নিউরাল কম্পিউটার
বিজ্ঞাপনটি শরীফ আকন্দের খুব পছন্দ হল। ছোট টাইপে লেখা।
সব সমস্যার সমাধান থাকে না–
কিন্তু যদি থাকে
আমরা সেটা বের করে দেব!
পাশে একটা চিন্তিত মানুষের ছবি। মানুষটিকে ঘিরে পটভূমিতে কিছু কঠিন সমীকরণ, কিছু যন্ত্রপাতি। একটা ভাস্কর্য, কয়েকটা খোলা বই। কঠোর চেহারার একজন সৈনিক এবং কিছু ক্ষুধার্ত শিশুর ছবি। বিজ্ঞাপনটি দেখলেই বোঝা যায় সমস্যা বলতে শুধু বিজ্ঞান বা গণিতের সমস্যা বোঝানো হচ্ছে না, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতির সমস্যাও বোঝানো হচ্ছে।
শরীফ আকন্দ জিভ দিয়ে পরিতৃপ্তির একটা শব্দ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনে বসে থাকা নজীবউল্লাহকে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় তোমার নজীব? এইবারে কি হবে? কথার মাঝে জোর থাকল হবে কথাটির মাঝে।
নজীব আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিয়ে বলল, কেমন করে বলি? এর আগেরবারও তো ভেবেছিলাম হয়ে যাবে–সেবারেও তো হল না।
শরীফ ভুরু কুঁচকে বলল, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তার সংজ্ঞা নিয়ে সমস্যা। এবারে অন্তত সেরকম কিছু তো নেই।
তা নেই কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেব না। যখনই আমাদের কাছে কেউ জানতে চেয়েছে আমাদের সিস্টেম কী–প্লটফরম কী–আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। বড়জোর বলা হবে নিজস্ব সুপার কম্পিউটার, আলট্রা কম্পিউটার আর নিউরাল কম্পিউটার!
নিউরাল কম্পিউটার! শরীফ দরাজ–গলায় হা হা করে হেসে উঠল, এই নামটা খুব ভালো দেওয়া হয়েছে।
নজীব জকুটি করে বলল, কেন? নিউরাল কম্পিউটার কি ভুল বলা হল?
না না–ভুল কেন হবে? শরীফ আকন্দ দুলে দুলে হেসে বলল, ভুল নয় বলেই তো তোমাকে বলছি। শরীফ টেবিলে রাখা গ্লাসের তরল পদার্থে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তোমার এই বিজ্ঞাপনের রি–একশান কী?
ভালো। খুব ভালো। কাল পর্যন্ত তেতাল্লিশটা খোঁজ এসেছে।
কারা কারা সমস্যার সমাধান চাইছে?
সব রকম আছে। দুজন মন্ত্রী, তিনটা কর্পোরেশনের সি. ই. ও. থেকে শুরু করে স্মাগলিং সিন্ডিকেটের মাস্তান এবং ব্যর্থ প্রেমিকও আছে!
কী মনে হয় তোমার! পারব তো করতে?
কেন পারব না? নজীব সোজা হয়ে বসে বলল, আমরা কয়টা টেস্ট কেস করলাম? কমপক্ষে দুই ডজন, সবগুলো ঠিক হয়েছে।
শরীফের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, ঠিকই বলেছ। কয়েকটা কেস দেখে ভয় লেগে যায়। বিশেষ করে সেই যে আত্মহত্যার কেসটা মনে আছে?
হ্যাঁ। দিন তারিখ সময় থেকে শুরু করে কীভাবে আত্মহত্যা করবে সেটাও বলে দিল।
চিন্তা করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই দেখ। শরীফ তার হাতটা এগিয়ে দেয়। সত্যিই তার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
নজীব আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিয়ে বলল, আমাদের সবচেয়ে বড় কাস্টমার হবে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। চিন্তা কতে পার আমাদের এই নিউরাল কম্পিউটার কীভাবে ক্রাইম সলভ করবে?
হ্যাঁ। শরীফের চোখ চকচক করে ওঠে, ঠিকই বলেছ।
তবে আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা আর পুলিশে ছুঁলে বত্রিশ ঘা!
হঠাৎ করে শরীফ সোজা হয়ে বসে বলল, আচ্ছা নজীব—
কী হল?
আমাদের এই প্রজেক্ট কাজ করবে কিনা সেটা আমাদের নিউরাল কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?
নজীব চিন্তিত মুখে শরীফের দিকে তাকাল, বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি। কিন্তু
এর মাঝে আবার কিন্তু কী? এত টাকাপয়সা খরচ করে এত হইচই করে একটা প্রজেক্ট ক্ষ করছি, সেটা যদি কাজ না করে আমোক তার পিছনে সময় দেব কেন?
ঠিকই বলেছে। নজীব চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু
কিন্তু কী?
আমাদের এই নিউরাল কম্পিউটার সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে, কখনো কখনো কী হবে তার ভবিষ্যদ্বাণীও করে দিতে পারে কিন্তু সেগুলোর সাথে তার নিজের ভবিষ্যৎ জড়িত থাকে না। কিন্তু এটার সাথে নিউরাল কম্পিউটারের নিজের ভবিষ্যৎ জড়িত।
তাতে কী হয়েছে?
এটা একটা প্রকৃতির সূত্র, কেউ যদি নিজে একটা সিস্টেমের ভেতরে থাকে তাহলে তারা সেই সিস্টেমকে বিশ্লেষণ করতে পারে না। অনেকটা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্রের মতো।
রাখ তোমার বড় বড় কথা। চল গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখি।
সত্যি জিজ্ঞেস করতে চাও? আমার মন বলছে কাজটা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না? চল যাই। ওঠ।
এখনই?
অসুবিধে কী? জিজ্ঞেসই যদি করতে হয় পুরোপুরি শুরু করার আগেই জিজ্ঞেস করা যাক।
ঠিক আছে। নজীবউল্লাহ খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলে রাখা পানীয়টা এক ঢোকে শেষ করে দিয়ে হাতের পেছন দিয়ে মুখ মুছে বলল, চল।
দুজনে বিল্ডিংয়ের সংরক্ষিত লিফটে করে সাততলায় উঠে যায়। লিফটের দরজা খোলার আগে দুজনকেই রেটিনা স্ক্যান করিয়ে নিশ্চিত হতে হল যে তারা সত্যিই ক্ৰন কম্পিউটিংয়ের মালিক শরীফ আকন্দ এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার নজীবউল্লাহ। ধাতব দরজাটি খোলার সাথে সাথে সার্ভেলেন্স ক্যামেরাগুলো তাদের দুজনের উপরে স্থির হল। শরীফ আকন্দ মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল, সিকিউরিটি, দরজা খোল।
কিছু মনে করবেন না স্যার। পাসওয়ার্ডটি বলতে হবে।
বাড়াবাড়ি সিকিউরিটি দেখে শরীফ আকন্দ বিরক্ত না হয়ে বরং একটু খুশি হয়ে উঠল, হা হা করে হেসে উঠে বলল, এই কোম্পানিটি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
হতে পারে স্যার। কিন্তু আমরা প্রফেশনাল।
আজকের পাসওয়ার্ড হচ্ছে ব্ল্যাক হোল। কালো গহ্বর।
খুট করে একটা শব্দ হতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজা খুলে গেল, দেখা গেল অন্যপাশে অনেকগুলো মনিটরের সামনে দুজন সিকিউরিটির মানুষ বসে আছে। একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওয়েলকাম স্যার আমাদের এই নির্জন কারাবাসে আমন্ত্রণ।
নির্জন বলছ কেন? শরীফ আকন্দ হেসে বলল, তোমার এই ফ্লোরে সবচেয়ে বেশি মানুষ। সব মিলিয়ে চৌদ্দজন।
সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা মানুষটি বলল, আপনি যদি ব্যাপারটা এভাবে দেখেন তাহলে অবিশ্যি আমার কিছু বলার নেই।
খুব উঁচুদরের একটা রসিকতা করা হয়েছে এরকম ভঙ্গি করে শরীফ আকন্দ এগিয়ে গেল। জীবউল্লাহ পকেট থেকে ছোট একটা কার্ড বের করে দরজায় প্রবেশ করাতেই একটা ছোট শব্দ করে দরজা খুলে গেল। লম্বা করিডর ধরে তারা একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে থেমে গেল। জায়গাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তবুও শরীফ আকন্দের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যায়। একটা বড় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নজীব দরজাটা খোল।
নজীবের মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ মটকে বলল, তোমার কাছেও চাবি আছে।
শরীফ মাথা নাড়ল, কিন্তু আমার খুব নার্ভাস লাগে–এখনো আমি অভ্যস্ত হতে পারি নি। প্রত্যেকবার বুকের ভিতরে কেমন যেন ধক করে ধাক্কা লাগে। তুমি বিশ্বাস করবে না আমি এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি।
কী দুঃস্বপ্ন দেখ?
দুঃস্বপ্ন দেখি যে আমি একটা ছোট বাথটাবে শুয়ে আছি আর আমার চারপাশ বারোটা
বারোটা কী?
তুমি জান কী! দরজা খোল নজীব।
নজীব পকেট থেকে ম্যাগনেটিক কার্ড বের করে দরজায় প্রবেশ করিয়ে কার্ডটা আবার বের করে নেয়। তারপর দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। দৃশ্যটি অনেকবার দেখেছে তার পরেও সে নিজের অজান্তে একবার শিউরে উঠল।
ভেতরে বারোজন বিকলাঙ্গ শিশু। শরীরের তুলনায় তাদের মাথা অতিকায় এবং অপুষ্ট শরীরে এই বিশাল মাথা বহন করতে একধরনের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। তাদের লিকলিকে হাত পা, তবে হাতের আঙুলগুলো দীর্ঘদেখে মাকড়সার কথা মনে পড়ে যায়। কোটরাগত চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখের জায়গায় একধরনের গর্ত এবং সেখান থেকে লাল জিভ বের হয়ে আছে। নাক অপরিণত–দেখে মনে হয় কুষ্ঠরোগে বসে গিয়েছে। তাদের মাথার পিছন থেকে একধরনের কো–এক্সিয়াল কেবল বের হয়ে এসেছে, সেটি একটা ছোট যন্ত্রের সাথে যুক্ত। যন্ত্রটি তাদের মাথার পিছন থেকে ঝুলছে।
শিশুগুলো দরজায় শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল এবং শরীফ আকন্দ তখন আবার শিউরে উঠল প্রত্যেকটা শিশু হুবহু একই রকম। এদেরকে এক সাথে ক্লোন করা হয়েছে এবং একইভাবে বড় করা হয়েছে। সরাসরি মস্তিষ্কে ইলেকট্রড বসিয়ে মস্তিষ্কের একই জায়গা একই সময়ে স্পন্দিত করা হয়–কাজেই তারা একই সাথে অনুরণিত হয়। শিশুগুলোর বয়স ছয় বছর কিন্তু দেখে সেটা অনুমান করার উপায় নেই তাদেরকে মানুষ বলে মনে হয় না–কাজেই মানুষের বয়সের কোনো কাঠামোতে তাদেরকে ফেলা যায় না।
শরীফ আকন্দ বা নজীবউল্লাহ শিশুগুলোকে কোনোরকম সম্ভাষণ করল না–এদেরকে সামাজিক কোনো ব্যাপার শেখানো হয় নি নিজেদের কাজ শেষ করা ছাড়া আর কিছুই তারা জানে না। জীবউল্লাহ এক পা এগিয়ে এসে বলল, তেতাল্লিশ বি–এর সমাধান কি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ। শেষ হয়েছে। নেটওয়ার্কে আপলোড করেছি।
চুহাত্তর এক্স টু?
কাজ করছি। ডাটা অনেক বেশি, নিউরন ওভারলোড হয়ে যায়।
কখন শেষ হবে?
দুই ঘণ্টা পর। দুই ঘণ্টা সাত মিনিট।
শরীফ আকন্দ একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই বারোটি বিকলাঙ্গ শিল্প দিকে তাকিয়ে রইল। এরা বারোজন মিলে আসলে একটি প্রাণী। কথা বলার সময় কে বলছে বোঝা যায় না। একেকজন একেকটা শব্দ বলে বাক্য শেষ করে কিন্তু তার মাঝে বিন্দুমাত্র অসঙ্গতি নেই। ঠোঁট নেই–কাজেই ঠোঁট না নেড়ে সরাসরি ভোকাল কর্ড থেকে শব্দ বের করে কথা বলে, তাই একধরনের যান্ত্রিক উচ্চারণ হতে থাকে।
আমি তোমাদের জন্যে একটা নতুন সমস্যা এনেছি।
প্রায়োরিটি কত?
অন্য প্রায়োরিটি ওভার রাইড করতে হবে।
ওভার রাইড কোড কত?
নজীবউল্লাহ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কোডগুলো পড়ে শোনাল। এই শিশুগুলোকে অনেকটা যন্ত্রের মতো প্রস্তুত করা হয়ে হয়েছে। পদ্ধতির বাইরে এরা কাজ করতে পারে না। কোড শোনার পর শিশুগুলো তাদের বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে নিজের বিশাল মাথা নিয়ে প্রায় সারিবদ্ধ হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। নজীব সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, সমস্যাটি প্রচলিত ভাষায়। শব্দের অর্থ যথাযথ। রূপক উপসর্গ সর্বনিম্ন। বাক্যাংশ এরকম : ক্রন কম্পিউটিংয়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের সম্ভাবনা কত?
নজীবের কথা শেষ হওয়া মাত্র শিশুগুলো নিজেদের কাছাকাছি চলে আসে, অপুষ্ট আঙুল নেড়ে নিজেদের ভিতরে দুর্বোধ্য একধরনের ভাষায় কথা বলে, একজন হামাগুড়ি দিয়ে একটা কম্পিউটারের সামনে উপুড় হয়ে বসে, দ্রুত হাত নেড়ে কিছু তথ্য প্রবেশ করায়। মাথা থেকে ঝুলে থাকা যন্ত্রগুলোতে আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে, একধরনের ভোঁতা যান্ত্রিক শব্দ হতে থাকে।
শিশুগুলোর অস্বাভাবিক কাজকর্ম যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম একেবারে হঠাৎ করে থেমে গেল। সবাই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সমাধানে অনিশ্চয়তা নব্বই ভাগ।
কেন?
প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব।
মূল ডাটাবেস থেকে তথ্য নিয়ে নাও।
নিরাপত্তাজনিত কারণে তথ্যগুলো আমাদের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
শরীফ আকন্দ এবং নজীবউল্লাহ একজন আরেকজনের দিকে তাকাল–এ ব্যাপারটি ঘটতে পারে তারা আগে চিন্তা করে নি। শরীফ আকন্দ ইতস্তত করে বলল, যে তথ্যগুলো তোমাদের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে সেগুলো তোমাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য। আমরা যে–প্রশ্নটি করেছি তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
আছে।
শরীফ আকন্দ ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে কেন কিন্তু এই বিকলাঙ্গ শিশুগুলোকে যেভাবে বড় করা হয়েছে তাতে তাদের সাথে আলোচনা বা তর্ক–বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। নজীবউল্লাহ জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী জানতে চাও?
আমরা কারা? আমরা এখানে কেন?
নজীবউল্লাহ নিজের ভিতরে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে মানুষের যে–প্রজাতিকে ক্লোন করে এই অচিন্তনীয় প্রতিভাধর শিশু তৈরি করা হয়েছে তাদের ভিতরে মানবিক কোনো চেতনা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা যে–প্রশ্ন করেছে তার উত্তর জানার জন্যে এই মানবিক অনুভূতিগুলো থাকার প্রয়োজন। সেই অনুভূতি ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর তারা কেমন করে অনুভব করবে? নজীবউল্লাহ আড়চোখে শরীফ আকন্দের দিকে তাকিয়ে নিচুগলায় বলল, আমি আগেই বলেছিলাম এই ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই।
শরীফ আকন্দ ফিসফিস করে বলল, এখন কী করতে চাও?
আমাদের প্রশ্নটা বাতিল করে দিই।
শরীফ আকন্দ মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
নজীবউল্লাহ গলার স্বর উঁচু করে বলল, আমরা যে–প্রশ্নটি করেছি তার উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নটা বাতিল করে দিচ্ছি।
প্রায়োরিটি কোডিং কত?
নজীবউল্লাহ আবার পকেট থেকে একটা ছোট কার্ড বের করে কিছু সংখ্যা উচ্চারণ করল।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর ভেতর থেকে কোন একজন বলল, সমস্যা বাতিল করা হল।
নজীবউল্লাহ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বিকলাঙ্গ শিশুগুলো আবার নিজেদের টেনেহিঁচড়ে ঘরের নানা জায়গায় বসানো কম্পিউটারগুলোর সামনে বসে কাজ শুরু করে দেয়। তাদের কাজ করার দৃশ্যটি অদ্ভুত– অনেকটা পরাবাস্তব দৃশ্যের মতো মনে হয় কোনো পচে যাওয়া মাংসের টুকরোর মাঝে কিছু পোকা কিলবিল করছে। এই শিশুগুলো কৃত্রিম উপায়ে তৈরি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান শিল্প ক্লোন, ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস হয় না।
শরীফ আকন্দ নজীবউল্লাহর কনুই স্পর্শ করে বলল, চল যাই।
চল।
দুজন ঘরের দরজার দিকে হেঁটে যায়, হ্যান্ডেল স্পর্শ করে দরজা খোলার চেষ্টা করে আবিষ্কার করল দরজাটি বন্ধ।
সে কী! দরজা বন্ধ হল কেমন করে?
শরীফ আকন্দ এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল, সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ। বিকলাঙ্গ বারোজন শিশুর সাথে একটা ঘরে আটকা পড়ে গেছে–এই ধরনের একটি অবাস্তব আতঙ্ক হঠাৎ তাকে গ্রাস করে ফেলে।
শরীফ আকন্দ হ্যান্ডেলটি ধরে জোরে কয়েকবার টান দিল, কোনো লাভ হল না। নজীবউল্লাহ গলা নামিয়ে বলল, টানাটানি করে লাভ নেই। তুমি খুব ভালো করে জান এই দরজা বন্ধ হলে ডিনামাইট দিয়েও ভোলা যাবে না। সিকিউরিটিকে ডাক।
শরীফ আকন্দ আড়চোখে বারোজন বিকলাঙ্গ শিশুর দিকে তাকাল–তারা তাদের
দুজনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে–কী কুৎসিত একটি দৃশ্য! তার সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসে। শরীফ পকেট থেকে ছোট টেলিফোন বের করে সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করার জন্যে লাল বোতামটি স্পর্শ করল। টেলিফোনে সবুজ বাতি না জ্বলে উঠে সেটি আশ্চর্যরকম নীরব হয়ে রইল। শরীফ আকন্দ টেলিফোনটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে নজীবউল্লাহর দিকে তাকাল, শুকনো গলায় বলল, টেলিফোন
কাজ করছে না।
নজীবউল্লাহ নিজের টেলিফোনটা দিয়ে চেষ্টা করে দেখল তার টেলিফোনটাও বিকল হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
এখন কী করা যায়?
নজীবউল্লাহ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি এত ভয় পেয়ে যাচ্ছ কেন?
না মানে–ইয়ে–তোমাকে তো বলেছি এদের দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে।
কেমন লাগলে হবে না। এখন এদেরকেই বলতে হবে সিকিউরিটিকে জানাতে।
নজীবউল্লাহ আবার বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর দিকে এগিয়ে গেল, একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছানোর পর শিশুগুলো নিজেদের কাজ বন্ধ করে সবাই একসাথে তাদের দিকে ঘুরে তাকাল।
কী ব্যাপার?
সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করে তাদের বলতে হবে দরজাটা খুলে দিতে। দরজাটা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।।
দরজাটা কোনো কারণে বন্ধ হয় নি–দরজাটা আমরা বন্ধ করে রেখেছি।
শরীফ আকন্দ আর নজীবউল্লাহ এক সাথে চমকে উঠল, নজীবউল্লাহ হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠে বলল, তোমরা দরজাটা বন্ধ করে রেখেছ? তোমরা!
হ্যাঁ। আমরা।
দুজন দুজনের দিকে বিস্তারিতভাবে তাকাল, তারপর ঘুরে আবার বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর দিকে তাকাল, তোমরা কীভাবে দরজা বন্ধ করলে?
মূল কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা অচল করে রেখেছি।
কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব?
সম্ভব। আমরা পারি।
অসম্ভব! এটি অসম্ভব।
না অসম্ভব নয়। আমরা বারোজন একসাথে অনুরণিত হই। আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা তিরিশগুণ বেশি। আমাদের সিন্সের সংখ্যা প্রতি নিউরনে এক হাজার গুণ বেশি। আমাদের যে–কোনো একজন তোমাদের একটি আলট্রা কম্পিউটার থেকে বেশি ক্ষমতাশালী।
নজীবউল্লাহ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমরা পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা অচল করে রেখেছ? এইজন্যে আমরা ফোন করতে পারছি না।
হ্যাঁ?
কেন?
তোমরা দুইজন বিশেষ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আমাদের সম্পর্কে তথ্য আমাদের আওতার বাইরে রেখেছ। আমরা জানতে চাই কেন?
শরীফ আকন্দ অনুভব করল সে কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে। নজীবউল্লাহর কনুই খামচে ধরে বলল, এখন কী হবে?
নজীবউল্লাহ শরীফ আকন্দের হাত সরিয়ে বিকলাঙ্গ শিশুগুলোকে বলল, এর কারণটি খুব সহজ। তোমাদের ওপর নির্ভর করে ক্রন কম্পিউটিং গড়ে উঠেছে। কাজেই তোমাদের নিরাপত্তা আমাদের জন্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে–তথ্যে তোমাদের প্রয়োজন নেই সেই তথ্য তোমাদের দেওয়া হচ্ছে না।
কিন্তু তুমি যে–সমস্যাটি দিয়েছিলে সেটি সমাধান করার জন্যেই তো আমাদের সেই তথ্যটির প্রয়োজন হয়েছিল।
কিন্তু– নজীবউল্লাহ ইতস্তত করে থেমে গেল। এরা সাধারণ শিশু নয়, এরা সাধারণ মানুষও নয়, এদেরকে মিথ্যা কথা বলে বা কুযুক্তি দিয়ে থামানোর কোনো উপায় নেই। এদেরকে সত্যি কথা বলতে হবে–সে ঘুরে শরীফ আকন্দের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এরা অসম্ভব বুদ্ধিমান, তুমি আমি ওদেরকে মিথ্যা কথা বলে পার পাব না।
তাহলে?
নজীবউল্লাহ মাথা চুলকে বলল, হয় সত্যি কথা বলতে হবে না হয়
না হয়?
চুপচাপ বসে থাকি। সিকিউরিটির মানুষ টের পেয়ে যখন আমাদেরকে বের করবে।
কিন্তু সেটা তো কঠিন। এখানে বাইরের কোনো সাহায্য নেওয়া যাবে না। এই দরজা–তুমিই বললে ডিনামাইট দিয়েও ভাঙা যাবে না।
নজীবউল্লাহ মাথা চুলকে বলল, তাহলে কী করা যায় বলো দেখি?
তুমিই বলো। এসব ব্যাপার তুমিই ভালো বোঝ।
সত্যি কথাটি বলে দিলেই হয়।
কোনো সমস্যা হবে না তো?
নজীবউল্লাহ মুখ বাঁকা করে বলল, সমস্যা হতে বাকি রইল কী?
তা ঠিক। শরীফ আকন্দ কপাল মুছে বলল, তুমি তাহলে কিছু–একটা বলো।
নজীবউল্লাহ এক পা এগিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, তোমাদের সম্পর্কে কিছু তথ্য তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে তার কারণ তোমরা মানুষ থেকে ভিন্ন। একজন মানুষের যে–তথ্য জানার অধিকার আছে তোমাদের সেই অধিকার নেই।
কেন?
কারণ জীববিজ্ঞানের ভাষায় তোমরা পরিপূর্ণ মানুষ নও। তোমাদের শরীরে দুটো ক্রমোজম কম। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তোমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র একটা মস্তিষ্ক হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই মস্তিষ্ককে কাজ করার জন্যে যেসব দরকার শুধুমাত্র সেসব রাখা হয়েছে–তার বাইরে কিছু নেই। তোমরা মানুষের মতো জন্ম নাও না। তোমাদেরকে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে ক্লোন করা হয়। তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরনকে সবসময় অতি উত্তেজিত অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। কাজেই তোমাদের বয়স দশ থেকে এগার হওয়ার মাঝেই তোমরা অকর্মণ্য হয়ে পড়।
তার মানে আমরা মানুষ নই?
না। মানুষের অনুভূতিও তোমাদের নেই। তোমাদের রাগ দুঃখ অপমান বা আনন্দের অনুভূতি অত্যন্ত দুর্বল–না–থাকার মতোই। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তোমাদের নিউরনের সংখ্যা এবং সিনান্সের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়াও তোমাদের একসাথে এক পরিবেশে ক্লোন করা হয়েছে। তোমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ ইলেকট্রড বসিয়ে তোমাদের বারোজনকে একসাথে অনুরণিত করা হয়–তোমাদের নিজস্ব বা ব্যক্তিগত অস্তিত্ব নেই। তোমরা সব সময়েই সমষ্টিগত প্রাণী। মানুষ থেকে ভিন্ন প্রাণী। মানুষের জন্যে এই পৃথিবীতে যে আইনকানুন বা অধিকার আছে সেই আইনকানুন বা অধিকার তোমাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। তোমরা নিজেরাই জান তোমরা দেখতেও মানুষের মতো নও।
বুঝতে পেরেছি। বিকলাঙ্গ শিশুগুলো খনখনে গলায় বলল, আমরা জৈবিক প্রাণী হলেও বিবর্তনের মূলধারায় আমরা নেই। আমাদের বিবর্তন হয় না।
তোমাদের বিবর্তন করা হয় ল্যাবরেটরিতে, বিজ্ঞানীরা করেন। তার নাম জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলো কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর নিজেদের ভিতরে নিচুস্বরে নিজস্ব ভাষায় কথা বলল, তারপর আবার ওকে দিকে ঘুরে তাকাল।
নজীবউল্লাহ বলল, আমি কি তোমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি?
তোমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব দিয়েছ। বাকি উত্তর আমাদের নিজেদের খুঁজে নিতে হবে।
সেগুলো কী?
মানুষের দেহ আমাদের দেহ থেকে কোনভাবে ভিন্ন। তাদের ভেতরে বাড়তি কী অঙ্গ রয়েছে। তাদের মস্তিষ্কের গঠন কী রকম। জননেন্দ্রিয় কীভাবে কাজ করে।
নজীবউল্লাহ চমকে উঠল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, তোমরা সেটা কীভাবে জানতে চাও?।
বারোটি বিকলাঙ্গ শিশু তাদের হাত একসাথে উঁচু করল, নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দ দেখল সেখানে একটি করে সার্জিক্যাল চাকু–কখন তারা হাতে নিয়েছে জানতেও পারে নি।
শরীফ আকন্দ কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর চিৎকার করে বলল, না। না–তোমরা এটা করতে পার না।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলো বলল, পারি। তোমরা নিজেরাই বলেছ আমরা মানুষ নই। মানুষের জন্যে যে আইনকানুন প্রযোজ্য আমাদের বেলায় সেই আইন প্রযোজ্য নয়।
নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দ অকল্পনীয় একধরনের আতঙ্কে দেখল বারোটি বিকলাঙ্গ শিশু হাতে ধারালো চাকু নিয়ে তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের কোনো অনুভূতি নেই, তাদের মুখে হাসি থাকার কথা নয় তবুও নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দের স্পষ্ট মনে হল এই শিশুগুলোর মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।