নিকষছায়া – পূর্বকথা

পূর্বকথা

গত চার বছরে এক দিনও হিন্দু হস্টেলে লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু আজ সেই যে দুপুর আড়াইটে নাগাদ কারেন্ট গেছে, এখন রাত বারোটা দশ, আসেনি। পল্লবরা চার জন ছাদে বসেছিল। চার জন বলতে, পল্লব, অমিয়, সুপ্রতিম আর সঞ্জয়। আকাশে একফালি চাঁদ। একফালি চাঁদ খারাপ জিনিস, আলো তো হয়ই না, উল্টে অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে। সেই আলো আঁধারিতে টানা ছাদের মাঝে মাঝে জলের ট্যাঙ্কগুলোকে কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে। রাস্তার পাশেই একটা বিরাট ছাতিম গাছ। দু’টো ডাল ছাদের ওপরে নুয়ে পড়েছে প্রায়। থেকে থেকেই উত্তুরে হাওয়ায় পাতাগুলো কেঁপে উঠছে। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে অমিয় বলল, ‘এই ওয়েদারে ভূতের গল্প না হলে জমে না। তোরা কেউ ভূত দেখেছিস কখনও?’

সুপ্রতিম বলল, ‘ভূত কেউ দেখে না। যারা বলে দেখেছে তারা গাঁজাখুরি গল্প দেয়।’

‘তুই এ ভাবে বলতে পারিস না। পৃথিবীর বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ ভূত ব্যাপারটাকে মান্যতা দিয়েছেন।’

‘ছাড় তো। কেউ কোনও প্রমাণ দিতে পেরেছে?’

‘সব কিছুর ও রকম প্রমাণ হয় না কি?’

‘প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুর অস্তিত্ব বিজ্ঞান স্বীকার করে না।’

এই ভাবে অমিয় আর সুপ্রতিমের তর্ক যখন প্রায় জমে উঠেছে, হঠাৎই সঞ্জয় চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘তোরা চুপ করবি?’

সঞ্জয়ের বলার মধ্যে কী যেন একটা ছিল। ওরা চুপ করে গেল। সঞ্জয় বলল, ‘ভূত আছে কি নেই আমি জানি না। তবে কিছু একটা আছেই। আমি তাদের দেখেছি। দেখেছি বলা ভুল, এখনও মাঝে মাঝে দেখি। আর সে ভাবে বলতে গেলে আমি এক বছর তাদের সঙ্গে কাটিয়েছি।’

সঞ্জয় অদ্ভুত ছেলে। পল্লবরা শুনেছে, অনেক ছোটবেলায় ওর মা বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তার পরে ও বড় হয়েছে একটা অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকে শুধু নিজের চেষ্টায় আজ ও ফিজিক্সে ফার্স ক্লাস ফার্স। তাই ওর প্রতি সবারই একটা সমীহ আছে। তা ছাড়া আজ পর্যন্ত সঞ্জয়কে কেউ কখনও অবান্তর কথা বলতে শোনেনি।

ওদের চুপ করে থাকতে দেখে সঞ্জয় বলল, ‘আমি কিন্তু মিথ্যে কথা বলছি না। তোরা শুনতে চাস ব্যাপারটা?’

বেশ শীত করছে। ওরা গা ঘেঁষে বসল। হিন্দু হস্টেলের খোলা ছাদে বসে একফালি চাঁদের আলোয় সঞ্জয় তার সেই ‘কিছু একটা’র গল্প শুরু করল

”লোকটাকে প্রথম বার দেখেছিলাম, তখন আমার দশ বছর বয়স। আমাদের গাড়িটা খাদে পড়ে গেছিল। মা, বাবা আর গাড়ির ড্রাইভার তিন জনেই স্পট ডেড। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি অক্ষত ছিলাম। শুধু কপালের বাঁ দিকটা কেটে গেছিল। রক্ত গড়াচ্ছিল। মায়ের দেহটা আটকে ছিল একটা গাছ আর একটা পাথরের মাঝখানে। তখনও তো আমি জানি না, মা বাবা কেউই আর বেঁচে নেই। আমি হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি, তখনই দেখলাম, মা যে পাথরটার মাঝে আটকে পড়েছে তার ওপরে বসে লোকটা পা দোলাচ্ছে। খালি গা, ধুতির মতো কিছু একটা কোমরে জড়ানো। লোকটা বিচ্ছিরি মোটা, এত বড় ভুঁড়ি। গায়ে বনমানুষের মতো লোম। মাথায় কিন্তু একটাও চুল নেই। চকচকে টাক। এই পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল, কিন্তু লোকটা আমার দিকে তাকাতেই আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। লোকটার নাক আর কান বলতে কিছু নেই। এমনকী কান আর নাকের জায়গায় কোনও ফুটো অবধি নেই। চোখ আছে কিন্তু সে দু’টো এতই ছোট যে না থাকার সামিল।

অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। দেখলাম সে পুরো ফোকলা। একটাও দাঁত নেই। তার পরে অবিকল মেয়েদের মতো গলায় সে আমাকে বলল, ‘রাগ করো না খোকা। আমি হুকুমের চাকর।’

আমি বললাম, ‘কার হুকুম?’

উত্তর না দিয়ে সে খিলখিল করে হেসে উঠল আর একটা তীব্র পচা গন্ধে আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

লোকটার সঙ্গে ফের আমার দেখা হল, মাস দেড়েক পরে। আমি তখন আমার কাকার কাছে আছি। সে দিন রবিবার। স্কুল ছুটি। আমি আর কাকার মেয়ে জিনিয়া দোতলার ঘরে বসে খেলছি, হঠাৎ শুনলাম, নীচে কাকা খুব চেঁচামেচি করছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি, উঠোনে একটা লোক হাঁটু মুড়ে বসে আছে আর কাকা হাত উঁচিয়ে বলছে, ‘বেরিয়ে যাও। এখনই বেরিয়ে যাও।’

লোকটার মাথায় উস্কোখুস্কো চুল। গায়ে একটা রংচটা ফতুয়া, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। কাঁধে একটা গামছা। খালি পা, পা ভর্তি ধুলো। কাকার রুদ্রমূর্তি দেখে সে উঠে দাঁড়াল তার পরে কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘চন্দন, টাকার গরমে ফুটছ তাই না? নিতে যখন এসেছি ভাগ্নাকে নিয়েই ফিরব।’

কাকা বলল, ‘শোনো, তোমার মতো ইতরের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না। তুমি যদি না যাও তা হলে পাড়ার ছেলেদের ডেকে আমি তোমাকে মার খাওয়াবো।’

এ কথা শুনে লোকটা বিশ্রি ভাবে হেসে উঠল। তার পরে উঠোনে পা ঠুকে ঠুকে বলল, ‘এই ভাবে গোঁড়াল দিয়ে তোমার গুমোর ভাঙব। তুমি এখনও লোকনাথ চক্কোত্তিকে চেনোনি। গোঁড়াল কাকে বলে জানো? পায়ের গোড়ালি দিয়ে যে লাথি মারা হয় তাকে বলে গোঁড়াল। আজ আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু ঠিক দু’হপ্তা পরে আসব। সে দিন মামা-ভাগ্না নাচতে নাচতে ঘরে যাবে।’

লোকটা হনহন করে হাঁটা দিল। গেট পেরনোর আগে একদলা থুতু ফেলে গেল উঠোনে। তখনই পচা গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠল। পেছন ফিরে দেখলাম, খাটের ওপরে বসে পা দোলাচ্ছে সেই বেঁটে কুৎসিত লোকটা। মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় সে আমাকে বলল, ‘মামার সঙ্গে যাইলা না কেন খোকা? মামায় তোমারে কত্তো ভাল পায়।’

আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বললাম, ‘কে তুমি?’

‘আমার নাম গেনু। তোমার মামায় আমার মালিক। মামারে প্রণাম করলা না খোকা? মামায় কত্তো ব্যথা পাইল। দু’হপ্তা পরে মামায় তোমারে নিয়া যাইব।”’

একটা রাতচরা পাখি ডাকতে ডাকতে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা ভবনের ভেতরে ঢুকে গেল। জোর চমকে উঠল সবাই। সঞ্জয় বলল, ”জল আছে?”

পল্লব জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিল। জল খেয়ে সঞ্জয় বলল, ”আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। আজ বরং থাক। পরে কখনও গল্পটা বলব তোদের।”

অমিয় বলল, ”না না। প্লিজ শেষ কর। দারুণ জমে উঠেছে।”

পল্লব আর সুপ্রতিমও সায় দিল অমিয়র কথায়। সঞ্জয় ফের বলতে শুরু করল

”আমার যে একটা মামা আছে তা আমি জানতাম না। রাতে খেতে বসে কাকার কাছে শুনলাম, আমার মায়েরা দু’ভাই-বোন। মামা বড়, মা ছোট। কিন্তু অল্প বয়সেই মামা খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে বখে যায়। নেশাভাঙ করতে শুরু করে। তার ওপরে শুরু করে তন্ত্র সাধনা। এক দিন পাশের বাড়ি থেকে একটা দু’বছরের বাচ্চা চুরি করে মামা শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছিল বলি দিতে। পাড়ার লোকেরা তাকে ধরে ফেলে এবং বেধড়ক পেটায়। দাদুও মামাকে ত্যজ্যপুত্র করেন। এই ঘটনার পর থেকেই মামা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এর মধ্যে মায়ের বিয়ে হয়েছে। দাদু-দিদা মারা গেছেন। আমিও অনেকটা বড় হয়ে গেছি। দীর্ঘ পনেরো-কুড়ি বছর মামার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমাদের অ্যাক্সিডেন্টের মাস খানেক আগে মামা না কি এক দিন হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিল বাবার অফিসে। বাবা সে দিন তাকে তাড়িয়ে দেয়। তবে তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল বাবা কাউকে বলেনি। কাকা মাথা নেড়ে কাকিমাকে বলেছিল, ‘সঞ্জুর মামাটা একটা জিনিস। ভাবছি পুলিসে একটা খবর দিয়ে রাখব।’

দিন তিনেক পরেই বাথরুমে পিছলে পড়ে কাকিমার পা ভাঙল। সবাই মিলে যখন ধরাধরি করে কাকিমাকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলছে, আমি দেখলাম, অ্যাম্বুল্যান্সের ছাদে বসে পা দোলাচ্ছে গেনু। আমাকে দেখে ফোকলা মুখে হেসে বলল, ‘মালাইচাক্কিটা ঘুরায়ে দিছি। ও আর জীবনে সোজা হইয়া খাড়াইতে পারব না। মামায় আসব তোমারে নিতে। মামার লগে যাইবা কিন্তু খোকা।’

আমি ছুট্টে ঘরে ঢুকে গেলাম। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি, জিনিয়া এসে বলল, ‘কাঁদিস না দাদাভাই। মা ঠিক হয়ে যাবে।’

আমি জিনিয়াকে বলতে পারলাম না যে আমি কাকিমার জন্যে কাঁদছি না। আমি কাঁদছি ভয়ে। খুব ভয় পেলেও মানুষ কাঁদে।

ঠিক চোদ্দ দিনের মাথায় মামা এল। কাকার বাড়িতে তখন হুলুস্থূল কাণ্ড। জিনিয়ার একশো পাঁচ জ্বর। সে কাশছে। কাশির সঙ্গে উঠে আসছে কাঁচা রক্ত। এমন সময়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে মামা হাঁক দিল, ‘চন্দন, ভাগ্নারে এ বারে ছাড়। অনেকটা পথ যেতে হবে তো না কি।’

ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরে গেছি, আমাকে যেতেই হবে মামার সঙ্গে। এই লোকটার বিরাট ক্ষমতা। তবুও বোকার মতো ছুটে গেলাম দোতলায়। মনে হল, যদি খাটের নীচে লুকিয়ে থাকি তা হলে হয়তো মামা আমাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু খাটের তলায় ঢুকতে যাব, দেখি বসে আছে গেনু। সে বলল, ‘খোকা আস। লুকাছুপি খেলি।’

পছন্দের দু’-একটা জিনিস স্কুলব্যাগে ভরে নীচে নেমে এলাম। বললাম, ‘মামা চলুন।’

আমাকে দেখের মামার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কই গেলে চন্দন? দেখে যাও, ভাগ্না নিজেই আসছে মামার কাছে। আটকাতে পারলা না তো?’

জিনিয়াকে কোলে নিয়ে কাকা বেরিয়ে এল। কাকার চোখে জল। মামা বলল, ‘চিন্তা কোর না। তোমার মেয়ে ভাল হয়ে যাবে। ভাগ্নাকে পেয়ে গেছি, আর আমার কিছু চাই না।’

আমার হাত ধরে মামা রওনা দিল।”

ফস করে একটা দেশলাই জ্বলে উঠল। সুপ্রতিম সিগারেট ধরিয়েছে। অমিয় চাপা গলায় বলল, ”ও রকম হঠাৎ করে দেশলাই জ্বালালি কেন? একটু বলেকয়ে জ্বালাবি তো, জোর চমকে উঠেছিলাম।”

সুপ্রতিম বলল, ”কেন, গল্প শুনে তুই ভয় পাচ্ছিস না কি?”

অমিয় পাল্টা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। পল্লব থামিয়ে দিল। সঞ্জয়কে বলল, ”তার পরে কী হল? তুই মামার সঙ্গে গেলি?”

”হ্যাঁ। গেলাম।”

”কোথায় নিয়ে গেল তোকে?”

”কোথায় আবার? মামা যেখানে থাকত সেখানে।”

”কোন জায়গা সেটা?”

”ট্রেনে করে বর্ধমান স্টেশনে নামলাম। তার পরে মাঠ-ঘাট, বন-বাদাড় পেরিয়ে দেড় দিন শুধু হেঁটেছি। রাতেও থামতে দেয়নি মামা। আমার পা ব্যথা করলে কাঁধে তুলে নিয়েছে। পথে খেয়েছি শুধু মুড়ি আর জল। এই ভাবে দেড় দিন পরে সন্ধেবেলা একটা খালের ধারে আমরা থামলাম। মামা বলল, ‘ভাগ্না, এসে গেছি। ওই যে খালের পারে আলো দেখছ, ওই হল শ্মশান। কীসের আলো বলো তো? তুমি তো শহরে থাকতে, তুমি জানবা না। ও হল গিয়ে চিতা? চিতা বুঝলা তো? মড়া পোড়ায় যাতে। ওই শ্মশানে আমার ঘর। আমি আর তোমার মামি থাকি। এ বার থেকে তুমিও থাকবা। কোনও অসুবিধা হলে আমারে বলবা। এ বারে চলো, সাঁকো পেরতে হবে।’

সাঁকোর সামনে এসে আমি থমকে গেলাম। একটা মাত্র বাঁশ পাতা আর পাশে ধরার জন্যে আড়াআড়ি আর একটা বাঁশ। তার ওপর দিয়েই মামা তরতর করে ও পারে চলে গেল। আমি পার হতে পারছি না দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘ভয় লাগছে না কি ভাগ্না? আমি এই বুড়ো বয়সে চলে এলাম আর তুমি পারলা না? যাকগে তুমি দাঁড়াও। আমি গেনুরে পাঠাচ্ছি।’

আমি বললাম, ‘না না। গেনুকে পাঠাবেন না। আমি পারব। আমি যাচ্ছি।’

চিতার আগুনের আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে মামা খলখল করে হেসে উঠল, ‘গেনুরে ভয় পাও কেন? ভয় পাবা না। আমি গেনুরে পুষি। সে তোমার কোনও ক্ষতি করবে না। যাই হোক চলে আস। তোমার মামি অপেক্ষা করছে।’

কোনও মতে প্রাণ হাতে করে আমি সাঁকো পার হলাম। মামা আমার হাত ধরে হাঁটা লাগাল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আমি কী কাজ করি তুমি জান?’

‘না মামা জানি না।’

‘এইটা তো তোমারে জানতে হবে। লোকে যখন জিজ্ঞেস করবে, মামায় কী করে, তখন তো হাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। তুমি যদি বলতে না পার, লোকে বলবে বাপ-মায় কোনও শিক্ষা দেয়নি। তুমি কি চাও লোকে তোমারে ভোদা বাচ্চা বলুক?’

‘না মামা।’

‘তা হলে শোনো, আমি হলাম ডোম। ডোম কারে বলে জান?’

‘হ্যাঁ, যারা মড়া পোড়ায়।’

‘ঠিক বলেছ। ভেরি গুড। ভেরি গুড। তবে ডোমগিরি আমার পেশা। নেশায় আমি তান্ত্রিক। তন্ত্র সাধনা করি। কিছু কিছু শক্তি লাভ করেছি। সময় মতো তোমারে বলব। একটা কথা জেনে রাখো, ডোমগিরি কিন্তু কোনও মহৎ পেশা না। তবে এইটায় তুমি লজ্জা পাবা না। বাপ-মায়ের পেশায় সন্তানের লজ্জা পাওয়া উচিৎ না। বুঝলা?’

‘হ্যাঁ মামা।’

কথা বলতে বলতেই আমরা একটা ঝুপড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। মামা উঁচু গলায় ডাক দিল, ‘রমা, রমা। বাইরে আস। ভাগ্নারে নিয়ে আসছি। ছেলেটা জোর ক্লান্ত। ওরে জল দাও, খাবার দাও।’

ঝুপড়ির বাইরে একটা তুলসীমঞ্চ। সেখানে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তা ছাড়া আর কোথাও কোনও আলো নেই। ঝুপড়ির ভেতরটাও নিকষ অন্ধকার। এমন থকথকে, চটচটে, গাঢ় অন্ধকার আমি জীবনে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছিল, গায়ে লাগলে এই অন্ধকার বুঝি আর কখনও উঠবে না। আমি আলোর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তখনই ঝুপড়ির ভেতরে একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠল। একটা ভাঙা লন্ঠন হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন এক কৃশকায়, দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। তাঁর মাথায় ঘোমটা। এত রোগা মানুষ আমি আজ অবধি দেখিনি। তিনি লন্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে দাঁড়ালেন। মামা বলল, ‘তোমার মামি। যাও প্রণাম কর। বড়দের প্রণাম করতে হয়। তুমি আমারেও প্রণাম করনি। আগে আমারে কর, পরে মামিরে।’

আমি মামার পা ছুঁলাম। তার পরে মামির পায়ে হাত দিতে যাব, ‘তিনি আমাকে দু’হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, ষাট ষাট। বড় হও বাপ। রাজা হও।’

সেই কালিপড়া লন্ঠনের আবছা আলোতে আমি শিউরে উঠে দেখলাম, মামির মুখে বেশির ভাগ দাঁতই নেই। এ দিক ও দিক কয়েকটা দাঁত এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা যেন সেই মুখগহ্বরের শূন্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণে।”

”রাতে আমি আর মামা পাশাপাশি খেতে বসলাম। সামনেই হাতপাখা হাতে মামি। আয়োজন সামান্য। ভাত, ডাল, কুচো মাছ ভাজা আর ডুমুরের ঝোল। এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামছিল না, তবু মুখ বুজে খেতে লাগলাম। শহরের আলো ছেড়ে এই অন্ধকার শ্মশানের মধ্যে বসে আমার কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু আমি কাঁদিনি। শেষ দু’দিনে বুঝে গেছিলাম, যদিও এখনও এই মামা লোকটা আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি কিন্তু এ যা বলবে মুখ বুজে শুনতে হবে। নয়তো কপালে দুঃখ আছে। তবে এত হাঙ্গামা করে লোকটা আমাকে এই বিরান জায়গায় কেন নিয়ে এল সেটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

খাওয়াদাওয়া মিটতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। মামিকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দিল মামা। আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে মামা বলল, ‘ভাগ্না আস। এই দাওয়ায় বসি। তোমারে কটা কথা বলে রাখি এই বেলা।’

আমি আর মামা পাশাপাশি বসলাম। সামনে টিমটিম করে লন্ঠন জ্বলছে। মৃদু একটা হাওয়া দিচ্ছে। গাছের পাতায় কেমন যেন সরসর শব্দ উঠছে। মাঝে মাঝেই হাওয়া বাড়ছে আর চিমসে একটা গন্ধ ধাক্কা মারছে নাকে। বুঝলাম, গন্ধটা আসছে শ্মশান থেকে। মাংস আর চামড়া পোড়া গন্ধ। মামা শক্ত করে আমার হাতটা ধরে বলল, ‘তোমার মামিরে তালাবন্ধ করলাম দেখে অবাক হয়েছ তাই না?’

‘হ্যাঁ মামা।’

‘তোমার মামির আসলে মাথার ঠিক নাই। রাতের বেলা উটকো চিল্লামিল্লি করে। গেনুরে দেখে ভয় পায়। অনেক বার বুঝিয়েছি, গেনুরে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমার হুকুম ছাড়া সে নড়ে না। তবু কথা শোনে না। তাই রাত হলে তোমার মামিরে বন্ধ রাখি। সকালে খুলে দি। দিনের বেলা ঠিক থাকে। ঘরের কাজকর্ম করে, কিন্তু রাত হলেই গণ্ডগোল। রাতে যদি তোমার মামি চেঁচায় ভয় পাবা না। আমি যদি না থাকি, দরজার পাশে একটা লম্বা লাঠি রাখা আছে। জানলা দিয়ে লাঠিটা ঢুকায়ে দু’টো বাড়ি দেবা, ঠান্ডা মেরে যাবে। বুঝলা?’

আমি অবাক হয়ে শুনছি। বলে কী লোকটা? লাঠি ঢুকিয়ে মামিকে মারব! এমন আবার হয় না কি? আমাকে চুপ থাকতে দেখে মামা বলল, ‘তোমার এখানে কোনও ভয় নাই। নিজের মতো থাকবা। খাবা-দাবা, ঘুরবা, খালে নাইবা, খেলাধুলো করবা ব্যস। এক বছর পরে তোমার ছুটি। পালানোর কথা ভুলেও ভাবনা না কেমন? শ্মশানের বাইরে গেলেই গেনু তোমারে ধরবে। গেনু রেগে গেলে কী করে জান?’

‘কী করে?’

‘চুষে চুষে মাংস খায়। তখন খুব ব্যথা লাগে। গেনুরে পোষ মানানোর আগে সে আমার দু’টো আঙ্গুল খেয়ে ফেলেছিল। এই দ্যাখো।’

দেখলাম, মামার বাঁ হাতের অনামিকা আর কড়ে আঙুলটা কাপড় জড়ানো। এটা আমি আগে খেয়াল করিনি। মামা কাপড় সরিয়ে দেখাল। ও দু’টোকে আঙুল বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন দু’টো শুকনো কাঠি হাতের সঙ্গে লেগে আছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। ভয়ে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, ‘আমাকে কেন নিয়ে এলেন? আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন মামা।’

আঙুলে কাপড় জড়িয়ে মামা বলল, ‘কাঁদবা না। একদম কাঁদবা না। কান্নাকাটি মেয়েমানুষের কাজ। তুমি কি মেয়ে? যদি মেয়ে হও তা হলে ওই গামছা নিয়ে ঘোমটা দাও মামির মতো। কান্না বন্ধ।’

হঠাৎ ভয় কেটে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি আচমকাই মামার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ঘাড়ের কাছটা কামড়ে ধরলাম। কিন্তু আমি কি আর মামার সঙ্গে পারি? এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে মামা আমার বুকের ওপরে পা দিয়ে দাঁড়াল। হিসহিস করে বলল, ‘ভাগ্না অসভ্যতা করবা না। অসভ্যতা করলে দাঁত ফেলে দেব। তোমার মামিরে দেখলা তো? দাঁত নাই। সে যখন এমন ছিটপিটায় আমি নোড়া দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দিই। তুমি কি কম বয়সে মামির মতো ফোকলা হতে চাও? যদি না চাও চুপচাপ শুয়ে পড় ঘরে ঢুকে।’

আমায় ফেলে মামা ঘরে ঢুকে গেল। আমি উঠোনেই পড়ে রইলাম সারারাত। অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙল, দেখলাম, আমি বিছানার ওপরে শুয়ে। মাথার কাছেই বসে আছে মামি। আমি ধড়মড় করে উঠে বসতে গেলাম। মামি আমাকে ধরে শুইয়ে দিলেন। আমার কপালে হাত রেখে বললেন, ‘উঠো না। তোমার জ্বর। আমি ওষুধ দিয়েছি। সেরে যাবে। আর একটা কথা, ভয় পেয়ো না। আমি আছি।’

সেই নির্বান্ধব শ্মশানে, গত দু’দিনের অস্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের পরে মামির কথাগুলো আমায় যেন হঠাৎই অনেকটা আশ্রয় দিল। মনে হল, বেঁচে থাকার জন্যে মামিই আমার শেষ ভরসা। আমি শক্ত করে মামির হাতটা চেপে ধরলাম। আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফেঁটা জল। রোগা হাতে সেই জল মুছিয়ে মামি বললেন, ‘তোমাকে এখান থেকে বার করার দায়িত্ব আমার। তবে ধৈর্য ধরতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। তুমি যত ভয় পাবে, তত হেরে যাবে।”’

এই পর্যন্ত বলে সঞ্জয় থামল। এক ঢেঁক জল খেয়ে বলল, ‘কটা বাজে?’

পল্লব বলল, ‘দেড়টা।’

সঞ্জয় বলল, ‘কারেন্ট কি আজ আর আসবে না?’

‘কে জানে! আচ্ছা তার পরে কী হল বল?’

”আর কী, তার পরে এক বছর ধরে আমি প্রতিদিন পালানোর সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু যত বারই শ্মশানের বাইরে এসে দাঁড়াই, একটা তীব্র পচা গন্ধ গা গুলিয়ে ওঠে। বুঝতে পারি, আমি গেনুর নজরবন্দি। চুপচাপ ফিরে যাই ঘরে। মামা সারাদিন কী করে কে জানে, বাড়িতে থাকে না। অনেক রাতে ফেরে। মামার সঙ্গে আমার দেখা হয় না বললেই চলে। আমিও চাই না মামার সঙ্গে আমার দেখা হোক। তাই মামা আসার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। তত দিনে মাস চারেক কেটে গেছে, ওখানেই আছি। এক দিন কিছুতেই ঘুম আসছে না। এ পাশ ও পাশ করছি। গলার আওয়াজে বুঝলাম মামা ফিরে এসেছে।

মামা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে আমাকে টান মেরে বিছানা থেকে তুলে দিল। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘কী হল মামা?’

আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এসে ভাঙা লন্ঠনটা তুলে মামা আমাকে দেখতে লাগল। তার পরে মামির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন রমা? তুমি এরে ঠিক মতো খেতে দাও না?’

মামি বলল, ‘খেতে দেব না কেন? কিন্তু রোজ রোজ শাক ভাত খেতে পারে ও? কোনও দিন খেয়েছে এ সব?’

‘কোনও দিন খায়নি বলে এখন খেতে পারবে না, এ কেমন কথা? অবস্থা বুঝে চলতে হয়। আর খেতে না চাইলে জোর করে গলায় পা দিয়ে খাওয়াবা। রোগা হলে তো আমার চলবে না।’

‘কী বলো তুমি? গলায় পা দিয়ে খাওয়াবো?’

‘হ্যাঁ তাই খাওয়াবা।’

মামি চাপা গলায় বলল, ‘শোনো ও সব পিচাশগিরি তুমি নিজে করো। আমাকে এর মধ্যে খবরদার টানবে না বলে দিলাম। আমি পারব না।’

‘পারবা না? ঠিক তো?’

‘না বললাম তো।’

মামা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘যাও ভাগ্না ঘরে যাও।’

আমি ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে এলাম। ফুঁ দিয়ে বাইরের লন্ঠনটা নিভিয়ে দিল মামা। বিছানায় শুয়ে কুঁকড়ে শুনলাম, মামি চাপা গলায় কাঁদছে। টানা একঘেয়ে সেই কান্না শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে দেখলাম, মামির আরও একটা দাঁত কমে গেছে। আরও বেড়েছে মুখগহ্বরের শূন্যতা।”

সবাই একসঙ্গে শিউরে উঠল। অমিয় বলল, ‘তোর মামাটা কি জানোয়ার?’

সঞ্জয় বলল, ‘হ্যাঁ। জানোয়ার বললেও কম বলা হয়।’

পল্লব বলল, ‘আচ্ছা, এত কাণ্ড করে তোকে আটকে রাখার কারণ কী ছিল?’

”মামা আমাকে বলি দিতে চেয়েছিল। তোদের মনে আছে, মামা বলেছিল, এক বছর পরে আমার ছুটি? আসলে সিদ্ধিলাভের জন্যে মামার একটা এগারো বছরের সুলক্ষণযুক্ত বাচ্চা দরকার ছিল। তাকে বলি দিতে পারলেই না কি অসীম ক্ষমতা করায়ত্ত হতো মামার। গেনুর থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী কিছুরা তার পোষ মানত। এর আগে মামা পাঁচ আর সাত বছরের দু’টো বাচ্চাকে বলি দিয়েছিল। সেই হতভাগ্য দু’জন আমার দুই মামাতো ভাই বোন।”

অমিয় শক্ত করে পল্লবের হাত চেপে ধরে বলল, ‘চুপ কর সঞ্জয়। আর শুনতে ভাল লাগছে না।’

সঞ্জয় বলল, ‘ভাল লাগার কথাও নয়। চল নীচে যাই।’

পল্লব বলল, ‘যাচ্ছি, এক মিনিট। তুই কী ভাবে পালিয়ে বাঁচলি শুধু সেটুকু বল। খুব কৌতূহল হচ্ছে।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সঞ্জয়, ”আমার জন্মদিন ১২ মে। সে দিন আমি দশ পূর্ণ করে এগারোয় পা দেব। ১১ তারিখ ভোরবেলায় মামা আমাকে তুলে কনকনে ঠান্ডা জলে স্নান করাল। তার পরে হাতে কী সব লাল সুতো বেঁধে সাদা একটা ধুতি পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাগ্না, মধ্যরাতে পুজোয় বসব। তুমি থাকবা আমার সঙ্গে। তার পরে তোমার ছুটি। আর আটকে রাখব না। মামার ওপরে রাগ করেছ না ভাগ্না? রাগ করবা না। মামার আদর হল দুই মায়ের আদরের সমান। দেখ না, মামা বলতে দুই বার মা বলতে হয়। শোনো এই স্নান করায়ে দিলাম, সোনা ছেলে হয়ে বসে থাকবা সারাদিন। ধুলোবালি ঘাঁটবা না। আমি রাতে তোমারে নিতে আসব। গেনু রইল, তোমার খেয়াল রাখবে।’

সে দিন সকালবেলাতেই মামিকে তালা দিয়ে মামা বেরিয়ে গেল। আমি ধুতি পরে বসে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম, খাটের তলা থেকে গেনু উঁকি মেরে ফোকলা মুখে হাসছে।

বসে আছি তো আছিই। সূর্য মাথার ওপরে উঠে পড়ল। একটু বোধ হয় ঝিমুনি লেগেছে, কে যেন আমায় ঠেলা দিল। দেখি মামি দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, ‘তুমি কী ভাবে বাইরে এলে মামি?’

মামি বললেন, ‘কথা বলার সময় নেই। পা চালাও।’

‘কোথায় যাব মামি?’

‘চলো না। গেলেই বুঝবে। এখানে বসে থাকলে তোমায় বাঁচাতে পারব না। তোমার মামা তোমায় বলি দেবে আজ রাতে।’

‘বলি!’

‘হ্যাঁ, যেতে যেতে সব বলব। চলো।’

আমি আর মামি সবে ঘর থেকে বেরিয়েছি, গেনু সামনে এসে দাঁড়াল। মামিকে বলল, ‘এইটা ঠিক করলেন না মা। কত্তায় কুপিত হইবেন।’

মামি বলল, ‘যা না, তোর কত্তাকে গিয়ে নালিশ কর। দেখি তোদের ক্ষমতা।’

আমার হাত ধরে মামি দ্রুত এগিয়ে চললেন। গেনু পেছন পেছন আসতে লাগল। সে একটাই কথা বলছিল, ‘কত্তা এখন আসনে বসা, আমি খবর দিতে পারছি না। খুব ক্ষতি হবে মা। খোকা তুমি নেমকহারমি করলা কেন? মামায় তোমারে কত্তো ভাল পায়। সে কত্তো ব্যথা পাইবে বলো?’

মামির হাত ধরে আমি যেন ভাসতে ভাসতে যাচ্ছিলাম। চারদিকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম, একটা থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মামি বলল, ‘এতক্ষণ তোমাকে যা যা বললাম, ভেতরে গিয়ে পুলিশকে সব বলবে। তুমি যে ঘরে শুতে তার মেঝেতে তোমার ভাই-বোনের কঙ্কাল পোঁতা আছে। শুধু দেহটা পাবে। মাথা দু’টো নেই। ও দু’টো তোমার মামা খালে ফেলে দিয়েছিল। মাগুর মাছে খেয়ে ফেলেছে। পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে। তবে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তোমার মামা এখন সমাধিতে, সে উঠে পড়ার আগেই তাকে ধরতে হবে। সে বসে আছে শ্মশানের পশ্চিম প্রান্তে নিম গাছের তলায়। ভয় পাবে না। আমি থাকব তোমার সঙ্গে। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”

সুপ্রতিম বলল, ‘পুলিশ তোর কথা শুনল?’

সঞ্জয় বলল, ‘হ্যাঁ। এক দল পুলিশ গিয়ে ঘরের মেঝে থেকে দু’টো মাথাবিহীন কঙ্কাল উদ্ধার করল। অন্য আর এক দল তখন মামাকে হাতকড়া পরিয়ে উঠোনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। যাওয়ার আগে মামিকে যে ঘরে তালা দিয়ে রেখে গেছিল, সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে মামা হঠাৎ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করল। পুলিশ সে ঘরের তালা ভাঙতেই আমি দেখলাম…’

‘কী দেখলি?’

‘দেখলাম, গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে মামি ঝুলছে।’

প্রেসিডেন্সি কলেজের পেছনের গেটে একটা কুকুর হঠাৎই কেঁদে উঠল। সঞ্জয় বলল, ‘আমি আর কাকার কাছে ফিরে যাইনি। পুলিশ আমাকে একটা হোমে রেখে দেয়। গেনু এখনও আসে। আজও ও আমার ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু বারবার করেই মামি সাবধান করে দেয় আমাকে।’

সুপ্রতিম হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল।

বাকিরা অবাক হল। পল্লব বলল, ‘কী হল?’

সঞ্জয়ের পিঠে একটা চাপড় মেরে সুপ্রতিম বলল, ‘ভাই তুই গল্প লেখ। তোর হবে। জীবনের দু’টো ঘণ্টা তোর গাঁজা শুনে নষ্ট করলাম।’

সঞ্জয় আহত গলায় বলল, ‘আমি তো তোকে বিশ্বাস করতে বলিনি। তোরা শুনতে চাইলি তাই বললাম। এখন প্লিজ এটা নিয়ে মজা করিস না।’

সুপ্রতিম উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ক্ষমা কর সঞ্জয়। যে যাই বলুক আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, তুই মিথ্যে কথা বলছিস।’

এ কথার উত্তরে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে কাঁপা গলায় সঞ্জয় বলল, ‘প্রতিম, এখানে এসে সবার সঙ্গে বোস। ওখানে একা দাঁড়িয়ে থাকিস না।’

‘কেন দাঁড়ালে কী হবে? এটা কী গল্পের আফটার এফেক্ট দিচ্ছিস?’

‘তর্ক করিস না। প্লিজ আয়। মামি তোকে চলে আসতে বলছে।’

‘মামি?’।, হো হো করে হেসে উঠল সুপ্রতিম, ‘তোর মামি আমাকে চলে আসতে বলছে? সঞ্জয় তুই ভাই খলিফা। বাকিরা সবাই তোর গল্পে বিশ্বাস করেছে। এ বার প্লিজ থাম নয়তো…’

কথা শেষ করার আগেই সুপ্রতিম এক পা পিছিয়ে গেল। তার পরে আচমকাই কেউ যেন এক ধাক্কায় তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিল। কাঁপতে কাঁপতে ওরা ধপ করে একটা শব্দ পেল। সুপ্রতিম নীচে পড়ল। আর তখনই একটা তীব্র পচা গন্ধে হড়হড় করে বমি করে দিল পল্লব।