নাটিকা

DRAMATIS PERSONÆ

রামধন-রামকৃষ্ণ-কলাবতী-দিবা-নিশা

প্রথম অঙ্ক
SCENE I

প্রতাপনগরের রাজবর্ত্ম

রামধন-রামকৃষ্ণ

রামধন। কিসের এত গোল?
[নেপথ্যে বহু লোকে “জয় জয় কলাবতী”]
ও কিসের জয়ধ্বনি?
রামকৃষ্ণ। জান না রাণী কলাবতী স্নান করিয়া যাইতেছেন।
রামধন। রাণী স্নান করিয়া যাইতেছেন, তার এত জয়ধ্বনি কেন?
[নেপথ্যে “জয় জয় রাণীজিকি জয়”]
ঐ শুন।
রামকৃষ্ণ। তুমি বিদেশী তাই অবাক্ হইতেছ। রাণী কলাবতীকে এ নগরের লোক বড় ভক্তি করে। বড়ই ভালবাসে।
রামধন। কেন রাণীর কিছু বিশেষ গুণ আছে?
রামকৃষ্ণ। তা আছে-রাণী অতিশয় দানশীলা আর বড় প্রজাবৎসলা। যার যে দুঃখ থাকে, রাণীকে জানাইতে পারিলেই-হইল-তার দুঃখ ঘুচিবে।
[নেপথ্যে “জয় জয় মা কলাবতীর জয়”]
ঐ শোন সকলেই রাণীকে মা বলিতেছে, তিনি প্রজামাত্রেরই মা’র মত। তাঁর গুণেই এখানকার প্রজারা এত সুখী।
রামধন। বটে! তবে রাজার এত সুখ্যাতি কেন?
রামকৃষ্ণ। রাণীর গুণে।
রামধন। তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কি প্রাচীনা।
রামকৃষ্ণ। না, তিনি বড় অল্পবয়স্কা তবে সকলের মা বলিয়া সকলকেই দেখা দেন। চল না আমরা মাতৃ-দর্শনে যাই।
রামধন। চল।
উভয়ে নিষ্ক্রান্ত

SCENE II
রাজার অন্তঃপুর
রাজা রাজেন্দ্র একা
রাজা। কে না জানে আকাশে মেঘ উঠে? তবে কেন এত ভাবি-মেঘ উঠে মেঘ ছাড়ে। এ মেঘও উড়িয়া যাইবে-তবে কেন এত চিন্তা করি? মনে করিয়াছিলাম এ নির্ম্মল আকাশে কখনও বুঝি মেঘ উঠিবে না, আমি মূর্খ তাই এত ভাবি। হায়! কোথা হইতে আবার এ প্রবল শত্রু দেখা দিল?
(কলাবতীর সজ্জিতা সখীদিগের প্রবেশ)
তোরা কেন গো? এত সাজগোজ যে।
‍দিবা। আমরা নাচব।
রাজা। খানখা নাচবে কেন গো?
নিশা। রাণী কলাবতীর হুকুম। [নৃত্য আরম্ভ]
রাজা। কেন নাচের হুকুম কেন?
দিবা। আগে নাচি। [নৃত্য]
রাজা। আগে বল্।
নিশা। আগে নাচি।
রাজা। আ মর! তোর পা যে থামে না-জোর করে নেচে যাবি নাকি-আমি দেখিব না-এই চোক বুজিলাম। [চোখ বুজিয়া]
দিবা। দেখুন মহারাজ! আপনাকে মুখ ভেঙ্গাচ্চে।
নিশা। দেখুন মহারাজ, আপনাকে কলা দেখাচ্চে।
রাজা। মরগে যা তোরা! আমি চোক চাব না।
নিশা। আচ্ছা কান তো খোলা আছে।
(করতালি দিয়া গীত)
নয়ন মুদিয়া, দেখিনু সজনী,
কানুর কুটিল রূপ।
গলেতে বাঁধিয়া পিরীতি কলসী
সাগরে দিনু যে ডুব।
রাজা। শুনবো না। [কর্ণে হস্তার্পণ]
দিবা। তবে ফুলের ঘ্রাণ নিন।
(কবরী হইতে পুষ্প লইয়া রাজার নাসিকার নিকট ধারণ)
রাজা। নিঃশ্বাস বন্ধ করিলাম।
নিশা। চক্ষু কর্ণ নাসিকা বন্ধ। রসনা বাকি আছে-চল ভাই রান্নামহলে খবর দিই।
রাজা। মুখ বুজিয়া থাকিব।
নিশা। তবে বড় মা ঠাকুরাণীকে ডেকে দিই।
রাজা। কেন সে ভয়ঙ্কর ব্যাপার কেন?
নিশা। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আপনার বাকি আছে পিঠের চামড়া।
(কলাবতীর প্রবেশ)
কলা। আ মলো, তোরা বড় বাড়ালি, দূর হ!
[সখীদ্বয় নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। দেখত কলাবতী, তোমার লোকজন আমায় কিছু মানে না, আমার উপর বড় অত্যাচার করে!
কলা। কি অত্যাচার করেছে মহারাজ? একটু হাসিয়াছে? সেটা আমারই অপরাধ। তোমার মুখে কয় দিন হাসি দেখি নাই বলিয়া আমি ওদের পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।
রাজা। আমার মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে-আমি হাসিব কি?
কলা। কি পাহাড় মহারাজ! আমায় ত কিছু বল নাই। যা ইচ্ছা করিয়া বল না-তা সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করি না। কি পাহাড় মহারাজ! পড়িলে তোমার একার ঘাড়ে পড়িবে না।
রাজা। পাহাড় আর কিছু নয়-খোদ দিল্লীশ্বর ঔরঙ্গজেব। এই ক্ষুদ্র রাজ্যের উপর নজর পড়িয়াছে, বাদশাহের যাহাতে নজর পড়ে তাহা তিনি না লইয়া ছাড়েন না।
কলা। এ সম্বাদ কোথা পাইলেন?
রাজা। আত্মীয়লোকে দূতমুখে বলিয়া পাঠাইয়াছে। বিশেষ, ঢাকায় সুবাদার অনেক সৈন্য জমা করিতেছেন। লোকে বলে প্রতাপনগরের জন্য।
কলা। কেন আমরা কি অপরাধ করিয়াছি?
রাজা। অপরাধ বিস্তর। প্রতাপনগর ধনধান্য পূর্ণ-লোক এখানে দারিদ্র্যশূন্য- আর আমরা হিন্দু! হিন্দুর ঐশ্বর্য্য বাদশাহের চক্ষুশূল।
কলা। যদি এ সম্বাদ সত্য হয়, তবে আমরাও যুদ্ধের উদ্যোগ না করি কেন?
রাজা। তুমি পাগল! দিল্লীশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ কি আমার সাধ্য! জয় কি হইবে?
কলা। না, তবে বিনা যুদ্ধে মরিব কেন?
রাজা। দেখি যদি বিনা যুদ্ধে কার্য্যোদ্ধার হয়। আমার ইচ্ছা একবার ঢাকায় যাই। আপনি সুবাদারের মন বুঝি, কোন ছলে যদি বশীভূত করিতে পারি করি।
কলা। এমন কর্ম্ম করিও না-ঔরঙ্গজেবের নায়েবকে বিশ্বাস কি? আর আসিতে দিবে না।
রাজা। সম্ভব-কিন্তু তাহাতে তাহার লাভ হইবে কি?
কলা। রাজহীন রাজ্য সহজে হস্তগত করিবে।
রাজা। আমি গেলে তুমি রাজ্যের রক্ষক থাকিবে।
কলা। ছি! স্ত্রীলোকের বাহুতে বল কিরাজা। এখানে বাহুবলের কাজ নয়। বুদ্ধিবলই ভরসা। প্রতাপনগরে বুদ্ধিবল তুমি একা।
কলা। মহারাজ, আপনাকে যাইতে দিতে আমার মন সরিতেছে না।
রাজা। থাকিলেই কোন মঙ্গল! যুদ্ধেই কোন মঙ্গল!
কলা। মারহাট্টা যুদ্ধ করিতেছে-আমরা কি মানুষ নই?
রাজা। না, আমরা মানুষ নই। শিবাজীর কাজ কি আমার দ্বারা সম্ভবে? আমি যাওয়াই স্থির করিতেছি। এখন শয়নঘরে চলিলাম।
[নিষ্ক্রান্ত]
কলাবতী। (স্বগত) বিধাতা, যদি আমায় স্ত্রীলোক করিয়াছিলে তবে আমায়- দূর হৌক সে কথায় এখন আর কাজ কি? হায়! আমি রাণী কিন্তু রাজা কই? রাজা অভাবে প্রতাপনগর রক্ষা হইবে না। হায়! রাণী হইলাম ত রাজা পাইলাম না কেন?
(দিবার প্রবেশ)
(চক্ষু মুছিয়া) কি লো দিবি?
দিবা। এই কাগজটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি। [এক পত্র দিল]
কলা। (পড়িলেন) “আমি রাজা রাজেন্দ্রের আজিও প্রবল শত্রু-প্রতাপনগর ধ্বংস করিয়া তোমাকে গ্রহণ করিব। নইলে ভালোয় ভালোয় এসো।”
এ পত্র কোথায় পাইলি?
দিবা। আজ্ঞে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি।
কলা। তোকে ফাঁসি দিব। আবশ্যক হইলে আমি হুকুম দিই, তা তুই জানিস?
দিবা-জানি-তা আমি কুড়িয়ে না পেলুম তা কোথা পেলুম?
কলা। কোথা পেলি? তুই হাতে হাতে নিয়েছিস!
দিবা। মাইরি রাণীমা, আমি হাতে হাতে নিই নে।
কলা। তবে কোথায় পেলি বল, নইলে ফাঁসি দিব।
দিবা। আমি পায়রার গলায় পেয়েছি।
কলা। সে পায়রা কোথায়?
দিবা। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি।
কলা। কালি কলম নিয়ে আয়-জবাব লেখ্।
দিবা। কালি কলম আছে-কি লিখিব।
কলা। লেখ্, “আমি তোমার পরম শত্রু-তোমায় ধ্বংস করিয়া প্রতাপনগর রক্ষা করিব।” লেখা হইল?
দিবা। লিখেছি-পায়রার গলায় বেঁধে দিয়ে আসি?
কলা। দে গিয়ে।
দিবা। হাঁ রাণীমা এ কে মা-
কলা। চুপ! কথা মুখে আনিলে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দিব। [দিবা নিষ্ক্রান্ত]
কলা। পায়ে কাঁটা ফুটিলে কাঁটা দিয়ে বাহির করিতে হয়, বুঝি আমাকে তাহাই করিতে হইবে।

SCENE III
রাজার অন্তঃপুর
দিবা-নিশা
দিবা। রাজা ঢাকায় চলিল কেন ভাই?
নিশা। তোর জন্য ঢাকাই কাপড় আন্‌তে।
দিবা। আমি ত এমন হুকুম দিই নে, আমার যে ঢাকাই কাপড় আছে।
নিশা। তবে তোর বর আন্‌তে।
দিবা। কেন এ দেশে কি বর পাওয়া যায় না?
নিশা। এ দেশে তেমন দাড়ি পাওয়া যায় না-তোমাকে একটা নেড়ে বর এনে দেবে।
দিবা। তা তার জন্য আর রাজার নিজে যাবার দরকার কি? আমায় বললে আমি একটা খুঁজে পেতে নিতুম। না হয় গোবিন্দ বখশীকে একটা পরচুলো দাড়ি পরিয়ে ঘরে নিয়ে আসতুম।
নিশা। আচ্ছা, বখশী মশাইকে বলে রাখ্‌ব।
দিবা। দূর হ পাপিষ্ট-তোর কাছে কোন কথাই বলবার যো নাই। তা যাক্- সত্য সত্য রাজা ঢাকায় চলল কেন?
নিশা। কি জানি কেন-রাজা রাজড়ার মন তুমি আমি কি বুঝ্‌ব।
দিবা। তা, রাজা কি ফিরিবে না কি?
নিশা। সে কি কথা? অমন কথা মুখে আনতে আছে! দিবা। রাণী কলাবতী অত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে কেন?
নিশা। স্বামী বিদেশে গেলে একটু কাঁদ্‌তে হয়।
দিবা। দূর! স্বামী ছেড়ে স্বামীর বাবার জন্য আমি কাঁদি নে।
নিশা। তোর সাত পুরুষের ভিতর স্বামী নাই, তুই আবার কাঁদবি কার জন্য? বরং রাজার জন্য একটু কাঁদিস ত কাঁদ।
দিবা। না ভাই তা পারিব না। বরং মনের দুঃখে বসে বসে লুচি মণ্ডা খাই গে চল।
নিশা। তাও মন্দ নয়।

দ্বিতীয়াঙ্ক
SCENE I
সুবাদার-রাজা
রাজা। আমার কি অপরাধ? কি জন্য দিল্লীশ্বর আমার উপর পীড়ন করিতে উদ্যত?
সুবা। আপনি মুসলমানের দ্বেষক। বাদশাহ মুসলমানের ধর্ম্মরক্ষক। সুতরাং বাদশাহ-
রাজা। আমি কিসের মুসলমানের দ্বেষক? আমার রাজ্যে হিন্দু মুসলমান তুল্য-
সুবা। প্রতাপনগরে একটি মসজীদ নাই-মুসলমানে নমাজ করিতে পায় না।
রাজা। আমি মসজীদ প্রস্তুত করিয়া দিব।
সুবা। প্রতাপনগরে একটি কাজি নাই-মুসলমানের বিচার কি হিন্দুর কাছে হয়?
রাজা। আমি কাজি নিযুক্ত করিব।
সুবা। মহারাজ-আপনি যদি বাদশাহের এরূপ বশ্যতাপন্ন হন, তবে বাদশাহ কেন আপনাকে রাজ্যচ্যুত করিবেন? কিন্তু আসল কথা এখনও বাকি আছে- প্রতাপনগরে মুসলমানে জবাই করিতে পায় না-তার কি হইবে?
রাজা। গোরু ভিন্ন অন্য জবাইয়ে আপত্তি করিব না।
সুবা। কিন্তু গোরুই আসল কথা।
রাজা। হিন্দু হইয়া গোহত্যা করিতে দিব কি প্রকারে?
সুবা। তবে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করুন।
রাজা। ধর্ম্মত্যাগ করিব? ইহকাল পরকাল খোয়াইব? এ কথাও কানে শুনিতে হইল।
সুবা। ইহকাল নষ্ট হইবে না। আপনি ইসলামের ধর্ম্ম গ্রহণ করিলে বরং ইহকালে সুখী হইবেন। রাজ্য বজায় থাকিবে এবং আরও বাড়াইয়া দিব। আর পরকালও যাইবে না। ইসলামই সত্য ধর্ম্ম-দেখুন কত বড় বড় হিন্দু এখন মুসলমান হইতেছে। তাহারা কি না বুঝিয়া ধর্ম্মত্যাগ করিতেছে? বরং আপনার যদি সন্দেহ থাকে, তবে আমি ভাল ভাল মোল্লামুফ্‌তি আপনার কাছে পাঠাইয়া দিতেছি। তাহাদের সঙ্গে বিচার করুন-বিচারে যদি ইসলাম সত্য ধর্ম্ম বলিয়া বোধ হয়, তবে গ্রহণ করিবেন ত?
রাজা। ইচ্ছা হয় মোল্লা মুফ্‌তি পাঠাইবেন। কিন্তু কিছু ফলোদয় সম্ভাবনা নাই। সম্প্রতি আমি যাহা নিবেদন করিলাম, অনুগ্রহ করিয়া বাদশাহের নিকট জানাইবেন। গোহত্যা ভিন্ন আর সকলেই আমি সম্মত-বার্ষিক কর দিতেও সম্মত। আজ আমি বিদায় হইব-যে হুকুম হয় অনুগ্রহ করিয়া জানাইবেন।
সুবা। কোথা যাইবেন?
রাজা। অনেক দিন আসিয়াছি, স্বদেশে যাইব।
সুবা। সে কি? আপনার শুভাগমনের সম্বাদ আমি দিল্লীতে এত্তেলা করিয়াছি। সেখান হইতে খেলওয়াত আসিবে-তাহা না গ্রহণ করিয়া কি যাওয়া হয়।
রাজা। বড় অনুগৃহীত হইতেছি কিন্তু আমার অবর্ত্তমানে রাজ্য বিশৃঙ্খল হইতেছে।
সুবা। নাচার-আপনাকে অবশ্য অপেক্ষা করিতে হইতেছে। আপনার ফৌজ সকল বিদায় দিন।
রাজা। সে কি আমাকে কয়েদ রাখিতে চাহেন?
সুবা। ও সব কথা কেন? তবে দিনকত আপনাকে এখানে থাকিতে হইবে। দিল্লীর হুকুম না আসিলে ছেড়ে দিতে পারিব না।
রাজা। (স্বগত) হায়! কলাবতী তুমি যা বলিয়াছিলে তাহাই হইল। (সুবাদারকে) যাহা হুকুম হয় তাহাই তামিল করিব।
সুবা। তছলীম। [সুবাদার নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। কয়েদই ত হইলাম। প্রমথ-প্রমথ
(প্রমথের প্রবেশ)
আমার আজকাল ফিরিয়া যাওয়া হইতেছে না, তুমি প্রতাপনগরে এই সম্বাদ লইয়া যাও।
প্রমথ। যাইব কি প্রকারে? সকল পথে পাহারা-আমাদের কয়েদ করিয়াছে।
রাজা। আমার শিপাহী সব কোথা?
প্রমথ। নবাবের লোকে তাহাদের হাতিয়ার কাড়িয়া লইয়াছে-তাহাদিগকে প্রতাপনগরে ফিরিয়া যাইবার হুকুম হইয়াছে।
রাজা। ভাল, তাহারাই গিয়া সম্বাদ দিবে।
প্রমথ। দিলেই বা কি হইবে।

SCENE II
কলাবতী-নিশা
কলা। আজ একুশ দিন হইল মহারাজ ঢাকায় গিয়াছেন, আজও কই কোন সম্বাদ ত পাইলাম না।
নিশা। হাঁ রাণীমা, রাজরাণীতেও কি এমনি কর্র্যে দিন গণে?
কলা। কই আমি দিন গণিলাম?
নিশা। কাঁদ কেন মা, আমি ত এমন কিছু বলি নাই।
কলা। নিশা, তুই একবার শহরের ভিতর একটা শিয়ানা লোক পাঠাইতে পারিস্-অবশ্য কেহ কোন সম্বাদ শুনিয়াছে, কেন না ঢাকায় ঢের লোক যায় আসে। আমি এত লোক পাঠাইলাম, কেহ ত ফিরিল না। বোধ হয়, মন্দ সম্বাদই আসিয়াছে-লোকে সাহস করিয়া আমার সাক্ষাতে বলিতে পারিতেছে না।
নিশা। আপনাকে ব্যস্ত দেখিয়া আমি আপনার বুদ্ধিতেই শহরে অনুসন্ধান করিতে লোক পাঠাইয়া দিলাম-কিন্তু-
কলা। কিন্তু কি?
নিশা। লোকে বলে যে মহারাজকে সুবাদার আটক করেছে-অমন কর কেন মা! এই জন্য ত বলি নাই। একটু শোও আমি বাতাস করি। উড়ো কথায় বিশ্বাস কি?
কলা। বিশ্বাস সম্পূর্ণ। আমি আগেই বলিয়াছিলাম যে গেলে তাঁকে আটক করিবে। নিশি! এখন আমার দশা কি হইবে! (রোদন)
নিশা। কাঁদিলে কি হবে মা। আমাদের সকলেরই ত এক দশা হইবে। আমরাও নিরাশ্রয় হইলাম-এখন মুসলমানের হাতে জাতি মান প্রাণ সব যাবে।
কলা। কি বলিলি সবার এক দশা? তোদের যে রাজা মাত্র-আমার যে স্বামী। তুই কি জানিস স্বামী কি ধন!
নিশা। তা বটে। রাজ্য যায় তবু প্রাণটা থাকিলে আমরা বজায় থাকিব। ভাল মা, এক কাজ কর না কেন? রাজার কাছে কেন লোক পাঠাও না যে সুবাদারকে রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া আসুন-আমরা না হয় তাঁকে গহনা পত্র বিক্রয় করিয়া খাওয়াইব। কাঁদ কেন মা এ কথায়?
কলা। তুই কেন আমায় অপমান করিস্? কি! আমার স্বামীকে আমি রাজ্যত্যাগ করিয়া প্রাণ বাঁচাইতে বলিব! নিশা-তোদের ভয় হইয়া থাকে তোরা চলিয়া যা-আমার স্বামী রাজা-তিনি রাজার কাজ করিবেন।-কিসের গোল ঐ?
[নেপথ্যে বহু লোক “জয় মা কলাবতীর জয়”]
আজিকার দিনে কে বলে কলাবতীর জয়?
(দিবার প্রবেশ)
দিবা। মহারাণী! নগরের সকল প্রজা আসিয়া রাজবাড়ী ঘেরিল।
কলা। কি হয়েছে?
দিবা। সকলে বলিতেছে ঢাকার সুবাদার রাজাকে কয়েদ করিয়াছে।
কলা। তার পর প্রজারা কি বলে। [নেপথ্যে “মহারাণী কলাবতীর জয়”] ওরা কি চায় দিবা?
দিবা। আপনি স্বকর্ণে শুনুন।
কলা। প্রজারা আমার পুত্র, আমার [নিকট] অবারিতদ্বার। প্রধানদিগকে আমার কাছে ডাকিয়া আন।
(দিবার প্রস্থান। কতিপয় নগরবাসীর সহিত পুনঃপ্রবেশ)
প্রজাবর্গ। জয় কলাবতীর জয়।
কলা। কি চাও বাবা তোমরা?
১ম প্রজা। মা, আমাদের রাজা কোথায়?
২য় প্রজা। মা, আমাদের রাজাকে নাকি দুষ্ট যবন কয়েদ করিয়াছে? মা, আমাদের বাহুতে কি বল নাই যে বাপের উদ্ধার করি? -বঙ্কিম-কণিকা, পৃ,১- ২২।