নাপিত পন্ডিত

বাগদাদ শহরে এক ধনীর ছেলে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল— সে কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিবে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, কাজটা তত সহজ নয়— সুতরাং কিছুদিন চেষ্টা করিয়াই সে বেচারা একেবারে হতাশ হইয়া পড়িল। দিনে আহার নাই, রাত্রে নিদ্রা নাই— তার কেবলই ঐ এক চিন্তা— কী করিয়া কাজীর মেয়েকে বিবাহ করা যায়।
বিবাহের সব চাইতে বড় বাধা কাজী সাহেব স্বয়ং। সকলেই বলে, “বাপু হে! কাজী সাহেব এ স্পর্ধার কথা জানতে পারলে তোমার একটি হাড় আস্ত রাখবেন না।” বেচারা কী করে? ক্রমাগত ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে রীতিমত জ্বর আনিয়া ফেলিল— বন্ধু-বান্ধব বলিতে লাগিল, “ছোকরা বাঁচলে হয়।” ইহার মধ্যে হঠাৎ একদিন এক বুড়ি আসিয়া খবর দিল, বিবাহের সমস্তই ঠিক। কাজী সাহেবকে না জানাইয়াই এখন চুপচাপ বিবাহটা হইয়া যাক— তারপর সুবিধামত তাঁহাকে খবর দেওয়া যাইবে; তখন তিনি গোল করিয়া করিবেন কি? সে আরও বলিল, “শুক্রবার সন্ধ্যার সময় কাজী সাহেব বাড়ি থাকবেন না— সেই সময় বিয়েটা সেরে ফেল— কিন্তু খবরদার! কাজীসাহেব যেন এসব কথার বিন্দুমাত্র জানতে না পারেন।”
শুক্রবার দিন ভোর না হইতে বর বেচারা হাত মুখ ধুইয়া প্রস্তুত, সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহার আর সবুর সয় না। দুপুর না হইতেই সে চাকরকে বলিল, “একতা নাপিত ডেকে আন্‌। এখন থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকি।” চাকর তাড়াতাড়ি কোথ হইতে এক নাপিত আনিয়া হাজির করিল।
নাপিত আসিয়াই বরকে বলিল, “আপনাকে বড় কাহিল দেখছি— যদি অনুমতি করেন ত’ ছুরি দিয়ে বাঁ হাতের একটুখানি রক্ত ছাড়িয়ে দিই— তা হলেই সমস্ত শরীরটা ঠান্ডা বোধ করবেন।” বর বলিল, “না হে, তোমাকে চিকিৎসার জন্য ডাকি নাই— আমার দাড়িতা একটু চট্‌পট্‌ কামিয়ে দাও দেখি।” নাপিত তখন তাহার সরঞ্জামের থলি খুলিয়া অনেকগুলা ক্ষুর বাহির করিল, তারপর প্রত্যেকটা ক্ষুর হাতে লইয়া বার বার পরীক্ষা করিতে লাগিল। এইরূপে অনেক সময় নষ্ট করিয়া সে একটা বাটির মত কী একটা বাহির করিল। বর ভাবিল, এইবার বাটিতে জল দিয়া কামান শুরু করিবে। কিন্তু নাপিত তাহার কিছুই করিল না; সে অদ্ভুত একটা কাঁটা-কম্পাসের মানযন্ত্র লইয়া ঘরের বাহিরে উঠানের মাঝখানে গিয়া, সূর্যের গতিবিধির কী সব হিসাব করিতে লাগিল। তারপর আবার গম্ভীরভাবে ঘরে আসিয়া বলিল, “মহাশয়, হিসাব ক’রে দেখলাম, এই বৎসর এই মাসে এই শুক্রবারের ঠিক এই সময়টি অতি চমৎকার শুভক্ষণ— দাড়ি কামাবার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আজ মঙ্গল বুধ গ্রহসংযোগ হওয়াতে আপনার কিছু বিপদের সম্ভাবনা দেখছি।”
কাজের সময় এরকম বক্‌বক্‌ কারিলে কাহার না রাগ হয়? বিবাহার্থী ছোকরাটি রাগিয়া বলিল, “বাপু হে, তোমাকে কি বক্তৃতা শোনাবার জন্য না জ্যোতিষ গণনার জন্য ডাকা হয়েছে? কামাতে এসেছ, কামিয়ে যাও।” কিন্তু নাপিত ছাড়িবার পাত্রই নয়, সে অভিমান করিয়া বলিল, “মশাই, এ রকম অন্যায় রাগ আপনার শোভা পায় না। আপনি জানেন আমি কে? আপনি কি জানেন যে বাগদাদ শহরে আমার মত দ্বিতীয় আর কেউ নাই? আমার গুণের কথা শুনবেন? আমি একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক, রসায়ন শাস্ত্রে আমার অসাধারণ দখল, আমার জ্যোতিষ গণনা একেবারে নির্ভুল, নীতিশাস্ত্র ব্যাকরণশাস্ত্র তর্কশাস্ত্র, এ সমস্তই আমার কণ্ঠস্থ, জ্যামিতি থেকে শুরু ক’রে বীজগণিত পাটিগণিত পর্যন্ত গণিতশাস্ত্রের কোন তত্ত্বি জানতে বাকি রাখি নি। তার উপর আবার আমি একজন পাকা দার্শনিক পণ্ডিত, আর আমি যে সকল কবিতা রচনা করি, সমঝদার লোকের মুখে তার সুখ্যাতি আর ধরে না।”— নাপিতের এই বক্তৃতার দৌড় দেখিয়া ছোকরাটি ভীষণ রাগের মধ্যেও হাসিয়া ফেলিল। সে বলিল, “তোমার বক্তৃতা শুনবার ফুরসৎ আমার নাই— তুমি কামান শেষ করবে কি না বল, না কর চলে যাও।” নাপিত বলিল, “এই কি আপনার উপযুক্ত কথা হল? আমি কি আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম, না আপনি নিজেই লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়েছিলেন? এখন আমি আপনাকে না কামিয়ে গেলে, আমার মান সম্ভ্রম থাকে কি ক’রে? আপনি সেদিনকার ছেলে, আপনি এসবের কদর বুঝবেন কি? আপনার বাবা যদি আজ থাকতেন তবে আমাকে ধন্য ধন্য বলতেন— কারণ তাঁর কাছে কোন দিনই আমার সম্মানের ত্রুটি হয়নি। আমার এ সকল আমূল্য উপদেশ শুনবার সৌভাগ্য সকলে পায় না— তিনি তা বেশ বুঝতেন। আহা, তিনি কী চমৎকার লোকই ছিলেন! আমার কথাগুলি কত আগ্রহ ক’রে তিনি শুনতেন! আর কত খাতির, কত তোয়াজ ক’রে কত অজস্র বকশিস্‌ দিয়ে তিনি আমায় খুসি রাখতেন। আপনি ত’ সে সব খবর রাখেন না।” এই রকম বক্তৃতায় সে আরও আধঘণ্টা সময় কাটাইয়া দিল। এদিকে বেলাও বাড়িতেছে, বিবাহের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে; কাজেই বর একেবারে সপ্তমে চড়িয়া বলিল, “যাও! যাও! তোমায় কামাতে হবে না।”
নাপিত তখন তাড়াতাড়ি ক্ষুর লইয়া কামাইতে শুরু করিল। কিন্তু ক্ষুরের দুই চার টান দিয়াই সে আবার থামিয়া বলিল, “মশাই! ওরকম রাগ করা ভাল নয়। ভেবে দেখুন, জ্ঞানে গুণে বয়সে সব বিষয়েই আপনি ছেলেমানুষ। তবে অবশ্যি, আপনার যে রকম তাড়া দেখছি, তাতে বোধহয় আপনি আজকে একটু বিশেষ ব্যস্ত আছেন। এ রকম ব্যস্ততার কারণটা কী জানতে পারলে, আমি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে ঠিক ভালমত ব্যবস্থা করতে পারি।” এই বলিয়াই সে আবার তাহার মানযন্ত্র লইয়া হিসাব করিতে লাগিল। যতই তাড়া দেওয়া যায়, ততই সে বলে, “এই হিসাবটা হল ব’লে।” তখন বেগিতিক দেখিয়া বর বলিল, “আরে, ব্যাপারটা কিছু নয়— আজ রাত্রে আমার এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে— তাই, বড় তাড়াতাড়ি।”
এই কথা শুনিবা মাত্র নাপিত একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল, “ভাগ্যিস্‌ মনে করিয়ে দিলেন! আমার বাড়িতেও যে আজ ছয়জন লোককে নেমন্তন্ন করে এসেছি! তাদের জন্য ত’ কোনরকম বন্দোবস্ত ক’রে আসি নি। এখন, মনে করুন, মাংস কিনতে হবে, রাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে, মিঠাই আনতে হবে;— কখন বা এসব করি, আর কখনই বা আপনাকে কামাই।” বর দেখিল আবার বেগতিক, সে নিরুপায় হইয়া বলিল, “দোহাই তোমার। আর আমায় ঘাঁটিও না— আমার চাকরকে বলে দিচ্ছি— তোমার যা কিছু চাই আমার ভাঁড়ার থেকে সমস্তই সে বা’র ক’রে দেবে— তার জন্য তুমি মিথ্যে ভেব না।” নাপিত বলিল, “এ অতি চমৎকার কথা। দেখুন, হামামের মালিশওয়ালা জান্তৌৎ— আর ঐ যে কড়াইশুঁটি বিক্রী করে, সালি— আর ঐ শিম বেচে, সালৌৎ— আর আখের শা তরকারিওয়ালা আর আবু মেকারেজ ভিস্তি আর পাহারাদার কাশেম— এরা সবাই ঠিক আমার মত আমুদে— এরা কখনও মুখ হাঁড়ি করে থাকে না; তাই এদের আমি নেমন্তন্ন করেছি। আর এদের একটা বিশেষ গুণ যে, এরা ঠিক আমারই মত চুপচাপ থাকে— বেশী বক্‌বক্‌ করতে ভাল বাসে না। এক একজন লোক থাকে তারা সব সময়েই বকর্‌ বকর্‌ করছে— আমি তাদের দু চক্ষে দেখতে পারি নে। এরা কেউ সেরকম নয়; তবে নাচতে আর গাইতে এরা সবাই ওস্তাদ। জান্তৌৎ কি রকম ক’রে নাচে দেখবেন? ঠিক এই রকম”— এই বলিয়া সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য ও বিকট সুরে গান করিতে লাগিল। কেবল তাহাই নয়, ঐ ছয়জন বন্ধুর মধ্যে প্রত্যেকে কি রকম করিয়া নাচে ও গায়, তাহার নকল দেখাইয়া তবে সে ছাড়িল। তারপর, হঠাৎ সে ক্ষুরটুর ফেলিয়া ভাঁড়ার ঘরে চাকরের কাছে তাহার নিমন্ত্রণের ফর্দ দিতে ছুটিল। বর ততক্ষণে আধ কামান অবস্থায় ক্ষেপিয়া পাগলের মত হইয়াছে, কিন্তু নাপিত তাহার কথায় কানও দেয় না। সে গম্ভীরভাবে ঘরের হাঁস মুরগী তরিতরকারি হালুয়া মিঠাই সব বাছিয়া বাছিয়া পছন্দ করিতে লাগিল। তারপর আরও অনেক গল্প আর অনেক উপদেশ শুনাইয়া অতি ধীর মেজাজে সাড়ে চার ঘণ্টায় সে তাহার কামান শেষ করিল। আবার যাইবার সময় বলিয়া গেল, “দেখুন, আমার মত এমন বিজ্ঞ, এমন শান্ত, এমন অল্পভাষী হিতৈষী বন্ধু আপনি পেয়েছেন, সেটা কেবল আপনার বাবার পুণ্যে। আজ হ’তে আমি আপনার কেনা হয়ে রইলুম।”
নাপিতের হাত হইতে উদ্ধার পাইয়া বর দেখিল, আর সময় নাই। সে তাড়াতাড়ি বিবাহ করিতে বাহির হইল। লোকজন সঙ্গে লইল না, এবং কাহাকেও খবর দিল না; পাছে কথাটা কোন গতিকে কাজী সাহেবের কাছে ফাঁস হইয়া যায়।
এদিকে নাপিতও কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকে নাই। সে কেবল ভাবিতেছে, “না জানি সে কি রকম নেমন্তন্ন, যার জন্য সে এমন ব্যস্ত, যে আমার ভাল ভাল কথাগুলো পর্যন্ত শুনতে চায় না। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।” সুতরাং বর যখন সন্ধ্যার সময় বাহির হইল, নাপিতও তাহার পিছন পিছন লুকাইয়া চলিল।
বর সাবধানে কাজীর বাড়ি হাজির হইয়া খবর লইল যে কাজীসাহেব বাড়িতে নাই; এদিকে সব আয়োজন প্রস্তুত— তাড়াতাড়ি বিবাহ সারিতে হইবে। দৈবাৎ যদি কাজীসাহেব আসিয়া পড়েন, তাহার জন্য ছাতের উপর পাহারা বসান হইল, তাঁহাকে আসিতে দেখিলেই সে চিৎকার করিয়া সঙ্কেত করিবে এবং বরকে খিড়কী দরজা দিয়া পলাইতে হইবে। এদিকে কিন্তু হতভাগা নাপিতটা বাড়ির বাহিরে থাকিয়া যে আসে তাহাকেই বলে, “তোমরা সাবধানে থেক— আমাদের মনিবটি কেন জানই এই কাজীর বাড়িতে ঢুকেছেন— তাঁর জন্য আমার বড় ভাবনা হচ্ছে।”
বিবাহ আরম্ভ না হইতেই মুখে মুখে এই খবর রটিয়া বাড়ির চারিদিকে ভীড় জমিয়া গেল— তাহা দেখিয়া ছাতের উপরে সেই পাহারাদার ব্যস্তভাবে ডাক দিয়া উঠিল। আর কোথা যায়! তাহার গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র “কে আছিস রে, আমার মনিবকে মেরে ফেললে রে” বলিয়া নাপিত “হায় হায়” শব্দে আপনার চুল দাড়ি ছিঁড়িতে লাগিল। তাহার বিকট আর্তনাদে চারিদিকে এমন হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে স্বয়ং কাজীসাহেব পর্যন্ত গোলমাল শুনিয়া বাড়ি ছুটিয়া আসিলেন। সকলেই বলে ব্যাপার কি? নাপিত বলিল, “আর ব্যাপার কী! ঐ লক্ষ্মীছাড়া কাজী নিশ্চয়ই আমার মনিবকে মেরে ফেলেছে।” তখন মার মার করিয়া সকলে কাজীর বাড়িতে ঢুকিল। বর বেচারা পলাইবার পথ না পাইয়া, ভয়ে ও লজ্জায় একটা সিন্দুকের মধ্যে লুকাইয়া ছিল, নাপিত সেই হাজার লোকের মাঝখানে সিন্দুকের ভিতর হইতে “এই যে আমার মনিব” বলিয়া তাহাকে টানিয়া বাহির করিল। সে বেচারা এই অপমানে লজ্জিত হইয়া যতই সেখান হইতে ছুটিয়া পলাইতে যায়, নাপিত ততই তাহার পিছন পিছন ছুটিতে থাকে আর বলে, “আরে মশাই, পালান কেন? কাজীসাহেবকে ভয় কিসের? আরে মশাই, থামুন না।” ব্যাপার দেখিয়া চারিদিকে লোকজন হাসাহাসি ঠাট্টা তামাসা করিতে লাগিল। কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিতে গিয়া, বিবাহ ত’ হইলই না, মাঝে হইতে প্রাণপণে দৌড়াইতে গিয়া, হোঁচট খাইয়া বরের একটা ঠ্যাং খোঁড়া হইয়া গেল। এখানেও তাহার দুর্দশার শেষ নয়, নাপিতটা সহরের হাটে বাজারে সর্বত্র বাহাদুরি করিয়া বলিতে লাগিল, “দেখেছ? ওকে কি রকম বাঁচিয়ে দিলাম। সেদিন আমি না থাকলে কি কাণ্ডই না হ’ত। কাজীসাহেব যে রকম খ্যাপা মেজাজের লোক, কখন কী ক’রে বসত কে জানে। যা হোক, খুব বাঁচিয়ে দিয়েছি।” যে আসে তাহার কাছেই সে এই গল্প জুড়িয়া দেয়।
ক্রমে ছোকরাটির অবস্থা এমন হইল যে, সে কাহাকেও আর মুখ দেখাইতে পারে না— যাহার সঙ্গে দেখা হয় সেই জিজ্ঞাসা করে, “ভাই, কাজীর বাড়িতে তোমার কি হয়েছিল? শুনলাম ঐ নাপিত না থাকলে তুমি নাকি ভারি বিপদে পড়তে।” শেষটায় একদিন অন্ধকার রাত্রে বেচারা বাড়িঘর ছাড়িয়া বাগদাদ সহর হইতে পলাইল, এবং যাইবার সময় প্রতিজ্ঞা করিয়া গেল, “এমন দূর দেশে পলাইব, যেখানে ঐ হতভাগা নাপিতের মুখ দেখিবার আর কোন সম্ভাবনা না থাকে।”