটা। ওটা পেলে আমি এখনও এক থালা ভাত খেয়ে নিতে পারি।

খাওয়াব। কদিন তো আছিস। মাঝে মাঝে রাঁধব। রান্না করতে তো আমার ভালই লাগে কিন্তু একার জন্য আর হয়ে ওঠে না।

একটু থমকে গেল সঞ্জয়, তিতাস আর একেবারেই আসে না?

হেসে ফেলল পল্লব, আর ক’বার এই প্রশ্নটা করবি সঞ্জয়? যখনই কথা হয় ঠিক এক বার না এক বার এটা জিগ্যেস করিস। কত বার বলব, তিন বছর হয়ে গেল তিতাসের সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই?

হুম, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সঞ্জয়।

সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে পল্লব বলল, আমি জানি কেন তুই বারবার এই প্রশ্নটা করিস। তুই যতই চাস, তিতাস আর ফিরবে না। আমাদের দু’জনের প্রায়োরিটিগুলো আলাদা। এই ভাল হয়েছে।

তুই চাস না তিতাস ফিরে আসুক?

এক একটা প্রশ্ন থাকে যার উত্তর নিশ্চিত ভাবে মানুষের জানা কিন্তু মানুষ কিছুতেই সে উত্তরটা দিয়ে উঠতে পারে না। তখন সে প্রশ্নকর্তাকে মিথ্যে বলে। সবার আগে নিজেকে মিথ্যে বলে। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। একটু চুপ করে থেকে পল্লব বলল, জানি না। বাদ দে এ সব। পুরনো কথা ডিপ টিউবওয়েলের মতো। জলের পাইপ গভীর থেকে আরও গভীরে যেতে থাকে। একবার শুরু হলে আর শেষ হবে না সঞ্জয়। তুই খাওয়া শেষ কর। কী জন্য এ ভাবে তড়িঘড়ি ছুটে এলি, কীসে ভয় পাচ্ছিস সবটা আমায় খুলে বল।

এক মুহূর্তের জন্য সঞ্জয়ের চোখে সেই অস্থিরতা ফুটে উঠল। তার পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। বলব বলেই তো আসা।

সেপ্টেম্বর মাস। রাতের দিকে একটু গা শিরশির করে। ফ্যানের রেগুলেটর এক ঘাট কমিয়ে সিগারেট ধরিয়ে সঞ্জয়ের মুখোমুখি বসল পল্লব। ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সঞ্জয় বলল, বড় আলোটা জ্বেলে দে তো। আজকাল একটু অন্ধকার হলেই কেমন গা ছমছম করে!

কথা না বাড়িয়ে আলো জ্বেলে দিল পল্লব, এ বার ঠিক আছে?

সঞ্জয় বলল, হ্যাঁ। আর তুই আছিস তো। অতটাও অসুবিধে হচ্ছে না। একা থাকলেই বেশি ভয় করে।

পল্লব বলল, ভয় করে সেটা আমি আগেও শুনেছি। কিন্তু কেন ভয় করে? তোর মতো ছেলে কেন এত ভয় পাচ্ছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।

সেকেন্ড পাঁচেক নীরবতার পর সঞ্জয় বলল, গেনু আর আসে না পল্লব। প্রায় এক মাস হয়ে গেল আমি আর গেনুর উপস্থিতি টের পাইনি।

কথাটা হজম করতে একটু সময় লাগল পল্লবের। তার পরেই সে লাফিয়ে উঠল, এ তো ভাল খবর সঞ্জয়। খুব ভাল খবর। এত ভাল খবর আমি বাপের জন্মে শুনিনি। এমন খবর পেলে পার্টি করতে হয়, গরিবকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে হয়, প্রেমিকাকে অবধি বলে ফেলা যায়, যা সিমরন জি লে আপনি জিন্দেগি… সেখানে তুই ভয় পাচ্ছিস? ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিস! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

একটানা এতগুলো কথা বলে দম নিল পল্লব। অবশ্য পল্লবের এই উচ্ছ্বাসের কারণ খুব সঙ্গত। গেনু নামটির সাথে ওদের চার বন্ধুর ভয়াবহ এক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে এক দিন রাতে হিন্দু হস্টেলের ছাদে তর্ক জমে উঠেছিল অমিয় আর সুপ্রতিমের মধ্যে। তর্কের বিষয় ছিল ভূত আছে কি নেই। তখনই সঞ্জয় ওদের থামিয়ে দিয়ে নিজের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। বলেছিল, তার মামা তাকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছিল বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানেই তাকে সর্বক্ষণের জন্য নজরবন্দি করে রেখেছিল এই গেনু। শেষমেশ সঞ্জয়ের মামি নিজের প্রাণ বলি দিয়ে সঞ্জয়কে উদ্ধার করেন মামা ও গেনুর কবল থেকে। হিন্দু হস্টেলের ছাদে বসে মরা চাঁদের আলোয় এ ঘটনা শুনতে শুনতে শিউরে উঠেছিল পল্লবরা। গল্প শেষ করে সঞ্জয় বলেছিল, গেনু না কি আজও আসে এবং ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করে কিন্তু প্রতিবারই মামি ওকে সাবধান করে দেয়। অমিয় এবং পল্লব এ কথা বিশ্বাস করলেও বিশ্বাস করতে চায়নি সুপ্রতিম। সে গোটা ঘটনাটাকেই সঞ্জয়ের মনগড়া বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তখনই ঘটেছিল সেই ভয়াবহ হৃদয়বিদারক ঘটনাটা। সুপ্রতিম কথাগুলো বলছিল ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কাঁপা গলায় সঞ্জয় বলেছিল, ছাদের ধার থেকে সরে আয় প্রতিম। মামি তোকে সরে আসতে বলছে।

যথারীতি সে কথায় কান দেয়নি সুপ্রতিম এবং পরক্ষণেই অদৃশ্য কিছুর ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিল ছাদ থেকে। অসহায় হয়ে বসে পল্লবরা সে দিন সুপ্রতিমের পতনের শব্দ শুনেছিল আর একটা তীব্র পচা গন্ধে বমি করে দিয়েছিল পল্লব। স্থবির ভাবটা কাটিয়ে উঠে সঞ্জয় ফিসফিস করে বলেছিল, গেনু।

তার পর ছুটে নেমে গেছিল নীচে।

পল্লব আর অমিয় যখন নীচে এসে পৌঁছেছিল ততক্ষণে সুপ্রতিমের দেহ ঘিরে ভিড় করেছে হিন্দু হস্টেলের ছেলেরা। বড় ভয়ানকভাবে পড়েছিল সুপ্রতিম। একটা পিলারের কিছুটা অংশ ঢালাই হওয়ার পর সেখান থেকে লোহার রড বেরিয়েছিল। সেগুলোই সুপ্রতিমের গলা আর বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সুপ্রতিম বেঁচে নেই তবু সবাই মিলে টেনে হিঁচড়ে বডিটা তুলে নিয়ে গেছিল মেডিক্যাল কলেজে। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে। শোকের ছায়া নেমে এসেছিল হিন্দু হস্টেলে। সঞ্জয় একদম চুপ করে গেছিল। মনে মনে সুপ্রতিমের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করছিল। কিন্তু তার পর যে আঘাতটা এসেছিল সেটা একেবারে অপ্রত্যাশিত। আনন্যাচারাল ডেথের তদন্ত করতে পুলিশ এসেছিল হস্টেলে। সেখানেই পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিল অমিয়। বলেছিল, সঞ্জয়ের পোষা ভূত সুপ্রতিমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।

যদিও ভূতের কথা পুলিশ বিশ্বাস করেনি কিন্তু সঞ্জয়কে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছিল বিস্তর। অমিয় সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে শুনে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল পল্লবের। ছুটে গেছিল অমিয়র রুমে। কিন্তু অমিয় দরজা খোলেনি।

সুপ্রতিম ছিল অমিয়র প্রিয়তম বন্ধু কিন্তু তাই বলে সে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানাবে এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি পল্লব। ভাবতে পারেনি সঞ্জয়ও কিন্তু সে নিজেকে ডিফেন্ড করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। পুলিশকে বলেছিল, অমিয় ঠিক বলছে। সুপ্রতিমের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।

সঞ্জয়ের কনফেশনের পর পল্লবের সাক্ষ্যকে পাত্তাই দিতে চায়নি পুলিশ। তারা কেস গোটানোর জন্য মুখিয়ে ছিল। শেষপর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে প্রেসিডেন্সির টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন। সঞ্জয় বরাবরই শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র ছিল। প্রতিভাবান ছাত্রটির এহেন পরিণতি মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। তাঁরা পল্লবের সাক্ষ্যকেই মান্যতা দিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সংসদের সদস্য দু’জন বাঘা ক্রিমিনাল ল-ইয়ার এগিয়ে এসেছিলেন অনুজ সতীর্থকে বাঁচাতে।

বেকসুর খালাস পেয়েছিল সঞ্জয় কিন্তু অমিয়র ঘটনাটা তার মনে তীব্র রেখাপাত করেছিল। সে বরাবরের চাপা স্বভাবের মানুষ কিন্তু পল্লব বুঝতে পেরেছিল সঞ্জয়ের মনে অমিয়র প্রতি এক দুর্লঙ্ঘ্য অভিমানের পাহাড় জমে উঠেছে। অমিয় যদি এসে কথা বলত তা হলে হয়তো মিটেও যেতে পারত ব্যাপারটা। কিন্তু অমিয় আসেনি। সে হস্টেল ছেড়ে তার এক মাসির বাড়িতে চলে গিয়েছিল এবং যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দিয়েছিল। অমিয়র সাবজেক্ট ছিল পলিটিক্যাল সায়েন্স। অন্য বিল্ডিংয়ে ক্লাস হতো। ফলে দেখা হবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না। তাও দু’এক বার ক্যাম্পাসে দেখা হয়েছিল, কিন্তু মুখ নীচু করে দ্রুত পায়ে ওদের এড়িয়ে গেছিল অমিয়। পল্লব বুঝতে পেরেছিল, রাগ নয়, অমিয়র এই পালিয়ে বেড়ানো ওর অপরাধবোধের তাড়নায়। সঞ্জয়কে তো ও-ও ভালবাসত।

কথায় বলে টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। সময়ের সাথে সাথে পুরনো ক্ষত শুকিয়ে আসে। কিন্তু সেই হিলিং প্রসেসের মধ্যেই অজান্তে দুটো মানুষের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব বেড়ে যায়। সে পথ পেরিয়ে ফের কাছে আসা সহজ কথা নয়। তাই ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্ব আর জোড়া লাগল না। মাস্টার্স শেষ করে সঞ্জয় আর কলকাতায় থাকতে চাইল না। পিএইচডি করতে আইআইটি চলে গেল। আর পল্লব ঢুকে পড়ল একটা খবরের কাগজের চাকরিতে। আজ প্রায় সাত-আট বছর অমিয়র সঙ্গে ওদের দুজনের কোনও যোগাযোগ নেই।

তার পরেও কিন্তু সঞ্জয়কে ছাড়েনি গেনু। মাঝে মাঝেই সঞ্জয় তার উপস্থিতি টের পেত এবং যথারীতি মামি তাকে সাবধান করে দিত। সঞ্জয় বলত, গেনুর হাত থেকে আমার মুক্তি নেই।

সেই গেনু আজ এক মাস হল আসছে না, এর থেকে ভাল খবর আর কী হতে পারে!

পল্লবের উচ্ছ্বাস দেখে সঞ্জয় ম্লান হেসে বলল, এখনও বদলালি না পল্লব। পুরোটা না শুনেই হইহই করতে শুরু করেছিস!

অপ্রতিভ হল পল্লব। এ তার বরাবরের সমস্যা। সে শুরুতেই রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। সে জন্য অনেক সমস্যা পোহাতে হয়েছে তাকে। তিতাসও তাকে ছেড়ে চলে গেছে এই বদভ্যাসের জন্যই। লজ্জিত গলায় সে বলল, আসলে এত একসাইটিং ছিল খবরটা তাই সামলাতে পারিনি।

একটু জল খেয়ে সঞ্জয় বলল, আমি তো আজ থেকে এ সব দেখছি না, আর তুই জানিস আমি এমনি ভয় পাওয়ার ছেলে নই। দেখ, গেনু যে সবসময় আসত তা নয়। কিন্তু কখনও একটানা এত দিন আসেনি এমনটা হয়নি।

আচ্ছা, তোর মামি এসেছিলেন?

গম্ভীর হয়ে গেল সঞ্জয়। আবার একটু জল খেল। মুখটা মুছে বলল, এসেছিল। আর সেখানেই তো সমস্যা।

পল্লব অবাক হয়ে গেল, মানে? মামি তো তোর ভাল চান। উনি এলে কী সমস্যা?

সমস্যা আছে পল্লব। নয়তো বলব কেন! এত দিন গেনু না এলে মামি আসত না। মামি আমাকে সবসময় গেনুর থেকে প্রটেক্ট করে এসেছে। কিন্তু তিন দিন আগে ঘটনাটা ঘটল। আমার স্পষ্ট মনে আছে রাতটা।

বলতে গিয়ে যেন শিউরে উঠল সঞ্জয়। দু’হাতে মুখ ঢেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পল্লব উঠে গিয়ে সঞ্জয়ের পাশে বসল, ঠিক আছিস ভাই?

মাথা নাড়ল সঞ্জয়। তার পর মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, তুই তো জানিস আমি আর্লি রাইজার। চেষ্টা করি বাই সাড়ে এগারোটা ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু পরের দিন ছেলেমেয়েদের একটা ক্লাস টেস্ট নেব বলেছিলাম। তারই কোয়েশ্চেন পেপার সেট করছিলাম রাত জেগে। আমি টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছি। শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। এসি চলছিল। ফ্যান বন্ধ। এসির একটা মৃদু গুঞ্জন আর ল্যাপটপের কি-তে মাঝে মাঝে আমার আঙুলের খুটখাট, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। তুই তো দেখেছিস আমার ফ্ল্যাটটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই ভিতরে তাই গাড়ির শব্দ আসে না। আর অত রাতে এমনিও গাড়ি কম চলে। নীচে পাহারাওলা বাঁশি বাজায় আধ ঘণ্টা অন্তর। পর পর তিন বার সে বাঁশি বাজাল। আমি চমকে মুখ তুলে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম দেড়টা বাজে। ভাবছি শুতে যাব তখনই শব্দটা পেলাম। খস খস করে একটা শব্দ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। বেশি করে মাড় দেওয়া কাপড় পরে হাঁটাচলা করলে যেমন শব্দ হয় তেমন। সঙ্গে খুব মৃদু চুড়ির টুংটাং। আমি বুঝতে পারলাম মামি এসেছে। কিন্তু মুহূর্তে আমার সব কটা ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল, মামি কেন এসেছে? তবে কি গেনু আসছে! এত দিন গেনু আসেনি দেখে আমি যে একটু একটু নিশ্চিন্ত হতে শুরু করেছিলাম, আমার সে সুখ কি ফুরোল! চমকে উঠে দাঁড়াতে যাব তার আগেই কাঁধের কাছে শীতল স্পর্শ পেলাম। আমার মাথার মধ্যে ফিসফিস করে ধ্বনিত হল মামির কণ্ঠস্বর। মামি যেন হাঁফাচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে মামি বলল, আমাকে ক্ষমা কোরো। গেনুর শক্তি বাড়বে। আমি হয়তো তাকে আর আটকাতে পারব না। আমাকে টানছে। আমি আর লড়াই করতে পারছি না। সে যা চাইছে তা যদি হয় সর্বনাশ হবে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রলয় আসবে।

আমি ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার থেকে। চিৎকার করে বললাম, কে টানছে তোমায়? কার সাথে লড়াই করতে পারছ না? গেনুর সাথে।

মামি উত্তর দিতে গেল কিন্তু তার আগেই কেউ যেন তার মুখ চেপে ধরল। আমার মাথার মধ্যে ধ্বনিত হতে লাগল মামির গোঙানি। অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় মামি যেন ছটফট করছে। ধীরে ধীরে সেই গোঙানি রূপান্তরিত হল কান্নায়। টানা একঘেয়ে ঘুনঘুনে এক কান্না। আমি কী করব তখন বুঝতে পারছি না। পাগলের মতো চিৎকার করছি, মামি, তুমি কোথায়? কী হয়েছে তোমার? কিন্তু উত্তর পাচ্ছি না। মাথার ভিতর শুধু সেই কান্নার শব্দ। তার পর হঠাৎ…

আচমকা চুপ করে গেল সঞ্জয়। পল্লব ছটফট করে উঠল, থামলি কেন? হঠাত কী?

নিজেকে গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিল সঞ্জয়। বলল, একটা শিসের শব্দ শুনলাম জানিস!

শিস?

হ্যাঁ? অদ্ভুত একটা সুরে কেউ যেন শিস দিচ্ছে। আমার মাথার ভিতর ঢুকে যাচ্ছিল শব্দটা আর ক্রমশই সেটা মামির কান্নার আওয়াজকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। এক সময় মামির কান্নার শব্দ থেমে গেল। শিসটাও থেমে গেল। এ বার কয়েকটা বিক্ষিপ্ত শব্দ। যেন কিছু একটা হেঁচড়ে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যাঁচ করে একটা দরজা খুলে গেল। তার পর আচমকাই একটা মেয়ে প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

সোফার ওপর এলিয়ে পড়ল সঞ্জয়। দরদর করে সে ঘামছে। পল্লব বুঝতে পারল, কথাগুলো বলতে অনেকটা ভয় জয় করতে হয়েছে সঞ্জয়কে। এ তারই ক্লান্তি। দ্রুত উঠে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিল পল্লব। সঞ্জয়ের হাত চেপে ধরে চুপ করে বসে রইল। বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর সঞ্জয় বলে উঠল, সে দিনের পর থেকে যখনই চোখ বুজতে যাই মাথার মধ্যে শব্দগুলো বাজতে শুরু করে। সেই কান্না, সেই শিস, মেয়েটার চিৎকার। খুব ভয় করে পল্লব। কিছুতেই ঘুমোতে পারি না। আমি বুঝতে পারছিলাম, একা থাকলে পাগল হয়ে যাব তাই তোর কাছে চলে এলাম।

পল্লব বলল, তোকে এখন আর যেতেও হবে না। কিন্তু এই শব্দগুলোর মানে কী? আর তোর মামি যে বলেছিলেন, গেনুর শক্তি বাড়বে, প্রলয় হবে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমিও পারছি না আর সেই জন্যই তো ভয় করছে। আমি চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখেছি, নিজেকে নিয়ে ভয় পাই না কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে এই বিপদ আমার একার নয়। এই বিপদ সমষ্টিগত। আমাদের সবার সাথে ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে কিন্তু সেটা কী তার কোনও আন্দাজ পাচ্ছি না।

ঠিকই বলেছিস তুই। তোর মামি যখন তোকে সাবধান করে দিয়েছে তার মানে কিছু তো একটা হবেই। কিন্তু সেই কিছুর সাথে আমরা ফাইট করব কী করে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্জয় বলল, জানি না পল্লব। এ বিপদের চরিত্র সম্পর্কে তো আমরা কিছু জানি না। তাই যতক্ষণ না সে বিপদ আমাদের কারও ওপর আছড়ে পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা কী বল তো, হয়তো এই বিপদের সামনে আমাদের অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণই করতে হবে কারণ আমরা তো মানুষ। মানুষের সাধ্য কী সে গেনুর সাথে লড়বে? বহুদিন আগে একবার রাগের চোটে এত বড় একটা আধলা তুলে ছুড়ে মেরেছিলাম গেনুর দিকে। নেহাতই ছেলেবুদ্ধি, আধলা ইটে কি গেনুর কিছু হয়! তবু মেরেছিলাম। দশ বছরের আমার কাছে সেটাই ছিল সবথেকে জোরাল অস্ত্র। আধলাটা গেনুর গায়ে লাগেইনি। যেন বাতাস কেটে দূরে গিয়ে পড়েছিল। হাসতে হাসতে মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় গেনু একটা কথা বলেছিল। কথাটা আজও আমার কানে বাজে।

তীব্র কৌতূহল নিয়ে পল্লব তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে, কী কথা?

গেনুরে মারবার পারবা না। গেনুর মরণ নাই।